★ মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা সম্বন্ধে-৩৮
★ শাস্ত্রবিধিতে অসঙ্গতি দেখা যায় কেন-৩৯
★ ভূত সম্বন্ধে -৩৯
★ কর্মে প্রেরণা-দান-৪০
★ শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৩৯
★ দুঃখ জয়ের পথ-৪০
★ গুরুভক্তিলাভে মাতৃভক্তি ও পিতৃভক্তির স্থান-৪১
★ শ্রীশ্রীঠাকুরের সোহাগ-৪১
★ কুকুরের চরিত্র ও কুকুর পোষা-৪২
[p38- 44]
২০ শে পৌষ , রবিবার , ১৩৪৮ ( ইং ৪/১/৪২ )
জীবনের লক্ষণ সত্তাপােষণী অনুসন্ধিৎসা , তাই জীবনম্বরপ যিনি তাঁর মধ্যে দেখতে পাই অন্তহীন অনুসন্ধিৎসা । শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে বাঁধের ধারে তাসুতে ব'সে আছেন , অনেকেই উপস্থিত আছেন । হারান ( দাস ) ব'লে একটি ছেলে বলল - আমার বাবা ভূতের ওঝা । তিনি অনেক কিছু জানেন এবং ভূতকে দিয়ে অনেক কিছু , করিয়ে নেন । ভূতে দুরারােগ্য রােগীর জন্য ওষুধ পর্যন্ত এনে দেয় এবং তা'তে তারা আরাম হয় ।
ভূতের কার্যকলাপ সম্বন্ধে ছেলেটি অনেক কথা বলল । শ্রীশ্রীঠাকুর প্রশ্ন ক'রে - ক'রে পরম কৌতহলভরে ভূতের গল্প শুনতে লাগলেন , পরে বললেন তাের বাপকে নিয়ে আয় , অমন কত মানুষ খুজি , কার মধ্যে কী আছে কে জানে ?
প্যারীদা ( নন্দী ) - আপনি কি এসব বিশ্বাস করেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - অবিশ্বাস করার মতাে উপযুক্ত কারণ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করাই তাে যুক্তিযুক্ত । অন্ততঃ খােলা মন নিয়ে অনুসন্ধান করায় দোষ কী ? মা’ বলতেন— “ যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই , মিলিলে মিলিতে পারে অমূল্য রতন । দুনিয়ায় কত রকমের অস্তিত্ব আছে , সব কি আমরা জানি ? আর জানি না বলেই কি উড়িয়ে দেব ? বরং জেনে , অধিগত ক'রে সবকিছুকে জীবনের পরিপােষক করে তোলাই তো বুদ্ধিমানের কাজ । গােপাল চলে গেল , গােপাল নানারকম experiment ( পরীক্ষা ) সুর করেছিল । আমার ইচ্ছা করে , মরার পর মানুষের কী অবস্থা হয় , কিভাবে থাকে , কী করে , সেটা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সাহায্যে দেখি ও দেখাই । আমি দেখতে পাব , তােমরা দেখতে পাবে না , এতে আমার সুখ হয় না । সেইজন্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের সাহায্যে দেখা ও দেখাবার কথা বলছি । অনন্ত মরার পর কতবার আমার কাছে এসেছে , কতবার তাকে দেখেছি , শুধু ; অনন্ত কেন আরাে কতজন , কিন্তু আমি দেখলে তো তােদের দেখা হয় না । আমি ভাবি সকলে দেখুক , সকলে বুঝুক --- যদি এর বাস্তব সত্তাই থেকে থাকে ।
