সুশীলচন্দ্র বসু :-
🔷 পঁচাত্তরটি আম খেয়ে ফেললেন সুশীলচন্দ্র .. কি করে ?
🔷 তোমার গুরু যিনি হবেন, তাঁর সঙ্গে আজ থেকে চার বছর পরে দেখা হবে...
🔷 অজ্ঞান অবস্থাতেও হাত উঁচু ক’রে ঝোলাটি তুলে ধরে রেখেছিলেন তিনি- ওতে যে ঠাকুরের ওষুধ! ....
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নবীন বয়সে তাঁর সান্নিধ্যে এসে তাঁর অসাধারণ প্রেমস্বরূপ সত্তার সন্ধান যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁরা উচ্চ আধ্যাত্মিক অধিকার সম্পন্ন এবং পরম সৌভাগ্যবান। বিশেষ অধিকার বিশিষ্ট না হলে তদবধি অখ্যাত একান্ত তরুণ ঐ মানুষটির আকর্ষণে জাগতিক সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের পথ পরিত্যাগ করে সানন্দে নিজেকে উৎসর্গ করা সম্ভব হত না। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সুশীলচন্দ্র বসু এই উচ্চ আধার এবং লোকোত্তর সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলেন। ধীশক্তি, কর্মতৎপরতা, সাধনা, লোকসংগ্রহ - সব দিক থেকে সুশীলচন্দ্র ছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের সৌরমণ্ডলীর অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। ঠাকুরের কাছে একেক ব্যক্তি একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসেছেন, এবং ঠাকুরের প্রেমশক্তিতে প্রত্যেকের দক্ষতা অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে গেছে। সুশীলচন্দ্রের মধ্যে ছিল সহজাত জ্ঞানানুরাগ, সংহত, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং অদম্য কর্মবুদ্ধি, ঠাকুরের পরশমণির ছোঁয়ায় যা অশেষ উজ্জ্বলতা লাভ করেছিল। তাঁর এক বিশেষ নিপুণতা ছিল সমাজের প্রতিষ্ঠিত, মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চবর্গের লোকেদের কাছে স্বচ্ছন্দ গমনাগমনের। মৃদুভাষী অথচ দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুশীলচন্দ্র ক্ষমতায় ও পাণ্ডিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত সমাজে ঠাকুরের বার্তা এবং ভাবধারা নিয়ে অনায়াস কুশলতায় উপস্থিত হতেন। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন ঠাকুরের অমল সন্নিধানে, তাঁর একান্ত আপনজন হয়ে।
সুশীলচন্দ্র বসুর আদি নিবাস যশোহর জেলার হরিণাকুণ্ডা গ্রামে, পিতা প্রতাপচন্দ্র, মাতা রমণীবালা। প্রতাপচন্দ্র ব্যবসার প্রয়োজনে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে সস্ত্রীক বসবাস করতেন; এখানেই ১৮৯০-এর ৭ই নভেম্বর সুশীলচন্দ্রের জন্ম হয়। বাল্যকাল থেকেই সুশীলচন্দ্র ছিলেন ধীর, স্থির, মেধাবী ও সাধুসজ্জন-প্রিয়। শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্যান্য পার্ষদবৃন্দের মত সুশীলচন্দ্রের ভিতরেও ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক প্রবণতা লক্ষণীয়। কলকাতা থেকে কৃত্বিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স ও আই. এ. পাশ করেন। কলকাতায় স্কুলে পড়াকালীন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃত পাঠ করে তাঁর অপূর্ব অনুভূতি হয়। পরবর্তীকালে কলেজে পড়ার সময় শ্রীমা সারদা দেবীর সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য হয় তাঁর। এছাড়া শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভ্রাতুস্পুত্র রামলালদাদা ও বেলুড়মঠের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট রাখাল-মহারাজের সঙ্গেও সুশীলচন্দ্রের পরিচয় হয়। রাখাল-মহারাজ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে সুশীলচন্দ্র কিছুদিন ভাগলপুরে ছিলেন; সেখান থেকে বি. এ. পাশ করে এসে কিছুদিন গ্রামের স্কুলে প্রধান শিক্ষকতা করেন। এর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. এবং আইন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু জীবনের গতি কোন দিকে বাঁক নিতে চলেছে, তা হয়ত তিনি তখন স্বপ্নেও ভাবেননি।
১৯১৭ সালের ৬ই নভেম্বর সুশীলচন্দ্র কুষ্টিয়া শহরে ভগ্নীগৃহে আসেন; ভগ্নী- পতি শ্রীঅশ্বিনী বিশ্বাস। সে বাড়িতে প্রবেশ করে বাইরের ঘরে দেখেন এক সুদর্শন ব্রাহ্মণ যুবক খালি গায়ে বসে আছেন। তাঁর দৃষ্টি অত্যন্ত উজ্জ্বল, অথচ কোমল, স্নেহমাখা। সুশীলচন্দ্র ঘরে প্রবেশ করা মাত্র যুবকটি অনেককালের চেনা মানুষের মত এগিয়ে এসে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করেন-আমাকে কীরকম লাগে, দাদা! একান্ত আপনজনসুলভ এই আচরণে অভিভূত সুশীলচন্দ্র বলেন- আপনার সঙ্গে আমার এই যে প্রথম পরিচয় তা তো মনে হচ্ছে না; মনে হচ্ছে আপনি আমার বহুদিনের পরিচিত বন্ধু। সুদর্শন যুবকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, প্রথমে আপনাকে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক বলেই ভেবে নিয়েছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যেন আপনিও আমার বহুদিনের পরিচিত বন্ধু।
কিছুক্ষণ পরে বাড়ির ভিতরে এসে ভগ্নীপতি অশ্বিনী বিশ্বাসের কাছ থেকে জানতে পারেন সুশীলচন্দ্র যে যুবকটির নাম অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী, তাঁরা এঁকে শ্রীশ্রীঠাকুর বলে ডাকেন। পাবনার হিমাইতপুরে শ্রীশ্রীঠাকুরের নিবাস। আরও শোনেন -কীর্তন করতে করতে এঁর ভাবসমাধি হয়, এবং সমাধিস্থ অবস্থায় বহু বাণী উচ্চারিত হয় মুখ থেকে। খানিকক্ষণ পরে সুশীলচন্দ্র আবার যান বাইরের ঘরে ঠাকুরের কাছে। সেখানে এবার এমন কিছু ব্যক্তিকে দেখতে পান যারা সমাজে কুখ্যাত নিকৃষ্ট চরিত্রের মানুষ, ফৌজদারি দণ্ডবিধির বহু ধারায় অভিযুক্ত। পরে তিনি জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলেন যে এই মহাপুরুষের সংস্পর্শে এসে এদের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন হয়েছে, রূপান্তরিত হয়েছে এরা সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষে।
রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর নিরালায় একান্তে বসেন সুশীলচন্দ্র ঠাকুরের শয্যাপার্শ্বে কিছু প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্ন করতে থাকেন তিনি, আর মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে অনর্গল উত্তর দিতে থাকেন ঠাকুর। দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র সুশীলচন্দ্র বিস্মিত হয়ে ভাবেন -তথাকথিত উচ্চশিক্ষাবিহীন মানুষটি কীভাবে এত সহজে এত জটিল তত্ত্বের সমাধান করছেন! ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সমস্যার আলোচনায় মুগ্ধ হন সুশীলচন্দ্র। কথায় কথায় ভোর হয়ে এসেছে। হাতমুখ ধুয়ে আবার তিনি এসে বসেন ঠাকুরের কাছে। ঠাকুরের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন তিনি; একটা মানুষের কথাবার্তায় ভাবভঙ্গিতে যে কত ভালবাসা থাকতে পারে তা বোঝেন ঠাকুরকে দেখে। সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য তাঁর গভীর অনুভূতি প্রবলভাবে আলোড়িত করে সুশীলচন্দ্রের অন্তর-অভিভূত ভাবে তিনি এগিয়ে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে বলেন, আমাকে দীক্ষা দিন, পথ দেখিয়ে দিন। ৭ই নভেম্বর, ১৯১৭ দীক্ষা হয়ে গেল সুশীলচন্দ্রের, দীক্ষা দিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং।
