শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 10
॥ দশ ॥
একদিন নির্মল চট্টোপাধ্যায়মশাই কথাচ্ছলে বললেন, বিলেত যাবার সময় স্যার আশুতোষকে যখন প্রণাম করতে যাই, তখন তিনি আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, 'দ্যাখো, বিলেত গিয়ে আমার নাম রাখা চাই। পরীক্ষায় তোমাকে ফাস্ট হতে হবে। আমারও বিশ্বাস ছিল, সব পরীক্ষায় ফাস্ট হতে পারবোই। কিন্তু পরীক্ষার সময়ে আমি বেশ ভালো রকম অসুস্থ হয়ে পড়লাম। একটা পেপারে পরীক্ষা দিতে সে আমি প্রায় অচৈতন্যই হয়ে গেলাম। সেই অবস্থাতেই লিখে চললাম। মজার কথা ঐ অর্ধচেতন দশায় লিখেও ঐ বিষয়ে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। আবার পরীক্ষার ফল বেরোবার আগেই পরীক্ষার ফল সম্বন্ধে আগাম সব বুঝতে পেরেছিলাম। এটাই বা হলো কেমন করে?
উত্তরে ঠাকুর বললেন, 'বৃত্তি বলে একটা প্রকৃতিগত ব্যাপার আছে। এই শরীরটা ঐ বৃত্তিকেই বহন করে। আবার, এই শরীরের কোষ সমূহেরও একটি অতি সূক্ষ্ম অবস্থা আছে। মৃত্যুর পরেও সেই অতিসূক্ষ্ম কোষগুলি অবিকৃতই থাকে। সেই কোষসমন্বিত দেহকে বলে চিন্ময় দেহ বা ভাব দেহ। বৃত্তিগুলি সেখানেও ঘুমন্ত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। আর সেই সমস্ত নিয়েই মানুষ পর জন্মের দেহ ধারণ করে। তাই মানুষ পরবর্তী দেহলাভ করে পূর্বেকার সংস্কারবশেই কাজ করে থাকে।'
বলেছেন, 'মৃত্যুর সময়ে প্রথমে গভীর অন্ধকার তারপরে চোখধাঁধানো আলো। তারপর শোনা যায় প্রচণ্ড ঢংঢং আওয়াজ। ঐ শব্দের ধাক্কাতেই স্মৃতিধারা ছিন্ন হয়ে যায়। এক ইষ্টের উপরে অতিগভীর টান থাকলে স্মৃতিধারা অবিচ্ছিন্নই থাকে। এই বাস্তব জীবনেও যে পরিস্থিতির প্রতিকূল আঘাতসমূহকে যে বেশি সয়ে নিয়ে ইষ্টপথে চলতে পারে, তার স্মৃতি-চেতনা লাভের সম্ভাবনাও তত বেশি থাকে।'
কথাপ্রসঙ্গে চট্টোপাধ্যায়মশাই বললেন, 'আমার মনে হয়, দ্বৈতকে বাদ দিয়ে অদ্বৈতে পৌঁছানো মুশকিল।'
ঠাকুর বললেন, 'খুব ঠিক কথা। রামকৃষ্ণদেবও তাই বলতেন। দ্বৈতবাদে ভক্তিরস আছে। ওতে প্রেম ও গুরুভক্তির চর্চা হয়। আর তা না হলে জীবন তো শুকনো কাঠ। আমার কিছুদিন একবার ঐ দশা হয়েছিল, আমি তো শুকিয়ে শুকিয়ে রসহীন আনন্দহীন হয়ে মরতে বসেছিলাম। আবার নিজেকে সবচেয়ে হীন ও দীন মনে করে চললেও প্রাণধারা শুকিয়ে যেতে বসে।, সেও অতি ভয়ংকর। গুরু-প্রেম ও গুরু-সেবার পথেই সাম্য রক্ষিত হয়- আর সেটাই স্বাভাবিক জীবন। তার মধ্যে রস এবং আনন্দ দুইই আছে।'
বললেন, 'সব সময় ভাবতে হয়- আমি তোমার সন্তান, আমি অজর অমর, আমি তোমার চৈতন্যে সদাচেতন। তাহলেইত শক্তিতে সতেজ থাকা যায়।'