অবিনাশদা ( ভট্টাচাৰ্য ) -আপনি কি ভূত দেখেছেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ভূত কাকে কয় তা তাে জানি না । তবে প্রসন্ন সিংহের বাড়ীর ওদিকে একটা সড়াগাছ ছিল , সেই সড়াগাছের ওখানে ভূতের ভয় ছিল ব'লে শুনেছি । একদিন দিনের বেলায় তিনটে - চারটের সময় আমরা কয়েকজন ছেলেপেলে মিলে ঐ সড়াগাছটাকে খুব লাঠিপেটা করলাম , হঠাৎ উপর থেকে এক চাঙ্গাড় ঢিল এসে পড়ল । একটু পরে অন্য দিক থেকে আর একটা ঢিল এসে পড়ল গায়ের কাছে , কিন্তু গায় লাগল না । কোথা থেকে যে ঢিল দুটো আসলাে , কে যে ঢিল দুটো ছুড়লাে , কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না । চারিদিক লক্ষ্য ক'রে দেখলাম , কোন মানুষ যে ঐ ঢিল ছুড়েছিল তা মনে হয় না । তখন আমার মনে হয়েছিল , ভূত বলে যদি কিছু থাকে , এটা তার কাজ হ'তে পারে । আর একদিন সন্ধ্যাবেলায় কেমিক্যালের মাঠে ব’সে আছি । বাদল বৈরাগীর বাড়ীতে খুব ভূতের উৎপাত । সেই সম্বন্ধে কথা হচ্ছে । হঠাৎ ঐ দিক থেকে একটা খােয়া এসে পড়লাে । আমাদের জীবনের ফাঁকে - ফাঁকে অনেক কাণ্ড ঘটে যায় , সে সবগুলি ঠিকমতাে pursue ( অনুসরণ ) করতে পারি না , observe ( পৰ্যবেক্ষণ ) করতে পারি না , তাই বহু , রহস্য আমাদের কাছে অনুদ্ঘটিত থেকে যায় । গাছ থেকে মাটিতে আপেল পড়তে তাে কত লােক দেখেছে , কিন্তু নিউটনের মনে এইটে একটা প্রশ্ন হ'য়ে দেখা দিল । তিনি এই নিয়ে গবেষণা করলেন , তার ফলে আবিস্কৃত হ'লাে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব । বৈজ্ঞানিক গবেষণা যতই হ'য়ে থাক , এখনও কিছুই হয়নি , আরাের সম্ভাবনা রয়েছে অফুরন্ত , আর এ চিরকাল থাকবেই । প্রত্যেকটা দিকেই অনেক কিছু , করবার আছে । ধর্ম্মাশ্রিত বিজ্ঞানের সাহায্যে পৃথিবীর রােগ , দারিদ্র্য , অজ্ঞতা , চরিত্র ও হৃদয়ের দৈন্য অদূর ভবিষ্যতে অনেকখানি দূর ক’রে দেওয়া সম্ভব । আমাদের বর্ণাশ্রম , আমাদের বিবাহনীতি এগুলিও বিজ্ঞানের সন্ধিৎসু , গবেষণারই ফল । এই মূল বিজ্ঞানের ফলে জাতি একদিন কত বড় হয়ে উঠেছিল । আমরা এ সবের তাৎপৰ্য্য ভুলতে বসেছি । সেইজন্যই তো মাথাওয়ালা লােক চাই , যারা দুনিয়ার সামনে ধৃতি বা ধৰ্ম্মকৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারে , আবার তাদের নিজেদেরও চাই এগুলি আচরণে ফুটিয়ে তােলা ।
প্রফুল্ল ( দাস ) -মনুসংহিতা ও অন্যান্য সংহিতার সব বিধান তাে মেনে নেওয়া যায় না এবং সব জায়গায় যুক্তিযুক্ততাও বােঝা যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - আগামাথা , কার্য্যকারণ ও প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বুঝতে গেলে অমনতরই মনে হবার কথা । কিন্তু একটু তলিয়ে বুঝতে গেলে দেখতে পাবে , যা আছে তা ' ঠিকই আছে - দেশ - কাল - পাত্রানুগ পরিপ্রেক্ষিতে , অবশ্য সামগ্রিকের