কয়েক বছর আগে ভাগলপুর কলেজে পড়ার সময় এক সাধুর সঙ্গে আলাপ হয় সুশীলচন্দ্রের, তিনি সম্পর্কে ব্রাহ্ম সমাজের নেতা কেশব সেনের মাতুল। সাধুটির সঙ্গে আলাপ আলোচনায় তাঁর মনে হয়েছিল তিনি খুব উচ্চস্তরের সাধক। একবার এক সহপাঠীকে নিয়ে যান সুশীলচন্দ্র ঐ সাধকের কাছে। সাধক ঐ সহপাঠীকে দীক্ষা দেন, কিন্তু সুশীলচন্দ্র দীক্ষা নিতে চাইলে তিনি বলেন-তোমার গুরু যিনি হবেন, তাঁর সঙ্গে আজ থেকে চার বছর পরে দেখা হবে। তিনিই তোমাকে দীক্ষা দেবেন। সেই দিনটি ছিল ১৯১৩ সালের ৬ই নভেম্বর। তখন সাধুজির কথা মনঃপূত হয়নি সুশীলচন্দ্রের, কিন্তু ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর দীক্ষা নিয়ে সেকথা মনে করে রোমাঞ্চিত হন তিনি। সদ্গুরু গ্রহণের ব্যাপার পূর্বনির্ধারিত থাকে; সেই কারণেই শ্রীশ্রীমা সারদা দেবী ও বেলুড় মঠের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাখাল- মহারাজের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও তিনি সেখানে দীক্ষা গ্রহণ না করে দীক্ষা নিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে।
দীক্ষার পরের দিনটা কাটল ঠাকুরের সঙ্গে নানা আলাপ আলোচনা কথাবার্তার ভিতর দিয়ে। ৯ই নভেম্বর সকালে ঠাকুর গেলেন রাতুল পাড়ায়, কুষ্টিয়া থেকে মাইল চারেক দূরে। সুশীলচন্দ্র কলকাতা ফিরে যাবেন ভেবে গেলেন না ঠাকুরের সঙ্গে। কিন্তু ঠাকুর চলে যাবার পরই তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল ঠাকুরের সঙ্গলাভের জন্য। সেই দিনটি কাটল ব্যাকুলতা নিয়ে- পরদিন, অর্থাৎ ১০ই নভেম্বর সকালে রাতুলপাড়ায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁকে দেখেই ঠাকুর গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলেন,-এই কথাই এতক্ষণ ভাবছিলাম যে, আপনি এলে খুব আনন্দ হ’ত, তাই পরমপিতা আপনাকে মিলিয়ে দিলেন। সুশীলচন্দ্র বললেন-আপনি চলে আসার পরই আপনাকে দেখবার জন্য মনটা কেন জানিনা অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠল, তাই চলে এলাম। খুব ভাল করেছেন—বলে ঠাকুর তাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। নানা কথাবার্তা হল দুপুর পর্যন্ত।
সন্ধ্যায় আরম্ভ হল কীর্তন, সঙ্গে চলল নৃত্য। কিছুক্ষণের মধ্যে ঠাকুর যোগ দিলেন কীর্তনে। তাঁর যোগদানে এক অদ্ভুত মাতোয়ারা ভাব সঞ্চারিত হল সকলের মধ্যে। ভাষার অতীত অপূর্ব মনোহর নৃত্যভঙ্গী ঠাকুরের-মুখমণ্ডল জ্যোতি বিভায় উদ্ভাসিত। ইতিপূর্বে সুশীলচন্দ্র কখনও কীর্তনে অংশগ্রহণ করেননি, কিন্তু তিনিও আর স্থির থাকতে পারলেন না, দু’বাহু তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কীর্তনে। কীর্তন যখন তুঙ্গে তখন হঠাৎ ঠাকুরের দেহখানি বাহ্যজ্ঞানশূন্য ও বিবশ হয়ে মাটিতে এলিয়ে পড়ল। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটি থরথর করে কাঁপছে। এই সময়ে কেউ তাঁর দেহ স্পর্শ করত না, কারণ স্পর্শে তাঁর খুব কষ্ট হত। সুশীলচন্দ্র তাঁর শিয়রের কাছে এসে বসলেন; দেখলেন—তাঁর চোখ দুটি পলকহীন, চক্ষু তারকা স্থির, অচঞ্চল, কপালটা চক্চক্ করছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলেন শরীর হিমশীতল, বুকে হাত দিয়ে হৃৎস্পন্দনের কোন লক্ষণই পেলেন না- অথচ এই তাণ্ডব কীর্তনের পর শরীরে উত্তাপ ও হৃৎস্পন্দন, দুই-ই বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।
বিস্ময়ের ঘোর না কাটাতেই ঠাকুরের কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন “রাম, ওগো রাম, সব রক্ত-কেবল রক্ত, রক্তগঙ্গা ছুটে গেল, এখনও নীরব, নিস্পন্দ? এখনও ঘাতকের মত ভুলে আছিস? প্রেমের সন্তান তোরা?... ঐ দ্যাখ ঐ দেশের মাটিতে, বুকে ধরে, হৃৎপিণ্ড দিয়ে কে প্রেম দিয়ে গেছে রে? ওরে সে যে আমারই... নির্দয় রূপে চোরের মত ক্রুশ বিদ্ধ হয়েছিল। আর তোরা এখনও নীরব, নিস্তব্ধ? পশুর মত কামাসক্ত, আমোদপ্রিয়?”
সময়টি ছিল ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তখন পৃথিবী জুড়ে; সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে লক্ষ্য করেই এই বাণী, বুঝলেন সুশীলচন্দ্র। তারপর আবার বাণী নির্গত হল-“যা কিছু হচ্ছে, যা কিছু কচ্ছে, সব শব্দ তরঙ্গ থেকে; চৈতন্য তরঙ্গই ব্রহ্ম। সহস্র দল থেকে বাইরের ধারা পিণ্ডে এসেছে”। সেদিনের সেই মহাভাবাবস্থা চল্লিশ মিনিটের মত স্থায়ী ছিল। বাহ্যজ্ঞান সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসার পূর্ব মুহূর্তে অনন্ত মহারাজের হাতে জল পান করেন। সমাধিভঙ্গের বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁকে সুস্থ ও স্বাভাবিক বলে মনে হওয়ায় সুশীলচন্দ্র ঠাকুরকে প্রশ্ন করেন, আপনার যে অবস্থা কিছুক্ষণ পূর্বে দেখলাম, এটা কী? একেই কি সমাধি বলে? সাধনার চরমে কি এই অবস্থা হয়? এই অবস্থায় আপনি কথাই বা বলেন কী করে-আর যা বলেন তার অর্থই বা কী? উত্তরে তিনি বলেন, আমার এই অবস্থার কথা যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি সহজ বা স্বাভাবিক অবস্থায় যা বলি তার দায়িত্ব আমার, আমার যখন কোন জ্ঞান বা চৈতন্য থাকে না, তখনকার কথার মানে আমি বলি কী করে? ওটা আপনারাই বিচার করে বুঝবেন। সুশীলচন্দ্র জানতে চান যে, ঠাকুর নির্জনে সাধনা করেন কি না। উত্তরে তিনি জানান, একান্তে বা নির্জনে বসে সাধনা তিনি কখনও করেননি। জ্ঞান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই সৎনাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ হয়েছিল তাঁর মধ্যে এবং তিনি অহর্নিশি এই নাম জপ করতেন। তিনি ভাবতেন, সবারই বোধহয় এটা স্বাভাবিক পরে অবশ্য তাঁর এই ধারণা দূর হয়। এমন চমকপ্রদ উত্তর সুশীলচন্দ্র আশা করেননি -কোন মহাপুরুষ বা অবতার পুরুষের জীবনে এমনটি ঘটেছে বলে তাঁর জানা ছিল না।
আরও অনেক কথা হল তাঁর শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে; শুনলেন ঠাকুরের বাল্য- জীবনের নানা অনুভূতির কথা, যোগীর যোগসাধনায়ও যা অপ্রাপ্য। পরের দিনটিও সুশীলচন্দ্র ঠাকুরের সঙ্গে কাটালেন, তারপর ফিরে এলেন কলকাতায়। ঠাকুরের সাহচর্যের তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন প্রতিমূহূর্তে, মনপ্রাণ ছেয়ে আছে এক আনন্দময়তা; তাঁর সান্নিধ্যের সুখানুভূতির স্মৃতিতে অভিভূত হয়ে আছেন সর্বদা। নামধ্যান যেন নেশার মত পেয়ে বসেছে, সর্বক্ষণ তাঁরই স্মরণে-মননে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। ঠাকুরের অকৃত্রিম ভালবাসার কথা প্রতিক্ষণেই মনে পড়ে। কলকাতা আর কোনভাবেই আকর্ষণ করতে পারছে না, তাঁর সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন সুশীলচন্দ্র। ঠিক করে নিলেন, আইনের তৃতীয় পরীক্ষাটি আর দেবেন না; এম. এ.-র পাঠক্রম শেষ হয়ে এসেছে-তাই ঠাকুরের কাছে আশ্রমে গিয়ে থাকলেও পরে এসে পরীক্ষাটা দেওয়া যাবে।
