দরদ- পৃ ১৯
শ্রীশ্রীঠাকুরের লোকতৃষ্ণা- ১৯
সেবায় লক্ষণীয়- ২০
উচিত কথা কী-২০
উন্নতিলাভের পথ-২০
অফিসে ব্যবহারের নীতি-২০
ঋত্বিকের সঙ্গে কী ধরণের লোক থাকবে-২১
ঋত্বিকের দায়িত্ব-২২
ঘটকপ্রথা-২২
বিবাহের গুরুত্ব-২২
লোকসংগ্রহ-২২
সন্তান ভাল হওয়ার মূলে-২২
কর্মীদের প্রতি-২৩
দরদ- ১৯, ২৩
প্রাচীনের উপর শ্রদ্ধা জাগাতে হবে-২৩
যাজন- ২৪
কাজে ঢিলেমি প্রশ্রয় না পায়-পৃ ২৫
কাজের নেশা-২৫
পৌরোহিত্য-সংক্রান্ত উপদেশ-২৫
সংস্কৃতজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা-২৫
আমিষাহারী ঘরে মেয়ের বিয়ে হ'লে-২৬
মদ খাওয়ার কারণ ও ফল-২৭
রসগোল্লার লোভ দমনের কাহিনী -২৭
শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-২৭
প্রবৃত্তি-জয়ের তুক-২৮
P 19-28
১৬ই পৌষ, বুধবার, ১৩৪৮ (ইং ৩১।১২।৪১)
বেলা আন্দাজ সাড়ে-আটটার সময় শ্রীশ্রীঠাকুর সৎসঙ্গ-প্রাঙ্গণে বাবলাতলায় একখানি বেঞ্চের উপর এসে বসেছেন। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য, সবারই দৃষ্টি তাঁর প্রতি নিবন্ধ। শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যবদনে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন।
একটি দাদা বললেন-আপনি বলেন মানুষকে বড় ক'রে বড় হবার কথা, কিন্তু আমাদের অফিসে দেখতে পাই, প্রত্যেকে অন্যকে দাবিয়ে বড় হ'তে চায়।
শ্রীশ্রীঠাকুর-যোগ্যতা যদি না থাকে, তবে দাবিয়ে বড় হওয়া যায় না। মানুষই তোমার স্বার্থ, তোমার সম্পদ, তাদের খাটো করলে তুমিই তো খাটো হ'য়ে পড়বে। তোমার বড়ত্ব দাঁড়াবে কিসের উপর? ররং মানুষকে এমন ক'রে সেবা দাও, এমন ক'রে মানুষের ভাল কর, যা'তে তোমার উন্নতিটা তারা নিজের স্বার্থ' ব'লে বিবেচনা করে। মানুষকে যদি আপন ক'রে তুলতে পার এবং তোমার যোগ্যতা যদি থাকে, তাহ'লে তোমার উন্নতির জন্য আর ভাবতে হবে না।
উক্ত দাদা-যারা খোসামুদে, বড়বাবুকে যারা খুশি রাখতে পারে, তাদেরই তো দেখি উন্নতি হয়!
শ্রীশ্রীঠাকুর-বড়বাবুকে খুশি রাখাটা তো খারাপ কথা নয়। শুধু বড়বাবু কেন, উপরে-নীচেয় এবং সমস্তরের সহকর্মী যারা আছে, সকলের সঙ্গেই এমন ব্যবহার নিয়ে চলা ভাল, যা'তে প্রত্যেকেই আপ্যায়িত হয়, সন্তুষ্ট হয়, তৃপ্ত হয়, খুশি থাকে। এর জন্য খোশামোদ করার দরকার করে না, তবে সবারই গুণগ্রাহী হ'তে হয়। এতে নিজের চরিত্রের উন্নতি হয়। মানুষকে আপন করতে পারা মানুষের একটা বড় গুণ। চাকরী, ব্যবসা, যাজন যাই কর, এটা সব জায়গায় লাগে। আর, মানুষকে আপন করতে গিয়ে তোমার আদর্শকে বিসর্জন দিলে কিন্তু চলবে না। আদর্শ হলেন মঙ্গলনিদান। তুমি যত আদর্শনিষ্ঠ থাকবে, ততই তুমি মঙ্গলের অধিকারী হবে, আর অন্যকেও যত আদর্শে অনুপ্রাণিত ক'রে তুলতে পারবে, ততই তাদের মঙ্গল হবে। তোমাকে দিয়ে মানুষ যদি মঙ্গলের অধিকারী না হয়, তা' হ'লে কিন্তু কোন জারিজুরি খাটবে না। তুমি যতই মিষ্টি ব্যবহার কর না কেন, তোমার ব্যক্তিত্বের কোন দাম থাকবে না