সঙ্গে সঙ্গতিহারা প্রক্ষিপ্ত যদি কিছু থাকে , তা’ বাদে । এ বাবা বিধির দলিল , ঋষির বিধান , এর মধ্যে গরমিল পাবে না । আমাদের একটা মুশকিল হয় কি জান ? আমরা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সব একাকার করে ভাবতে অভ্যস্ত , কিন্তু আমাদের শাস্ত্রের মস্ত কথা হলাে বৈশিষ্ট্যের সংরক্ষণ ও পােষণ , সেই দিক দিয়ে যদি চিন্তা না কর , তাহ’লে সমাধানী সূত্ৰ খুজে পাবে না ।
নদীয়া থেকে সরেনদা ( বিশ্বাস ) ব'লে একজন এসেছেন , তিনি নিজের দুঃখ - কষ্ট , অভাব - অভিযােগের কাহিনী বিবৃত ক’রে শ্রীশ্রীঠাকুরকে কাতরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন - ঠাকুর ! আমার অবস্থার কি পরিবর্তন হবে ? আমি কি সুখের মুখ দেখতে পাব ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( জোরের সঙ্গে পরিবর্তন করতেই হবে । তাের হাতের মধ্যেই সব । আর , তাের ভাবনা কী ? তুই তাে পথে আ'সে গিছিস । পরমপিতার নাম পাইছিস । এইবার যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি কর , -তাঁকে ভালবেসে নিজের দুঃখের কথা ভুলে যা । তাঁকে পাইছিস , এতবড় সুখের মধ্যে দুঃখের কথা কি মনে থাকে । সেই সুখের কথাই ক ’ মানুষকে , মানুষকে সুখী কর , সেবা দে , যাতে মানুষের উপকার হয় , ফিঙ্গে হ'য়ে লেগে তাই কর । হাতের কাছে যাকে পাবি , তাকেই পরমপিতার ভাবে ভরপূর ক'রে দিবি ।............ তােদের আবার দুঃখ , অভাব ? ও - কথা আমার বিশ্বাস করতেই ইচ্ছা হয় না । মনে হয় , ঐ কথা বলার অভ্যাস আছে , তাই বলিস , ব্যাপার তা ' নয় । আবার ভাবি দুঃখকেই হয়তাে ভালবাসিস , তার হাত থেকে মুক্তি চাস না , মুখে শুধু বলিস— “ দুঃখ যাবে কি করে ? ' মােট কথা , যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি যে আন্তরিকতার সঙ্গে করে , মানুষের আপদে , বিপদে , দুঃখে , কষ্টে যে সাধ্যমতাে করে , বাধাবিঘ্নে যে ডরায় না, যে খানিকটা পরিশ্রমী , যার স্বাস্থ্য মােটামুটি চলনসই , সে অভাব - পীড়িত হ'য়ে হাহাকার করে বেড়াবে - এ হতেই পারে না । কিছুদিন এই চলনে চললে তার অবস্থা ফিরতে বাধ্য , আমি কাগজে - কলমে লিখে দিতে পারি ।......... আমি ভাবি , একটা খাঁটি সৎসঙ্গী যদি একটা গ্রামে থাকে , সে তার গ্রামের একটা লোককেও দৈন্যগ্রস্ত থাকতে দেবে কেন ? মানুষকে কতখানি দৈন্যমুক্ত করলি , সেই খবরই তােদের কাছ থেকে শুনতে চাই । ঐ ধান্ধা যেন এতখানি প্রবল হয় , যার কাছে নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ তুচ্ছ হয়ে যায় । সুখের কথা বলছিলি , এই - ই কিন্তু সুখের প্রাণ , মনে করলে এই মহূর্ত্ত থেকেই তুই এই মহাসুখের অধিকারী হতে পারিস । কী বলিস ? এ - কথা মনে ধরে ?
