📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
⭐ শরৎদা ( হালদার ) -নারী - পুরুষের বৈশিষ্ট্যের মূল কোথায় ?
⭐ প্রেরিত পুরুষদের কাউকে স্বীকার করি , কাউকে অস্বীকার করি , কাউকে ছােট করে কাউকে বড় করি , তাহলে সেটা কাফেরদেরই সামিল...
[P 213-220]
শরৎদা ( হালদার ) -নারী - পুরুষের বৈশিষ্ট্যের মূল কোথায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — একটা ঢেউ - এর উদ্বেলায়িত অবস্থাটা যেন পুরুষ , অবেলায়িত অবস্থাটা যেন নারী । অববেলায়তের উপর ভর দিয়ে যেন উদ্বেলায়িত দাঁড়ায় । প্রকৃতি যেন পুরুষের বিশ্রামের ক্ষেত্র । নারী পুরুষের পরিপােষক , পুরুষ নারীর পরিপূরক , উভয়ে মিলে যেন এক , নারী যেন পুরুষের সত্তার বাকীটুকু । তাই মনােবৃত্ত্যনুসারিণী স্ত্রীর কথা বলে , আর স্বামী যেন স্ত্রীর সত্তা । পুরুষ - নারীর এই গভীর সম্পর্ক অনেকে বােঝে না । তাই একে অন্যকে তথাকথিত ভােগের উপকরণ মনে করে । কিন্তু প্রকৃত দাম্পত্য মিলন ও প্রণয় যেখানে , সেখানে ঠিক লক্ষ্মী - নারায়ণ বা শিব - দুর্গার আবির্ভাব হয় । পুরুষের এই উদ্বেলায়িত অবস্থাটা অটুট রাখবার জন্য তাকে আবার পুরুষ - শ্রেষ্ঠে সংলগ্ন থাকতে হয় । নচেৎ তার পৌরুষই লােপ পেতে বসে । সে কামমুগ্ধ হয়ে ওঠে নারীতে , তার পরিপূরণী প্রতিভাই নষ্ট হতে থাকে । নারী তেমনতর পুরুষকে নিয়ে সুখী হতে পারে না । Negative ( রিচী ) তার counter - self positive ( সমবিপরীত ঋজী সত্তাকে ) খুঁজে বের করে , তাকে reinforce ( শক্তিসমৃদ্ধ ) করে সত্তায় সজাগ ও বৃদ্ধিতে উপভােগ - প্রতুল থাকতে চায় । এ শুধু পুরুষ - প্রকৃতির বেলায় নয় , greater বা greatest positive- এর ( বৃহত্তর বা বৃহত্তম ঋজী শক্তির কাছে lesser positive এর ( নূ্যনতর ঋজী শক্তির ) -ও এইরকম হয় , এরা এসে জুটলে তাঁর লীলার আসর জমাট বেঁধে ওঠে । তাই বলে , - “ সে তো একলা থাকে না ভাই , যখন যেখানে যায় , তার সঙ্গে থাকে গো রাই । ( ব’লেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন ) —কি কো’স কালীষষ্ঠী ?
কালীষষ্ঠীমা ( সহাস্যে ) —একলা থাকলি চলবে কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — দেখ , শালা ! দুনিয়ায় কেউই একলা থাকতি চায় না । মানুষ যে - মুহূর্তেই ভাবে যে তার কেউ নেই , সেই মুহূর্তেই তার দম আটকে আসতে চায় । অচ্ছা ! এমন কেন হয় ?
কালীষষ্ঠীম — কেন হয় , তা জানি না । কিন্তু হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষের জারিজুরি যতই কও , তার মূল ঐখানে । এক ঠিক থাকলে সব ঠিক থাকে , তখন পরাণ ঠাণ্ডা ।
ইন্দু মিস্ত্রীদাকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — টেবিলটা করে দিলি না ?
ইন্দুদা — করছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — করছি কি রে ?
