Topic & Pag no 👇
- শ্রীশ্রীঠাকুরের লোকসেবার ধরণ-৮৩
- পুরুষোত্তমের সেবক না হ'লে মানুষ কাপুরুষ থাকে-৮৪
- ভালবাসার স্বরূপ- ৮৪
- মানুষের উপাস্য পুরুষোত্তম-৮৪
- শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মবোধ- ৮৪
- কর্ম্মে' 'অনুসন্ধিৎসার স্থান-৮৫
- প্রাণের ঠাকুর-৮৫
- ইষ্টার্থী কর্ম-সম্পাদনের কৌশল-৮৬
- নামধ্যান করা হ'চ্ছে কিনা তার পরখ-৮৬
- বনত বনত বনি যাই' ঢিলে চরিত্রের কথা ৮৬
- ইষ্টহীন সংসার অসার-৮৭
- মায়ামুক্ত হওয়া মানে-৮৭
- শঙ্করাচার্য্য-৮৭
- শ্রদ্ধা-৮৭
- শ্রীশ্রীঠাকুরের রহস্যপ্রিয়তা-৮৮
- সন্তান ভাল হওয়ার মূলে- ৮৮
[P 83-89]
২ রা মাঘ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৬।১৪।২ )
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে নিভৃতনিবাসে বিছানায় বসে আছেন দক্ষিণাস্য হ'য়ে । চশমা চোখে দিয়ে নিবিষ্টমনে নাদকারণীর ইন্ডিয়ান মেটিরিয়া মেডিকা পড়ছিলেন । এইবার ওষুধ মেলায় খুশি , বললেন— “ তামাক সাজ ।’ কালিদাসী মা তালাক সেজে দিলেন । মালদহের একটি দাদার গুরতর অসুস্থতার সংবাদ জানিয়ে কাল একখানা চিঠি এসেছে । সেই থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর ডাক্তারী বই ঘটছিলেন । কেষ্টদা , বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , হরিপদদা ( সাহা ) , প্যারীদা ( নদী ) , কালীদা ( সেন ) প্রভৃতির সঙ্গে মাঝে - মাঝে আলাপ করছিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুরকে অতটা উদ্বিগ্ন দেখে প্রফুল্ল জিজ্ঞাসা করলাে - অসুখ - বিসুখ সম্বন্ধে কত চিঠিই তাে আসে , সব ক্ষেত্রে তাে আপনাকে এতখানি উদ্বিগ্ন ও ব্যস্ত - সমস্ত হতে দেখি না , ক্ষেত্রবিশেষে আপনার এই বিশেষ উদ্বেগের কারণ কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর একটু হেসে বললেন — উদ্বেগ নিয়েই আছি আমি । তবে তােমরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠ যদি , সেই - ই আমার আনন্দ । সেইজন্য অনেক সময় কাউকে - কাউকে নাকানি - চুবানি খেতে দেখেও রা করি না । আবার , সাহায্য করলেও সামনা - সামনি করি না , করি পরোক্ষভাবে , যাতে সে হাল ছেড়ে না দেয় । মানুষের এমনি দোষ , তারা যেন নাবালক ও পঙ্গু হয়ে থাকতেই ভালবাসে । আমার একটু সাহায্য পেলেই গা ঢিল মারে , সেই সাহায্যের উপর দাঁড়িয়ে যে আরাে চেষ্টা করে কৃতী হবে , তা ' আর হয় না । তাই আমি নজর রাখি সবার উপর , কিন্তু সবসময় সবাইকে হাত বাড়িয়ে দিই না , তবে যখনই দেখি , কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছে , তখন আর স্থির থাকতে পারি না । আমার রকমটা