শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 8
॥ আট ॥
আশ্রমে এসেছেন এন.সি. চ্যাটার্জী অর্থাৎ নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-মশাই। তাঁকে যত্ন করে বসানো হয়েছে। তিনখানা বেঞ্চ পাশাপাশি রেখে তার উপরে একটা বিছানামতো পাতা হয়েছে। ঠাকুরের অনুরোধে তিনি সেখানেই উপবেশন করেছেন।
ঠাকুর কথায় কথায় চট্টোপাধ্যায়মশাইকে বললেন, 'জাতির যে অবক্ষয় ঘটেছে এবং যা ঘটে চলেছে, তার একমাত্র দাওয়াই হলো প্রজনন-পরিশুদ্ধি। সুবিবাহই সুপ্রজননের প্রথম সোপান। ঘরে ঘরে ভালো সন্তানের জন্ম হলে তবেই তো একটা মজবুত ধর্মনিষ্ঠ জাতি পেতে পারেন। সেই জন্যেই আমি এত করে সুবিবাহ এবং সুপ্রজননের উপরে জোর দিই। বিবাহ এবং প্রজনন একটা বিধিনির্ভর বৈজ্ঞানিক ব্যাপার- এর মধ্যে গলদ ঢুকলে ফল ভয়াবহ হতে বাধ্য। অবৈজ্ঞানিক প্রতিলোমবিবাহের ফলেই আজ দেশে রাষ্ট্রদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক জাতকের জন্ম হয়ে চলেছে। ভালো এবং সব দিক দিয়ে সুস্থ মানুষের জন্মই আজকাল কম হচ্ছে। তাই পরস্পরের ভিতরকার শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি কমে-কমে কোথায় এসে ঠেকেছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যেকার সম্পর্কটার দিকেই একটু তাকিয়ে দেখুন না-আগেকার সে-দিন কি আছে?'
বিজ্ঞানমতে মঙ্গলকর বিবাহ-প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, প্রকৃতি-জগতে অনুলোম যৌন সম্পর্কটা কিন্তু স্বাভাবিক। মানুষরা নিজেরা বুদ্ধি করে তার উল্টো কাজটা করে বসে। জীবন-ধারার পক্ষে সেটা বিপরীত-স্বাভাবিক মোটেই নয়। কারণ, প্রকৃতি চায় আমাদের বাঁচা ও বাড়ার অন্তর আকুতিকে সহায়তা করতে। জৈব এবং অযৌগ উভয়বিধ প্রকৃতি জগতেই কিন্তু তাই তদ্বিরোধী যৌন মিলন লক্ষ্য করা যায় না। মানুষ তো বুদ্ধিধর জীব, সে কুবুদ্ধির কবলে পড়ে সেই নিয়ম ভঙ্গ করে সংসারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্রোহী সন্তানের সৃষ্টি করে। পতন এবং ধ্বংসটা আসে এই ভাবে।
আশ্রমে থাকাকালে একদিন কথাপ্রসঙ্গে চট্টোপাধ্যায় মশাই বললেন, 'স্বাধীনতা-সম্বন্ধে আপনার কথা আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বোঝে উলটো।'
ঠাকুর তার জবাবে বললেন, 'স্বাধীনতা কথাটাই তো কেমন গোলমেলে গোছের। স্বাধীনতার মানে যদি অন্য-নিরপেক্ষতা হয়, তবে সে তো মহা অবাস্তবতার ব্যাপার। অন্যের উপর নির্ভর না ক'রে মানুষের বাঁচার রাস্তা কোথায়? প্রাণী-জগতের সবাই সমাজবদ্ধ হয়েই বাস করে। মানুষ সব থেকে বেশি সমাজবদ্ধ জীব। তার জীবন অর্থাৎ বাঁচাটাই যৌথ প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার ফল। এই প্রয়াস ও সহযোগিতা আরও আন্তরিক এবং ব্যাপক হলে মানব-জীবনের সামগ্রিক বৃদ্ধি অবাধ হয়ে ওঠে। তার নীট ফল হলো মনুষ্যজাতির উদ্বর্ধন।'