যখন চাই , তখন যদি না পাই তাহলি কি সুখ হয়। কম খরচে তাড়াতাড়ি সুন্দর করে যদি না করতে পারিস , তাহলে কী হ'লে ?
ইন্দুদা — এক হাতে কয়টা করব ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — দশভুজার কথা শুনিসনি ? মা দুর্গাকে কয় দশভুজা । তুমি এত নিপুণ হবা , এত তাড়াতাড়ি কাজ করবা যে , একাই পাঁচজন হ'য়ে উঠবা । তুমি ফিঙ্গে হ'য়ে লেগে দেখ না কেন ? আগের থেকে কতখানি আগাইছ , খেয়াল আছে ? আর দরকার হলে আরাে লােক জুটিয়ে নিতে হয় ।
ইন্দুদা ‘ আচ্ছা ’ ব’লে বিদায় নিলেন ।
গুরুদাসদ ( ব্যানার্জী ) —বহু পরিবারে আছে আচার - আচরণগুলি ধরানই যেন যায় না , যেমন ইষ্টভৃতি , নিরামিষ - আহার , সদাচারে চলা ইত্যাদি , ধরলেও আবার ছেড়ে দেয় । এর কী করা ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — অনেকের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর রকমই থাকে ঢিলে । দৃঢ়তার সঙ্গে নিরন্তরতা নিয়ে সৎ কোনকিছুতে লেগে - প’ড়ে থাকতে পারে না ।তাদের পেছনে লেগে থাকা ছাড়া আর কোন পথ নেই । তবে অধৈর্য্য বা হতাশ হলে চলবে না। তােমাদের কাজ হলাে অসীম ধৈর্য্যের কাজ । একটা ছােট ছেলেকে যে মা মানুষ করে , সে হাগে , মােতে , বমি করে , অসুখে ভােগে , কত দৌরাত্ম করে , তবু মা তাকে কত যত্নে পেলে - পুষে মানুষ করে তােলে । এ - ও সেই রকম । অনেক স'য়ে , অনেক ব'য়ে তবে এক - একজনকে ঠিক করা লাগে । আর , এই ব্যক্তি - চরিত্র নিয়ন্ত্রণ যদি না হয় , পরিবার - নিয়ন্ত্রণ যদি না হয় , তবে কোন কাজই করা সম্ভব শত - শত বছর ধরে ঋত্বিক্ তার কাজ করেনি , পুরােহিত তার কাজ করেনি , তাই আবর্জনা ও জঞ্জাল বহু জমে উঠেছে । তোমাদের এখন খেটেপিটে এগুলি সাফ করা লাগবে । আবার ধাঁজটা একবার এনে যদি ফেলতে পার , তখন দেখবে কত সহজ । আমাদের রক্তের মধ্যেই যে এটা আছে । তবে বহুদিনের অনভ্যাসের ফলে এখন নতুন মনে হয় । এই - ই যে আমাদের নিজস্ব জিনিস তা ভুলে গেছি ।
বেলা হ’য়ে উঠেছে । লােকজনের সমাবেশে আশ্রম - প্রাঙ্গণ চঞ্চল হ’য়ে উঠেছে । শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার গাত্রোখান করলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর দুপুরে খেয়ে - দেয়ে ঘুম থেকে ওঠার পর বঙ্কিমদা ( রায় ) এসে জানালেন — পাবনা থেকে হক সাহেব ব’লে একজন সরকারী কর্মচারী এবং আরো কয়েকজন ভদ্রলােক বিকালে বেড়াতে আসবেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আসলে তোমরা ঘুরিয়ে - টুরিয়ে দেখিয়ে কথাবার্তা ক’য়ে পরে আমার কাছে নিয়ে এসাে - যদি তাদের আগ্রহ থাকে । বঙ্কিমদা — আপনার সঙ্গে দেখা করবার আগ্রহই তাে তাদের বেশি । শুনেছি হক সাহেব বেশ ধর্মপ্রাণ লােক ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- যাহোক , তােমরা আগে কথাবার্তা ক'য়ো , তোমাদের সঙ্গে কথাবার্তা ক’য়ে পরে আমার কাছে আসলে ভাল হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর একটু বাদে মাতৃমন্দিরের উত্তর দিকে অশ্রম - প্রাঙ্গণে বকুল গাছতলায় একটা হাতওয়ালা বেঞ্চে এসে বসলেন । সঙ্গে - সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রাদি যথা — গড়গড়া , তামাক , টিকে , জলের ঘটি , সুপারির কৌটা , দাতখােটা , পিকদানি প্রভৃতি নিয়ে আসা হলো । ঝিরঝির করে একটু হাওয়া দিচ্ছে । শ্রীশ্রীঠাকুর চাদরটা চেয়ে নিয়ে গায় দিলেন । বেলা তখন প্রায় চারটে । আশ্রমের দাদারা ও মায়েরা আসছেন শ্রীশ্রীঠাকুর - দর্শনে । প্রত্যেকে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করছেন , প্রণাম করে কেউ বসে , কেউ দাড়িয়ে দেখছেন । তাঁর কমনীয় মােহন ঠাম । শ্রীশ্রীঠাকুর অমৃতস্রবা স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে - চেয়ে দেখছেন সবার পানে , কোন কথা নেই মুখে , তবু এই দৃষ্টি যেন অনির্ব্বচনীয় ভাব , ভাষা ও মমতায় ভরা । এই দৃষ্টিপাতে মানুষের মনের গহনতলে সুখতরঙ্গ স্বতঃই আন্দোলিত হয়ে ওঠে । এই মানুষই তাে জীবজগতের আনন্দকন্দ , তার সব চিন্তা , সব করা , সব বলা , মায় অস্তিত্বের প্রতিটি অনুরণন পর্যন্ত নিখিলের নিত্য অনিন্দবিধায়ক , সর্ব্বথা মঞ্জুল - মঙ্গলপ্রদ , তাই তাে মানুষ অনিবার্য্য আকর্ষণে ছুটে আসে তার কাছে । শুধু মানুষ নয় , ইতর প্রাণীও তাঁর মমতার আশ্রয় খোঁজে , তাঁর সান্নিধ্য কামনা করে ।
কয়েকজন ভদ্রলোক আসবেন বলে শ্রীশ্রীঠাকুর সুবােধ - ভাইকে বললেন কয়েকখানা চেয়ার পেতে রাখ তো ।
সুবােধভাই (বন্দ্যোপাধ্যায় ) কয়েকখানা চেয়ার এনে পেতে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সাজিয়ে - গুছিয়ে ভাল করে পাত । বিশৃঙ্খল রকমে পাতলে কি ভাল দেখায় ? কাজ যা ’ করবি , এমন সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে করবি যে , তা'তে তোর নিজের মনে যেন একটা আত্মপ্রসাদ আসে , আর তাের কাজ দেখে অন্যের প্রাণও যেন ঠাণ্ডা হয়ে যায় ।
সুবােধভাই শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দ্দেশমত চেয়ারগুলি ঠিকভাবে পেতে দিলেন ।
প্রফুল্ল বাইরের কাজের দিকে অতাে মন দিতে গেলে তো মানুষের মন বহির্ম্মুখী হয়ে যাবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দূর পাগল ! কো’স কি ? কাজকর্ম্ম তাে আমাদের তপস্যারই অঙ্গ । কাজকর্ম্ম করব তার প্রতিকামনায় । এই কাজকর্ম ছাড়া কি আত্ম নিয়ন্ত্রণ হয় ? আমাদের ভিতর যত বিশৃঙ্খলা থাকে , কাজকর্ম্ম তত এলােমেলো ও অবিন্যস্ত হয় । বাইরের কাজকর্ম্ম যদি সুষ্ঠ ও সুশৃঙ্খলভাবে করতে অভ্যস্ত হই , তার মধ্যদিয়ে আমাদের