📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
⭐ শরৎদা নাম - ধ্যানে আয়ু বৃদ্ধি পায় না ?
⭐ ঠাকুর আগে কত কী দেখিয়েছেন , এখন আর তােমরা কী দেখছ ?
⭐ আত্মসমর্পণের কথা বলে , কথাটা আত্মসমর্পণ , না , বৃত্তিসমর্পণ
⭐ আত্মা তাে পূর্ণ । তার আবার বিবর্তন কী ?
[P 224-232]
১০ ই পৌষ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৫/১২/৪১ )
ভোরে তপােবনের শিক্ষকবৃন্দ ও শরৎদা ( হালদার ) , সতীশদা ( দাস ) প্রভৃতি অনেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আসলেন । সবাই এসে প্রণাম করে তাসুর মধ্যে উপবেশন করলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — আপনারা বসেন , আমি একটু প্রস্রাব ক'রে আসি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বাইরে এসে তারাভরা আকাশের দিকে একবার চাইলেন , চেয়ে বললেন — এখনও রাত আছে মনে হয় ।
একজন বললেন — প্রায় ৫ টা বাজে , শীতের রাত কিনা , তাই আকাশে অতাে তারা । চারিদিকে গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে । প্রকৃতির এই মূর্ত্তি দেখে শ্রীশ্রীঠাকুরের মনও যেন গভীর ভাবাবেশে মগ্ন হ’য়ে উঠলো ।
তিনি প্রস্রাব করে ঘরে ফিরে তন্ময় হয়ে কী যেন ভাবছেন । হঠাৎ বললেন — দ্যাখেন , যে - জিনিস আপনারা পেয়েছেন , ভাল করে অনুশীলন করেন । এ বড় সাচ্চা মাল , করলে হাতে - হাতে ফল , অবশ্য ফলের লোভে কিছু করতে যাবেন না । নাম - ধ্যান নেশার মত চালিয়ে যান , একটা দিনও বাদ দেবেন না । নিয়মিত করা — এ খুব ভাল । ভাল না লাগলেও করা ভাল , করতে - করতে রস জমে ওঠে । নিজের মত করে অনুভব না করলে মানুষের প্রত্যয় পাকা হয় না । নাম যত করবেন , কাজকর্মও তত ভাল করে করতে পারবেন , উৎসাহ , উদ্দীপনা ও শক্তির অভাব বােধ করবেন না । অনেকে আছে , নাম করতে - করতে বুদ হয়ে পড়ে , কোন কাজকর্মে মন দিতে চায় না , ও কিন্তু ভাল নয় । ওতে কিছুদিন পরে মানুষ নিথর হয়ে পড়ে । নাম - ধ্যান , অনুভূতি ইত্যাদি ব্যাপারেও অগ্রগতি থেমে যায় , চড়ায় ঠেকে যাওয়ার মত হয় । কিন্তু নাম - ধ্যান ও কাজকর্ম যারা নিত্যনিয়মিত ক'রে যায় , তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে সুবিধা হয় । সংঘাতের ভিতর না পড়লে নিজের দোষ - দুর্বলতাগুলি ধরা পড়ে না , আর কর্মক্ষেত্রে বাস্তবে সেগুলি সংশােধন করা ছাড়া , মনে - মনে সংশােধন করলে হবে না । তাই যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি এগুলি সমান তালে তাে করবেনই , তাছাড়া আপনাদের যাকে যখন যা করতে বলি , তা ’ কাটায় কাটায় করতে চেষ্টা করবেন । এই বলার পেছনে আমার অনেক কিছু উদ্দেশ্য থাকে , কিন্তু যখন যা বলি তখন যদি তা না করেন , তাহলে বড় অসুবিধার কারণ হয় । আবার কিন্তু ঠিকমত করলে অনেক বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারেন , শুধু বিপর্যয়ের হাত থেকে বাচা নয় , becoming ( বিবর্ধন ) এর পথও অনেকখানি খুলে যায় । এক - একজন যে কী হয়ে উঠতে পারেন , তার ঠিক নেই ।
শরৎদা — অল্প সময়ের চেষ্টায় যা সিদ্ধ হয় , তা করতে আমাদের তত আটকায় না , কিন্তু ক্রমাগতি নিয়ে কিছু করে চলা অনেক সময় আমাদের ধাতে পোষায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ভালবাসা যেখানে ক্রমাগত সেখানে । মা যে সন্তানকে মানুষ করে তােলে , তার পিছনে তাকে দিনের পর দিন , বছরের পর বছর ক্রমাগত কী কঠোর পরিশ্রমই করতে হয় । ছেলে হাগে , মোতে , কাঁদে , বিরক্ত করে , রােগে ভােগে , ক্ষিদে পেলে তাকে খাওয়াতে হয় , সময়মত তাকে জামা - কাপড় পরাতে হয় , তেল মাখিয়ে দিতে হয় , স্নান করাতে হয় , প্রতিটি মুহূর্তে তার প্রতি নজর দিয়ে চলতে হয় , তবে সে বেচে থাকে , বড় হয় । মায়ের এই সেবার ক্রমাগতি যদি না থাকতো , তাহলে কি শিশু মানুষ হতে পারতাে ? মহৎ কিছু পেতে গেলে তাই অনুরাগের সঙ্গে , ধৈর্যের সঙ্গে তার জন্য পরিশ্রম করা লাগে । আর , করতে করতে এই অভ্যাস পেকে ওঠে । তখন যা হাতে নেয় তা সমাধা না করে পারে না ।
মায়ের কথা বলছিলাম — তার এই টান এতখানি প্রখর যে ঘুমের মধ্যে পর্যন্ত সে সজাগ থাকে । তাই না সরােজিনী ?
