📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
👉 সুজনন - বিজ্ঞান মেয়েদের কিভাবে শিক্ষা দিতে হবে ?
👉 সংস্কার, ব্যাবহার, সুশিক্ষা...
👉 শিশুশিক্ষা কী ভাবে দেওয়া উচিৎ...
[P 207-213]
৯ ই পৌষ , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৪১২৪১ )
রাত পোহাতে না পােহাতেই তপােবনের শিক্ষকবৃন্দ এবং আরাে অনেকে এসে হাজির হলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে তাসুতে বিছানায় বসে আছেন । সবাই আসতেই হাসিমুখে বললেন — আসেন , আপনারা না আসলে যেন নেশা জমে না । ঘুম ভাঙ্গলেই মনে হয় , কখন আপনারা আসবেন ।
সবাই একে - একে প্রণাম করে উপবেশন করলেন । শিশুশিক্ষা - সম্বন্ধীয় প্রশ্নের অবতারণা হলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ডাক পড়িয়ে শেখান ভাল । খেলার মধ্যদিয়ে নামতা শেখান যায় । বাস্তব প্রয়ােজনের মধ্যদিয়ে যােগ , বিয়ােগ , গুণ , ভাগ বোধে এনে দিলে ‘ বােধটা এমনভাবে মাথায় গেঁথে যায় যে — কেন , কি জন্য , কোথায় যােগ , বিয়ােগ , গুণ , ভাগ - এর কোটা প্রয়ােগ করতে হবে , সহজে বুঝতে পারে । গোড়ায় বুঝটা গজিয়ে দিতে পারলে পরে বাধে না । ধর , কুল নিয়ে বা ফুল নিয়ে আরম্ভ করলে । একজনের হাতে প্রথমে ৫ টা দিলে , ৫ টা দিয়ে গুণতে বললে , সে গুণে বলল ৫ টা পেয়েছে , তারপর আর তিনটে দিলে , দিয়ে একসঙ্গে সব কটা মিলিয়ে ক’টা হলাে জিজ্ঞাসা করলে , সে গুণে বলল ৮ টা । এই জিনিসটা যে যােগ করা হ'লে তাকে বুঝিয়ে দিলে , প্রথমে মুখে - মুখে বললাে , তারপর সেইটে লেখায় আবার হয়তো ঐ ৮ টা থেকে ২ টে নিয়ে নিলে , তখন জিজ্ঞাসা করলে -ক’টা আছে বল , সে বলল ৬ টা । এই জিনিসটাই যে বিয়ােগ বা বাদ দেওয়া , তা ’ বললে । সেটা আবার লেখায় আনালে । এইভাবে যোগ , বিয়ােগ , গুণ , ভাগের বাস্তব প্রয়ােজনটা কী , এবং কেমনভাবে তা করতে হয় ধরিয়ে দিলে সে তা ’ আর জীবনে ভুলবে না । জীবনের প্রয়ােজনগুলি ভাগ করে বিশেষ কয়েক রকম কাজ সৃষ্টি করতে হয় । সেগুলি করতে গিয়ে যে - যে অসুবিধাগুলি আসবে, সেগুলি কাবেজে অনিবার কায়দা ধরিয়ে দিতে হয় , এইভাবে যে - সব ছেলে বের ক'রে দেবে , এম - এ পাশরাও তাদের কাছে দাঁড়াতে পারবে না । প্রয়ােজনীয় সবরকম কাজ হাতে - কলমে শেখার ব্যবস্থা থাকলে প্রত্যেক ছেলের ঝোকই পুষ্ট হবে । একটা দিকে বিশেষ ঝোঁক থাকলে সেটা যেমন শিখবে , সেই সঙ্গে - সঙ্গে আরাে পাঁচ রকম কাজ শিখবে , তাতে চৌকস হয়ে উঠবে , বিভিন্ন রকম জানা তার মূল সহজাত - সংস্কারকে আরাে পুষ্ট করে তুলবে । মানুষের সহজাত - সংস্কার গুলি যথাযথভাবে পুষ্ট হলে , সে উপচয়ী , অনুসন্ধিৎসু , উদ্ভাবনী কর্ম্মে আনন্দ পায় , সেবাপ্রাণ হয়ে ওঠে , অর্থস্বার্থী না হয়ে মানুষ - স্বার্থী হয়ে ওঠে । জীবনে কৃতকার্য হয়ই । অবশ্য , সবটার ভিত্তি হওয়া চাই শ্রদ্ধা । ছেলেদের শিক্ষা ছেলেদের মত হবে , আর মেয়েদের শিক্ষা মেয়েদের মত হবে । সুজনন বিজ্ঞানটা মেয়েদের ভালভাবে শেখাতে হয় ।
বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) —সুজনন - বিজ্ঞান মেয়েদের কিভাবে শিক্ষা দিতে হবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — প্রথম কথাই হলাে , তাদের বংশ - মৰ্যাদা ও আভিজাত্য - সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা । ঐ গৌরববােধ তাদের মধ্যে এতখানি তাজা করে তোলা চাই , যাতে তারা কখনও নিকৃষ্টের কাছে আত্মদান না করে । প্রতিলোম বিয়ের পর মেয়েরা যে মনে - মনে কী নরকযন্ত্রণা ভােগ করে , তার ঢের confession (স্বীকারােক্তি ) আমি শুনেছি । প্রথমে মােহের বশে হয়তাে আকৃষ্ট হয় , কিন্তু যখনই স্বামী তা'তে উপগত হতে যায় , তখনই যেন তার অন্তরাত্মা ডুকরে কেঁদে ওঠে । তার পূর্বপুরুষরা সবাই একযোগে মিলে তখন যেন গিছি - গিছি ক'রে আর্তনাদ করে ওঠে , সে যে কী যন্ত্রণা , তা ' ব'লে বোঝাবার নয় । মানুষ আত্ম হত্যার সময়ও বােধ হয় অতাে কষ্ট পায় না । আর , প্রতিলোম সন্তানসন্ততির কী দুর্গতি হয় , তা তো তোমাদের অজানা নয় । তাই প্রতিলোম - সম্বন্ধে একটা প্রচণ্ড ভীতি গজিয়ে দিতে হয় — বাস্তব বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে উদঘাটিত করে । অর , শ্রেয়ের প্রতি সহজ টান যাতে গজায় তাই করতে হয় । আবার , শ্রেয়কুল সঞ্জাত উপযুক্ত স্বামী লাভ হলেও কেমন করে তার মনোজ্ঞ চলনে চলতে হয় , কেমন করে তার কুল - সংস্কৃতিকে , তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যকে সশ্রদ্ধ সক্রিয় সেবায় পুষ্ট করে চলতে হয় , সে - সব তার মাথায় ধরিয়ে দিতে হয় । মেয়েদের বিয়ে মানে জন্মান্তর , স্বামীকে নিয়ে , তার সংসারকে নিয়ে সে নতুন মানুষ হয়ে উঠবে । নিজেকে যতখানি সে স্বামীতে উৎসর্গ করতে পারবে ইষ্টানুগ রকমে , ততখানিই তার সুসন্তান লাভের সম্ভাবনা । এ উৎসর্গ মানে একটা ভাবালু রকম নয় । তার প্রতিটি চিন্তা , চলন , বাক্য ও কর্ম পূজারতি হ'য়ে ফুটে উঠবে । এই - ই হবে তার ধ্যান , জ্ঞান , অনুসন্ধিৎসা ; দেহে , মনে , প্রাণে , অন্তরাত্মায় সে নিজেকে যতখানি নিরলসভাবে স্বামী - তপা করে তুলতে পারবে , ততই স্বামীর সদগুণগুলি সন্তানের মধ্যে মূর্ত করে তুলতে পারবে — তা ’ সন্তানের সহজাত - সংস্কারে ও তার চরিত্রে ।
কথা হচ্ছে , এমন সময় একজন এসে তার বাড়ীতে অসুখের কথা বলে ২৫ টাকার জন্য প্রার্থনা জানালেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যে গান ধরলেন — বল্ মা তারা দাঁড়াই কোথা ?
