- ঋত্বিকের দায়িত্ব-পৃ১০
- দীক্ষাদানে বিচার্য্য-পৃ১১
- কাজে ঢিলেমি প্রশ্রয় না পায়-পৃ১২
- সংগঠনের কৌশল-পৃ১২
- লেখকদের প্রতি-পৃ১৩
- 'ন বুদ্ধিভেদং জনয়েৎ'-এর উদাহরণ-পৃ১৪
- অনুতাপে পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে হয়-পৃ১৫
- অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য করণীয়-পৃ১১
- জাতির পরাধীনতার কারণ-পৃ১৭
- ধর্ম-পৃ১৭
- ধর্মে বিরোধ নেই-পৃ১৮
- নেতার চরিত্র-পৃ১৮
P 10-19
১৫ই পৌষ, মঙ্গলবার, ১৩৪৮ (ইং ৩০।১২।৪১)
ঋত্বিক্-অধিবেশন চলেছে, অগণিত লোকের ভিড়, সবাই হাসিখুশি। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনান্তে মাতৃ-মন্দিরের সামনের বারান্দায় এসে বসেছেন দক্ষিণাস্য হ'য়ে। একে-একে অনেকে এসে প্রণাম করছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর খুশিমনে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। ঋত্বিকদের মধ্যে অনেকে উপস্থিত আছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর আবেগভরে বলছেন-ঋত্বিকদের বড় দায়িত্বপূর্ণ কাজ। মানুষের জীবনের সব দিক নিয়ে তোমাদের কারবার। একটা মানুষ কিংবা একটা পরিবারও যেন কোন দিক দিয়ে হীন না থাকে, অসমর্থ না থাকে, তাই তোমাদের দেখতে হবে। প্রত্যেকটা মানুষের পিছনে তোমরা লেগে থাকবে, এবং ফন্দী-ফিকির করবে, কিভাবে তাকে বড় ক'রে তুলতে পার। তার ঘর-গৃহস্থালী, বাগান, ক্ষেত, গরু-বাদুর, আয়-উপার্জন, খাওয়া-পরা, বিয়ে-পাওয়া, আমোদ-আহমাদ থেকে সুরু ক'রে শিক্ষন, দীক্ষা, সাধনা, সদাচার ও ব্রহ্মজ্ঞান পর্য্যন্ত কোন দিকটাই যেন তোমাদের নজর না এড়ায়। আমার দেখতে ইচ্ছা করে যে তোমাদের স্পর্শে ঘরে-ঘরে মানুষ দেবতা হ'য়ে উঠছে।
যোগেশদা (চক্রবর্তী) মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য আমরা কী করতে পারি?
শ্রীশ্রীঠাকুর-মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে আছে তার যোগ্যতা।
প্রত্যেকের যোগ্যতা যা'তে বাড়ে, তাই দেখতে হবে। মানুষ যত সুনিয়ন্ত্রিত হয়, সুকেন্দ্রিক সেবার আকৃতি তার মধ্যে যত বাড়ে, ততই তার যোগ্যতা বেড়ে ওঠে। আর, এই করতে গেলে যজন, যাজন, ইষ্টভৃতির ধান্ধা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। শুধু পেটের ধান্ধা নিয়ে থাকলে তার যোগ্যতা বাড়বে না। আর, ঋত্বিকরা হাতে-কলমে দেখিয়ে দেবে, কেমন ক'রে মানুষ আয়-উপার্জন বাড়াতে পারে। ধরেন, একজন কৃষি করে, কৃষিটা আরো লাভজনকভাবে করতে পারে কী ক'রে সে-সম্বন্ধে তাকে শিক্ষিত ক'রে তুলতে হবে। ফসল বাড়াবার জন্য কী সার দিতে হবে, নূতন কী-কী ফসল হ'তে পারে তার জমিতে, যে-জমিতে বছরে একটা কি দুটো ফসল ফলায়, সেখানে আরো পারে কি না, এই সব ধরিয়ে দিতে হয়। আর, কৃষিজাত দ্রব্যের উপর দাঁড়িয়ে কুটির-শিল্প কী-কী করতে পারে, তা'ও দেখাতে হয়। ছোটখাট যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হয়। নিজেরই অনেক ভাবা লাগে, দেখা লাগে, শোনা লাগে, পড়া লাগে, করা লাগে। যে-জিনিস তারা তৈরী করলো তা' বিক্রীর ব্যবস্থা ক'রে দিতে হয়। সস্তায় সুন্দর-ভাবে