সতীশচন্দ্র জোয়ারদার :-
🔷 পাঁচজনের ব্যবস্থায় ত্রিশ চল্লিশ জনের পূর্ণ ভোজন সমাধা হল
🔷 মানুষটির ভালবাসা মুগ্ধকর, কিন্তু অবতার বলে বোঝা যাবে কী করে?
🔷 সতীশচন্দ্র তাঁর কাছে ওষুধ চাইলে তিনি ‘আঃ, ভুলে যান’-এই বলে ব্যথার জায়গাটি স্পর্শ করা মাত্র ব্যথার আর লেশমাত্র থাকল না....
🔷 রাত্রে যিনি স্বপ্নে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, ইনিই তিনি...
🔷 সতীশচন্দ্রের স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ, প্রাণের কোন আশা নেই। তার পর....
🔷 সতীশচন্দ্র কে ঠাকুর অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালেন...
'অভাবে পরিশ্রান্ত মনই ধর্ম বা ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা করে,' -শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের এই অমোঘ উক্তি তাঁর স্বজ্ঞাপ্রসূত। এবং অভাব এক অর্থে মনুষ্যস্বভাব। সর্বপ্রকার বস্তুগত প্রাপ্তির মধ্যেও আরও কিছুর অভাব মানুষকে অস্থির করে তোলে। 'ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর'। আর যে-মুহূর্তে সেই পরশমণির সন্ধান পাওয়া যায়, সুবর্ণের শাশ্বত উজ্জলতায় রূপান্তরিত হয় সকল অসংগতির মালিন্য, ধন্য হয়, সার্থক হয় নরজীবন এই মরলোকের সীমানায়। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সান্নিধ্য ও কৃপার পরশমণির ছোঁয়ায় আত্মানুসন্ধানের উদ্বেলতা থেকে প্রত্যয়ের দৃঢ়তায় উত্তীর্ণ এমনই এক জীবন পেয়েছিলেন সতীশচন্দ্র জোয়ারদার।
সতীশচন্দ্র জোয়ারদারের জন্ম হয় নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত বরইচারা গ্রামে। পিতার নাম হরিশচন্দ্র জোয়ারদার। বাল্যকাল থেকেই সতীশচন্দ্রের অন্তরে ঈশ্বর-বিশ্বাস ও ঈশ্বর-প্রাপ্তির ব্যাকুলতা ছিল। ছাত্রাবস্থায় ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণচন্দ্র দে তার ঈশ্বর-ভাবনাকে আরও জাগ্রত করেন। কী ভাবে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যাবে-এই চিন্তা বিভোর করে রাখত কিশোর সতীশচন্দ্রকে।
স্কুলের পাঠ শেষ করে এল. এম. পি. পরীক্ষা দেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কুষ্টিয়া শহরে চিকিৎসা কার্য শুরু করেন। তিনি কিছুদিন স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস- চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন; এই সময় তাঁর জনসেবামূলক কাজ বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। ডাক্তারিতেও জনপ্রিয়তা এবং সাফল্য আসে সহজেই।
কিন্তু ভগবৎ-পিপাসু তাঁর মন এ সবের মধ্যে প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পায় না। বিভিন্ন সময়ে বহু মতে সাধন-ভজন করে বিফল মনোরথ হয়ে একসময়ে সদ্গুরুর আশ্রয় লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন সতীশচন্দ্র। এই সময় কুষ্টিয়ার ডাক্তার গোকুল মণ্ডলের কাছে শুনলেন, সদগুরুর সন্ধান পেয়েছেন গোকুল মণ্ডল। তিনিও একজন চিকিৎসক, বিপ্রসন্তান। তঁৎপ্রদত্ত সৎনাম-ই তাঁদের সাধনা; নিরামিষ আহার এবং সদাচার সাধনার সহায়ক। সংসার জীবনের সব কিছুর ভিতর দিয়েই সাধন-ভজন চলতে পারে। এই সদ্গুরুকে অনেকে মহাপুরুষ বলেন, অনেকে আবার বলেন অবতার পুরুষ। কথাগুলি শুনে আনন্দিত হলেন সতীশচন্দ্র, কিন্তু মনের সন্দেহও রইল কিছু, কারণ ইতিপুর্বে বহু ধর্মগুরুই তাঁকে হতাশ করেছেন। তবু তাঁকে দর্শনের আকাঙক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠল মন।
একদিন শুনলেন, সদ্গুরু শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কুষ্টিয়া শহরে আসছেন। মনে মনে ভাবলেন, এবার তাঁকে ভালভাবে পরীক্ষা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। ভগবান যখন ভালমন্দের বোধ দিয়েছেন, তখন বিচার করে দেখতে অসুবিধা কোথায়? তিনিই যে সদ্গুরু, এ বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া গেলে তাঁর চরণে আশ্রয় নেওয়া, নতুবা পূর্ব থেকেই সাবধান হওয়া—এই ছিল সতীশচন্দ্রের মনোভাব।
কুষ্টিয়ার বার লাইব্রেরির বেশ কিছু উকিল, মোক্তার এবং শহরের গণ্যমান্য ডাক্তার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী প্রভৃতি অনেকেই তখন তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। কারও কারও আবার স্বপ্নে উপদেশ এবং দীক্ষা গ্রহণ হয়েছে। এঁরা সকলেই তাঁকে ‘ঠাকুর’ সম্বোধনে অভিহিত করেন।
বছরটি ছিল বাংলার ১৩২৪ সাল। শ্রীশ্রীঠাকুর এসেছেন তাঁর বিশিষ্ট ভক্ত উকিল প্রফুল্ল রায়ের বাড়িতে। কৌতূহলবশত সতীশচন্দ্র একদিন সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, এক গৌরবর্ণ কমনীয় কান্তি যুবা সংজ্ঞাহীনের মত ঘরের মেঝেতে শায়িত রয়েছেন-অথচ অনবরত তাঁর মুখ থেকে বহু কথা নিঃসৃত হয়ে চলেছে। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ; ঘরের বাইরে এবং চতুর্দিকে দর্শন-প্রয়াসী উৎসুক বহু নরনারীর ভিড়। কয়েকজন ভক্ত অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তাঁর মুখনিঃসৃত কথাগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখছেন। আরও লক্ষ্য করলেন—তাঁর শরীরের দক্ষিণদিকের কটিদেশ থেকে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পর্যন্ত অংশের অভ্যন্তরস্থ সমস্ত মাংসপেশী অতি দ্রুতগতিতে কম্পিত হচ্ছে। ভাবলেন-ভণ্ডামি নয় তো? অতীতের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা এই সন্দেহের মূলে ছিল।
