- ভালবাসার স্বরূপ-৭৮
- শৃঙ্খলা ভাঙ্গার মূলে কী থাকে-৭৮।
- শ্রদ্ধা-৭৮
- জনগণের বিক্ষোভ-নিরাকরণের পথ-৭৯
- ভোটাধিকার সম্বন্ধে -৭৯
- চরিত্রগঠনের সূত্র-৮০
- ভিক্ষা করার নীতি-৮০
- কর্মে প্রেরণা-দান- ৮১
- শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৮১
- সেবা কিভাবে অপরের কাছে লাভাবহ হয়-৮১
- দরদ- ৮২
- বর্তমান গণতন্ত্র অবৈজ্ঞানিক কেন-৮২
- বর্ণাশ্রমের গুরুত্ব-৮৩
[P 77-83]
২৮ শে পৌষ , সোমবার , ১৩৪৮ ( ইং ১২।১।৪২ )
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনান্তে নিভৃত - নিবাসে বিছানায় বসে আছেন । এমন সময় কেষ্টদা ওখানে গেলেন । কেষ্টদা শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম ক'রে নীচেয় মেঝের উপর বিনা - আসনে বসতে যাচ্ছিলেন দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যস্তসমস্ত হ'য়ে বললেন -- এত ঠাণ্ডায় খালি শানের উপর বসবেন না । একটা আসন টেনে নিয়ে বসেন ।......... তা আপনি আইছেন , ভালই হইছে । লােকের দঙ্গলের মধ্যে আপনাকে যা কইবার তা কইতেই পারি না । যখন যেটা ক'বার তখন সেটা না কলি আবার কামের অনেকখানি ক্ষতি হয়ে পড়ে । তা ছাড়া একটা করণীয় কাজ করা হলাে না বলে মনে একটা অস্বস্তিও লাগে থাকে । অনেক সময় পরে আবার ভুলও হয়ে যায় । এইজন্যই এই জালের ঘর করছিলাম- ভাবিছিলাম , রােজ কিছু সময় এখানে বসে আপনাদের সঙ্গে প্রয়ােজনীয় কথাবার্তা কব। তা ' এ জায়গাও এখন বারােয়ারী জায়গা হ'য়ে গেছে । কেমন একটা ব্যাপার হইছে , শৃঙ্খলা যেন আমরা কিছুতেই মানতে পারি না ।
কেষ্টদা -- এই শৃঙ্খলা ভাঙ্গার বুদ্ধি কেন হয় আমাদের ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — দেখেন , ভালবাসা যদি থাকে তাহলে বুদ্ধি থাকে প্রিয়ের সুখ , সুবিধা , স্বাচ্ছন্দ্য কিসে হয় । প্রিয়র সান্নিধ্য না পেলে তার হয়তাে বুক ভেঙ্গে যায় , কিন্তু তা'তেই যদি প্রিয়ের সুবিধা হয় , তেমন ক্ষেত্রে সে মনের ব্যথা মনে চেপে হাসিমুখে দূরেই থাকে , দূরে থেকেই তাঁর সুখ - শান্তির জন্য যা পারে সন্তুষ্টচিত্তে ক'রে যায় । কোন অনুযােগ করে না , অভিযোগ করে না । সীতাকে যখন নির্ব্বাসন দিলেন রামচন্দ্র , তখন অনেকে সীতার প্রতি সহানুভূতিপরবশ হয়ে রামচন্দ্রের কাজের অযৌক্তিকতা সম্বন্ধে তাঁর কাছে বলতে যেতেন , তা'তে কিন্তু সীতা রুখে উঠতেন , বলতেন , “ অৰ্য্যপুত্র ঠিকই করেছেন , তিনি প্রজানুরঞ্জক রাজা , তাঁর কাজ হলাে প্রজাগণের সন্তোষ বিধান । তাদের মধ্যে অসন্তোষ বা বিক্ষোভ দেখা দিলে রাজার কৰ্ত্তব্যচ্যুতি ঘটে । তাই , আমাকে বনবাসে দিয়ে তিনি সেই অসন্তোষ ও বিক্ষোভের কারণ নিরসন করেছেন । এ তিনি ঠিকই করেছেন , এবং সহধর্মিণী হিসাবে আমারও উচিত তাঁকে তাঁর কর্ত্তব্য - পালনে সহায়তা করা । তাই আমি সত্যিই সুখী , কারণ , নির্ব্বাসিত জীবন যাপন করে আমি আমার