তাদের কাছে। তাই বলি, ভালই যদি চাও, নিজে ইষ্টের পথে চল ও অন্যকেও ইষ্টের পথ ধরাও। নইলে, গোঁজামিল দিয়ে কোন লাভ হবে না। আর, মনে রেখো, দুটো টাকা পেলে তোমার কিছু পাওয়া হ'লো না, যদি কিনা তোমার চরিত্র উন্নত না হয়, তোমার যোগ্যতা না বাড়ে এবং মানুষ তোমাকে দিয়ে উপকৃত না হয়। পরিবেশ-শুদ্ধ মনুষ্যত্বে, চারিত্রে, বোধে, যোগ্যতায় যতখানি বেড়ে উঠলে, ততটুকুই তুমি বড় হ'লে। তোমার এই বড়ত্ব আবার সন্তান-সন্ততির ভিতরও চারিয়ে যাবে। ফাঁকির কারবার টেকসই হয় না।
উক্ত দাদা-আমি একটু উচিত-বস্তা আছি, তাই আমার সঙ্গে কারও তেমন বনে না।
শ্রীশ্রীঠাকুর-উচিত কথা মানে কী জান তো? উচিত কথা মানে সেই কথা যা'তে পরস্পরের মধ্যে মিল হয়। উচিত-বক্তা যদি হ'তে পারতে, তাহ'লে মানুষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কথা নয়। মানুষের দোষ দেখিয়ে কথা কওয়া কিন্তু উচিত কথা নয়। গোড়াতেই মানুযের অহংকে যদি আহত ক'রে তোল, তাহলে সে কিন্তু আর তোমার কথা নিতে পারবে না । তাই , মানুষের প্রতি স্বাথান্বিত হয়ে যথাসম্ভব হৃদ্যভাবে তার ভুলটা তাকে ধরিয়ে দেবে , যাতে সে অনুতপ্ত হয়ে তা শােধরাতে চেষ্টা করে । এতে দেখবে মানুষকে কত আপন ক'রে পাবে । আর , যে - কথা দশজনের সামনে বললে সে চ'টে যাবে , সে - কথা তাকে গােপনে ডেকে যদি বল , তাহ'লে সে হয়তাে নিজেই নিজের দোষ স্বীকার করবে । মানুষ নিয়ে চলতে , মানুষের ভাল করতে অনেকখানি বােধ , বিবেচনা , সহ্য , ধৈৰ্য্য , প্রীতি থাকা চাই । নইলে মানুষ উপায় করা যায় না । মানুষের উপায় করতে যে পারে , টাকা উপায় করা তার কাছে কিছুই না ।
ভূপেশদা ( দত্ত ) আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — কি রে , কী খবর ?
ভূপেশদাগাড়ীর একটা part ( অংশ ) খারাপ হয়ে গেছে , সেইজন্য একবার কলকাতায় যেতে হবে ।
শ্রীঠাকুর — এখানে ঠিক করা যায় না ?
ভূপেশদা - এখানে ঠিক করবার মতাে নয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর দরকার হলে যাও । আমার ইচ্ছা করে , তােমরা এমনভাবে তৈরী হও , যা'তে যা - কিছু দরকার এখানেই ক'রে নিতে পার ।
ভূপেশদা — অনেক জিনিস আছে , যা এখানে করতে গেলে কলকাতার থেকে খরচ অনেক বেশী প'ড়ে যাবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুরগোড়ায় খরচ কিছ , বেশী পড়তে পারে , কিন্তু তোমরা যখন অভিজ্ঞতা অর্জন করবে , তখন আর বেশী খরচ পড়বে না । অভিজ্ঞতাটাই মস্ত লাভ । কিছু পারব না বা পারি না , এ - কথা ভাবতে আমার ভাল লাগে না । এখানে যে - সব কর্ম - প্রতিষ্ঠানের সষ্টি হয়েছে , টাকার দিকে চেয়ে করা হয়নি । এর মূল উদ্দেশ্য শিক্ষা । সৰ্ব্বতোমুখী শিক্ষা , সৰ্ব্বতােমুখী প্রয়ােজন - পুরণের যােগ্যতা যদি না হয় , তবে জাত বড় হ'তে পারে না ।
যতীনদা ( দাস ) -বাইরে বিভিন্ন জায়গায় আমরা যে কাজ করছি , সেখানেও কি তাহ'লে নানারকম কৰ্ম্মপ্রতিষ্ঠান তৈরী করা দরকার ?