ঐ ঘরে উপস্থিত কেউ কেউ বললেন, কীর্তনের মধ্যে ঠাকুরের সমাধি হয়েছে। এটি তাঁর মহাভাবাবস্থা। জগতের মঙ্গলের জন্য এই সব মহাবাণী তাঁর শ্রীমুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। সতীশচন্দ্র পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ঠাকুরের ডান পা-খানি চেপে ধরে দেখলেন যে সে কম্পন অকৃত্রিম এবং সাধারণ মানুষের সাধ্যাতীত; ঐ দ্রুত স্পন্দন কারও পক্ষে ইচ্ছা করে করা আদৌ সম্ভব নয়। তিনি ঠাকুরের দুটি পা বলপূর্বক মাটিতে চেপে ধরেও সে স্পন্দনের গতি রোধ করতে সক্ষম হননি। তিনি আরও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে ঠাকুরের মুখনিঃসৃত বাণীসমূহ অতি সুন্দর, প্রেমপূর্ণ, ধর্ম ও কর্মের সার সত্য, তত্ত্বপূর্ণ এবং জগতের সকল প্রকার মঙ্গলকর উপদেশ।
ঠাকুরের মহাভাবাবস্থার পর অর্ধচেতন দশা এবং ক্রমে সম্পূর্ণ বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল। তাঁর চেহারার মধ্যে কোন সাধুর চিহ্ন বা বেশভূষা নেই। মনে হল নেহাৎ ছেলেমানুষ, কিন্তু চেহারাটি সুন্দর। সুপ্রশস্ত ললাট, জ্যোতির্ময় শরীর, আর অদ্ভুত এক আকর্ষণ চোখদুটিতে; এমনটি ঠিক আর আগে কখনও দেখেননি সতীশচন্দ্র। আবার অপূর্ব সরলতা তাঁর আচার-আচরণে, একেবারে বালকসুলভ। যতই দেখেন যেন পিপাসা মেটে না কিছুতেই। বেলা অনেক হয়েছে। এরপর হঠাৎই ‘দাদা, আসুন, আপনাকে আমি তেল মাখিয়ে দিই’-এই বলে অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঠাকুর সতীশচন্দ্রের গায়ে তেল মাখিয়ে দিলেন।
যিনি এত লোকের ঠাকুর, আরাধ্য দেবতা, তাঁর এই দীন ব্যবহার! এই সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ, সরলতা, উদারতা, বিনয়, সকলের প্রতি সমদৃষ্টি, সকলকেই আত্মবোধ এ সবই মুগ্ধ করল সতীশচন্দ্রকে।
স্নান ও আহারের পর সকলে একত্রে ঠাকুরের কাছে বসে নানা সদ্ আলোচনা শুনছেন, সতীশচন্দ্রও আছেন সেখানে। মনে ভাবছেন—মানুষটির ভালবাসা মুগ্ধকর, কিন্তু অবতার বলে বোঝা যাবে কী করে? এই চিন্তার উদয় হওয়ামাত্র ঠাকুর তাঁর কাছে এসে সুমধুর কন্ঠে বলেন-দাদা, আমি মহাপুরুষও নই, অবতারও নই। আপনিও যে পরমপিতার সন্তান, আমিও সেই পরমপিতার সন্তান।
এই ঘটনার দু’একদিন পরে ঠাকুরের সঙ্গে বারাদী গ্রামে গোপেন্দ্রনাথ সাহার বাড়িতে গিয়েছেন সতীশচন্দ্র। সেখানে হঠাৎ তাঁর পায়ের স্নায়ুতে ভয়ানক ব্যথা শুরু হয়। মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর অন্দর মহল থেকে ছুটে এসে বলেন,-দাদা, কী হয়েছে? আহা! পায়ে বড় ব্যথা হয়েছে? দেখুন দাদা, মন বড় পাজি, যদি উপরের দিকে অর্থাৎ পরমপিতার দিকে থাকে তবে এসব কিছু হয় না। আর যদি মন নিচের দিকে থাকে তবে ওসব হয়। সতীশচন্দ্র তাঁর কাছে ওষুধ চাইলে তিনি ‘আঃ, ভুলে যান’-এই বলে ব্যথার জায়গাটি স্পর্শ করা মাত্র ব্যথার আর লেশমাত্র থাকল না। ঠাকুর তৎক্ষণাৎ অন্দরমহলে চলে গেলেন। পাশে ছিলেন শ্রীশচন্দ্র রায়চৌধুরী। তিনি পুলকাশ্রু-রোমাঞ্চিত অবস্থায় বিভোর হয়ে গেলেন। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়ে শ্রীশচন্দ্র বলেন, আমি এই ঠাকুরকে আর কখনও দেখিনি। এই প্রথম দর্শন। যখন তিনি তোমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন আমি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম, ঠিক যেন শ্রীগৌরাঙ্গ মূর্তি—এই বলে শ্রীশচন্দ্র আবার কাঁদতে লাগলেন। সতীশচন্দ্র গিয়েছিলেন তাঁকে পরীক্ষা করতে, কিন্তু প্রতি পদে পদে ধরা পড়লেন। কত দেখলেন, কত বুঝলেন, দ্বিধা তবু সম্পূর্ণ যেতে চায় না। আর দয়াল ঠাকুর তাঁর অনন্ত প্রেমের বাহু প্রসারিত করে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষায় আছেন ভক্তের দ্বিধাহীন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের।
আর একদিনের ঘটনা। বারাদীর উক্ত গোপেন্দ্রনাথ সাহার বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর এবং ত্রিশ চল্লিশ জন ভক্তের নিমন্ত্রণ। সকলে সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হলেন। ঠাকুরের যাওয়ার কোন প্রস্তুতি নেই দেখে সতীশচন্দ্র ঠাকুরকে বারাদী যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেন। ঠাকুর বলেন, পা চলছে না দাদা। সতীশচন্দ্র বলেন—পা চলছে না কেমন? তিনি বলেন, মন চলছে না। এ কথা শুনে সতীশচন্দ্র বলেন, তারা এত লোকের রান্নার বন্দোবস্ত করেছে, এতক্ষণে বোধহয় রান্না শেষও হয়ে গিয়েছে, এখন না গেলে তারা মনে বড় ব্যাথা পাবে। তাছাড়া, আমরাও বাড়িতে খাব না বলে এসেছি, বারাদী না গেলে আমরাই বা এখন খাব কোথায়? তিনি বলেন, স্টেশনে তাদের লোক আসতে পারে, একখানা চিঠি লিখে তাদের জানিয়ে দেওয়া হোক। অগত্যা একজন চিঠি নিয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখলেন সেখানে বাস্তবিকই তাদের লোক এসেছে, তার হাতে চিঠি দিয়ে দেওয়া হল। এদিকে ঠাকুর সবাইকে তাঁর ওখানেই মধ্যাহ্নের আহার সেরে নিতে বলেন। সতীশচন্দ্র সে কথার উত্তরে বলেন যে মাত্র চার পাঁচজনের মত ব্যবস্থায় ত্রিশ চল্লিশজনের আহার সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। ঠাকুর বললেন-দুটি দুটি করে খেয়ে জল খেয়ে কোনমতে কাজ চালিয়ে নিন, প্রণয় থাকলে তেঁতুল পাতায় স্থান হয় শুনেছেন তো! তাঁর কথায় সকলেই আহারে বসেন এবং আকন্ঠ ভোজন করেন। অর্থাৎ পাঁচজনের ব্যবস্থায় ত্রিশ চল্লিশ জনের পূর্ণ ভোজন সমাধা হল।