যেন করতে পারে। নইলে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। অনেকখানি খাটতে হবে এর পিছনে। নইলে উপরসা-উপরসা দুটো সৎকথা শুনিয়ে চ'লে আসলাম, তা'তে চলবে না। আর, সৎসঙ্গীদের মধ্যে যা'তে পারস্পরিকতা বাড়ে, প্রত্যেকে যা'তে প্রত্যেকের পিছনে এসে দাঁড়ায় তা' করতে হবে। প্রত্যেকের প্রত্যেকের প্রতি যদি সক্রিয় দরদ থাকে, তাহ'লে কারও অবস্থা হীন থাকে না। এতে গরীব-ধনী সবাই উপকৃত হয়। একজনের যদি অজস্র টাকা থাকে, কিন্তু তার পিছনে যদি মানুষ না থাকে, তাহ'লে সেও কিন্তু নিঃস্ব। তাই মানুষ আহরণের প্রয়োজনের বিষয়ে সকলকেই সজাগ ক'রে দিতে হয়। আর, আপনারা যে দীক্ষাদি দিচ্ছেন, এর মধ্যে একটা balance (সাম্য) চাই, দীক্ষিতের মধ্যে অযোগ্যের সংখ্যাই যদি যোল আনা হয়, তাহ'লে তাদের নিয়ে পারবেন কি ক'রে? যোগ্যতর লোকের সংখ্যা বাড়াতে হয়, তখন তাদের সহায়তায় অযোগ্যদেরও যোগ্য ক'রে তুলতে পারেন, এবং পারস্পরিকতার ভিতর-দিয়ে প্রত্যেককেই বাড়িয়ে তুলতে পারেন। আবার, উচ্চতর বর্ণে অর্থাৎ enlightened stable বর্ণের মধ্যে যা'তে দীক্ষিতের সংখ্যা বাড়ে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়, নইলে আন্দোলনের গতি ঢিলে হ'য়ে পড়ে। আপনাদের নিজেদের উৎকর্ষের জন্যও শ্রেষ্ঠযাজী হওয়া প্রয়োজন। অনেক-কিছু দিক্ ভেবে চলা লাগে। কেবলই যদি মামুলী লোক দীক্ষিত করতে থাকেন, তাহ'লে আপনাদের এ জিনিস যতই সারী ও সাচ্চা হো'ক না কেন, সমাজে মর্য্যাদাশীল সুপ্রতিষ্ঠিত যারা, তারা এই আওতায় আসতে সঙ্কোচ বোধ করবে। যদিও এটা দুর্ব্বলতা, তাহ'লেও এ দুর্ব্বলতা মানুষের আছে। ফলকথা, এতে মানুষকে বঞ্চিত করা হবে। আর, শুধু কী এই? ধরেন, আজ আপনার মেয়ের বিয়ের জন্য যদি একটা কুলীন সৎসঙ্গী ছেলে খোঁজেন, তা' পাওয়া দুষ্কর, অথচ একটা অদীক্ষিত ছেলের হাতে আপনার মেয়েকে দিতে হয়তো আপনার প্রাণ চায় না, জানেন, মেয়েটা যেভাবে লালিত-পালিত তা'তে বাইরে পড়লে তার কষ্ট হবে। তাই, সমাজের সব স্তরের মধ্যে যদি এটা চারিয়ে দিতে না পারেন, তাহ'লে মুশকিল।
করুণাদা (মুখোপাধ্যায়) সৎসঙ্গের মধ্যে কোথায় কোন্ উপযুক্ত ছেলে আছে, তাও তো আমরা সব সময় খবর পাই না।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তাইতো আমি বলি, বিবাহের উপযুক্ত ছেলে ও মেয়েদের বর্ণ
বংশ, গোত্র, নাম, ধাম, জন্মকুণ্ডলী ইত্যাদি সম্বলিত একটা তালিকা এখানে তৈরী করা ভাল। তা'ছাড়া ভাল-ভাল চাকুরিয়া, ব্যবসাদার, জমিদার, জোদ্দার, কনট্রাক্টর, শিল্পপতি ও বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী ও গুণীলোক যারা আছে, তাদেরও নাম, ধাম, ঠিকানাসহ তালিকা প্রস্তুত করা দরকার। এদের ভিতর-দিয়ে আমরা অনেককে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি ও অনেককে বিশেষ-বিশেষ বিষয়ে শিক্ষিত ক'রে তুলতে পারি, আবার এখানকার জন্য যে-সব মানুষ প্রয়োজন তা'ও পেতে পারি।
এমন সময় প্যারীদা (নন্দী) আসলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যস্ত-সমস্ত হ'য়ে জিজ্ঞাসা করলেন-ছেলেটার জ্বর কেমন রে?