স্বামীর জীবনব্রত উদযাপনে সাহায্য করতে পারছি । তােমরা তাঁর কাজের সমালােচনা করাে না , তিনি সাধারণ মানুষ নন , তিনি কখনও ভুল করেন না , অন্যায় করেন না । ' কী কথা ! ভাবলেও , বুকখানা আনন্দে ফুলে ওঠে । একেই কয় ভালবাসা । রামচন্দ্রের সঙ্গ ছাড়া হ'য়ে সীতার প্রাণটা কী করতাে , তা ' তো বুঝতেই পারেন , কিন্তু দেখেন — কোনই অনুযােগ নেই , অভিযােগ নেই তার বিরুদ্ধে , বরং তার কাজ সমর্থন করেছেন কেমন সুন্দরভাবে । এহেন জীবন - যাপন ক'রে গেছেন তিনি , তাই রামের সঙ্গে তাঁর নামও জড়িয়ে গেছে ভারতের ইতিহাসে , বলতে বলে ‘ সীতারাম ' । তাই , এই ঘরে ঢোকা সম্বন্ধে শৃঙ্খলা যে ভাঙ্গে , তার মূলে আছে ভালবাসার অভাব , আছে আত্মপ্রীতি , অত্মিপ্রতিষ্ঠার বুদ্ধি । আপনাদের মধ্যে অনেকে আছে যারা মানুষের কাছে দেখাতে চায় , তারা আমার পক্ষে কতখানি অপরিহার্য্য , তাদের কতখানি অধিকার , সর্বত্র তাদের কতখানি অবাধগতি । এর মূলে আছে inferiority ( হীনম্মন্যতা ) -- শ্রদ্ধার শ - ও নেই ওতে । শ্রদ্ধা মানুষকে তার চলনার সীমারেখা ও অধিকারভুমি সম্বন্ধে সচেতন করে দেয় , সে তা লঙ্ঘন করে না । এইটেই হ'লাে সত্যিকার আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তির লক্ষণ । এই সীমারেখা সম্বন্ধে যাদের বােধ নেই তাদের শিক্ষিত বা মার্জ্জিতরুচি বলা যায় না । তারা অযথা দাবী করে , দৌরাত্ম করে , উৎপাত করে , অনাধিকার চর্চ্চা করে , অন্যের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যকে ক্ষুন্ণ করে , আর এমনি ক'রে মানুষের বিরাগভাজন হয়ে ওঠে । তাই , আমাদের আর্য্যশিক্ষাপদ্ধতি ও সাধনপদ্ধতির মধ্যে অধিকারী ভেদ ' - এর উপর অতো জোর দেওয়া হতাে । আপনাদের এই যে তথাকথিত গণতন্ত্র , এটা কিন্তু অবৈজ্ঞানিক ।
কেষ্টদা - আপনি যে বর্তমান গণতন্ত্রকে অবৈজ্ঞানিক বলছেন , কিন্তু পথিবীর সেরা - সেরা নেতা যাঁরা , তাঁরা সবাই তাে এই গণতন্ত্রের সমর্থক । রকম যেমন দেখা যাচ্ছে , তাতে সারা পৃথিবীতেই তাে এই গণতন্ত্র ছড়িয়ে পড়বে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - বৈশিষ্ট্য - বিধত গণতন্ত্র যদি হয় , তাতে তাে আটকায় না । গণতন্ত্র আপনাদের দেশেই কি কম ছিল ? শুনেছেন তাে রামায়ণের কথা ? একটি ব্রাহ্মণের ছেলের অকালমৃত্যু হয়েছিল ব'লে , ব্রাহ্মণ এসে কৈফিয়ৎ তলব করেছিল রামচন্দ্রের কাছে কেন তােমার রাজ্যে অকাল - মত্যু হ'লাে ? এত বড় ব্যক্তিগত অধিকারের কথা আজকের দিনে কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আপনারা কি কল্পনা করতে পারেন ? অগণ্য নগণ্য প্রত্যেকেরই এতখানি অধিকার তখন ছিল । দেশের ব্যক্তিগুলির সঙ্গে মন্ত্রী বা নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কোথায় ? গণতন্ত্রের নায়ক যাঁরা , তাঁরা যদিও বলেন প্রত্যেক মানুষ সমান , তাহ'লেও তাঁরা অন্তরে - অন্তরে জানেন