শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 12
॥ বারো ॥
সেদিন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের প্রথম দিক। তখন প্রচণ্ড গ্রীষ্ম-মরশুমের প্রারম্ভিক কাল। দেওঘরে গ্রীষ্মের উষ্ণতা একটু বেশিই। ঠাকুর শীত কাতুরে মানুষ, আবার গ্রীষ্মের দাবদাহেও ক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। যত তাপ বাড়তে থাকে, চতুর্দিকে উষ্ণ বায়ু-জনিত ঘূর্ণিঝড়-জাতীয় বাত্যাবিক্ষোভ বাড়তে থাকে। ধুলো আর শুকনো ঝরা পাতার আবর্ত পথ-চলতি মানুষের ক্লেশের কারণ হতে থাকে। গ্রাম-বাংলার চলতি ভাষায় একে বলে ঝাঁএল। ঝাঁএলের যন্ত্রণা পথিককে বেশ বিড়ম্বনা দেয়। বায়ু যত তপ্ত হতে থাকে, ঝাঁএলের উৎপাত তত বাড়তে থাকে।
এই রকম এক চৈত্রের শেষাংশে এক সকালে ঠাকুর বসে আছেন বাড়ল বাংলোর বারান্দায়। বসে চারিদিককার ব্যথিত প্রকৃতি জগৎকে প্রত্যক্ষ করছেন। ক্লিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশও তাঁর মনে বিষাদ সৃষ্টি করে, তিনি প্রকৃতির ক্লেশও নিজের স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে উপলব্ধি করে ক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। প্রকৃতি-জগতের সুখদুঃখও তাঁর বোধজগতে পরিবর্তন আনে। প্রকৃতির সকল আলোড়নই তাঁর অনুভূতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ, তাঁর অন্তর্দেশ বহির্জগতের সঙ্গে একাত্ম। আবার তিনি প্রাকৃত জগতের এই নির্মম উত্তালতাকে প্রকৃতির বিধান বলে মেনে নিয়ে তার ক্রিয়ার বৈচিত্র্যকে উপভোগও করে থাকেন। সে দিনকার ঝাঁএল তাড়িত এই প্রাকৃতিক মত্ততার দিনেও তিনি বেশ শান্তচিত্তে বাইরের এই বাত্যা-বিক্ষোভকে মেনে নিয়ে সব-কিছুকে উপভোগ করছেন। বিক্ষুব্ধ বহির্জগৎও তাঁর ক্লেশের কারণ হচ্ছে না, তিনি বরং তার বিধানবশ্যতা দেখে খুশিই হচ্ছেন- ভাবটা এই রকম। প্রকৃতির যে উন্মাদনা আমাদের কাছে উদ্বেজনার কারণ, তাই মনে হয় তাঁর চিত্তকে হ্লাদিত করে তুলছে। সবাই বিধান মেনে চলছে- এই ভাবনা তাঁকে উল্লসিত করছে। হ্লাদিত ঠাকুরকে ঘিরে বেশ-কিছু ভক্ত তাঁর এই সাম্যের মানসিকতাকে উপলব্ধি করে আনন্দিত হচ্ছে।
কথাপ্রসঙ্গে সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যের কথা উঠলো। ঋত্বিগাচার্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বললেন, মহাকবি কালিদাসের কাব্যগ্রন্থগুলি রীতিমতো আর্য-ভারতের ঋষি-কথিত জীবনবৃদ্ধির ভাবধারাকেই পরিবেশন করেছে।
কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যগ্রন্থ তো সুবিবাহ এবং সুপ্রজননের দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যেই লিখিত। কুমারসম্ভব বৈজ্ঞানিক সুবিবাহ পদ্ধতির এক কাব্যিক দলিল।
এ-সব ঠাকুরের জানা। তাই, তিনি বললেন, ওঁদের কাব্যসৃষ্টি শুভপ্রসূ। জনগণের মধ্যে সামাজিক কল্যাণবুদ্ধির প্রচার ঘটানোর জন্যেই ওঁদের লেখনী ধারণ। কারণ, সাহিত্য সমাজের বাইরে নয়, সাহিত্য সমাজের জন্যই। সাহিত্য তো সু-এর প্রসবিনী।
কেউ কেউ বলেন, সাহিত্য কোন তত্ত্বের প্রচার করে না- সাহিত্য আনন্দদায়ক এক রসসৃষ্টি মাত্র। তাঁরা বলেন, সাহিত্য শুধুমাত্র একটি কলা। আর কলার সৃষ্টি কলার রম্যতা ভোগের জন্যই। কোন-কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে কলাকার কলা সৃষ্টি করেন না।
ঠাকুর এই ধারণার বশবর্তী নন। তিনি বলেন, সমাজের কাছে মঙ্গলকর না হলে কোন কলাই কলা নয়। মানুষের সকল অবদানই মানুষের জন্যে।
কথাপ্রসঙ্গে সংস্কৃত ভাষাশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও এসে পড়লো। সংস্কৃত ভাষা না শিখলে এবং সংস্কৃত সাহিত্যসম্ভার পড়ে বুঝতে না পারলে আর্য ভারতের জীবনবৃদ্ধিকর ভাবরাজি সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না।
