🔲 বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী মানুষের প্রকৃতির বিভিন্নতা হয়-৭০
🔲 শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৭০
🔲 বিজ্ঞানদৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা-৭৩
🔲 কর্মীদের অপারগতার কারণ-বিশ্লেষণ-৭৪
🔲 শিষ্যকে গুরু কিভাবে পরীক্ষা করেন-৭৪
🔲 সময়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভাগ সম্বন্ধে-৭৫
🔲 আশীর্ব্বাচন-৭৬
🔲 নবশায়ক সম্প্রদায়-৭৬
🔲 নমঃশূদ্র সম্প্রদায়-৭৬
[p 70-77]
২৬ শে পৌষ , শোনিবার , ১৩৪৮ ( ইং ১০।১।৪২ )
খেপুদা ( চক্রবর্ত্তী ) , কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য্য ) ও বঙ্কিমদা ( রায় ) প্রাতে নিভৃত নিবাসে শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে সমবেত হয়েছেন । শ্রীশ্রীঠাকুর দক্ষিণাস্য হ'য়ে বসেছেন , সামনেটা খোলা , সেই দিকেই চেয়ে আছেন । মাঝে - মাঝে কুষ্টিয়া মােহিনী - মিলের চোঙটার দিকে চেয়ে - চেয়ে দেখছেন , দেখতে - দেখতে বলছেন ছেলেবেলা থেকে আমার দৃষ্টিটা বড় সন্ধানী দৃষ্টি । যা ’ দেখব , শুনব , বুঝব , তা ' পুরােপুরি না দেখলে , না শুনলে , না বুঝলে আমার কিছুতেই তৃপ্তি হয় না । ছেলেবেলায় বাগানে দেখি কতরকম গাছ , দেখি আর মনে হয় , এক মাটি আর এতরকম গাছ - এ সম্ভব হয় কী করে ? ভেবে আর কিনারা পাই না । শেষটা একদিন বাগানে যেয়ে ছোট - ছোট অনেক গাছপালা উপড়ে - উপড়ে দেখলাম । পরে বুঝলাম , মাটি এক হ'লেও বীজ আলাদা , তাই একমাটিতে হ'লেও গাছের চেহারা আলাদা হয় , ফল আলাদা হয় । আবার , বীজগুলিও হয় যে - বীজ থেকে ঐ গাছ হয়েছে সেই বীজেরই মতন , যদিও মাটির প্রকৃতি অনুযায়ী গাছের species ( জাতি ) -এর উৎকর্ষ্ - অপকর্ষ হতে পারে । মানুষগুলিও ঐরকম । একই পরিবেশে বহু , মানুষকে জন্মাতে ও বাস করতে দেখা যায় , কিন্তু বীজ অনুযায়ী আকৃতি - প্রকৃতির পার্থক্য হয় , আবার তারা যে বীজবাহী হয় , সে - বীজও তারা যে - বীজ হ'তে উদগত হয়েছে তারই অনুরপ , পুরুষপরম্পরায় এমন করেই চলে , তাই বর্ণধারা ও বংশধারা না মেনে উপায় নেই । কৃষ্টির মূলকথা হ'লাে , বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি , উদ্বর্দ্ধন ও সামঞ্জস্যবিধান । পুরুষোত্তম হ'লেন সব বৈচিত্র্য , সব বৈশিষ্ট্যের সার্থক সঙ্গমতীর্থ । ঐ কেন্দ্র - পুুরুষকে বাদ দিয়ে যেখানে ঐক্যবিধানের প্রচেষ্টা , সেখানে দেখা যাবে , হয় মন বৈশিষ্ট্যগুলিকে ছেটে - কেটে একাকার করতে চেষ্টা করছে , নয়তো বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের নামে পারস্পরিক বিভেদ ও বিচ্ছেদকে বাড়িয়ে তুলে হিংসাদ্বন্দে লিপ্ত হচ্ছে । আমি মুখ্য মানুষ , বই - কেতাবও পড়িনি , কিন্তু প্রকৃতিকে অস্বীকার করে গায়ের জোরে , গলার জোরে বা কলমের জোরে চালাতে গেলে তাতে শেষরক্ষা হবে কিনা বুঝতে পারি না । হ্যাঁ কেষ্টদা ! আপনার বিজ্ঞানে কী কয় ? যে - জিনিসের যে- character ( চরিত্র ) , যে property ( গুন ) , তা ' তেমনতরই bolhave ( আচরণ ) করবে তো , না অন্য কিছু ?