পরক্ষণেই বীরেনদাকে বললেন — ওঠেন আপনি । কী আর করবেন ? আপনার তো ঐ কাম ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করে উঠে পড়লেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর অপসােসের সুরে বলছেন — আমি দেখি , মানুষ আমার কাছ থেকে যত নেয় , তত পঙ্গু হয়ে পড়ে । তবু কেউ যখন অসুবিধার কথা বলে , তখন না দিয়ে পারি না । ভাবি , যদি বেঘােরে পড়ে । ভিতরে - ভিতরে কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠি । কিন্তু এইভাবে দেওয়ায় - নেওয়ায় যােগ্যতা বাড়ে না , মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না । অসময়ে আমার কাছ থেকে যেমন নেয় অন্যের অসময়ে তেমনি যদি স্বতঃ - দায়িত্বে দেয় , দেখে , শােনে , করে , নিজে না পারলে ভিক্ষা করেও যদি করে , তাতেও মানুষের পারগতা অনেকখানি বজায় থাকে এবং আমারও ভার একটু লাঘব হয় । কিন্তু তা করবে না । এতে যে নিজেরই ক্ষতি করা হয় , তা বোঝে না ।
নগেনদা ( বসু আপনি যখন বােঝেন যে , এইভাবে দেওয়ায় আমাদের ক্ষতি হয় , তখন না দেওয়াই তাে ভাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওই তাে আমার দুর্বলতা । তাছাড়া , অসুবিধার সময় নেওয়া তো দোষণীয় নয় । অন্যের অসময়ে করার বুদ্ধি থাকলেই হয় । আমি যে দিই , সেও তাে পরিবেশ থেকে নিয়েই দিই , কিন্তু আমার সবসময় বুদ্ধি থাকে , যার কাছ থেকে নিই , তাকে যাতে তাজা রাখতে পারি । এই চেষ্টা থাকার দরুন পরমপিতার দয়ায় আটকায় না । আপনারা আমার এই রকমটা দেখে এই ভাবে চললেই পারেন । আমি তাে নেংটে , কানাকড়ি বলতেও আমার সম্বল নেই। আমার আছেন আপনারা । আপনারাও তেমনি প্রত্যেকে প্রত্যেকের হ'য়ে উঠুন — শুধু কথায় নয় , করায় , তাহলে দেখবেন আপনারা প্রত্যেকেই রাজা । নগেনদা —আপনার সঙ্গে মানুষের তুলনা হয় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এর মধ্যে একটা ফাঁকিদারী বুদ্ধি আছে । আমি কি আজগবী কিছু করি । আমি যা করি , তা তো খোলামেলা । এবং আপনাদের প্রত্যেকেই তার মত করে এটা করতে পারেন — যার যেমন সামর্থ্য সেই অনুযায়ী , করতে করতে আবার করার শক্তি বাড়ে । আর , যতটা করবেন , ততটা হবে । আমার চলনে যদি না চলেন — যার - যার বৈশিষ্ট্য - অনুযায়ী , —তাহলে আমি আপনাদের কিসের ঠাকুর ? আমাকে যদি এতটুকু ভালবাসেন , তাহলে তাে আমি যে - চলনে চলি , চলতে বলি , সেইভাবে চলার চেষ্টা করা উচিত । এই তাে শ্রদ্ধা - ভালবাসার লক্ষণ । আপনার সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতা ছাড়বেন না , সার্থকতার পথে চলবেন না , অথচ আমাকে ঠাকুর ব’লে ভক্তি দেখাবেন , সে - ভক্তিতে আপনাদেরই বা লাভ কি ? আমারই বা তৃপ্তি কোথায় ? আমাকে ভালই যদি বেসে থাকেন , আমার পথে চ'লে আপনাদের ভালবাসার মর্যাদা রক্ষা করুন । দেখুন তাতে কী হয় । কপটতায় কিন্তু ফয়দা নেই ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কথাগুলি চোখা - চোখা বাণের মত প্রত্যেকের অন্তরে বিদ্ধ হ’য়ে গেল ।
তপোবন বাের্ডিং - এর একটি ছেলে একখানা ছবি একেছে । সেই ছবি দেখতে নিয়ে এঁসেছে । শ্রীশ্রীঠাকুর দূর থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন — ও কিরে ? কী অনিছিস্ ?