যে তাঁরা অসামান্য , অসাধারণ । প্রকৃতপ্রস্তাবে অগণ্য , নগণ্য , দুঃখী , সৰ্বসাধারণের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কতখানি ? তাঁরা সভা করে বক্তৃতা করেন , কাগজে বিবৃতি দেন , ব্যথিত কারও বাড়ীতে গিয়েও বড় একটা খোঁজ - খবর নেন না , কিংবা ব্যক্তিগতভাবে লােকগুলি তাঁদের কাছে ব্যথার কথা জানাবার সুযোগ কমই পায় । তাদের বৈতরণী পার হবার খেয়ানৌকা হ'লাে ভােট , ভােটের মালিক হ'লাে জনতা ; জনতার চাপ , জনতার দাবী যেখানে , সেখানেই তাঁরা দরদী ন্যায়বিচারের থলি খুলে বসেন । ব্যষ্টি দিয়ে যে জনতা , সেই ব্যষ্টির তাঁরা ধার ধারেন না , তার কথায় কর্ণপাতও করেন না । তাই গণতন্ত্রের মধ্যে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের কথা বলা হয় , ওটা একটা লােকঠকান কথা । প্রত্যেকটা প্রাপ্তবয়স্ক লােককে ভােটাধিকার দিলেই গণতন্ত্র হয় না । দেখতে হবে , এই ভােটাধিকারের ভিতর দিয়ে সে পেল কী ? আবার , জনতার দাবী ছাড়া গ্রাহ্য হয় না ব'লে , বহু , মানুষ ক্ষুদে নেতাদের খপরে পড়তে বাধ্য হয় , যারা কিনা দল বাঁধতে ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে ওস্তাদ । তারা অনেক সময় মানুষের প্রবৃত্তি ও প্রলােভনকে উস্কে দেয় , কর্ত্তব্য সম্বন্ধে সচেতন না করে মানুষকে অধিকার - আদায় সম্বন্ধে ক্ষেপিয়ে তােলে , ফলে তারা কর্মশক্তি , কর্ত্তব্যবুধি ও যােগ্যতা হারিয়ে সমাজের ভারস্বরপ হয়ে ওঠে । সেইজন্য ওর দুঃখবেদনার কথা , সমস্যার কথা সহানুভূতি - সহকারে শুনতে হয় এবং সম্ভবমতো তার নিরাকরণের ব্যবস্থা করতে হয় । তাহ'লে জনতার বহু , দাবী দাওয়া ও বিক্ষোভের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় । আপনার কাছে একটা মানুষ এসে যদি soothcd ( তুষ্ট ) হ'য়ে যায় , সে আবার তার পরিবেশের কাছে বলে এতে , এতে বহু মানুষের শ্রদ্ধা আপনার উপর আকৃষ্ট হয় , আর প্রত্যেকে যদি জানে যে তার ব্যথা নিরাকরণের একটা জায়গা আছে , তাহলে মানুষগুলির মন আশ্বস্ত থাকে । কেউ বিক্ষোভমুলক বিপক্ষদল গঠন করতে চাইলে , তারাই প্রতিরােধ করে তা ' । দুষ্টলোেক মানুষকে ক্ষেপিয়ে সমাজের অনিষ্ট করবার সুযােগ পায় কম , সংহতিও বজায় থাকে অনেকখানি । তাই তাে আপনাদের বলি — প্রত্যেকের সঙ্গে কথা - বার্তা বলবার কথা । আপনার সঙ্গে প্রত্যেকটা কর্মীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক যত গভীর হবে , ঋত্বিক - সঙ্ঘের কাজও আপনি তত সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারবেন । প্রত্যেকের কথা শুনবেন , প্রত্যেকের জন্য ভাববেন , প্রত্যেকের জন্য যথাসাধ্য করবেন , আর সাহায্যাদি যা করবেন , তা যথাসম্ভব নিজে সংগ্রহ করে করবেন । কারও মুখাপেক্ষী বা হাতধরা হয়ে থাকবেন না । ফিলানথ্রপির থেকে দিল ভাল , না দিল , না দিল । আপনার ভিক্ষা