শারীরিক সুস্থতা-বিধান সম্বন্ধে- পৃ ২৯,
স্বস্ত্যয়নী-২৯
কর্মে প্রেরণা-দান-৩১,
বক্তৃতাদানের রীতি-৩১.
যাজন ৩১
কৰ্ম্ম-অনুযায়ী ভাব সৃষ্টি হয়-৩২
যজন-যাজন-ইষ্টভৃতি- ৩২
শ্রীশ্রীঠাকুরের আত্মকথা-৩২,
বিবাহের গুরুত্ব-৩৩
যাত্রা-নাটক সম্বন্ধে-৩৩
ঋত্বিকের দায়িত্ব-৩৪,
তারুণ্য ও স্ফূর্ত্তি ধর্মজীবনের লক্ষণ-৩৪
ধর্ম-৩৪
নিত্য বেদাভ্যাস মানে-৩৪
প্রাচীনের উপর শ্রদ্ধা জাগাতে হবে- ৩৪,
বিধিদত্ত ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করতে হয় ৩৪।
কর্মে প্রেরণা-দান-৩১, ৩৫
১৭ই পৌষ, বৃহস্পতিবার, ১৩৪৮ (ইং ১।১।৪২)
P 28-35
শ্রীবিগ্রহ - পুরুষােওম - তনু দুনিয়ার সব চাইতে আকর্ষণের বস্তু । তাঁর প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস সর্ব্বজীবের অশেষ কল্যাণনিষ্যন্দী । তাই তাঁর কাছে এসে মানুষ পায় শান্তি , পায় স্বস্তি , তৃপ্তির পরমাশ্রয় খুঁজে পায় তাঁর ভিতর । মানুষের প্রাণ তাই আকুলি - বিকুলি করে তাঁর স্পর্শ লাভের জন্য । এমনই আকূতি নিয়ে অগণিত ভক্তবৃন্দ তাঁর চরণতলে এসে বসেছেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে আশ্রম - প্রাঙ্গণে বাবলাতলায় একখানি বেঞ্চে বসে আছেন । মধুর হাস্যে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন । পশুপতিদা ( দত্ত ) কাল রাত্রে আলগা জায়গায় শুয়েছিলেন , শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে বলছেন — আপনার ঐ সুটকি শরীর , দেখেন যেন ঠান্ডা না লাগে ।
পশুপতিদা — আমার অভ্যাস আছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সে ভাল । শরীরটাকে যত সহনপটু ক'রে তােলা যায় , প্রকৃতির সঙ্গে যত খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় ততই ভাল ।
পশুপতিদা — আগে আমার শরীরের জন্য খুব চিন্তা হতাে , এখন আর তেমন হয় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — শরীরের সম্বন্ধে খুব চিন্তা হওয়া একটা অসুস্থতার লক্ষণ । আমাদের চোখটা যে আছে সে - সম্বন্ধে সাধারণতঃ আমরা খুব সচেতন থাকি না , কিন্তু চোখে যখন একটা কুটো পড়ে কিংবা অন্য কোন কারণে যখন চোখে অসুবিধা হয় তখনই আমরা চোখটার বিষয়ে খুব সজাগ হয়ে উঠি । তার মানে চোখের স্বস্থতা তখন ব্যাহত হয়েছে । শরীর - সম্বন্ধেও ঐ কথা ।
যতীনদা ( দাস ) —মনটা যদি শরীরমুখী হয়ে পড়ে সে - অবস্থায় করণীয় কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — শরীর অসুস্থ হ'লে মনটা আপনা থেকেই শরীরমুখী হ'য়ে পড়ে । তবে একটা কথা হচ্ছে এই যে , স্বস্ত্যয়নীর বিধানের মধ্যে যেমন আছে শরীরটাকে ইষ্টপূজার যন্ত্র - স্বরূপ বিবেচনা ক’রে সুস্থ ও সহনপটু রাখবার কথা , ঐ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলতে হয় । তাতে শরীরটা মুখ্য হয় না , মুখ্য হয় ইষ্টের কাজ । ঐ মনােভাব নিয়ে আমরা যাই করি না কেন , তাতে অভিভূতির থেকে রেহাই পাই , নচেৎ আমাদের নিস্তার নাই । স্বস্ত্যয়নী এমন মাল , এ যদি কেউ ঠিকভাবে করে , তার উন্নতি হতে বাধ্য । শুধু তার উন্নতি হয় না , তার আশপাশের লোকও ঐ আবহাওয়ায় প'ড়ে উন্নত হয়ে ওঠে ।
