নাম ও নামী প্রসঙ্গে
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
সংগ্রাহক-শ্রীভূপেন্দ্রনাথ সিকদার দাল
নিবেদন
মানুষই শ্রেষ্ঠ জীৰ। God has created the man after his own image, পূর্ণত্ব হওয়াই একমাত্র কাম্য বৃত্তিদ্বারা চালিত না হ'য়ে নিয়ামক হ'তে হবে মানুষকে। আদি কারণকে প্রাণে প্রাণে অনুভব করাই পূর্ণত্ব।
বহু জন্মের পুণ্যের ফলে শ্রীশ্রীঠাকুরকে বাস্তব দেহে আমরা কেউ কেউ দর্শন ও স্নেহস্পর্শ পেয়েছি। তিনি হ'লেন বিশ্বসত্তার প্রতীক। সব সময় নামময় হ'য়ে থাকতেন তিনি, নাম তাঁর মধ্যে জীবন্ত, বাস্তবায়িত, আয়ত্তীকৃত। তাই তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছিলেন তারাও ডুবে থাকতেন তাঁর ভাবে। প্রবৃত্তির পর্দা যেন সরে যেত, অনুভব করা যেত সেই পরম কারণকে তিনি জেগে উঠতেন আমাদের মধ্যে।
তিনি যখন আসেন সৎনাম নিয়েই আসেন। তাই তিনি এবং নাম অভিন্ন। প্রত্যেকটি System কেমন ক'রে উদ্ভিন্ন হ'য়ে ওঠে - সেই সত্তায়, নাম কি, নাম কেমন ক'রে করতে হয়, নাম করলে নিয়ন্ত্রণ, সামঞ্জস্য ও সমাধান কেমন করে হয়, কেমন করে মনুষ্য জন্ম সার্থক ক'রে তুলতে হয় ইষ্টে, ইত্যাদি কথা তিনি বলেছেন। আমরা অনেকে সেই প্রসঙ্গ অনুধাবন করিনি। তাই, যখন যা পেয়েছি সংগ্রহ করে রেখেছি-এর দ্বারা যদি কারও সাধন জগতে কিছু সহায়তা করে তবে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
বন্দে পুরুষোত্তমম্।
তাঁরই দীন সন্তান
ভূপেন্দ্রনাথ শিকদার
প্রশ্ন-আচ্ছা, কুলকুণ্ডলিনী কি এবং তাহার স্থানই বা কোথায়? এ সম্বন্ধে দয়া করিয়া বুঝাইয়া দিন।
শ্রীশ্রীঠাকুর-Spinal Cord একটা নলের মতন, fluid দিয়ে ভরা, তার lower end শেষ হয়েছে মূলাধারে, সেটাও fluid দিয়ে ভর্তি; এর upper end cerebellum-এ গিয়ে শেষ হয়েছে, এর ঘাটে ঘাটে nerves-এর গুচ্ছ জড়িয়ে আছে, একে ইংরেজিতে ganglion বলে। এইরকম অনেক ঘাট আছে। Penal gland-এ নামের কম্পন তুললে কিংবা cerebellum-এর centre-এ নামে কম্পন তুললে ঐ মূলাধারে যে fluid আছে তার ভিতর একটা vibration-এর সৃষ্টি হয়। এই কম্পন আস্তে আস্তে fluid-কে এবং তা'র ভিতর দিয়ে different centres বা ganglion-কে আন্দোলিত করতে থাকে এবং এরই অনুপাতে cerebellum-এর কোষগুলি যা' spinal cord-এর কাছাকাছি অবস্থিত তা' elastic ও sensitive হতে থাকে। তারপর দূরের কোষগুলি by induction sensitive হ'য়ে পড়ে। এর ফলে brain cells finer and finer হ'তে থাকে, সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম সাড়া গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। জগৎটাও ঐ brain cells-এর adjustment ও cc-ordination অনুযায়ী বোধ হ'তে থাকে। একটা সামঞ্জস্য, সমাধান ও প্রতীতির ভিতর দিয়ে জীবন চলতে-infinite becoming-এর পথে। যে layer-এর কোষগুলি developed হ'তে থাকে spinal cord-এর ভিতর ganglion-গুলি তদনুযায়ী ফুটে উঠতে থাকে আর তেমন তেমন দর্শন, জ্ঞান ও আনন্দ বোধ হয়। নাম করলে যে তাপের সৃষ্টি হয় তাই জ্যোতিঃরূপে প্রতিভাত হয়। আর inner cumbustion বা adjustment-এর দরুণ যে কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকেই শব্দ বা নাদ বলে, আর spinal cord-এর ভিতর যে সুড়সুড়ে আনন্দ অনুভূত হয় vibration যাতায়াতের দরুণ, তাকেই কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ বলে। Whole nerve-system-কে controi করা যায়, যদি cerebelium-এর cell-গুলি properly adjusted ও co-ordinated হয়, এমন-কি এতে মৃত্যুকেও জয় করা যায়।
প্রশ্ন-মন্ত্র কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর-Mantra is a formulated clue, meditating on which leads to the unfoldment of the cause (মন্ত্র মানে এমনতর সূত্রী-কৃত সঙ্কেত, যার ধ্যান কারণকে উদ্ঘাটিত করে)। মন্ত্রের উদ্গাতার প্রতি নিষ্ঠা নিয়ে অনুরাগভরে নিয়মিত মন্ত্র সাধন করলে wealth of perception (বোধ-বিভূতি) বেড়ে চলে।
প্রশ্ন-বহুপ্রকারের মন্ত্র তো ভারতে প্র্যলিত আছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-বীজমন্ত্র শব্দতত্ত্বের ব্যাপার। এক-এক বীজ বোধভূমির এক-একটা স্তরকে represent (সুচিত) করে। তাই মন্ত্র বহু থাকা স্বাভাবিক। কোন স্থূল স্তরের মন্ত্র বা নামকে চরম মনে ক'রে তাতে আটকে থাকলে মানুষের progress (উন্নতি) blocked (রুদ্ধ) হ'য়ে যায়। সেইজন্য যুগপুরুষোত্তমকে গ্রহণ করার কথা অত ক'রে বলে। কারণ, He is the most evolved Stevolved person in evolution (বিবর্তনের রাজ্যে তিনিই সবচাইতে বিবত্তিত পুরুষ)। তিনি যে holy name (সৎনাম) নিয়ে আসেন, তার মধ্যে অন্য সব নাম নিহিত থাকে। তাই ঐ নাম গ্রহণ ক'রে যদি বিহিতভাবে অনুশীলন করা যায়, তা' খুব effective (কার্য্যকরী) হয়।
(আঃ প্রঃ ১০ম খণ্ড)
দেশবন্ধু-নাম কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর-আমাদের System (শরীর-বিধান)-এর ভিতর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দরুণ প্রতি-নিয়তই যে সমস্ত শব্দ স্বভাবতঃই হচ্ছে তাকেই নাম, নাদ বা বীজ বলে। এই নামের স্থূল সূক্ষ্ম ভেদ হিসাবে স্তরভেদ আছে। হ্রীং, ক্লীং, ও', রং প্রভৃতি প্রত্যেকেই এক একটি স্পন্দন। আমাদের brain-cells (মস্তিষ্ক কোষ)-গুলি বহির্মুখীন প্রবৃত্তির চাপে মুদ্রিত থাকে, কোন বীজমন্ত্র মনোযোগের সহিত মনে মনে উচ্চারণের ফলে, আমাদের, স্নায়ুর উপর ক্রিয়া করিয়া মস্তিষ্কের কোষগুলিকে উত্তেজিত করিয়া তোলে, সেগুলি পূর্বের চেয়ে অধিক সাড়াপ্রবণ হয়, cells (কোষ)-গুলি ফুটে ওঠে, যাহা পূর্ব্বে বোঝা কঠিন হতো তাহা তখন সহজে বুঝা যায়, বুদ্ধি বিকশিত হয়, জ্ঞানের দরজার যেন চাবি খুলে যায়।
শ্রীশ্রীঠাকুর-নাম হ'লো কারণস্বরূপের স্পন্দনাত্মক প্রতিচ্ছবি। আপনি, আমি দুনিয়ার যা'-কিছুই কিন্তু ঐ নামেরই বিবত্তিত রূপ। কারণরূপী যিনি তিনিই সূক্ষ্ম ও স্থূলে পর্য্যবসিত হয়েছেন। সৃজন- ধারার কথা ভাবতে গেলেই পুরুষ-প্রকৃতির কথা আসে, বিজ্ঞান বলে Positive, negative-এর কথ কথা। এই দুইয়ের