কেষ্টদা - আপনি যা বলছেন , তা তাে স্বতঃসিদ্ধ , অন্য কোন প্রমাণনিরপেক্ষ , এ - সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কোথায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( অধীর আগ্রহে ) -আপনি সত্যি করে ক'ন , আমাকে খুশি করবার জন্য কিছু কবেন না । আমি ভাবি , আমার মতাে একটা নিরেট মানুষ বােঝে , আর বড় - বড় নামকরা লােকেরা কেন বােঝে না , আমারই ভুল , না তাদেরই ভুল ?
কেষ্টদা — আপনার ভুল হতে যাবে কেন ? সত্যিকার জ্ঞানী যাঁরা , বিজ্ঞানী যাঁরা , তাঁরা তাে এই কথাই বলেন । Nobel laureate Alexis Carrel বলেছেন - The democratic creed docs not take account of the constitution of our body and of our consciousness . It does not apply to the concrete fact which the individual is . Indeed human beings arc equal , but individuals are not . The equality of their rights is an illusion . . Thc fcebleminded and the man of genius should not be equal before the law . Sexes are not equal . To disregard all these incqualitics is very dangerous . The democratic principle has contributed to the collapse of civilisation in opposing the development of an elitc.- ( গণতান্ত্রিক মতবাদ আমাদের দেহ ও চেতনার গঠন সম্বন্ধে চিন্তা করে না । প্রতিটি ব্যক্তি যে কী , সেই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেও ইহা প্রযুক্ত নয় । সব মানুষই মনুষ্যজাতির অন্তর্ভুক্ত , সেই হিসাবে তারা সমান , কিন্তু ব্যষ্টিগুলি সমান বা এক নয় । তাদের অধিকারের সমতাও একটা ভ্রান্তি - বিশেষ । আইনের চক্ষে একজন ক্ষীণমনা লােক ও একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি সমান হওয়া উচিত নয় । পুরুষ - নারী সমান নয় । এই সমস্ত বৈষম্য উপেক্ষা করা অত্যন্ত মারাত্মক । গণতান্ত্রিক নীতি সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তিসমুহের উদ্ভবে বাধা সৃষ্টি ক'রে সভ্যতার ধংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । ) Man the Unknown বইয়েতে তিনি আরাে বলেছেন --- The ancestral tendencies , transmitted according to the laws of Mendel and other laws give a special aspect to the development of each man . In order to manifest Themselves , they naturally require the co - operation of the environment ..... Indeed , the circumstances of develop ment arc efficient only within the limits of the hereditary predispositions , of the immanent qualities of tissues and consciousness . ( মেণ্ডেলের আবিস্কৃত নিয়ম এবং অন্যান্য নিয়ম অনুযায়ী পুরুষপরম্পরায় যে প্রবণতাগুলি সংক্রামিত হয় , সেগুলি প্রতিটি মানুষের বিবন্ধনের পথকে বৈশিষ্ট্যখচিত ক’রে তােলে । ঐ প্রবণতাগুলির বিকাশের জন্য পরিবেশের সহযােগিতা প্রয়ােজন হয় । অবশ্য , বিকাশের অনুকূল অবস্থাগুলি ততটুকুই কাৰ্য্যকরী হ'তে পারে , যতটুকু সম্ভাব্যতা কিনা তার বংশানুক্রমিকতার মধ্যে , দৈহিক উপাদান ও চেতনার মধ্যে অনুস্যূত হ'য়ে আছে । ) মনীষী Galton বলেছেন— The parent is rather the trustee than the producer of the germ - cells ; or again thc individual bodies are like mortal pendents that fall away from the immortal necklace of germ - cells .