কথাপ্রসঙ্গে উদ্দীপ্ত হয়ে জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন। 'ভক্তের জীবনই আলাদা' সে গুরু ছাড়া কিছু বোঝে না, কিছু চায় না। গুরুই তার জীবনে কীল অর্থাৎ ধারকদণ্ড। আর এইখানেই ভক্তিমার্গের সব রস। ভক্ত তাই রসিক পুরুষ- প্রেমিক পুরুষ। সব মানুষ তার আপন। দুনিয়াটা তার কাছে রসময় আনন্দের উৎস।'
'যে নিজে শুকনো, দুনিয়াটাও তার কাছে শুকনো।'
গুরুগত ভক্তের কাছে বিশ্বটাই গুরুমূর্তি। তাই সে বিশ্বের সেবক- সে বিশ্ব-প্রেমী।
জানবে, প্রেম ভক্তিরই জাতক। ভক্তি না থাকলে প্রেম অসম্ভব। আর প্রেমহীনতাই মৃত্যুর নামান্তর। সে জীবন শুকনো। তার অন্তরে ভাব নেই, নয়নে দীপ্তি নেই। চেতনার বোধশক্তি নিষ্প্রভ, অনুভূতি মৃতপ্রায়। সে অন্ধ।
শোন দীনবন্ধু-দাদার গল্প।
এক গরিব বিধবার একমাত্র বালক-পুত্র। বালকটি পাঠশালার ছাত্র। বাড়ি থেকে পাঠশালা বেশখানিকটা দূর। কিছুটা পথ গিয়ে খানিকটা বনজঙ্গলও পার হতে হয়। ছোট ছেলে, রাস্তায় তার একা যেতে ভয় করে। যে গ্রাম থেকে সে স্কুলে যায়, সেখান থেকে তার আর কোন সঙ্গী নেই। এ পল্লীর এক কোণে তার মায়ের বাস। সেখান থেকে স্কুলে যাবার আর কেউ নেই। একা স্কুলে যেতে তার
একটু ভয়ভয়ই করে। সে একদিন মাকে বলেই ফেল্লে, মা, সব সময় তো রাস্তায় লোক পাই না, তাই নির্জন রাস্তায় একলা হয়ে গেলে কেমন ভয়ভয় করে। তার ভয়ের কারণ শুনে মা বললে, 'বাছা, যখন ভয়ভয় করবে, তখন এক কাজ কোরো। তখন দীনবন্ধুদাদাকে ডেকো। দীনবন্ধুদাদা না! সব মানুষের বিপদকালে তার কাছে এসে সাহায্য করেন। তিনিও তোমাকে সঙ্গে করে বনের পথটা পার করে দেবেন। তিনি খুব দয়ালু।'
ছেলে বললে, 'সেই দীনবন্ধুদাদা কোথায় থাকে?'
'দীনবন্ধুদাদা আশপাশেই থাকেন, ডাকলেই তিনি শুনতে পান আর কাছে এসে মানুষকে সাহায্য করেন- এইটাই আমার জানা। তুমি ভয় বোধ করলেই তাঁকে ডাকবে, তিনি এসে তোমাকে জঙ্গল পার করে দেবেন। বাছা, তোমার কোন ভয় নেই।'
ছেলে শুনে খুশি হলো। জঙ্গলের কাছে এসে সঙ্গীহীন হয়ে পড়লেই সে দীনবন্ধুদাদাকে ডাকে। অমনি দীনবন্ধুদাদাও এসে বলেন, 'ভাই, তোমার ভয় করছে? এসো আমার সঙ্গে। তোমার কিছু ভয় নেই- আমি তোমাকে জঙ্গলের পথ পার করে দিচ্ছি।'
এই ভাবে বালকের স্কুলে যাতায়াত চলে। বাড়ি থেকে স্কুলে যাবার পথে বা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সঙ্গীহীন হয়ে পড়লে সে দীনবন্ধুকে দাদা বলে ডাকে, অমনি দীনবন্ধুদাদাও আবির্ভূত হয়ে তাকে চলার পথে সঙ্গ দিয়ে সাহায্য করেন।
এইভাবে বালকের লেখাপড়া চলে।
একদিন এক ঘটনা ঘটলো। মাস্টার মশাইয়ের বুড়ো বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। গুরু মশাইয়ের এবার পিতৃশ্রাদ্ধ করতে হবে। তাঁর তো পয়সাকড়ি নেই, বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সাহায্যই তাঁর সম্বল। তারা বাড়ি থেকে যা আনবে, তাই তাঁর ভরসা। তাই দিয়ে গুরুমশাইয়ের পিতৃশ্রাদ্ধের পারলৌকিক ক্রিয়া এবং গ্রামবাসীদের ভোজনব্যবস্থা। তাই, যথাসময়ে গুরুমশাই তাঁর বাচ্চা ছাত্রছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন পিতৃশ্রাদ্ধে কে কী দিতে পারবে।