মধ্যে আছে আকর্ষণ, বিকর্ষণ, আকুঞ্চন, প্রসারণ। তার মধ্য দিয়েই লীলায়িত হ'য়ে ওঠে স্পন্দন। স্পন্দনে স্পন্দনে আবার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলে। এইভাবে পারস্পরিক সংঘাত সংযোগ-বিয়োগের ভিতর দিয়ে সৃষ্টি গুণিত হ'য়ে চলে ছন্দায়িত তালে। এক-একটির ছন্দ এক- এক-রকম, তাই আমরা দেখতে পাই, সৃষ্টির কোন দুটি জিনিস একরকম নয়, প্রত্যেকটিই বিশিষ্ট। সমজাতীয় বৈশিষ্ট্যের এই গুচ্ছকেই বলা হয় বর্ণ', তাই বর্ণ' জিনিসটা কিন্তু মানুষের তৈরী নয়। এটা সৃষ্টির মধ্যেই অনুস্যুত। ফলকথা, বৈশিষ্ট্যবান স্পন্দনের ঘাত-প্রতিঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিপ্লব চলছে দুনিয়াময়। তার মধ্য দিয়েই সৃষ্টি নিত্য নবীনভাবে উৎসারিত হ'চ্ছে-কারণ হ'তে সূক্ষ্মে, সূক্ষ্ম হ'তে স্থূলে। স্থূল থেকে সূক্ষ্ম ও কারণ-রাজ্যে যদি যেতে হয়, তবে যে স্পন্দন নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও রকমারির ভিতর দিয়ে এত পথ বেয়ে আজ এই হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকে অনুসরণ ক'রেই যেতে হবে। নাম হ'লো সেই স্পন্দনেরই প্রাণবীজ, যে-কোন স্পন্দনের মরকোচ আছে এই নামের মধ্যে। তাই একে বলা হয় অনামী নাম। এই নাম যদি ঠিক ঠিক ভাবে অনুশীলন করেন- নামীর প্রতি অনুরাগ নিয়ে, তবে আপনার সমস্ত অতীত আপনার সামনে উদ্ভাসিত ও উদ্ঘাটিত হ'য়ে উঠবে। আপনি একেবারে মূলে চ'লে যেতে পারবেন। যেমন ধরেন, আপনার সামনে একগাছ দড়ি প'ড়ে আছে, সেই দড়িটা বাঁধা আছে দূরে একটা গাছের সঙ্গে, কোন্ গাছের সঙ্গে বাঁধা আছে, তা' যদি আপনি জানতে চান, এই দড়িটা ধ'রে এগিয়ে গেলেই তা' জানতে পারবেন। নাম ও নামীও তেমনি এই অজানাপথে আমাদের একমাত্র অবলম্বন।
(আঃ প্রঃ ২য় খন্ড)
প্রশ্ন-নামধ্যানের তত্ত্ব-সম্বন্ধে আপনি দয়া করে কিছু বলুন।
শ্রীশ্রীঠাকুর-নামই হ'ল বিশ্বচরাচরের প্রতিটি সত্তার মূল ভিত্তি। তাই নামকে জানলে আত্মতত্ত্ব জানা যায়। নামকে জানতে গেলে নামীর শরণাপন্ন হ'তে হয়। নামী মানে যিনি নামস্বরূপ অর্থাৎ নামের মূর্ত্ত বিগ্রহ। তিনি হলেন দয়ীপুরুষ। জীবের প্রতি করুণাবশে তিনি মানুষ হ'য়ে আসেন, যাতে মানুষ তাঁকে ধ'রে দয়াল দেশে পৌঁছাতে পারে। নাম প্রেরণা জোগায় আর ধ্যান মানুষকে ধ্যেয়ের ভাবে ভাবিত ক'রে তদভিমুখী ও তৎচলনপরায়ণ ক'রে তোলে। যার-তার ধ্যান করতে নেই, কারণ তাতে ধ্যেয়ের মধ্যে যদি কোন imperfection (অপূর্ণতা) বা unsolved knot (অসমাহিত গ্রন্থি) থাকে, তবে তা ধ্যানীর মধ্যে transmitted (সঞ্চারিত) হ'য়ে যেতে পারে। উপর থেকে যিনি perfection-এর (পূর্ণতার) তকমা নিয়ে আসেন, তিনিই ধ্যেয়। কারণ, He is the highest and best guide and goad to human evolution (তিনি হলেন মানব-বিবর্ত্ত'নের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক ও অনুপ্রেরক)। পুরুষোত্তমকে যারা জীবদ্দশায় পায়, তারা যদি তাঁর প্রতি অনুরক্ত হ'য়ে তাঁর সঙ্গ, অনুসরণ, অনুচৰ্য্যা ও তীব্র কর্ম'সহ নিষ্ঠাসহকারে নামধ্যান করে, তবে অল্প সময়ের মধ্যে ঢের এগিয়ে যেতে পারে। পুরুষোত্তমই ইষ্ট, পুরুষোত্তমই ধ্যেয়। তাঁর অন্তর্ধানের পরও তিনিই মানুষের ইষ্ট ও ধ্যেয় হ'য়ে থাকেন, যতদিন পর্য্যন্ত তাঁর পুনরাবির্ভাব না ঘটে। তাঁর অনুগামীদের কাজ হ'ল তাঁকেই লোকসমক্ষে তুলে ধরা। মানুষের প্রাপ্তব্য হ'লেন ঈশ্বর এবং পুরুষোত্তমই হ'লেন রক্তমাংসসঙ্কুল আমান ঈশ্বর। আবার পুরুষোত্তমকে নিজ জীবন দিয়ে যিনি যতখানি অবিকৃত-ভাবে, ধারণ, বহন, প্রতিষ্ঠা ও প্রকাশ করেন, যাঁর চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব যতখানি ইষ্টানুরাগসন্দীপী, তিনি ততখানি পূজনীয় মানুষের কাছে।
(আঃ প্রঃ ১১ খণ্ড)
প্রশ্ন-(প্রফুল্লদা) নামী ছাড়া অন্য কাউকে ধ্যান করলে কি হয় না?
শ্রীশ্রীঠাকুর-নাম-নামী অভিন্ন। নাম করার সঙ্গে সঙ্গে নামীকে ধ্যান অর্থাৎ চিন্তা করতে হয়। তাতে জপ ও ধ্যান একলক্ষ্যাভিমুখী হ'য়ে পারস্পরিকভাবে পরিপূরণী হ'য়ে ওঠে। নাম ও নামীর সঙ্গে প্রতিটি সত্তার সম্বন্ধ নিত্য ও অবিচ্ছেদ্য। তাই বলে জীব নিত্য কৃষ্ণদাস। যাঁর সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ নিত্য নয় এবং যিনি চরমধামের মালিক নন তাঁর ধ্যানে মানুষ নিত্য ও চরমধামে উপনীত হ'তে পারে না। ধ্যেয় যদি নামের মুর্ত্ত' প্রতীক না হ'য়ে অন্য কিছু হন, তবে নামের গন্তব্যে যাওয়া যাবে না। হয় মাঝপথে থেমে যেতে হয়, না-হয় দোটানা অবস্থার সৃষ্টি হয়। জপ্য নাম যাঁর দ্যোতক, তাঁকেই ধ্যান করতে হয়। নইলে integrated evolution (সংহত বিবর্ত্তন) hampered (ব্যাহত) হয়, এমন-কি সাধকের জীবন ওতে bifur- cated (দ্বিধাবিভক্ত) হ'য়ে যেতে পারে, কারণ, নাম তাকে দেয় এক impulse (প্রেরণা) আর ধ্যান তাকে দেয় আর এক impulse (প্রেরণা)। নাম যে স্বরূপ-সচেতন, ঈশিত্ব-অধ্যুষিত ব্যক্তিত্বকে সুচিত করে, সেই তাঁকে ছাড়। অন্যকে ধ্যান করলে নামধ্যানের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। (বিজ্ঞান), সাধন-তপস্যা একটা science (বিজ্ঞান,) আবোল-তাবোল যা' তা' করলে evolution (বিবর্তন) হয়না হয়ে devolution (অপবর্ত্ত'ন) হ'বার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। তাই তো ধর্ম্মে'র দেশ ভারতে আজ মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর, ধর্ম্মে'র নামে চলে অজান, আত্মম্ভরী মানুষদের আজব ধরণের আজগবী।
(আঃ প্রঃ ১১ খণ্ড)
নামী লাগবে কেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর-নামী হলেন তিনি যিনি নামের চেতন মূর্ত প্রতীক বা নামকে উপলব্ধি করেছেন জীবনে, এক-কথায় নাম যাঁর মধ্যে জীবন্ত, বাস্তবায়িত, আয়ত্তীকৃত। নামের উপলব্ধির উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বের যা-কিছুই তাঁর কাছে ব্যাখ্যাত ও অর্থপূর্ণ হ'য়ে উঠেছে-করা, বলা, ভাবার সুসঙ্গত সমন্বয়ে, সপরিবেশ জীবনবৃদ্ধির সার্থকতায়। নামকে যদি এমনভাবে আমার জীবনে সাথ'ক ক'রে তুলতে চাই, তবে ঐ নামীকে অনুসরণ ক'রেই তা' সম্ভব। নাম আমার মধ্যে জীয়ন্তই হ'য়ে উঠবে না, ঐ নামীর সঙ্গে যোগ ছাড়া। তাই বলে-তজ্জপস্তদর্থ ভাবনঞ্চ। তদর্থ'ভাবনা মানে নাম যা'তে সার্থক হয়েছে, নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তেমনতর হ'য়ে ওঠা, ভাবনার মধ্যে আছে হওয়া, শুধু চিন্তা নয়। আবার কিছু হ'তে গেলে তাঁর জীবন্ত রূপটি আমার সামনে থাকা চাই। তাঁর নির্দেশ চ'লেই আমি তবে সহজে হ'তে পারব-আমার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমি যেমন হ'তে পারি। এর মূল জিনিস হ'লো, তাঁ'তে সক্রিয় প্রাণের যোগ, টানের যোগ। তাই দেখুন নামীর প্রয়োজন কোথায়?