পৃথিবীতে অনেক ঘটনারই সাধারণভাবে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না; আমাদের দৃষ্টির বা বোধের সীমানার বাইরে থাকে সে সমস্ত সংঘটনের প্রকৃত তাৎপর্য। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের কোনখানে কার্যকারণহীন বিশৃঙ্খল কোন ঘটনা সম্ভব নয়-কার্যকারণ- সম্পর্কটি সাধারণ লৌকিক জ্ঞানের বাইরে থাকে, সেখানেই বিষয়টি অলৌকিক বলে প্রতিভাত হয়। বস্তুত অলৌকিক বলে কিছু নেই। সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা পুরুষ যিনি, তাঁর জ্ঞানের ও দৃষ্টির পরিধির বাইরে কিছু নেই, তাঁর লোকোত্তর প্রজ্ঞার অন্তর্গত সবই; তাই তিনিই আপাত দৃষ্টিতে ব্যাখ্যার অযোগ্য বহু বিষয় অনায়াসে সম্পন্ন করেন।
আহার-পর্ব শেষে সবাই দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামরত; বারাদী থেকে দুজন এসেছিলেন, ঠাকুরের নির্দেশে তাঁরাও এখানেই আহার করেছেন। বেলা গড়িয়ে এসেছে; হঠাৎ ঠাকুর বলেন-চলুন, এখনই সেখানে যাব, তারা বড় ব্যস্ত ও দুঃখিত হয়ে পড়েছে। তাঁর কথায় সবাই অবাক হল। কিছুক্ষণ আগেই যেখানে যাওয়া হবে না বলে সকলের আহারের ব্যবস্থা হল, এখনই কি না সেখানে যাওয়ার জন্য ঠাকুর ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন! অগত্যা ঠাকুরের ইচ্ছামত সবাই বারাদী অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে ঠাকুর সতীশচন্দ্র-কে জিজ্ঞাসা করেন, সতীশদা, সেখানে গিয়ে খেতে পারবেন তো? সতীশচন্দ্র উত্তর দেন, সে কী কথা, একবার আকন্ঠ ভোজন করিয়ে আনলেন, পাঁচ ছয়জনের রান্নায় ত্রিশ চল্লিশ জনকে খাওয়ালেন, আবার এ কী বলছেন? ঠাকুর বললেন, চলুন, দেখতে পাবেন সেখানে কোন এক ব্যাপার বোধহয় আছে। সেখানে উপস্থিত হয়ে জানা গেল, গোপেনবাবুর ভ্রাতৃবধূর প্রসব বেদনা আরম্ভ হওয়ায় বাড়ির লোকেরা তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিমন্ত্রিত লোকেদের জন্য সুবন্দোবস্ত তখনও ঠিকমত হয়ে ওঠে নি। ঠাকুরের বিলম্বে আসার কারণ এতক্ষণে বোঝা গেল। এদিকে শ্রীশ্রীঠাকুর বাড়িতে পদার্পণ করা মাত্র একটি কন্যাসন্তান অক্লেশে ভূমিষ্ঠ হল। কিছুক্ষণ পরে চিকিৎসক গোপেনবাবুও রোগী দেখা সেরে ফিরলেন। অবশেষে রাত্রে সকলে মহাসমারোহে আপ্যায়িত হলেন।
ঠাকুরের অকৃত্রিম ভালবাসায় এবং এই জাতীয় নানা ঘটনায় সতীশচন্দ্র ক্রমে ক্রমে ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। একদিন ঠাকুর ও অনন্ত মহারাজকে নির্জনে পেয়ে তিনি অকপটভাবে বলেন,- ঠাকুর, কেউ কেউ আপনাকে মহাপুরুষ বলে, কেউ কেউ আপনাকে পূর্ণ অবতার বলে, কিন্তু আমি তো এখনও বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস করতেও পারিনি, তবে এটা বুঝতে পেরেছি যে আপনি আমার অন্তরের সমস্ত ব্যাপার এবং জীবনের সমস্ত গোপন ঘটনা অবগত হয়েছেন। আমি অনেক সাধুসন্ন্যাসী ও মহাপুরুষের সঙ্গে মিলে-মিশে ঘুরে-ফিরে ও বহু সম্প্রদায়ের সমস্ত খবর জেনেশুনে এবং গুরুদেবের কাছে দীক্ষাগ্রহণ করে যথাসাধ্য সাধন-ভজন করেও অন্ধকারেই পড়ে আছি। বিশেষ কোন ফল পেলাম না। যদি সহজে সত্বরে অন্ধকার দূর হওয়ার কোন উপায় করে দিতে পারেন তবে দিন, নচেৎ আপনার কাছে আমি কিছুই চাই না।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিভরা মুখে স্নেহের সুরে বলেন,-দাদা, আমি পূর্বেই তো বলেছি, আমি মহাপুরুষ নই, অবতারও নই। তবে আপনি যা চাচ্ছেন তা হবে দাদা। আর ভয় নেই, তিক্ত, কষা ওষুধ সেবনে রোগ আরোগ্যের সময় এখন নেই। এখন সুলভ ও বিস্বাদহীন উচ্চশক্তি বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিকের মাত্র এক মাত্রা সেবনে রোগ আরোগ্যের মত আধ্যাত্মিক রাজ্যের রোগ সারাবার ব্যাপার হয়েছে। এ যুগে সাধন-ভজনের জন্য ভীষণ কঠোরতা করতে হবে না। সহজে বিনা খরচায় অতি সত্বর সংসারের সমস্ত কার্যের মধ্যেই সাধন ভজন চলতে পারবে। গাড়িতে, বাই-সাইকেলে, ঘোড়ায় চেপে, অফিসে চেয়ারে বসে, খেতে শুতে চলতে ফিরতে, আচার নিয়মের অযথা কঠোরতায় আবদ্ধ না হয়েও সাধন ভজন চলতে পারবে।
সতীশচন্দ্র ঠাকুরকে বলেন-ঠাকুর, আমার গুরু আছেন, দীক্ষা নিয়েছি, আপনার কাছে পুনরায় কিছু গ্রহণ করলে গুরুত্যাগ বা মন্ত্রত্যাগজনিত পাপ হবে না তো? তিনি বলেন-প্রকৃত গুরুত্যাগ হতেই পারে না। সে গুরুকে বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি করতে হবে। তাঁকে যা দেওয়া হয় তা দেবেন, যেমন বার্ষিক প্রণামী ইত্যাদি। আমি কারো গুরু নই, কেউ আমার শিষ্য নয়। যা প্রকৃত সত্য বলে জানি বন্ধুভাবে তা-ই বলে দিই। এখানে বংশপরম্পরার কোন সম্বন্ধ নেই। এতে কোন পাপ হবে না। যদি কোন পাপ হয় তা আমি মাথায় করে নিচ্ছি। আপনার সমস্ত পাপতাপ আমি গ্রহণ করলাম।
সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান হল। দীক্ষা নিলেন সতীশচন্দ্র। বহুদিনের এক জিজ্ঞাসু মন অনেক পরখ-নিরিখের পর, সব প্রশ্নের সমাধানে নামের অনলে প্রদীপ্ত হল, তীরে এসে পৌঁছল এক দিগ্ভ্রান্ত তরী। দীক্ষাগ্রহণের পরই তিনি বুঝতে পারেন, নামের ক্রিয়ার সচলতা তাঁর দেহে মনে এনে দিয়েছে এক নতুন জীবন। পৃথিবী প্রতিভাত হল এক নতুন দৃষ্টিতে। জীবনকে মূল্যায়ন করতে শিখলেন নতুন করে ঠাকুরের আলোকে।
