শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 9
॥ নয় ॥
কুষ্টিয়া থেকে সদাকর্মী ননীগোপাল সরকার এসেছেন দেওঘর-আশ্রমে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন হিমাইতপুরের তোয়েব হোসেনকে।
ঠাকুর তোয়েব ও ননী সরকারকে আদর করে বসালেন, বসিয়ে ননী সরকারকে বললেন, 'তুমি তো পুরণো মানুষ, দেখো-তোয়েবের যেন কোন অসুবিধে না হয়।'
ওদের বসিয়েই বললেন, 'মানুষের ঈশ্বর একজনই। প্রেরিত মানেই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাঁদের সকলের কথাই এক। এক উদ্দেশ্যেই ওঁরা আসেন। ধর্মপ্রাণ মানুষ যে-সম্প্রদায়ভুক্তই হোক না কেন, তারা ঈশ্বর এবং তাঁর প্রেরিত পুরুষদের অনুমোদিত পথে চলে।'
আরও বললেন, 'হিন্দু যদি প্রকৃত হিন্দু হয় এবং মুসলমান যদি প্রকৃত মুসলমান হয়, তবে তাদের মধ্যে কোন প্রভেদ থাকে না। ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের চলার পথ একটাই। সে পথ ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষদের প্রদর্শিত পথ।'
'দুজন প্রেরিত পুরুষের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। তাঁরা পরস্পরের স্বার্থকে পূরণ করে চলেন। তিনি যে-মতাবলম্বীর প্রতিনিধিই হোন না কেন।'
আরও একটি বিপ্লবাত্মক কথা বললেন এই প্রসঙ্গে। বললেন, 'আমি হিন্দু নাম নিয়ে হিন্দু পরিচয়েই ইসলামের বিধিগুলি যদি পালন করে চলি, তাতে কি কারও আপত্তি থাকতে পারে? কোন কোন তরফ থেকে হয়তো বলা হবে, আমি কোন মোল্লার কাছে কলমা পড়ে মুসলমান হচ্ছি না- কেন আরবী ভাষায় ঈশ্বরের স্তুতিপাঠ করছি না? আমি ভারত ভূমির একজন হিন্দু-সন্তান থেকেই পিতা-পিতামহের পরিচয় বজায় রেখে এবং ভারতীয় ভাষায় কেন আল্লাতালার অর্থাৎ ঈশ্বরের স্তুতি করতে পারবো না? আল্লাকে ও তাঁর নবী অর্থাৎ প্রেরিতকে মানলে আমার জাত ত্যাগ করতে হবে কেন? আমার গোত্র বংশ সব ভুলে নতুন নাম ও পদবী নিয়ে নতুনভাবে পরিচিত হতে হবে কেন? খোদাতালা এবং তাঁর পয়গম্বরদের মানতে চাইলে আমার অনুকূল চক্রবর্তী নাম পরিত্যাগ করে অন্য নাম নিতে হবে কেন?'
আর সকল মতের সমতা স্বীকার করে নিলে সব মতাবলম্বীরা যদি কোন ব্যক্তিকে নিয়ে নিজের দলে ঢুকিয়ে নিবার জন্যে টানাটানি করে, তবে লোকটার অবস্থা হবে কেমন? তাকে তো আর অখণ্ড রাখাই যাবে না, টুকরো টুকরো করে এক এক অংশ এক এক মতের মধ্যে ফেলতে হবে। সব অবাস্তব কথা।
'পরম পুরুষের পথে চলতে গিয়ে আমি হিন্দু থাকতে পারবো না কেন? আমার পিতৃপুরুষের পরিচয় খোয়াতে হবে কেন?'