তাে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না । দেখেন না , আমি কাউকে বিপদে আপদে , বিশেষ প্রয়ােজনে দেবার বেলায় ফিলান্থ্রপির কাছে চাই না । জন্মে অবধি ভিক্ষা করতেই আছি । ও অভ্যাস আমি ছাড়তে চাই না । আমি যদি নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ না করি , তাহলে অন্যেও করবে না । এই অর্জনপটুত্ব মানুষের চরিত্র - গঠনের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন । এতে মানুষের অভ্যাস - ব্যবহার অনেক শুধরে আসে , মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখতে হয় , মানুষকে সাধ্যমতাে সেবা দিতে হয় ।
প্রফুল্ল ( দাস ) -আমরা অনেক সময় মানুষকে সাময়িকভাবে কথাবার্ত্তায় উদ্বুদ্ধ ক'রে যা প্রয়ােজন সংগ্রহ করি , কিন্তু তাদের জন্য তেমন কিছু করি না । অন্যের কথা বলতে পারব না , কিন্তু আমি নিজে এইরকম ক'রে থাকি ! ভাবি , ইষ্টের ব্যাপারে যখন সংগ্রহ করছি , তখন আমার অতাে ভাববার কি আছে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর -- আমি যদি তােমাকে কিছু সংগ্রহ করতে বলি , সে - ব্যাপারে যদি আমার নাম ভাঙ্গাও , তাহ'লে তােমার কিছু হলাে না । মানুষগুলির সঙ্গে তোমার এমন সবন্ধ থাকা চাই , যা'তে তুমি চাইলেই তোমাকে দেবে , তোমাকে দিতে পেরে আত্মপ্রসাদ বােধ করবে । কেউ যদি খুশি মনে তার ক্ষুধার অন্ন থেকে দিতে চায় এবং তা গ্রহণ না করলে ব্যথিত হয় , সে জায়গায় তাকে খিন্ন না করে কিছু নিলেও দোষ হয় না , আবার কেউ যদি অন্তরে - অন্তরে ক্ষুণ হ'য়ে তার অফুরন্ত ঐশ্বর্য্যের এক অংশ দিয়ে দেয় , এবং তা'তে যদি সে imaterially ( বস্তুগতভাবে ) এতটুকুও affected ( ক্ষুণ ) না হয় , তাহলেও তা ' না নেওয়া ভাল । আমি দেখিস না -- যাদের আছে , তাদের অনেকের কাছে কিছুই চাই না , বরং তাদের আরো দিই , কিন্তু যাদের কিছু নেই , তাদের কাছেই হয়তাে চাই । দ্যাখ , পরমপিতার সেবায় অর্থ ব্যয় করতে সুকৃতি লাগে , পিতৃপুরুষের পুণ্য না থাকলে সে - প্রাণ লাভ করে না মানুষ । তবে আমার সব সময় বুদ্ধি থাকে , যার কাছ থেকে এক পয়সা নিই , কেমন করে তাকে এক টাকা পাইয়ে দেওয়া যায় । ফল কথা , দেবার বুদ্ধি থাকলে মানুষের যােগ্যতা প্রাপ্তির খাঁকতি ঘটে না । তােরাও ঐ বুদ্ধি মাথায় রাখবি , যার কাছ থেকে যা নিবি , তার বেশী তাকে লাভবান করে দিতে চেষ্টা করবি ।
প্রফুল্লতা ’ করব কিভাবে ? আমাদের তাে ট্যাঁক গড়ের মাঠ হয়ে থাকে , সব সময় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( হেসে বললেন ) —মাথা খাটানাে লাগে । আমি কী দিয়ে করি ? আমার তাে কানাকড়ি নেই , তােদের তাে তবু , বাক্স আছে , চাবি আছে । সময় অসময়ে দু ' - চার টাকা তা'তে রাখিস । আমি তাে তালা - চাবির ধার ধারলাম না জীবনে । আমার তা লাগবে কিসে ? আমি তাে সবসময় শূন্য হয়ে আছি । কিন্তু পারি কি করে ? পারি