কিরকম জান ? ধর , তুমি একজনকে সাঁতার শেখাচ্ছ , কেবলই যদি তাকে তুমি ধরে থাক , তাহলে সে কিন্তু আর সাঁতার শিখতে পারবে না , মাঝে - মাঝে তাকে ছেড়ে দেওয়াই লাগবে , সেই অবস্থায় সে হয়তাে একটু - আধটু জলও খাবে । কিন্তু এমনি করেই সে সাঁতার শিখবে । আবার যদি দেখ , ছেড়ে দেওয়ার ফলে সে ডুবে যাচ্ছে , তখন তাকে ধরা ছাড়া উপায় কী ? এই যে বলছি , এ হ'লাে বুদ্ধিকরা কথা । আমার মন চায় না যে তােমাদের কারও গায় একটু কাঁটার আঁচড় লাগে , তাই তােমাদের অসুবিধা দেখলে আমি ভিতরে ভিতরে অধীর হয়ে পড়ি , তার দরুন তােমাদের যতখানি struggle ( সংগ্রাম ) করতে দেওয়া উচিত আমি , তা ” দিতে পারি না । বলতে পার , কেন সে সুযােগ দেন না । কিন্তু ঐখানেই আমার স্নেহদৌর্বল্য । আমি সবসময় ভাবি , যত কষ্ট আমার উপর দিয়ে যাক , আর সবাই সুখে থাক । জীবন বড় প্রিয় এবং তা সবার কাছেই — এই জীবন নিরাবিল হােক , সুখকর হােক সবার সেইটেই আমার সত্তার ক্ষুধা । তাই , ক্ষুধিতের মতাে হন্যে হয়ে দুটি মানুষের পাছে । আমি জানি , কেউ ব্যর্থ বা ব্যথিত হ'লে সে বেদনা অামাকেই সইতে হবে । তাই নিজের স্বার্থে , নিজের গরজেই যতটুকু পারি করি । কারও জন্য প্রাণপণ করলেও আমার মনে হয় না যে , যা করার সবটুকু করেছি , সবসময় ভাবি , করতে বাকী থাকলো কোনটুকু । আমার অন্তরের ছবিখানা যদি কেউ দেখতে পেতাে , তাহলে সে বুঝতে পারতাে , ভালবাসার কি জালা , ভালবাসার কি দায় ? তবে আমি তােমাদের লাখ ভালবাসি না কেন , সেটা তােমাদের সম্পদ নয় কিন্তু । তােমাদের তরফের ভালবাসাই কিন্তু তােমাদের মূলধন । ঐটুকু খাটিয়েই তােমরা তরে যেতে পার , তরিয়ে দিতে পার মানুষকে । প্রত্যেকের চোখ - মুখ , চেহারা , চাল চলন , কাজ - কর্মের মধ্যে আমি লক্ষ্য করি , ভালবাসা কতটুকু জাগলাে তার মধ্যে । কারও মধ্যে যখন দেখি , অকৃত্রিম অনুরাগের একটি পাপড়ি মেলেছে , তখনই যেন আমার অন্তররাজ্যে উৎসব লেগে যায় । কতবার রােমন্থন করি সে স্মৃতি । আমাকে কেউ ভালবাসে কি - না তার পরখ হলাে কিন্তু তার পরিবেশে ; পরিবেশের সঙ্গে ইষ্টানুগ সঙ্গতি নেই , পরিবেশের জন্য স্বতঃদায়িত্বে দরদের সঙ্গে ভাবা নেই , করা নেই অথচ আমাকে ভালবাসে , এমনটা হতে পারে না । এই ভালবাসা মানুষের সামর্থ্যকে বাড়িয়ে দেয় , সে যে কতভাবে কতজনের পূরণ করতে থাকে তার লেখাজোখা নেই । মানুষের উপাস্য হলেন পুরুষোত্তম , অর্থাৎ সব্বোত্তম পুরণস্বভাব - সম্পন্ন মানুষ । পুরুষােত্তমের পুজারী যখন হয় মানুষ তখন থেকেই সে হয় পূরণব্রতী , সেবাব্রতী , তখনই সে পুরুষ - নামের যােগ্য হয় । তার আগে পর্যন্ত সে কাপুরুষ । কাপুরষের স্থান