প্যারীদা-আজ অনেক কম।
শ্রীশ্রীঠাকুর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন-যাক, বাঁচলাম। আমার যে কী উৎকণ্ঠায় দিন কাটে।
পরক্ষণে ভগীরথদা (সরকার)-কে জিজ্ঞাসা করলেন-ওষুধের অর্ডার দিছিস নাকি?
ভগীরথদা-দেবো। ব্যস্ততার মধ্যে দিতে পারিনি।
শ্রীশ্রীঠাকুর (রাগত কন্ঠে)-ঐ তো তোদের দোষ। যদি সেটা না করিস, তাহ'লে কিন্তু পরে পস্তাতে হবে। অভ্যাসটাই ভাল না। আজই দিবি। যখনকার যেটা তখনই কাজে গড়িমসি করার
ভগীরথদা-হ্যাঁ, আজ দেব।
শ্রীশ্রীঠাকুর এখনই যা. লিখে ফেল গিয়ে।
প্যারীদার দিকে চেয়ে বললেন তুইও খোঁজ নিবি যা'তে আজ চিঠি যায়। ডাকের আগে আমাকে খবর দিবি যে চিঠি গেছে।
প্যারীদা-আচ্ছা।
শ্রীশ্রীঠাকুর-এইবার একটু সুপুরি দাও।
প্যারীদা সুপুরি দিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসন্ন বদনে সুপুরি চিবোতে-
চিবোতে সবার দিকে চেয়ে-চেয়ে দেখছেন, অধরে প্রাণকাড়া মধুর হাসি, নয়নে স্নেহপ্রীতির অমৃতনির্ঝর। সকলেই আনন্দরসে পরিপ্লুত।
কতকগুলি পায়রা রোদের মধ্যে আনন্দে গলা ফুলিয়ে বকবকম্ বকবকম্ করছে। শ্রীশ্রীঠাকুর কিছু সময় সস্নেহে ঐ দিকে চেয়ে রইলেন।
কলকাতা থেকে একটি ভাই এসেছেন। তিনি তাঁর কবিতার খাতা বের ক'রে বললেন-আমার লেখা কয়েকটা কবিতা প'ড়ে শোনাব?
শ্রীশ্রীঠাকুর-হ্যাঁ, পড়।
ভাইটি পর-পর কয়েকটা কবিতা প'ড়ে শোনালেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর শোনার পর বললেন-বেশ হইছে। আরো লেখার তালে থাক।
ছন্দের দিকে একটু নজর দিও। সাম্য সম্বন্ধে যা' লিখেছ, ওখানে ভাবের মধ্যে কিন্তু একটু গোল আছে। সব একাকার হ'য়ে গেলে কিন্তু সাম্য হয় না। প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা, বৈশিষ্ট্যকে মুছে ফেলে কারও লাভ নেই। আম-গাছকে দিয়ে খেজুর গাছের কাজ পাবে না, খেজুর গাছকে দিয়ে আমগাছের কাজ পাবে না। আম, জাম, খেজুর, তাল-প্রত্যেকটা তাই থেকে যদি আরো ভাল হয়, তা'তেই আমাদের লাভ। কোনটার অভাবে আমাদের কষ্ট পেতে হয় না। মানুষের বেলায়ও ঐ কথা। তাই, কারও বৈশিষ্ট্যকে উড়িয়ে দেওয়া বা নাকচ করা ভাল না। সব সময় লক্ষ্য রাখবে, তুমি যা' লেখ, যা' বল, যা' কর, তা' যেন মানুষের সত্তাপোযণী হয়। ভগবান যে ক্ষমতা দিয়েছেন, তার সদ্ব্যয় করবে। কত প্রতিভাবান লোক আছে, তারা আবোলতাবোল জিনিস পরিবেষণ করে, তা'তে লোকের উপকারের থেকে অপকার বেশী হয়। সেই জন্য যাই কর, ধর্ম, ইষ্ট, কৃষ্টিতে সুনিষ্ঠ হ'য়ে করবে, তবেই তা' সফল হবে। যা' সত্য, শিব, সুন্দর তাই-ই দুনিয়ায় টিকে থাকে। তার পরিবেষণেই প্রতিভা সার্থক হয়। সত্য মানে কিন্তু সত্তাপোযণী, শিব মানে মঙ্গলকর, সুন্দর মানে আদরণীয়। এই তিনের অন্বয়েই শিল্প সার্থক হয়, শুধু শিল্প কেন, সব কিছুই। Cultural conquest (কৃষ্টিগত পরাভব)-এর পাল্লায় প'ড়ে যদি উল্টোকথা চমকপ্রদ ক'রে লেখ, তা'তে সাময়িক বাহবা পেতে পার, কিন্তু ওতে কারও বাস্তবে লাভ নেই। আমি কই-তুমি এমন লেখা লেখ, যা'তে মানুষের প্রাণ স্বস্তি ও তৃপ্তিতে মধু-মধু ক'রে ওঠে।