তােরা সব এত আছিস ব'লে । তােদেরও তাে মানুষের অভাব নেই , কত মানুষ তােদের ভালবাসে , তােরাও তাদের ভালবাসিস । নিজের যা থাকে তা দিবি , যেখানে পারবি না — মানুষকে দিয়ে মানুষের জন্য করবি । করতে থাক , -দেখিস , ব্যক্তিত্বের এমন প্রভাব হবে যে তােদের মুখের কথায় মানিয়ে হাজার টাকার কাজ হয়ে যাবে । আবার , সঙ্গে - সঙ্গে বুদ্ধি দিবি , প্রেরণা দিবি , মনের ব্যথা মুছে নিবি , obsession ( অভিভূতি ) -গুলি কাটিয়ে দিবি , ইষ্টানুরাগ বাড়িয়ে দিবি । সেবার সবরকম হাতিয়ার তােদের হাতে আছে , তোরা তাে রাজা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর একটুখানি চুপ ক'রে থেকে মৃদুমধুর হাসতে লাগলেন , আকুল করা সে - হাসি , সে - হাসি দেখলে মনে হয় - অনন্তকাল ঠুস হ'য়ে প'ড়ে থাকি তাঁর পায়ের তলে , আর মাঝে - মাঝে মুখ তুলে চেয়ে দেখি তাঁর ঐ ভুবন - ভােলানাে হাসিমুখখানি ।
প্রফুল্ল বসে - বসে ভাবছে মানুষকে বস্তুগতভাবে লাভবান ক'রে তােলা যায় কেমন ক'রে , কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে সাহস পাচ্ছে না , কারণ , শ্রীশ্রীঠাকুর যা ' বলেছেন , তা সুস্পষ্ট । শ্রীশ্রীঠাকুর তখন আপন মনে বলছেন — ধর , একটা লোক অর্থবান কিন্তু মাতাল , মদ খেয়ে - খেয়ে শরীর , মন , অর্থ সব নষ্ট করছে । তুমি যদি তোমার সুগঠিত চরিত্রের প্রভাবে , তোমার ভালবাসার যাদু দিয়ে , তােমার ইষ্টনেশার পরশ লাগিয়ে তার ঐ মদের নেশা ছুটিয়ে দিতে পার , তাহ'লে তুমি কিন্তু তাকে indirectly ( পরোক্ষভাবে ) materially profitable ( বস্তুগতভাবে লাভবান ) করে তুললে । তাই service ( সেবা ) -এর কোন লেখাজোখা নেই । Active feeling ( সক্রিয় অনুভূতি ) থাকলে মাটিচাপা ফোয়ারার মতাে নিত্যনতুন পন্থা মাথায় ফুটে বেরুতে থাকে । তবে সব করাটা হবে ইষ্টসূত্রে গ্রথিত ক'রে , নইলে লােক - সেবা করতে যেয়ে মানুষ বেহেড হয়ে পড়ে , কারণ , করাগুলির মধ্যে কোন integrating thread ( সংহতি - সূত্র ) থাকে না , ক্রমাগত environment ( পরিবেশ ) -এর complex ( প্রবৃত্তি ) -অনুযায়ী utilised ( ব্যবহৃত হয় ।
ইতিমধ্যে খেপুদা এসে বসলেন । খেপুদা খুকখুক ক'রে কাশছিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর শাসনের সুরে বললেন - তোরে ক’য়ে আমি আর পারলাম না , কতদিন কইছি , তাের ফেরেঞ্জাইটিসের ভাব আছে , শীতের ক'মাস সকাল - সন্ধ্যে মাফলারটা গলায় পেচায়ে রাখবি , তা ' তুই খেয়ালই করিস না । আর আমারও এমন কপাল , এমন একটা মানুষও দেখি না , যে তাের কাছে - পাছে থাকে এইগুলি করে দেবে । আমার ভাবনার অন্ত নেই । একটু অবসর পেলেই কত কথা মনে পড়তে থাকে ।
.......... ..যা প্যারী , খ্যাপার মাফলারটা এনে দে তাে ।
প্যারীদা ছুটে গেলেন মাফলার আনতে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওষুধ - টষুধ খাচ্ছিস তাে ঠিকমতাে ?