শ্রীশ্রীঠাকুর -- এখানে যেগুলি হয়েছে , প্রয়ােজনবশে গজিয়ে উঠেছে , বাইরেও তেমনি হবে । এখন বিশেষ করে নজর দেন লােক - সংগ্রহের দিকে । তাদের মধ্যে যা'তে পারস্পরিকতা বাড়ে সেদিকে লক্ষ্য দেন । আর , আমার ইচ্ছা করে যে প্রত্যেক ঋত্বিকের সঙ্গে অধ্বর্য্যু , যাজক ছাড়া উকিল , ডাক্তার , ইঞ্জিনীয়ার , মেকানিক , কৃষি - অভিজ্ঞ , কুটিরশিল্প - অভিজ্ঞ লােক থাকবে । তারা প্রয়োজনমতাে যেখানে যা ' করবার করবে । যজমানদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিভা ও যােগ্যতাসম্পন্ন লােক যারা আছে , তাদেরও ভাল ক'রে শিক্ষিত করে তুলতে হবে , লাভজনকভাবে কাজে লাগাতে হবে । এমনি করেই প্রয়ােজনমতাে নানাস্থানে কর্ম্ম - প্রতিষ্ঠান । গড়ে উঠবে । ঋত্বিকের নিজের সব বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকা চাই । মানুষের বাঁচতে-বাড়তে যা'-যা' লাগে, তার কোনটাই তার অজানা থাকবে না। সে হবে কার্য্যকরী জ্ঞানের একটা জীয়ন্ত ভান্ডার। আলাপে-আলোচনায়, কথায়-বাত্তায়, কাজে-কর্ম্মে সম্বত্র সে একটা উৎকর্ষে'র হাওয়া চারিয়ে দেবে। তার লক্ষ্য থাকবে, একটা মানুষও যেন অজ্ঞ না থাকে, দরিদ্র না থাকে, অসুস্থ না থাকে, অপারগ না থাকে, রিপুপরবশ না থাকে। ঋত্বিকের মতো ঋত্বিক্ সব হ'লে দেখতে-দেখতে ভারত আবার দেবজাতি হ'য়ে উঠবে, দেবভূমি ব'লে সারা পৃথিবীর লোক আবার ভারতকে নতি জানাবে। আর, আপনাদের কাজ শুধু ভারতে নয়। সারা পৃথিবীতে আপনাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে। তাইতো কেবল কই, মানুষ জোগাড় করার কথা। আপনারা মানুষই জোগাড় করতে পারেন না। যেমনতর ৩০০ মানুষ জোগাড় করার কথা বলেছি অমনতর ৩০০ মানুষ জোগাড় করেন। দেখেন যেন কী কান্ড হয়! আর যত কাজই করেন, বিশেষ ক'রে লক্ষ্য রাখবেন, সর্বত্র বিয়ে-থাওয়াগুলি যেন ঠিকমতো হয়। প্রতিলোম যেন কিছুতেই না ঘটতে পারে। ওর মতো সর্বনেশে ব্যাপার আর নেই। ওতে সন্তান বিশ্বাসঘাতক হবেই কি হবে। সবর্ণ ও অনুলোম বিয়ের ব্যাপারেও যেমন-যেমন বলেছি, শাস্ত্রে যেমন আছে, তেমনই বিধিমাফিক হওয়া চাই। আগে কত ভাল-ভাল ঘটক ছিল, তার। প্রত্যেক বংশ-সম্বন্ধে কত খোঁজ-খবর রাখতো, তারা যোগাযোগ-গুলি করার সময় ব'লে দিতে পারতো, ক'টি সন্তান হবে, তার মধ্যে ছেলে বা ক'টি, মেয়ে বা ক'টি, এবং কে কেমন হবে সে-সব এখন রূপকথার মতো মনে হয়। তেমনতর ঘটক পেলে তাদের খাঁজে বের করা লাগে। ভাল বিয়ে যদি না হয় তবে ভাল সন্তান হবে না। আর, ভাল সন্তান যদি না জন্মে দেশে, তবে কিছুই করতে পারবেন না।
মনোরঞ্জনদা (বন্দ্যোপাধ্যায়)- সাধারণতঃ দেখা যায় যে পিতামাতা যেখানে ইষ্টপ্রাণ, সেখানে ছেলেপেলেগুলি ভাল হয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তা' হবারই কথা। উভয়ে যদি ইষ্টপ্রাণ হয়, তবে উভয়ের মধ্যে সঙ্গতি থাকে অনেকখানি। পুরুষের ইষ্টপ্রাণতায় তার অন্তর্নিহিত শক্তি অনেকখানি মুখর হয়ে ওঠে, আবার ইষ্টপ্রাণতার ফলে স্ত্রীর স্বামীভক্তিও বেড়ে যায়, ঐ সক্রিয় ভক্তির ফলে সে স্বামীর অনেকখানিই সন্তানে মূর্ত্ত ক'রে তুলতে পারে। আবার, এমনতর সন্তানের পিতৃভক্ত, মাতৃভক্ত ও গুরুভক্ত হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। তারা সংযমী হয় সহজেই। বাপের কাছে যদি প্রবৃত্তি বড় না হ'য়ে পিতামাতা ও ইষ্ট বড় হন এবং মা'র কাছে যদি প্রবৃত্তি বড় না হ'য়ে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ী ও ইষ্ট বড় হন, তবে তাদের থেকে উদ্ভুত যে সন্তান, সে-সন্তানেরও ঐ ধাঁজ হবে। আর, ঐটেই হ'লো বড় হওয়া ও ভাল হওয়ার মূল বীজ। তাদের শরীরও পটু হবে, বুদ্ধিবৃত্তিও প্রখর হবে। এরা হবে সমাজের সম্পদ। এমনতর মানুষ যত বেশী জন্মাবে, ততই জাতির মঙ্গল। আর আমাদের যে দশবিধ-সংস্কার আছে, সেগুলিও ভাল ক'রে প্রবর্ত্তন করতে হয়।