চিন্তা , চলন ও চরিত্রকেও সুবিন্যস্ত করে তোলার পক্ষে সাহায্য হয় । আমার তাে মনে হয় , কাজকর্ম্ম না করলেই মানুষ বহির্মুখী হয় বেশী । কাজকর্ম্ম করতে গেলে তো চিন্তাধারাকে কাজের উপযােগী করে নিয়ন্ত্রিত করতে হয় । এমনতর লাভজনক নিয়ন্ত্রণে মনের যে শিক্ষা হয় , নিষ্কর্মা থেকে সে শিক্ষা হয় না , উড়ো - উড়ো ভাব হয় । কাজকর্ম্মের ভিতর দিয়ে মানুষের যেমন জীবনের প্রয়োজন সমাধা হয় , তেমনি আবার ভিতরের বিন্যাসও হয় , এই তাে কাজের প্রধান গুণ । তবে কাজ হওয়া চাই ইষ্টার্থে , আমার বেঁচে থাকা পর্যন্ত তার প্রয়ােজনে ।
কথা হ’চ্ছে এমন সময় হকসাহেব এবং আরো কয়েকজন বঙ্কিমদা , প্রকাশদা ( বসু ) প্রভৃতি - সহ আসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর উঠে দাঁড়িয়ে তাদিগকে অভ্যর্থনা করলেন ।
ওঁরা বললেন — না , আপনি বসুন ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর বসলেন এবং ওঁরাও বসলেন । হকসাহেব বললেন আপনার কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি দেখে আসলাম । বেশ সুন্দর । তবে ধর্ম প্রতিষ্ঠানে এত কর্মের আয়ােজন কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ধর্ম মানে আমি বুঝি তাই করা যাতে আমাদের বাঁচা - বাড়া অক্ষুন্ন থাকে । এর জন্য গােড়ায় চাই ঐ রসুল বা কামেল পীর , তাঁকে ভালবেসে , তাঁকে অনুসরণ করে আমরা যখন চলি তখন দুনিয়ার হাজারাে রকম টান আমাদের আর বিচ্ছিন্ন করতে পারে না , আমরা বিভ্রান্ত হই না । ঐ খোঁটা “ ঠিক রেখে বাঁচার জন্য , বাড়ার জন্য , যা - যা ’ করি , সবই তখন ধৰ্ম্ম হয়ে দাড়াবে । বরং বাঁচা - বাড়ার জন্য যা - যা করণীয় , তার কোনটা যদি বাদ দিই , তাহ'লে আমাদের জীবন ততখানি ধৰ্মচ্যুত হয়ে পড়বে , অর্থাৎ বাঁচা - বাড়ার থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে । আবার , পরিবেশকে না বাঁচিয়ে আমরা বাঁচতে পারি না । আমাদের কর্মের ভিতর - দিয়ে , সেবার ভিতর - দিয়ে পরিবেশকে যতখানি উন্নত করে তুলতে পারব , পরিবেশের উন্নততর কর্ম ও সেবার ভিতর দিয়ে আমরাও তত সুষ্ঠভাবে সম্বৰ্দ্ধিত হব । তাই দেখুন , ধর্ম্মের মধ্যে কর্ম্মের প্রয়োজন কতখানি , তবে সব কৰ্ম্ম সার্থক হ'য়ে ওঠা চাই খােদাতালায় , রসুলে ।
হরিপদদা ( সাহা ) তামাক সেজে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যদি অনুমতি করেন , একটু তামাক খাই ।
ওঁরা একবাক্যে বললেন , হ্যাঁ , হ্যাঁ নিশ্চয়ই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - নেশাখোর মানুষ কিনা । নেশার বস্তু সঙ্গে থাকলে আড্ডাটা জমে ভাল ।
ভদ্রলোকেরা একটু হাসলেন ।