(আঃ প্রঃ ২য় খণ্ড)
বীজমন্ত্র
(১) অচ্যুত ইষ্টনিষ্ঠ হয়েই-
বীজমন্ত্র জপ করতে হয়,
নতুবা বিকেন্দ্রিয়তায়
বিক্ষেপই নিয়ে আসে-
তাই যোগের সার্থক মরকোচই
হচ্ছে অচ্যুত ইষ্টানুরাগ
অর্থাৎ ইষ্টে অচ্যুত ভাবে যুক্ত হওয়া-
আর করা-সার্থকতায়।
(২) ব্যোমতরঙ্গের বিভিন্ন
রকম ও স্তর
যা মূর্ত্ত' হ'য়ে প্রকট হয়েছে-
নানা ভাবে,-রকমে
সেই অন্তর্নিহিত তারঙ্গিক
প্রতিশব্দই হচ্ছে বীজমন্ত্র।
(৩) বীজ কথার মানেই হ'লো-
যা দু'দিকেই গজিয়ে ওঠে-
ভেতরে-বাইরে,
বীজমন্ত্র জপে সত্তা তরঙ্গ
এমন উস্কানি পায়-
যার ফলে বৈধানিক পরিণয়নে
অনেক কিছুরই অনুভূতি
অন্তরে বিকশিত হ'য়ে ওঠে,
তার প্রতিফলনে-
বাহ্যিক দর্শনও
অন্তধী সম্পন্ন হয়।
(৪) বীজ যেমন তার উপযুক্ত মাটিতে
যথাযথ অচ্যুত ভাবে
যুক্ত না হলে অঙ্কুরিত হয় না-
তেমনি আচার্য্যে, আদর্শে বা ইষ্টে
যথাবিহিত অচ্যুতভাবে যুক্ত হয়ে
তপশ্চরণ না করলে
বীজমন্ত্র ও অঙ্কুরিত বা উদ্গত
হয় না-কি বাইরে-কি ভিতরে।
(যতি অভিধর্ম')
প্রশ্ন-আমাদের নিরুদ্ধ গ্রন্থিগুলি নিরসন ও সমাধানের উপায় কি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর-উপায় ঐ ইষ্টস্বার্থ-প্রতিষ্ঠার urge (আকূতি)। নামধ্যানে ওগুলি জেগে উঠতে থাকে, এবং তার নিয়ন্ত্রণ, সামঞ্জস্য, সমাধানের পথ আবিষ্কৃত হয়। "ইষ্ট আর ইষ্টস্বার্থে' মনের আনাগোনা, এমনি ক'রে ধ্যানে আসে চিত্ত-সংযোজনা।” মস্তিষ্ককোষগুলি নামের তরঙ্গে যতই আন্দোলিত ও আলোড়িত হ'তে থাকে, ততই ওগুলির ভিতর অনুস্যুত নানা ছাপ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। অনেক বীভৎস চিন্তা, কল্পনা ও প্রবৃত্তি হাজির হতে থাকে। অনেকে ঐ সব দেখে আঁতকে ওঠে, ভাবে 'আমার বুঝি অধোগতি হ'চ্ছে, আবার কেউ-কেউ, মন একাগ্র ও সংযত হ'চ্ছে না, মনের চঞ্চলতা ও মলিনতা বেড়ে যা'চ্ছে ইত্যাদি ভেবে নাম করা ছেড়ে দেয়। তা' কিন্তু ঠিক নয়। নামে সুপ্ত গুপ্ত যা', তা' যে আত্মপ্রকাশ করে, সেইটেই লাভ, তখন বোঝা যায় নামের ক্রিয়া হ'চ্ছে, কিন্তু ধ্যানসমন্বিত নাম চাই। মনের কোণে যাই উ'কি মারুক না কেন, ধ্যানের সাহায্যে সেটাকে ইষ্টের সঙ্গে সঙ্গতিশীল ও ইষ্টার্থ' পূরক ক'রে তোলার কায়দাটা মাথায় এ'চে নিতে হয়, আবার বাস্তব কর্মক্ষেত্রে হাতে-কলমে করতেও হয় তেমনি। এমনতর ক'রে চলার মধ্য-দিয়ে ওগুলির সমাধান ও নিরসন হয়, নচেৎ ধামাচাপা দেওয়া অবস্থায় থাকে। কখন যে কোন প্রবৃত্তি বেঘোরে ফেলে তার ঠিকানা নেই।
প্রশ্ন-ধরুন, নামধ্যানের সময় একটা জঘন্য চিন্তা আমার মাথায় এলো, তখন কি করব?
শ্রীশ্রীঠাকুর-অস্তি-বৃদ্ধির বিরোধী যা', ইন্টস্বার্থ-প্রতিষ্ঠার প্রতিকূল যা' তাকেই বলতে পারেন জঘন্য। এখন আপনার কাছে যা' জঘন্য হ'য়ে আছে, তাকেই আপনি সুষ্ঠু ও সুন্দর ক'রে তুলতে পারেন, যদি তা'কে অস্তিবৃদ্ধি-অনুগ ও ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠার সহায়ক ক'রে তুলতে পারেন। ধরুন, কোন মেয়েছেলের প্রতি অবাঞ্ছিত অনুরাগ আছে আপনার, এবং এটা আপনার মনের তলায় চাপা আছে, নাম-ধ্যানের সময় সেই চিন্তাটা ভেসে উঠলো, তখন ঐ চিন্তায় অস্থির হ'য়ে আপনি ওটাকে যতই তাড়াতে চেষ্টা করছেন, ততই যেন ওটা আপনাকে পেয়ে বসছে। কিন্তু তখন যদি আপনি চিন্তা করেন, আমি যদি ভালই বাসি কাউকে, তার যাতে ভাল হয় তাই তো আমার করণীয়। পরমপিতার কাছে তার মঙ্গলের জন্য যদি প্রার্থনা করেন, সে যা'তে ইন্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠাপন্ন হয়, সুখী হয়, সেজন্য আপনার যদি কিছু করবার থাকে, সম্মানযোগ্য ব্যবধান বজায় রেখে আপনার বংশ-মর্য্যাদা ও ইষ্টগৌরব স্মরণে রেখে তা' কিভাবে করা যায় তার কোন উপায় যদি আপনি চিন্তা করেন তা' তো দোষণীয় হবে না। বরং ঐ চিন্তা ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে গ্রথিত হওয়ার দরুন মঙ্গলপ্রসুই হবে। একেই বলে নিয়ন্ত্রণ, সামঞ্জস্য, সমাধান। সমাধান শুধু মাথায় আসলেই হবে না, তাকে কাজের মধ্য দিয়ে বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে। ধরুন, একজনের প্রতি গভীর বিদ্বেষভাব পোষণ করেন, ধ্যানের সময় ঐ চিন্তা আপনাকে পীড়া দিচ্ছে। আপনি হয়তো ধ্যানে ব'সে ঠিক করলেন, তার সঙ্গে এর পর থেকে বন্ধুর মত মিশব, আজই তার বাড়ীতে যাব, আমার গাছের একটা লাউ হাতে ক'রে নিয়ে, আর তার ছেলেপেলেদের জন্য কিছু চিনেবাদাম নিয়ে যাব। কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রে ভিতরের নিরোধ-প্রবৃত্তির দরুণ তা' আপনি করলেন না, আর মনে-মনে হয়তো ভাবলেন, আমার অন্তরে বিদ্বেষ না থাকলেই হ'লো, বাইরে এসব করার দরকার কি? কিন্তু James বলেছেন-It is purpose that God looks at, and not the intention. Purpose-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে Set forth, অর্থাৎ কি উদ্দেশ্য নিয়ে কি কাজের মধ্যে তুমি নিজেকে ন্যাস্ত করেছ সেইটে হলো কথা; তোমার অলস ইচ্ছার কোন দাম নাই।
প্রশ্ন-নাম-ধ্যানের সময় চঞ্চল মনের পিছনে যদি ছুটতে হয়, তাহ'লে চঞ্চলতা বেড়েই যাবে, মন আর স্থির হবে না।
শ্রীশ্রীঠাকুর-তুমি তো মনের পিছনে ছুটবে না, ছুটবে ইষ্টের পাছে, তোমার যা' আছে তাই নিয়ে তোমার ভালমন্দ সব-কিছুকেই ইষ্টের হাতিয়ার ক'রে নিতে হবে। ইষ্টকে কেন্দ্র ক'রে তোমার ভালমন্দ সব-কিছুকে readjust (নবীন ভাবে বিনায়িত) ক'রে তুলতে হবে। এই যদি না কর, তবে তোমার undivided personality (অখন্ড ব্যক্তিত্ব) গ'ড়ে উঠবে না। তোমার তথাকথিত ভালটাকে যদি ইষ্টের কাজে লাগাতে পার, তথাকথিত মন্দটাকেই বা লাগাতে পারবে না কেন? সব প্রবৃত্তিকেই যে তাঁর কাজে লাগান যায়, এই লাগানটাই ধর্ম'। জীবনের ক্ষেত্রে সর্ব'প্রবৃত্তিরই উপযোগিতা আছে, যদি তা' ধর্মানুগ হয়, ইষ্টানুগ হয়। তুমি যেটাকে ছোঁটে-কেটে বাদ দেবে-সেইটের সেবা ও সুফল থেকে ততখানি বঞ্চিত হবে। ধর, তুমি ক্রোধী, এই ক্রোধ বিসর্জন দিতে গিয়ে যদি তুমি righteous indignation অর্থাৎ পরাক্রমকে বিদায় দাও, তাহ'লে তোমার জীবনই দুর্ব্বহ হ'য়ে উঠবে আর দিন-দিন অসৎকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হবে। আবার, একটা প্রবৃত্তিও যদি তোমার ইষ্টার্থ'-সংন্যস্ত হ'তে বাকী থাকে, অসংলগ্ন থাকে, তবে তার প্ররোচনায় তুমি কখন যে কী করতে পার, তার ঠিক নেই, অমনতর বিচ্ছিন্ন জীবন কখনই নির্ভরযোগ্য নয়। চঞ্চলতা হ'লো মনের ধর্ম', চঞ্চলতা লাখ বাড়ুক তা'তে ক্ষতি নেই, যদি তা, ইষ্টার্থে' হয়। বিভিন্ন প্রকারের চঞ্চলতা যখন ইষ্টার্থী হ'য়ে আসে তখনই আসে স্থৈর্য্য, তখনই আসে সাম্যভাব, অর্থাৎ balance. তখন লাখো কর্ম' ও দায়িত্বের মধ্যেও আমরা দিশেহারা হই না, সবটাকে সুসামঞ্জস্যে অন্বিত ক'রে তোলার শক্তি গজায় অসীম। আর এটা খুব ঠিক কথা, মানুষ যতই ইষ্টময় হ'য়ে উঠতে থাকে, ততই তার শরীর-মনের অবান্তর বিক্ষেপ ও বিশৃঙ্খলা স্তিমিত হ'য়ে আসতে থাকে। উত্তাল কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যেও সে গভীর প্রশান্তি অনুভব করে। তথাকথিত ভাল-মন্দের দ্বারা সে বড় একটা আবিষ্ট হয় না, সাক্ষীস্বরূপ সবই দেখে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ, সামঞ্জস্য, সমাধান, বিনিয়োগ, প্রত্যাহার, উপেক্ষা বা তিতিক্ষা যেখানে যেমন প্রয়োজন তাই-ই ক'রে চলে। জীবনকে নিয়ে সে তখন আর বিব্রত বোধ করে না। তাই বলে 'যোগঃ কর্ম্মসু কৌশলম্'। এই যুক্তি যে, তার জীবনে বৈচিত্র্যের অভাব থাকে না, কিন্তু তাই ব'লে ব্যাঁতক্রমী চলন থাকে না। কারণ, একের জন্যই সে বহুকে চায়, সর্বাবস্থায় একের অর্থাৎ ইষ্টের পরিপূরণ ও পরিচর্য্যাই তার লক্ষ্য। তাই সব বৈচিত্র্য 'সূত্রে মণিগণা ইব' মালাকারে গ্রথিত হ'য়ে ওঠে, chaos (বিশৃঙ্খলা) cosmos-এ (শৃঙ্খলায়) পর্য্যবসিত হয়।
(আঃ প্রঃ ২য় খন্ড)
প্রশ্ন-(কিশোরীদা) কাজকর্ম' বাদ দিয়ে কেউ যদি শুধু নাম-ধ্যান নিয়ে থাকে, তা'তে কি তা'র পূর্ণ' বিকাশ হয় না?