সরােজিনীমা — হ্যাঁ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ভালবাসায় মানুষের অমনি হুশ বেড়ে যায় । তার চোখ , কান , নাক , গায়ের চামড়া , জিহ্বা প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয়ই সজাগ ও সাড়াপ্রবণ হয়ে ওঠে , কিছুই তার চেতনাকে এড়িয়ে যায় না । আমি যে এখানে বসে থাকি , আমার সবদিকে নজর থাকে , কোথায় কে যায় আসে , কী করে , কোথায় কোন্ শব্দটা হয় , কোথার থেকে কোন্ গন্ধটা আসে , কে কী মতলব নিয়ে ঘােরে , আমার সবদিকে লক্ষ্য পড়ে । এই নজর কিন্তু আপনাদের মধ্যে দেখতে পাই না । নাম - ধ্যান যত অটুট অনুরাগ নিয়ে করবেন , ততই দেখবেন , চলনা সজাগ হবে , বুদ্ধি - বিবেচনা বেড়ে যাবে ।
শরৎদা নাম - ধ্যানে আয়ু বৃদ্ধি পায় না ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তা ’ পায় বই কি ? অন্ততঃ হাতের মধ্যে যতখানি potency ( সম্ভাব্যতা ) আছে তার পুরাে সুযােগ পাওয়া যায় । নাম - ধ্যানে vital current ( প্রাণস্রোত ) উদ্বেলিত ও পুষ্ট হয়ে ওঠে । এমন - কি নামের সাহায্যে বহু দুরারােগ্য রোগ সারান যায় , মুমূর্ষ রােগীকে বাঁচান যায় । কুষ্টিয়ায় ওরা অনেক করেছে ।
শরৎদা — অনেকে বলে , ঠাকুর আগে কত কী দেখিয়েছেন , এখন আর তােমরা কী দেখছ ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — যারা miracle ( সিদ্ধাই ) -এর উপর নির্ভর করে , তাদের ভিত্তিই অজ্ঞতা , তারা বেশী দূর এগােতে পারে না । জগতে যা - কিছু ঘটে তারই কারণ আছে , আমরা যেখানে কারণটা ধরতে পারি না , সেখানে সেইটেকে বলি অলৌকিক । অলৌকিকের উপর দাড়ালে টান হয় না , আর টান না হ'লে মানুষের কোন লাভ হয় না । ধর্মের সঙ্গে আছে ভক্তি , অনুরাগ , কর্ম , জ্ঞান । এর ভিতর - দিয়ে প্রয়ােজনমত সব আসে । ঝাড়ফুঁক , তুকতাকে বিশ্বাস কিন্তু ধর্মবিশ্বাস নয় ।
পূর্ব দিক থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ঐ জানালাটা বন্ধ করে দিতে বললেন ।
এমন সময় কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) আসলেন । কেষ্টদাকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর হাসি - খুশি হয়ে বললেন — আসেন কেষ্টদা ! বসেন ।
কেষ্টদা ভিতরে এসে বসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কাল সন্ধ্যায় হকসাহেব ব'লে একজন এসেছিল , লােকটি কিন্তু ভাল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল , আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই । আপনি কাজেকর্মে ব্যস্ত আছেন ভেবে আর ডাকিনি ।
কেষ্টদা - কর্মীদের সঙ্গে আলাপ - আলোচনা করছিলাম । কাল রাত্রেই আমি ভদ্রলােকের কথা শুনেছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- কর্মীদের সঙ্গে আলাপ - আলোচনা করছিলেন , সে খুব ভাল । Conference ( অধিবেশন ) -এর আগে ঘরোয়া বৈঠক যত বেশী হয় , মাথা মাথা কর্মীদের নিয়ে , ততই ভাল । মানুষের মাথায় জিনিসটা যত ধরিয়ে দেওয়া যায় , ততই কাজ সহজ হয়ে ওঠে । ধারণায় গােল থাকলে মানুষ কাজও সুষ্ঠভাবে করতে পারে না । আলাপ - আলোচনায় মানুষের মাথা সাফ হয় ।
