শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 6
॥ ছয় ৷।
নোয়াখালি জেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের ছেলে প্রভাত মজুমদার। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেছিল নোয়াখালি জেলায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে বোঝায় সমান সমান দু'পক্ষের হননমুখী লড়াই। এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তা নয়। আসলে এটা দাঙ্গাই নয়। এক পক্ষকে মার দিচ্ছে আর একপক্ষ। দুর্বল অসংগঠিত হিন্দুরা মার খাচ্ছে সংখ্যাগুরু ধর্মদ্বেষী মুসলমানদের হাতে। এ কথার অর্থ এই নয় যে, সব মুসলমানই ধর্মদ্বেষী আর সব হিন্দুরা সব মুসলমানের হাতে মার খাচ্ছে। ঘটনা ঘটেছিল এই রকম যে, সাধারণ হিন্দুরা পাইকারি হারে হিংসার শিকার হয়েছিল সেই সব মুসলমানদের হাতে যারা পরধর্মদ্বেষকে নিজের ধর্মের অঙ্গ বলে বুঝে নিয়েছিল। কী দুর্ভাগ্য এই মানবজাতির।
যে কথা হচ্ছিল। প্রভাত মজুমদার শিকার হয়েছিলেন এই ধর্মদ্বেষী ভ্রাতৃমারণের। ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে এসে সেই ইষ্টপ্রাণ-শিষ্য গল্প করে বলছিলেন, কেমন ভাবে তিনি গুরুর দয়ায় অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন শ্রীগুরুর শ্রীচরণপ্রান্তে।
কথা হচ্ছে জীবন রক্ষার প্রায় দু'বছর পরে দেওঘরে বড়াল বাংলোয় বসে। শুনে ঠাকুর বললেন, দ্যাখো প্রভাত, ইষ্টপ্রাণতার জোরে এই রকমই হয়। শুনেছি, বাইবেলেও প্রভুপ্রেমের এই দৈব শক্তির কথা বলা আছে। সেখানেও এই নামের অস্তিত্বেরও উল্লেখ আছে। আর বলা আছে, এই নামের আওতায় যারা আসবে, তারা নামমাহাত্ম্যের জোরে সকল আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। আমরা একেই জানি পরমপিতার দয়া বলে।
গল্পের মাঝে প্রভাত মজুমদার স্বীকার করলেন, সেই মারণাঘাতের একেবারে মুখোমুখি হয়ে মৃত্যুর শীতল সান্নিধ্যের মধ্যেও দেখতে পেয়েছিলেন করুণাময় ইষ্টদেবের সহাস্য শ্রীমুখখানি এবং তাঁর সম্প্রসারিত বরাভয়-হস্তের ছত্রচ্ছায়া। সেই মুহূর্তের স্মৃতি ভোলবার নয়।
স্মিতবদনে সব শুনলেন ঠাকুর। বললেন, এই রকমই হয়। ঐটাই পরমপিতার দয়া- তাঁর স্নেহল রূপের আভাস।
নোয়াখালি কিলিং ছিল ক্যালকাটা কিলিং এরই সহোদর ভাই। ঘটনার বিশদ বিবরণ শুনে ঠাকুর বললেন, এ তো দেখছি, ভক্ত প্রহ্লাদের চেয়েও কঠিন পরীক্ষায় পাস করে আইছে। দয়ালের দয়ায় এই রকমই হয়।
একটা দরকারি কথার জবাব পাওয়া গেল একদিন দেওঘরে বসে। স্বস্তিসেবক বাহিনীর সেই কর্মকর্তা শরৎ-চন্দ্র কর্মকার রামকানালিতে সৎসঙ্গের কলোনি করার উদ্দেশ্যে মাথাপিছু ২৫০ টাকা করে অনুদান ভিক্ষার ব্যাপারে গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'নন্-সৎসঙ্গীদের কাছ থেকে এই টাকা নেওয়া যাবে তো?'