- (জনক জনয়িতা নয় বরং তার অছিমাত্র । আবার এও বলা যায় যে , প্রত্যেকটি জাতক যেন অবিনশ্বর বীজকোষের মালা হ'তে প্রলম্বিত এক - একটি নশ্বর পুঁতিমাত্র । ) Aldous Huxley বলেছেন - We must begin by the frankest , the most objectively scientific acceptance of the fact that human beings belong to different types .- (গোড়াতেই আমাদের অত্যন্ত অকপট ও অরঙ্গিলভাবে এই বৈজ্ঞানিক সত্যকে মেনে নিতে হবে যে , মনুষ্যজাতি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত । ) মহামতি Downing লিখেছেন Galton , in his studies of the families of distinguished English judges , found that the son of an English judge is 500 times as likely to be a person of note as the son of the average Englishman . A similar fact was disclosed in Galton and Schuster's studies of other ‘ notc - worthy families ' . It is cvident from this that ability runs in families .—- ( গ্যালটন বিশিষ্ট ইংরেজ জজদের পরিবারগুলিকে পর্যবেক্ষণ ক'রে দেখেছিলেন যে , একজন সাধারণ ইংরেজের ছেলের তুলনায় একজন ইংরেজ জজের ছেলের খ্যাতনামা ব্যক্তি হওয়ার সম্ভাবনা অন্ততঃ ৫০০ গুণ বেশী । গ্যালটন ও সুষ্টার অন্যান্য খ্যাতনামা পরিবারগুলিকে পৰ্যবেক্ষণ ক'রেও অনুরুপ তথ্যের সন্ধন পেয়েছেন । এটা সুস্পষ্ট যে , যােগ্যতা বংশপরম্পরায় পরিবার গুলির মধ্যে প্রবাহিত হ'য়ে চলে । ) বিখ্যাত Sociologist Prof. Gilding বলেছেন - The notion that all men are cqual citer in work , | capacity or utility is unfounded and all cfforts to blend the classes into one human castc are forccloomcd to failure , because cquality is a chimerl- ( কর্ক্ষমতা , যােগ্যতা বা উপযোগিতার দিক দিয়ে যে সকল মানুষ সমান , এ - কথা সম্পূর্ণ অযৌকি এবং মনুষ্যসমাজের বিভিন্ন শ্রেণীকে এক শ্রেণীহীন মানবজাতিতে পরিণত করার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য , কারণ , তথাকথিত সাম্য অলীক কল্পনামাত্র । ) এইরকম জগদ্বিখ্যাত আরাে বহু মনীষীর বহু , কথা পাওয়া যায় , যার ভিতর - দিয়ে বােঝা যায় যে , বর্তমান বিজ্ঞান আপনার কথারই প্রতিধ্বনি করছে , অজানিতে আপনার সিদ্ধান্তের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার কথা বলে কথা নয় । Fact is fact ( তথ্য তথ্যই ) , যেমনভাবে তা ' উদঘাটন করা যায় , তেমনভাবে যে অগ্রসর হয় , সেই - ই তার সাক্ষাৎকার লাভ করতে পারে । অসুবিধা হয়ে পড়ে , যদি কোন untoward bias ( প্রতিকূল ঝোঁক ) থাকে । যাহােক , এইসব কথা শুনলে ভরসা হয় , ভাবি , আমি তাহলে বেহেড হয়ে যাইনি , কিংবা দুনিয়াও একেবারে দেউলে হয়ে যায়নি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাকিয়ায় ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুকে অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় পা - দুটি ছড়িয়ে দিলেন বিছানার উপর উত্তর দিকে । হাসিমুখে বলতে লাগলেন স্থূল হ’তে সূক্ষ্ম ও কারণ - স্তর পর্যন্ত আমার এই আমান অস্তিত্ব দিয়ে যতটুকু দেখেছি বা বােধ করেছি ব'লে বলি , সমস্ত জগৎও যদি তাকে মিথ্যা বলে , তাহ'লেও আমার অনুভবটা মুছে ফেলতে পারব না , আমার সত্তায় তা ’ গাঁথা হ'য়ে আছে । এ আমার শােনা কথা নয় যে , অন্যের কথায় আমার ধারণা পাল্টে যাবে । তবু , উপযুক্ত মানুষ , বিভিন্ন শাস্ত্র ও বিজ্ঞানের বাস্তব সমর্থন পেলে আমার আনন্দ হয় , ভাল লাগে । কারণ , জীবনীয় সম্পদ আমার যদি কিছু থাকে , সকলেই তা উপভােগ করুক , এই - ই আমি চাই । একলা - একলা উপভােগ হয় , উপভােগ যা'তে এন্তার হয়ে ওঠে , সেইজন্য প্রত্যেককে এর ভাগ দিতে চাই । বিশিষ্ট লােকদের কাছ থেকে আৰ্য্যকৃষ্টির মূল নীতিগুলি সম্পকে সমর্থনসূচক সিদ্ধান্ত ও উক্তি পেলে , অনেকের সে - বিষয়ে আস্থা ও আগ্রহ হবে । তাই আপনাদের এত পড়তে বলি , খুঁজতে বলি । পড়ার লােক তাে আপনাকে ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে দেখি না । সুশীলদা ও শরৎদারও পড়বার অভ্যাস আছে , কিন্তু ওদের science ( বিজ্ঞান ) না পড়া থাকার দরুন অনেকখানি deficiency ( খাকতি ) রয়ে গেছে । Science ( বিজ্ঞান ) পড়তে - পড়তে মানুষের জ্ঞানচর্চ্চা , চিন্তা , চলন ও কথাবার্তার মধ্যেও একটা scientific outlook ( বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ) ফুটে ওঠে , কোন কিছু , শুনেমিলে বা প'ড়ে তার মাৎটুকু বাদ দিয়ে সারটুকু পাকড়ে নিতে পারে । এর ভিতর দিয়ে আসে accuracy of knowledge ( জ্ঞানের বিশুদ্ধতা ) , হাবিজাবি ভেজাল থাকে না তা'তে । বঙ্কিমেরও সব বিষয়ে interest ( অনুরাগ ) আছে , কিন্তু বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে ও যা ' বলে তা খানিকটা ধারণা - অনুরঞ্জিত । Scientific outlook ( বৈজ্ঞাকি দৃষ্টিভঙ্গী ) থাকলে মানুয ঐ ধারণা - অনুরঞ্জনাকে বাদ দিয়ে চলে । ধর্মের ব্যাপারেও ঐ কথা । যুক্তি , বিচার ও প্রমাণসহ যা ' নয় , তেমনতর কিছুই আপনি মানতেন না , কিন্তু আপনার ভিতরটা মানবার মতাে কিছু পাওয়ার জন্য আঁকুপাঁকু করত , এতে আপনার পক্ষে ঢের সুবিধা হয়েছে । ধর্ম , আধ্যাত্মিকতা , ঈশ্বর , আত্মদর্শন , ব্রহ্মজ্ঞান , সাত্ত্বিকতা , সাধুতা , পুণ্যকর্ম , পরকাল , জ্ঞানযােগ , ভক্তিযােগ , রাজযােগ , কৰ্ম্মযােগ , ' প্রাণায়াম , সমাধি ইত্যাদি সম্বন্ধে কতগুলি মনগড়া ধারণা নিয়ে যারা গুরুর কাছে আসে এবং ঐ ধারণার মাপকাঠিতে যারা গরুকে বিচার করে , তারা অনেক সময় বঞ্চিত হয় । একজন হয়তাে সাধনতত্ত্ব জানবার লােভে আমার কাছে আসলাে , আমি হয়তাে তাকে বললাম গরুর ঘাস কাটতে । গুরুর আজ্ঞা পালন করলে পুণ্য হয় , সেই লােভে লােভে সে হয়তাে গেল ঘাস কাটতে । ঘাস কেটে ফিরতে দেরী হয়ে গেল , এদিকে ক্ষিদেয় পেট চোঁ - চোঁ করছে , এসে অসময়ে আনন্দবাজারে গেছে , রাঁধুনে বামুন উঠলাে মুখ খিঁচিয়ে । অমনি