শ্রীশ্রীঠাকুরকে যেমন দেখেছি P - 11
॥ এগারো ॥
সেদিন হলো ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ৮ই চৈত্র রবিবার। দুপুরের আহারান্তে ঠাকুর বড়াল বাংলোর একটি ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করছেন। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েননি, চারদিকে নারী-পুরুষ সঙ্গলোভী লোকজন উপবিষ্ট। এটা-সেটা ঘর-গৃহস্থালির কথাবার্তার পর বর্তমান পুরুষোত্তমের প্রচার-কৌশল সম্পর্কে বললেন, বর্তমানের বার্তা জনসমাজে পৌঁছে দিতে পূর্বতনদের বাগব্যবহারের কথাও পরিবেশন করতে হয়। কারণ, একই দ্রষ্টা-পুরুষই যুগে-যুগে আবির্ভূত হয়ে এক বার্তাই তো উপহার দিয়ে থাকেন। পূর্ববর্তীদের কার্যকলাপ ও কথাবার্তাকে বাদ দিয়ে বর্তমান দ্রষ্টা-পুরুষের কথা বলা যায় না- তা করতে গেলে কাজও ভালো হয় না। ধরো, এ-যুগের দ্রষ্টা-পুরুষের সম্বন্ধে তুমি মানুষকে বোঝাতে চাও- তাঁকে সুষ্ঠুভাবে পরিবেশন করতে চাও। তোমাকে তা হলে তাঁর পূর্ববর্তী মহাপুরুষগণের জীবন-চরিত থেকে তথ্য পরিবেশন করে সমরসের পরিবেশ সৃষ্টি করতেই হবে। যে রকম মানুষের প্রচার করতে চাও, সেই রকম আর একটি পূর্ববর্তী মানুষের বাগাচরণের উল্লেখ করতে হয়। এতে তোমার বর্তমান প্রচার্য মহাপুরুষের কথা পরিবেশন করার পশ্চাদভূমি তৈরি হয়। এই ভাবে ইষ্ট-পরিবেশনের জমি তৈরি করতে হয়। তুল্য পুরুষদের কথা বাদ দিয়ে খাপছাড়া ভাবে খপ্ করে তোমার ইষ্টদেবের কথা বলতে গেলে মানুষ সে-কথায় আগ্রহান্বিত হয় না। সমান সমান উদাহরণ দিতে হয়।
আবার যার ধারণায় যে-ভাবে বললে বোঝা সহজ হয়, তাকে সেই ভাবে বোঝাতে হয়। সেই জন্যে সমান-সমান অন্য মহাপুরুষদের জীবনচরিত থেকে সাহায্য নিতে হয়। যেমন ধরো, শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, যীশুখৃষ্ট, হজরত মহম্মদ (দাঃ), চৈতন্যদেব, শ্রীরামকৃষ্ণ- এঁদের জীবন ও বাণীর মধ্যে একটা মিল বা একতানতা আছে। ঐ সব থেকে আলোচনা করতে হয়। তবে, বর্তমান মহাপুরুষকে মানুষ সহজে ধরতে পারে। তুলনামূলক আলোচনা যাজনের পক্ষে কত সহায়ক, সেই কথাই বলতে চেয়েছেন ঠাকুর। তিনিতো নিজে তাঁর অব্যবহিত পূর্ববর্তী লোকগুরু শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে হামেশাই বলতেন। তাঁকে বলেছেন- স্বয়ং ভগবান। এই ভাবে পূর্ববর্তীর প্রতিষ্ঠা করতেন মনপ্রাণ দিয়ে। তাতে মানুষ বর্তমান সম্বন্ধে অর্থাৎ তাঁর সম্বন্ধে বুঝে ওঠার পথ পেতো। কোন মহাপুরুষ সম্বন্ধে মানুষকে বোঝাতে হলে তাঁর সমতুল্য অন্যান্য মহাপুরুষদের কথা বললে, তাঁর কথা পরিবেশন সহজ হয়।
খবরের কাগজে পাকিস্তানের স্রষ্টা কায়েদে আজম জিন্নার একটি বিবৃতি বেরিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- 'আমরা এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের জান-মাল ভারতের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা পাবে।....'