ছেলেটি বলল — একখানা ছবি একেছি , তাই আপনাকে দেখাতে এনেছি।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( উল্লাস সহকারে ) —দেখা ! দেখা !
ছেলেটি বের করে দেখল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — বেশ হইছে ।
আরাে ভাল আঁকার অভ্যেস কর । ••• আমার হাতে দে তো !
হাতে নিয়ে চোখের কাছে এনে ও দূরে রেখে , একবার বিছানার উপর যে রোদ এসে পড়েছে , সেই রােদে রেখে আগ্রহভরে ঘুরিয়ে - ঘুরিয়ে দেখলেন । বললেন - বাস্তব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য যে - গুলি দেখবি , সে - গুলি নিখুতভাবে লক্ষ্য করে যদি ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারিস্ তাহলে ভাল হয় । ধর , এখানকার সূর্যাস্তের দৃশ্য । দৃশ্যটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে মাথায় একে রাখা চাই , পরে তখন তাকে ছবিতে রূপ দিবি । বাস্তবের সঙ্গে মিল করে এইরকম কতকগুলি করা যদি থাকে , তারপর কাল্পনিক দৃশ্য আঁকতে পার । তখন সে কাল্পনিক দৃশ্যের মধ্যেও বাস্তবতার ছাপ থাকবে । গোড়াতেই কাল্পনিক ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক দিও না । আর , গোড়ায় ছবি দেখে ছবি আঁকার অভ্যেস না করে , বস্তু দেখে যদি ছবি আঁকার অভ্যেস করো , সে - ছবির মধ্যে তােমার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে তোমার হাত খুব ভাল , অনুশীলন করলে আরো ভাল হবে ।
ছেলেটি বলল — আমার ছবি আঁকতে খুব ভাল লাগে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — নতুন ছবি আঁকলে আমাকে এনে দেখাবি। আমারও ভালো লাগে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ছবিখানা নিজের হাতে রেখে চারিদিকে ঘুরিয়ে সকলকে দেখালেন , দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — কি বলেন ? কেমন হইছে ?
সকলে একবাক্যে বললেন — ভাল ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর ছবিখানা ছেলেটির হাতে দিলেন । সে প্রণাম করে খুশি মনে চ’লে গেল ।
একটি দাদা এসেছেন বরিশাল থেকে , তিনি হাই ব্লাডপ্রেসারে অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছেন , শ্রীশ্রীঠাকুরকে কাতরভাবে নিবেদন করলেন — দয়াল ! ওষুধপত্র তাে অনেক কিছুই করলাম , কিছুতেই স্থায়ী ফল হয় না । আপনি নিজ মুখে যদি একটা - কিছু বলেন , তাহলে তাই খেয়ে দেখতে পারি । আর আমি পারি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর একটুখানি ভাবলেন , ভেবে তারপর বললেন , কেষ্টদাকে একবার একটা পাচন দিয়েছিলাম , তাতে তার খুব উপকার হয়েছিল । আমার যতদূর মনে হয় , হরীতকী , আলকুশী , শালপানি , অনন্তমূল , বেড়ে ও অর্জুন এই ক’টা জিনিস ছিল তাতে । মাত্রা বিষয়ে বীরেনদা বা হরিপদর কাছে শুনে নিতে হয় । পরমপিতার দয়ায় কেষ্টদার কিন্তু ওতেই সেরে গেছে । তুমিও ব্যবহার করে দেখতে পার ।