ব্রজেনদা ( চট্টোপাধ্যায় ) -আমরা এত লোক তাে স্বস্ত্যয়নী করছি , কিন্তু আপনি যেমন বলেন তেমন তাে উন্নতি দেখা যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর --স্বস্ত্যয়নী করা মানে স্বস্ত্যয়নীর সবকটা নীতি পালন করে চলা । তা ’ করলে তার ফল হাতে - হাতে পাওয়া যায় । তার মনের ভূমিই বদলে যায় , অবস্থাও তার যেমনই হাে’ক , তাকেই সে শুভে নিয়ন্ত্রিত করে তােলে । মানুষের সব - কিছুর মূলে আছে তার চরিত্র , অভ্যাস , ব্যবহার , ইচ্ছা ও আকুলতা । স্বস্ত্যয়নী - ব্রতে এই সবগলির গায় হাত পড়ে । এগুলি যদি বদলে যায় , তার অবস্থাও বদলাতে বাধ্য ।
কেদারদা ( ভট্টাচাৰ্য্য ) —স্বস্ত্যয়নী করা সত্ত্বেও মানুষের যখন নানা বিপদ আসে , তখন মনটা দুর্বল হ’য়ে পড়ে , ভাবে , এ ক’রে লাভ কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমরা গ্রহের হাতেই আছি , যখন সেগুলির প্রতিকূল প্রভাব থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই , তখন ওগুলিও অনেক সময় তাদের প্রতাপ দেখাতে ছাড়ে না । কিন্তু তখন যদি স্বস্ত্যয়নী ছেড়ে দিই , তাহ'লে পুরােপুরিই ওদের কবলে পড়ে যাব , ওরাই আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘােরাবে , এইভাবে জাহান্নমের পথই পরিষ্কার হবে । তাই বিপদ - আপদ যাই আসুক , স্বস্ত্যয়নী আরাে কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরতে হয় । এ ছাড়া পরিত্রাণের পথ নেই । দেবাসুরের সংগ্রাম । স্বস্ত্যয়নী হলাে দৈবী জীবনের পথে অভিযান । কঠোর সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় এ পথে । নিষ্ঠার সঙ্গে ধ'রে থাকলে জয় অনিবার্য্য। আর , আপনারা লক্ষ্য ক'রে দেখবেন , জীবনে যারাই সত্যিকার বড় হয়েছে , তাদের চরিত্রে স্বস্ত্যয়নীর নীতি কিছু - না - কিছু মর্ত্ত আছেই । এই পাঁচটি নীতি যদি কারও চরিত্রে মূর্ত্ত হয় , তাহলে সে একটা দিকপাল হয়ে উঠবেই - তা ’ সে একটা চাষাভূষােই হােক বা মুটে - মুজরই হােক । তাই নিত্য বিশ্লেষণ করে দেখতে হয় , ঐ পাঁচটি নীতি কোনটা কেমন পরিপালিত হচ্ছে । যেটার পরিপালনে শৈথিল্য হচ্ছে , সেটা ভাল করে করতে হয় , তাহলে দুদ্দর্ব আমাদের জীবনে প্রবেশ করার কোন রন্ধ পায় না । আর , এর সঙ্গে যজন , যাজন , ইষ্টভৃতিও ঠিকমতাে করতে হয় ।
কেদারদা - জাতির অর্থনৈতিক উন্নতি কি স্বস্ত্যয়নীর উপরই নির্ভর করে?