উক্ত ভাই বললেন-আমি আপনার বইটইগুলি ভাল ক'রে প'ড়ে নেব।
শ্রীশ্রীঠাকুর পড়বে, যতীনদা (দাস) ইত্যাদির সঙ্গে ভাল ক'রে আলাপ-আলোচনা করবে। সব জিনিসটা এমন ক'রে হজম ক'রে ফেলবে, যা'তে যে-কোন। কুট প্রশ্নেরই সমাধান দিতে পার। যজন, যাজন খুব করবে, ওতে মাথা সাফ হ'য়ে যাবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন এখন ক'টা বাজে রে?
হীরালালদা (চক্রবর্ত্তী) সাড়ে আটটা।
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার তোরা মিটিং-এ যাবি না?
অনেকে একযোগে বললেন- হ্যাঁ। তাঁদের মধ্যে অনেকে উঠে পড়লেন।
এমন সময় আশ্রমের মেথর দুলাল এসে বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, 'ঠাকুর-বাবা! হামার ভাল জামাকাপড় নাই। শীতে বড় কষ্ট হ'চ্ছে।'
শ্রীশ্রীঠাকুর ক'টাকা লাগবে?
দুলাল-৫।৬ টাকা।
শ্রীশ্রীঠাকুর সঙোষদার (রায়) দিকে চেয়ে বললেন-দশটা টাকা ওকে দিতে পারবি?
সন্তোষদা বললেন-হ্যাঁ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাহ'লে ওকে দে। দুলালের দিকে চেয়ে বললেন-বেশী টাকা দেওয়া হ'চ্ছে ব'লে মদটদ খাবি না তো?
দুলাল-টাকা হাতে পেলেই তো হামার মদ খেতে ইচ্ছা করে। খাব না, এ-কথা কি ক'রে বলি?
সকলের হাস্য।
শ্রীশ্রীঠাকুর-না, এ টাকা জামাকাপড়ের জন্য খরচ করবি। তোদের যা'-যা' লাগে কিনে নিবি। বুঝিস না, তোরা শীতে কষ্ট পেলে আমারও কষ্ট লাগে? আর, দরকারী জামাকাপড় কেনার পর যদি কিছু বাঁচে, তা' দিয়ে একটু-আধটু মদ খেতে পারিস। আর, যদি বুঝিস, টাকা হাতে পড়লে সব টাকা মদে উড়িয়ে দিবি, তাহ'লে নিস না। ও বাজার থেকে জিনিস কিনে এনে দিক।
দুলাল-না বাবা! ওনার যেতে হবে না। আমি আগে ভাল-ভাল জামাকাপড় কিনব। তারপর যদি বাঁচে তখন শীতের দিনে একটু খাব।
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন-তাই ভাল ওসব মাল বেশী কখনও খাবিনা।
দুলাল টাকা নিয়ে চ'লে গেলে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-ওকে যদি মদ খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিতে বলা হয়, তাহ'লে এখন পারবেও না, বরং মুষড়ে পড়বে। তাই গীতায় আছে, 'ন বুদ্ধিভেদং জনয়েৎ'। প্রত্যেকটা মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করার একটা বিশিষ্ট রীতি আছে।
একটি দাদা বললেন-আমার একটু প্রাইভেট আছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অন্য সবাইকে স'রে যেতে বললেন। দাদাটি তাঁর কতকগুলি দুষ্কর্মের কথা বললেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সব কথা শুনে অভয় দিয়ে বললেন-আর অমন কাম করিস না, আর একটা শিশু চান্দ্রায়ণ ক'রে ফেলিস। কেষ্টদার কাছে সব শুনে নিস।