দাদাটি শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছ থেকে বিধান পেয়ে বললেন — আপনার মুখ দিয়ে যখন বেরিয়েছে , এতেই আমার অসুখ সেরে যাবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সে পরমপিতার দয়া । ইন্দুদা ( বসু ) —ছেলেপেলেদের স্কুলে যেমন শিক্ষা দিতে হবে , বাড়ীতেও তাে তেমনি উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা চাই ? বাড়ীতে ছেলেপেলেদের শিক্ষার জন্য প্রধান করণীয় কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ছেলের প্রথম শিক্ষা শুরু হয় তার মা'র কাছে । তাই মা'র অভ্যাস , চাল - চলন খুব নিয়ন্ত্রিত হওয়া চাই । মা’র এতটুকু ভুলে ছেলের অনেক ক্ষতি হতে পারে । ছেলে হয়তো রোখের সঙ্গে একটা কাজ করতে যাচ্ছে , কাজটাও ভাল , কিন্তু মা মনে করলাে — এ তাে অনর্থক , তাই ভেবে খুব বাধা দিলো , এতে হয়তাে তার কর্ম - সম্বেগই অনেকখানি স্তব্ধ হয়ে ওঠে । আবার , অন্যায়ও যদি কিছু করতে যায় খুব সম্বেগ নিয়ে , —সেখানেও স্তব্ধ করে দিতে নেই , বরং ঐ সম্বেগটাকে সুনিয়ন্ত্রিত করে দিতে হয় । শিশু অনুসন্ধিৎসা নিয়ে মা'র কাছে কতরকম প্রশ্ন করে , মা যদি ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয় , তাহলে তার অনুসন্ধিৎসার কিন্তু ঐখানেই খতম । আবার , আবােল - তাবোল যা ' - তা ” উত্তরও দিতে নেই , তার মাথায় ধরে এমন করে বলতে হয় । যেটা জান না , সেটা - সম্বন্ধে বলতে হয় — পরে বলব , পরে জেনে নিয়ে বলতে হয় তাকে । ছেলের স্বভাব , রুচি , পছন্দ , বৈশিষ্ট্য মায়ের নখদর্পণে থাকা চাই । প্রত্যেকটা ছেলেকে মানুষ করতে হয় তার নিজস্ব রকমে । শাসন , তোষণ , আদর , সোহাগ প্রত্যেককে ঠিক একই রকমে করলে হয় না , যার যেমন প্রকৃতি , তার সঙ্গে সেই চা’লে চলতে হয় , নইলে তার অন্তরের ক্ষুধা মেটে না । বিশিষ্টতা - সম্বন্ধে এই বোধটা খুব কম মায়েদের আছে , তারা ও - নিয়ে অতো মাথা ঘামায় না । পরিবারের মানুষগুলির সেবা - যত্নের ব্যাপারে যদি ঐ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে চলার অভ্যাস থাকে , তখন সন্তানপালনের বেলায়ও সে - ধাজটা থাকে । সব জিনিসেরই অভ্যাস চাই , শিক্ষা চাই । সেইজন্য মেয়েদের খুব গােড়া থেকে এই সবগুলি খেয়াল করে শেখাতে হয় । তারপর সংসারে গুরুজন কেউ হয়তো ছেলেকে কোন অন্যায়ের জন্য শাসন করেছে , মা তখন - তখনই যদি ছেলের পক্ষ নিয়ে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে যায় তার সঙ্গে , তাতে কিন্তু সন্তানের মাথা