সমস্ত ভাবনাচিন্তার অবসান ঘটিয়ে ১৯১৮ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি স্থায়িভাবে চলে আসেন পাবনার হিমাইতপুর আশ্রমে। আশ্রম প্রাঙ্গণেই দেখা হল ঠাকুরের সঙ্গে। প্রণাম করতেই স্মিতহাস্যে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন-এসেছেন, বেশ ভালই হয়েছে। বেশ স্ফূর্তিতে থাকা যাবে। এই কথা ক’টির মধ্যে যে অদ্ভুত প্রেরণা ও আনন্দ লাভ করলেন সুশীলচন্দ্র, তা ভাষায় অপ্রকাশ্য। তখন আশ্রম বলতে বিস্তীর্ণ পদ্মাতীরে বাবলা গাছের তলায় তিনটি ছোট ঘর। ঘরের মেঝে মাটির, ছাউনি কোনটার খড়ের, কোনটার টিনের। প্রাঙ্গণটি গোবর মাটি দিয়ে তক্তকে করে নিকোনো। যেন একটি পরিচ্ছন্ন চিত্র। পদ্মার কূল ঘেঁষে পশ্চিমমুখী ঘরটিতে বাঁশের মাচায় রাত্রে ঠাকুর ও অনন্ত মহারাজ থাকতেন—তাঁদের দুজনের মাঝে শোওয়ার স্থান ঠিক হল সুশীলচন্দ্রের।
আশ্রমের তখন আদিপর্ব। অনন্ত মহারাজ ব্যতীত আশ্রমবাসী বলতে ছিলেন মাত্র দুজন, নফরচন্দ্র ঘোষ এবং ঠাকুরের কম্পাউণ্ডার যতীন্দ্রনাথ সরকার। ঠাকুরের মা মনোমোহিনী দেবী ছিলেন সাক্ষাৎ জগজ্জননী। তাঁর আচার আচরণে আপন জননীর প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন সুশীলচন্দ্র। রাত্রি থাকতেই উঠে নামধ্যান, সকাল হতেই ঠাকুরের স্নেহমধুর সঙ্গ, উদ্দীপনী আলোচনা, বেলা হলে ঠাকুরের সঙ্গে পদ্মানদীতে স্নান, সাঁতার কাটা, আহারান্তে বিশ্রামের পর ঠাকুরের সঙ্গে গভীর বিষয়ে আলাপ, কোন কোন দিন কীর্তন, আবার কখনও বা পদ্মাবক্ষে নৌকায় ভ্রমণ-এরকম নিরবচ্ছিন্ন আনন্দে সারাদিন কেটে যায় সুশীলচন্দ্রের। হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে জরুরি চিঠি পেলেন বাড়ি যাবার জন্য। বাড়ির তাগিদের কথা ঠাকুরকে বলায় তিনি বলেন, কত আবর্তনের ভিতর দিয়ে আপনি আজ এ শরীর নিয়ে এসেছেন। কত জন্মই তো গেছে-এই জন্মটা এই বামুনের কাছে দিয়ে দেখুন না কী হয়। ঠাকুরের কথায় সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায় ভক্ত সুশীলচন্দ্রের, নিশ্চিন্ত হন তিনি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে পরিচয়ের পূর্বে, ১৯১৬ সালে কলকাতার এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের কন্যা নিরূপমা দেবীর সঙ্গে সুশীলচন্দ্রের বিবাহ হয়। মাতা মনোমোহিনী দেবীর নির্দেশে ১৯১৮ সালের শেষ দিকে সুশীলচন্দ্র স্ত্রীকে নিয়ে আসেন আশ্রমে। ঠাকুর তাঁকে ‘রাণীমা’ বলে ডাকতেন, তাই আশ্রমে ঐ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। সুশীলচন্দ্রকে আশ্রম থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাড়ি থেকে যেমন প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না, তেমনই তাঁর শ্বশুর মহাশয়ও জামাতাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন। সেই সময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরিরও ব্যবস্থা করেন তিনি সুশীলচন্দ্রের জন্য, কিন্তু কোন আকর্ষণই আকৃষ্ট করতে পারেনি তাঁকে। তিনি পেয়েছেন জগতের সবসেরা আকর্ষণের কেন্দ্র, যেখানে আর সব চাওয়া পাওয়াই তুচ্ছ।
ঠাকুরের পিতা শিবচন্দ্র একবার সুশীলচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন-তোমরা ওর (ঠাকুরের) মধ্যে এমন কী দেখলে যে এত কষ্ট করে এখানে পড়ে আছ? বলি ভগবান কি আর কোথাও জায়গা না পেয়ে শেষে শিব চক্কোত্তির ঘরে এসেই ঢুকল? আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না।... তোমাদের মা-ও (মনোমোহিনী দেবী) তো ওর সঙ্গে সায় দিয়ে চলেন। তাঁরও তো কোন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই, তা থাকলে আর এরকম হত না।
উত্তরে সুশীলচন্দ্র বলেন-দেখুন, আপনার ছেলেকে আপনি আরও পাঁচজনের মতই মনে করেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ছেলের মধ্যে কোন বিশেষ গুণ না থাকলে এত লোক তাঁর আকর্ষণে এখানে এসে ভিড় করবে কেন? ভগবানে আমরা যে-সব গুণ আরোপ করে থাকি, সে-সব গুণের প্রকাশ আপনার ছেলের মধ্যে দেখে বলেই মানুষ তাঁকে ভগবান বলে। যুগে যুগে তো ভগবান এমনি করেই কখনও দেবকীর গর্ভে, কখনও শচীমাতার গর্ভে, কখনও চন্দ্রমণির গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। সেরকমভাবে আপনার ঘরেই যদি এসে থাকেন তবে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? আপনি মহা ভাগ্যবান। শিবচন্দ্র কথাগুলি শুনে গেলেন, কোন উত্তর দেননি।
ধীরে ধীরে আশ্রমে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রয়োজনমত তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে চালনার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে কার্যনির্বাহক সমিতির, ১৯২৫ সালে যা প্রতিষ্ঠিত হয়। সৎসঙ্গের এই সমিতির প্রথম সম্পাদক হন সুশীলচন্দ্র বসু। বনজংলায় ঘেরা, অশিক্ষা, অন্তঃকলহ, রোগব্যাধিতে ভরা হিমাইতপুর গ্রাম কর্মচঞ্চল হয়ে উঠল, পরিণত হল বাংলা তথা ভারতের এক আদর্শ গ্রামে। কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সৎসঙ্গ তপোবন বিদ্যালয়, বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র, মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল ওয়ার্কশপ, কেমিক্যাল ওয়ার্কস্, প্রেস ও পাবলিকেশন হাউস, কুটির শিল্প বিভাগ, ব্যাঙ্ক, পূর্তকার্য বিভাগ, মাতৃসঙ্ঘ, স্বাস্থ্য বিভাগ, কলাকেন্দ্র, আনন্দবাজার (ভোজনালয়), গৃহনির্মাণ বিভাগ, ফিলানথ্রপি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংগঠন বিষয়ে সুশীলচন্দ্র ছিলেন ঠাকুরের দক্ষিণহস্তস্বরূপ; ঠাকুরের নির্দেশ অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন কর্মযোগী সুশীলচন্দ্র।