নেই জগতে । সে মানুষের গলগ্রহ হ'তে পারে , কিন্তু কাউকে গলায় গ্রহণ ক'রে বইতে পারে না । এ যেমন আছে , আবার এ - কথাও ঠিক , কেউ যদি অকপট আৰ্ত্ত হয় , সে - ও কিন্তু মানুষের প্রাণে দয়ার উদ্রেক করে , তার কর্মশক্তিকে সঞ্চালিত করে আত্মরক্ষার উপায় করতে পারে । ভগবান অসহায় করেননি কাউকেও , সব অবস্থায় মানুষের জন্য পথ করে রেখেছেন । যারা কপট , নিষ্ঠাহীন , দোদলবান্ধা , তাদেরই মুশকিল সবচাইতে বেশী । কারও জন্য আমার করবার প্রাণ শীর্ণ নয় , কিন্তু যে যেমন impulse ( সাড়া) দেয় , প্রাপ্তিও ঘটে তার তেমনতর । অনেকে লেখে , বলে , ভাষার কত চাকচিক্য , কিন্তু তাদের মুখ যা বলে চোখ তা কয় না , আবার কতজনে আছে নাংলা , গুছিয়ে কথা বলতে পারে না , কিন্তু সৰ্ব্ব অঙ্গের ভাষা দিয়ে প্রাণে দাগ দিয়ে যায় ।
একটি দাদা জিজ্ঞাসা করলেন — ঠাকুর ! আমরা বিপদে - আপদে পড়ে আপনাকে যখন আকুলভাবে ডাকি , তখন কি আপনি ডাক শুনতে পান ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( স্মিতহাস্যে ) তােমাদের অন্তরের ঠাকুর যখন শুনতে পান , তখনই আমার শোনার সামিল হয় । ঠাকুর আমাদের ছেড়ে নেই কাউকে , তিনি সবার সঙ্গেই আছেন । ফল কথা , কেবল তিনিই আছেন বহুরপে , বহুভাবে । আমরা যেখানে যতখানি বিমুখ তাঁর প্রতি , তিনিও সেখানে ততখানি অপ্রকট আমাদের কাছে । জান্তে , অজান্তে তাঁর সঙ্গেই ঘর করছি আমরা , তাঁর দেওয়া যা - কিছু , সবই চাই আমরা , কিন্তু এমনই অকৃতজ্ঞ যে , তাঁকে চাই না , তবু , তিনি বিমুখ হন না আমাদের প্রতি , প্রতীক্ষায় কাল গণেন , কবে চাইব তাঁকে । যে দিন সত্যি করে তাঁকে চাই , সেদিন সব জুড়ে , সব ভ'রে , সব শুন্যতার আকাশে ব্যাপ্ত হয়ে তিনিই ধরা দেন আমাদের কাছে । ঠাকুর আমাদের কি যে - সে ঠাকুর ! ( এই ব'লে গান ধরলেন ) —ও তাঁর গুণের কথা কইব কেমনে ? সে যে গুণাতীত পরম রতন ।
বারবার আবেগভরে গানের একটি কলিই গাইছেন । গাইতে - গাইতে চোখের কোণ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলাে ............ এরপর একটুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন । খানিকটা বাদে গূঢ়স্বরে বলছেন — আমিই আমার তল পা'লাম না । পরমপিতা যে কাণ্ড করতিছেন , তিনিই জানেন ।
আজ একটা গভীর , গম্ভীর , সুখসমদ্ধ রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে প্রকাশ্য দিবালােকে এই জালের ঘরে ( নিভৃত - নিবাসে ) , ঠিক যেন ঠাওর পাওয়া যাচ্ছে না — কোথায় ব'সে আছি সবাই , কা'র সামনে বসে আছি । এমন সময় একটা মােটরের হর্ণ শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন - দেখে আয় তাে কে আসলো !