শ্রীশ্রীঠাকুর-প্রধান কথা হ'লো নামীর প্রতি উর্জ্জী আনতি ও অনুরাগ। সেই আনতি ও অনুরাগ থাকলে তাঁর প্রীতি-কথা ও প্রীতি- কর্ম্মে'র প্রতিও ঝোঁক গজায়। নিজের সব শক্তি-দিয়েই তাঁকে তুষ্ট, পুষ্ট করার বুদ্ধি হয়-চলন, চরিত্র তদনুগ ক'রে তুলতে ইচ্ছা হয়-যাতে তিনি নন্দিত হন। আরো মনে হয়, সবাইকেই তদ্ভাবভাবিত ক'রে তুলি, তদাকারাকারিত ক'রে তুলি-প্রত্যেককে তাঁ'র বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী। তাই, নামধ্যান ঠিক ঠিক হলে ঐ নামধ্যানই করা-বলার দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে। আবার, করা-বলা বাদ দিয়ে নামধ্যানও ঠিকমত হয় কিনা সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। শুধু যদি খাওয়া যায়, আর হাগা যদি একদম না হয়, তাহ'লে যেমন বদহজম হয়-খাবার স্পৃহা থাকে না, শুধু Sensory engorgement (বোধমুখী ভরণ) যদি হয়, আর motor outlet (কর্মপ্রবাহী নিঃসরণ) যদি না-থাকে, তাহ'লে মনোরাজ্যে তেমনি একটা অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া অসম্ভব নয়। ওতে মানুষ unbalanced (সাম্যহারা) হ'য়ে পড়ে। আমার সত্তার সব-কিছুর ভিতর তাঁকে যদি অনুপ্রবিষ্ট ক'রে তুলতে চাই, তবে আমার সব-কিছুই সক্রিয়ভাবে তাঁর সেবায় লাগান চাই। যে-দিকটা অসংলগ্ন থাকবে, সে-দিকটায় তাঁর ছাপ পড়বে না, অযুক্ত ও অনুজ্জল থেকে যাবে, পূর্ণ' বিকাশের পথে অতোখানি খাঁকতি থেকে যাবে। আমাদের মধ্যে কতকগুলি বিকৃত ও একপেশে ধারণার উদ্ভব হয়েছে। বৌ-ছেলেকে ভালবাসতে গিয়ে আমরা কিন্তু কখনও একথা ভাবি না যে শুধু তাদের কথা ভাবব, তাদের জন্য বাস্তবে কিছু করব না। তাদের বেলায় সেটা যদি প্রযোজ্য না হয়, ভগবানুকে তথা ইষ্টকে ভালবাসার বেলায় সেটা প্রযোজ্য হবে কেন? ভালবাসার জনের জন্য মানুষের করণীয়ের অন্ত নেই। যত করা যায়, তত দেখা যায় আরো বহু-কিছু করবার আছে। আর, ভগবানুকে ভালবাসলে তাঁর খাতিরে প্রত্যেকটি সত্তাকে ভালবাসতে হয়, প্রত্যেকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সার্থকতার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করতে হয়। কেউ যদি বাপ-মাকে ভালবাসে, তাহ'লে কি সে কখনও ভাই-বোনদের সম্বন্ধে উদাসীন থাকতে পারে? ভক্তের করণীয়ের কি কোন লেখাজোখা আছে? এই কর্ম' কিন্তু তা'র সেবাযজ্ঞ, পূজাপরিক্রমা, সাধনভজনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নামধ্যান ও কর্ম' তা'র ওতপ্রোতভাবে জড়ান। আর, সব-কিছুই তা'র ইষ্টের জন্য। পরিবেশের সেবা যতই মহৎ কাজ হো'ক-তা' যদি ইষ্টার্থে না হয় তা একটা unsolved complex (অসমাহিত গ্রন্থি)-এর মত থেকে যেতে পারে, এবং তা'তেও মানুষের অকল্যাণ হ'তে পারে।
(আঃ প্রঃ ৫)
শ্রীশ্রীঠাকুর-দ্যাখেন, যে জিনিস আপনারা পেয়েছেন, ভাল ক'রে অনুশীলন করেন। এ বড় সাচ্চা মাল, করলে হাতে-হাতে ফল, অবশ্য ফলের লোভে কিছু করতে যাবেন না। নাম-ধ্যান নেশার মত চালিয়ে যান, একটা দিনও বাদ দেবেন না। নিয়মিত বসা, নিয়মিত করা-এ খুব ভাল। ভাল না লাগলেও করা ভাল, করতে-করতে রস জ'মে ওঠে। নিজের মত ক'রে অনুভব না করলে মানুষের প্রত্যয় পাকা হয় না। নাম যত করবেন, কাজকর্মও তত ভাল ক'রে করতে পারবেন, উৎসাহ, উদ্দীপনা ও শক্তির অভাব বোধ করবেন না। অনেকে আছে, নাম করতে-করতে বুঁদ হ'য়ে পড়ে, কোন কাজকর্মে মন দিতে চায় না, ও কিন্তু ভাল নয়। ওতে কিছুদিন পরে মানুষ নিথর হ'য়ে পড়ে। নাম-ধ্যান, অনুভূতি ইত্যাদি ব্যাপারেও অগ্রগতি থেমে যায়, চড়ায় ঠেকে যাওয়ার মত হয়। কিন্তু নাম-ধ্যান ও কাজকর্ম যারা নিত্যনিয়মিত ক'রে যায়, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে সুবিধা হয়। সংঘাতের ভিতর না পড়লে নিজের দোষ-দুর্ব্বলতাগুলি ধরা পড়ে না, আর কর্মক্ষেত্রে বাস্তবে সেগুলি সংশোধন করা ছাড়া, মনে-মনে সংশোধন করলে হবে না। তাই যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি এগুলি সমান তালে তো করবেনই, তা'ছাড়া আপনাদের যাকে যখন যা' করতে বলি, তা' কাঁটায়-কাঁটায় করতে চেষ্টা করবেন। এই বলার পেছনে আমার অনেক-কিছু উদ্দেশ্য থাকে, কিন্তু যখন যা' বলি তখন যদি তা' না করেন, তাহ'লে বড় অসুবিধার কারণ হয়। আবার কিন্তু ঠিকমত করলে অনেকবিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারেন, শুধু বিপর্য্যয়ের হাত থেকে বাঁচা নয়, becoming (বিবর্দ্ধন)-এর পথও অনেকখানি খুলে যায়। এক-একজন যে কী হ'য়ে উঠতে পারেন, তার ঠিক নেই।
প্রশ্ন-নাম-ধ্যানে আয়ু বৃদ্ধি পায় না?