একবার উৎসবের অল্প কয়েকদিন আগে ঠাকুর বললেন-নিজেদের স্থায়ী প্যাণ্ডেল ও স্টেজ করতে হবে। হাতে সময় নেই; সতের দিন ধরে হবে উৎসব- তদনুযায়ী মজবুত হওয়া দরকার প্যাণ্ডেল। ঠাকুরের নির্দেশ, সুশীলচন্দ্র আর দেরি না করে চলে এলেন কলকাতায়। বিখ্যাত ব্যবসায়ী ভবতোষ ঘটককে ধরলেন লোহার স্ট্রাকচার আর করোগেটেড টিন দেওয়ার জন্য, যার মূল্য তখনকার দিনে দশ হাজার টাকা। সুশীলচন্দ্রের সঙ্গে কোন টাকা নেই, অচেনা ব্যবসায়ী এত টাকার জিনিস ধারে দিতে রাজি নন। সুশীলচন্দ্রের মানসপটে ভেসে উঠল দয়াল ঠাকুরের শ্রীমুখখানি, তাঁর আদেশ, উৎসবের আগে প্যাণ্ডেল হওয়া চাই। ঠাকুরের কথা মনে পড়তেই দেহে ও মনে তীব্র গতি পেলেন সুশীলচন্দ্র, খুব জোর দিয়ে ঘটককে বললেন, দেশের কাজে, নরনারায়ণের ইচ্ছাপূরণে আমি এসেছি আপনার কাছে। হয় আপনি আমাকে জিনিস ধারে দেবেন, না হলে আপনাকে নামতে হবে আমার সঙ্গে কাজে। সুশীলচন্দ্রের ব্যাক্তিত্বের দৃঢ়তা ও মুখচোখের অভিব্যক্তি দেখে ঘটক বলেন- পাঁচশো টাকা এক ঘন্টার মধ্যে এনে দিতে পারলে তিনি ধারে সব জিনিস দেবেন। পথ পেয়ে গেলেন সুশীলচন্দ্র। অপেক্ষা না করে চলে গেলেন একটি ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কর্মী ইষ্টভ্রাতা প্রাণকৃষ্ণ মল্লিকের কাছে। তাকে কোম্পানীর ইংরেজ মালিকের কাছে পাঠিয়ে পাঁচশো টাকা এনে ঘটককে দিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস আশ্রমে নিয়ে এলেন। কাজ আরম্ভ হল এবং যথাসময়ে তা সুসম্পন্নও হল।
সুশীলচন্দ্র ছিলেন সাধনাসিদ্ধ পুরুষ। নিয়মিত সুগভীর নামধ্যানের অভ্যাস ছিল তাঁর মজ্জাগত। পাবনা থাকাকালীন বিকেল চারটে নাগাদ পদ্মার তীরে চলে গিয়ে নামধ্যানে বসতেন-পরদিন সকাল ন’টায় ফিরতেন। পরবর্তীকালেও শেষরাত্রি থেকে শুরু করে সকালে যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব বসে নাম করতেন। নামে ও ইষ্টপ্রেমে তাঁর সত্তা যে কতখানি বিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল, পরবর্ণিত ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার একটি ঝোলায় বেশ কয়েক শিশি ওষুধ নিয়ে ট্রামে করে যাচ্ছিলেন। এসপ্ল্যানেডে নামবেন বলে ঝোলাটি কাঁধে নিয়ে ট্রামের দরজার কাছে এসে একহাতে হ্যান্ডেলটি ধরে দাঁড়ালেন। এমন সময় সীট থেকে একজন উঠে হঠাৎ সুশীলচন্দ্রের হাতটি সরিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে নেমে গেল-সুশীলচন্দ্র টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়লেন রাস্তায়, আকস্মিক আঘাতে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। পথচারীদের পরিচর্যায় অল্পক্ষণের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি এবং বিস্ময়করভাবে ঝোলার সমস্ত কাচের শিশির ওষুধ অক্ষত ছিল, কারণ অজ্ঞান অবস্থাতেও হাত উঁচু ক’রে ঝোলাটি তুলে ধরে রেখেছিলেন তিনি- ওতে যে ঠাকুরের ওষুধ!
এক গভীর প্রশান্তি ও প্রসন্নতা বিকীর্ণ হত সুশীলচন্দ্রের সর্বাঙ্গ হতে-তাঁর সান্নিধ্যে এলেই যেন শান্তিলাভ করত মানুষ। কিন্তু এই প্রশান্তির মধ্যে বিন্দুমাত্র উদাসীনতা বা কর্মশৈথিল্যের স্থান ছিল না, নিয়ত নিরলসভাবে ইষ্টকর্মে নিযুক্ত রাখতেন নিজেকে এবং ইষ্টার্থবিষয়ক যে-কোন মূঢ়তা বা বিচলন দৃঢ়ভাবে সমূলে উৎপাটিত করতেন। তাঁর মাধ্যমে সৎনামপ্রাপ্ত নব্যদীক্ষিত এক তরুণ তাঁর প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন; শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রত্যক্ষ সঙ্গলাভের বিশেষ সুযোগ তখনও তরুণটির হয়নি। তিনি সুশীলচন্দ্রকে বলেন-সুশীলদা, আমার ঠাকুরকে ধ্যান না করে আপনাকে ধ্যান করতে আরও সহজ মনে হয়। এ কথা শোনামাত্র সুশীলচন্দ্র বজ্রনাদে এমনি প্রচণ্ড তর্জন করে ওঠেন যে তরুণটি হতচকিত হয়ে পড়েন; তাঁর মত এমন একান্ত অনুগামীকে যে সুশীলচন্দ্র এমনভাবে তিরস্কার করতে পারেন, এ ছিল তাঁর কল্পনারও অতীত! পরমুহূর্তে নবদীক্ষিত তরুণকে তাঁর ঋত্বিকদেবতা সুশীলচন্দ্র বলেন-সদ্গুরু ছাড়া আর কেউ ধ্যেয় নয়। ঐ তরুণই পরবর্তীকালে সফল ব্যবসায়ী ও ইষ্টপ্রাণ কর্মোদ্যোগী মধুসূদন বন্দ্যোপাধ্যায়; তাঁর নিজের ভাষায়- ‘আমাকে ঐ ধমকটা না দিলে কথাটা আমার মাথায় কিন্তু এমনভাবে ঠিকমত বসতো না। শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গ করলে তাঁর ওপর টান হবেই, কিন্তু যতক্ষণ তাঁর সংস্পর্শে আসবার সুযোগ না হয়, তখন অমন ঋত্বিকেরই অবশ্য প্রয়োজন।’
সুশীলচন্দ্র মিষ্টভাষী হলেও যথাস্থানে যথাযোগ্য দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন। কর্মযজ্ঞের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মের প্রয়োজনে বা শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবধারা প্রচারের জন্য সেকালের প্রখ্যাত বহু জননায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সুশীলচন্দ্র। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত সৎসঙ্গের ও সৎসঙ্গীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন তিনি; নেহরু কিছুটা ক্রোধান্বিত হয়ে বলে ওঠেন-এজন্য কি আমি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করব নাকি? সুশীলচন্দ্র দৃঢ়ভাবে বলেন-যুদ্ধ শুরু করার কথা হচ্ছে না, কিন্তু পূর্ববাংলায় যে পরিস্থিতি হয়েছে তা আপনাকে দেখতেই হবে। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে প্রধানমন্ত্রীর ক্রোধও প্রশমিত হয়- এরপরে সে বিষয়ে কী করণীয়, সে সম্বন্ধে নেহরু আলোচনা করেন।
যে-সমস্ত জননেতা বা খ্যাতিমান ব্যক্তিবৃন্দের সঙ্গে সুশীলচন্দ্রের পরিচয় হত, তিনি নিয়মিত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং অবকাশমত ঠাকুর বিষয়ক আলাপ আলোচনা করতেন। তাঁর যাজনে আকৃষ্ট হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরকে গুরুপদে বরণ করে ধন্য হয়েছেন বহু প্রথিতযশা ব্যক্তি। যাঁরা দীক্ষা নেননি, তাঁরাও ঠাকুরের প্রতি বিশেষ আগ্রহী এবং তাঁর অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন সুশীলচন্দ্রের যাজনগুণে।
ঠাকুরকে যাঁরা যথার্থভাবে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের জীবনে এমন অনেক ঘটনার সমাবেশ দেখা যায়, যা লৌকিক হয়েও লৌকিকোত্তর। একবার মাতা মনোমোহিনীর সঙ্গে হিমাইতপুর থেকে কুষ্টিয়ায় এসেছেন সুশীলচন্দ্র। এক গুরুভাইয়ের মেয়ের বিয়ে হয়েছে আগের রাত্রে। সেদিন বর ভোজন, বেলা দুটোর সময় নিমন্ত্রণ বাড়িতে প্রচুর খেয়েছেন। বিকেল চারটের সময় সেখান থেকে এসেছেন গোকুল বিশ্বাসের বাড়িতে। গোকুল বাবুর বাড়িতে প্রথম এসেছেন-তিনি কিছু না খাইয়ে ছাড়বেন না। কোন ওজর আপত্তি তিনি শুনতে নারাজ। আম ও প্রচুর সন্দেশ এনে দেন খাওয়ার জন্য। কোনরকমে তা গলাধঃকরণ করে সেখান থেকে সন্ধ্যায় বারাদীতে খোকা ডাক্তারের বাড়িতে আসেন সুশীলচন্দ্র। সেখানেও খোকা ডাক্তার তাঁকে খাওয়ার জন্য চেপে ধরেন। তিনি অনেক বোঝান-কিন্তু ডাক্তার নাছোড়বান্দা। অগত্যা তিনি কী খাওয়াবেন সুশীলচন্দ্র জানতে চাইলে তিনি বলেন-ভাল চিড়ে, ঘন দুধ আর বাড়ির গাছের মিষ্টি কলমের আম। নিরুপায় হয়ে খেতে বসেন সুশীলচন্দ্র। তিনি খেতে লাগলেন আর একটার পর একটা আম ছাড়িয়ে দিতে থাকেন খোকা ডাক্তার। এই ভাবে বাড়ির সব আম শেষ হয়ে গেল; পাশের বাড়ি থেকে আম এনে দিলেন ডাক্তার, তাও সব শেষ। এমনি করে পঁচাত্তরটি আম খেয়ে ফেললেন সুশীলচন্দ্র।