ঠাকুরকে কেন্দ্র করে প্রতি মুহূর্তেই সৃষ্টি হয় একেকটি আনন্দের পরিবেশ। প্রতিক্ষণই নতুন মনে হয় চিরচেনা পৃথিবীকে, অনাবিল অফুরন্ত রসপ্রবাহে অভিষিক্ত হয়ে ওঠে পারিপার্শ্বিকের সমস্ত উপাদান। ঠাকুর সকলের সঙ্গে একাসনে বসেন, কখনও কাউকে কাঁধে তুলে নিচ্ছেন প্রাণের উচ্ছ্বাসে, আবার কখনও বালকের মত কারও কাঁধে উঠে পড়ছেন নিজেই; তথাকথিত গুরুর মত গাম্ভীর্য নিয়ে নিজেকে পৃথক করে রাখেন না, যেন সকলেরই প্রাণের সখা, একান্ত সুহৃদ্। প্রত্যেকেরই মনে হয়, তিনি তাঁকেই সবচাইতে বেশি ভালবাসেন। ঠাকুরের পার্ষদগণও সেই প্রেমেরই প্রতিবিম্ব; তাঁরাও প্রত্যেকেই একেক প্রেমের অবতার-সকলকে একই পরিবারভুক্ত করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে বেঁধে রেখেছেন। এখানে জাতিধর্মবর্ণ ভেদের কোন বিদ্বেষ নেই, ঘৃণা নেই, আছে নিবিড় ভালবাসার চিরপ্রবাহ।
সতীশচন্দ্রের ইচ্ছা, তাঁর সহধর্মিণীও দীক্ষা নেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী স্বপ্নে এক দিব্য পুরুষের কাছ হতে দীক্ষা পেয়েছিলেন, তাই তিনি আর কোন দীক্ষা নিতে রাজি হলেন না। সদ্গুরুর আশ্রয় থেকে স্ত্রী বঞ্চিত থাকবেন-এই চিন্তায় সতীশচন্দ্র উদ্বিগ্ন হন। ঠাকুরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা জানান-যেন তাঁর পায়ে সহধর্মিণীর মতি হয়। মধ্যরাত্রে স্ত্রীর ক্রন্দনে ঘুম ভেঙে সতীশচন্দ্র তাঁর কাছে শোনেন যে পূর্বে যিনি তাঁকে স্বপ্নে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তিনিই স্বপ্নে পুনরায় দীক্ষা দিতে চাইলেন। রাজি না হওয়ায় তিনি বলপূর্বক তাঁর হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। পরদিন সকালে সতীশচন্দ্র ঠাকুরের কাছে বিস্তারিত জানালে তিনি মৃদু হেসে সতীশচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়িতে আসেন। এই প্রথম সেখানে তাঁর আগমন, সতীশচন্দ্রের স্ত্রীরও প্রথম দর্শন তাঁকে; কিন্তু তাঁকে দর্শনমাত্র বিস্ময়ে, আনন্দে সতীশচন্দ্রের স্ত্রীর বাকরোধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে বিহ্বলতা কিছুটা কাটিয়ে উঠে জানালেন যে পূর্বে যিনি স্বপ্নে তাঁকে দীক্ষা দিয়েছেন, যাঁকে পাওয়ার জন্য প্রাণের আকাঙ্ক্ষা ও কাতরতা নিয়ে বহু তীর্থ ভ্রমণ করেও দেখা পাওয়া যায় নি, গত রাত্রে যিনি স্বপ্নে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, ইনিই তিনি। অতঃপর ঠাকুর স্বয়ং তাঁকে দীক্ষাদানে কৃতার্থ করেন।
সাধারণভাবে দেখা যায়, পৃথিবীতে কিছু ভাগ্যবান থাকেন, যাঁদের প্রতি অবতার পুরুষের কৃপা-প্রসন্নতা অযাচিত ভাবে বর্ষিত হয়ে থাকে। তবে আপাত দৃষ্টিতে অযাচিত এবং আকস্মিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এর পশ্চাতে বহু জন্ম-জন্মান্তরের আকুতি ক্রিয়াশীল। আবার এই জাতীয় কৃপার প্রদর্শন অবতারগণের নরলীলার প্রথম দিকেই বেশি প্রকট থাকে; ভগবৎসত্তা সাধারণ্যে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং গৃহীত হওয়ার পর লোকোত্তর লীলা অনেকখানি সংবৃত হয়ে আসে। মহাভাগ্যবান তাঁরা, যাঁরা আসেন তঁৎসন্নিধানে তাঁর প্রকাশের প্রথম পর্বে।
বেশ কিছুদিন পরের কথা। সতীশচন্দ্রের স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ, প্রাণের কোন আশা নেই। মুমূর্ষু অবস্থায় ঠাকুরের দর্শন পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। ঠাকুর তখন সপার্ষদ গিয়েছিলেন খলিলপুর। রোগিণীর অবস্থা এত সংকটজনক যে টেলিগ্রাম বা অন্য কোন মাধ্যমে খবর পাঠানোর মত সময় নেই। অগত্যা ঠাকুরের চরণে প্রার্থনা করেন তিনি মৃত্যুপথযাত্রিণীর অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য। প্রার্থনার আকুলতায় শ্রীশ্রীঠাকুর শীঘ্রই সেখানে উপস্থিত হয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলেন-মা, দেখ তোর সব সেরে গেছে। ঠাকুরের কথা শ্রবণমাত্রই রোগিণী উঠে বসে ঠাকুরকে প্রণাম করেন। তারপর থেকেই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা শুরু করেন এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
একবার নদীয়া জেলার আলমডাঙা বাজারে ধর্মসভায় এসেছেন সতীশচন্দ্র-
কয়েকদিন এখানে থাকার কথা। ধর্মসভার আয়োজনও সম্পূর্ণ। এমন সময় ঠাকুরের একান্ত পার্ষদ অনন্ত মহারাজ সেখানে উপস্থিত হয়ে জানান যে ঠাকুর তাঁকে সত্বর হিমাইতপুর চলে আসতে বলেছেন। সতীশচন্দ্র আর কালবিলম্ব না করে পরদিনই ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হন। ঠাকুর তাঁকে দেখে প্রেমময় ভঙ্গিতে বলেন-আমি দেখলাম যেন আপনার খুব বসন্ত হয়েছে, আপনি দুই চার দিন আমার কাছে থেকে যান। সতীশচন্দ্র ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিনই সর্বদেহে যন্ত্রণা ও জ্বর হয়, সমস্ত দিন অজ্ঞানাবস্থায় কাটে। তার পরদিন শরীরে বসন্তের গুটি দেখা দিল। ঠাকুরের নির্দেশমত চিকিৎসায় খুব অল্পদিনের মধ্যেই সতীশচন্দ্র সুস্থ হয়ে ওঠেন। সতীশচন্দ্র বুঝলেন, ঠাকুর কেন তাঁকে জরুরি সংবাদ পাঠিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন; নতুবা বাইরে থাকলে যে কী দুরবস্থা হত তা অনুমান করে ঠাকুরের অশেষ দয়ার কথা ভেবে তিনি পরম আনন্দে পুলকিত হন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, সেসময়, অর্থাৎ ১৩২৬ বঙ্গাব্দে বসন্ত রোগের প্রকোপ ছিল অত্যন্ত বেশি এবং তা মহামারীর আকারে প্রাদুর্ভূত হয়ে বহু প্রাণ হরণ করত।