ঠাকুর এই চিন্তার সমর্থনে আরও বললেন, সংস্কৃত বেশ ভালো করে শেখা লাগে। পরস্পরের কথাবার্তাও সংস্কৃত ভাষায় হওয়া চাই । তবেই কাজের কাজটি হবে।
একদিন স্বস্ত্যর্ঘ্য ঋত্বিক, সুশীল বসু মশাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছে। নিঃশেষে আত্মবলিদান সম্পর্কে কথা তুলছেন বসু মশাই।
সেই প্রসঙ্গে ঠাকুর বললেন, 'দেখুন সুশীলদা, আপনার সত্তার সৃষ্টিকর্তা কিন্তু আপনি নন। তাই, আপনি আপনার জীবনের মালিক নন। বাহাদুরি দেখাবার জন্যে অথবা শহীদ হয়ে অমরত্ব অর্জনে এই জীবন খরচ করার অধিকার কারও নেই। বরং আপন সত্তাকে উদ্বর্ধনের পথে এমন যত্নে পরিচর্যা দিয়ে সুস্থ ও সবল রাখতে হবে যাতে এই দেহ ও মন দিয়ে অন্যকে সেবাযত্নে তুষ্ট ও পুষ্ট করে তাদের ক্রমবর্ধনশীল জীবনের পথে পরিচালিত করা যায়। এইটাই বিধির বিধি।
এক সময়ে ব্রজেন চট্টোপাধ্যায় মশাই কথা বলতে বলতে 'নন-সৎসঙ্গী' শব্দটা ব্যবহার করলেন। 'নন-সৎসঙ্গী' কথার দ্বারা সৎসঙ্গে সমাগত নন, এমন ব্যক্তিকেই বোঝানো হয়েছে। এই প্রচলিত শব্দটায় ঠাকুর আপত্তি জানালেন। বললেন, 'ঐ শব্দটা ঠিক নয়। সৎসঙ্গ মানে তো অস্তি ও বৃদ্ধির পথে চলার সঙ্গ। কোন মানুষ কি নিজের অস্তি ও বৃদ্ধির শত্রু? না, সবাই বাঁচা-বাড়ার পথে চলতে চায় আপন গরজে। সেই হিসাবে সৎসঙ্গ বিরোধীও নয় ননসৎসঙ্গীও নয়-জীবনের পথ ধরে সবাই চলতে চায়। কখনো কখনো হয়তো প্রতিকূল চাপে সেই পথে তার চলা হয়ে ওঠে না, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যেক মানুষই জীবন পথের পথিক- অর্থাৎ সৎসঙ্গী।
একবার দিনলিপিকার প্রফুল্লকুমার দাস-মশাই জিজ্ঞেস করলেন, 'ঠাকুর, আপনি যা বলেন, তা আমরা করতে চাই- চেষ্টাও সাধ্যমতো করি, কিন্তু যে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করলে আপনি খুশি হতে পারেন বা আপনার কাজের সুবিধা হয়, ততখানি গতি ও সুন্দরতাসহ তা সম্পন্ন করতে পারি না- কিছু-না-কিছু খাকতি থেকেই যায়। আপনার ঠিক মনের মতো কর্মী আর হয়ে ওঠা হয় না।'
উত্তরে ঠাকুর বললেন, হ্যাঁ, ঐ রকম কথা বাইবেলেও আছে। বলেছে, 'তোমার কাজ করতে তো অন্তরাত্মা রাজি, কিন্তু দেহ দুর্বল- সে পেরে ওঠে না।' 'আমার তাই মনে হয়। তবে মনপ্রাণ নিয়ে লেগে থাকলে কাম কিছু হয়ই। ইষ্টনিষ্ঠায় অনড় হয়ে লেগে থাকাটাই সাফল্যের আসল চাবিকাঠি।'
একবার নির্মলবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আজকাল অধিকাংশ মানুষই ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটি ধরে উঠতে পারে না। তাই, তারা ধর্ম ছাড়াই রাজনীতি করেথাকে।'
ঠাকুর বললেন, 'সেই সব রাজনীতিবিদরা ধর্মের সঠিক মানেই বোঝে না। ধর্মের তত্ত্বটা না বুঝলে ধর্ম থেকে দূরে থাকার ঐ মানসিকতা আসবেই। আমার চোখে তো এমন কোন বিষয়বস্তু পড়েই না যা মানুষের পক্ষে জীবনীয় অথচ ধর্মের মধ্যে পড়ে না। আমি তো দেখি ধর্মসম্মত সব ব্যবস্থাই ব্যষ্টি মানুষ ও সমষ্টিগত মানুষের পক্ষে অতি আবশ্যিক এবং বিশেষ কল্যাণকর।'
আরও বলেছেন, 'ধর্ম মানেটা কী? ধর্ম মানে- তেমন বলা, তেমন করা, তেমন ভাবা, যাতে পরিবেশকে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকতে পারি এবং বেড়ে উঠতে পারি। ধর্ম-শব্দের মধ্যে শুধু ধরে থাকার কথাই নেই- বেড়ে ওঠার কথাও আছে। এটা তো ঠিক যে, শুধু থাকাটা অনেকটাই অবান্তর। কারণ, অস্তিত্ব স্থবির হতেই পারে না। বেঁচে থাকার ভিতরে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আছেই। মৃত হয়ে বেঁচে থাকা যায় না। মানুষের 'মমি' আর জীবন্ত মানুষটা এক নয়।'✅
10