খবর শুনে ঠাকুর একটু হেসে বললেন, 'শুনতে তো বেশ ভালোই লাগছে, কিন্তু সেখানকার রাজ-কর্মচারীদের এ কথা মনে থাকলেই ভালো।'
একদিন কথা উঠলো বাঁচার সার্থকতা নিয়ে। এক ভক্ত প্রশ্ন করেছেন, পৃথিবীতে এত লোক, আমার মতো একজন সামান্য লোকের বাঁচায় লাভ কী? আমি থাকলেও যা, না থাকলেও তাই- পৃথিবী একরকমই থাকবে।
ঠাকুর বললেন, 'বাঁচাটা হলো প্রিয়পরমের জন্যে- প্রিয়পরমের স্বার্থে। বাঁচাটা যখন কারও জন্যে হয়, তখন তা অর্থান্বিত। বাঁচাটা তখন নিরর্থক নয়।'
আরও বললেন, 'বাঁচা তো প্রিয়তমের জন্যে, তাঁর কাজের জন্যে। ভালোবাসাই মানুষকে বাঁচতে বলে- ভালোবাসাই মৃত্যুর মুখ থেকে কেড়ে এনে মানুষকে আরও করে বাঁচতে শেখায়। বেঁচে থেকে ইষ্টকর্ম করাই আসল বেঁচে থাকা। যিনি জীবন দিয়েছেন, জীবনটা তাঁর কর্মে উৎসর্গ করার মধ্যেই তার সার্থকতা। এ ছাড়া অন্য অর্থে জীবনযাত্রা করা মানে পরমায়ুর অপব্যয় করা।'
'প্রায় সব মহাপুরুষের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁদের জীবন যেন বিষাদময়।' কথা তুললেন ঋত্বিগাচার্য কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য।
'দেখুন, মহাপুরুষরা তো নিজেদের প্রতি নির্মম। তাঁরা তো অন্য সকলের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতেই আসেন- নিজের দিকে চাইবার সময় নেই, মানসিকতাও নেই। আর, শিষ্যরা তাঁর দিকে প্রাণঢালা প্রেম এবং সেবাযত্ন না দিতে পারলে- তাঁর ইচ্ছাপূরণে সর্বসাধ্য নিয়োগ করতে না পারলে তিনি অতৃপ্তই থেকে যান। তাঁদের মনের বিষাদ জন্মায় এই ভাবেই। তা দূর হয় একমাত্র শিষ্যগণের সর্বাত্মক গুরুপ্রাণতায়। শিষ্যদের মধ্যে গুরু প্রেমের অভাব হলে তিনি তো তাদের মানুষ করে তোলার সুযোগ পান না। সেটাই তো তাঁদের দুঃখ। গুরুকে জান-মাল কোরবানি দিয়ে শিষ্যরা যদি অনুসরণ করতে পারে, তবেই তাঁর আনন্দ হয়- অন্তরটা সাফল্যের অনুভূতিতে ডগমগ করে ওঠে। নচেৎ, অবতার মহাপুরুষরা কখনো নিজের দিকে তাকান না। তাঁরা দিতে এসেছেন, দিয়েই চলে যান।'
এই কথাবার্তা মিটলে এক শিষ্য তার অভাব-অভিযোগের কথা জানিয়ে তা থেকে মুক্তির আবেদন জানালো।
উত্তরে ঠাকুর বললেন, 'আরে বাবা, পয়সা কি পয়সা দেয়? পয়সা দেয় মানুষ। বাঁচার জন্যে যা-যা লাগে তা মানুষই দিয়ে থাকে। তাই পয়সা উপার্জনের জন্যে দৌড়াদৌড়ি না করে মানুষ উপার্জনের চেষ্টা করা লাগে। মানুষকে ভালোবেসে মানুষকে সেবা দিয়ে তুষ্ট করে তাকে আপন করে নাও। দেখবে, সেও তোমার অভাব মেটাতে তোমাকে পুষ্ট ও তুষ্ট করতে উদ্যমী হয়ে উঠবে।