উক্ত দাদা বারবার মনে অনুতাপ আসে, সঙ্কল্পও করি, কিন্তু কাৰ্য্যকালে ঠিক থাকে না।
শ্রীশ্রীঠাকুর (রূঢ় কণ্ঠে) ও অনুতাপও নয়, সঙ্কল্পও নয়, ও একরকমের ন্যাকামী। সত্যিকার অনুতপ্ত হ'লে কি মানুষ এক ভুল বারবার করে? মানুষ যেমন ইচ্ছা ক'রে ভুল পথে পা দেয়, তেমনি ইচ্ছাশক্তির বলেই তা' থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এখনও বুঝতে পারছ না যে নিজের কতখানি সর্বনাশ করছ, তা' বুঝলে ও-পথ আর মাড়াতে না। নিজ মুখে যাকে ঘৃণ্য ব'লে বলছিস, তাই-ই আবার আঁকড়ে ধ'রে আছিস, এটা কি সত্যিই তোর ব্যক্তিত্বের পক্ষে অমর্য্যাদাকর নয়? ঐ সব আত্মত্মপ্রবঞ্চনা ছেড়ে দে, সোজা হ'য়ে দাঁড়া। মানুষের মতো চল। যদি সত্যিই অনুতাপ এসে থাকে, যা' বললাম তাই কর্। আর, যদি মনে-মনে ধারণা থাকে, যা' অন্যায় করেছি, তার জন্য এখানকার মতো একবার প্রায়শ্চিত্ত করি, পরে আবার যদি অন্যায় করি প্রায়শ্চিত্ত ক'রে শুদ্ধ হব, তাহ'লে অমন প্রায়শ্চিত্ত না করা ভাল। প্রায়শ্চিত্তের মধ্যে কোন 'যদি' থাকবে না। অমনতর অকাম আর করবই না-এই হ'লো সোজা কথা। মনে যদি অতোখানি রোখ থাকে, তবে লেগে যা।
দাদাটি বিনীত কণ্ঠে বললেন-আপনি দয়া করবেন, আর যেন আমার এমন দুর্বুদ্ধি না হয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর (দরদের সঙ্গে)- পরমপিতার দয়া অছেই। দুর্ব্বলতার প্রতি মমতাসম্পন্ন হোস না, তাকে পুষে রাখিস না, নির্মমভাবে তাকে পরিহার ক'রে চলিস, তাহ'লে ভাবনা নেই। দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলে মানুষের মনের জোর ক'মে যায়, তার চরিত্রে কোন জেল্লা থাকে না। নিজেই তো বুঝিস, কিসে কী হয়, তবু কেন বেকুবের মতো চলিস? তোদের এমনতর ঢিলে রকমে চলতে দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়। আমি কতো আশা ক'রে ব'সে আছি, তোরা পবিত্র হ'বি, মানুষের মতো মানুষ হ'বি, তোদের আওতায় এসে কতো মানুষ সৎ হ'য়ে যাবে। তোরা কী আমার সেই আশা ও কল্পনাকে ভেস্তে দিবি?
এইবার দাদাটি হাউ-হাউ ক'রে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন-না ঠাকুর! আপনার যা'তে কষ্ট হয়, তা' আমি কিছুতেই করব না, আর কখনও করব না। আমি প্রায়শ্চিত্ত ক'রে শুদ্ধ হব। আশীর্ব্বাদ করুন, আমি যেন আপনার মনোমতো হ'য়ে চলতে পারি।
শ্রীশ্রীঠাকুর করুণাস্নিগ্ধ দৃষ্টিতে দাদাটির দিকে চেয়ে রইলেন, পরে বললেন -যা, কেষ্টদার কাছে সব বল্ গিয়ে।
দাদাটি প্রণাম ক'রে ধীরে-ধীরে উঠে গেলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর তরুমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন-এর মধ্যে বেরোইছিস যে? তোর শরীর ঠিক হইছে?