হরিপদদা ( সাহা ) খবর নিয়ে এসে বললেন - খেপুদা পাবনা যাবেন , তাই ভূপেশদা ( দত্ত ) গাড়ী নিয়ে এসেছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- এখন আবার পাবনা যাবি কেন রে ?
হরিপদদাতা ' তাে জিজ্ঞাসা করিনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Non - inquisitive blunt ( অনুসন্ধিৎসু , নিরেট ) রকমে যদি চল , তাতে কিন্তু ধর্ম হবে না । কোন কাজে যদি পাঠাই ভেবে নেবে কী উদ্দেশ্যে আমি পাঠিয়েছি , এবং সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে , সিদ্ধ করতে যতটুকু যা ’ - যা ’ করা লাগে , ক্ষিপ্রভাবে করে আসবে । যখন যা করবার তাই যদি পূর্ণভাবে , নিখুতভাবে করতে অভ্যস্ত হও , তার ভিতর - দিয়েই ধীরে - ধীরে perfection- এর ( পূর্ণতার ) পথে এগুতে পারবে , নচেৎ perfection ( পূর্ণতা ) একটা হাওয়ার নাডু় । মানুষ ভাবে , কাজকর্মগুলি সাধন - জীবনে গৌণ ব্যাপার । কিন্তু ইষ্টার্থপরণী কোন কর্মই গৌণ জিনিস নয় । তাই , আধখেচড়া ভাবে তা ’ করা ভাল না , ওতে নিষ্ঠা ও অনুরাগের ব্যত্যয় হয় । সব কাজে চোখটা নিবি আমার , মনটা নিবি আমার , চিন্তাটা নিবি আমার , ধান্ধাটা নিবি আমার । এইগুলি তাের মধ্যে বসিয়ে নিয়ে উদ্দেশ্যে অমােঘগতি হ'য়ে তাের শক্তি প্রয়ােগ করে কাজ হাসিল ক'রে অসিবি । এইভাবে চ'লে দেখ —দেখবি , হাজারাে তাফালের মধ্যে থেকে নিয়ত বৈকুণ্ঠে বাস করছিস । আমার কাছে বাবা নগদানগদি উমদচীজ - এখনই হাতে - কলমে কর , এখনই পাও , এখনই ‘ তেরা বনত বনত বনি যাই ’ – এ সব ঢিমেতেতালা কথা আমার ভাল লাগে না ।
কথা শেষ হ'তেই হরিপদদা দ্রুত পদে গিয়ে জেনে আসলেন — টাউনে কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করবার কথা আছে , সেইজন্য খেপুদা যাচ্ছেন , কা'র - কা'র সঙ্গে দেখা করার কথা আছে , তা তিনি কিছু বলেননি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রীতিস্নিগ্ধ কণ্ঠে ডাক দিলেন — হরিপদ !
ডেকে একটুক্ষণ হরিপদদার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইলেন , চোখমুখ দিয়ে করুণা , ও মমতা ঝ'রে পড়ছে , স্নেহস্বরে বললেন -- আমার কথায় তোর মনটন খারাপ হয়নি তাে ? কী জন্য আমি কী কই , তা বুঝিস তাে ?
