📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔷 — আমরা বরাবর লক্ষ্মীপূজা করতাম , এখন দীক্ষা নিয়েছি , এখনও কি আমরা লক্ষ্মীপূজা করতে পারি ?
🔷 ভগবান ইচ্ছে করলেই তাে মানুষকে ভাল করে গড়তে পারেন ? কেন করেন না?
🔷সন্তান মানেই হচ্ছে বিস্তৃত হ’য়ে চলা
🔷আমিষ ও নিরামিষ আহার গুণ
🔷পারিপার্শ্বিককে সন্তুষ্ট করা যায় কেমন করে?
[P 232-234]
পাবনা কলেজের কয়েকটি ছাত্র বেড়াতে এসেছে , তাদের সঙ্গে ক্যামেরা তারা শ্রীশ্রীঠাকুরের ফটো তোলার অনুমতি চাইলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — আচ্ছা ।
তারা বললো — আপনি যেখানে বসে আছেন , ওখানে তাে ফটো ভাল উঠবে না , যদি দয়া করে রােদের দিকে বসেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কোন ওজর - আপত্তি না করে রােদের দিকে এসে দাঁড়ালেন । শ্রীশ্রীঠাকুরের বেঞ্চখানি সেখানে সরিয়ে দেওয়া হলাে । তিনি বসলেন । তারপর ওরা ফটো তুলে নিল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সস্নেহে তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে লাগলেন । জিজ্ঞাসা করলেন — তোমরা কোথায় থাক ? তোমাদের বাড়ী কোথায় ?
ওরা বললাে — আমরা হোষ্টেলে থাকি , আমাদের ক’জনের বাড়ী নাটোর ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — নাটোরের কাঁচাগোল্লা খুব ভাল । তাই না ?
একজন বলল — হ্যাঁ। তবে শুনি আগের মত জিনিস এখন পাওয়া যায় না । আগে আরাে ভাল ছিল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — অনেক জিনিসেই আজকাল ভেজাল ঢুকে যাচ্ছে । ভেজাল দিতে - দিতে খাঁটি জিনিস করবার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলছে । এটা জাতির পক্ষে সবদিক দিয়েই ক্ষতিকর ।
উক্ত ভাই — মানুষ অভাবে পড়ে এমনতর করতে বাধ্য হয় । শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে বললেন) আমার মনে হয় উল্টো । এমনতর বুদ্ধি যত ঢোকে , ততই মানুষ অভাবে পড়ে । মানুষের যদি সেবাবুদ্ধি ও দক্ষতা দুই - ই থাকে , তাহলে তার অভাব না হবারই কথা । আর , দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা , মানুষের আত্মমর্যাদার পক্ষেই অবমাননাকর । আগে মানুষ হামেসা বলতাে — আমি অমুকের ছেলে , অমুকের নাতি , আমি কি কখনও এমন হীন কাজ করতে পারি ? ঐ ধরণের কথা আজকালকার যুবকদের মধ্যে কমই শােনা যায় । পূর্বপুরুষ - সম্বন্ধে গৌরববোধ মানুষের মধ্যে যদি তাজা থাকে , তাহলে তাদের ধারাটা , বিশেষতঃ তার মধ্যে সৎ ও শােভন যা ' , তা ধ'রে রাখবার একটা আগ্রহ হয় । তা’তে মানুষ অনেকখানি ঠিক থাকে । তােমরা লেখাপড়া শিখছ , তােমরা ভাল ক’রে লাগলে দেশের হাওয়া ফিরিয়ে ফেলতে পার ।
ছাত্রটি বলল — আমাদের আর ক্ষমতা কতটুকু ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ইচ্ছা যদি থাকে , অনুশীলন যদি কর , ক্ষমতার অভাব হবে না ।
সে বিনীতভাবে বলল — সেই আশীৰ্বাদই করুন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — পরমপিতার আশীৰ্বাদ আছেই ।
এরপর ওরা প্রণাম করে বিদায় নিল । যাবার বেলায় শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন -- সুযােগ পেলে আবার এসো । ফাঁক পেলেই এসাে ।
ওরা সম্মতি জানালো ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর পর - পর কয়েকটি লেখা দিলেন ।
দুপুরে মায়েদের বৈঠকে শ্রীশ্রীঠাকুর একটি মাকে জিজ্ঞাসা করলেন — তাের ছেলে পৈতে নিয়েছে , সন্ধে - অহিক ঠিক মত করে তাে ? প্রস্রাব করে জলটল । নেয় তাে ?