শ্রীশ্রীঠাকুর-তা' পায় বই কি? অন্ততঃ হাতের মধ্যে যতখানি potency (সম্ভাব্যতা) আছে তার পুরো সুযোগ পাওয়া যায়। নাম- ধ্যানে vital current (প্রাণস্রোত) উদ্বেলিত ও পুষ্ট হ'য়ে ওঠে। এমন-কি নামের সাহায্যে বহু দূরারোগ্য রোগ সারান যায়, মুমুর্ষ, রোগীকে বাঁচান যায়। কুষ্টিয়ায় ওরা অনেক করেছে।
প্রশ্ন-(কিশোরীদা) সাধনার পথে 'নামে রতি' নাকি একান্ত প্রয়োজন? সেই 'নামে রতি' আসে কি-ক'রে?
শ্রীশ্রীঠাকুর-রতি মানে অনুরাগ। নাম করতে-করতে নামীর প্রতি অনুরাগ বাড়ে। নামীর প্রতি যত অনুরাগ বাড়ে, নামের প্রতিও তত অনুরাগ বাড়ে। কারণ, নাম করলে নামীর কথাই মনে পড়ে। যা'কে ভালবাসা যায়, তাঁ'র চলন-চরিত্র, চেহারা, গুণাবলী ও লীলাকথা স্মরণ-মনন করতে ভাল লাগে। এ ভাল-লাগার সঙ্গে-সঙ্গে ইচ্ছা হয় নিজের চলন-চরিত্রকে নিজ বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী তদনুগ ক'রে তুলতে। এর ভিতর-দিয়ে আসে নিরখ-পরখ। নিজের দোষগুণ যেমন-যেমন বোঝা যায়, তেমন-তেমন আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছে করে। মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ যতই করে ততই দেখে যে এর শেষ নেই। এই প্রয়োজন-বোধের থেকে মানুষ আবার নিরন্তর নাম করবার প্রয়োজন বোধ করে। তাছাড়া ইষ্টের অফুরন্ত চাহিদা ও ইচ্ছা পুরণ করতে গিয়ে মানুষ সর্বদাই নিজের শক্তির অসম্পূর্ণতা সম্বন্ধে সচেতন হয়। ঐ শক্তির সন্ধানে মানুষ তখন নামের শরণাপন্ন হয়। যত নাম করে ও তাঁ'র পথে চলে ততই বোধ করে-ভিতর থেকে কে যেন অনবরত শক্তি ও বুদ্ধি জুগিয়ে যাচ্ছে। তাই, ইষ্টের সম্বন্ধে actively interested (সক্রিয়ভাবে অন্তরাসী) হ'লে নামে রুচি আপনা-থেকে আসে। নামীর সঙ্গে প্রণয় বাদ দিয়ে শুধু mechanically (যান্ত্রিকভাবে) নাম করলে বেশী কিছু হয় ব'লে আমার মনে হয় না। তবে নাম করতে গেলে নামীর দিকে নজর পড়েই। আর, নামের সঙ্গে আছে আমাদের সত্তার যোগ। তাই, নাম করতে-করতে মন সত্তামুখী হয়, কারণমুখী হয়, উৎসমুখী হয়। নাম যত করা যায়, তত নামের উপর লোভ বাড়ে-সে দুর্নিবার আকর্ষণ ত্যাগ করা যায় না, ক্রমাগত আরো গভীরে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করে। ইষ্টচিন্তা, ইষ্টকথা ও ইষ্টকর্ম' এই নিয়ে মগ্ন থাকতে ভাল লাগে। তখন আসক্তির বিষয়ই হন ইষ্ট। এই আসক্তি প্রবৃত্তি- আসক্তির থেকে অনেক প্রবল। তবে, মাঝে-মাঝে একটা নিরস ভাবও আসে, ভিতরটা যেন শুকিয়ে যায়, নামে রস পাওয়া যায় না। তখনও কিন্তু জোর ক'রে নাম চালাতে হয়, লেগে থাকতে হয়, লেগে থাকতে-থাকতে আবার ঠিক হ'য়ে আসে। Depression (অবসাদ)-এর পর অনেক সময় বন্যার মত আবেগ আসে। তাই, গোঁ ধরে থাকতে হয়। কারণ, তাঁ'কে যে আমার চাই-ই, তাঁ'কে বাদ-দিয়ে জীবন যে অচল। মানুষ জীবনে যত যা-ই করুক, কোনটাই সার্থকতা লাভ করে না, যতদিন সে ইষ্টকে কায়মনঃপ্রাণে ভালবাসতে না-পারে। ভালবাসার ধাঁজে চলতে-চলতে ভালবাসাটা স্বতঃ হ'য়ে ওঠে। সেই বুদ্ধিই সার বুদ্ধি-যে-বুদ্ধি মানুষকে ইষ্টে একান্ত ক'রে তোলে। একেই বলে অব্যভিচারী ভক্তি। ইষ্টকে যদি আমার সুখ-সুবিধার জন্য ডাকি, আমার সুখ-সুবিধার জন্য ভালবাসি, তাহ'লে সেটা হ'লো ব্যভিচারী ভক্তি। তাঁর জন্য তাঁ'কে যে ভালবাসে, সে ধন্য হ'য়ে যায়, পবিত্র হ'য়ে যায়। তাঁ'র ভিতর আর কোন কলুষ বা মালিন্য থাকে না। তাই গীতায় আছে-'অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামন্যভাক্ , সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যক্ ব্যবসিতো হি সঃ?' অনন্যভাক্ বলতে আমি বুঝি-একমাত্র তাঁকেই ভজনা করে যে এবং সে শুধু তাঁরই জন্য। প্রাণ যা'র কোঁদে ওঠে তাঁ'র জন্য। সে-ই এটা পারে। কত সাধু পারে না, আবার হয়তো পাপী-তাপী লহমায় পেরে যায়। যে-পারে সে-ই ভাগ্যবান।
(আঃ প্রঃ ৫ম খণ্ড)
প্রশ্ন-যদি কেউ অন্যত্র দীক্ষিত থাকে তাহ'লে সে কি সদ্গুরুর দীক্ষা গ্রহণ করতে পারে?
শ্রীশ্রীঠাকুর-জীবন্ত সদ্গুরু গ্রহণে কারও পক্ষে কোনও বাধা নেই। যে-যা করছে সেই করাটাই সার্থক ও তীব্র গতি-সম্পন্ন হ'য়ে ওঠে সদ্গুরু প্রদত্ত নির্দেশের অনুশীলনের ভিতর-দিয়ে। সৎনাম সর্ববীজাত্মক। এতে কোন নাম বাদ পড়ে না। যা' থেকে সব নাম, সব মন্ত্র, সব শব্দ, সব সৃষ্টি উদ্ভুত হয়েছে তাই হ'ল সৎনাম। সৎনাম সার্বজনীন। এটা কোন সংস্কার-প্রসূত জিনিস নয়। মূলতঃ যে তত্ত্ব অর্থাৎ তাহাত্ব সর্বত্র নানাভাবে ক্রিয়াশীল ও প্রকাশশীল, সৎনাম তারই দ্যোতক। তাই বলে শব্দব্রহ্ম। পৃথিবীর সব মানুষের পক্ষে এটা এক। তবে এক-এক স্তরের অনুভূতি এক-এক রকমের। একাগ্রতা ও স্নায়ুর সুক্ষয় সাড়াশীলতা যার যেমনতর সে তেমনতরই বোধ করতে পারে। সম একাগ্রতা ও স্নায়ুর সূক্ষর সাড়াশীলতাসম্পন্ন একজন ভারতবাসী ও একজন ইউরোপীয়ের শব্দানুভূতির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না-- তা' তারা যে-কোন সম্প্রদায়েরই লোক হোক না কেন। এক কথায় আধ্যাত্ম-বিজ্ঞান জড়বিজ্ঞানেরই মত সর্বত্র সমভাবে ক্রিয়াশীল। আমি বুঝি সদগুরু ও সৎমন্ত্র সকলেরই গ্রহণীয়। তাতে কিছুই ছাড়া হয় না। যে স্তরে আছি সেখান থেকে আরও উপরে উঠার শক্তি ও প্রেরণা সংগ্রহ করা হয়।
(আঃ প্রঃ ১০ম খন্ড)
শ্রীশ্রীঠাকুর-spirit (আত্মা)-এর মধ্যে আছে spirare-to breathe (শ্বাস নেওয়া), বিশ্বাসের মধ্যেও আছে শ্বাস নেওয়া। যার উপর দাঁড়িয়ে প্রাণন-সম্বেগ এগিয়ে চলে তাকেই বলে আধ্যাত্মিক চলন বা বিশ্বাস। আধ্যাত্মিকতার মধ্যে আছে অধি-আত্মিকতা, অধিকার বা অবলম্বন ক'রে চলা। যার প্রতি মুহূর্ত্তে'র শ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ চিন্তা ও কর্মপ্রয়াস পরমপিতার অনুবর্তী হ'য়ে চলে তাকেই বলে বিশ্বাসী মানুষ বা আধ্যাত্মিকতা-সম্পন্ন মানুষ। এমনতর চলনে চলে যারা, জাগতিক উন্নতিও তাদের অবশ্যম্ভাবী। তাই, দুইয়ের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। এক কথায় এ-দুটো একই জিনিসের দুটো দিক্। বাস্তব ব্যাপার দুটো নয়। সবটা মিলিয়ে একটা।