তরুমা-এখনও সন্দি আছে, গা'টাও ব্যথা আছে, আপনাকে না দেখলে ভাল লাগে না, তাই একবার আসলাম।
শ্রীশ্রীঠাকুর-জ্বরটর নেই তো?
তরুমা-আছে অল্প।
শ্রীশ্রীঠাকুর-অল্প কত?
তরুমা-৯৯।
শ্রীশ্রীঠাকুর-যা-যা! পালা এখান থেকে! ঘরে চ'লে যা! জ্বর নিয়ে ঘোরাফেরা করিস না। ওষুধ-টষুধ ঠিকমতো খাতিছিস তো?
তরুমা-হ্যাঁ।......... অসুখে প'ড়ে থাকলে নিজেকে যেন অপরাধী মনে হয়, আপনার কাজকর্ম কিছু করতে পারি না।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ঐ রকম মনে হওয়াই তো ভাল। তা'তে খুঁজেপেতে বের করবি, কেমন ক'রে তাড়াতাড়ি সুস্থ হ'য়ে উঠতি পারিস, আর ভবিষ্যতেও অসুস্থ হ'য়ে না পড়িস।
ধীরে-ধীরে লোকজন জড় হ'তে লাগলেন।
কলকাতা থেকে মদনদা (দাস) একটা ভাল ক্যালেন্ডার নিয়ে এসেছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর দেখে খুশি হ'য়ে বললেন-বা। বেশ তো! তোর পছন্দই আলাদা। যা, ক্যালেন্ডারটা মণিকে দে।
মণিদা (ছোড়দা) তখন ঘরে ছিলেন না।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-তোর কাছে রেখে দে। পরে মণির হাতেই দিস।
শ্রীশ্রীঠাকুর আসামের সতীশদার (চৌধুরী) কাছে হাতী ধরার গল্প শুনছিলেন। এমন সময় নদীয়ার দুজন কংগ্রেসকর্মী আসলেন। একখানা বেঞ্চ এনে দেওয়া হ'লো। প্রণাম ক'রে তাঁরা ঐ বেঞ্চে বসলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর-আপনারা কখন আইছেন?
একজন উত্তর করলেন-আমরা কাল এসেছি পাবনায়। সেখান থেকে এলাম। আপনার নাম শুনেছি, কিন্তু সাক্ষাৎলাভের সুযোগ হয়নি, তাই আসলাম।
শ্রীশ্রীঠাকুর-যাক, আইছেন, তাই দেখা হ'য়ে গেল, খুব ভাল হ'লো। এখানে থাকলি যে আরো স্ফূর্ত্তি হ'তো।
উক্ত ভদ্রলোক আমরা কংগ্রেসের কাজ উপলক্ষে এসেছি, ওখানেই আমাদের থাকা দরকার।
শ্রীশ্রীঠাকুর তা' বেশ। ফুরসুতমতো যখন পারেন আসেন যেন।
চেষ্টা করব।............... আমাদের কয়েকটা প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
-বলেন।
-রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ না ক'রে আমরা দেশের উন্নতির জন্য যাই করতে যাই না কেন, তা' কি ফলপ্রসূ হ'তে পারে? পরাধীন, জাতির প্রথম প্রচেষ্টাই তো হওয়া উচিত পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া।
-পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়াই তো চাই।
-কিন্তু তাহ'লে আপনারা ধর্ম-আন্দোলন নিয়ে আছেন কেন?
-আমারও তো মনে প্রশ্ন জাগে ধর্ম-আন্দোলন বাদ দিয়ে পরাধীনতার নিরসন আদৌ হ'তে পারে কিনা। এই কথাটা কি ভেবে দেখেছেন, আমরা পরাধীন হলাম কেন ও কী ক'রে?
--সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্রান্তে।
-সে চক্রান্ত যদি থেকেই থাকে, তা' আমাদের উপর কার্য্যকরী হ'লো কেন? আমরা তা' এড়াতে পারলাম না কেন?
-আমাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল।
-ঐক্যের অভাব হ'লো কেন?
-প্রত্যেকে স্বার্থপর ও স্ব-স্ব প্রধান হ'য়ে উঠেছিল।
--তা' হ'লো কেন?