মা - টি বললেন — হ্যা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওসব দিকে খুব নজর রাখবি । আর , খাদ্যখানা সম্বন্ধেও যেন খুব সাবধান থাকে , যেখানে - সেখানে যেন না খায় । দোকানে চা - টা খাওয়া মোটেই ভাল না । খানিকটা গোঁড়ামি থাকলে চরিত্রের একটা আঁট থাকে ।
ফরিদপুরের একটি নবাগত মা জিজ্ঞাসা করলেন — আমরা বরাবর লক্ষ্মীপূজা করতাম , এখন দীক্ষা নিয়েছি , এখনও কি আমরা লক্ষ্মীপূজা করতে পারি ? শ্রীশ্রীঠাকুর - পারবি না কেন ? তবে যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি বাদ দিয়ে কিন্তু নয় । এইগুলি ঠিক রেখে , তারপর যা প্রাণে চায় করবি । লক্ষ্মীপূজার মধ্যে তো নাম করার ব্যাপার নেই , ফুলজল নৈবেদ্য দেওয়া , পাঁচালী পড়া — এই সব , সেটা স্বতন্ত্রভাবে করবি । নাম করার সময় লক্ষ্য রাখতে হয় , এই নামের পর যেন অন্য কোন নাম না করা হয় । পূর্বে যদি অন্য কোন নাম নেওয়া থাকে , আর সেটা যদি করতে ইচ্ছা করে , তবে আগে সেইটে ক'রে পরে এইটে করবে ।
উক্ত মা — আমাদের বাড়ীতে রীতি আছে বিশেষ - বিশেষ তিথিতে ও বিশেষ বিশেষ বারে বিশেষ - বিশেষ জিনিস খাওয়া হয় না , কিন্তু ছেলেরা তা মানতে চায় না , এ - সম্বন্ধে আপনি কী বলেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওগুলি মানাই ভাল । কোন প্রথার মধ্যে ভাল - মন্দ কি আছে , না জেনে , না বুঝে , তা ছাড়া ভাল না । যা ’ মানায় কোন লােকসান নেই , বরং না মানায় লােকসান হতে পারে , তা মানাই ভাল । ভাল করে অনুসন্ধান করলে এর মধ্যে জীবনীয় সম্পদ্ও মিলতে পারে । আমার মা বলতেন , “ যেখানে দেখিবে ছাই , উড়াইয়া দেখ তাই , পেলেও পাইতে পার অমূল্য রতন । ”
[P 234-240]
১০ ই পৌষ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৮।১২।৪১ )
শীতের প্রাতে শ্রীশ্রীঠাকুর পাবনা আশ্রমে বাঁধের ধারে টিনের তাসুতে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে আছেন প্রীতিপ্রসন্নমুখে — স্নেহল , স্নিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে । দিনের আলাে এখনও দেখা দেয়নি , একটু ঘাের - ঘাের ভাব , পাখীর কাকলী ঊষার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জাগরণী গান গাইছে — দূরবিসারী মাঠ থেকে হিমেল হাওয়া ভেসে আসছে । ঋত্বিক - অধিবেশন আগতপ্রায় , বাইরে থেকে কর্মীরা আসতে সুরু করেছেন , কয়েকজন গিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের চৌকী ঘিরে বসলেন । কথা আরম্ভ হ'লো—