প্রশ্ন-আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর-আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য। আত্ম-নিয়ন্ত্রণ না হ'লে ব্যক্তিত্ব খণ্ডিত থেকে যায়। সব দিকার সঙ্গতি হয় না। আমাদের বহু বৃত্তি আছে। তার তার মধ্যে ষড়রিপু প্রধান । এদের আবার বহু division (ভাগ) আছে। এইগুলির হুচকিতে মানুষ ভুলে যায়। ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকে না। Passion (প্রবৃত্তি) check (দমন) করতে পারে না। তাই, আমাদের বাইরে above-এ (ঊদ্ধে') এমন একজন superior (গুরুজন) চাই যাঁকে খুলী করার প্রলোভনে বৃত্তির প্রলোভন বা প্ররোচনা এড়িয়ে চলা যায়। সেই মানুষটির আবার শ্রেয়প্রাণতার ভিতর দিয়ে adjusted (নিয়ন্ত্রিত) হওয়া চাই। এমনতর সক্রিয় শ্রেয়প্রাণ চলনাকে আমি বলি আধ্যাত্মিকতা। নইলে disintegration (ভাঙ্গন) আসে। indi- viduality (অখণ্ডতা) গজায় না। Passionate crave (প্রবৃত্তি- রঙ্গিল আকাঙ্ক্ষা) বা ambition (উচ্চাকাঙ্ক্ষা) থেকে মানুষ যত বড়ই হো'ক না কেন, তা'তে আত্মনিয়ন্ত্রণক্ষমতা জাগে না। তাই আকাশ-পাতাল ঢুড়েও শান্তি পায় না। আর, যে নিজেই শান্তি পায়নি, সে অন্যকেই বা শান্তি দেবে কী ক'রে? হয় অনেক ক্ষমতার অধিকারী হ'য়ে মানুষকে গুতিয়ে নিয়ে বেড়ায় ও নিজেও গুঁতো খায়।
(আঃ প্রঃ ৭ম খন্ড)
শ্রীশ্রীঠাকুর-এক ব্রাহ্ম ভদ্রলোক এসেছিলেন হরিনাম জপ করতেন, ঘুমের মধ্যেও তাঁর নাম চলতো। কিন্তু অবতারবাদ বা গুরুতত্ত্বে তাঁর আদৌ বিশ্বাস ছিল না। ভক্তি-বিশ্বাস বাস্তব ও জীয়ন্ত কাউকে অবলম্বন করতে যখন কুণ্ঠিত হয়, তখন মনে হয় তার মধ্যে মনের কারচুপির অবকাশ থাকে ঢের। আমি সাধনা করি অথচ আমার গুরু নাই, তার মানে আমার অনিয়ন্ত্রিত মনকে গুরুপদে বসিয়ে তাকেই আমি অনুসরণ করছি। অর্থাৎ, আমি আমার মনের ঘানিতেই ঘুরছি। বল্গাহারা অনিয়ন্ত্রিত মনবুদ্ধিকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুকেন্দ্রিক করাই সাধনা। কিন্তু আমার যদি কোন জীয়ন্ত নিয়ন্ত্রণী কেন্দ্র না থাকে এবং সেখানে যদি আমি সক্রিয়ভাবে অনুরাগনিবন্ধ না হই, তবে আমি সুনিয়ন্ত্রিত ও সুকেন্দ্রিক হ'তে পারব কেমন ক'রে, তা' আমি বুঝতে পারি না। তাই গীতায় আছে-'অব্যক্তা হি গতিদুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।'
(আঃ প্রঃ ১০ম খণ্ড!
প্রশ্ন-আপনার জীবন-চরিতে দেখলাম, আপনি ছেলেবেলায় নাকি খুব নাম করতেন। নাম করলেও নাকি ঐ রকম হয়। 'নাম করা' মানে কি? আর কেনই বা নাম করতেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর-পাতঞ্জলে আছে 'তজ্জপস্তদর্থ' ভাবনঞ্চ' 'নাম করা' মানে যাহা জপ করিতে হইবে তাহা মনে-মনে উচ্চারণ করিয়া তাহার অর্থ ধ্যান বা তাহাকে ধ্যান করা। তা'তে একটি শব্দ লইয়া মনে-মনে Continuously উচ্চারণের ফলে আমাদের স্নায়ু ক্রিয়া করিয়া মস্তিষ্ক:- কোষগুলিকে উত্তেজিত করিয়া তোলে। তার ফলে আমাদের কোষ- গুলি যেমনতর আছে, তা'র চেয়ে ঢের বেশী sensitive হয়-আর, এই sensitive হওয়ার দরুণই যে-সমস্ত সাড়া পূর্বে' বোধের অগম্য ছিল, তাহা ক্রমে বোধগম্য হইয়া ওঠে।
আর, continually with attachment একচিন্তাপরায়ণতার দরুণ অর্থাৎ প্রিয়চিন্তা বা ধ্যানের ফলে ঐ sensitive কোষগুলি এমনতরভাবে adjusted হয়, যা'তে সাড়া ত' লয়ই-আরো অটুট-ভাবে ধরিয়া রাখিতে সমর্থ হয়, অর্থাৎ receptive হয়। ক্লীং, ওঁ প্রভৃতি ধ্বন্যাত্মক বা বীজযুক্ত নামগুলি জপ করিলে Brain cell-এর Sensitiveness-সুক্ষ্ম বোধশক্তি বাড়ে, আর কোন মূর্তিধ্যানের ফলে স্নায়ুগুলি receptive হয়।
তা'হলেই আমাদের observation-গুলি কত উন্নত, কত deeper হইয়া ওঠে দেখুন। আর এগুলি সব নাম ও ধ্যান হইতে যেমনতরভাবে হইতে পারে, অন্য-কোন প্রকারে বোধ-হয় এমনতরভাবে সম্ভব নয়। তবে এক কথা-যা'তে বা যাহাতে এ-নাম সার্থক হইয়াছে, সে-ই বা তিনি ধ্যেয় বা অনুসরণীয়-কারণ, ইহা করিলে যে-যে ভাবগুলি excited হয় তার physical expression-এ তাহা প্রকটিত থাকে।
প্রশ্ন-কিন্তু নাম করার ফলে ত' দেখি বাঙ্গালী জাতির স্নায়ু- দৌর্বল্য ছাড়া আর বেশী কিছু হয়নি?
শ্রীশ্রীঠাকুর-এ হ'ল মাগ নাই শ্বশুরবাড়ী যাবার কথা-মোটেই চাচী রাঁধে না, তপ্ত আর পান্তা। নাম করলে nervous debility যে সারে, এ কথা চিরন্তন,- আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এ যে কত রকমে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। বরং অপকর্মে'র দ্বারা debilitated হ'য়ে পড়লে নামধ্যান করা তাহার পক্ষে একটু মুশকিলই। তাই, ব্রহ্মচর্য্য অর্থাৎ উচ্চচিন্তা, যা'তে বাঁচা ও বৃদ্ধি-পাওয়া উন্নত হয়, এমনতর বিধির সহিত স্বাস্থ্যের নিয়ম-যাহাতে মানুষ সুস্থ শরীর ও মন নিয়ে থাকতে পারে বিশেষ- ভাবে তা'র বিধি দিয়ে নাম, ধ্যান, ধারণা ইত্যাদির উপদেশ দেওয়া আছে তা' আরো উন্নতির জন্য।
যাদের স্বাস্থ্য নাই, তা'রা আবার আবার ধর্ম কি করবে? যা'তে স্বাস্থ্যরক্ষা হতে পারে-ধর্ম' করতে হ'লে তার নিয়মকে অক্ষুণ্ণ রেখে তা'র উপরে তপস্যা ও সাধনাকে দাঁড় করাইতে হইবে। তাই, চৈতন্যদেব নৃত্যগীতের সহিত নাম করা, ধ্যান করার উপদেশ দিয়েছিলেন বোধ হয়। মানুষ যখন অলস, অবশ, হীনস্বাস্থ্যসম্পন্ন হয়, তা'দিগকে উন্নতির পথে চালনা করিতে হইলে নৃত্যগীতের সহিত নামকীর্ত্তন একটা প্রধানতম পন্থা
অবিধিপূর্বক নৃত্যগীতের সহিত নাম-কীর্ত্তন করিলেই debilitated হওয়া বরং সম্ভব-অবিধিপূর্বক ডামবেল বা মুগুর ভাঁজলেও স্বাস্থ্যের হানি-এমন-কি দুরারোগ্য রোগ যে হয়, তাহাত' বহু-ই দেখা গিয়েছে-আর সবারই জন্য-ও-ও ত' তাই।
প্রশ্ন-আচ্ছা, আপনি যে বললেন ধ্বন্যাত্মক নাম-'ধন্যাত্মক নাম' কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর-আমাদের System-এর ভিতর ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার দরুণ যে-সমস্ত শব্দ হইতেছে, তাহাই ধ্বন্যাত্মক নাম বা অনাহত নাদ, আর, এই নাদের বিকাশের ক্রম বা 'স্তর আছে-grosser to finer- যেমন হ্রীং, ক্লীং ওঁ, রং ইত্যাদি। এগুলি হ'ল সেই বা সেই স্তরের শব্দ-যা' নাকি আমাদের System-কে আলোড়ন করিয়া বাক্যের ভিতর দিয়া আহত শব্দে মূর্ত্ত' হয়, আর তাহাই ধ্বন্যাত্মক নাম-ধ্বনি যা'র আত্মা। এক-কথায় বলিতে গেলে আমাদের মস্তিস্কের কোষগুলির বিশেষ-বিশেষ প্রকার excitement-এ বিশেষ-বিশেষ প্রকার জ্যোতিঃ ও শব্দ অনুভব করিতে পারি-সেই ধ্বনিই ধ্বন্যাত্মক নাম, আর সেই জ্যোতিঃই রূপ।
প্রশ্ন-আপনি বললেন কোন মুর্ত্তিধ্যানের ফলে স্নায়ুগুলি receptive হয়-receptive কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর-Receptive যেমন সেতারের তার কানের সঙ্গে জড়ান। কানের টানে Sensitiveness বাড়ে, আর তেমনতর শব্দ হয়; কিন্তু কানটা না থাকলে তারটা কোন impulse receive-ই করে না। যা'কে centre ক'রে centric mood, attitude, keenness-টা আসে, সে-ই হয় ঐ attitude-এর cue-তা'কে দেখলেই ঐ mood আসে, আর তাহাই receptivity বা গ্রহণ ক্ষমতা।
প্রশ্ন-যে কোন-কিছুর ধ্যানেতেই কি গ্রহণক্ষমতা বাড়ে?