তখন খোকা ডাক্তার সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বললেন—আপনারা হলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের আপনজন, আপনারা যে এমন বিশ্বম্ভর মূর্তি ধারণ করতে পারেন, তা আমার আগে জানা উচিত ছিল। আমার দর্প চূর্ণ হল, আর কখনও আপনাকে খাওয়ানোর জিদ করব না।
হরিতকী বাগান লেনের বাড়িতে থাকার সময় একবার ঠাকুর সুশীলচন্দ্রের কাছে একটি পকেট ওয়াচ চান। সুশীলচন্দ্র ওমেগা কোম্পানির ভাল ঘড়ি কিনে ঠাকুরকে দেন। ঠাকুর ঘড়িটি কয়েকদিন ব্যবহার করে সুশীলচন্দ্রের কাছে রাখতে দেন। একদিন বিকেলে ঠাকুর যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরে টেবিলের উপর ঘড়িটি রেখে সুশীলচন্দ্র বাইরে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখেন ঘড়িটি নেই। মন খুব খারাপ হয়ে গেল তাঁর-ঠাকুরের ঘড়ি, তিনি তাঁর কাছে রাখতে দিয়েছেন, অথচ তাঁরই অসাবধানতায় হারিয়ে গেল সেটি। তিনি স্থির করলেন, ঠিক ওরকম আর একটি ঘড়ি ঠাকুরকে কিনে দেবেন। ঠাকুরকে সেকথা বলাতে তিনি নতুন ঘড়ি কিনতে নিষেধ করলেন। এতে সুশীলচন্দ্রের মন আরও খারাপ হল; তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন- ঠাকুর, যে ঘড়িটা নিয়েছে দয়া করে তাঁর মনে এমন পরিবর্তন এনে দাও, যাতে সে আপনা হতেই ঘড়িটি ফেরত দিয়ে যায়।
পরদিন বিকেলে কোন্নগরের এক ভদ্রলোক তাঁর চৌদ্দ-পনের বছরের ছেলেকে নিয়ে ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হলেন। ছেলেটি ঠাকুরের পায়ের কাছে ঘড়িটি রেখে কাঁদতে থাকে। আগের দিন ঠাকুর-দর্শনে এসে লোভে পড়ে ঘড়িটি নিয়ে যায় ছেলেটি। সে ক্রমাগত ঠাকুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। ঠাকুর তাকে কোলের কাছে বসিয়ে আদর করে ঘড়িটি নিতে বলেন, ভাল করে লেখাপড়া করে বড় হতে বলেন এবং ভবিষ্যতে আর এরকম কাজ করতে বারণ করেন। শাসনের পরিবর্তে আদরের উপঢৌকন পেয়ে তার কান্না আরও বেড়ে গেল; ঠাকুর তাকে আদর করে রসগোল্লা খাওয়ালেন, কত বোঝালেন, কিন্তু সে ঘড়িটি কিছুতেই নিল না। ছেলেটি চলে যাওয়ার পর সেই ঘড়ি ঠাকুর আবার সুশীলচন্দ্রের কাছে রাখতে দেন। এর কয়েকদিন পরে ঐ ঘড়ি নিয়ে সুশীলচন্দ্র শ্যামবাজারে এক আত্মীয়ের বাড়ি গেলে সেখানকার এক বালক ভৃত্য ঘড়িটি চুরি করেছিল, পরে অনুতপ্ত হয়ে ফেরত দেয়।
ঘড়িটি সম্পর্কে আর একবার আর একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। একদিন গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যার মুখে কার্জন পার্কে বেড়াতে গিয়েছিলেন সুশীলচন্দ্র। গরমে জামা খুলে বসেছেন, উঠে আসার সময় লক্ষ্য করেননি ঘড়িটি পকেটে আছে কি না। ট্রামে ফেরার পথে খেয়াল হল পকেটে ঘড়ি নেই। ফিরতি ট্রামে কার্জন পার্কে এসে খুঁজলেন, কিন্তু পেলেন না, ভাবলেন-এবার ঘড়িটা সত্যিই হারাল। পরদিন সন্ধ্যায় আবার এসে বসেছেন আগের দিনের জায়গাটিতে। দেখলেন, একটি বছর আটেকের ছেলেকে নিয়ে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক আসছেন। কাছে আসার পর কথাপ্রসঙ্গে তাকে ঘড়ি হারানোর কথা বললেন সুশীলচন্দ্র। শুনে ঐ ভদ্রলোক ঘড়িটা ফেরত দিয়ে বললেন যে গত সন্ধ্যায় বাচ্চা ছেলেটি বেড়াতে এসে এখানেই ঐ ঘড়ি পেয়েছিল। ঘড়ি ফেরত পেয়ে সুশীলচন্দ্র ওটির আনুপূর্বিক ইতিহাস ভদ্রলোককে বললেন। শুনে তিনি হেসে বলেন- ঠাকুরের ঘড়ি বলেই এমন আশ্চর্যজনকভাবে আপনার কাছে ফেরত এল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পার, পরবর্তীকালে ঘড়িটি আর হারায়নি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি সুতীব্র অনুরাগের ফলে তাঁর সঙ্গে সুশীলচন্দ্রের সহজ একতানতা গড়ে উঠেছিল এবং সেহেতু ঠাকুরের যে-কোন অবস্থানের সংকেত তাঁর মনে আভাসিত হয়ে উঠত। ১৯২১ খৃষ্টাব্দে একবার ঠাকুর দীর্ঘকালীন অসুস্থতায় আক্রান্ত হন। কোন কিছুতেই রোগ নিরাময় না হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে বায়ু- পরিবর্তনের জন্য জননীদেবী ও পরিবারের অন্যান্য সবাই ঠাকুরকে নিয়ে ১৯২২ খৃষ্টাব্দে কার্শিয়াং যান। কিন্তু তাতেও কোন সুফল পাওয়া গেল না। একদিন শ্রীশ্রীঠাকুরের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ল। সুশীলচন্দ্র তখন আশ্রমের জরুরি কোন কাজে হিমাইতপুর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় ধ্যানরত অবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুরের তৎকালীন গুরুতর অবস্থার দৃশ্য সুশীলচন্দ্রের মানসপটে স্পষ্টভাবে ভেসে উঠল। দেখলেন, ঠাকুর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আর্তস্বরে কাতরোক্তি করছেন। ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেল। আবার ধ্যানে বসলেন, আবারও একই দৃশ্য। পরপর তিন বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি- স্থির করলেন, তৎক্ষণাৎই কার্শিয়াং রওয়ানা হবেন। ঠিক তখনই ঠাকুরের শিক্ষক ও পরবর্তীকালে তাঁর ভক্ত ডাঃ শশিভূষণ মিত্র ঠাকুরের গুরুতর অসুস্থতার সংবাদবাহী টেলিগ্রাম নিয়ে উপস্থিত হলেন। কালবিলম্ব না করে শশিভূষণ, সুশীলচন্দ্র ও ইষ্টভ্রাতা ডাঃ গোকুল মণ্ডল কার্শিয়াং রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে দুই চিকিৎসক ঠাকুরকে পরীক্ষা করে দেখলেন যে, প্রবল জ্বরের সঙ্গে গলায়, বুকে, হৃৎপিণ্ডে ও অন্যান্য স্থানে ভীষণ অস্বস্তিকর নানা উপসর্গ রয়েছে।
ঘটনাচক্রে সেদিন দুপুরে বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর-জায়া শ্রীশ্রীবড়মা, ভগ্নী গুরুপ্রসাদী ও ঠাকুরের কাছে সুশীলচন্দ্র ব্যতীত অন্য কেউ ছিলেন না। সুশীলচন্দ্র হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, ঠাকুর অসহ্য যন্ত্রণায় যেন ক্রমশ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছেন। এই সময় তিনি সুশীলচন্দ্রকে নিজের মাথায় হাত দিয়ে ইশারা করলেন। ইশারা বুঝতে পেরে বড়মা ও গুরুপ্রসাদীকে ডেকে এনে সুশীলচন্দ্র তাঁদের সহায়তায় ঠাকুরের মাথায় তুষার- শীতল জল অবিরত ঢালতে লাগলেন। এর ফলে ঠাকুর অনেকখানি সুস্থ হয়ে ওঠেন। একটু সুস্থ হয়ে বলেন-সুশীলদা ঠিক সময়েই এসে পড়েছিলেন। আর একটু দেরি হলেই গেছিলাম আর কী! সুশীলদা যে আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আমার সর্দি কাশি জ্বর ইত্যাদি সম্বন্ধে কোন বিচার বিবেচনা না করে, অনবরত জল ঢেলেছেন পরমপিতার দয়ায় এতেই বেঁচে গেলাম...।