প্রফুল্ল — পারিপার্শ্বিকের প্রতিকূল প্রভাব নিয়তির মত আমাদের পথে টেনে নিয়ে যায় তাদের নিয়ে চলতে গিয়ে যে আমরা নিজেরাই বিধবস্ত হ’য়ে পড়ি , তার প্রতিকার কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যবদনে বলতে লাগলেন — শাক্যসিংহ সেনের বাবা চন্দ্রশেখর সেনের কাছে গল্প শুনেছি — গ্রীনল্যাণ্ডে নাকি যখন - তখন দারুণ ঝড় ওঠে , সেই ঝড়ের সময় বাইরে থাকলে তার নাকি রক্ষা পাওয়াই মুশকিল , কিন্তু তাকে যদি কেউ উদ্ধার করতে যায় — তবে মজায় নাকি একটা দড়ি বেধে যায় , সেই দড়ির অন্যদিক বাঁধা থাকে ঘরের সঙ্গে । তখন সে সেই দড়ির সাহায্যে আবার ঘরে ফিরে আসতে পারে , অন্যকেও ঝড় থেকে বাঁচাতে পারে । আমরাও যদি তেমনি ইষ্টের সঙ্গে সমস্ত টান ও ঝোক নিয়ে বাধা থাকি , আমরা নিজেরা তাে বাচতে পারিই , সঙ্গে - সঙ্গে প্রবৃত্তিমুখী মৃত্যুপথের পথিককে টেনে আনতে পারি ।
একজন হঠাৎ প্রশ্ন করলেন — জগতে যা - কিছু হচ্ছে , ভগবানই তাে মূলে , মানুষের হাত কোথায় , তিনি ইচ্ছা করলেই তাে মানুষকে ভাল করে গড়তে পারেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - ভগবানের হাতে মানে মানুষের হাতে । ছেলে বাপেরই সৃষ্টি , কিন্তু তা সত্ত্বেও ছেলে স্বাধীন –তার স্বাধীন ইচ্ছায় সে বাপের অনুগত হয়েও চলতে পারে , বাপের বিরুদ্ধেও চলতে পারে । সেখানকারটাই এখানে হ'য়ে আছে — জানেন তো জগন্নাথ টুণ্ডা , হাত নেই , ধরতে পারে না , আমাদেরই হাত দিয়ে ধরতে হয় অর্থাৎ কোন মহাপুরুষ , কোন ভগবানই কারও কিছু করতে পারেন না , যদি কিনা তার tendency of attachment তা'তে ligared না হয় ( তার অনুরাগের টান দিয়ে সেই মহাপুরুষের সঙ্গে যুক্ত না হয়)।
সতীশদা — করলেই যদি হয় , ভালটা করি না কেন , তাতেই তো সুবিধা ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাহ’লে আমার দুঃখটা ভােগ করবে কে ? আমরা যে দুঃখ বিলাসীর দল , মতলব করে দুষ্ট চলনায় চলব , জীবনের বিধিকে অনুসরণ করব না , আর ভগবান ’ ‘ ঠাকুর ” ইত্যাদি বলে অনুযোগের কান্না কাঁদব — এ - সব কপট ভণ্ডামী Rupa Men's Thermal Bottomছাড়া আর কিছু নয় । প্রকৃত ভক্তের মধ্যে নীচস্বার্থযুক্ত লােলুপ হীনত্ববােধ থাকে না , ভালবাসার স্বরূপই তা নয় । চাওয়া - পাওয়ার বালাই তার নেই , তার সর্ব্বশক্তি দিয়ে সে প্রেষ্টপূরণের ধান্ধায় পাগল , এতে যায় তার সব অপারগতা ঘুচে , সে হয় সার্থককৰ্ম্মা , আশাবাদী , সর্ব্বকৰ্ম্মকৃৎ , আত্মপ্রত্যয়ে অটুট । তাই চৈতন্যচরিতামৃতে আছে—
আমারে ঈশ্বর ভাবে আপনারে হীন
তার প্রেমে কভু আমি না হই অধীন ।
অর - একটা কথা আছে—
প্রভু প্রভু বলিস তুই দাস হলি তুই কবে
মেটে গর্ব্বে ফেটে মরিস্ বিভবের বৈভবে ।
এই তাে ব্যাপার । কথার পর কথা , নানা কথা উঠতে লাগলো । কেষ্টদার সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বলতে লাগলেন–