ঠাকুর উত্তরে বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, তা নেওয়া যাবে-সকলের কাছ থেকেই নেওয়া যাবে। তবে, তুমি ঐ যে নন্-সৎসঙ্গী বললে, ঐ বলাটা ঠিক হলো না। বলতে পারতে নন্-ইনিশিয়েটেড অর্থাৎ- এখনও দীক্ষা হয়নি, এমন। সৎসঙ্গী নয় কে? 'সৎ' অর্থাৎ জীবনবৃদ্ধির অনুরাগী যারা- সৎ মানুষের সঙ্গ যারা করে, তারা তো সকলেই সৎসঙ্গী। তুমি দীক্ষিত এবং অদীক্ষিত- এই ভাবে উল্লেখ করতে পারো।'
মানুষের মনে একটা প্রশ্ন ছিল, সেটা উঠে গেল।
বাইবেলে পাওয়া যায়, এক সময়ে যোহন বলেছিলেন, আদিতে বাক্য ছিলেন, বাক্য ঈশ্বরের কাছে ছিলেন-বাক্যই ঈশ্বর ছিলেন (এই বক্ই আদি নাদ) এর থেকেই যাবতীয় সৃষ্টি।
দেওঘরে বসে এই কথাটি ঠাকুর আর একবার বললেন। বললেন তাঁর মতো করে। বললেন, 'শব্দই আচরণের মধ্য দিয়ে জীবন হয়ে ফুটে উঠলো- রক্ত এবং মাংসের রূপ গ্রহণ করলো। সুতরাং, বলা যায়, বাক্য ও আচরণই মানুষের জীবন ও অস্তিত্বরূপে ফুটে উঠেছে।'
ব্যাখ্যাসূত্রে যোগ করলেন, 'মানুষ যে আজ মানুষ হয়ে উঠেছে, তার পিছনেও আছে আদি বাকের অজস্র আচরণ অর্থাৎ আচলন-মানে সম্যক চলনের অশেষ-বিধ রকম-ফের।'
পরম বাক্ বা ধ্বনির এই ঘোলা-ঘাঁটার নামই বিবর্তন। জীব হোক বা বস্তু হোক আদিধ্বনির এই আত্ম-বর্তনের নিরন্তরতার ফলেই তাদের উদ্ভব সম্ভব হয়েছে।
একে আদি-চৈতন্যের বিস্ফোরণও বলা যায়।
আদি চৈতন্যই পরম প্রাণ। তিনি আছেনই। তবে আদি-কালের সেই আত্মানুভূতি বা অস্মিতার মধ্যে ছিল একটা অসন্তোষ। এ হলো একাকীত্বের অসন্তোষ। আমার আত্মপ্রকাশন-লীলার কোন সহভোক্তা নেই-এই অভাববোধ থেকেই জাত হলো এক অব্যক্ত যাতনা। সেই যাতনা থেকে জাগ্রত হলো পরা-চৈতন্যশক্তির বুকে নবতর বেদনার আর এক বিঘূর্ণন-আকর্ষণ এবং বিতাড়ন। নানাবিধ মাপের চৈতন্য পরমাণু ও পরপরমাণুদের চাপাচাপি এবং বিচ্ছুরণ-অর্থাৎ আকর্ষণ এবং বিতাড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল সঙ্গীহীন অস্মিতার বুকে আত্ম-বিভাজনের এক মহোৎসব।
এই হলো আদিবাক্ বা আদি-নাদের আচরণ। একের বেদনা থেকেই অনেকের সত্তার নকশা। একে বলা যায় জগদ্ব্যাপী এক রমরমা আত্মরমণের রভসোল্লাস।
একবার আগ্রা সৎসঙ্গের এক সৎসঙ্গী এসেছেন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। হুজুর মহারাজের আদরের কন্যা সুশীলা-মা অর্থাৎ মনোমোহিনী দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান তথা প্রথম পুত্র বাংলা সৎসঙ্গের প্রাণ-পুরুষ ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নাম শুনছেন অনেক দিন থেকেই, এবার দেখা পাওয়ার সুযোগ পেয়ে কলকাতা থেকে চলে এসেছেন দেওঘরে। ভদ্রলোক যুনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক-এর