সেসময় নামের কম্পনের দ্বারা কঠিন রোগগ্রস্ত বা মৃতকল্প ব্যাক্তির জীবন ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে Life Research Society বা জীবনগবেষণা সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতির সদস্যরা ডাক্তার কর্তৃক পরিত্যক্ত মৃতকল্প রোগীর অঙ্গ স্পর্শ করে নাম কম্পনের মাধ্যমে তাদের সুস্থ করে তুলতে থাকেন। সুশীলচন্দ্র এরকম একজনকে নামের দ্বারা বাঁচিয়ে তোলার ব্যাপারে যুক্ত ছিলেন। শ্রীকান্ত সরকার নামে সাতাশ/আঠাশ বছরের এক যুবক মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তখন এই রোগের বিশেষ কোন চিকিৎসা ছিল না-ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। রাত এগারোটায় রোগীর হৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তার পরিচর্যাকারীরা নাড়ি দেখে তাকে মৃত বলে জানিয়ে দেয়। সেই অবস্থায় সুশীলচন্দ্র ও আরও পাঁচজন তাকে স্পর্শ করে অনবরত নাম করতে লাগলেন। সারারাত এভাবে চলার পর সকালবেলা রোগীর হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া একটু আরম্ভ হয়েছে বলে মনে হল, যদিও রোগী তখনও সম্পূর্ণ অচেতন। প্রাতঃকৃত্যের সময় এঁরা ছয়জন উঠে গেলে অপর ছয়জন রোগীকে স্পর্শ করে নাম করতে বসেন। এইভাবে নিরন্তর নাম করার ফলে তিন দিনের মধ্যে রোগীর জ্ঞান সম্পূর্ণ ফিরে আসে এবং পরে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে।
এবিষয়ে ঠাকুর বলেছেন—আপনারা যদি কঠিন রোগগ্রস্ত বা মৃতকল্প ব্যক্তিকে স্পর্শ করে অনবরত নামের কম্পন তার মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেন, তাহলে রোগ নিরাময় হতে পারে, মৃতকল্প ব্যক্তিও জীবন ফিরে পেতে পারে।
১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে ঠাকুর এসেছেন কলকাতায়। প্রথমে ওঠেন হরিতকী বাগানের বাড়িতে। পরে অত্যন্ত লোক সমাগম হওয়ায় ১২৪/৪এ মানিকতলা স্ট্রীটের অপেক্ষাকৃত বড় ভাড়া বাড়িটিতে উঠে আসেন ঠাকুর। ঐ সময় সুশীলচন্দ্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর রসা রোডের বাড়িতে যান। সৎসঙ্গ থেকে এসেছেন শুনে দেশবন্ধু বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে ঠাকুরের কথা জিজ্ঞাসা করেন। ঠাকুর কলকাতায় আছেন শুনে সেইদিনই তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান, কিন্তু সেদিন একটি বিশেষ সভা থাকায় ঠাকুরের কাছে যেতে পারেননি। পরে সিরাজগঞ্জ কনফারেন্স থেকে ফিরে তিনি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯২৪ সালের ১৪ই জুন দীক্ষা হয় দেশবন্ধুর। সুশীলচন্দ্রের সান্নিধ্য পেতে তিনি সব সময়ই উৎসুক ছিলেন। ঠাকুরের কথা, আশ্রমের কথা জেনে নিতেন, বুঝে নিতেন তাঁর কাছে। দেশবন্ধুর আগ্রহে পরবর্তীকালে সুশীলচন্দ্র কলকাতায় এসে দেশবন্ধুর বাড়িতেই উঠতেন। এই বিষয়ক বিস্তৃততর চিত্র পাওয়া যাবে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ’ নিবন্ধে।
১৯২৫ সালের ২৩শে মে মহাত্মা গান্ধী হিমাইতপুর আশ্রমে আসেন। এই সময় সান্তাহার স্টেশন থেকে একই কামরায় মহাত্মাজির সফরসঙ্গী ছিলেন সুশীলচন্দ্র। সুশীলচন্দ্রই মহাত্মাজিকে নিয়ে আশ্রম পরিদর্শন করান। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর আশ্রমে আগমনে এত ভিড় হয়েছিল যে শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে গান্ধীজির সাক্ষাৎ মাত্রই হল, আলাপ-আলোচনা কিছুই করা সম্ভব হল না। দেশবন্ধুর প্রয়াণের দু’মাস পর মহাত্মাজি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে নিয়ে কলকাতায় অখিল মিস্ত্রী লেনের বাড়িতে আর একবার ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন।
মান্দারিন জেল থেকে মুক্তি পাবার দু’বছর পরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আশ্রমে আসেন। তাঁকেও সমস্ত প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখান সুশীলচন্দ্র। ঠাকুরের ভাবধারা, কর্মযজ্ঞ, সমাজ সংস্কার ইত্যাদি বহু বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন তিনি। সব দেখে শুনে সুভাষচন্দ্র বলেন, আশ্রম বলতে লোকে অবিবাহিত সংসার বিবাগীদের স্থান বোঝে। গৃহী হয়ে আশ্রম জীবনযাপন করার দৃষ্টান্ত এযুগে আপনারাই প্রথম দেখাচ্ছেন। পরিবার পরিজনের ভার নিয়ে, অভাব অভিযোগের ভিতর দিয়ে আপনারা যদি এভাবে এগিয়ে যেতে পারেন, তাহলে গার্হস্থ্য আশ্রমের আদর্শ রূপ আপনারা মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারবেন।
পরবর্তীকালে কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য ও সুশীলচন্দ্র এলগিন রোডের বাড়িতে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আলোচনা প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন- শ্রীশ্রীঠাকুর আপনাদের যে-পথে পরিচালিত করছেন, সেটাই সর্বকালের, সর্বমানবের পথ, এতে কোন সন্দেহ নেই। বৈদেশিক শাসন থেকে ভারত যখন মুক্তি লাভ করবে, তখন তাকে এই পথই অনুসরণ করতে হবে।
১৯৩৮ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান পরিষদের রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠান উপলক্ষে কলকাতায় আগত বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক জেম্স্ জীন্স, অ্যাস্টন, এডিংটন, য়ুঙ্গ প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বসমূহের সঙ্গে সুশীলচন্দ্র শ্রীশ্রীঠাকুর ও ভারতীয় আদর্শবাদের কথা আলোচনা করেন, এবং তাঁরা বিশেষ চমৎকৃত হন তাঁর আলোচনায়, ঠাকুরের প্রতি প্রকাশ করেন সুগভীর শ্রদ্ধা।
সংগঠন যুগের প্রধান কর্মকর্তা সুশীলচন্দ্রে জনপ্রীতি ছিল অসাধারণ। তাঁকে সবাই যেমন ভালবাসতো, তেমনই ভক্তি করত। সেযুগে ঠাকুরের প্রথম তিনজন লীলাপার্ষদ অনন্তনাথ রায়, কিশোরীমোহন দাস এবং সতীশচন্দ্র গোস্বামী-এই ত্রয়ীর পরেই সৎসঙ্গী সাধারণের কাছে তিনি ছিলেন ভক্তি ও ভালবাসার উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত। সুশীলচন্দ্র কখনও কাউকে কোন কাজের আদেশ করতেন না। নিজেই কাজ আরম্ভ করতেন, তা দেখে লোকজন আপনা থেকেই এসে তাঁর হাত থেকে কাজ কেড়ে নিয়ে সুসম্পন্ন করত। একবার আশ্রমে ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রীজ আসবেন, সমস্ত আশ্রম বিশেষভাবে পরিষ্কৃত করা দরকার। ঝাড়ু হাতে ঝাঁট দিতে আরম্ভ করলেন সুশীলচন্দ্র। তাঁকে ঝাঁট দিতে দেখে দলে দলে আশ্রমিকরা ছুটে এসে তাঁকে এই কাজে নিবৃত্ত করে নিজেরাই কাজ আরম্ভ করে দেন। একে একে কুড়িখানি ঝাড়ু বেরোল, কুড়িজনকে নিযুক্ত করলেন সুশীলচন্দ্র কাউকে কাজ করার কথা মুখে কিছু না বলেই।
অপরের সুখবিধানের প্রতি তাঁর লক্ষ্য ছিল অপরিসীম। একবার মাঝরাত্রে কলকাতার সৎসঙ্গ বাড়িটিতে পৌঁছে কারো ঘুম না ভাঙিয়ে সিঁড়ির সামনে শুয়ে রইলেন। একজন ঘুম ভেঙে তাঁকে ঐখানে ঐ অবস্থায় দেখে নিঃশব্দে অন্যদের জাগিয়ে দিল। তাঁর ঘুম কেউ ভাঙালো না-নিজেরা না ঘুমিয়ে পালা করে তাঁকে হাওয়া করে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিল তারা। অচ্যুত ইষ্টনিষ্ঠা লোকদরদী সুশীলচন্দ্র এমনই ভালবাসা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন সবার কাছে।