শ্রীশ্রীঠাকুর - অর্থনৈতিক উন্নতি কেন , সর্ববিধ উন্নতিই নির্ভর করে স্বস্ত্যয়নীর উপর । স্বস্ত্যয়নী সবকিছুই গজিয়ে তােলে । তাই স্বস্ত্যয়নী যত বেশীর মধ্যে চারিয়ে দিতে পারবেন , ততই ভাল । স্ত্যয়নী - ব্রতধারী মানে আমি বুঝি — সে ঈশ্বরের মানুষ , ধর্ম্মের মানুষ , কৃষ্টির মানুষ -- বাস্তব আচরণে , তাই তার স্পর্শে অন্যেরাও উৎসমুখী হয়ে ওঠে , জীবনবৃদ্ধিমুখী হ'য়ে ওঠে । তার সব করা , বলা , ভাবাগুলি হ'য়ে ওঠে একমুখী , এর মধ্যদিয়ে সংহত ব্যক্তিত্বের উদ্ভৰা হয় , প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে । কিছু লােক এনতর হয়ে উঠলে , তারাই দেশ ও দুনিয়ার হাওয়া বদলে দিতে পারে ।
মন্মথদাকে ( দে ) দেথে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন -- মন্মথদা , বসেন । এবার নাকি খুব ভাল কাম হইছে আপার , গল্প করেন শুনি ।
মন্মথদা প্রণাম করে বসলেন । বললেন আমি নিজে তো বড় বেরোতে পারি না , তবে আমার সহকর্মী যারা আছেন , তাঁরা খুব খেটেছেন । তাদের যেমন direction ( নির্দ্দেশ ) দিয়েছি , সেইভাবে চলেছেন , ভাল - ভাগ দীক্ষা অনেকগুলি হয়েছে , আরো বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋত্বিক চেয়ে পাঠাচ্ছে । সামনের টার্ম্মে আরাে ভাল কাজ হবে আশা করা যায় । আমি নিজে ঘুরতে পারি না এই যা ’ দুঃখ , তবে আমার দাদারা খুব ভাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মাহুত ঠিক থাকলে , সব ঠিক হ’য়ে ওঠে । দেখেন আপনারা কতটুকু করিছেন , তা'তেই চারিদিকে কেমন সাড়া প’ড়ে গেছে । তেমন ক'রে লাগলে তাে কথাই ছিল না । তাই কই , এতদিন ওকালতি তাে করলেন , এইবার পরমপিতার ওকালতি একবার ভাল করে ক'রে দেখেন ।
মন্মথদা --- ঘুরতে পারলে কাজ হয় , কিন্তু বেশী সময় দিতে পারি না , এই যা ' অসুবিধা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - পরমপিতার কাজ নিয়ে যদি থাকেন , কোনটাই আটকায় না । নারায়ণের সেবা নিয়ে থাকলে , লক্ষী তার পাছে - পাছে ঘোরেন । প্রথমটা কিছু কষ্ট হ’তে পারে , কিন্তু যজমানগুলিকে যদি তাজা করে তুলতে পারেন , তাহ'লে আর ভাবনা থাকে না । আপাততঃ ঋত্বিকতাকে মুখ্য ক'রে ওকালতি ফাঁকে - ফাঁকে করলে হয় । জোর দিয়ে এই কাজ করতে পারলে পরে আর ওকালতি করবার দরকার হবে না ।
