শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 5
॥ পাঁচ ॥
১৯৪৮ সাল চলছে। এত দিনে বড়াল বাংলোকে কেন্দ্র করে দেওঘরে সৎসঙ্গ আশ্রম বলে একটা নতুন অস্তিত্ব গজিয়ে উঠেছে। বড়াল বাংলোর চত্বরে পাকা বিল্ডিংএর প্রায় সামনাসামনি একটা গোলাকার স্থায়ী তাসু তৈরি হয়েছে, টিনের ছাউনি দিয়ে। ঠাকুর প্রায়ই সেখানে এসে বসেন। এর নাম হয়ে গিয়েছে গোলঘর। এর সবদিকই খোলা, মাঝখানে ঠাকুরের শয়ন বা উপবেশন করার মতো বড়শড়ো তক্তপোশে শুভ্রশুচি-পরিচিত বিছানা।
সেটা ৪৮ সালের শীতকাল। ঠাকুর ঐ গোলঘরে বসে আছেন, বিস্তৃত বিছানায়। আশেপাশে বসে আছেন ভক্তগণ। তাঁদের মধ্যে আছেন ঋত্বিগাচার্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, প্রকাশ বসু, রে আর্চার হাউজারম্যান, তাঁর মা প্রভৃতি গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ।
হাউজারম্যানের মা উপস্থিত আছেন লক্ষ্য করে ঠাকুর আপন মনেই বলতে থাকলেন, একজন খৃষ্টান সবার আগে যিশুকে ভালোবাসবে, আর সেই ভালোবাসার মাধ্যমে সে অন্য সব প্রেরিতপুরুষকে ভালোবাসবে। একজন হিন্দুর উচিত শ্রীকৃষ্ণকে বা যে প্রেরিতকে সে অনুসরণ করে তাঁকে আগে ভালোবাসা। তাঁর মাধ্যমে সে অন্যান্য যাবতীয় প্রেরিতকে ভালোবেসে ফেলবে। কোন প্রেরিতকে বোঝা মানে, তিনি যেমন ছিলেন, সেই ভাবে তাঁকে বোঝা-তাঁর মর্ম চিহ্নিত করা। কোন খৃষ্টান যদি বলে, যিশুকে নয়, আমি মা মেরিকে ভালোবাসি, তাহলে সে মা মেরিকে ভালোবাসে কিনা তাতেই সন্দেহ আছে।
আবার বললেন, কেউ যদি তার নিজধর্মমতের প্রবক্তাকে ঠিকঠিক ভালোবাসে, তাহলে অন্যান্য প্রেরিত পুরুষের প্রতিও তার ভালোবাসা গজাতে বাধ্য। তা না হলে বুঝতে হবে, ঐ ভালেবাসার মধ্যে প্রবৃত্তির খাদ আছে।
এই প্রসঙ্গে আবার যোগ করলেন, অনেক সৎলোক শাস্ত্রের বিকৃত ব্যাখ্যাকারীদের পাল্লায় পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। এর জের টেনে বললেন, শাস্ত্রের বিকৃত ব্যাখ্যা পরিবেষণ করার মতো পাপ খুব কম আছে।
তাই, শাস্ত্র বা ধর্ম গ্রন্থের টীকাটীপ্পনী বা সেই গ্রন্থের কথকের ব্যাখ্যার উপরে নির্ভর না করে মূল শাস্ত্রটি নিজের বুদ্ধিতে বুঝতে চেষ্টা করা বরং ভালো।
একবার নিমাই পণ্ডিতকে এক ভাগবতপাঠক প্রশ্ন করেছিলেন, 'কি বাবা, যা বলছি, তা সব বুঝতে পারছো তো?'
উত্তরে নিমাই বলেছিলেন, 'আজ্ঞে না, আপনার টীপ্পনী আর ব্যাখ্যা ঠিক ধরতে পারছি না, কিন্তু আপনি যখন গ্রন্থের মূল অংশ পড়ছেন, তখন বুঝতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না।'
নিমাইয়ের কাছে মূলগ্রন্থই স্বপ্রতিষ্ঠ, কথকের ব্যাখ্যাই যত গোলমালের কারণ। কারণ তার মধ্যে রয়েছে ব্যাখ্যাতার আপন প্রবৃত্তির মিশেল।
খানিকক্ষণ পরে ঠাকুর রে আর্চারের মাকে বাললেন, আপনি তো প্রোটেষ্ট্যান্ট, তো আপনি কি ক্যাথলিকদের ভালোবাসেন?