ঠাকুরের নির্দেশে সুশীলচন্দ্র জাতিস্মর রহস্য নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিস্তারিত অনুসন্ধান করেন। এই উদ্দেশ্যে ১৯৩৯ সালের ১১ই জুন হিমাইতপুর আশ্রম থেকে দিল্লী অভিমুখে রওয়ানা হন। সেসময় শ্রীশ্রীঠাকুর স্বহস্তে একটি খাতায় এই বাণীটি লিখে দেন, “অনবিচ্ছিন্ন স্মৃতিবাহী চেতনা যা অমরণকে প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে বাস্তবভাবে অমর করে তুলতে পারে—তারই অনুসন্ধিৎসু হচ্ছি এই আমরা, এই আর্য্যজাতি-এর ভিতর দিয়েই আমরা অনন্তকে স্পর্শ করে উপভোগ করতে চাই।” সুশীলচন্দ্রের জাতিস্মরের তথ্যানুসন্ধানের বিশদ বিবরণ ‘জাতিস্মরের কথা’ নামক গ্রন্থাকারে ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের ২৫শে ভাদ্র প্রথম প্রকাশিত হয়। পুস্তাকাকারে প্রকাশের পূর্বে ‘জাতিস্মরের সন্ধানে’ শীর্ষক নিবন্ধমালায় সৎসঙ্গের মুখপত্র ‘আলোচনা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
১৯৩৫-এর ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৬ এর ২৯শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শ্রীশ্রীঠাকুরের সামনে বসে সুশীলচন্দ্র ঠাকুরেরই উৎসাহে ধারাবাহিকভাবে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে চলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরও দিয়ে চলেন অনর্গল সহজ সমাধান। এসমস্ত প্রশ্নোত্তর পরবর্তীকালে ‘কথাপ্রসঙ্গে’ নামে তিন খণ্ডে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এই পুস্তকে ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনের নানা সমস্যা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অবতারবাদ, সন্ন্যাস, পুনর্জন্মবাদ, বৈদিক ধর্ম, জ্ঞান-ভক্তি-কর্মের সমন্বয় তত্ত্ব, দীক্ষাগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা, অধ্যাত্ম জগতের নিগূঢ় দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রদত্ত অভাবনীয় সমাধান ও বিশদ বর্ণনা। সৎসঙ্গ পাবলিশিং হাউস থেকে ১৩৫০ বঙ্গাব্দে এই তিন খণ্ডের প্রথম প্রকাশ হয়। তার আগে এসমস্ত প্রশ্নোত্তর ১৩৪২ থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘সৎসঙ্গী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯৩৬-এর ৯ই ফেব্রুয়ারি সুশীলচন্দ্র শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রশ্ন করেন-অনুভূতি কী। সেদিন থেকে পরপর ক’দিন শ্রীশ্রীঠাকুর নিজের জীবনে অধ্যাত্ম-রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের অনুভূতি ও অপূর্ব দর্শনের বিশদ বিবরণ ক্রমাগত বলে যেতে থাকেন। সুশীলচন্দ্রের ভাষায়: “সে সময়ে তাঁর মুখমণ্ডলের ভাব-ব্যঞ্জনা উপনিষন্ন ভক্তগণের মনে এক অনির্বচনীয় রসাবেশের সঞ্চার করেছিল; মনে হয়েছিল-তিনি যেন বর্ণিত ভূমিতে বিচরণ করতে করতে তার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়ে চলেছেন। এই অত্যাশ্চর্য বর্ণনা সত্যই বিশ্ব সাহিত্যে অতুলনীয়...”
‘কথাপ্রসঙ্গে’ পুস্তকাকারে প্রকাশের কথা স্থির হলে শ্রীশ্রীঠাকুর সুশীলচন্দ্রকে বলেন-আমি যা বলছি তার সমর্থনে জ্ঞানী মহাপুরুষদের উক্তি যদি কিছু থাকে, তবে তা বইয়ের পাদটীকায় সংযোজন ক’রে দেবেন।
তদনুযায়ী সুশীলচন্দ্র বিপুল অধ্যবসায়ে দিনের পর দিন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থাগার) -তে গিয়ে বুদ্ধ, যীশু, মহম্মদ, শ্রীচৈতন্য, নানক, কবীর ও শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক অনুভূতি সম্বন্ধে তাঁদের উক্তির সুগভীর অনুসন্ধান ও অধ্যয়ন করেন। এই গবেষণাকর্মের সময় সুশীলচন্দ্রের প্রত্যয় হয় যে কোন-কোন স্থানে শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে তাঁদের উক্তির মিল থাকলেও, ওরকম পুঙ্খানুপুঙ্খ ও বিশদ বিবরণ আর কেউ কখনও দেননি। অবশেষে উপযুক্ত তথ্যসমৃদ্ধ পাদটীকাসহ ‘কথাপ্রসঙ্গে’ তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৪৩-এর ডিসেম্বর মাসে।
শ্রদ্ধেয় ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্যের প্রণোদনায় শ্রীশ্রীঠাকুর কর্তৃক ইংরেজিতে অপরূপ বাণী প্রদানের পর সুশীলচন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন-আপনি ইংরেজি না জেনেও এমন সুন্দর বাণী দিলেন কী করে?
-আপনারা ধরে পড়লেন, আমিও ভাবতে লাগলাম। দেখলাম, নদীর জলে যেমন মাছের ঝাঁক বেরিয়ে যায়, সেইরকম ভাব-রাজি ইংরাজি ভাষায় ভূষিত হয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে। আমি তাদের ধরে ধরে আপনাদের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ওসব কথার মানে যদি এখন আমায় জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে হয়তো আর তা বলতে পারব না।
-তাই যদি হয়, তবে তো আপনি শুধু ইংরাজি কেন, অন্য যে কোন ভাষাতে যেমন ধরুন জার্মান ভাষাতে এরকম অনর্গল বাণী দিতে পারেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর একটু ভেবে বললেন, হয়তো তা সম্ভব,... কিন্তু একটা impulse দরকার।
-impulse বলতে আপনি কী mean করছেন?
-ধরুন, একজন জার্মান ভাষা জানা লোক যদি আমার কাছে থাকে আর মাঝে মাঝে ঐ ভাষার দু’একটা কথা বলতে শুরু করে, তাহলে সেটা Sufficient impulse হতে পারে আমার কাছে, হয়তো ঐ ভাষায় বাণী দেওয়ার পক্ষে।
এ কথা শুনে সুশীলচন্দ্র পরম বিস্মিত হয়ে বলেন- বলেন কী ঠাকুর! আমরা ছেলেবেলা থেকেই ইংরেজি লিখতে পড়তে আরম্ভ করেছি, তবু এত বয়সেও ইংরেজি লিখতে বা বলতে গেলে বেশ যেন একটু বেগ পেতে হয়। আর আপনি বলছেন- দু’চারটে কথা শোনার পরই আপনি যে-কোন বিদেশি ভাষায় বিশুদ্ধভাবে উত্তর দিতে পারেন? এ কথা তো আমরা ভাবতেও পারি না।
শ্রীশ্রীঠাকুর সহজভাবে বলেন-তা কেন, ওরকম তো সবারই হতে পারে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ইংরেজি বাণীর পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঋত্বিগাচার্য্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ও সুশীলচন্দ্র স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রিন্সিপাল ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপচার্য ডঃ আর্কুহার্ট-এর কাছে যান। তিনি পাণ্ডুলিপির কিয়দংশ পাঠ করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বললেন-শ্রীশ্রীঠাকুরকে আমি আপনাদের উৎসব উপলক্ষে পাবনা গিয়ে দেখে এসেছি; কিন্তু আমি তো জানতাম তিনি মোটেই ইংরেজি জানেন না! এখন এই লেখা পড়ে দেখছি যে এতে কতগুলো word এমন archaic sense-এ ব্যবহার করা হয়েছে-যা একজন perfect master of the English tongue ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। It is something like a revelation to me!