নূতন - নূতন কর্ম্মী , যাদের বাইরে নূতন - নূতন জেলায় পাঠাবেন , তাদের নিয়ে বার - বার বৈঠক করবেন , ভাল করে equip ( তৈরী ) করে ছেড়ে দেবেন । ওদের জামা - কাপড় , বিছানা , লেপ , কাঁথা , শীতবস্ত্রাদি আছে কিনা খোঁজ নেবেন , না থাকলে যথাসম্ভব ব্যবস্থা করে দেবেন । প্রত্যেকে যাতে শ্রেষ্ঠ - যাজী হয় , সে - কথা ভাল করে বুঝিয়ে বলবেন । কৰ্মী যারা বাইরে যাবে , তাদের আচার আচরণ , চাল - চলন খুব দুরস্ত হওয়া চাই । তারা যদি সদাচারী না হয় , তাদের অভ্যাসগুলি যদি সুন্দর না হয় , ব্যবহার যদি শ্রদ্ধা - সন্দীপী না হয় , তাহলে মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না ।
কেষ্টদা - অমি এইগুলির উপর খুব জোর দিচ্ছি । যেমন — ভোরে ওঠা , নিয়মিত নাম - ধ্যান করা , ব্যক্তিগতভাবে নিত্য কিছু পড়াশুনা করা , অনুসন্ধিৎসার সঙ্গে পরিবেশের জন্য বাস্তবে কিছু করা ইত্যাদি । ওদের বলছি — আপনার যে সব টোটকাগুলি দেওয়া আছে ঐগুলি টুকে রাখতে । এতে বহু মানুষকে সেবা দেওয়া যায় । জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে - সব ছড়া দেওয়া আছে আপনার , সেগুলি সম্বন্ধেও ভাল করে ওয়াকিবহাল করে দিচ্ছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এই তো কাজের কাজ । একেই তাে বলে আচাৰ্য্য । আর মুখে - মুখে ব'লে - বলে এমনভাবে তৈরী করে দেবেন , যে যে - বিষয়েই , যে বাদ বা দর্শন সম্বন্ধেই প্রশ্ন করুক না কেন , তৎক্ষণাৎই যেন তার সহজ সমাধান দিতে পারে । যে - সব বই এদের পড়া প্রয়োজন , সে বইগুলিও এদের দিয়ে পড়িয়ে ফেলবেন । প'ড়ে কতটা হজম করলো , তা আবার পরখ করবেন । পড়ে যেন note নেবার ( প্রয়ােজনীয় অংশ টোকার ) অভ্যাস করে । অর , প্রত্যেকের অর্জন - পটুত্ব যাতে বৃদ্ধি পায় , তেমনভাবে প্রবুদ্ধ করে তুলবেন । গাঁটের টাকা খরচ করে ঘুরে - ফিরে যদি চলে আসে তাহলে তাতে কিন্তু অভিজ্ঞতা বাড়ে না । সামান্য কিছু দিয়ে দিলেন । তাই নিয়ে বেরুলাে , আর পথে - পথে মানুষের সঙ্গে হৃদ্যতা করে , তাদের আপন করে নিয়ে , তাদের প্রীতি অবদানের উপর দাঁড়িয়ে হিল্লী - দিল্লী ঘুরে কাজ সমাধা করে আসলো , এতে অনেকখানি বেশী শিক্ষা হয় । আপনারা আগে খালি হাতে বেরিয়ে কত কী সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন । এর মধ্যদিয়ে সব চেয়ে বেশী উপকার হয়েছে আপনাদের নিজেদের । টাকার উপর যদি দাঁড়াতেন , তাহলে কিন্তু তা হতাে না । কর্ম্মীদের মধ্যে নেবার আগ্রহের পরিবর্তে দেবার আগ্রহকে যত ফুটিয়ে তুলতে পারবেন , ঐ আগ্রহই তাদিগকে স্বাবলম্বী ও দক্ষ করে তুলবে । এইভাবে যখন ঘুরেছেন , বাইরের কত হােমরা - চোমরা লোক আপনাদের সাহায্য করতে পেরে নিজেদের কৃতার্থ মনে করেছে , আসার সময় ছাড়তে চায়নি , চোখের জলে বিদায় দিয়েছে । আপনাদের কাছে কত গল্প শুনেছি , শুনে একটা আত্ম প্রসাদ অনুভব করতাম । মানুষকে আপন করে পাওয়াই তাে সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব । গোপাল একবার দার্জিলিং থেকে এসে গল্প করছিল , শুনে মনে হ'লো — একেবারে ‘ বসুধৈব কুটুম্বক ’ করে ফেলছে ।