আরও বললেন, 'আমার এই সৎসঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ইত্যাদি সকল মতাবলম্বীরই প্রতিষ্ঠান। এখানে এসে তারা নিজ নিজ ধর্মমতে অবিচল থেকেই তাদের মধ্যেকার ঐক্যটা বুঝতে শিখবে এবং বাঁচা ও বাড়ার একটা পথই সংঘবদ্ধভাবে মেনে চলবে। তাতেই তো সকল মতবিরোধ ঘুচবে এবং মানুষ ঐক্যের পথ খুঁজে পাবে।'
এক ভক্ত জিজ্ঞেস করলেন, 'খৃষ্টানদের মধ্যেও কি আদিনাম বা বীজনাম-সাধনার কথা আছে?'
'হ্যাঁ- খুবই ছিল। বাইবেলেই আছে-আদিতে বাক্ ছিলেন, বাক্ ঈশ্বরের কাছে ছিলেন এবং ঐ বাই হলেন ঈশ্বর।' তাই ঈশ্বর-সাধনা করতে গেলে আদিধ্বনি বা বীজনামের কথা এসে পড়ে।
আবার বলা আছে, নাম ও নামী এক। পশ্চিম ভারতের সৎসঙ্গ দরবার থেকে সৎসঙ্গের প্রখ্যাত দ্বিতীয়গুরু শ্রীশ্রীহুজুরমহারাজ তাঁর বহু পরিচিত বাণীগ্রন্থে পরিষ্কার জানিয়েছেন- আদি নাম এবং পরমপুরুষ মূলতঃ অভিন্ন। ভক্তিবাদ প্রসঙ্গে বলেছেন, পরমপুরুষকে বাদ দিয়ে কিন্তু নাম-সাধনা করা যায় না। ধর্মাচরণের পথে প্রথম কথাই হলো, আদিপুরুষে বিশ্বাস স্থাপন করে আদি ধ্বনির ভজন করা। ভক্তি-মার্গ বাদ দিয়ে যন্ত্রের মতো নামোচ্চারণ করে চললে মুক্তি আসতে পারে না। আর মুক্তি কথার মানেই করেছেন পরমধামে শেষ গতি হওয়া। পরমপুরুষকে তাঁরা বলেছেন- পরমপিতা। নামধামে আদিধ্বনি ও পরমপিতার উপস্থিতি সম্পর্কে হুজুর মহারাজের চিত্রকল্প বর্ণনাটি কেমন মনোরম। বলেছেন, সেই পরমধামে স্বর্ণসিংহাসনে উপবিষ্ট পরমপিতা- তাঁর চরণযুগল থেকে বিনিসৃত হচ্ছে আদিধ্বনি- এই চিত্রের মধ্য দিয়ে বুঝে দেখা দরকার, নামরূপী নামীকে কত উচ্চস্থানে স্থাপিত করা হয়। ঐ নামরূপী আকার বিশিষ্ট পরমপিতাকে ভালোবেসে নামধামে গত হওয়ার প্রয়াসের কথা বলা হয়েছে সন্ত-নীতিতে। আগে সর্ববীজাত্মক নামস্রষ্টা পরমপিতার প্রতি ভক্তি ও প্রেমের চর্চা করে তাঁর সাকার নরবিগ্রহের স্মরণ নিয়ে গুরুগত হয়ে সাধন-ভজন করলে তবে ফলোদয়ের আশা করা যায়।
একবারে খড়গ'র মতো ধারালো সোজা কথা। ভক্তি এবং গুরুবাদকে বাদ দিয়ে আদি ধ্বনির সাধন করে কোনই ফল লাভ করা যায় না। সন্তমত তাই মূলতঃ গুরুভক্তি ও গুরু-করুণার কথাই প্রচার করেছে। সকল মতের ধর্মচর্চার মূল কথা এইটাই। নরদেহধারী জীবন্ত নামরূপী ইষ্টপুরুষকে গ্রহণ করো- তাকে ভালোবেসে তাঁর আদেশপালনে তৎপর হও-নাম তোমার কাছে আপনিই ধরা দেবেন এবং তুমি দয়ালধামের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করবে।✅
10