হরিপদদা - আপনার কথায় কোনদিন আমার মন খারাপ হয় না । মন খারাপ যা হয় সে নিজের চলার ত্রুটির জন্য । দয়া করে আপনি আমার ভুলত্রুটিগুলি মাঝে - মাঝে দেখিয়ে দেন , এটাকেই আমি সৌভাগ্য বিবেচনা করি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- তােমরা সবাই নিজেদের দোষত্রুটি নিজেরা যদি ধরতে পার , সেই - ই ভাল । আবার , আমি বা অন্য কেউ ধরিয়ে দিলে ক্ষুব্ধ না হয়ে যদি নিজেকে উপকৃত মনে কর ও প্রসন্নচিত্তে আত্মসংশােধনে লেগে যাও , তাহ'লেও বুঝতে হবে , তোমরা মঙ্গলের পথে চলেছ । কেউ নাম - ধ্যান করে কিনা তার একটা মস্ত পরখ হ'চ্ছে এই যে , সে আত্মবিশ্লেষণমুখর কিনা , অকৃতকাৰ্য্যতার জন্য অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে নিজেকে দায়ী করে কিনা । এ অভ্যাসই এমন যে , এতে দেখতে - দেখতে সােনা ফলে , এমনতর মানুষের সাহচর্য্যে বহু , লোক উপকৃত হয় । দেখ , তুমি - আমি দুনিয়ার কিছু করতে পারি না , ধর , তোমার পাঁচটি ছেলে আছে , তাদের জন্য তুমি একটি সোনার পাহাড় ক'রে রেখে গেলে , তাদের যদি চরিত্র না থাকে , যােগ্যতা না থাকে , ঐ সোনার পাহাড় শেষ করতে তাদের বড় বেশী দিন লাগবে না । কিন্তু তাদের মধ্যে চারিত্র্য ও কর্মদক্ষতার স্মরণ করে দিয়ে যেতে পার যদি , তাহলে দেখবে , তারা প্রলয়েও নষ্ট পাবে না । যে অবস্থায়ই পড়ুক , জাপানী ডলের মতাে ঘুরে - ফিরে জায়গায় এসে দাঁড়াবে । আর , আশার কথা এইটুকু যে , প্রত্যেক মানুষের ভিতর অল্প - বিস্তর শ্রদ্ধা আছে এবং শ্রদ্ধা দেবচরিত্র দেখলে মানুষের অন্তর্নিহিত শ্রদ্ধার একটা সদগতি হয় , আর এর ভিতর দিয়েই মানুষ চারিত্র্য অর্জনে সমর্থ হয় । সেইজন্য আমি কই , তােমাদের চরিত্র শ্রদ্ধাময় হােক , শ্রদ্ধাহ হােক , তা'তে তােমাদেরও মঙ্গল , দুনিয়ারও মঙ্গল । এ ছাড়া আর সব ফক্কিকারী । ছেলেবেলা থেকে আমার এক ব্যবসা — সে হ’লাে মানুষ - চাওয়া । একটা সাম্রাজ্যের বিনিময়েও আমি একটা মানুষ ত্যাগ করতে প্রস্তুত নই , আবার একটা মানুষকে মানুষ করে তুলতে যদি একটা সাম্রাজ্য ফতুর করে দিতে হয় , তাতেও আমি কুণ্ঠিত নই । মানুষের শরীর চিরস্থায়ী নয় , যদিও ইচ্ছা করে , এই শরীর নিয়ে বেচে থাকি অনন্তকাল । যাহােক , আমি থাকতে - থাকতে যদি দেখে যেতে পারি যে তোরা কতকগুলি মানুষ মানুষ হয়েছিস — এমন মানুষ যারা কোন প্রবৃত্তির কাছে কাবু হয় না , ধর্ম - ইষ্ট , কৃষ্টি যাদের জান - প্রাণ , হাড় - মাস , তাহ'লে জানব মনুষ্যজীবন আমার সার্থক । তখন তােরাই পারবি দুনিয়াকে ঢেলে সেজে নিতে । আমি যা ' দিয়ে গেলাম সেই দাঁড়াগুলি যদি ঠিক থাকে , তাহলে