কেষ্টদা — আশ্রমের এত কিছু যে গড়ে উঠলো , সবই তাে ভিক্ষার উপর , প্ৰীতি - অবদানের উপর । আপনি যতটুকু করিয়ে নিয়েছেন , তার উপর দাঁড়িয়ে এই বিশ্বাস হয়ে গেছে যে , টাকার অভাবে কিছু না - হওয়া থাকে না , অভাব যা ' , তা ’ কেবল মানুষের ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাইতো ক্ষুধার্তের মত আমি কেবল মানুষ খুজি । কি কন কেষ্টদা – আমার ক্ষুধা কি মিটবে না ?
কেষ্টদা — আমরা যদি চারিদিকে ভাল করে হাউড় দিতে পারি , তাহলে ভাল - ভাল মানুষ সব এসে পড়বে । মানুষ আছে বইকি ? এত বড় একটা দেশে মানুষ নেই , তা কি হতে পারে ? যদি বাংলায় না জোটে , ভারতের অন্যান্য প্রদেশে চেষ্টা করতে হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( ম্লান হেসে ) —সেই চেষ্টা করবার জন্য যে - ক’টা লােকের দরকার , তাই - ই যে জুটছে না ।
কেষ্টদাজুটে যাবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমিও তাে তাই ভাবি । ঋষি , মহাপুরুষের দেশ যে একেবারে দেউলে হয়ে যাবে , এ বিশ্বাস আমার হয় না । কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে , তাই ভয় হয় — সময়মত সব সামাল দেওয়া যাবে কিনা ।
ইন্দুদা ( বসু ) —আমরা এই ভরসা রাখি যে , আপনি যখন মাথার উপর রয়েছেন তখন বেকায়দা কিছু হবে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যা বলি তা যদি কর , তাহলে বেকায়দা না হওয়াই সম্ভব , কিন্তু না করলে আমি তাে নিরুপায় । তােমাদের প্রত্যেকের এমন হওয়া চাই যে , অন্য কোন consideration (বিবেচনা ) যেন কাজের পথে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে না পারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার পাশ ফিরে বীরাসন করে বসার মত বসলেন ।
বঙ্কিমদা ( রায় ) আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর আব্দারের সুরে বললেন — আমার আরজীটা মনে আছে তাে ? তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে দাও লক্ষ্মী ।
বকিমদা হেসে বললেন — আপনি যখন বলেছেন নিশ্চয়ই হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাই হ'লেই হয় ।
বঙ্কিমদা — আপনি হুকুম করবেন , আমরা তামিল করব , সেইজন্যই তাে এখানে আছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার কি বায়নার অন্ত আছে ? তাই মাঝে - মাঝে সমীহ হয় । অবশ্য , আমার জন্য তাফাল স’য়ে যারা সুখী হয় , তাদের দেখে মনে হয় , তারাও ভাগ্যবান , আমিও ভাগ্যবান ।
শরৎদা — আত্মসমর্পণের কথা বলে , কথাটা আত্মসমর্পণ , না , বৃত্তিসমর্পণ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আত্মসমর্পণ কথাটা আত্মসমর্পণের অন্তরায় , আত্মসমর্পণ তখনই হয় , যখন আমরা with all our passions ( সমস্ত প্রবৃত্তি নিয়ে ) ইষ্টে interested ( স্বার্থান্বিত ) হই । ইষ্টে আপ্রাণ হলে মানুষ active evolving nature- এর হয়ে পড়ে অর্থাৎ সক্রিয় বিবৰ্ত্তনী স্বভাব - সম্পন্ন হয়ে ওঠে । আত্মসমর্পণ যে করে , সে টের পায় না যে সে আত্মসমর্পণ করেছে । এই - ই তার কাছে একমাত্র জীবন , যার কল্পনা সে করতে পারে । অন্য