শ্রীশ্রীঠাকুরের ইংরেজি বাণীসমূহ ‘The Message’ নামে নয় খণ্ডে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৫ সালে প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর ইষ্টভ্রাতা ভূষণ মিত্র ঐ বইটি তদানীন্তন ল’ কলেজের অধ্যক্ষ ও পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেন। পরে সুশীলচন্দ্র ভূষণ মিত্রের সঙ্গে প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গেলে তিনি বলেলেন-শুনেছিলাম আপনাদের ঠাকুর নাকি লেখা-পড়া জানেন না। তারপরে যখন কানে এল যে তিনি ইংরাজিতে বই লিখছেন, তখন মনে করলাম, তাঁর কাছে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি যাঁরা আছেন, তাঁরাই হয়তো বই লিখে তাঁর নামে চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার নিজেরও একটু গর্ব আছে যে আমি ইংরাজি বেশ ভালই জানি। কিন্তু বইখানা পড়ে বুঝলাম, শুধু আমি কেন, কোন University product-এর পক্ষে এ লেখা সম্ভব নয়। কাজেই মেনে নিতে বাধ্য হলাম যে এ-সব শ্রীশ্রীঠাকুরেরই লেখা- and so wonderful!
প্রত্যেক ক্ষেত্রে শ্রীশ্রীঠাকুরের এরকম সর্বস্পর্শী ও সুগভীর অসাধারণ জ্ঞানের ব্যাপ্তিতে বিস্মিত সুশীলচন্দ্র উপলব্ধি করেন-আদি কারণকে যিনি জেনেছেন, তাঁর পক্ষেই কেবল এরকম জ্ঞানের অধীশ্বর হওয়া সম্ভব।
সুশীলচন্দ্রের অনবদ্য স্মৃতিকথা ‘মানসতীর্থ পরিক্রমা’ পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১০ই আগস্ট, ১৯৭২। এই স্মৃতিকথাও ‘আলোচনা’ পত্রিকায় আগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ঠাকুর সন্নিধানে তাঁর পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত করার প্রাপ্তিস্বরূপ ব্যক্তিগত বিচিত্র অভিজ্ঞতার ধারাবিবরণী সমৃদ্ধ মূলত শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনীমূলক স্মৃতিকথা এই ‘মানসতীর্থ পরিক্রমা’। তাঁর রচিত অপর একটি গ্রন্থ ‘রাজস্থানের পথে’ সেযুগে যথেষ্ট সমাদৃত ছিল।
দেশ বিভাগের প্রায় এক বছর আগে শ্রীশ্রীঠাকুর দেওঘর চলে আসেন। সেই দিনটি ছিল ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে। দেওঘর আসার তিন দিন আগে ৩০শে আগস্ট, ১৯৪৬ বিকেলে ঠাকুর সুশীলচন্দ্রকে ডেকে বলেন যে তিনি দেওঘর যাবেন; সেইমত কলকাতায় গিয়ে গাড়ি রিজার্ভ করতে এবং দেওঘরে বাড়ি ঠিক করে আসতে বলেন। তখনও বোঝা যায়নি যে তিনি তাঁর প্রিয় জন্মভূমি এবং তাঁরই সৃষ্ট বিরাট আশ্রম চিরতরে ছেড়ে যাওয়ার উদ্যোগ করছেন। সেদিন রাত্রে বীরেন্দ্রলাল মিত্র ও রাজেন মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসে ট্রেন রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা করে ৩১শে আগস্ট রাত্রের ট্রেন ধরে দেওঘর আসেন সুশীলচন্দ্র। সেখানে স্থানীয় ইষ্টভ্রাতা সুরেন সেনকে নিয়ে ‘বড়াল বাংলো’ ভাড়া নেন। বর্তমানে এই বাংলোটি ‘ঠাকুর বাংলো’ নামে পরিচিত।
ঠাকুর ১লা সেপ্টেম্বর রবিবার আশ্রমের কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মীকে নিয়ে ঈশ্বরদি স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট রিজার্ভড্ বগীতে রওয়ানা হয়ে ২রা সেপ্টেম্বর সকাল ন’টায় দেওঘর পৌঁছন। স্টেশন থেকে সুশীলচন্দ্র প্রমুখরা শ্রীশ্রীঠাকুর ও অন্য সবাইকে বড়াল বাংলোয় নিয়ে আসেন।
হিমাইতপুর আশ্রমের আর্থিক মূল্য তখন ছিল দেড় কোটি টাকার উপর। একবারও ঠাকুর ফিরে তাকাননি সেদিকে; কোনদিন শোনা যায়নি তাঁর মুখে বিন্দুমাত্র আফশোষ। এই নিস্পৃহতা ও অনাসক্তি শুধু তাঁতেই সম্ভব।
কর্পদক শূন্য অবস্থায় দেওঘরে এসে সুশীলচন্দ্র ভেঙ্গে পড়েননি। ঠাকুরের প্রেরণায় নতুন উদ্যোগে কর্মযজ্ঞ আরম্ভ করেন। ঠাকুর আসার পর শ’য়ে শ’য়ে ভক্তরা আসতে থাকেন, তাঁদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমস্যার সমাধান হাসিমুখে করতে হয়েছে সুশীলচন্দ্রকে। পরবর্তীকালে দেওঘরেও গড়ে উঠেছে সুবিশাল প্রতিষ্ঠান, নানা কর্মকেন্দ্র, যার পিছনে সুশীলচন্দ্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ নিরন্তর প্রেষণা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
শ্রীশ্রীঠাকুরের সমস্ত পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য পাঁচ হাজার বিঘা জমির প্রয়োজন। ঠাকুর সুশীলচন্দ্রকে পশ্চিমবাংলায় এই বিস্তীর্ণ জমি খোঁজ করতে বলেন। অনুসন্ধান করে সুশীলচন্দ্র জানতে পারেন, পানাগড়ে ভারত সরকারের অধীনে মিলিটারি ডিপার্টমেন্টের হাতে ছ’হাজার বিঘা জমি আছে। দিল্লী গিয়ে উক্ত ডিপার্টমেন্টের সচিবের সঙ্গে দেখা করে জানতে পারেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অনুমোদন ব্যতীত এই জমি পাওয়া সম্ভব নয়। অতঃপর তিনি নেহরুজির সঙ্গে দেখা করে ঠাকুরের পরিকল্পনার কথা বিশদভাবে বলেন। প্রধানমন্ত্রী সহানুভূতির সঙ্গে সব শুনে ঐ ছ ‘হাজার বিঘা জমি সৎসঙ্গকে দেওয়ার আদেশ দেন এবং বলেন যে জমিটি যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে সেহেতু সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদনও প্রয়োজন। সুশীলচন্দ্র তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করলে তিনি সব শুনে মাত্র আঠাশ বিঘা জমি দিতে রাজি হন। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর ঐ স্বল্প পরিমাণ জমি গ্রহণে রাজি হননি—কারণ তাতে তাঁর পরিকল্পনা রূপায়িত হওয়া সম্ভব ছিল না। এর পরেও পশ্চিমবঙ্গে আরও কিছু জমির সন্ধান বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেলেও নানা কারণে তা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
সৎসঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সংগঠন যুগের অন্যতম নায়ক সুশীলচন্দ্র পরবর্তীকালে সৎসঙ্গের অধ্যক্ষ পদে বৃত হন। সকলের শ্রদ্ধা ও প্রীতির পাত্র সুশীলচন্দ্র ধীর, স্থির, অমায়িক ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ছিলেন শান্ত। অনুক্ষণ ইষ্টময় ও ধ্যানপরায়ণ হয়ে থাকতেন তিনি।
এবার ঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বলেন, সুশীলদা আজকাল এমনই হয়েছেন যে, আজ যদি তিনি গভীর বনে, পাহাড়ে, গহ্বরে অথবা মহাসমুদ্রের অজানা দ্বীপে চলে যান- আমাকেও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে সেখানেই বসতে হবে।
সংসারের কোন মায়ার বন্ধন তাঁকে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি। জীবনের শেষ প্রান্তে অসুস্থ শরীরেও সর্বদাই ইষ্টপ্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাপৃত থাকতেন। মনের জোরও ছিল অক্ষুণ্ণ। এই বিরল কর্মযোগীর কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে ইংরেজীর ৬ই মার্চ, ১৯৬৯ রবিবার দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমে, শ্রীশ্রীঠাকুরের মহাপ্রয়াণের এক মাস দশ দিন পরে। দেহের অবসানে ভাবের অবসান ঘটে না। তাঁর ঠাকুরগত প্রাণময়তা সঞ্চারিত হবে যুগ যুগ ধরে ঠাকুরকে যাঁরা ভালবাসবেন তাঁদের অন্তরে। প্রেমের সাম্রাজ্যে তাঁর অস্তিত্ব অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।
#সুশীলচন্দ্র_বসু
10