-এটা জাতীয় চরিত্রের দুর্ব্বলতা।
-তাহ'লে তো আপনি নিজেই বলছেন, জাতীয় চরিত্রের দুর্ব্বলতাই আমাদের পরাধীনতার কারণ। এখন সেই কারণের যদি নিরাকরণ না করেন, তাহ'লে কি রোগ সারবে? এইখানেই প্রয়োজন ধর্মের, আদর্শের, কৃষ্টির। মানুষের দুর্বলতা মানে প্রবৃত্তিমুখিনতা। প্রবৃত্তিমুখিনতা থেকে মানুষ রেহাই পেতে পারে না, যদি সে ইষ্ট ও কৃষ্টিমুখী না হয়। এই জন্যই আছে আচার্য্যের কাছ থেকে দীক্ষাগ্রহণ ক'রে, তা' অনুসরণ ও অনুশীলন ক'রে চলার পদ্ধতি। আচার্য্য মানে, যিনি আচরণ ক'রে জীবনবৃদ্ধির বিধিকে নিজের জীবনে জেনেছেন, মূর্ত্ত ক'রে তুলেছেন। ধর্ম মানে, যে-অনুশীলনের ভিতর-দিয়ে বাঁচা-বাড়া অবাধ হ'য়ে চলতে থাকে-ধারণে, পোষণে। আর, ঐ আচার্য্যানুরাগ ও আচার্য্যানুসরণই ধর্মের মেরুদণ্ড। তিনি প্রত্যেককে তার বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী পরিচালনা করেন, তাই প্রত্যেকেই পরিপুরিত হয় তাঁকে দিয়ে। এমন একজনকে কেন্দ্র ক'রেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ হ'য়ে ওঠে, তখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রীতি ও সহযোগিতা সহজ হ'য়ে ওঠে, পরস্পর পরস্পরের স্বার্থে স্বার্থান্বিত হয়, পরস্পর পরস্পরের সেবা করে, এর ভিতর-দিয়েই জাতি সবল, সংহত ও ঐশ্বর্যা-শালী হ'য়ে ওঠে। এই হ'লো ধর্মের রূপ। এমনতর যারা তাদের আর পরাধীন বা পরমুখাপেক্ষী থাকতে হয় না। বাঁচা-বাড়ার জন্য যা' প্রয়োজন, (৩য়-২) তা' তখন তারা নিজেরাই সরবরাহ করতে পারে, সৃষ্টি করতে পারে। বাইরের আগন্তুক শক্তির তখন কোন উপযোগিতা থাকে না, তাই তারা খ'সে পড়তে বাধ্য হয়। তাই আমার মনে হয়, এই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে যদি আমরা না চলি, সংগঠিত ও সংস্কৃত না হই, তবে যতই হুজুগ করি না কেন, তা'তে আমাদের সত্যিকার লাভ কিছু হবে না। ইংরেজদের দোষ না দিয়ে আমাদের চিন্তা ক'রে দেখা ভাল, তাদের কী গুণের দরুন তারা আমাদের উপর প্রভুত্ব করতে পারছে, আর আমাদের কী দোষের দরুন এত বড় একটা বিরাট দেশ এমনতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
সুধীরদাকে (দাস) দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন-কাজের কতদূর রে?
সুধীরদা-হ'চ্ছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তাড়াতাড়ি সেরে ফেল্!
সুধীরদা সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক চাইলেন।
হরিপদদা (সাহা) তামাক সেজে দিলেন।
ভদ্রলোকটি বললেন-রাজনীতির মধ্যেও তো নেতাকে মান্য করা আছে। নেতার প্রভাবেও তো জাতি অনেকখানি গঠিত হয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর-যিনিই নেতা হউন না কেন-দেখতে হবে, তিনি কারও দ্বারা নীত কিনা। কোন নীতির দ্বারা নীত হ'লে চলবে না, কোন মানুষের দ্বারা নীত হওয়া চাই, যার মধ্যে ঐ নীতি মূর্ত্ত। ফলকথা, জীবন্ত আদর্শানুসরণ ছাড়া মানুষের প্রবৃত্তিগুলি সুনিয়ন্ত্রিত হয় না। যে নিজে সুনিয়ন্ত্রিত নয়, সে অন্যকে নিয়ন্ত্রিত করবে কি ক'রে? বিপুল পারিপার্শ্বিকের মধ্যে প'ড়ে সে' নিজেও বিধ্বস্ত হ'য়ে উঠবে, অন্যকেও বিধ্বস্ত ক'রে তুলবে। যে নিজে একায়িত হয়নি, সে দশকে ঐক্যবদ্ধ ক'রে তুলবে কি ক'রে? তখন দেখা যাবে, দলে-দলে নেতায়-নেতায় কোন্দলই বেড়ে উঠবে। তাই, আদর্শনীতিকে বাদ দিয়ে নেতৃত্ব বা রাজনীতি কখনও সার্থক হ'তে পারে না। প্রকৃত আদর্শ'পরায়ণ নেতা যিনি তাঁর ঝোঁকই হয়, মানুষের অন্তরে আদর্শের প্রতিষ্ঠা করে, পোষণে, পুরণে, সেবায় নিরন্তর তাকে বাঁচা-বাড়ার পথে সমুন্নত ক'রে তোলা। ওই-ই হয় তাঁর ধান্ধা, তাঁর নেশা, তাঁর স্বার্থ। তাই আমি বলি, রাজনীতির মূল হ'লো সম্পনীতি।
ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন-ধর্ম্মের অবতারণা করতে গেলে তো বিভেদ আরো বেড়ে যাবে? সম্প্রদায়, আদর্শ, গুরু ও ধর্মমতের কি অন্ত আছে?