মন্মথদা - যাজন নিয়ে থাকতেই প্রাণ চায় , ওতেই সবচাইতে বেশী আনন্দ পাই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - যাজনের মতো জিনিস নেই । যাজনের সময় কত কথা যে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় , নিজেই ভেবে অবাক হয়ে যেতে হয় । ভাবমুখী হ'য়ে থাকলে পরমপিতা রাশ ঠেলে দেন । ভিতরে যা - কিছু , জমায়েৎ আছে ফুটে ফুটে ওঠে , বিন্যস্ত হয়ে বের হয় । ‘ মূকং করােতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিং , যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ - মাধবম্ । ' যাজনের সময় মনে হয় , ভগবান , আমার বুকে এসে বাসা বেধেছেন , তিনিই আমাকে দিয়ে তাঁর কথা কইয়ে নিচ্ছেন । প্রকৃত যাজনে যাজক ও যাজিত উভয়েই উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে , উল্লসিত হয়ে ওঠে , উপভােগ - উচ্ছল হ'য়ে ওঠে । মনে হয় , জীবনে এত সুখও ছিল ! হায় সে কী সুখ ! হাতে লয়ে জয়তুরী , জনতার মাঝে ঝাঁপায়ে পড়িতে , রাজ্য ও রাজা ভাঙ্গিতে গড়িতে , অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া হানিতে তীক্ষা ছুরি । ' মানুষকে ইষ্টমুখী করে তোলায় , তার অসৎ যা - কিছুকে সুনিয়ন্ত্রিত ক’রে তোলায় , মােড় ফিরিয়ে দেওয়ায় যে কী আনন্দ তা ' ব'লে শেষ করা যায় না । এতে যেন আমিই পেলাম আমার জীবনকে আরো ক’রে । যাজন যেমন করবেন, বক্তৃতাও তেমনি অভ্যাস করবেন । আপনি বক্তৃতা তো খুব ভাল করেন শুনেছি । বক্তৃতাকরার সময় শ্রোতাদের মুখের দিকে ভাল ক’রে চেয়ে দেখতে হয় । তাদের ধারণা কী , সমস্যা কী , চাহিদা কী , সংস্কার কী , জ্ঞানের পরিধি কতখানি ইত্যদি আঁচ ক'রে নিয়ে বক্তৃতার মধ্যে নানারকমের ঢেউ তুলতে হয় যাতে প্রত্যেকের মন ব’লে ওঠে এই জিনিসই তো আমার চাই । যাজন বা বক্তৃতা এমন হবে যে তা'তে দীক্ষার কথা বলব না , অথচ মানুষ দীক্ষার জন্য পাগল হ’য়ে তার উঠবে তার যেন তখনই দীক্ষা না পেলে চলছে না — এমনতর হওয়া চাই । মানুষকে শুধু , আবেগােদ্দীপ্ত ক’রে তুললেই হবে না , তদনুযায়ী কর্ম্মপ্রবণ ক'রে তুলতে হবে । তাকে বিহিত কর্ম্মনিরত ক’রে তুলে তা'তে কৃতী ক'রে তুলতে হবে । ক্রমান্বয়ী প্রেরণায় ইষ্টানুগ কৰ্ম্মনিরত রেখে মানুষগুলিকে বাড়িয়ে তুলতে হবে । কেউ যেন ঢ'লে পড়ার অবকাশ না পায় , চেতিয়ে উদ্বর্দ্ধনমুখর রাখতে হবে সকলকে ।