কলকাতাস্থিত আঞ্চলিক অফিসের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি এসে বিনীত প্রণাম নিবেদন করে তাঁর পরিচয় দান করলেন। তিনি আগ্রার সৎসঙ্গী শুনে ঠাকুর অতিশয় আদরসহকারে তাঁকে গ্রহণ করে সেখানকার সৎসঙ্গের খবরাদি শুনলেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত কুশল বার্তা জানতে চাইলেন অতি স্নেহের আপনজন হিসাবে।
কথা প্রসঙ্গে ঠাকুর বললেন, 'আমার এই ভাবনা চিন্তাগুলি যদি আপনি শোনেন এবং আপনার গুরু-ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু মত প্রকাশ করেন, তো খুব ভালো লাগবে।' এই বলে অনুলেখক প্রুফুল্ল দাস-মশাইকে ইংরেজি বাণী থেকে কিছু পড়ে শোনাতে বললেন। দাসমশাইকে বলে দিলেন, 'ওঁকে শুনিয়ে ওঁকে দিয়ে ঠিক করিয়ে নাও।'
এই কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন, 'সন্ত-পুরুষের বাণী চিরকালই ঠিক থাকে- তাকে আর ঠিক করতে হয় না। আমাদের কাজ হলো আপনাদের মতো গুরুমুখ-প্রাপ্ত সেই উপদেশ গুলি মেনে চলা।'
সেদিন সন্ধ্যায় ঠাকুরের সামনেই উক্ত পশ্চিমদেশীয় সৎসঙ্গী ভদ্রলোককে নিয়ে সৎসঙ্গ করা হলো। তাতে সুরেশ মুখোপাধ্যায়, হরিদাস ভট্টাচার্য ইত্যাদি কয়েকজন আগ্রা সৎসঙ্গের বাঙালি শিষ্যও উপস্থিত ছিলেন।
প্রথমে আহ্বানী দিয়ে তৎপর যথারীতি বিনতিগীতি সমাপনান্তে আচমনিক অভিভাবন এবং পুরুষোত্তমবন্দনা ইত্যাদি সহ প্রথামত সৎসঙ্গে'র মন্ত্রোচ্চারণ-অংশ সমাপ্ত হলো। তারপর শ্রীশ্রীঠাকুর লিখিত সত্যানুসরণ থেকে পাঠ হলো। হিন্দী পুস্তক থেকেও কিছু পাঠ করা হলো। অনুষ্ঠান-চলাকালে রমেশ চক্রবর্তী হঠাৎ করে উচ্চৈঃস্বরে ঠাকুরের প্রণামমন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন। তাতে করে ঠাকুর মহা অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন।
পরে এই নিয়ে বললেন, যে-আসরে সন্ত সদ্গুরুদের বাণী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, হুজুর মহারাজের উপদেশ নিয়ে চর্চা চলছে, সেখানে হঠাৎ করে আমার প্রশস্তি নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলে-সাধারণ বোধটুকু পর্যন্ত লোপ পেয়েছে। তাও আবার একজন ঐ-দেশীয় গুরু ভাইয়ের সামনে। মনে রাখবে, কখনও এরকম কর্ম করবে না। আমাকে এ-ভাবে অপমান করার অধিকার তোমাদের দেওয়া হয়নি। কী মজা দ্যাখো, হুজুর মহারাজের বই পড়া হচ্ছে, তার মধ্যে আমারই সামনে 'সত্যানুসরণ' পাঠ করা শুরু করে দিলো! আবার আমারই সামনে পুরুষোত্তমবন্দনা পাঠ আরম্ভ হলো। আমাকে আমার সতীর্থদের সামনে আর কী রকমভাবে ছোট করা চলতো? তোমাদের এটাও জানা নেই, ঐ পুরুষোত্তমবন্দনা কেষ্টদার আগ্রহাতিশয্যে আমি কেমন করে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ওর পিছনে আমার কত অমত এবং কত অস্বস্তি। আমার সামনে কাউকে যাজন করাও আমি সহ্য করতে পারি না। তোমরা যেরকম ভাবে সৎসঙ্গ করো, তাও আমার সামনে করা ঠিক না।