কোন প্রকার জীবন যে সম্ভব , তাই - ই তার মাথায় আসে না । তার বাচাটাই নিরর্থক মনে হয় প্রেষ্ঠকে বাদ দিয়ে । এর মধ্যে কোন তাত্ত্বিকতারই বালাই নেই । তার সত্তাই এই কথা কয় । মাছ যেমন বাচতে গেলে জলেই বাঁচে , ভক্তও তেমনি বাঁচতে গেলে ইষ্টেই বাঁচে , ইষ্টের জন্যই বাঁচে , নইলে সে বাঁচবে কী দিয়ে ? বাঁচবে কী নিয়ে ? ( এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর একবার তামাক খেলেন ) ।
শরৎদা — আত্মা তাে পূর্ণ । তার আবার বিবর্তন কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — জীবাত্মার বিবর্তন হয় , জীবাত্মা মানে প্রবৃত্তি - সমন্বিত আত্মা । জীব আবার বিভিন্ন স্তরের । যারা জীবকোটি , তাদের প্রবৃত্তি জীবনের উপর দিয়ে , ইষ্টের উপর দিয়েও প্রধান , ইষ্টও তাদের প্রবৃত্তি - পােষণের জন্য । আর , যারা ঈশ্বরকোটি , তাদের সুরত থাকে সম্যকভাবে আদর্শ - নিবদ্ধ , তারা সব প্রবৃত্তি দিয়েই ইষ্টের সেবা করে , যে - প্রবৃত্তি যেখানে ইষ্টসেবার অন্তরায় সৃষ্টি করে , সেখানেই তাকে নির্মমভাবে পরিহার করে চলে বা সহজেই নিয়ন্ত্রিত করে তোলে। ফলকথা , এমন কোন প্রবৃত্তি নেই , যা ইষ্টসেবায় লাগান যায় না । গীতায় আছে , ধর্ম্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি ভরতৰ্ষভ ' । ধর্ম্মের অবিরুদ্ধ কাম , ক্রোধ , লোভ , মদ , মোহ , মাৎসর্য্য ধর্ম্মেরই অঙ্গ , ধর্ম্মেরই সাথিয়া । অনর্থ তো সৃষ্টি করেই না , বরং জীবনকে সার্থক করে তােলে । ঈশ্বরকোটি পুরুষ যারা , তাদের সব প্রবৃত্তিই ধৰ্ম্মানুগ হ'য়ে ওঠে , অর্থাৎ প্রবৃত্তির উপর আধিপত্য তাদের সহজ ও স্বতঃ হয়ে ওঠে । এই আধিপত্য তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বিস্তারলাভ করে । আর আধিপত্য মানেই , ধারণ - পালনী সম্বেগ সমন্বিত আগ্রহ - উদগ্রীব সক্রিয়তা । তারা যে - কোন স্থানে পড়ুক না কেন , responsible (দায়িত্বশীল ) , active ( সক্রিয় ) leading position- এ ( নেতৃত্বের পটভূমিতে) গিয়ে দাঁড়ায় , আবার সে - ও ইষ্টার্থে — আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নয়কো ।
অস্তে - আস্তে রােদ উঠে গেল । আশ্রমের দাদারা ও মায়েরা এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করতে লাগলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তাদের স্বাস্থ্য , সুখ - সুবিধা , অসুবিধা ও কাজকৰ্ম্ম - সম্বন্ধে খোঁজ - খবর নিতে লাগলেন । প্রেসের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মী তার অতিরিক্ত খাটুনির কথা বললেন । শ্রীশ্রীঠাকুর চোখ - মুখ ঘুরিয়ে তীব্র উদ্দীপনার সঙ্গে বললেন — শালা , কাজের কাছে হার মানবি কেন ? বরং কাজই তোর কাছে হার মেনে যাবে । যত কাজই আসুক , তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে এনে তুই তার উপরে উঠে দাঁড়াবি ।
দাদাটি বললেন — শরীরে পেরে উঠি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কাজের মধ্যে বরং শরীর ভাল থাকে । অবশ্য খাওয়া - দাওয়ার দিকে একটু নজর দিবি । একটু দুধ - টুধ খাস্ তাে ? আর , কোন অসুখ - বিসুখ নেই তাে ?