মন্মথদা – মানুষের ভিতরে যদি জিনিস না থাকে , তবে বাইরের চেষ্টায় কক্ষণ চেতিয়ে রাখা যায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - মানুষ যে যেমনই হাে’ক , ভালবাসার টান প্রত্যেকেরই তার মতাে ক'রে আছে । ইষ্টকে অবলম্বন ক’রে সেইটের সদ্ব্যবহার যা'তে করে , সেই প্রেরণা ও দৃষ্টান্তই জোগাতে হবে । করতে - করতে কার কোন্ সময় খুলে যায় , কিছুই বলা যায় না । পিপ্পুলিয়া হরিদাসের কথা শুনেছি , তার অন্তর শুষ্ক ও ভাবভক্তিহীন ব’লে চোখে ঝাল লাগিয়ে কাঁদত , এই কাঁদতে - কাঁদতে তার ভিতর সত্যিকার ভাব - ভক্তি জেগে উঠলাে , তখন ঈশ্বরের কথা স্মরণ ক'রে স্বতঃই সে প্রেমাশ্রু বিসর্জন করতাে । মানুষের সম্বল হ'লাে তার শ্রদ্ধা , ভালবাসা , সেইটেকে যত উসকে তোলা যায় ততই মঙ্গল । আপনারা যে যজন , যাজন , ইষ্টভৃতির কথা এত ক'ন , সেও তাে ঐ ইষ্টানুরাগের অনুশীলনের জন্য । ইষ্টানুরাগ থাকলে যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি আপনিই করা আসে । আবার যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি করতে - করতেও ইষ্টানুরাগ ফুটে ওঠে । তাই , যা করণীয় মানুষকে তা ' করার তালে ফেলে দিতে হয় , তখন ভিতরটাও সেইভাবে গ'ড়ে উঠতে থাকে । আমি একবার একটা খেজুর গাছে উঠেছিলাম পাখীর ছানা ধরতে , গাছে উঠে গর্ত্তে হাত দিয়ে হাত বের করে দেখি , ইয়া মোটা কাল মিচমিচে একটা সাপ , তখন আলগােছে ওটা গর্তের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম , নেমে একটা দৌড় মারলাম , খানিক দুর দৌড়ে এসে দেখি , ভয়ে আমার হাত - পা অবশ হয়ে এসেছে , আমি যেন আর চলতে পারছি না । এর আগ পর্য্যন্ত আমি কিন্তু ভয় ব'লে বােধ করিনি । দৌড়ে আসার পরই ভয়টা যেন পেয়ে বসলাে । আর একবার রাস্তায় একটা সাপ ফণা তুলে ছিল , তার উপর দয়ে লাফ দিয়ে পার হ'য়ে খানিকটা দৌড়ে এসে ভয়ে জড়সড় হ'য়ে পড়লাম । যখন লাফ দিয়ে পার হয়েছি , তখন কিন্তু ভয় করেনি । বার - বার এইরকম দেখে আমার ধারণা হয়েছে যে , করা - অনুযায়ী ভাব আমাদের ভিতর সষ্টি হয় । তাই , করাটার উপর আমি এতখানি জোর দিই । ভিতরে ইচ্ছা নিয়ে করা , বলা , ভাবাটাকে যদি মক্স ক'রেও চালান যায় , অন্তররাজ্যের বিন্যাসও কতকটা তেমন হয়ে ওঠে । তবে জন্মগত বৈশিষ্ট্য যে একটা মুল কথা , সে - বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ।
বিদ্যামার সঙ্গে মন্টুন এসে দাঁড়িয়েছে , শ্রীশ্রীঠাকুর সােহাগের সুরে বললেন -মটুন সােনা ! মন্টুন সােনা !
মন্টুনের মুখখানা আনন্দে ডগমগ হ’য়ে উঠলাে ।
বিদ্যামা বললেন — তরুদির শরীর খারাপ , এখন আমার পাছ ছাড়তে চায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) -দৌরাত্ম্য করার জায়গা পালি কেউ ছাড়ে ?