শ্রীশ্রীঠাকুর-Love tension আনে, Beloved-এর মত করতে ইচ্ছা করে-তাই যার ধ্যান করি, তার মত হ'য়ে যাই।
প্রশ্ন-আপনি বলেন শুনতে পাই, নামের সাহায্যে পনের বছরের-টা পাঁচ বছরে জানতে পারি তবে কি জানার সাধারণ উপায় ছাড়া অতীন্দ্রিয় আর কোন উপায় আছে?
শ্রীশ্রীঠাকুর-Super sensitive ইন্দ্রিয়ই অতীন্দ্রিয়, তা'ছাড়া অতীন্দ্রিয় ব'লে আর কিছু জানি না।
প্রশ্ন-চোখ-বুজে যোগবলে জানা যায় না? অনেকে ত' বলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এইখানে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-যোগবলে attachment-এর বলে তা জানা যায়ই। কোন object-এ যদি আমি attached বা interested হই, সেই সম্বন্ধে চিন্তা করলে তা'র জ্ঞান বাড়ে বৈকি। চোখ বুজলে disturbance কমে, এই মাত্র। ধ্যান এবং কর্ম'নিরত একলব্য যেমন দ্রোণাচার্য্যের সাহায্য না পেয়েও বড় হ'য়ে গেছিল। যোগের বল যদি থাকে, super psychical জিনিসও ধরা যায়; কিন্তু মূল object-টা জানতে হবে ইন্দ্রিয় দিয়েই; আর ভারতীয় বৈশিষ্ট্য তাই। কেকিউলের মত একচিন্তানিরত হ'য়ে atom এর dance দেখা যায়।
প্রশ্ন-শারীরিক ব্যায়ামের নিয়মগুলি যেমন সবারই গ্রহণ করতে বাধে না. তেমনি ধ্বন্যাত্মক নাম ও ধ্যান ব'লে আপনি যা' ব'লছেন এটাও ত' আধ্যাত্মিক সাধনা হিসাবে সবাই গ্রহণ করতে পারে- কারণ, ইহাও ত' বিজ্ঞানসম্মত সার্বজনীন সত্য?
শ্রীশ্রীঠাকুর-নিশ্চয়ই-বুঝলেই হতে পারে।
(নানাপ্রসঙ্গে ১ম খন্ড)
প্রশ্ন-(কেষ্টদা) আমরা যে জপ-ধ্যান করি, তার প্রকৃত তাৎপর্য্যই বা কি আর প্রয়োজনই বা কী?
শ্রীশ্রীঠাকুর-পাতঞ্জলে আছে তজ্জপস্তদর্থ 'ভাবনঞ্চ; জপের মধ্যে আছে মানস আবৃত্তি। আবৃত্তি মানে সম্যকভাবে থাকা। জপ্য মন্ত্র বা নাম আদি কারণের প্রতীকস্বরূপ। আর নাম করা মানে সেই কারণ সত্তার প্রতি আনত হ'য়ে তাঁতেই অবস্থান করার চেষ্টা করা। অর্থ মানে গতি বা গন্তব্য। নামের গন্তব্য হ'চ্ছেন নামী। নামের অর্থ ভাবতে গেলেই নামীতে যেয়ে পৌঁছাতে হবে। নাম, নামী, জগৎ ও আমি এই সবগুলির সার্থক সঙ্গতি ও সম্পর্ক' আবিষ্কারই জপ- ধ্যানের কাজ। তা' যদি না করি তবে আঁধারে পথ চলার মত অবস্থা হয়। চলনটা হয় ফসকানে রকমের। কারণ, নিজের সঙ্গে ও জগতের সঙ্গে এবং তার পিছনের কারণের সঙ্গে কোন পরিচয় বা যোগসূত্র ঘটে না। তাই চলনটা হয় এলোমেলো ও অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু সেই পরিচয় আমাদের করাই চাই। অর্থসহ নাম করলে ঠাকুরের পরমস্তুতি হয়। নাম হ'লো শব্দব্রহ্মেরই প্রতীক, তা' থেকেই যা' কিছুর উদ্ভব। নামের মধ্যেই আছে বিশ্বসত্তার বর্ণপরিচয়। নামই ঠাকুরের সত্তা, প্রতিটি যা' কিছুর সত্তা। তোমার প্রাণশক্তির তোষণ করলে তুমি যেমন তৃপ্ত হও, ঠাকুরের প্রতি অনুরাগ নিয়ে নাম করলে তিনিও তেমনি তৃপ্ত হন, তুষ্ট হন, অর্থাৎ তোমার সত্তারূপী ঠাকুর প্রেরণাপুষ্ট ও নন্দিত হ'য়ে ওঠেন। যতই নামধ্যান করা যায় ততই ঠাকুরের প্রতি অর্থাৎ জীবন্ত সদ্গুরুর প্রতি সত্তার সম্বেগ বাড়ে। তিনিই যে আমার জান-প্রাণ এমনতর অনুভব সমগ্র সত্তাকে ঠেসে ধরে। এইভাবে এগোতে-এগোতে 'বাসুদেবঃ সর্ব'মিতি' হ'য়ে ওঠেন। স্পষ্ট বোধ করা যায় তিনি ছাড়া কেউ নেই, কিছু নেই। সবের মধ্যে এককে দেখি, আবার সেই পরম একের মধ্যে সবকে দেখি। এই দেখাই তো দেখা, এই জানাই তো জানা। আর, এই জানাটাই কিন্তু একটা ধ'রে নেওয়া বা আরোপ করা ব্যাপার নয়। সেই একই শক্তি কোথায় কিভাবে কেমন ক'রে কিরূপে পরিনয়ন লাভ করেছে, তা' মরকোচ-সহ বোধ করা যায়। Analyt.cally (বিশ্লেষণ সহকারে) ও Synthetically (সংশ্লেষ সহকারে) দেখা যায় সেই একই আছেন সর্বত্র। সবদিক দিয়ে এগিয়ে, সবরকমে সেই এককে বিচিত্ররূপে না পেলে সুখ কোথায়, মজা কোথায়? এ-আনন্দ নিত্যনুতন যোগসূত্র ও সম্পর্ক' আবিষ্কারের আনন্দ। তাই বলে নিত্যলীলা। মানুষ তখন নির্ভয়, নিরুদ্বেগ হয়, সদানন্দ হয়। দ্রুতিতে গান ধরে-তোমার খাই, তোমার পরি, তোমার ঘরে বসত করি।
Theory (উপপত্তি) করলে হবে না, concrete-এ (বাস্তবে) এসে পৌঁছান চাই। তাই বলেছেন বাসুদেব অর্থাৎ বসুদেবের ছেলে
কেষ্ট ঠাকুর।
শ্রীকৃষ্ণের যতেক লীলা
সর্বোত্তম নরলীলা
নরবপু তাঁহার স্বরূপ,
গোপবেশ বেনুকর
নবকিশোর নটবর
নরলীলার হয় অনুরূপ।
শুধু নরবপু ব'লে ছেড়ে দেননি, গোপবেশ বেনুকর, নবকিশোর নটবর ব'লে চিহ্নিত ক'রে দিয়েছেন। তাঁকেই চাই। অর্থাৎ নিজ সদ্গুরুর প্রতি অটুট নিষ্ঠা চাই। ঐ সক্রিয় নিষ্ঠা ও অনুরাগই মূল জিনিস। নতুবা শুধু নাম করলে কি হবে? তাই আছে 'কোটি জন্ম করে যদি নাম-সংকীর্ত'ন, তথাপি না পায় কেহ ব্রজেন্দ্র-নন্দন। অবশ্য, আগ্রহ- সহকারে নাম করতে-করতে অনুরাগ হয়। তাই চাই আগ্রহ-সন্দীপ্ত অভ্যাস-যোগ। Mood-টা (ভাবটা) ঐ মুখী ক'রে ফেলতে হয়। করলেই হয়। হওয়ার রাস্তা এন্তার খোলা। 'মীরা কহে বিনা প্রেমসে নাহি মিলে নন্দলালা।'
আমি বলি, নন্দলাল কেন কাউকেই কিছুকেই 'বিনা প্রেমসে' মেলে না। প্রেম যদি ঢালতেই হয় তবে নন্দলাল ছাড়া যার-তার পায়ে ঢালতে যাব কোন্ দুঃখে। আমরা কি বেকুব নাকি?