একবার সতীশচন্দ্র ও অন্য কয়েকজন ভক্তসহ শ্রীশ্রীঠাকুর রাতুলপাড়া গ্রামে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন—এমন সময় ইষ্টভ্রাতা যোগেন্দ্রনাথ সরকার একটি কাপড়ে বেঁধে কিছু আম নিয়ে এসে তাঁদের অনুরোধ করলেন ঐ গ্রামে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্য। শ্রীশ্রীঠাকুর অগ্রসর হয়ে যোগেন্দ্রনাথের হাত থেকে ঐ আমের বোঝা গ্রহণ করে নিজেই বহন করে নিয়ে চললেন। কিছুটা যাওয়ার পর সতীশচন্দ্রের কাছে ঠাকুরের বোঝা বয়ে চলাটা মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াল-তিনি বললেন-ঠাকুর, আম কটি আমার কাছে দিন, আমি একটু বয়ে নিয়ে যাই, পরে নাহয় আপনি নেবেন। ঠাকুর সেকথা শুনে আমের বোঝা সতীশচন্দ্রকে দিলেন। মাঠের রাস্তা পিছল, কর্দমাক্ত; তার মধ্য দিয়ে একহাতে জুতো, আর এক হাতে কাপড়ের কোঁচা এবং মাথায় আমের থলি নিয়ে অতি সাবধানে চলতে থাকেন সতীশচন্দ্র। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পরে শ্রীশ্রীঠাকুর সতীশচন্দ্রকে বলেন—এই আম ক’টি যেভাবে বহন করছেন, আর জুতো ও কাপড় যেভাবে রক্ষা করে পথ চলছেন, ঠিক এইভাবে সংসারে থেকে সব কাজ ঠিক রেখে ধর্মকার্য ষোল আনা রকমের করতে হয়-মনে রাখবেন।
গুরুর প্রতি আকৃতি, ভালবাসা ও নিঃশর্ত আত্মনিবেদন থাকলে সৎদীক্ষা ও সৎনামের প্রভাবে অসম্ভবও সম্ভব হয়ে ওঠে। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে সতীশচন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র বিজয়কৃষ্ণ প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়—তার বয়স তখন মাত্র ছ বছর। একদিন সন্ধ্যার পর থেকে বালকের অবস্থার অবনতি হতে থাকে; বুকের দু’পাশে অসহ্য ব্যথা এবং আনুষঙ্গিক নানা কষ্টে বাহ্যত সে নিশ্চল হতে থাকে। শ্রীশ্রীঠাকুর তখন কুষ্টিয়ায় এক ভক্তের বাড়িতে। দিশাহারা সতীশচন্দ্র উপায়ান্তর না দেখে ঠাকুরের কাছে ছুটে যান। সতীশচন্দ্রকে দেখে ঠাকুর জানতে চান তাঁর মুখ অমন ভারাক্রান্ত কেন। সতীশচন্দ্র অসুখের বৃত্তান্ত নিবেদন করলে ঠাকুর বলেন, ওতে মুখ ভার করলে চলবে কেন? ও ছেলে তো বাঁচবার কথা নয়। এর আগেও সতীশচন্দ্রের কয়েকটি সন্তানের অকালমৃত্যু ঘটেছে। ব্যথাতুর পিতা তাই কম্পিত কন্ঠে বলতে থাকেন- ঠাকুর আমার আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই; হয় তুমি দয়া করে এমন ক্ষমতা দাও যে ছেলের মৃত্যু হলেও আমি যেন বিচলিত না হই, সহ্য করতে পারি, নতুবা এমন কর যেন ছেলের মৃত্যুর পূর্বেই আমার মৃত্যু হয়। স্নেহললিত কণ্ঠে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন, তা কি হয় দাদা, যে সময়ে আপনার মৃত্যুর দিন নির্দিষ্ট ছিল সেদিন কেটে গেছে, আবার যে সময়ে নির্দিষ্ট হয়ে আছে তার আগে তো মৃত্যু হতে পারে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে সতীশচন্দ্রের কোষ্ঠীতে এই ঘটনার বহু আগেই মৃত্যুযোগ ছিল, সৎনাম গ্রহণ ও মননে তা খণ্ডিত হয়। ভক্তের আকুল আবেদনে ঠাকুর সতীশচন্দ্রের বাড়িতে যান তাঁর ছেলেকে দেখতে। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছেলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলেন, নিউমোনিয়া হয়েছে বলে মনে হয়, ডাক্তারবাবুকে (গোকুল ডাক্তার) ডাকুন তো দেখি। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হলে গোকুল ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন, ডবল নিউমোনিয়া, দু’দিকেই প্রবল আক্রমণ, জীবনের আশা বড় কম। আরও দু’জন ডাক্তারও দেখে একই মত প্রকাশ করেন। ঠাকুর শুধু বলেন, বাবা-মায়ের মনের বল, বিশ্বাস ও সৎনাম-মাহাত্ম্যে সবই হতে পারে-এ ছেলেও বেঁচে যেতে পারে। এই বলে তিনি চলে গেলেন।
গোকুল ডাক্তারের নির্দেশমত ছেলেটিকে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হল- কিন্তু শত চেষ্টাতেও তা পারা গেল না। তখন সতীশচন্দ্র অনন্যোপায় হয়ে নিবিড় মনঃসংযোগ করে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত সৎনাম করতে শুরু করেন; মধ্যরাত্রি পর্যন্ত এভাবে নাম চলে। তারপরে সতীশচন্দ্র সহ পরিবারের সকলেই তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ভোরে ঘুম ভেঙে দেখেন, ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ। ছুটে যান তিনি ডাক্তার গোকুলচন্দ্রের কাছে এবং বলেন এ আশ্চর্য ঘটনার কথা। সব শুনে চিকিৎসক বলেন, এ তো বিজ্ঞানাতীত ব্যাপার। দিনের বেলায় নিউমোনিয়ার অমন প্রবল আক্রমণ, আর সেই রাতেই সম্পূর্ণ রিজলিউশন হয়ে রোগীর আরোগ্য লাভ-এ ব্যাপার বিজ্ঞানের অগম্য, শাস্ত্রযুক্তির অতীত। সৎনামের মাহাত্ম্য ও গুরু কৃপায়ই এ আরোগ্য সম্ভব। শ্রীশ্রীঠাকুরকে সতীশচন্দ্র সমস্ত কথা বিবৃত করলে তিনি মধুর দৃষ্টিতে স্মিতহাস্যে বলে ওঠেন—জয় গুরু!
এই ঘটনার এক মাস পরের কথা। সতীশচন্দ্রের দৌহিত্র গৌরগোপাল ইনফ্লুয়েঞ্জা
নিউমোনিয়ায় সংকটাপন্ন। বড় বড় ডাক্তারের চিকিৎসায় কোন ফল না হওয়ায় তাঁর কন্যা ও জামাতা শোকে নিদারুণভাবে ভেঙে পড়েন এবং পুত্রের সুস্থতার জন্যে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে নিবেদন করতে অনুরোধ করেন সতীশচন্দ্রকে। সতীশচন্দ্র বলেন, বার বার ঠাকুরের কাছে রোগমুক্তির প্রার্থনা করা যায় না। তোমরা তো সকলেই নাম গ্রহণ করেছ-নাম করতে থাক এবং তাঁর কাছে মনে মনে প্রার্থনা কর। সতীশচন্দ্রের কন্যা-জামাতা তাঁর কথানুযায়ী নাম করতে থাকেন। এমন সময়ে ঠাকুরের কীর্তনের সঙ্গী ও অন্যতম পার্ষদ কিশোরীমোহন দাস নাম-সংকীর্তন সহকারে ঐ রাস্তা দিয়ে আসছিলেন। সতীশচন্দ্র জামাতাকে বলেন, কিশোরীমোহনকে দিয়ে যদি ছেলের কাছে কীর্তন করানো যায় তবে সে নিশ্চয়ই বেঁচে যাবে। জামাতার আকুল অনুরোধে কিশোরীমোহন সংকীর্তনসহ বাড়ির উঠোনে প্রবেশ করলেন। ভাবে মাতোয়ারা কিশোরীমোহন-তাঁর প্রেমময় পরম পবিত্র মধুর ভাব যেন এক স্বর্গীয় শোভার আলেখ্য। সে যুগে যাঁরা এই দিব্য সংকীর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন—তাঁরাও এই দেবোপম ভাবের বর্ণনা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারেননি, সে দৃশ্যের অপূর্বতা ভক্তের সানুরাগ অনুভব সাপেক্ষ। কিশোরীমোহনের সম্মুখে উঠোনে মুমূর্ষু বালকটিকে শুইয়ে দেওয়া হল। কিশোরীমোহন মিনিট দশেক বালকের চারদিকে নাম-কীর্তন করার পর তাকে ঘরে নিয়ে যেতে বললেন। ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে তাকে একবিন্দু চরণামৃত দেওয়া হল; সেই রাত্রেই সে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়। সতীশচন্দ্রের ভাষায়-“আমার ডাক্তারি বিদ্যার গৌরব পূর্বেই পুত্রের নিউমোনিয়াতে ও অন্যান্য কয়েকটি ঘটনাতে ঘুচিয়া গিয়াছিল, এই দিন একেবারে বিদূরিত হইল।