যোগেনদা (হালদার) উপনয়ন-সংস্কারের যে কতখানি সুফল, তা' উপনয়ন গ্রহণ করার আগে বুঝতে পারতাম না, ৩৬ দিন প্রাজাপত্য ক'রে উপনয়ন নিয়ে বুঝতে পেরেছি এর মূল্য কতখানি।
শ্রীশ্রীঠাকুর-প্রত্যেকটা সংস্কার সম্বন্ধেই ঐ কথা। যথাযথভাবে করলে তখন বোঝা যায়, কোন্টার প্রভাব কতখানি। এই সব আচার-আচরণগুলির ভিতর-দিয়ে যেতে হয়, তা' না হ'লে অনেকগুলি জিনিস মরচে প'ড়ে থাকে। পূর্বপুরুষের সঙ্গে যে আমাদের একটা যোগসূত্র আছে, সেটা গভীরভাবে বোধ করতে গেলে, তাদের অনুসৃত ধারাগুলি বজায় রাখতে হয়। আর, আমাদের শাস্ত্রীয় বিধানগুলির যে একটা বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য্য আছে, তা' সবার সামনে তুলে ধরতে হয়। এ-সব নিয়ে আলাপ, আলোচনা, যাজন তো প্রায় নিভেই গেছে। বারবার মানুষের কাছে না বললে, তাদের সামনে ক'রে না দেখালে মানুষ বুঝতে পারে না। সেইজন্য আপনাদের একই সঙ্গে আচারবান ও যাজনশীল হওয়া লাগে। শুধু মুখে যদি বলেন আর নিজেরা যদি না করেন, তাহ'লে কিন্তু আপনাদের কথার কোন দাম থাকবে না। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী, সদাচার, পারিপার্শ্বিকের সেবা, বর্ণাশ্রম, শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, ইষ্টানুগ দাম্পত্যজীবন, দশবিধ-সংস্কার ইত্যাদি যে-সব জিনিসগুলি আপনারা চারাতে চান, সেগুলি আপনারা নিজেরাও সম্ভবমতো অনুশীলন করবেন। অনুশীলনের সঙ্গে-সঙ্গে যদি বলেন, তাহ'লে সে-বলা কার্য্যকরী হবে। মোটকথা, এই ধান্ধা আপনাদের পেয়ে বসা চাই। পোষাকী রকমে করলে হবে না। সময় কম, গলদ জমেছে বহুদিনের, ক্ষেত্র বিরাট, কর্মীসংখ্যা নগণ্য-তাই আপনাদের প্রত্যেকের এখন এমনভাবে খাটা লাগবে, যা'তে এক-একজন হাজার মানুষের কাজ করতে পারেন। আর, প্রত্যেকেই উৎসাহ-উদ্দীপনার এমন এক-একটা প্রচন্ড ঘূর্ণি হ'য়ে উঠুন-যা'তে আপনাদের আওতায় এসে অতিবড় নিথর মানুষও রেহাই না পায়। আপনাদের কাছে আসলেই মানুষ যেন সৎসঙ্কল্পে পাগল হ'য়ে ওঠে। এইভাবে গুণিত হ'য়ে চলুন, আর বাছা-বাছা লোক দেখে কর্মী সংগ্রহ করুন।
শ্রীশ্রীঠাকুর এরপর একবার তামাক খেলেন।
গ্রামের একটি মুসলমান ভাই এসে বললো-ঠাকুর, আমার ছেলেটির বসন্ত হইছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর- টিকে দিছিলি?
উক্ত মুসলমান ভাই-না।
শ্রীশ্রীঠাকুর ডাক্তার (কিশোরীদা)-কে নিয়ে দেখা। আর, খুব সাবধান মশারির তলে রাখিস! রোগ যেন না ছড়ায়। আর বাড়ীর আর সব্বাইকে টিকে নেবার ব্যবস্থা ক'রে দে।
উক্ত মুসলমান ভাই মশারি তো একখানা আছে মাত্র।
শ্রীশ্রীঠাকুর তখন কিশোরীদাকে একখানা মশারি দেবার ব্যবস্থা করতে বললেন। পরক্ষণে প্যারীদাকে ডেকে বললেন তাড়াতাড়ি লিম্প আনিয়ে সবাইকে টিকে দেবার ব্যবস্থা কর। একটি প্রাণীও যেন বাকী না থাকে।
প্যারীদা-আচ্ছা।
শ্রীশ্রীঠাকুর এরপর উঠে একবার বাড়ীর ভিতর শ্রীশ্রীবড়মার কাছে গিয়ে বসলেন।
সেখান থেকে পরে আবার খেপুদার বারান্দায় এসে বসলেন। আবার লোকের ভীড় জমে উঠলো। গোসাঁইদা এসে প্রণাম ক'রে দাঁড়ালেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর মধুর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন--গোসাঁইদা, কেমন আছেন?