এখন আমাদের বিশেষ করে দরকার platform work— আমার কথা লোকের দরজায় গিয়ে নানান ধাঁজে পরিবেষণ করুন , মানুষগুলিকে integrated ও consolidated (যুক্ত ও সংহত ) করে তুলুন — তখন দেখবেন , সব sprout করে (গজিয়ে) উঠবে , common Ideal -এ(এক আদর্শে ) interested (অন্তরাসী ) না ক'রে তুলে আন্দোলন যেন বালুর ডেলা , তার স্থায়িত্ব কি ? Cementing force ( সম্মিলনী শক্তি ) কোথায় ? দেশে যত group ( দল ) , যত পন্থীই থাক্ না কেন — সবাই হবে for the Ideal ( আদর্শার্থে) । পরস্পরকে consolidated ( সংহত ) ক’রে তুলতে হবে যা’তে বােঝা যায় –আমি মানে এতগুলি , বোঝা যায় জোর , মনে হয় বীর ।
অনুলােমের প্রবর্তন করে প্রতিলোম - প্রথা তুলে দিতে হয় , সঙ্গে - সঙ্গে চাই অভ্যাস , ব্যবহার , ঝোঁককে নিয়ন্ত্রিত করে কার্যকরী শিক্ষা আর agricultural ও industrial activity launch ( কৃষি ও শিল্পের প্রবর্তন ) profitable becoming ( উপচয়ী বিবর্ধন ) -এ যেতে হবে । দৈনন্দিন জীবনে যা’-যা’ প্রয়ােজন তা হাতে - কলমে প্রস্তুত করতে চেষ্টা করতে হবে , কৃষি থেকে কৃষিজাত শিল্প হবে , instrument ( যন্ত্র ) দোয়াড়ে পরিবেষণ করা লাগবে , তাহলে কাণ্ড যা হয় — তা আর কওয়া যায় না । এর জন্য গোড়ায় দরকার প্রত্যেক জেলায় - জেলায় উপযুক্ত কর্মী ।
Consolidation ( সংহতি ) -সম্পর্কে কথা উঠলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন কয়েকটা মানুষ যদি ঠিক - ঠিকভাবে consolidated ( সংহত ) হ'য়ে ওঠে , তবে আর ভাবতে হয় না । যতগুলি আসে , সেই আওতায় ফেলে ঠিক করে নেওয়া যায় ।
অন্যান্য কথার পর শরৎদা কথা তুললেন — আপনার কাছে আগে বলেছি , আজও বলছি — সমাজতন্ত্রীরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার মানে না । এর উত্তর কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার স্বাতন্ত্র ও সহজাত - সংস্কার নিয়েই তাে আমার আমিত্ব — তাই খাটিয়েই তাে আমার দুনিয়ায় চলা , এমন প্রতি - প্রত্যেকটি আমি নিয়েই তাে সমাজ ও রাষ্ট্র । আমার activity ( কর্ম ) ও service ( সেবা ) এর প্রয়ােজন যদি সমাজের থাকে তবে সে - সমাজের আমার interest ( স্বার্থ ) , incentive ( প্রেরণা ) , evolution ( বিবর্তন ) , enjoyment ( উপভোগ ) ও প্রতিষ্ঠা দেখবারও প্রয়ােজন আছে । আর , সম্পত্তির উত্তরাধিকারী সন্তান হবে না কেন , তা তো বুঝতে পারি না । বাপের চোখ - মুখের চেহারা , নানা দোষগুণ — মায় syphilis ( সিফিলিস ) থাকলে তা পর্যন্ত বিধির বশে সন্তানে বর্তাবে — আর তার অর্জিত ধন - সম্পদ তাতে বৰ্ত্তাতে পারবে না — সে কেমন কথা ? সন্তান আত্মজ , তার মানে পিতারই continuation ( ক্রমাগতি ) —নানা রকমে সে নিজেকে অভিব্যক্ত করতে করতে চলেছে — তাই তাকে সন্তান বলে । সন্তান মানেই হচ্ছে বিস্তৃত হ’য়ে চলা । মাথার দলিল , রক্তের দলিল যদি উল্টাতে পার , তখন আইনগত কাজের দলিল উল্টাতে চেষ্টা করাে । আর , এ - প্রথা উঠিয়ে দিলে মানুষ কাজে তেমন জোর পাবে না — তার স্বভাব হ'লে — সে মুছে যেতে চায় না , লুপ্ত হতে চায় না — যাদের সে ভালবাসে তাদের মধ্যে সে বেঁচে থাকতে চায় — তার অর্জিত ধন বংশপরম্পরার ভিতর - দিয়ে অনন্তকাল ধ'রে ভােগ করতে চায় — এ সহজ অধিকার থেকে বঞ্চিত হ'লে তার আট থাকবে না । যে সব অসুবিধার কথা ভেবে socialist- রা এ - কথা বলে তার প্রতিকার এটাকে উঠিয়ে দিয়ে নয় , বরং স্বস্ত্যয়নী ইষ্টোত্তর বেশী করে রেখে সন্তানদের স্বস্ত্যয়নী - ব্রতধারী সেবাইতরুপে নিয়ােগ করে তা’ হ’তে পারে । মূল গণ্ডগােল বেধেছে বর্ণবিধানের গণ্ডগােলে এবং বিয়ের গােলমালে — তাই আজ কত pauperistic ism ( দৈন্যপীড়িত বাদ ) গড়ে উঠছে । বৈশিষ্ট্যানুসরণ , আদর্শানুসরণ , পারি পাশ্বিকের সেবা , জীবিকার্জন - ধৰ্ম্ম , অর্থ , কাম , মোক্ষ সব ছিল আমাদের আৰ্য - বিধানে একসূত্রে গাঁথা — হীনতাবােধের বালাই ছিল না । অযথা প্রতি যােগিতা বা পরস্পরের মুখের গ্রাস কাড়ার ভয় বা অসংযত লালসা ছিল না , টাকা তখন মানুষ ছাপিয়ে ওঠেনি , বেকার - সমস্যা ভয়াল হয়নি , সুষ্ঠ বর্ণবিধানের ফলে সমাজ ছিল সুস্থ , স্বস্থ — আজ আমরা সে - অবস্থা কল্পনাও করতে পারি না । আর পঞ্চাশ হাজার উকিলের দেশে কী দরকার ? লক্ষ - লক্ষ বিপ্র আজ শুদ্ৰবৃত্তি অবলম্বন করে চলেছে , তারা যদি যথাযথভাবে বিপ্রবৃত্তি নিয়ে থাকতো , বামনাই কাজ করতাে , ঋত্বিকতা করতো — তবে ইষ্ট বাঁচতো , কৃষ্টি বাঁচতো , তারা বাচতাে , দেশশুদ্ধ বাঁচাতে পারতো । তারা প্রত্যেকের পিছনে lovingly ( প্রীতির )সঙ্গে হানা দিয়ে sexual life ( যৌন - জীবন ) থেকে public life : ( সমাজজীবন ) পর্যন্ত সবদিক থেকে right channel- এ ( ঠিক পথে ) যদি goad (চালনা ) করতাে , তবে দেশ কি এতখানি পড়তে পারতাে ? Pauper- ism ( দারিদ্রব্যাধি ) দেশ থেকে ছুটে পালাতে বাধ্য হতাে , এমন - কি ঢুকতেই অবকাশ পেতো না । কেষ্টদা ঈশ - উপনিষদের একটা শ্লোকের মানে জিজ্ঞাসা করলেন “ আত্মনন্যবানুপশ্যতি ••••••••••••••• ইত্যাদি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — নিজেকে অন্যের অবস্থায় ফেলে সে হয়ে গিয়ে সেই চোখে তাকে ও নিজেকে দেখা , এবং নিজের দাড়ায় নিজের মত করে অন্যকে দেখা এই দুই দিক দেখলেই দেখা সম্পূর্ণ হয় । যেমন , আমার দাড়ায় ফেলে কুলিদের দেখেছিলাম এবং কুলিদের অবস্থায় কুলিদের মধ্যে মিশে কাজ করে কুলিদের ও নিজেকে দেখেছিলাম , এতে ব্যাপারটা আমার পুরােপুরি বোঝা হয়েছিল । ওদের সঙ্গে মিশে বুঝেছিলাম — আমরা বাইরে দাড়িয়ে নিজেদের stand ( দাড়া ) থেকে ভেবে ওদের যা ’ problem ( সমস্যা ) মনে করি , তা আদৌ ওদের problem ( সমস্যা ) নয় । তাই সম্যকভাবে না দেখে যারা দরদী হ'য়ে ওদের জন্য movement ( আন্দোলন) করতে যায় — তারা ওদের নিগুঢ় সমস্যা বোঝেও না , প্রতিকারও করতে পারে না । সব ক্ষেত্রেই এই রকম ।