পরক্ষণেই বললেন - ও বােধহয় শ্রীশদার থেকে লম্বা হবে ।
বিদ্যামা — তা হ’তে পারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষের ভরসা অশেষ । বাপ - বড়বাপের কত জিনিস যে আমাদের ভিতর লুকায়ে থাকে তার ইয়ত্তা নেই । আমি যদি কোন দিক দিয়ে বেশ্যাও হই , আমার বিয়ে যদি ঠিকমতাে হয় , আমার পিতৃপুরুষাগত সম্পদ , আমার সন্তানদের ভিতর - দিয়েও প্রকাশ হতে পারে । তাই , উপযুক্ত বিয়ে ও কুলাচারের ভিত - দিয়ে বংশধারা ঠিক রাখা বড় দরকার ।
কথায় - কথায় যাত্রার কথা উঠলাে ।
ভাল আদর্শ ও কৃষ্টির প্রতি যাদের অনুরাগ আছে , তারা যদি আবার ভাল অভিনেতা হয় এবং বইগুলি যদি আদর্শমূলক হয় , তবে তাদের অভিনয়ে আদর্শ সঞ্চারিত হবে বেশী করে । ধর্ম - সম্বন্ধে , কৃষ্টি - সম্বন্ধে বহু , কিম্ভুতকিমাকার ধারণা লোকের মধ্যে চারিয়ে গেছে অবান্তর ধারণা বহু , বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে , সেগুলির নিরসন ক'রে নির্ভেজাল জিনিসটির প্রতিষ্ঠা করতে হবে । খাঁটি জিনিসটি বার - বার লােকের চোখের সামনে তুলে ধরা চাই , কানের কাছে ঢাক পিটিয়ে বলা চাই । নইলে , বহু মানুষ আসল - নকলের ভেদ বুঝতে পারে না । চিন্তার রাজ্যে মানুষ যদি কতকগুলি জঞ্জাল পুরে রাখে , তাদের চলনাও এলােমেলাে হয়ে ওঠে । তাই , মানুষের মাথা সাফ করার জন্য অনেক খাটুনি আছে । এদিক দিয়ে যাত্রাকে নেকখানি কাজে লাগান যায় । শুধু , যাত্রা কেন , থিয়েটার , নাটক , নভেল , সিনেমা , কথকতা সবগুলিকেই ঢেলে সাজাতে হয় । আর , শিক্ষা - ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা লাগে । মানুষ যাতে চরিত্রবান হয় , চৌকস হয় , জীবনীয় ও জ্ঞাতব্য যা' -কিছুর অনুশীলনে , গবেষণায় ও চর্চ্চায় যা'তে সারা দেশ উদ্দাম হয়ে ওঠে , তার ব্যবস্থা করা লাগে । আর , আপনারা ঋত্বিকরাই হবেন তারপ্রবর্তক । যেখানে যাবেন জড়তা বা অজ্ঞতাকে কিছুতেই টিকতে দেবেন না । আলাপে , আলােচনায় , আচরণে ক্রমাগত দেখাতে থাকবেন , শেখাতে থাকবেন বাঁচা - বাড়ার জন্য কী - কী জানা লাগে , কী - কী করা লাগে , কেমনভাবে চলা লাগে , সঙ্গে - সঙ্গে আমাদের পূর্ব্ব গৌরব যা ’ সেগুলি সম্বন্ধে সকলকে ওয়াকিবহাল করে তুলবেন । প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধা ছাড়া মানুষ কখনও বড় হতে পারে না । আজকাল কত বাদের আমদানী হচ্ছে , আর আমাদের দেশের যুবকরা তাতেই ঢলে পড়ছে , কিন্তু আমাদের যে কী সম্পদ ছিল , তা তারা ভেবে দেখে না । সে - কথা তাদের শােনায়ই বা কে , শেখায়ই বা কে ? আমাদের ভাণ্ডারে কী ছিল তা ' উদঘাটিত করা লাগবে , সবার গােচরে আনা , লাগবে । এত বড় একটা বিরাট জাত আত্মবিস্মৃত হয়ে মেকুরের মতাে হয়ে আছে , এদের জাগান , এদের বাঁচান ।
সকলেই স্তম্ভিত হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কথাগুলি শুনছেন , এমন সময় শ্রীশদা ( রায়চৌধুরী ) ও বঙ্কিমদা ( রায় ) আসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁদের সঙ্গে নতুন দালানের জন্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের বিষয় আলােচনা করলেন । ওরা চলে যাবার পর একটি দাদা আর একজনকে দেখিয়ে বললেন — আপনি যাত্রার কথা বলছিলেন , এই দাদা এক সময়ে যাত্রার দলে ছিলেন এবং খুব ভাল পাঠ করতেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর —আজকাল করিস না ?