জেনে রাখো ঐ প্রশংসায় আমি খুশি হই না। আমাকে যদি প্রশংসা করতেই হয়, সেটা করবে তোমাদের কাজের ভিতর দিয়ে, তোমাদের চরিত্রের ভিতর দিয়ে, তোমাদের অর্জিত সৌজন্যের ভিতর দিয়ে। তোমরা প্রশংসনীয় কাজ করলে এবং তার মধ্য দিয়ে যদি তোমরা প্রশংসিত হও, একমাত্র তখনই আমি আত্মপ্রসাদ লাভ করি। তোমরা জনকল্যাণের কাজ নিয়ে লোকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ো, হাজার মানুষের হাজার মুখে তোমাদের প্রশংসা রটতে থাকুক, দেখবে,
তখন আমার কী আনন্দ! আমার তোয়াজে আমি খুশি হই না-বিরক্ত হই, নিজেকে খুব ছোট মনে করি। এই সব মনে রেখে চলবে।
প্রখ্যাত আইনজ্ঞ এবং নিষ্ঠাবান্ হিন্দুসংগঠক শ্রীযুক্ত নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মশাই ইদানীং ঠাকুরের ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর ব্যক্তিসান্নিধ্যের প্রতিও আসক্ত হয়েছেন। কিছুকাল থেকে তিনি হার্টের অসুখে ভুগছেন। ঠাকুরের সান্নিধ্যে আশ্রমে কিছু কাল কাটিয়ে যাবার ইচ্ছে হয়েছে তাঁর। সস্ত্রীকই থাকবেন। সেই মর্মে তিনি সুশীল বসুর কাছে মনোভাব ব্যক্ত করায়, বসুমশাই সেই খবর পাঠিয়েছেন ঠাকুরের কাছে। সেই চিঠি এসেছে আশ্রমে। তদনুসারে আশ্রমের চৌহদ্দিতে রঙ্গনভিলায় নির্মলবাবুর অবস্থানের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, তিনি তাহলে সহজেই বড়াল-বাংলোয় এসে ঠাকুরের কাছে বসতে পারবেন আবার ঠাকুরও প্রয়োজন হলেই তার ঘরে গিয়ে তাঁর খোঁজখবর নিতে পারেন।
দেশসেবক নির্মলবাবু সকলের কাছে এন. সি. চ্যাটার্জি নামেই পরিচিত ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। পড়াশুনো করতে বিলেত যাবার সময়ে তিনি যখন স্যার আশুতোষকে প্রণাম করতে যান, তখন বাংলার বাঘ তাঁকে এই বলে আশীর্বাদ করেছিলেন, বিলেত যাচ্ছো পড়তে-খুব ভালো কথা, কিন্তু তোমাকে আমার মুখ রাখতে হবে। তোমার পরীক্ষায় ফাস্ট হতে হবে।
নির্মলচন্দ্রেরও বিশ্বাস ছিল, ওটা এমন কিছু নয়-ফাস্ট তিনি হতেই পারবেন।
কিন্তু পরীক্ষার মাঝখানে নির্মলচন্দ্র মারাত্মক রকম অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক রকম বাহ্যিক জ্ঞানহারা অবস্থায় তিনি পরীক্ষার বাকি বিষয়গুলি লিখেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, তাতেও তিনি প্রথম স্থানাধিকারী হয়েছেন।
সেই এন.সি. চ্যাটার্জি এসে থাকতে চান শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে- দেওঘর আশ্রমে।✅
10