খাওয়াই হয় । একান্নবর্তী পরিবারে অনেক সময় এই রকম দেখা যায় । এমন কি অন্যায়ভাবেও যদি সে শাসন করে থাকে , ছেলের সামনে তা নিয়ে তাকে কথা শুনান ভাল নয় । বরং শুভবুদ্ধিতে তাকে শাসন করেছেন , সেই কথাটাই বলতে হয় । সব সময় লক্ষ্য রাখতে হয় , ছেলেদের জীবনে যা'তে কিছুতেই অশ্রদ্ধা , দোষদৃষ্টি , অনৈক্যবুদ্ধি ইত্যাদি শিকড় গেড়ে না বসে । সামনে পরনিন্দা , পরচর্চা যত না করা যায় , ততই ভাল । সুকেন্দ্রিক উদারতা ও সেবা - সহানুভূতির দৃষ্টান্তই যেন তারা মা - বাবার চরিত্রে দেখতে পায় । তারপর , কখনও কোন কারণেই ছেলেপেলেদের এমনভাবে বকা ভাল না , যাতে তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায় । মা হয়তো ছেলেকে পড়াতে গেছে , ছেলে পারলো , অমনি বলে বসলো — লেখাপড়া তোকে দিয়ে হবে না , তাের মাথায় গােবর পোরা । মায়ের মুখ থেকে এমনতর কথা ছেলের জীবনকে সাবাড় করে দিতে পারে । আবার , মা - বাবা ছেলের সামনে নীতি - উপদেশ দিচ্ছে , কিন্তু নিজেরা সেই অনুযায়ী চলে না , এতেও কিন্তু ছেলেদের খুব অসুবিধা হয় । আর , মা বাবা পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত করে তুলতে চেষ্টা করবে ছেলেকে । সঙ্গে - সঙ্গে পিতৃপুরুষের কথা , ইষ্টের কথা মাথায় ঢুকিয়ে দেবে ।বাস্তব আচরণের ভিতর - দিয়ে সেটা তাদের ভিতর গেঁথে দেওয়া চাই । ধর , শীতকাল , বাড়ীতে নুতন কমলা এসেছে , দেখে ছেলের খুব খাবার লােভ । তখনই বললে— বেশ তাে ! চল যাই আগে ঠাকুরবাড়ী দিয়ে আসি গিয়ে , তারপর আমরা খাব । এই বলে তার হাত দিয়েই কমলাটা ঠাকুরকে দেওয়ালে । এইভাবে বাস্তব আচরণের মধ্যদিয়ে দেখাতে হয় যে , ইষ্টই তােমাদের জীবনের মুখ্য । উপদেশ দেওয়া লাগে না । আবার , তোমার বাবা - মা হয়তাে বেঁচে নেই , ঘরে হয়তাে তাদের ফটো আছে , নিত্য সেই ফটোর সামনে প্রণাম কর তােমরা , ধূপধুনাে দাও , মালা দিয়ে যত্নের সঙ্গে ফটোটি সাজিয়ে রাখ । ঠাকুর - দেবতাকে যেমন ভাল জিনিসটা নিবেদন করে , মা - বাবার ফটোর সামনেও হয়তাে তাই কর তােমরা । এসব যদি ছেলেপেলেরা দেখে তবে পিতৃভক্তি , মাতৃভক্তি তাদের মধ্যেও উছলে উঠবে । পিতা - মাতা যাদের জীয়ন্ত আছেন , তারা তাদিগকে জাগ্রত গৃহদেবতার মত ভক্তি ও সেবা যদি করে , ছেলেপেলেরা ওর ভিতর - দিয়েই শিক্ষার মূল মরকোচ ধরে নিতে পারবে । একটা জিনিস হামেশাই দেখা যায় । মা - বাবা ছেলেপেলের সামনে নিজেরা অনেক সময় ঝগড়া - বিবাদ করে । এই কাজটি কখনও ভাল নয় । মােকথা কয়েকটা বললাম । আরো কত আছে । ফলকথা , মা - বাবা যদি সুনিয়ন্ত্রিত না হয় , তবে ছেলেপেলেদের সুনিয়ন্ত্রিত করে তোলা দুঃসাধ্য ।
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10