শ্রীশ্রীঠাকুর, ধর্ম মানে বাঁচা-বাড়ার নীতি। এই নীতি বিভিন্ন অবতার মহাপুরুষদের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কিন্তু কোন বিরোধ নেই। তাই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের কোন কারণ নাই, কারণ, সবই একপন্থী।
বর্তমানে এমন যদি কোন আদর্শ থাকেন, যাঁর মধ্যে সবারই বৈশিষ্ট্যসম্মত পরিপুরণ আছে, তাহ'লে তাঁর ছত্রছায়াতলেই সবাই মিলিত হ'তে পারেন-স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে।
কংগ্রেসী দাদা হেসে বললেন-এর মধ্যে একটা বিরাট 'যদি' রয়ে গেছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর (সোজা হ'য়ে র'সে হাতে একটা তুড়ি মেরে সমস্যাটাকে হালকা ক'রে দিয়ে বললেন)- অমনতর আদর্শ-পুরুষ পরমপিতারই অবদান। পরমপিতা কখনই তাঁর অবদানে কার্পণ্য করেন না, এখন আমরা তাঁকে বিমুখ না করলেই হয়।
দাদাটি বললেন-আমি ভগবদ্বিশ্বাসী, আমিও বিশ্বাস করি, ভগবানের দয়ায় অসম্ভব সম্ভব হ'তে পারে। ধর্ম্মের যেমনতর ব্যাখ্যা আপনি দিলেন, ঐ যদি ধৰ্ম্ম' হয়, তবে সে ধর্ম্মে' কা'রও আপত্তি থাকতে পারে না।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তবে ভগবানের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকলে হবে না। হনুমানের মতো খাটা লাগবে তাঁর জন্য। ভক্তি মানুষকে পঙ্গু করে না, পঙ্গুকে গিরিলঙ্ঘন করিয়ে ছাড়ে।
কংগ্রেসী দাদা--আপনার অমূল্য উপদেশে অত্যন্ত উপকৃত হলাম। সুযোগ পেলে আবার আসব। এখন উঠতে হবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর--যতবার সুযোগ পান, ততবারই আসবেন। ওঁকেও নিয়ে আসবেন। আমার লোভ বড় বেশী, অল্পেতে আশ মেটে না। কেউ এসে তাড়াতাড়ি চ'লে গেলি মনে হয় খালাম বটে, ক্ষিদে মিটলো না। খাই-খাই ভাব লেগে থাকে।
দুজনেই শ্রীশ্রীঠাকুরের কথায় অভিভূত হ'য়ে পড়লেন। শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম ক'রে বিদায় নিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরও ২।১ মিনিট পরে ওখান থেকে উঠে পড়লেন। সঙ্গে বহুলোক।
রাস্তায় একটা ফড়িংকে ডানাভাঙ্গা অবস্থায় দেখে অস্থির হ'য়ে ব'লে উঠলেন -কে মাড়ায়ে চ'লে গেছে রে! এটাকে ডিস্পেন্সারীতে নিয়ে যা তো। বাঁচায়ে তোলা চাই।
রমেশদা (দত্ত) তাড়াতাড়ি ওটাকে নিয়ে গেলেন ডিস্পেন্সারীতে। শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_তৃতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10