সুরেনদা পারি না - পরিকল্পনা করতেও ভাল লাগে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( উত্তেজিত কন্ঠে ) - যা তােরা । পারবি না , তা আমি কখনও করতে বলি না তোদের । কতকগুলি গাল - ভরা দার্শনিক কথা বলার অভ্যাসও আমার নেই । তোমাদের সুবিধাটা আমার একটা গরজ - বিশেষ , না হ’লে নিজেই কষ্ট পাই , সেই দায়ে আমার প্রাণ চুইয়ে কথাগুলি বেরোইছে । যা ' কইছি -এর চাইতে সহজ সরল পথ আর হয় না , এতে একসঙ্গে ধর্ম্ম , অর্থ , কাম , মােক্ষ । এর পরেও যদি কেউ না - পারার কথা কও , আমার ভারি কষ্ট লাগে । ( শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখ - মুখ আন্তরিকতায় ছলছল ক’রে উঠলাে , কণ্ঠে অনুরণিত হ’য়ে উঠলাে মমতাদীপ্ত আকুল আবেদন । )
সুরেনদা — আপনার দয়ায় ঠিক পারব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( হাসিমুখে ) -মিনমিনের মতাে ক'স কেন ? জোর গলায় ক ' । সুরেনদা ঐ কথা আবার বললেন , স্পষ্ট ক’রে জোরের সঙ্গে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তখন হাসতে - হাসতে বললেন — এক - একটা বলদ থাকে , ইচ্ছা করলে খুব দ্রুতবেগে লাঙ্গল টানতে পারে , কিন্তু তা ' টানে না , ঢিমে - তেতালা চলে । কৃষাণ তখন লেজে এমন ক'রে মােড়া মারে যে বলদ চেতে ওঠে । তােদের অনেকের বেলাও সেইরকম দেখি । তােরা পারিস সব , কিন্তু ইচ্ছা ক'রে চেতিস না। এতে আমার খাটুনি বেড়ে যায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসন্ন বদনে সবার মুখের দিকে চেয়ে একটা নিবিড় তৃপ্তি সঞ্চারিত ক'রে দিচ্ছেন প্রাণে - প্রাণে , সবার বুক ভ'রে উঠেছে অনির্ব্বচনীয় সুখ - সন্দীপনায় ।
অরুণকে ( জোয়ার্দ্দার ) একটা বই হাতে ক’রে নিয়ে আসতে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর সোল্লাসে বললেন -- কী রে ?
অরুণ — এটা গ্রামার ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সরােজিনীমার দিকে চেয়ে বললেন — ওর হাঁটাচলা , রকম - সকম দেখে মনে হয় , এখন পড়াশুনাে ওর ভাল লাগছে ।
সরােজিনীমা -আপনার হাতে মার খাওয়ার পর থেকে ও বদলে গেছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - তাের ' পর নেশা আছে ওর খুব । এই নেশা যদি ঠিক থাকে , তবে দিন - দিন আরাে ভাল হবে ।
সরােজিনীমা - আমার উপর নেশায় আর কতটুকু ভাল হবে ? আপনার উপর নেশা থাকলেই মানুষ হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- তোমার উপর নেশা না থাকলে আমার উপর নেশা হ'তে পারে মাতৃভক্তি নেই , পিতৃভক্তি নেই , অথচ গুরুভঙি- এ খুব কমই দেখতে পাবে । যদি দেখ , তাও সন্দেহ করাে-- সে ভক্তি আসল না , নকল । তবে এমন হ'তে পারে যে মা - বাপের ভুলের দুরন তাদের প্রতি শ্রদ্ধাটা বিব্রত ও বােঝা হ’য়ে রয়েছে , এবং সদগুরুর সান্নিধ্যে গুরুভক্তি , মাতৃভক্তি ও পিতৃভক্তি একই সঙ্গে সম্বেগবান হ'য়ে উঠেছে । ‘এক তরী করে পারাপার ।’ ভবসাগর সুখে পাড়ি দেওয়ার নিরাপদ তরণীই হচ্ছে ঐ শ্রদ্ধা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তক্তপােষের উপর আসনগেড়ে ব’সে সামনের দিকে ঝুকে কথা বলছেন । বসার মধ্যে , কথার মধ্যে একটা পরম অন্তরঙ্গতার সুর ।
তপোবনের একটি ছাত্র কুকুর পুষতে ভালবাসে , সে এসেছে , সঙ্গে - সঙ্গে তার কুকুরটিও এসেছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এটা বুঝি তাের কুকুর ?