উক্ত দাদা — অসুখ কিছু নেই । এমনি শরীর দু্র্ব্বল লাগে । দুধ একটু করে খাই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( স্নেহাপু্লত কণ্ঠে ) —দুধ যদি হজম হয় , দুধ আর - একটু বাড়িয়ে দিলে পরিস্ । দরকার হলে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিস্ । আর , কাজকৰ্ম্ম একেবারে বাদ দিস্ না , তাতে নিজেকে রােগী মনে হবে , ওতে আরাে দুৰ্বল বােধ করবি । স্বচ্ছন্দে যতটা পারিস্ কাজকর্ম্ম করিস্ । অবশ্য তোর যদি ভাল লাগে ।
দাদাটি হেসে বললেন — আপনি যেভাবে বলছেন , এতে তাে কাজ করবার জন্য উৎসাহ - আগ্রহ হয় , কিন্তু কেউ যদি জোর করে কাজ চাপাতে চায় , তাহলে যেন আর করতে ইচ্ছে করে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —জোর করে চাপালােই বা , এ তাে তাের নিজের কাজ । নিজের স্বার্থের ব্যাপারে কেউ যদি তোর উপর জবরদস্তি করে তাের ভাল করতে চায় , তা’তে কি তাের দুঃখ করার কিছু আছে ?
দাদাটি এইবার খুব হাসিখুশি হ’য়ে উঠলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মনে কোন গলদ বা বিরুদ্ধভাব জমতে দিবি না । তা'তে দেখবি শরীর - মন দুই - ই চাঙ্গা থাকবে ।
মন দুষ্ট হ’লেই জানিস
রোগের আথাল হয় ,
তারপর কি তো ?–
প্রফুল্ল — ঐটেকে তুই এড়িয়ে গেলেই
করবি ব্যাধি জয় ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর গাত্রোখান করলেন । মাতৃমন্দিরের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় কিশোরীদার পরিচালনায় সমবেত বিনতি - প্রার্থনা সুরু হলাে । অনেকেই সেখানে গিয়ে যােগদান করলেন । ভক্তগণের মিলিত প্রার্থনার সুর দূর - দূরান্তে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলাে । ধন্য হিমায়েতপুর , ধন্য সৎসঙ্গ আশ্রম , যেখানে দিনের পর দিন , মাসের পর মাস , বৎসরের পর বৎসর অবিশ্রান্তভাবে প্রভাবিত হয়ে চলেছে ভাগবত লীলার অখণ্ড মন্দাকিনী - স্রোত । এই আশ্রমের প্রতিটি ধূলিকণাও কত পবিত্র । এই ধূলি অঙ্গে মেখে যুগযুগান্তে কত মানুষ দিব্যভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠবে । আসুন , এই মহাতীর্থ - বেদীতলে আমরা আভূমিলুণ্ঠিত প্রণাম করি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনান্তে মাতৃমন্দিরের বারান্দায় এসে বসলেন । একটু বাদে নবাব - মিস্ত্রী আসলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীশদা ও বঙ্কিমদাকেও ডাকতে বললেন । শ্রীশদা ও বঙ্কিমদা আসলে , সকলকে সঙ্গে করে নিয়ে পােষ্ট অফিসের পাশে যেখানে ফিলান্থপি অফিসের নূতন দালান উঠবে , সেই জায়গা দেখতে গেলেন । ক'টা ঘর হবে , বারান্দা কোন্ দিকে থাকবে , দরজা - জানালা কেমন হবে , কোন্ ঘর কতজনের উপযোগী হবে ইত্যাদি বলে সেইভাবে পরিকল্পনা করতে বললেন । নবাবকে বললেন — ভাল করে বুঝে নিবি , পরে যেন কোন অসুবিধা না হয় । আর , দালান হওয়া চাই ছবির মত সুন্দর । একপাশ দিয়ে সিড়ি থাকবে । সেই সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে সেখানে যেন প্রয়োজনমত সভা - সমিতি করা যায় । বাড়ী যেন বেশ মজবুত হয় প্রয়োজনমত যা’তে দোতালা করা যায় , তার ব্যবস্থা যেন থাকে ।
নবাব বললো — আচ্ছা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ওখান থেকে এসে খেপুদার বারান্দায় বসলেন । বসে শ্রীশদাকে বললেন — এদিকের ব্যবস্থা খানিকদূর অগ্রসর হলে পঞ্জিকা দেখে গৃহারম্ভের দিন ঠিক করে কাজ শুরু করে দেন । ✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10