চ্যাটার্জীমশাইয়ের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে হিন্দুত্বের কথা উঠলো। ঠাকুর বললেন, 'হিন্দুদের অত্যন্ত প্রতিকূল প্রাকৃতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে। অস্তিত্বকে বজায় রাখার জন্যে তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই সংগ্রামের ধারাকে বজায় রাখার জন্যে তাদের একজন নেতা বা পরিচালককে খুঁজতে হয়েছে। এই থেকে তারা একজন গুরুকে মেনে চলার সংস্কার লাভকরেছে। এইভাবে আর্য-হিন্দুদের মধ্যে ঋষিকে ধরে চলার অভ্যাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই, দেখতে পাওয়া যায়, আর্য-হিন্দুদের রক্তধারার মধ্যেই নেতা বা গুরুর প্রতি আনুগত্য, অসৎনিরোধী সংগ্রামের মানসিকতা সত্তার সঙ্গে একেবারে গাঁথা হয়ে আছে।'
আরও বলেছেন, 'সাধনার ভিতর দিয়ে যে-কোন বর্ণের মানুষই এক জীবনেই ব্রাহ্মণ হতে পারে অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারে।'
'তবে, বর্ণ হিসেবে বিপ্রত্বে উন্নীত হতে গেলে কোন বর্ণের পাঁচ পুরুষ, কোন বর্ণের সাত পুরুষ আবার কোন বর্ণের বা নিশ্ছেদ ভাবে পরপর চৌদ্দ পুরুষ ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করতে হয়। এটা ব্রাহ্মণত্ব অর্জন এবং নির্ভঙ্গ ভাবে বংশধারার মধ্যে তা ধরে রাখার ব্যাপার। তখন সেই বংশের লোকেরা হয় 'অধিকারী বামুন'। এই ভাবে এটা বংশানুক্রমে অর্জন করে স্থায়ী করে নিতে হয়। এই উদ্দেশ্যে সাধনা করে চললে একটা জাতির সকল বর্ণের মানুষই একদিন বংশগতভাবে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠে জাতি-পরিচয়ে 'বিপ্র' হয়ে উঠতে পারে। জ্ঞানোন্মেষ ও বংশগত উন্নয়নের পদ্ধতিই হলো এই। সবই ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের উপরে দাঁড়িয়ে করতে হয়। ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্য তাই সবার আগে বিচার্য। এক দাঁড়িতে এক বাটখারায় সব মানুষকে মাপা যায় না। যার বৈশিষ্ট্যে যে-রাস্তা সহজ হয়, তাকে সেই রাস্তাতেই চালাতে হয়। সামাজিকভাবে এবং জাতিগতভাবে এই ভাবেই মানুষ বেড়ে-বেড়ে স্থায়ীভাবে ব্রাহ্মণত্বের লাইনে থেকে বিপ্রজাতিতে পরিণত হয়। সবটাই ধারাবাহিকভাবে অনুশীলন এবং বংশানুক্রমিক ভাবে ধরে রাখার ব্যাপার।
কথাপ্রসঙ্গে আরও যোগ করে বলেছেন- 'প্রকৃত বামুনরাই হলেন সমাজের স্বাভাবিক প্রতিনিধি। প্রকৃত বামুনের ধাতই হলো, সকল বৈশিষ্ট্যের সকল লোকেরই বৈশিষ্ট্যকে সম্মান দেওয়া ও তার বিবর্ধনের পথে সহায়তা করা। আর তিনি নিজের কোন স্বার্থপূরণের জন্য এটা করেন না। জনস্বার্থই তাঁর স্বার্থ। এটা তাঁর ব্রাহ্মণসুলভ ধাতের স্বভাব।'
একজনের, কথার উত্তরে ঠাকুর বলেছেন, শুধু সমজ্ঞান লাভই যথেষ্ট নয়। সকল মানুষ তো সমান নয়। এক-একজন মানুষের বৈশিষ্ট্যই তো এক-একরকম। জগৎটাই যে বহু ব্যক্তিত্বের বহু কিছু প্রাকৃতিক বস্তুর অসম গঠন এবং আচার নিয়ে গড়া, সেটা আগে বুঝে নিতে হবে। উন্নতিটা যার-যার বৈশিষ্ট্যের পথে আসবে। সমদৃষ্টি এবং সমাচরণ বলে কোন কথা হয় না। কোন মানুষকে বড় করতে হলে, তার শির-দাঁড়ার উপরে দাঁড় করিয়েই তাকে বড় করতে হবে।