ছেলেটি — হ্যাঁ । একরকম আমার । আমার পাছে - পাছে ঘােরে — আমি খেতে না দিলে খেতে চায় না । আমাকে দেখা অবধি কুকুরটা আমার পিছু নিয়েছে । বাড়ীতে আমার ভাল কুকুর আছে । সেটাও আমাকে খুব ভালবাসে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তুই ভালবাসিস কিনা , তাই তােকে ভালবাসে । কুকুর পােষা খুব ভাল । আমারও কুকুরের উপর খুব ঝোঁক ছিল । কুকুরকে পােষ মানাতে গিয়ে নিজেরও অনেকখানি শিক্ষা হয় । আমাদের যত বড়কে মানার বুদ্ধি থাকে , অন্যেও তত আমাদের মানে , এমন - কি ইতর জীবজন্তু পৰ্য্যন্ত । এইসব জীবজন্তু ভাল করে পােষ মানাতে গেলে ভাল করে লক্ষ্য করতে হয় , এদের মেজাজ কখন কেমন থাকে , চাহিদা ও প্রয়ােজন কখন কেমন হয় , ইত্যাদি । এরা তাে কথা বলতে পারে না । চোখ - মুখ ও চেহারা দেখে বুঝে নিতে হয় । কুকুর - বিড়ালের চরিত্র যদি এইভাবে পড়া থাকে , মানুষের চরিত্র পড়ে নিতেও তােমার দেরী লাগবে না ।......... কুকুর পুষতে গেলে সেইরকম কুকুর পুষতে হয় , যার জাত ও বংশ খুব ভাল । ভাল জাতের , ভাল বংশের কুকুর কখনও বিশ্বাসঘাতক হয় না । সে কোন লােভানিতে ভােলে না । যে লােভ দেখাতে যায় , তারই বরং টুটি চেপে ধরে । অনেক কুকুর আছে , যাদের এক টুকরাে মাংসের লোভ দেখিয়ে চোরে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে । কিন্তু pedigreed dog অর্থাৎ ভাল কুকুর যেগুলি , তাদের কাছে তা কখনই সম্ভব নয় । তারা জান দেবে , কিন্তু নেমকহারামী করবে না , প্রভুর কোন ক্ষতি হতে দেবে না । ওগুলির মধ্যে ভক্তি - ভালবাসার একটা অকৃত্রিম রূপ দেখা যায় । যেমন বাধ্য , তেমনি পরাক্রমী , যেমন সংযত , তেমনি তেজী ।
ছেলেটি বললো - বাড়ীতে নিজের কুকুরটা ছেড়ে এসে কুকুরটার জন্য আমার মন কেমন করতাে । কিন্তু এই কুকুরটাকে পেয়ে এখন আর তত খারাপ লাগে না। তবে ভাবি , আমি যখন পরীক্ষা দিয়ে এখান থেকে চ'লে যাব , তখন তাে এর মন খারাপ হয়ে যাবে , আর কে - ই বা একে খাওয়াবে , যত্ন নেবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - যাওয়ার আগে তাের মতাে কাউকে ঠিক করে দিয়ে যাস , যা'তে ওর অযত্ন না হয় । তোর মতাে কুকুর ভালবাসে এমন কারও উপর ভার দিয়ে যাবি , আর তুই থাকতে - থাকতে তার সঙ্গে ভাব করে দিবি । তখন তার -দিয়েই কুকুরটা তোকে পাবে , তাের ছেড়ে - যাওয়ার কষ্টটা ওর তত লাগবে না ।
ছেলেটি শ্রীশ্রীঠাকুরক প্রণাম করে চলে গেল ।
আশ্রমের প্রতি স্থানীয় অনেকের বিরুদ্ধ মনােভাবের বি়ষয় কথা উঠলাে । একটি দাদা এই প্রসঙ্গে বললেন - যাদের প্রকৃতি খারাপ , তারা সৎ - এর বিরুদ্ধে