উক্ত দাদা — অনেক দিন করি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - করাই তাে ভাল । মুখস্থ থাকলে কর্ তাে দেখি , শুনি ।
দাদাটি প্রথমে আমতা - আমতা করতে লাগলেন ।
সকলে চেপে ধরলেন , “ ঠাকুর বলছেন যখন করেন না ? এতে লজ্জার কী ? তখন দাদাটি দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী সহকারে উচ্চৈঃস্বরে ভীমের পাঠ ক'রে শোনালেন ।
দেখতে - দেখতে আরাে বহু , লােক এসে জড় হলেন ।
অভিনয় শেষে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন -ভগবান যে ক্ষমতা দিয়েছেন , তার সদ্ব্যবহার করতে হয় । প্রত্যেকটা ক্ষমতাই তাঁর কাজে লাগান যায় , তা দিয়ে লােকের ভাল করা যায় , তাই কোন ক্ষমতাকেই অনভ্যাসে নষ্ট হতে দিতে নেই । আমরা অনেকেই অল্প বয়সে বুড়াে মেরে যাই । উৎসাহ , উদ্যম , স্ফূর্তি কমে যায় , মর্কট - বৈরাগ্য এসে ঘিরে ধরে , আর ভাবি , আমরা খুব ধর্ম্মের পথে এগােচ্ছি , তা কিন্তু নয় । ধর্মের সঙ্গে - সঙ্গে আছে উৎসাহ , উদ্দীপনা , আনন্দ , কর্ম্ম , নিত্য নতুন অধিগমন । নিত্য বেদভ্যাস বলে , তার মনে নিত্য নতুন জানার অভ্যাস । ধর্ম্ম মানুষের জীবনকে রেখে দেয় চির নবীন , চির তরুণ , এই তারুণ্য ও স্ফূর্তিকে খতম হ'তে দিতে নেই । তা ' দিলে জীবনে জরা নেম আসে ।
প্রফুল্ল ( দাস ) -অনেককে তাে দেখা যায় বহ , বয়স পর্য্যন্ত তারা উদ্দাম প্রবৃত্তি - উপভােগ ও স্ফূর্ত্তি নিয়ে চলে , অথচ কোন আদর্শের ধার ধারে না , তাহলে কি তাদের ধাৰ্মিক বলা ঠিক হবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - আদর্শহারা অনিয়ন্ত্রিত জীবনে যে ক্ষত্তি তার দুষ্ট প্রতিক্রিয়া আসবেই , সে আজই হােক আর কালই হােক । কিন্তু আদর্শকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনে যে উৎসাহ , উদ্দীপনা , আনন্দ তা ক্রমাগত বেড়েই চলে । অবশ্য , শরীরটাকে তাজা রাখা ধৰ্ম্মের একটা অঙ্গ । শরীর ভাল না থাকায় মানুষ অনেক সময় নিস্তেজ ও নিরুৎসাহ হ'য়ে পড়ে । কিন্তু ইষ্টানুরাগ এমন একটা জিনিস , যা ব্যাধি ও জরাকে অনেকখানি প্রতিহত করে রাখে । আমরা যে ব্যাধি ও জরা গ্রস্ত হই , সে তাদের আমন্ত্রণ করি বলে । আমরা যদি তাদের আমল না দিই , সর্ব্বদাই যদি ইষ্টনেশায় মাতাল হয়ে থাকি , স্বাস্থ্য ও সদাচারের নিয়মগুলি আমরা যদি নিখুতভাবে পালন করে চলি , তবে ব্যাধি ও জরা আমাদের সহজে আক্রমণ করতে পারে না । এতে আয়ু পৰ্য্যন্ত বেড়ে যায় । ফলকথা , জন্মগত সম্ভাব্যতার মধ্যে সব দিক দিয়ে ভাল যতখানি হওয়া সম্ভব তাই হয় ।✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_তৃতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10