১৩২৭ বঙ্গাব্দ। সতীশচন্দ্র নির্জনগৃহে একাকী ধ্যান করছিলেন। ধ্যানে সম্পূর্ণ নিমগ্ন অবস্থায় দৈববাণী শুনতে পেলেন—তুমি এই স্থানে বসে ধ্যান করলে ছ’মাসেও কিছু হবে না; ঐ বাগানে ঐ স্থানে বসে ধ্যান করলে শীঘ্রই ফল পাবে। বাগান ও স্থানের ইঙ্গিত সতীশচন্দ্র সহজেই বুঝতে পারলেন। তখন সেই দৈববাণী নির্দেশিত স্থানে বসে ধ্যান করেন এবং সূক্ষ্ম অনুভূতির স্পর্শ অনুভব করতে থাকেন। ধ্যানের মধ্যে আবার শুনতে পেলেন, তোমার আর ধ্যান করতে হবে না।... মোক্তারের মেয়ের পেটের অসুখ, তিনবার লোক এসে তোমাকে খুঁজে পায়নি; তুমি এখানে রয়েছ বাড়ির কেউ জানে না। শীঘ্রই সেখানে যাও। সাধকপ্রবর তখনই বাড়ি গিয়ে শুনলেন, সেই মোক্তারের বাড়ি থেকে তিনবার লোক এসেছিল। তিনি আর কালবিলম্ব না করে মোক্তারের বাড়ি গিয়ে ‘তাঁর মেয়ের চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। তাঁতে প্রকৃত আনতি থাকলে ভক্তজন অতি সহজেই তাঁর নির্দেশ অনুভব করতে পারেন। সাধনার ফলে স্নায়ুগুলির সাড়াপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে গ্রহণ ও প্রেরণ ক্ষমতা তীক্ষ্ণতা প্রাপ্ত হয়। এ কোন অলৌকিক ক্ষমতা নয়-মস্তিষ্ককোষের বিবর্তনগত অবস্থান মাত্র। নিষ্ঠানন্দিত নামধ্যানের ফলেই এই পরিবর্তন সম্ভব।
১৩২৭ সনের আশ্বিন মাস। পাবনার অন্তর্গত দোগাছি গ্রাম থেকে ঘোড়ার গাড়িতে হিমাইতপুর ঠাকুরবাড়িতে আসছেন সতীশচন্দ্র ও অন্যান্য কয়েকজন ভক্ত। দূরে বাতাবিলেবুর গাছ দেখে সতীশচন্দ্র বলেন, চিনি দিয়ে বাতাবিলেবুর সরবত খেলে বেশ আরাম বোধ হয়। প্রায় ঘন্টা দুয়েক বাদে ঠাকুর বাড়ি পৌঁছে দেখেন আকাঙিক্ষত সরবত প্রস্তুত হয়ে রয়েছে; ঠাকুর সরবত ভর্তি একটি গ্লাস সতীশচন্দ্রের দিকে এগিয়ে বলেন, সর্বাগ্রে আপনি খান। পরে অন্যান্য সকলকে দেওয়া হল, ঠাকুর নিজেও খেলেন। সে যুগে যে কতভাবে ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতেন তিনি, সেসব কাহিনী আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বসেছে। ঠাকুর আমাদের চির অতন্দ্র অন্তর্যামী- আজও তিনি প্রকৃত ভক্তের অন্তরের খবর পান এবং পোষণ দেন সেইমত।
আর একবারের ঘটনা। রাতুলপাড়া থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর সহ সতীশচন্দ্র ও অন্যান্য ভক্ত ঘোড়ার গাড়িতে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ঠাকুর গাড়িতে উঠেছেন, ভক্তরা উঠতে যাচ্ছেন, এমন সময় দেখা গেল, একটি লোক কয়েকটি ‘পলো’ নিয়ে যাচ্ছে। বাঁশের শলার তৈরী এই ‘পলো’ দিয়ে দুধের ঢাকনা দেওয়া, বিলে চুনো মাছ ধরা এসব কাজ হত। ঠাকুর সতীশচন্দ্রের দিকে চেয়ে বলেন, সতীশদা, পলো কিনবেন না? সতীশচন্দ্র জানান-পলোর দরকার নেই। ঠাকুর উচ্ছ্বসিতভাবে বলেন, দরকার আছে বৈকি, কিনুন না! সতীশচন্দ্র সঙ্গে পয়সা নেই বলায় ঠাকুর অপর এক ভক্তের কাছ থেকে পাঁচ আনা নিয়ে একটি পলো কিনে সতীশচন্দ্রকে দিলেন। কুষ্টিয়ায় পৌঁছে তাঁকে নিজের বাড়ি যেতে বললেন ঠাকুর। তখন তাঁর মনে পড়ল যে প্রায় দিন পনের আর তাঁর স্ত্রী তাঁকে একটি পলো কিনে আনতে বলেছিলেন, যা তিনি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন।
১৩২৯ সনের প্রথম দিকের ঘটনা। শ্রীশ্রীঠাকুর সৎসঙ্গের গ্রন্থাগারের বারান্দায় বসে আছেন ভক্তমণ্ডলী পরিবৃত হয়ে। নানা কথা আলাপ আলোচনা চলছে—এমন সময় ঠাকুর সতীশচন্দ্রকে হঠাৎ বললেন, সতীশদা, আমি যা বলব তা করতে পারবেন? সতীশচন্দ্র উত্তরে বলেন, সাধ্য হলে করব। ঠাকুর বলেন, সেটা প্রকৃত ভালবাসার কথা হল না, সাধারণ ভালবাসার কথা। সতীশচত্র চিন্তায় পড়েন, অবশেষে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে কথা দেন—পারব। ঠাকুর তখন তাঁকে গ্রন্থাগারের ভেতর নিয়ে গিয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা ছেঁড়া একজোড়া জুতো নিয়ে আসতে বলেন। সতীশচন্দ্র সেই জুতোজোড়া নিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে বাইরে এলেন। এরপর ঠাকুর এক অভিনব আদেশ করেন যা সতীশচন্দ্রের কল্পনারও অতীত। ঠাকুর বলেন, ঐ জুতোর এক এক পাটি দিয়ে আমার পিঠে তিনটে করে ছ’ঘা মারুন। স্তম্ভিত সতীশচন্দ্রের সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল-এ কী আদেশ? কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় বার বার কানে আসতে লাগল ঠাকুরের ঐ একই আদেশ। অবশেষে আদেশ পালনে বাধ্য হয়ে উদ্যত হলে ঠাকুর বলেন-দেখবেন, যেন আস্তে মারবেন না, বেশ জোরে মারবেন, যেন বেশ ব্যথা লাগে। সতীশচন্দ্র ঠাকুরের কথামত তাই করলেন। ঠাকুর ‘ঠিক হয়েছে’ বলে হাসতে লাগলেন। উপস্থিত ভক্তরা দুঃখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সতীশচন্দ্রের অবস্থা আরও শোচনীয়। কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়ে ঠাকুরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় ঠাকুর সুর করে গানের ভঙ্গীতে বললেন, আমিই বুঝিতে নারি, অন্যে বলা ভার! এরপরে কথাবার্তায়, হাসিতে অল্পক্ষণের মধ্যে সেই বেদনার্ত পরিবেশকে সহজ করে তোলেন ঠাকুর। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ঠাকুরের একান্ত পার্ষদ কিশোরীমোহনকে দিয়েও একবার তিনি নিজ দেহে পাদুকাঘাত করিয়েছিলেন। তাঁর এই আচরণের প্রকৃত কারণ জানা না গেলেও অন্তরঙ্গ ভক্তদের ধারণা, অপরের কুকর্ম বা অন্যায় আচরণের জন্য তিনি নিজেই এইভাবে শাস্তি নিতেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরকে অবতার, ভগবান ইত্যাদি বললে তিনি খুব আপত্তি করতেন। বলতেন-দেখুন, আমাকে অবতার-টবতার বলবেন না, ওতে আমার বড় কষ্ট হয়। আবার কখনও বলতেন -আমাকে বিশ্বগুরু, অবতার ইত্যাদি বলে প্রচার করা কেন? আমি কি কোনদিন বলেছি আমি বিশ্বগুরু, অবতার ইত্যাদি? আপনারা আমাকে যে ঠাকুর বলেন, তাতেও আমি আপত্তি করেছি, তাও আপনারা গ্রাহ্য করেননি। শেষে ভেবে নিলাম, লোকে রাঁধুনী বামুনকেও তো ঠাকুর বলে। আমি বরং সেই রকম একজন। ভক্তরা কিন্তু তাঁদের এই প্রাণের মানুষটিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভূষণে ভূষিত করেছেন। তাঁরা যেমনটি দেখতেন, যেমনটি বুঝতেন, তেমনটি বলে আনন্দ পেতেন।
ঠাকুর একবার সতীশচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি তাঁকে অবতার বলেন কেন। উত্তরে সতীশচন্দ্র বলেন-আমি আমার বিশ্বাস মতো যা সত্য বলে বুঝি, তা-ই বলি। আমার স্ত্রী মৃতবৎ অবস্থায় যাঁর কর্তৃক জীবন লাভ করতে পারে, কাতর আহ্বানে রুদ্ধদ্বার গৃহাভ্যন্তরে যিনি সশরীরে ভক্তদের দর্শন দান করে বাক্যালাপ ও শান্তিদান করেন, যাঁকে দর্শন না করেও, যাঁর নাম পরিচয় না জেনেও স্বপ্নে যাঁর কাছ থেকে দীক্ষা পাওয়া যায়, যাঁর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলে সর্বপ্রকার মনস্কামনা পূর্ণ হয়, যাঁর নামে ভোগ নিবেদন করলে তিনি চিদঘন মূর্তিতে বা সশরীরে স্বয়ং এসে সেই নিবেদিত ভোগ গ্রহণ করেন, পিতামাতা অপেক্ষাও যিনি অধিক ভালবাসেন, যাঁর ভালবাসা সকলের প্রতি এমন কি সর্ব জীবের প্রতি সমান দৃষ্ট হয়, যাঁকে না দেখে এবং নাম না শুনেও স্বপ্নে পূর্ণাবতার বলে বহুলোক জানতে পেরেছেন, ভাল ভাল জ্যোতিষীগণ যাঁকে পূর্ণাবতার বলে স্বীকার করে যাঁর চরণে লুন্ঠিত হয়ে পড়েন, যিনি বহুদূরে থেকেও আমাদের সংবাদ জানতে পারেন, যিনি বহু দূরদেশে থেকেও দৈববাণী দ্বারা আমাদের সময়ে সময়ে চালিত করেন, যাঁর দর্শনে বা স্পর্শে আমাদের রিপু শান্ত হয়ে পড়ে, যিনি ধ্যানের সময় মুরলীধর শ্রীকৃষ্ণ দর্শন দিয়ে-এ কথা বলতেই ঠাকুর বাধা দিয়ে বলেন ও কথা আর বলবেন না। সতীশচন্দ্র থামলেন, ঠাকুরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে থাকেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর আত্মপ্রচারে পরাঙ্মুখ ছিলেন। সতীশচন্দ্র দীক্ষা গ্রহণের পরে ঠাকুরের মূর্তি-ধ্যান অভ্যাস করেন। সেকথা জানতে পেরে ঠাকুর স্বীয় বাড়ির ঠাকুরঘরে অন্যান্য কয়েকজন পূর্ব পূর্ব মহাপুরুষের ছবি দেখিয়ে বলেন যে, এ সমস্ত সদ্গুরু-মূর্তির যেটি ভাল লাগে তাঁরই ধ্যান করা চলে, তাঁর নিজের ধ্যান করার দরকার নেই। তখন সতীশচন্দ্র একটি কৌশল করেন। ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেন যে গুরুর সব আদেশই পালনীয় কি না। ঠাকুর ইতিবাচক উত্তর দেওয়াতে বলেন-পূর্বের অনেক সদ্গুরুই তো লোককে তাঁদের ধ্যান করতে নিষেধ করতেন, সে-ক্ষেত্রে তাঁদের মূর্তি ধ্যান করলে তো গুরুর আদেশ অমান্য করা হয়। প্রত্যুত্তরে ঠাকুর বলেন-এমন ক্ষেত্রে গুরুর আদেশ অমান্য করা চলে। সতীশচন্দ্র তখন বলেন-তবে এক্ষেত্রে আমরাও আপনার আদেশ অমান্য করতে পারি। ঠাকুর তখন “পুত্রাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ঃ” এই নীতির গৌরবে হার মেনে নিয়ে চুপ করে যান।
ঠাকুর-জননী মাতা মনোমোহিনী দেবীও তাঁর পুত্রের মূর্তি শিষ্যরা সদ্গুরু- জ্ঞানে ধ্যান করে, এ ব্যাপারটি ঠিক মেনে নিতে পারেননি। সতীশচন্দ্রকে একদিন বলেন- হ্যাঁরে, তোরা ওর মূর্তি ধ্যান করিস কেন? সতীশচন্দ্র উত্তর দেন-শ্রীকৃষ্ণ কিম্বা অন্য কোন সদ্গুরু-মূর্তিধ্যান করতে গেলেই যে আপনার ছেলের মূর্তিধ্যানে উপস্থিত হন, কী করব? মা কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গে বলেন—তা যদি সত্যি হয় তো কর।
ঐদিন দুপুরে ঠাকুরের বাড়িতেই ঠাকুর, সতীশচন্দ্র ও অন্য ক’জন আহারে বসেছেন। ঠাকুর মাকে ডেকে বলেন, তাঁর আহার্য মা যেন তাঁর ইষ্টকে নিবেদন করে নিজে একটু খেয়ে প্রসাদ করে দেন, তারপরে ঠাকুর খাবেন। মা বলেন-এখন পারি না। কিন্তু ঠাকুর অবুঝ বালকের মত বারবার ঐ একই কথা বলে আবদার করতে থাকেন। মা তখন বাধ্য হয়ে ঠাকুরের আহার্য তাঁর ইষ্টকে নিবেদনের জন্য বসেন। তিনি চোখ বন্ধ করে ধ্যানে তাঁর ইষ্টদেবতাকে ভোজ্য নিবেদন করতে গিয়ে দেখেন তাঁর পুত্রই আজ ইষ্টের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ভোজ্য গ্রহণ করছেন। তারপর চোখ খুলে ছেলের দিকে চেয়ে বলেন-এখন কি তোর এঁটো আমাকে খেতে হবে নাকি? ঠাকুর পরম বিস্ময়ে বলেন-ওমা, সে কী কথা! মা বলেন-ইষ্টকে নিবেদন করলাম, দেখলাম তো তুই-ই খেয়ে গেলি! ঠাকুর আবার একই ভাবে বলেন-ওমা, সে কী কথা! উপস্থিত সকলেই বুঝলেন—কথাটা কী। এরপরে জননীদেবী আর কাউকে কখনও তাঁর ছেলের মূর্তি ধ্যান করতে নিষেধ করেননি।