গোসাঁইদা-ভাল।
শ্রীশ্রীঠাকুর-বসেন দেখি, গল্প করি।
গোসাঁইদা বসলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর (সহাস্যে)- আগের সেই পাগলা যুগের কথা আপনার সব মনে আছে?
গোসাঁইদা-মনে আছে বইকি? এখনও সেই সব দিনের কথা গল্প করতে বসলে নিজেকে ভুলে যাই। শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা শক্তি জেগে ওঠে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ও-সব গল্প করা ভাল। নূতন যারা আসছে, তারা অনেকেই তো জানে না। আপনি, কিশোরী ওদের কাছে গল্প ক'রে শোনাবেন ।.........
আপনি বক্তৃতা করতে পারেন না?
গোসাঁইদা-বক্তৃতা-হিসাবে বক্তৃতা আসে না। তবে কথায়-কথায় কথা উঠে গেলে ভিতর থেকে যেন অনর্গল বেরুতে থাকে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ও-ও তো একরকমের বক্তৃতা। ব'সে ব'সেও বক্তৃতা হয়।......... তবে ঐ যে বললেন, কথা উঠে গেলে অনর্গল বেরোতে থাকে। আড্ডা ক'রে ব'সে ঐ ভাবের মজলিশী গল্প যদি করেন, খুব ভাল হয়। সে-আমলের আপনারা সেজেগুজে যাজন করা যাকে বলে তা' করেননি, কিন্তু তখন আপনারা অল্প ক'জনে মিলে যাজন যা' করেছেন, তার তুলনা হয় না। আপনাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথাই যদি বলেন, তা'তে অনেকের চোখ খুলে যাবে। ঐরকম একটা মত্ত নেশা না থাকলে কি যাজন হয়? তখন আপনারা যেখানে যেতেন, সেখানেই মানুষকে পাগল ক'রে তুলতেন। আপনি ও কিশোরী কাশীতে যেয়ে কী কাণ্ডটা করলেন?
গোসাঁইদা-তখন আপনার দয়ায় একটা আত্মহারা রকম ছিল। কিশোরী তো প্রেমোন্মাদ হ'য়ে থাকতো, বিশ্বনাথের মন্দিরে যেয়ে এমন অপূর্ব ভাবাবেশে হুঙ্কার দিয়ে নাচতে লাগল যে পান্ডারা পর্যন্ত স্তুতি করতে লাগলো। ঐ-সব দিনের গল্প করতে গেলেও আবার সেই ভাবটা যেন জেগে ওঠে।
শ্রীশ্রীঠাকুর জাগবেই তো। মাল যে সব ভিতরে মজুত আছে। এখন আবার সবাইকে নাচায়ে তোলেন। ঝাঁকি দিলেই হয়। তখন আপনারা নেশা-খোরের মতো এই নিয়ে বেহাশ হ'য়ে থাকতেন। ঘর, সংসার, টাকা, পয়সা, নাম-যশ- কোন পিছটানেরই বালাই ছিল না। অমনতর তীব্র, তরতরে আবেগ থাকলেই মানুষকে তাড়াতাড়ি মতিয়ে তোলা যায়। আপনাদের ঐ আস্বাদ জানা আছে, তাই বললেই ভিতরটা সাড়া দিয়ে ওঠে। অনেকে ঠাওরই করতে পারে না ব্যাপারটা কী! প্রাণটাকে আলগা রেখে বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। তা'তে কি আর বোধের দরজা খোলে? আর আপনি যে আজকাল পৌরোহিত্য করছেন, এ খুব ভাল। কয়েকজন ব্রাহ্মণ ঋত্বিকে পৌরোহিত্যের ক্রিয়া-কর্মগুলি শিখিয়ে দেন। কোন্ অনুষ্ঠান, কেন করা হয়, তার তাৎপর্য্য তাদের ধরিয়ে দেবেন। যজমানদের কাছেও ক্রিয়াকর্ম-ব্যপদেশে সংক্ষেপে ওগুলি বলতে হয়। ঐ বলার ভিতর-দিয়ে মানুষের আগ্রহ ও বোধ বাড়ে। তাৎপর্য্য ও ব্যাখ্যা-সমন্বিত ক্রিয়াকর্ম'-পদ্ধতি একখানা নিজে যদি লিখতে পারেন, কিংবা কাউকে দিয়ে লেখাতে পারেন, তাহ'লে ভাল হয়।