অহঙ্কার , অভিমান , সন্দেহ , অবিশ্বাস সবগুলি এসে জেকে বসলাে । ঐদিন রাত্রে সে হয়তাে টিকিট কাটলাে , তারপর আর তার টিকিটি পর্যন্ত দেখা গেল না এ - মুলকে এ - জীবনে । বাইরে গিয়ে হয়তাে বলে বেড়াচ্ছে — মশায় ! সৎসঙ্গের কথা বলছেন ? ওখানে ধর্মের ‘ ধ ' - ও নেই । আছে প্রবল বিষয় - বুদ্ধি । আমি গেলাম ঠাকুরের কাছে সাধনতত্ত্ব শিখতে , তিনি কিনা আমাকে বললেন ঘাস কাটতে ।......... এইরকম কত রকমারি যে হয় , তার কি ইয়ত্তা আছে ? নিখুত ও নিয়মিতভাবে নিঠাসহকারে ঘাস কাটার মধ্যদিয়ে , নিজের অহঙ্কার - অভিমানকে নিয়ন্ত্রিত করার ভিতর দিয়ে , পরিবেশের সঙ্গে শুভ সঙ্গতি বজায় রাখতে গিয়ে তার কতখানি বাস্তব সাধন হ'তাে , সে কি তার বােঝবার জো আছে ? এখানে যারা আছে সবাই যে আমাকে ভালবেসে আছে , তা মনে করবেন না । এমন লােকের অভাব নেই , যারা আমাকে ভগবান বলে প্রচার করে , কিন্তু স্বার্থ ও অভিমানে আঘাত লাগলে তৎক্ষণাৎ আমার interest ( স্বার্থ ) sacrificc ( ত্যাগ) করতে পারে । যারা প্রবত্তির দায়ে হামেশা আমার interest ( স্বার্থ ) sacrifice ( ত্যাগ ) করে , বুঝবেন তারা আমাকেও যে - কোন মুহূর্ত্তে অস্বীকার করতে পারে , ত্যাগ করতে পারে । কথাগুলি কঠোর মনে হচ্ছে , কিন্তু এই হচ্ছে আদত ব্যাপার । বাড়ীর পোষা ময়নাটার উপর মানুষের যে প্রীতি ও মমতা হয় , আজীবন যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি ক'রেও অনেকের ইষ্টের উপর সে প্রীতি ও মমতাটুকু হয় না । তাই , সব চলনাটাই হয় কেমন যেন কৃত্রিম ।
খেপুদা , বমিদা বিদায় নিলেন , ইতিমধ্যে আরো ২|৩ জন আসলেন ।
উপস্থিত একটি মায়ের দিকে চেয়ে শ্রীঠাকুর রহস্য ক'রে বলেন - আমি যদি মানুষ না হ'য়ে টাকা হতাম , তাহলে তাের ভালবাসা লুফে নিতি পারতাম ।
মা - টি বললেন --- আপনি কী যে কন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( হাসতে - হাসতে ) —মাঝে - মাঝে অপ্রিয় সত্য কথা কই । সেটা আমার দোষও কইতে পার , গুণও কইতে পার । যখন দেখি , মােলায়েম করে সত্য কথা কইলে তােমাদের অনেকের চামড়া ভেদ করে না , তখন দায় ঠেকে তোমাদের ভাল চেয়েই একটু - একটু কড়া কথা কই । তােমাদের কাউকে প্রয়ােজন বশতঃও রূঢ় কিছু বললে আমার যে কতখানি লাগে , তা যদি তােমরা বুঝতে ! এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক চেয়ে খেলেন । তামাক খাওয়ার পর বালকের মতাে ঔৎসুক্যসহকারে একটা ঘড়ির Parts ( অংশগলি ) দেখতে লাগলেন । কেষ্টদার কাছে আবার খুঁটে - খুঁটে জিজ্ঞাসা করলেন — এটা কী ? ওটা কী ? এতে কী হয় ?
কেষ্টদা সব খুঁটিনাটি করে বুঝিয়ে বললেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এমন ঘড়ি করা যায় না যে বছরে একবারের বেশী দম দেওয়া লাগবে না ।
কেষ্টদা — খুব সূক্ষ্ম লম্বা spring ( প্রিং ) যদি হয় , কিংবা দম ফুরিয়ে গেলে automatically ( আপনা থেকে ) দম হ'য়ে যাবে এমনতর mecha nical arrangement ( যান্ত্রিক ব্যবস্থা ) যদি থাকে , তাহলে হতে পারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - আমাদের দেশে আগে সময় নির্ণয় করতে কী করে ?