হকসাহেব — আপনি রসুলের কথা বলছেন , হিন্দুর মুখে রসুলের কথা তাে বড় একটা শুনি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — খোদার প্রেরিত যিনি , তিনি সবারই আপনজন । তিনি হিন্দু মুসলমান সকলেরই , সৰ্বমানবেরই । এই রসুলকে বাদ দিয়ে আমরা খােদা তালায় পৌঁছাতে পারি না । আবার রসুল বলেছেন — আমরা যদি প্রেরিত পুরুষদের কাউকে স্বীকার করি , কাউকে অস্বীকার করি , কাউকে ছােট করে কাউকে বড় করি , তাহলে সেটা কাফেরদেরই সামিল । আবার ঈশ্বরবিশ্বাসী , অটুট ইষ্টপ্রাণ কাউকে যদি কেউ কাফের বলে , সেও তার ভিতর - দিয়ে নিজের কাফেরত্বেরই পরিচয় দেয় । প্রকৃত প্রস্তাবে ধার্ম্মিক কখনও কাফের নয় , আবার কাফের কখনও ধার্মিক নয় । খাঁটি হিন্দু , মুসলমান , বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টানে কোন প্রভেদ নেই , তারা সবাই একপন্থী । প্রত্যেকেরই উচিত প্রত্যেকটি প্রেরিত পুরুষকে শ্রদ্ধা করা । এর ভিতর দিয়েই পারস্পরিক সম্প্রীতি সহজ হয়ে ওঠে । ধর্মের বিকৃতি যাতে না হয় , সেদিকে আমাদের সমবেত লক্ষ্য রাখা উচিত । রসুলের কোন বাণীর কদৰ্থ যাতে কেউ না করে , সেদিকে অাপনারও যেমন লক্ষ্য রাখা প্রয়ােজন , আমারও তেমনি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন । প্রত্যেক মহাপুরুষ সম্বন্ধে প্রত্যেকের এই মনােভাব থাকা উচিত । আমরা পরস্পরকে যত জানি ও শ্রদ্ধা করি ততই লাভবান হই । যতই অনুধাবন করি ততই বােধ । করতে পারি খােদা এক , তার প্রেরিতপুরুষগণ একবার্তাবাহী এবং ধর্ম অর্থাৎ জীবন - বৃদ্ধির নীতিও একই ।
হকসাহেব — ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম্মে তাে অনেক পার্থক্য দেখা যায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মূলগত পার্থক্য কমই পাবেন । তবে দেশ - কাল - পাত্রানুগ বৈশিষ্ট্যানুযায়ী খুটিনাটি ব্যাপারে বিশেষ - বিশেষ ব্যবস্থার বিধান থাকতে পারে । এবং আমার তাে মনে হয় সেটা ঐক্যেরই নিদর্শন । কারণ , প্রত্যেক প্রেরিত পুরুষই বৈশিষ্ট্যপূরণী । এই বৈশিষ্ট্যপূরণের দিক দিয়ে সবার মধ্যে ঐক্য আছে । বৈশিষ্ট্য যেখানে বিচিত্র , সেখানে বৈশিষ্ট্যপূরণী ব্যাপারে বৈচিত্র্যের অভিব্যক্তি থাকবেই । কিন্তু সবটার মূল লক্ষ্য ঈশ্বরমুখী জীবনবৃদ্ধি । আর , প্রেরিতপুরুষদের মধ্যে পাবেন পূর্বতনের আপূরণ । ‘ স পূৰ্ব্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ । পরবর্তী পূর্ধ্বতনদেরই সংহতমূৰ্ত্তি । পূর্বতনদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ নাই বরং তাঁর মধ্যে আছে সবার পরিপূরণ ।