গোসাঁইদা-আমি নিজেই যে সব জানি না, তবে আপনার দয়ায় অনেকখানি ধারণা ক'রে নিতে পারি, কোন্টা কেন করা হয়। আর, কাজকর্ম্মের সময় আমি সেগুলি কিছু-কিছু বলিও। শেখাবার কথা বলছেন, কিন্তু তেমন আগ্রহশীল লোকই তো কম।
শ্রীশ্রীঠাকুর-পৌরোহিত্য করবার সময় লক্ষ্য রাখতে হয়, কোন অনুষ্ঠানকে যেন অযথা দীর্ঘ করা না হয়। দীক্ষাদানের ব্যাপারেও ঐ কথা। একটা সম্বেগের সঙ্গে মুখ্য করণীয় যা' তা' বাদ না দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে কাজ সমাধা ক'রে ফেলতে হয়। শিথিল, মন্থর গতিতে দীর্ঘ সময় ধ'রে করলে মানুষের আগ্রহও শিথিল হ'য়ে ওঠে। তা'তে মাথায় ভাল ক'রে গাঁথে না। এক বিষয়ে দীর্ঘ সময় তীব্র মনোযোগ দেবার মতো ক্ষমতাও মানুষের কম। আর, যাদের শেখাবেন, তাদের আগ্রহও যেমন থাকা চাই, সংস্কৃত জ্ঞানও কিছু থাকা চাই। মন্ত্রের অর্থগুলি যদি ভাল ক'রে না বোঝে, উচ্চারণ যদি শুদ্ধ না হয়, তাহ'লে ব্যাপারটা প্রাণহীন হ'য়ে ওঠে। শুধু এই জন্য নয়, প্রত্যেক হিন্দু সন্তানেরই সংস্কৃতটা ভাল ক'রে শেখা দরকার, তা' না হ'লে আমাদের নিজেদের তফিলে কী মাল আছে, সে-সম্বন্ধে কোন ধারণা হয় না। বেদ থেকে আরম্ভ ক'রে যে-কোন সংস্কৃত গ্রন্থে কী আছে নিজে প'ড়ে বুঝতে পারে, এতখানি জ্ঞান থাকা চাই, নচেৎ টীকাটিপনির মাধ্যমে যদি বুঝতে চায়, তাহ'লে অনেক গোল ঢুকে যাবে।
গোসাঁইদা-টীকাটিপনি ছাড়া বোঝাও মুশকিল।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ওর মধ্যে অনেক অবান্তর জিনিস ঢুকে গেছে। তাই ব্যাকরণ ও ভাষাটা এতখানি আয়ত্ত করা চাই, যা'তে মূল প'ড়ে মানে বুঝতে পারে। আপনার হরি চেষ্টা করলে পারে। গোসাঁইদা-ধরিয়ে দেওয়ার মতো লোক দরকার।
শ্রীশ্রীঠাকুর-সে আপনি, পঞ্চাননদা বা কেষ্টদা পারেন।
গোসাঁইদা-আমি অনেক ভুলেটুলে গেছি।
শ্রীশ্রীঠাকুর-স্তোত্র-টোত্র যে রকম বানান, তা' দেখে তো তা' মনে হয় না।
গোসাঁইদা-ও আমি ভেবেচিন্তে লিখি না। ভিতরে একটা ভাব আসলে, আপনার কথা স্মরণ ক'রে কলম ধরি, যা' আসার এসে যায়।
শ্রীশ্রীঠাকুর ভাবমুগ্ধ অন্তরে ললিতমধুর ভঙ্গীতে সকলের মর্মকন্দর আড়োলিত ক'রে তান তুললেন-
'মুকং করোতি বাচালং, পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিং,
যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ-মাধবম্।'
তারপর একটুক্ষণ চুপচাপ কাটলো।
বহিরাগত একটি মা বললেন-আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছি অদীক্ষিত পরিবারে, সেখানে তারা মাছ খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে, তাই, মেয়ে সেখানে যেতে চায় না, আমি এখন কী করব?