রে-জননী উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, ওদের আমি ভালোবাসি। ওদের একটা নিয়ম আমার খুব ভালো লাগে। ওরা সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে ওদের ধর্মযাজকের কাছে কৃতপাপের কথা স্বীকার করে এবং ঈশ্বরের কাছে দীনতা সহকারে ক্ষমাভিক্ষা চায়। এই স্বীকারোক্তি এবং নিজের দৈন্য জ্ঞাপন আমার খুব ভালো লাগে।
রে-জননীর কথায় ঠাকুর চট করে তাঁর তরুণ বয়সের এক ঘটনার স্মৃতি ফিরে পেয়ে সে-সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগলেন।
বললেন, 'মা, আমার ছোটবেলায় একবার ঐ দশা হয়েছিল। আমি ভাবতাম, আমি সর্বশক্তিমান পরমপিতার সন্তান- আমি শুদ্ধবুদ্ধ, নিষ্পাপ, আমারও শক্তি অসীম। আমি জ্যোতির জাতক, আমি নির্ভয়, নিষ্কলঙ্ক ইত্যাদি।'
এই রকম মনোবলে এবং আত্মপ্রসাদের অনুভূতির কালে একদিন দীনতার ভজনকারী এক বৈষ্ণব সাধু আমাকে উপদেশ দিলে, না গো, ঐ ভাবে নিজেকে নিষ্কলুষ এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সন্তান বলে ভাবতে নেই- ওতে অহঙ্কার আসে, পতন ঘটে। বরং বলবে, হে গোবিন্দ, আমি নরাধম, ঘোর পাপিষ্ঠ। আমি বিষ্ঠাতুল্য ঘৃণ্য এবং হীন। তুমি নিজ গুণে আমাকে উদ্ধার না করলে আমার চরম নরক ছাড়া গতি নেই।
এই বৈষ্ণবীয় উপদেশ শুনে আমি তাই করতে লাগলাম। আমি পদ্মার তীর ধরে হাঁটি আর নিজে মহাপাপী, নরাধম এবং ক্ষমারও অযোগ্য বলে ভাবি।
রে-জননী ঠাকুরের নিজ-জীবনের এই কাহিনী নিবিষ্ট চিত্তে শুনে চলেছেন।
শেষকালে কী হলো জানেন? ঠাকুর বিবৃতি দিয়ে চলেছেন।
'আমার ভিতরটা শেষ হয়ে যেতে লাগলো, আমি ফুরিয়ে যেতে বসলাম। আমি যেন চোর, লোকের ঘৃণা কুড়ানোরই যোগ্য।'
'সপ্তা দুই ধরে এই রকম রিহার্সেল দেবার পর একদিন সূর্যাস্তলগ্নে পদ্মার ধারে ঘুরছি, আগে এই রকম সময়ে রক্তলাল সূর্যের দিকে তাকালে এক অপূর্ব আনন্দে ও সৌন্দর্য-বোধে হৃদয় মন ভরে উঠতো, সেদিন কী হলো জানেন?'
'আমি ভিতরে ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে লাগলাম। অপূর্ব মনোরম দৃশ্যে হৃদয়ে কোথায় আনন্দ হবে, তা না আমি ভীত হয়ে শেষ হয়ে যেতে বসলাম। মনে হলো, আমি এখনই হার্ট-ফেলিওরে মারা যাবো। নিরুপায় হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, পরমপিতা, আমি ভুল করেছি, আমাকে মাফ করো-আমি পাপী-তাপী নই, নরাধম নই- আমি সর্বশক্তিমান তোমারই সন্তান আমি পবিত্র, আমি পবিত্র, আমি পবিত্র-আমি অমৃত লোকের অধিকারী, নিষ্কলুষ, বীর্যবান। শরণাগত হয়ে এই রকম বলতে বলতে নিজেকে ফিরে পেলাম- বেঁচে গেলাম।'
বললেন, 'তাই ঠেকে শিখে আমার ধারণা হয়েছে-পাপের কথা বেশি বলা ভালো না। আমি পাপী, আমি নিকৃষ্ট, আমি দুরাশয়-এই রকম চিন্তা করার মধ্যে নিস্তার নেই। বরং ভাবতে হবে, আমরা পরমপিতার সন্তান, আমরা অজর, আমরা অমর। এই স্বতঃ-অনুজ্ঞাই আমাদের শক্তি দিতে পারে-তাঁর পথে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।'
নিজেকে শয়তানের প্রজা ভাবতে নেই। পরমপিতার সন্তান হিসেবে পরমপিতার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে।
সদ্বোধক, অস্তিবোধক, বৃদ্ধিচেতন মনন-সাধনার দরকার আছে অধ্যাত্মজীবনের স্ফুরণের জন্যে। নেতিচিন্তা মরণের পথই দেখিয়ে দেয়।
রে-জননী নতুন এক বিজ্ঞানসম্মত বিধানের সন্ধান পেলেন। সেটা হলো, বদ্ধধারণার বিজ্ঞানসম্মত অননুমোদন।
আলোচনা সভায় কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-সঙ্গ না করলে কি কারও প্রতি শ্রদ্ধাজাগ্রত হয়?