খেপুদা — হ্যাঁ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- তবে প্যারী যে কয় , সব ওষুধ ঠিকমতাে খাস না ?
খেপুদা - প্যারী ভাবে , গাদাগাদা ওষুধ খেলে রােগ তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ডাক্তারের নির্দেশ পুরােপুরি মেনে চলাই ভাল । পুরােপুরি মেনে চ'লে যদি ফল না হয় , তখন তুমি প্যারীকে বলতে পারবা তােমার ওষুধ এই ক’দিন খেলাম , কিন্তু ফল কিছু পেলাম না । প্যারীর কোন ভুল - ত্রুটি হয়ে থাকলে সে - ও তা বিচার - বিবেচনা করবার সুযোেগ পাবে । কিন্তু direction ( নির্দেশ ) -গুলি যদি in toto ( সম্পূর্ণভাবে ) follow ( অনুসরণ) না কর , তাহলে কিছুই বােঝা যাবে না ।
খেপুদা — আচ্ছা খাব । পরে কেষ্টদার দিকে চেয়ে হাসতে - হাসতে বললেন , —ওষুধ খাবার যন্ত্রণা রােগের যন্ত্রণা থেকে নিতান্ত কম নয় ।
কেষ্টদা হেসে উত্তর দিলেন — যা ' কইছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুরও সেই হাসিতে যােগ দিয়ে বললেন — ওষুধ খাওয়ার যন্ত্রণার একটা ফয়দা আছে , কারণ , ওষুধ ঠিক - ঠিক মতাে পড়লে ও তা ঠিকঠিক মতাে খেলে রোগ সারে ।
কেষ্টদা পূৰ্বপ্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললেন — আপনি যে বৰ্ত্তমান গণতন্ত্রকে অবৈজ্ঞানিক বলছিলেন , সেটা কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - আমি তাে বই - টই পড়িনি , তবে আপনাদের মুখে যা শুনেছি তা'তে এই বুঝেছি , গণতন্ত্রের ধারণা — সব মানুষ সমান । কিন্তু এই ধারণাটাই ভুল । কোন দুটো মানুষই সমান নয় , দুটো মানুষ কেন , ভগবানের সষ্টির মধ্যে কোন দুটি প্রাণী বা বস্তুই অবিকল এক নয় , প্রত্যেকটি যা - কিছুই বিশিষ্ট ও বিভিন্ন । এই বিশিষ্টতা ও বিভিন্নতা না মানাই অবৈজ্ঞানিক বুদ্ধি । এই হিসাবে আমাদের বর্ণাশ্রম - সম্বলিত গণতন্ত্রই কার্য্যকরী । এখানে প্রত্যেক মানুষেরই অধিকার স্বীকৃত হয়েছে , কিন্তু প্রত্যেকের তার মতাে করে । বর্ণ , বংশ , ব্যক্তিগত প্রকৃতি ও ইতিহাস ইত্যাদিকে বাদ দিয়ে যদি শিক্ষা , বিবাহ ও জীবিকা ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা হতে থাকে , তাহলে বিপৰ্যয় ছাড়া আর কিছু হবে না । আপনি - আমি হয়তাে দেখে যেতে না পারি , কিন্তু পথিবীকে যদি বাঁচতে হয় তবে বর্ণধর্মের fundamental principles ( মৌলিক নীতিগুলি ) -কে adopt ( গ্রহণ ) করতেই হবে । আমি এ কথা নিজ হাতে কাগজ - কলমে লিখে দিয়ে যেতে পারি ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখমুখ আবেগদীপনায় জ্বলজ্বল করতে লাগল । সকলেই অবাক - বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন তাঁর পানে ।✅
#Alochona_prosonge_part_3
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_তৃতীয়_খণ্ড
#তৃতীয়_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1


10