বিধবার এই ছেলেটিকেও শুধোলেন, তুই কী দিতে পারবি? বাড়ি থেকে জেনে এসে ছেলেটি বললে, মাষ্টারমশাই, ভোজের দিনে যা দই লাগবে সেটা আমি দেবো। মায়ের ভরসা ঐ দীনবন্ধুদাদা। মা জানেন, যা করার দীনবন্ধুদাদাই করবেন। দীনবন্ধুকে ছেলেটি সব ব্যাপার বললে। শুনে দীনবন্ধুদাদা বললেন, ঠিক আছে, তুমি দইই দিও- আমি তোমাকে দই এর যোগান দেবো। কিন্তু ওমা, এ কী। কাজের দিনে দীনবন্ধুদাদা একটা ছোট ভাঁড়ে কিছুটা দই এনে ছেলেটির হাতে দিয়ে বললেন, 'এই যে তোমার মাস্টারমশাইয়ের পিতৃশ্রাদ্ধের দই! ছেলেটিও সেই দই নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের গৃহে হাজির। সেখানে তো বহুলোক লাইনে বসেছে শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে। তখনও দই আসেনি দেখে মাস্টারমশাই তো খুব ভাবনায় পড়েছেন। যাই হোক ছেলেটি দীনবন্ধুদাদার দই নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাস্টারমশাই তো এমনি বিরক্ত হয়ে ছিলেন, এবার দইয়ের পরিমাণ দেখে একটু ক্রোধ প্রকাশ করে বলেই ফেললেন, এই দই ক'জনের হবে রে?
ছাত্রটি বলল, 'মাষ্টার মশাই, এ দই আমার দীনবন্ধুদাদা দিয়েছেন- এই দইয়ে বহু লোকের খাওয়া হবে। বিস্মিত মাস্টারমশাই হতাশ মনে সেই দই লোকের পাতে দিতে লাগলেন। প্রথম জনের পাতে সবটাই দিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় জনের পাতের কাছে গিয়ে ইতস্তত করতেই ছাত্রটি বলে উঠলে, 'মাস্টারমশাই দিতে থাকুন, দই তো ভাঁড় ভর্তি।' অবাক্ মাস্টারমশাই সব লোকের পাতে প্রচুর পরিমাণে দই পরিবেশন করেও ভাঁড়ের দই শেষ করতে পারলেন না। বিস্ময়ে মুখের কথা হারিয়ে ছাত্রকে বললেন, 'বাছা, তোর দীনবন্ধুদাদা কেমন রে! এ দই তো কিছুতেই শেষ করতে পারলাম না। সে মানুষ নয় রে! চল আমি তাকে দেখবো!'
ছাত্রের সঙ্গে মাস্টার মশাই এসে দাঁড়ালেন সে বনের ধারে। দাঁড়িয়ে বললেন, 'ডাক তোর দীনবন্ধুদাদাকে, দেখি সে কেমন গোয়লা।'
ছাত্রটি ডাক দিলে, 'দীনবন্ধুদাদা, তুমি এসো, দেখা দাও!'
অমনি দীনবন্ধুদাদা জঙ্গলের রাস্তায় এসে দর্শন দিলেন।
ছাত্রটি বললে, 'মাস্টারমশাই, এই যে, ইনিই দীনবন্ধুদাদা- এঁকে দেখুন।'
'কই রে, তোর দীনবন্ধুদাদা কই?'
'এই তো, আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। দেখতে পাচ্ছেন না?'
'নারে, আমি কিছুই দেখছি না।' দীনাতিদীন বিধবার পুত্রের নিত্যদেখা দীনবন্ধুদাদাকে শিক্ষিত মাস্টারমশাই নানাভাবে চোখ রগড়িয়েও দেখতে পেলেন না।
জীবনে ইষ্ট চাই, হৃদয়ে ভক্তি চাই। তবেই অন্তরে বোধ আসে, নয়ন দর্শনক্ষম হয়। নতুবা, সমস্তই রসহীন মরুভূমি। অভক্ত দীনবন্ধুর দয়া বুঝতে পারে না। সে অবোধ- অন্ধ।✅
10