কেষ্টদা -- সূৰ্য্যের ছায়া মেপে সময় নির্ণয় করা হতাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার মনে হয় , যেকালে পল , বিপল , অনুপল ইত্যাদি কথা হামেশা প্রচলিত ছিল , তখন সেগুলি শুধু , গাণিতিক সিদ্ধান্ত হিসাবেই ছিল না , দৈনন্দিন জীবনে ওর প্রয়ােগ ছিল এবং তা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করার মতাে উপযুক্ত ব্যবস্থাও ছিল । সূৰ্য্যের ছায়া মেপে সময় নিদ্ধারণের কথা যা বলছেন , তার অনেক অসুবিধা আছে , যেমন বৃষ্টির দিনে যখন সূৰ্য্য দেখা যায় না , তখন মানুষ সময় ঠিক করবে কী করে ? রাত্রে কী করবে ? আমরা জ্যোতিষ গণনায় দেখতে পাই , সময়ের কত ক্ষুদ্রতম অংশ ওর মধ্যে ক্রিয়াশীল । সময়ের এসব ক্ষুদ্রতম বিভাগগুলি নির্ণয় করার মতাে যন্ত্র ছিল বলে আমার মনে হয় । যন্ত্র - বিজ্ঞানে আপনারা যে কম ছিলেন তা কিন্তু নয় । ছিটেফোঁটা খবর যা মেলে তা'তেই তো অবাক বনে যেতে হয় । হাজার বছর বিজিত অবস্থায় বাস , ক'রে আমরা আমাদের ইতিহাস ভুলে গিছি , কৃষ্টি ভুলে গিছি । তোতাপাখী মতো মনিবরা যা শেখাচ্ছে তাই শিখছি , যা ' বলাচ্ছে তাই বলছি । ভাল করে ঢোঁড়েন , জাতির সত্যিকার ইতিহাসটা উদঘাটিত করে দেন । ভীবনের প্রত্যেকটা বিভাগে আমাদের পিতৃপিতামহেরা কতখানি উন্নতি করেছিলেন , কথায় কথায় , গাথায় - গাথায় সেগুলি চারিয়ে দেন । মায়েরা ছেলে কোলে করে নিয়ে শুয়ে ঐ গল্পই করুক । পিতা - পুত্র , স্বামী - স্ত্রী , বন্ধু - বান্ধব এদের দৈনন্দিন আলোচনার সামগ্রী হােক আমাদের পূর্বপুরুষের গৌরবগাথা । কত বড় একটা সভ্যতা , কত বড় একটা কৃষ্টির অধিকারী যে এরা ছিলেন , তা বােঝা যায় এই দেখে যে , লক্ষ ঘাত - প্রতিঘাতের মধ্যেও এত বড় প্রাচীন জাতি আজও টিকে আছে , এবং শুধু , টিকে থাকা নয় , দুনিয়াকে নিত্য - নতুনভাবে দিয়ে চলেছে । স্বামী বিবেকানন্দকে যে পাশ্চাত্ত্য দেশ এতখানি সম্মান দেখালাে , সে তাঁর চেহারা দেখে নয় , তাঁর কাছ থেকে তারা এমন কিছু পেয়েছিল , যা ' তারা আর কোথাও পায়নি । রবীন্দ্রনাথ চ'লে গেছেন কিন্তু আজও সারা বিশ্বে তার সমাদর , শুনি রবীন্দ্র - সাহিত্য সম্বন্ধে পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্বৎ -সমাজে একটা প্রচণ্ড আগ্রহ বিদ্যমান , কত ভাষায় তাঁর কাব্য ও সাহিত্যের অনুবাদ হ'চ্ছে । জাতির মজ্জায় - মজ্জায় অনেকখানি মাল না থাকলে কি এমন সব মানুষের অমিদানী হতে পারে ? কন কি কেষ্টদা ! আমি সুখ রাখার জায়গা পাই না , যখন ভাবি , আজও আমাদের দেশে ভগবান রামকেষ্ট - ঠাকুরের মতাে বিশ্বত্ৰাতার আবির্ভাব হয় । পরমপিতা আপনাদের প্রতি সুপ্রসন্ন , তাঁর নেক নজরে আছেন আপনারা । আপনাদের বিনাশ নাই , সব নাশকে বিনাশ করবার জন্য অবিনশ্বর হ'য়ে থাকতে হবে আপনাদের দুনিয়ার বুকে । কেবল লক্ষ্য রাখবেন — বিয়ে - থাওয়ার গােলমালে ভাল ছােপগুলি নষ্ট না হয়ে যায় । আর , অনুলােম চালাতে গিয়ে যেন অজ্ঞাতে প্রতিলােমের কারণ ঘটাবেন না , চাইতে বরং সবর্ণ বিয়ে ভাল ।