নিত্যি - নিত্যি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কম । যেমন শুনেছি , শঙ্করাচাৰ্য্য থেকে সুর ; ক'রে এই যে সংসার অসার , মায়াময় , নারী নরকের দ্বার ইত্যাদি কথা ঘােষিত হয়েছে , তা'তে আদৌ ভাল হয়নি । ইষ্টহীন সংসার তাে অসারই , মায়াময়ই , কিন্তু যে সংসারে বেঁচে থাকতে হচ্ছে , বেঁচে থাকতে চাই , তাকে অসার করে না রেখে , মায়াবদ্ধ ক'রে না রেখে ইষ্টের সেবায় লাগিয়ে সারী ক'রে তুলি না কেন ? --- মায়ামুক্ত করে তুলি না কেন ? মায়ামুক্ত হওয়া বলতে আমি বুঝি , মায়াকে সীমিত করে না রাখা । ধর , তুমি পুত্রের প্রতি অফুরন্ত মমতাশীল , আমি বলি — পুত্রের প্রতি তুমি অফুরন্ত মমতাশীল থাক , তা'তে ক্ষতি নাই , কিন্তু মমতা ওখানেই যেন সীমিত হ'য়ে না থাকে , তা ' ব্যাপ্ত হয়ে পড়ুক বৃহৎ বিশ্বের প্রতিটি সন্তানে । একদিন , দেখবে , সেই মমতা বিস্তার লাভ করে তৃণলতা , পশু - পাখী , স্থাবর - জঙ্গম সবকিছুকেই আলিঙ্গন করবে । একতাল লােহা দেখে তাকেও হয়তাে চুমু দিতে ইচ্ছা করবে — যেমন দিতে ইচ্ছা করে ছেলের মুখে । কিন্তু এই পরিণতির জন্য চাই ঐ ইষ্ট - ইষ্টের জন্য যদি তােমার পুত্র হয় , পুত্রস্নেহ হয় , তবে ঐ ইষ্টানুরাগের এরােপ্লেনে চ'ড়ে তােমার পুত্রস্নেহ বিশ্ব পরিক্রমায় বের না হয়ে পারবে না , কারণ , তাঁরই যে সব । আবার নারীকে নরকের দ্বার কেন ক'রে রাখবে ? সে হােক মা , সে হােক সহধর্মিণী , হােক সে ধাত্রী , পাত্রী , বৃদ্ধিদাত্রী । সে স্বামীর বংশানুক্রমিক শুভ - সম্পদগুলিকে মূর্ত্ত করে তুলক তার গর্ভজাত সন্তানে । সে দেবী হােক , মূর্ত্তিমতী কল্যাণী হোক । সে নরকের দ্বার হ'তে যাবে কেন ? তা'তে তার সার্থকতা কী ? অমনতর কথাই আমার মনে হয় খানিকটা obsession ( অভিভূতি ) -প্রসূত । অবশ্য মূল বক্তা কোন প্রসঙ্গে কী উদ্দেশ্যে বলেছেন , সেটা না বুঝে একটা রায় দেওয়া সমীচীন নয় । তিনি হয়তাে বলতে চেয়েছেন নারীকে পুরুষ যেখানে শুধুমাত্র ভােগের ইন্ধন করে ব্যবহার করে , নারী সেখানে নরকেরই দ্বার হ'য়ে আর , সেকথা ঠিকই । কিন্তু এই abnormal ( অস্বাভাবিক ) জিনিসটার উপর আমরা অতাে জোর দিতে যাই কেন ? ঋষি - মহাপুরুষের দেশে আমরা তাে শ্রীভগবানের বাণী জানি— “ ধর্মবিরদ্ধো ভূতেষু , কামােহস্মি ভরতর্ষভ " -ধর্মের অবিরুদ্ধ যে কাম সে কাম তিনিই , তা ' অনীশ্বর নয় । আমরা কামকে , কামিনীকে অমন ক'রে নিয়ন্ত্রিত ও পরিশুদ্ধ করে যদি তুলি , তাহলেই আমাদের ঘরে - ঘরে আবার বালগােপাল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াবে । যেভাবে কই , সেইভাবে বিয়ে - থাওয়া ও দাম্পত্যজীবন