ভক্তের লক্ষণ কী , শ্রীশ্রীঠাকুর সেই কথাপ্রসঙ্গে বললেন — প্রকৃত দেখলেই তার প্রেষ্ঠকে মনে পড়বে , তার কথাবার্তা , আচার - আচরণ হয় বুককাড়া , মনকাড়া ।
ঋত্বিকদের কেমনভাবে শিক্ষিত হয়ে ওঠা উচিত , সেই সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — ঋত্বিকদের সব বিষয়ে thorough practical knowledge , , thorough conception ( সুসম্পূর্ণ কার্যকরী জ্ঞান ও ধারণা থাকা চাই , যাতে যে - কোন affair (ব্যাপার ) , situation ( অবস্থা ) বা topic ( বিষয় ) -কে masterfully deal ( আধিপত্যের সঙ্গে চালনা ) করে ইষ্টস্বার্থ , ইষ্টপ্রতিষ্ঠা করতে পারে ।
আমিষ ও নিরামিষ আহার - সম্বন্ধে কথা উঠলাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মাছ খাওয়া না - খাওয়া দুটোই আমি ভাল করে দেখেছি , ভাবলাম — মাছ খাওয়া বজায় রাখা যায় কিনা । মাছ না খেয়ে নাম করে দেখেছি , অল্পতেই কেমন তরতর করে মন উপরে উঠে যেত । মাছ খেয়েছি , নাম করেছি , কিন্তু কী যেন রাহুর মত ঠেসে ধরত , ধারাটা কেটে যেত , continuity ( ক্রমাগতি ) কিছুতেই বজায় রাখতে পারতাম না , fatigue ( ক্লান্তি ) এসে ঘিরে ধরতো । যারা মাছ খায় না তারা সাধারনতঃ ছােটখাট ব্যারামে vitally injured ( গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত) হয় না । মাছ খেলেই শরীরে যে toxin ( বিষ ) জন্মে , তা আমি প্রস্রাব দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি । সেই প্রস্রাব কয়েকদিন এক জায়গায় পড়লে সেখানকার গাছ , ঘাস জ্ব'লে যেত ; ছয় মাস মাছ না খাওয়ার পর দেখেছি , সে - প্রস্রাবে তেমন হয়নি। মাছে তাে এই করে আর অধিক ভােজন activity ( কর্মক্ষমতা ) নষ্ট করে , চিন্তার flow ( প্রবাহ ) কমিয়ে দেয় ।
... ধ্যান - সম্বন্ধে কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন —
ধ্যান মানে লােকে বােঝে না , অযথা কসরৎ করে । Fixation ( ত্রাটক ) মানুষকে মূঢ় করে — আর লোকে সাধারণতঃ ধ্যান বলতে fixation ( ত্রাটক ) বােঝে । Fixation ( ত্রাটক ) এবং Concentration ( একাগ্রতা) এ দুইয়ে আকাশ - পাতাল ফারাক ; concentration ( একাগ্রতা ) -কেই প্রকৃত ধ্যান বলে । Concentration ( একাগ্রতা ) মানে centre ( কেন্দ্র )সম্বন্ধীয় চিন্তা — এতে মনের দুনিয়া ও বাইরের দুনিয়ার সমস্ত বিরোধ ও অর্থহীন , সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন বৈচিত্র্য ইষ্ট সম্পর্কে সম্পকিত হয়ে জীবনটাকে সার্থক করে তােলে ।