একদিনের ভক্ত সমাবেশে উপস্থিত আছেন হিন্দু মহাসভার প্রবক্তা নির্মল চট্টোপাধ্যায় মশাই। তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, 'দাদা, মানুষকে জাগাতে হবে। • পত্রিকা চালিয়ে, বই লিখে, সাংস্কৃতিক কাজ কর্ম করে মানুষের মধ্যে ইষ্টের কথা প্রচার করা চাই। আপনারা যা সত্য বলে বুঝেছেন, তা মানুষের মধ্যে চারিয়ে দিতে হবে। সত্যকে গুপ্তধন করে রাখলে হবে না, তা সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে। সবাইকে আদর্শের দিকে আকর্ষণ করতে হবে। দেশের ভিতরে এইভাবে নতুন জীবনধারার স্রোত বইয়ে দিতে হবে। দেখবেন, তবেই একটা নতুন জাতি জেগে উঠবে। সমস্যার সমাধান, তখনই হবে। সংগঠন বলতে আমি তো এই বুঝি।'
'তাই, মোদ্দা কথা হলো, যেমন শ্রদ্ধা করার মতো মানুষ চাই, তেমনি অন্য দিকে আবার সেই শ্রদ্ধেয় মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ব্যবস্থাও চাই। শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে তাঁর ইচ্ছাপূরণে যদি মানুষ কর্মতৎপর হয়ে ওঠে, তবেই একটা জাতি বড় হয়। আবার ব্যষ্টির সমুত্থানও ঘটে এই পদ্ধতিতেই। অন্য রাস্তায় ব্যষ্টি বা সমষ্টির কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা নেই।'
গুরুদাস বন্দোপাধ্যায় ঠাকুরের একজন বিশিষ্ট শিষ্য। তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্যে আর এক ভক্ত হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বড় ইচ্ছা। মুখুজ্জেমশাই সেকথা ঠাকুরকে জানালেন। শুনে ঠাকুর বললেন, 'ঋত্বিকদের বিয়ের ব্যাপারে আমার তো একটা কথা বলাই আছে- তাদের ঋত্বিকী পূরণ হলে তবেই করা ঠিক। এই ধরুন, গুরুদাসের কথাই- গুরুদাস যদি ঋত্বিকীর লক্ষ্য পূরণ না করে আপনার মেয়েকে বিয়ে করে, তবে আপনার ভার কমবে ঠিকই, কিন্তু গুরুদাস ভারাক্রান্ত হবে।'
তার সঙ্গে যোগ করলেন আর একটা কথা। বললেন, 'দেখুন, ঋত্বিকতার কাজ ছেড়ে যেন মেয়ের বিয়ের খোঁজ করতে যাবেন না।- ঋত্বিকতার কাজ বজায় রেখে তার ফাঁকে ফাঁকে বিয়ের সম্বন্ধ দেখবেন। প্রাথমিক কর্তব্য বাদ দিয়ে কোন কর্তব্যই সারতে যাবেন না। তাতে মার খাবে দু'টোই।'
একদিন কথাপ্রসঙ্গে বললেন, 'লাখ-দেড়েক লোককে দীক্ষিত করে তোলা লাগে। দীক্ষিতের ও ক্রিয়াপরায়ণ লোকের সংখ্যা না বাড়াতে পারলে জাতির ও দেশের দুর্দশা মোচন করা যাবে না। এ ব্যাপারে আর কালক্ষেপের সুযোগ নেই। এই মুহূর্ত থেকেই সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।'
প্রশ্ন করা হলো, এটা কি আমরা পেরে উঠবো?
উত্তরে বললেন, 'চেষ্টা করতে থাকলে পুরোটাই তোমরা করতে পারো। পরমপিতা ক্ষমতা দিয়েই রেখেছেন, তোমরা গুরুনাম নিয়ে লেগে পড়লেই, দেখবে, সফলকাম হয়েছো। এটা আমার দেখা আছে।'✅
10