নিয়ন্ত্রিণ কর সমাজে , দেখ , কেইসান মাল সব আসে। এ বাবা বিজ্ঞান , এর মধ্যে আবােল - তাবােল নেই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর মাতােয়ারা হয়ে কথা বলে চলেছেন , ঝরণার জলের মতাে কথাগুলি একটা প্রচণ্ড বেগের সঙ্গে বের হচ্ছে । সে - বেগের আবেগ - বন্যায় ভেসে যাচ্ছে প্রত্যেকের অন্তরের যত মালিন্য , অন্ধকার গহ্বরের যত জীর্ণ জঞ্জাল ।
হরিপদদা তামাক সেজে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে রহস্য ক'রে বললেন — যাই কও , তামাকের মতাে দোসর কিন্তু কম আছে । ভাই কও , বন্ধু , কও , ছেলে কও , মেয়ে কও , বউ কও , সব সময় সকলকে ভাল লাগে না । কিন্তু তামাক ভাল লাগে সব সময়ই , যখন পথিবীতে কারও সঙ্গ পছন্দ হয় না , একেবারে নিঃসঙ্গ থাকতে ইচ্ছা করে , তখনই বরং তামাকের সঙ্গ বেশী ক'রে ভাল লাগে । খােদার দুনিয়ার আজব কাণ্ড ।
বিকালের দিকে ঘুম থেকে উঠে শ্রীশ্রীঠাকুর আপন মনে হাঁটতে - হাঁটতে পােষ্ট - অফিস ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন । অনেকে বললেন — একখানা চেয়ার এনে দিই । শ্রীশ্রীঠাকুর উত্তর করলেন- চেয়ার লাগবি না । আমি একটু স্বচ্ছন্দে ঘুরে - ফিরে বেড়াব , তাও তােরা দিবি না ? তােরা ঠাকুর - ঠুকুর যাই বলিস , আমি এ - কথা কখনও ভুলি না যে , আমি গরীব বামুন শিব চক্কোত্তির ছেলে , অামার সবরকম অভ্যাস আছে । এখনও যদি মন করি , হেটে কুষ্টে ( কুষ্টিয়া ) চ'লে যেতে পারি , রাতের পর রাত জেগে সমানে কাজ করতে পারি । -এই ব'লে পােষ্ট - অফিস ঘরের রকে খালি মাটিতেই ব'সে পড়লেন । মাটিতে বসার কী অপূৰ্ব ভঙ্গী ! যখন যেখানে যে - বেশে , যে - অবস্থায় থাকেন , মনে হয় , এমনটি আর দেখিনি — সুন্দর ! সুন্দর ! অপরূপ সুন্দর ! শ্রীশ্রীঠাকুর ডান পাখানি তুলে বসেছেন , কাপড় উঠে গেছে প্রায় ঊরু , পৰ্য্যন্ত , সেদিকে খেয়াল নেই , আত্মভােলার মতাে চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন । রােদের ঝিলিক এসে পড়ছে তাঁর চোখে , মুখে , গায়ে ; মনে হচ্ছে জ্যোতিঃর তনয় জ্যোতিঃর কোলে উপবিষ্ট হয়ে আছেন । আমাদের মনে হচ্ছিল — এই অবস্থায় একটা ফটো যদি তুলে নেওয়া হতো , কত ভাল হতাে । এই মনােমােহন ভঙ্গি , এই জ্যোতিঃ বিভাসিত রূপ আমরা কতিপয় মাত্র দেখছি , এই অবস্থার ছবি তোলা থাকলে বিশ্ববাসী দেখত অনন্তকাল , দেখতাে আর মােহিত হ'তে , মােহিত হ'তাে আর মূঢ়তা অপসৃত হ'তো , কত ভাল হতো ! ✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_তৃতীয়_খণ্ড
#তৃতীয়_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1



10