হকসাহেব — মূলগত বিষয়ে যে পার্থক্য নেই , তাই বা বলা যায় কি করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ধরুন , ইসলাম শব্দের মানে আমি শুনেছি , খোদায় আত্ম নিবেদন বা শান্তি । সব ধর্ম্মই তাে মূলকথা এই । সব ধৰ্ম্ম বললে কথাটা ভুল বলা হয় , কারণ ধর্ম্মটা বহু নয় , ধর্ম্ম একই । আর কলেমা , নামাজ , রোজা , হজ , জাকাত এই পাঁচটি অনুষ্ঠান শুনেছি মুসলমানদের অবশ্য করণীয় । প্রত্যেক শাস্ত্রেই তাে এই বিধান আছে , তবে হয়তো ভিন্ন ভাষায় , ভিন্ন নামে হতে পারে । কলেমা মানে আমি বুঝি খােদাতালায় বিশ্বাস রেখে প্রেরিত পুরুষকে স্বীকার করে তার অনুশাসনে চলা । এই বিশ্বাস , স্বীকৃতি ও অনুসরণ ধর্মের প্রথম ভিত্তি । হিন্দুর মধ্যেও আছে যুগপুরুষােত্তম বা সদ্গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে তাকে অনুসরণ করে চলার কথা । খ্রীষ্টানদের মধ্যেও আছে baptism ( অভিষেক ) -এর প্রথা । বৌদ্ধরাও আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিশরণ - মন্ত্র গ্রহণ করে থাকে বলে শুনেছি । এই স্বীকৃতি , এই পুরুষশ্রেষ্ঠকে আপন করে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই তার অনুবৰ্ত্তনে চলার পক্ষে সুবিধা হয় । আর , নামাজ মানে সন্ধ্যা , বন্দনা , প্রার্থনা । মানুষ ইষ্টের স্মরণ , মনন যত করে , তত তার মন পবিত্র হয়ে ওঠে , প্রবৃত্তিগুলিকে সুনিয়ন্ত্রিত করবার কায়দা পায় , আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমীক্ষণে পটু হয় , তাছাড়া এতে করে ইষ্টীচলনের সম্বেগ বাড়ে , তাই এ নির্দ্দেশও সর্বত্র আছে । আর , রোজা মানে ইষ্টচিন্তাপরায়ণ হ'য়ে সুনিয়ন্ত্রিত উপবাস , এতে শরীর , মনের অনেক গলদ বেরিয়ে যায় , ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয়ে ওঠে । শুনেছি , বিধিমাফিক উপবাস কাম দমনের পক্ষেও সহায়ক । এও সবারই করণীয় , যে যে - পথেই চলুক । হজ মানে তীর্থযাত্রা , ভাবসিক্ত হয়ে তীর্থ - দর্শন করলে আমরা সাধু - মহাপুরুষদের ভাবে অনুপ্রাণিত ও অভিষিক্ত হয়ে উঠি । এ বিধানও সবার মধ্যে আছে । অর ; জাকাত মানে ধৰ্ম্মার্থে দান , ইষ্টার্থে উৎসর্গ । এই বাস্তব করণের ভিতর - দিয়ে ইষ্টের প্রতি আমাদের অনুরাগ বাড়ে , তাছাড়া আমাদের উদরান্ন - অহরণী কৰ্ম্মও ইষ্টসার্থকতায় সার্থক হয়ে উঠতে থাকে । এইভাবে ইষ্ট আমাদের সবকিছুতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে ওঠেন । সংসারে চলতে আমাদের হাজারো তাল নিয়ে চলতে হবে , কিন্তু সবটার মধ্যে যদি ইষ্টকে স্থাপনা করতে পারি , তাহলেই আমরা বহু অনিষ্ট , বিপদ , আপদ ও অনর্থের হাত হতে রেহাই পেতে পারি । যেমন জাকাত আছে , তেমনি অন্যত্র আছে ইষ্টভৃতি । এই ইষ্টভৃতি যে কতবড় জিনিস , মানুষের কতবড় রক্ষাকবচ তা করলেই বােঝা যায় । অাবার , এর ভিতর - দিয়ে দুঃস্থ পরিবেশও প্রভূত উপকৃত হয় । তাহলেই দেখুন , মূল জিনিসগুলি সর্ব্বত্র সমান কিনা ।
সন্ধ্যা হ’য়ে গেছে । বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন- আপনাদের শীত লাগছে না তাে ?