কেষ্টদা - অনুলােম চালাতে গিয়ে প্রতিলােম ঘটান বলতে আপনি কী বলছেন , তা বুঝতে পারছি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ধরেন , এই যশােহরের সুরেনরা , দেশে ওদের বলে নমঃশুদ্র , লােকে ভাবে ওরা শুদ্র , কিন্তু তা তাে নয় , ওরা হ'লাে পারশব বিপ্র , বামুনের রক্ত ওদের গায় , ওদের মেয়ে যদি কায়স্থের ঘরে যায় , তাহলে তা ' হবে ডাহা প্রতিলােম । আবার , বিপ্রের ঔরসজাত হ'লেও ওদের মা হ'লাে শুদ্রা , তাই ওদের ছেলেরা ক্ষত্রিয় - কন্যা বা বৈশ্য - কন্যাকে যদি বিয়ে করে , তা'ও হবে প্রতিলোম , কারণ ওদের মাতৃবর্ণ নিম্নতর । এই সবগুলি লক্ষ্য করতে হয় । তা ছাড়া প্রত্যেকটি সম্প্রদায় ও শ্রেণীর ইতিহাস যথাযথভাবে বের করতে হয় । নবশায়কদের প্রত্যেকটি শ্রেণীই বৈশ্য কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে । ওদের মধ্যে উচ্চতর বর্ণের অনুলােম জাত সন্তান থাকাও অসম্ভব নয় । যেমন প্রফুল্ল , শরৎদা এদের দেখলে আমার মনে হয় , হয়তাে এদের মধ্যে বামনাই ছিট থাকতে পারে । কিন্তু আমার মনে হওয়ার দাম কী , যদি শাস্ত্র ও ইতিহাসে নজীর না পাওয়া যায় । আমি প্রফুল্লকে কত কইছি ঘেটে দেখতে , তা ' ও গা - ই করে না । প্রফুল্ল যারা এইসব নিয়ে বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করে , তাদের অনেকের মধ্যেই দেখেছি কেমন যেন একটা inferiority ( হীনম্মন্যতা ) work ( ক্রিয়া ) করে , বামুন সাজার বুদ্ধি । তাই আমার ও ভাল লাগে না , শেষটা আমারও হয়তো ঐ ভাব এসে যেতে পারে । আর , উপরে যত বেশী লােক থাকে সেই তাে ভাল , হাউস মিটিয়ে প্রণাম করা যায় অনেককে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর --- পাগল আর কী ? নিজের সত্যিকার পরিচয়টা জানতে চেষ্টা করার মধ্যে inferiority ( হীনম্মন্যতা ) কোথায় ? আর শুধু তোদেরটাই যে বের করতে বলছি তা তাে নয় , নবশায়কের সবগুলি শাখা সন্ধেই নির্ভরযােগ্য উক্তি ও তথ্য বের করবি । Uncoloured ( অরঙ্গিল ) হ'য়ে research ( গবেষণা ) করে যেমন , তেমনি করবি ।
প্রফুল্ল - আপনি বলার পর থেকে আমি কিছু - কিছু ঘাঁটাঘাঁটি করছি , কিন্তু নানা বইতে নানা বিরােধী উক্তি ও তথ্য পাওয়া যায় । কোন পথ পাওয়া যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —হাতড়াতে - হাতড়াতে clue ( সঙ্কেত ) পেয়ে যাবি । ..... একটু পরে বললেন — চলেন , রােদের মধ্যে যাই , শীতে যেন জমে গিছি । বাইরে এসে কেষ্টদার ঘাড়ে হাত দিয়ে উত্তরমুখী হ'য়ে মাতৃ - মন্দিরের দিকে এগলেন । খানিকটা এগিয়ে দেবুভাইকে বললেন - মােড়াটা নিয়ে আয় তাে কাজলের মা’র ঘর থেকে ।
দেবু , ভাই ( বাগচী ) ছুটে গিয়ে মােড়া এনে পেতে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর রােদপিঠ ক'রে ব'সে রমজানের কাছ থেকে ধান - পানের খবর নিতে লাগলেন ।✅
#Alochona_prosonge_part_3
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_তৃতীয়_খণ্ড
#তৃতীয়_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1


10