শিক্ষা - সম্পর্কে কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল পােষণ না পাওয়ার দরুন মানুষের কত instinct (সহজাত সংস্কার ) যে stunted ( খর্ব ) হ'য়ে যাচ্ছে তার ঠিকানা নেই , তাই আজ দেশে একটা আস্ত গােটা মানুষ পাওয়া ভার — সবাই যেন ভাঙ্গাচোরা , বাড়তির পথে কত কী যেন gap ( ফাঁক ) প'ড়ে গেছে , বাদ পড়ে গেছে , গোঁজা মেরে - মেরে না দিলে যেন খাড়া হয়ে সব অবস্থায় চলতে পারে না , যখন - তখন নুইয়ে পড়ে । কলকাতার মত সহরে ছেলেপেলেদের কত instinct ( সহজাত সংস্কার ) উঠে কেঁদে - কেঁদে ফিরে যায় , জীবনের মাল - মসলা অযথা নষ্ট হয়ে যায় । আমাদের আশ্রমে কেমন শিক্ষার আবহাওয়া গড়ে উঠেছিল — বিচিত্র কাজ কর্ম্ম , গবেষণা ও আলোচনার স্রোতে শিক্ষা দক্ষিণা হাওয়ার মত বইত — শুধু ঘুরে বেড়িয়েই মানুষ কত শিক্ষা লাভ করতাে ।
সদ্গুরুর অনুকূল্য - সম্বন্ধে কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — নিজে সহায় থাকলে সদ্গুর সহায় হন । সদ্গুরুর প্রতি টান আসে তার প্রীতিজনক কর্মে । সেই কৰ্ম্মপথের যত অন্তরায় সে অতিক্রম করে পরম তৃপ্তিভরে , আত্মপ্রসাদ কানায় - কানায় তার মনকে ভ'রে তোলে , যে - কাজ সে ধরে তা'তেই জয়যুক্ত হয় — কৃতকাৰ্যত প্রতিপদক্ষেপে তাকে অনুসরণ করে , গু ধরলে তার হাতে পড়ে সােনা হ’য়ে যায় , চারিদিকে ধন্য - ধন্য প'ড়ে যায় । পারিপার্শ্বিকের ইষ্টপ্রাণ সেবা তার স্বভাবসিদ্ধ হ’য়ে দাঁড়ায় — দেখতে - দেখতে অর্থ , মান , যশ তাকে ঘিরে ধরে , লােকে বলে অদৃষ্ট — তাই বটে ।
পারিপার্শ্বিককে সন্তুষ্ট করা যায় কেমন করে সেই বিষয়ে কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — পারিপার্শ্বিককে সন্তুষ্ট কর , সে আবার কী কথা ? পারি পার্শ্বিককে সন্তুষ্ট করতে গেলেই সর্বনাশ , এক - একজন এক - এক ফরমাজ করবে , আর তাই তুমি তামিল করতে যাবে — তবে তো তুমি গিয়েছ । পারিপার্শ্বিকের করবে ইষ্টানুগ সেবা ও সম্বর্দ্ধনা — তাতে তুমিও বাঁচবে , তা'রাও বাঁচবে । শুনেছি , একদিন একটা লোক এক গাধার পিঠে চড়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল , একজন দেখে বললে— “ সে কি , তুমি গাধার পিঠে চড়ে যাচ্ছ ? তোমার মত লোক তে দেখিনি । সে ভাবলে , কাজটা অন্যায় হয়েছে , তাই গাধার পিঠ থেকে নেমে হাঁটিয়ে নিয়ে চলতে থাকলো । কিছুদূর যাবার পর আর একজন বললে ছি - ছি ! গাধাটাকে কষ্ট দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছ , তুমি কেমন মানুষ গা ? ” সে ভাবলে তাই তাে ! এই ভেবে সে গাধার হাত - পা বেঁধে নিজের কাধে করে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো । এতে গাধা ও তার দুরবস্থার আর সীমা রইল না । কোন principle ( আদর্শ ) -এর দিক না চেয়ে পারিপার্শ্বিককে খুশি করতে গেলে এমনতর দশাই হয় । ✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10