১৯১৮ খৃষ্টাব্দে একবার কলকাতার উপকন্ঠে এক ধনী ভক্তের বাগানবাড়িতে অন্যান্য অনেকের সঙ্গে সতীশচন্দ্রও এসে কয়েকদিন ছিলেন। তাঁরা পৌঁছনোর দু’দিন পরে ঠাকুরও সেখানে আসেন এবং সপ্তাহখানেক অবস্থান করেন। তখনও ঠাকুরের বহুল প্রচারের যুগ আরম্ভ হয়নি। কিন্তু সতীশচন্দ্র প্রথম থেকেই সর্বত্র ঠাকুরের কথা, বিশেষতঃ তাঁর কৃপায় কত অসম্ভব সম্ভব হয়েছে, সে সমস্ত কথা বলতেন। তাঁরা যখন ঐ বাগানবাড়িতে উপস্থিত হন, তখন গুরুভ্রাতাদের মধ্যেই কয়েকজন সতীশচন্দ্রকে বিদ্রুপ করে বলেন যে, তিনি সত্য-প্রচারের বদলে মানুষ-প্রচার করছেন এবং অলৌকিক ঘটনাবলির প্রচার করছেন। সতীশচন্দ্র এতে মনে ব্যথা পেলেও কিছু বলেন না। দু’দিন পরে শ্রীশ্রীঠাকুর এসে পৌঁছন। তাঁকে নিয়ে সকলে দোতলার একটি ঘরে গিয়ে বসেন। সতীশচন্দ্র একতলার একটি ঘরেই ছিলেন; ঠাকুর ডাকলে তবে দোতলায় যাবেন- এরকম মনে ভাবেন তিনি। তৎক্ষণাৎ ঠাকুর তাঁকে ডেকে পাঠান। তিনি দোতলায় উঠে প্রণাম করার পরে ঠাকুর তাঁর কাছে জানতে চান—কী হয়েছে। তিনি বলেন- সবই তো জানেন, কী বলব! তখন ঠাকুর তাঁকে একান্তে ডেকে তাঁর সব কথা শোনেন এবং বলেন—কারো কথায় অসন্তুষ্ট হবেন না। যা জ্ঞান-বিশ্বাস মতে সত্য বলে জানেন, নির্ভীকভাবে সেই সত্য প্রচার করবেন।
ঐদিন সন্ধ্যায় আবার কয়েকজন সতীশচন্দ্রের উদ্দেশ্যে ঐ জাতীয় কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। সতীশচন্দ্র নীরবে বসে থাকেন। এমন সময়ে শ্রীশ্রীঠাকুর সেখানে প্রবেশ করে জিজ্ঞাসা করেন যে কী কথা হচ্ছে। আর এক ভক্ত অশ্বিনী বিশ্বাস বলেন -সতীশ ডাক্তার সত্যপ্রচার না করে মানুষ প্রচার করে ও অলৌকিক ঘটনার কথা বলে, তা কেউ কেউ পছন্দ করেন না, সেই কথা হচ্ছে। ঠাকুর তখন সতীশচন্দ্রের কাছে তাঁর অভিমত জানতে চান। সতীশচন্দ্র জানান যে তাঁর বিশ্বাস-সত্য যাঁর মাধ্যমে লাভ করা যায়, সেই মানুষ এবং সত্য পৃথক নয়। সুতরাং সেই মানুষটিকে গোপন রেখে শুধুমাত্র সত্য প্রচার ভণ্ডামি। ঠাকুর বলেন—যা ভাল বোঝেন বলুন, কিন্তু ধোপে টিকলে হয়! অশ্বিনী ‘ধোপে টেকা’ মানে কী জানতে চাওয়ায় ঠাকুর বলেন- ধোপে টেকা মানে বুক না কাঁপলে হয়। তখন অশ্বিনী এবং অন্যান্য গুরুভ্রাতাগণ বুঝলেন যে সতীশচন্দ্রের প্রচাররীতি শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুমোদিত। তখন তাঁরা নিজেদের ভ্রম স্বীকার করে সতীশচন্দ্রকে প্রাণ খুলে প্রচার করতে বলেন।
দীক্ষাগ্রহণের পূর্বে সতীশচন্দ্রকে শ্রীশ্রীঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন—বহুকাল ধরে নানাপ্রকার সাধনা করে ফল পাননি, কিন্তু এই প্রণালীটি এতই চমৎকার যে একচল্লিশ দিন সাধনা করলে আশ্চর্য ফল পাবেন। দীক্ষার পর পনের দিনের মধ্যেই নানাপ্রকার উপলব্ধি হতে থাকে সতীশচন্দ্রের। মনের মধ্যে আসে তীব্র আনন্দের অনুভূতি। বিভিন্ন প্রকার ধ্বনি, নাদ শ্রবণ ইত্যাদি সাধন জগতের অনুভূতিসমূহ অতি সহজেই তাঁর আয়ত্তে আসে। জীবনের অন্য সব কাজের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে গভীর ও গতিময় নাম-ধ্যান ও যজন-যাজন। সতীশচন্দ্র নিজের মধ্যেই খুঁজে পেলেন এক অন্য সত্তা, ইষ্টচিন্তায় যা সর্বদাই তন্ময়।
সতীশচন্দ্র যে সময়ে দীক্ষা নিয়েছিলেন আশ্রমের সে সময়টিকে বলা যায় কীর্তনের যুগ বা মহাভাবাবস্থার যুগ। প্রকৃতপক্ষে এই সময়কে পাবনা সৎসঙ্গের ঊষা লগ্ন বলা চলে। তখনও গড়ে ওঠেনি বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠান। সম্বল ছিল শুধুমাত্র কিছু মানুষের ভালবাসা, নিষ্ঠা, আর প্রত্যয়ের অপ্রতিরোধ্য গতি। ঠাকুর ছিলেন তাঁদের ঘরোয়া সম্পদ, পরিবারের একজন। হাসিকান্না সুখদুঃখ সবই তাঁরা বন্টন করে নিতে চাইতেন ঠাকুরের সঙ্গে একত্রে। এই ভালবাসার মানুষটিকে শুধু নিজেরা উপভোগ করে শান্তি পেলেন না তাঁরা, চাইলেন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। শুরু হল প্রচারের যুগ। এই প্রচারের যুগেই ঠাকুরকে নিয়ে প্রথম জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন সতীশচন্দ্র জোয়ারদার। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩২ বঙ্গাব্দে। তখন বইটির নাম ছিল “জননী মনোমোহিনী ও শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র”। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণের নাম রাখা হয় “শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র”; নামের এই পরিবর্তনের কারণ-জননী মনোমোহিনী দেবীর কথা গ্রন্থে স্বল্পই আছ। বইটির ভূমিকায় বলা হয়েছে, “.... পুরুষোত্তম - লীলাপ্রসঙ্গখানি চিরদিন ভক্তহৃদয়ে সুধাবর্ষণ করবে। গ্রন্থখানির সাহিত্যিক মূল্য যাই হোক না কেন, পুরুষোত্তমের প্রথম প্রকাশিত জীবন-আলেখ্য হিসাবে বাংলার সারস্বত প্রাঙ্গণে এর মূল্য থাকবেই।”
এই গ্রন্থটি থেকে সৎসঙ্গের ঊষালগ্নের অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। যদিও এটিতে জীবনীর পারম্পর্য বা ধারাবাহিকতার পরিবর্তে অলৌকিক ঘটনার সমাবেশের বাহুল্য লক্ষ করা যায়, তবুও শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রথম জীবনীকার হিসাবে সতীশচন্দ্র জোয়ারদার চির প্রণম্য হয়ে থাকবেন। তাঁর অবদান এই পুস্তক-অবলম্বনে সেকালে ফিরে যেতে ভক্ত সমাজের অসুবিধা হবে না। সতীশচন্দ্র বহুদিন আগে চলে গিয়েছেন অমৃতলোকে, কিন্তু তাঁর এই গ্রন্থের মধ্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন ভক্তহৃদয়ে যুগ যুগ ধরে।
__________________________
#সতীশচন্দ্র_জোয়ারদার
10