হকসাহেব — আমাদের তাে শীত লাগার কথা নয় । গরম জামা - কাপড় গায় আপনার গায় তাে সামান্য একটা সুতাের চাদর । আপনারই বরং ঠাণ্ডা লাগছে । চলুন , অন্যত্র গিয়ে বসি , অবশ্য আপনার যদি অসুবিধা না হয় । আপনার কথাগুলি খুব ভাল লাগছে , আরাে শুনতে ইচ্ছা করছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার আবার অসুবিধা কী ? আমার তো মনে হয় , আপনারা সারারাত থাকুন , সারারাত আপনাদের সঙ্গে গল্পে - গুজবে কাটিয়ে দিই । মনের মত মানুষ পেলে দুই - এক রাত না ঘুমােলেই বা কি যায় আসে ?
হকসাহেব এবং ওরা সবাই খুব হাসিখুশি হয়ে উঠলেন।
হকসাহেব বললেন — চলুন বারান্দায় গিয়ে বসি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর উঠে পড়লেন । সঙ্গে - সঙ্গে ওঁরাও উঠলেন । কয়েকজনে মিলে হাতে - হাতে ক’রে চেয়ারগুলি নিয়ে আসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন — ওঁদের torch (টর্চ্চ ) ধরে নিয়ে এসাে ।
দৌড়ে গিয়ে একজন টর্চ্চ দিয়ে পথ দেখালেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃমন্দিরের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় তক্তপােষের উপর পাতা বিছানায় উপবেশন করলেন , ওঁরা চেয়ারে বসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ব'সে বললেন — আলো নিয়ে আয় , মুখ না দেখতে পারলে ভাল লাগে না ।
একজন একটা হ্যাজাক নিয়ে এসে একপাশে টানিয়ে দিল ।
হকসাহেবের সঙ্গের এক ভদ্রলােক পর - পর দু - তিনবার একটু কাশলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আপনার কাশি হয়েছে ?
উক্ত ভদ্রলোক — ফ্যারিঞ্জাইটিস ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্যারীদাকে ডাকতে বললেন ।
প্যারীদা আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন —আমার জন্য যে বড়ি তৈরী করে রাখছিস্ , তার কয়েকটা বড়ি এই দাদাকে দে তাে । ওর ফ্যারিঞ্জাইটিস হইছে ।
প্যারীদা বড়ি আনতে গেলেন । একটু পরে এনে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ঐ বড়ি এখন একটা মুখে দিয়ে রাখেন । আর , রেখে দেন , পরে ব্যবহার করবেন । আর , মাফলারটা গলায় পেচিয়ে বসেন ।
ভদ্রলােক তাই করলেন ।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে , মাতৃমন্দিরের দোতালায় আশ্রমবালিকাগণের পূজারতি ও স্তবস্তোত্রপাঠ সুরু হয়েছে । বাড়ীতে - বাড়ীতে পরিবারের সকলে মিলে সমবেতভাবে বিনতি - প্রার্থনাদি করছেন । ওদিকে অতিথিশালায় আজ অাবার বিশেষ সৎসঙ্গের অধিবেশন । যীশুখ্রীষ্টের জীবন ও বাণী নিয়ে আজ সেখানে আলোচনা হবে । স্নিগ্ধ , শান্ত পরিবেশ চতুর্দিক প্রার্থনারত । শ্রীশ্রীঠাকুরও আপনভাবে মগ্ন হ’য়ে আছেন । ✅
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10