শ্রীশ্রীঠাকুর- উপযুক্ত ঘরে যদি মেয়ে দিয়ে থাকিস, তাহ'লে পাঠাবি না কেন? তারা তাদের বুঝমতো মাছ খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে, কিন্তু তোর মেয়ে যদি তাদের সেবাযত্ন ভাল ক'রে করে এবং আবদার ক'রে তাদের মত নিয়ে নিরামিষ খায়, তাহ'লে কি আটকায় নাকি? বরং তোর মেয়ে যদি তেমন হয়, তার-দৌলতে তার শ্বশুরবাড়ীর সবাই সৎসঙ্গী হ'য়ে যেতে পারে। অতোটুকু না পারলে তোর শিক্ষার বাহাদুরী কোথায়? তোর মেয়ে যখন, ঠিক পারবে।
মা-টি খুশি হ'য়ে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করলেন। একটু বাদে শ্রীশ্রীঠাকুর স্নানে গেলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর বিকালে মাতৃমন্দিরের উত্তর দিকে বকুলতলায় বেঞ্চে এসে বসেছেন, একটু উত্তরে বাবলা গাছ, তার পাশে ফিলান্থ্রপি অফিসের কাঠের ঘর, তার পুবদিকে কিশোরীদার ঘর, পশ্চিমদিকে ডিস্পেন্সারী, পোষ্ট অফিস ইত্যাদি, মাঝখানে প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের কোথাও-কোথাও চাপ-চাপ দুর্বাঘাস, কোথাও-কোথাও একেবারে পরিষ্কার। বাবলা গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে বেলা-শেষের রোদ খাবলা-খাবলা ছড়িয়ে পড়েছে। শীতের দিন, সেই ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রোদের মধ্যে অনেকে এসে বসেছেন। ভক্তবৃন্দ যাঁরা বাইরে থেকে অল্প কয়েক-দিনর জন্য অধিবেশন-উপলক্ষে এসেছেন, তাঁদের অনেকেই এই ক'টি দিনের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে চেষ্টা করছেন। ঋত্বিক-অধিবেশনের ফাঁকে-ফাঁকে তাঁরা যতটা বেশী সময় পারেন শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্যে তাঁর সঙ্গসুখ উপভোগে অভিধাহিত করেন। খুলনা, যশোহর, বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, পাবনা, রাজসাহী, রংপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, চব্বিশ পরগণা, কলকাতা, আসাম ইত্যাদি নানাজায়গা-থেকে অনেকে এসেছেন। বিভিন্ন স্থানের বহু লোক একত্র ব'সে আছেন। সকলে ভাই-ভাই, পিতার চরণতলে সমবেত হ'তে পেরে সকলের মহা আনন্দ। আগ্রহাকুল সন্তানদের পেয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরও মহ উল্লসিত, অফুরন্ত আনন্দ-উদ্দীপনায় ভরপুর ক'রে তুলেছেন সকলকে। এই আনন্দের সঞ্চয় নিয়ে ক'দিন পরে যে-যার ঘরে ফিরে যাবে, তাদের ঘর-সংসার, পরিবার-পরিবেশকে ক'রে তুলবে আনন্দময়। এই আনন্দের হাটে যোগ দিতে পারা কতই না ভাগ্যের কথা।
প্রমথদা (দে) বললেন-গাড়ীতে আসবার সময়, একজন মাতাল আমাদের কামরায় বড় হল্লা করছিল।
শ্রীশ্রীঠাকুর (হেসে বললেন) শালা মাতালের কান্ডই আলাদা।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর ভঙ্গী ক'রে দেখাতে লাগলেন মাতালরা মদ খেয়ে কেমন-ভাবে কথা বলে, কেমন কায়দা করে ইত্যাদি।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন ও হাসছেন, হাসতে-হাসতে তাঁর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল। শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে-সঙ্গে সবাই হো-হো ক'রে হাসছেন। হঠাৎ শ্রীশ্রীঠাকুর গম্ভীর হ'য়ে উঠলেন, সমবেদনার সুরে বলতে লাগলেন, অনেকে মদ খায় জীবনের দুঃখ-জালা-যন্ত্রণা ভুলে থাকবার জন্য। কিন্তু মদ খাবার পর সাময়িক উত্তেজনা যেমন আসে, তারপরেই আসে ঘোরতর অবসাদ। সেই অবসাদ কাটাবার জন্য আবার মদ খায়। এইভাবে শরীর-মনকে জীর্ণ' ক'রে তোলে। এই চক্রের থেকে বেরুতেও পারে না। মনে-মনে শুভ-সঙ্কল্প আসলেও ঝোঁক যখন চাপে, তখন আর সামলাতে পারে না। কিন্তু ঝোঁকটা যখন আসে তখনই যদি ঐ সম্বেগ নিয়ে অন্য কোন কাজে নিজেকে ব্যাপ্ত করে, তাহ'লে