সাক্ষাৎ ইষ্টগুরুর উত্তর- 'শুনে হয়। আবার, বই পড়েও হয়। তবে, যার মুখ থেকে শোনা হচ্ছে, সেই লোক যদি প্রেম-পরায়ণ হয়, তবে খুব ভালো ফল হয়। যিনি কাহিনী শোনাবেন, তিনি প্রেমপরায়ণ হলে অর্থাৎ যাঁর সম্বন্ধে বলছেন, তাঁর প্রতি প্রেমবদ্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে শ্রোতার মনেও সেই প্রেমানুরাগের ছাপ পড়বেই পড়বে। আর সেই কথক যদি তার বক্তব্যের সঙ্গে নিজের চালচলন ও আচরণের সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে, তাহলে শোনার ফল হয় অমোঘ।'
তাই যোগ করে দিলেন, 'প্রকৃত বিশ্বাসী মানুষ তার বিশ্বাসের জোরে অন্যের মনে বিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে পারে।
মোদ্দা কথা এইটা।
সদ্গুরু স্বদেহে বিদ্যমান না থাকলেও এই ভাবেই তাঁর প্রতি মানুষের স্বাভাবিক শ্রদ্ধা জাগ্রত হতে পারে।
আর, বই পড়াও তো বইয়ের অভিলক্ষ্য ব্যক্তির চরিত্র প্রবাহের সঙ্গ করা। এখানে বইয়ের লেখক হলেন বক্তা। তাঁর ইষ্ট-প্রেম এবং ইষ্ট-প্রতিষ্ঠার নেশা ও প্রয়াস তাঁর লিখন শৈলীর ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হবেই। সফল জীবনীকারের জীবনীগ্রন্থ জীবন্ত হয়ে কথা কইতে থাকে পাঠকের সামনে, কথকের আসনে বসে। এমন জীবনী ও জীবনীকারকে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
এই রকম জীবনীগ্রন্থ বাণিজ্যিক সাহিত্য নয়। এ ভাগবত সাহিত্য। আর ভাগবতকার মানেই ভগবদভক্ত- ঈশ্বর প্রেমী।
এমন একখানি গ্রন্থও চিরজীবন্ত, তার লেখকও মৃত্যুঞ্জয়ী।
কথা বলতে বলতে একদিন ঠাকুর বললেন, 'আমি নিজেও অনেক সময় সঙ্কোচে পড়ে যাই-যে-কথাটা খুব জোর দিয়ে বলা উচিৎ, তা আর বলা হয় না। ভদ্রতা রক্ষা করতে গিয়ে মানুষকে বাঁচার রাস্তায় চালাতে পারি না।'
'সে আবার কেমন?' ভক্তদের জিজ্ঞাসা।
'এই দেশবন্ধুর কথাই ধরো না কেন। তাঁর অনুরাগী ভক্তরা রোগমুক্তির জন্যে তাঁকে দার্জিলিং নিয়ে গিয়ে রাখার জন্যে সব ঠিক করে ফেলেছে। তাদের ধারণা, ওখানকার স্বাস্থ্যকর জলবায়ুতে যক্ষ্মারোগের উপশম হবে-তিনি আবার সেরে উঠবেন। আমার ধারণা ছিল, অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে গুরুসান্নিধ্যে গুরুগৃহে বাসই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। দাশদার রাজনৈতিক চেলাদের দৃঢ়সংকল্পের জন্যে আমার প্রস্তাবটা মৃদুভাষায় বলেই নিবৃত্ত হতে হলো। যতটুকু চাপ দিয়ে তা করা সম্ভব হলেও হতে পারতো, তা আর সম্ভব হলো না। হতাশ হয়ে রশি ছেড়ে দিতে হলো।'
'আবার মুক্তাগাছার জমিদার যতীন আচার্যির কথা ধরো। সেই রাত্রে তার পিছনে যম ঘুরছিল। আমি সব দেখতে পাচ্ছি, সব বুঝতে পারছি, কিন্তু তাকে হাজার রকমে বুঝিয়েও নিবৃত্ত করতে পারলাম না। এক এক সময়ে ইচ্ছে হচ্ছিল, তার মোটর গাড়ি বিকল করে দিয়ে তাকে আটকিয়ে রাখি। কিন্তু সব কি করা যায়? যেখানে বাঁচার প্রতি মানুষের এত অনিচ্ছা, সেখানে বোধ হয় এমনি ভাবেই হাতের থেকে হ্যান্ডেল কেড়ে নেয়-কিছুই করতে পারি না, অসহায় হয়ে পড়ি।'
বললেন, 'আমার অসহায় অবস্থা তোমরা বুঝবে না।'
মরণকে বেইজ্জৎ করতে তিনি পারেন- তাকে তার থাবা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করার কৌশল তিনি জানেন, কিন্তু মানুষ তাঁকে সে কায়দা খাটাবার সুযোগ দেয় না। এই কথাটাই পরিষ্কার প্রকাশ করলেন জীবনসাধক ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
হিমাইতপুর থাকার কালে কতবার প্রকাশ করেছেন এই কষ্টকর অসহায় অবস্থার কথা। দেওঘরে এসেও সে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের পীড়া সমানভাবে যন্ত্রণা দিয়ে চলেছে এখনও। মানুষের জন্যেই মানুষের-ভগবানের চোখের জল শুকনো হয় না। ✅
10