তাই, ঠাকুর ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যপালী পূরণ মানসিকতার উপরে বড় জোর দিয়েছেন। তা না করে সবকিছুকে নিয়ে খিঁচুড়ি করে ফেলে সে খিচুড়িতে মানুষ গোষ্ঠীর উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। অথচ, এই প্রবণতাই আজ দেশ এবং রাষ্ট্রনায়কদের মানসিকতাকে পেয়ে বসেছে।
অনেক মানুষের ধারণা, সব মানুষকে এক ধরণের করতে হবে, নইলে ঐক্য হবে না-সাম্য আসবে না।
ঠাকুরের মন্তব্য- বৈচিত্র্য থাকবেই। সংসারের কোন দু'টি বস্তুই এক নয়। একটু রসিকতার ঢঙেই বলেছেন, সবাই যদি এক রকম হয়ে যেতো, তাহলে তো কেউ কাউকেই চিনতেই পারতো না।
সব কথা শুনে 'চট্টোপাধ্যায়মশাই বলতে বাধ্য হলেন, 'যেখানে বর্ণাশ্রমধর্ম অটুট ছিল, সেখানে হিন্দুরা বিজাতীয় প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে খুব কমই।' বিজ্ঞানভিত্তিক অনুলোম বিবাহ ও তার ফলে যে সুপ্রজনন, তাই সমাজকে ক্রমোন্নত করে একটা পরিশুদ্ধ জাতিতে পরিণত করে। আর্য হিন্দুজাতির এই ছিল গোড়ার কথা। এ জন্য তারা সর্বদাই একজন জাতীয় ইষ্টগুরুকে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। হিন্দুদের এই সুপ্রজনন-বুদ্ধি এবং বৈশিষ্ট্যভিত্তিক বর্ণগত উন্নয়ন-পরিকল্পনাই তাদের জাতি হিসেবে উন্নত এবং বিশিষ্ট হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
একদিন ঠাকুর বড়াল বাংলোর হাতায় জামতলায় এসে চেয়ারে বসেছেন। সময় তখন অপরাহ্ন। প্রকৃতির চতুর্দিক তাকিয়ে দেখে দেখে তার বহুরৈখিক লাবণ্য আস্বাদন করছেন। নিকটে থেকে কিছু আশ্রমবাসী ভক্ত এবং বহিরাগত দর্শনার্থী সেই দৃশ্য উপভোগ করছেন। এমন সময়ে ঠাকুর হঠাৎ নিজের মনেই বলে উঠলেন, 'মানুষ সাধারণত মনে করে, যে ভালো-ভালো কথা বলতে পারে এবং বেশ উপর-পালিশ, সে-ই বুঝি জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান। কিন্তু তার ঐ বলা এবং চলার মধ্যে মিল আছে কি না, তাই দেখে তার মূল্যায়ন করতে হবে। ও সব বাহির পালিশের কোন দাম নেই।'
একদিন গলরোগের নামকরা চিকিৎসক ডঃ এস, কে, নাগচৌধুরী ঠাকুরের কাছে এসেছেন। তাঁর দেওঘরের উপকণ্ঠে নিরিবিলি অঞ্চলে অস্থায়ী ভাবে বসবাসের বাড়ি আছে। মাঝেমধ্যে সেইখানে থাকেন। অনেক বিশিষ্ট মানুষই এই রকম দেওঘরের উপকণ্ঠে নিজস্ব বাড়ি করেছেন-জনবহুল কলকাতা শহর থেকে একটু সরে এসে পবিত্র জলবাতাসের জায়গায় কিছুদিন থেকে একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠার উদ্দেশ্য। এঁরাও এক ধরণের নিয়মিত চেঞ্জার। এঁদের মধ্যে অনেকেই নিরিবিলি রোহিণী রোডের ধারে বড়াল বাংলোয় এসে ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন- নানারকম কূটতত্ত্ব ও সন্দেহের নিরসন ঘটানোর জন্যে কাছে বসে আলোচনা করেন। ঠাকুরেরও এই সব বুদ্ধিমান জিজ্ঞাসুদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালোই লাগে। তাঁর আগমন তো মানুষের প্রশ্ন নিরসনের জন্যই। চলার পক্ষে সকল কপাট খোলার জন্য সঠিক চাবিকাঠি মানুষের হাতে তুলে দেবার জন্যই তো তাঁর মর্ত্যাবতরণ।✅
Aponakegoy guru bholo thakun
উত্তরমুছুন