না লেগেই পারে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যারা অহঙ্কারী , প্রভুত্বকামী , ঈর্ষা ও দ্বেষ - পরায়ণ , তাদের নিয়েও চলার রীতি আছে । সেই রীতি যদি আমরা না জানি , তাহলে কেবল অন্যের ঘাড়ে দোষ দিলে চলবে না । একসময় ছিল , যখন আমি গ্রামের সবার সঙ্গে মিশতাম , সবার বাড়ী যেতাম , সবার খোঁজ - খবর নিতাম , তাতে মানুষ তুষ্ট থাকতাে । কিন্তু পরে আমি এদিকে লােকজন নানা ঝামেলা নিয়ে এতই ব্যাপৃত হয়ে পড়লাম যে , গ্রামের সবার সঙ্গে মেলামেশা করবার আর সে - সুযােগ পেলাম না । আমার হ'য়ে যে তােমরা এটা করবে , তাও তোমরা করলে না , ফলে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে পড়লাম । সামাজিক স্তরে মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেলা মেশা করার একটা প্রয়ােজন আছে । নচেৎ তুমি মানুষের যতই ভাল কর না কেন , তা'তে তাদের মন পাবে না । ওতে তাদের inferiority- তে ( হীনম্মন্যতায় ) ঘা লাগবে । তারা ভাববে , তুমি বড় মানুষ হয়েছ , তাই সবাইকে দয়া করছ । কিন্তু বিনীত থেকে তুমি যদি সবার সহানুভূতি কুড়িয়ে নাও , সেইটেই বরং তোমার লাভ । এক সময় ছিল , পাবনার উকিল , মােক্তার , মুহুরী , এমনকি নকল - নবীসরা পৰ্য্যন্ত আমাদের কাজের ব্যাপারে কোন পয়সা নিত না , স্বেচ্ছায় সানন্দে ক'রে দিত , এবং এই করার ভিতর - দিয়ে তারা একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করতো যে , তারা একটা সৎ - প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করছে । পরে আমাদের তরফের যারা , তাদের মধ্যে কেউ - কেউ এমন টাকার গরম দেখাতে লাগল , লােভনি দিতে লাগল — যে এখন আর পয়সা ছাড়া এক - পা চলা যায় না । অন্যে যেটা এক পয়সায় পারে আমাদের সেখানে পাঁচ পয়সা খরচ করতে হয় , তা'ও কাজ উদ্ধার হয় না । মানুষের লোভ আছে , অহমিকা আছে , দ্বেষ , হিংসা , স্বার্থপরতা আছে , আমাদের চালের ভুলে সেইটেকে যদি আরাে উস্কে দেওয়া হয় , তাহলে তাে বিপদ বেড়ে যায় । আর , এই যে অজ্ঞাতসারে উস্কে দেওয়া , এর পিছনেও থাকে নিজেদের স্বার্থবুদ্ধি , নানারকম প্রবৃত্তির কণ্ডূয়ন । মানুষের দোষ তাে আছেই , কিন্তু সেই দোষকে মাথা তুলতে না দেওয়ার মতাে দুরদর্শিতা , কৌশল , চরিত্র , চলন , ব্যবহার , পরাক্রম ও প্রস্তুতি যদি আমাদের না থাকে , তবে তা আমাদের আয়ত্ত করতে হবে তাে । যাজন সর্বত্রই করা লাগে । যেমন কথায় , তেমনি কাজে । আমরা বাইরে এত যাজন ক'রে বেড়াই , কিন্তু এখানে আমাদের যাজন কোথায় ? আর , যাজনের প্রথম কথাই হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সশ্রদ্ধ হৃদ্যতা স্থাপন ।
..........এটা , অবশ্য তােমাদের করণীয় যা ' সেই দিক দিয়ে বলছি , কিন্তু এমন বহু , বিশ্বাসঘাতক আছে , যারা কিছুতেই ছোবল মারতে ছাড়বে না । এই জীবনে কম দাগা পাইনি সে - দিক দিয়ে । কতকগুলি মানুষ এমন আছে , তাদের জন্য যত করা যাবে , তারা ততােধিক ক্ষতি করবে । অনেক সময় ভেবেছি তাদের জন্য আর কিছু করবাে না , তা'তে অন্ততঃ তাদের অত্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতার দৌরাত্ম থেকে খানিকটা রেহাই পাব । কিন্তু যখনই তারা বিপন্ন হ’য়ে পড়ে তখন সব কথা ভুলে যাই । একটা বিহিত করতে না পারলে নিজের প্রাণ যেন আর বাঁচে না । আমার কথা কী কব ? একটা মেয়ে - মানুষেরও আমার থেকে মনের জোর ঢের বেশী । তাই মনে হয় , আমাকে সংরক্ষণ করার ক্ষমতা আমার নেই, আছে তােমাদের ।
10