কিছুদিন এভাবে করতে-করতে ঐটে আয়ত্তে আসে। প্রথমে আমি এটা ঠিক পেলাম রসগোল্লা খাওয়ার ব্যাপারে। রসগোল্লর পরে আমার অত্যন্ত লোভ ছিল। অনেক সময় ধার ক'রে রসগোল্লা খেতাম। একবার বেশ কয়েক টাকা বাকী পড়লো। দোকানদার পরিষ্কার জানিয়ে দিল-'ভাল কথায় যদি টাকা না দেন, তাহ'লে যে-কোন ভাবে টাকা আদায় করব। ভদ্রলোকের ছেলে! আপনার লজ্জা করে না, বাকী ক'রে রসগোল্লা খান, পয়সা দেবার নাম নেই?' তখন মনে এত গ্লানি হ'লো যে, টাকাটা কোনভাবে শোধ দিয়ে দিলাম। আর, মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করলাম-আর এভাবে রসগোল্লা খাব না। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলে কী হবে? আবার রসগোল্লা খাবার লোভ আমাকে পেয়ে বসলো। মনে-মনে ভাবতে লাগলাম-যাক্, আজ খাই, একদিন খেলে আর কী হবে? এই ব'লে গুড়িগুড়ি ক'রে রসগোল্লার দোকানের দিকে এগুতে লাগলাম। তখনই আবার মনে হ'লো, লোভ তো আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোভের কাছে তো আমি হেরে যাচ্ছি। এই ব'লে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে থেকে মনে হ'লো কে যেন আমাকে হিড়হিড় ক'রে রসগোল্লার দোকানের দিকে টানছে। তখন সোজা মাটিতে শুয়ে পড়লাম। শুয়েও মনে হ'তে লাগলো, আমি নিজেকে সামলাতে পারব না, আমাকে টেনে নিয়ে যাবেই। তখন অড়হর ক্ষেতে ঢুকে দুই হাত দিয়ে অড়হর গাছগুলি জড়ায়ে ধ'রে প'ড়ে থাকলাম। ভিতরে তখন দারুণ তোলপাড় করছে। মন একবার বলছে, 'যা না! রসগোল্লা খেলে কী হবে? ওটা তো এমন অখাদ্য কিছু নয়। আর বেশী বাকী না পড়লেই হ'লো, সময়মতো যদি শোধ দিয়ে দিস কিংবা বাকী না করিস তাহ'লে ক্ষতি কী?' পরক্ষণেই বলছে-'না! লোভকে প্রশ্রয় দিলে আরো পেয়ে বসবে, যাওয়া হবে না।' এইভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। তারপর দেখলাম-রসগোল্লা খারার ঝোঁকটা যেন ক'মে গেল। ধীরে-ধীরে বাড়ী ফিরে আসলাম। দ্বিতীয় দিন ঐ সময় মা'র কাছে মার খেয়ে কেটে গেল। তৃতীয় দিন আবার যাব-যাব মন করতেই হেম চৌধুরীর সঙ্গে ইচ্ছে ক'রে ঝগড়া বাধিয়ে দিলাম। সে ঝগড়া করবে না, কিন্তু আমার যে ঝগড়া না করলেই নয়, আমার যে সময়টা কাটিয়ে দেওয়া চাই। তারপর মনে করলাম, অড়হর ক্ষেতে শোবারই বা কী দরকার? খামকা ঝগড়া করবারই বা কী দরকার? ব্যাপার তো হ'লো ঝোঁকটা যখন চাপে, তখন অন্যভাবে ব্যস্ত হ'য়ে সময়টা কাটিয়ে দেওয়া। তাই, রোজ বুদ্ধি ক'রে সময়টা এক-একভাবে কাজে ব্যস্ত হ'য়ে কাটিয়ে দিতে লাগলাম। ক্রমে-ক্রমে রসগোল্লার লোভ আমার আয়ত্তে আসলো। কিন্তু তা' সত্ত্বেও পুরো তিন বছরের মধ্যে আর রসগোল্লা খাইনি। যে-কোন প্রবৃত্তিকেই এইভাবে বশে আনা যায়। প্রবৃত্তির খেয়াল যেই চাপে, সেই মুহূর্তেই অন্য কোন প্রীতিকর সৎকাজে আত্মনিয়োগ ক'রে শরীর-মনকে ও-থেকে দূরে রেখে দিতে হয়, তাহ'লে আস্তে-আস্তে ওটা তখনকার মতো উবে যায়। যখন-যখন ঐ আবেগ পেয়ে বসতে চায়, তখন-তখনই ঐ রকম করতে হয়। বার-বার এই রকম করতে-করতে প্রবৃত্তির বন্ধন ঢিলে হ'য়ে পড়ে। ছোট্ট একটু জিনিস, এইটে তোমরা যদি কাজে লাগাও এবং অন্যকেও কৌশলটা শিখিয়ে দাও, তাহ'লে দেখবে প্রবৃত্তি-জয় কতো সহজ। আমি অনেককে এ-কথা বলেছি, অনেক মাতাল, অনেক দুশ্চরিত্র এই সামান্য তুকটা প্রয়োগ ক'রে ভাল হ'য়ে গেছে। তবে ইচ্ছা ও অনুশীলন একসঙ্গে দু'টি জিনিস থাকা চাই।
এরপর কেষ্টদা (ভট্টাচার্য্য) ও খেপুদা (চক্রবর্তী) একত্র এসে শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে নিভৃতে অনেক সময় ধ'রে কথা বললেন। ✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_তৃতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10