(আঃ প্রঃ ১০ খঃ)
শ্রীশ্রীঠাকুর-ভাবাত্মক নাম এক শ্রীকৃষ্ণের বহু হ'তে পারে। কিন্তু তার কোনটাই Complete (পূর্ণ) নয়। কোনটাই সব aspect (দিক) Cover (অন্তর্ভুক্ত) করে না। কিন্তু তাঁর বীজাত্মক নাম একটাই হয় এবং তাঁর সবগুলি aspect-ই (দিকই) নিহিত থাকে ঐ নামের মধ্যে। তাই অনুরাগের সঙ্গে সদ্গুরু-প্রদত্ত বীজনাম জপ ও সদ্গুরুর ধ্যান অর্থাৎ চিন্তা, তাঁর প্রসঙ্গ, তাঁর প্রীতিপ্রসূ কর্ম', সেবা ও তাঁর বাস্তব নির্দেশপালন ইত্যাদির ভিতর দিয়ে তাঁকে তত্ত্বতঃ উপলব্ধি করা যায়। ভগবদনুভূতির এই-ই হ'লো সহজ-সরল পথ। দীক্ষা অনেকে নেয়, কিন্তু যেমন-যেমন ভাবে যতটা সম্বেগ নিয়ে যতখানি যা' করার তা' নিষ্ঠাসহকারে নিয়মিত করে না। তাই টেরই পায় না যে সদ্গুরুর দীক্ষা কত বড় বস্তু। তবে নিবিড়ভাবে না পারলেও যজন, যাজন, ইষ্টভৃতির অনুশীলন যারা নিয়মিত ধ'রে থাকে, তারা পদেপদেই এর প্রভাব টের পায়। কিন্তু তন্ময় হ'তে না পারলে সুখ নেই।
(আঃ প্রঃ ৯ম খন্ড)
শ্রীশ্রীঠাকুর-Concentration (একাগ্রতা) fixation (ত্রাটক) নয়। Con মানে with (সহ) আর Centration মানে Centre (কেন্দ্র) Concentration মানে with the Centre (কেন্দ্রসহ)। "ইষ্ট আর ইষ্টস্বার্থ' মনের আনাগোনা এমনি ক'রেই ধ্যানে আসে চিত্ত সংযোজনা।” Third (তৃতীয়) তিল-এ বা আজ্ঞাচক্রে মনঃসংযোগ করার কথা বলা হয়, মানুষ গভীর চিন্তা করতে গেলেই কিন্তু অজ্ঞাতসারে ওখানে হাত দেয় process (নিয়ম) অনুযায়ী ওগুলি করতে গেলে base of the brain excited (মস্তিষ্কের তলদেশ উত্তেজিত) হয়, pineal gland-এ (আজ্ঞাচক্রে) সেই excitement (উত্তেজনা) চারিয়ে যায়। Suppressed (নিরুদ্ধ) অনেক কিছু, বেড়িয়ে পড়ে, বোধ করা যায়, কাজের ভিতর দিয়ে আবার সেগুলি adjusted (নিয়ন্ত্রিত) হয়।
প্রশ্ন-(প্রফুল্লদা) নামধ্যান না ক'রে যদি motor activity (কাজকম') বেশী ক'রে চালাই?
শ্রীশ্রীঠাকুর-তাতে subconscious or unconscious mind- এ (অবচেতন বা অচেতন মনে) unsolved (সমাধান হারা) যা' থাকে তা জানা যায় না, adjust (নিয়ন্ত্রণ) করা যায় না। জ্ঞান, বোধ-ওখানে ধ্যান করলে জ্ঞান ও বোধ হয় বলেই বলে। আর pressure (চাপ)-টাই আদত জিনিস, জ্ঞা ধাতু মানে ওকে আজ্ঞাচক্র ইষ্টভৃতি সেই pressure হাতের exercise (কসরত) যতই কর, muscle (পেশী)-এর দিকে attention (নজর) না দিলে কিন্তু কাজ হয় না। কথামৃতের গল্পের মত-নষ্টা মেয়ে যাকে ভালবাসে, সব কাজের মধ্যে তার কথা মনে পড়ে, ভাবে কখন তার কাছে যাবে, তাকে দেখলে আনন্দ, তাড়াতাড়ি ভাল ক'রে কাজ সেরে সেখানেই ছুটে যায়। অনুরাগোন্দীপ্ত নাম-ধ্যান চাই, তাঁর প্রতিষ্ঠা ভরণের আকুল ধান্ধা চাই-ভালবাসলে যেমনটি করে; তাই যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি স্বতঃই আসে।
(আঃ প্রঃ ১ম খণ্ড)
*প্রশ্ন- (বিমলদা) একটা কথা শুনি-'যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা' আছে ভান্ডে'। তার মানে কি?
শ্রীশ্রীঠাকুর-বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা' আছে, তা' আমাদের
শরীরেই আছে। যে-সব উপাদানের সমবায়ে ও সমাবেশে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রচিত হয়েছে, তা' সংহতভাবে আমাদের দেহবিধানেই আছে। নামধ্যান, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের সাহায্যে যখন আমরা আমাদের সত্তাটাকে সমগ্রভাবে জানতে পারি, তখন বিশ্বব্যাপারের যা'-কিছুও আমরা সহজে জানতে পারি।
শরীরের একটা কোষ, কি একটা বালুকণাকেও যদি আদ্যন্ত সামগ্রিক- ভাবে জানা যায়, তার মধ্য দিয়েও বিশ্বব্রহ্মান্ডের জ্ঞান আমাদের আয়ত্ত হয়। জগতের কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, একটাকে পুরোপুরি জানতে গেলে সেই সঙ্গে সব-কিছুর জ্ঞান এসে পড়ে। কোন-কিছুকে পুরোপুরি জানা মানে, তার সঙ্গে অন্য যা'-কিছুর সঙ্গতি ও সম্পর্ক'শুদ্ধ জানা। সেইজন্য আমি বলি, যা' করবে, তা' thoroughly (পুরোপুরি) করবে, নিখুঁতভাবে করবে। এই নিখুত করা ও জানার অভ্যাসই আমাদের পূর্ণতার পথে এগিয়ে দেয়। অনেকে হীনমন্যতার বশে স্বধর্ম' ও স্বকর্ম'কে ত্যাগ করতে চায়। তার চাইতে ভুল আর নেই। সহজাত কর্ম', তা' যার যাই হোক না কেন, তার ভিতর দিয়েই মানুষ চরম জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে। নইলে তার জ্ঞানের কপাট খোলে না। তাই গীতায় আছে "স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম ভয়াবহঃ”। তোমার যা' সম্পদ আছে, তার উপর দাঁড়িয়েই তুমি আরোর পথে হাত বাড়াও। তোমার সম্পদকেও তুমি যদি অবহেলা কর, তবে বাইরের সম্পদকেও তুমি আয়ত্ত করতে পারবে না।
(আঃ প্রঃ ২য় খন্ড)
প্রশ্ন-শুনি যা' আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা' আছে ভান্ডে, তার অর্থ কি? এবং ভান্ডে যা' আছে তা' সব জানতে পারি কি করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর-এ ওই microcosm (মনুষ্য-শরীর) ও macro- cosm (ব্রহ্মাণ্ড)-এর কথা। বিশ্বজগতে যা' আছে, মানুষের শরীরেই তা' আছে কেন্দ্রীভূত হয়ে। আবার মানুষের সমগ্র শরীরে যা' আছে, শরীরের একটি কোষের মধ্যেও তা' আছে, একটা অণুর যা' গঠন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠনও মূলতঃ তাই। স্থূল যা' দেখছ, তার মধ্যে সূক্ষ্মতম যা কিছু স্তর পারম্পর্য্যে ওতপ্রোতভাবে অনুস্যুত হয়ে আছে। প্রত্যেকটি যা'-কিছু আজ যে আকারে দেখছ, হয়ত এ আকারে ছিল না, কিন্তু এই হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তা'তে, সেই সম্ভাব্যতাই বিবর্তিত হ'তে হ'তে চলেছে প্রকৃতির বক্ষে, পরিবেশের মধ্যে, তাই বর্তমানের মধ্যে অতীতের ছাপ সুপ্ত, লুপ্ত হ'য়ে থাকলেও আছে। একই বহুর মধ্যে বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ ক'রে আছে। একই বহু হ'য়ে আছেন, আরো হ'য়ে চলেছেন। সেই ঐক্যসূত্রটি ধরতে হবে যা' বহুতে রূপায়িত। সেই মূল জিনিসটি হল কেন্দ্রানুগ আকর্ষণ। কেন্দ্রের প্রতি সক্রিয় আকর্ষণকে বাদ দিয়ে কিছুই আত্মরক্ষা করতে পারে না। এই আকর্ষণের আবার একটা সুসীম সীমারেখা আছে, সেটাকে অতিক্রম ক'রে সে যখন কেন্দ্রকেই আত্মসাৎ করতে চায়, তখনই আসে বিকর্ষ'ণ, এই আকর্ষণ-বিকর্ষণের টানাটানি ও সংঘাতের মধ্য দিয়েই নূতনের আবির্ভাব হয়। এইভাবে পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষ'ণ ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে আরও নূতনের অভ্যুদয় হয়, এমনি ক'রেই সৃষ্টি গুণিত হ'য়ে চলে। এই তাঁর লীলা। লীলা মানে আলিঙ্গন, গ্রহণ, দেওয়া-নেওয়া, মিলন-বিরহ, সব হারিয়ে সব পাওয়া, সব পেয়েও নিজের বলতে কিছু না রাখা, কিছু না থাকা। 'যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি, সে মুহূর্তে কিছু তব নাই, তুমি তাই পবিত্র সদাই।'
ধূর্জটিদা-এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটা যেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
শ্রীশ্রীঠাকুর-দাঁড়া দেখিয়ে দিচ্ছি। খাতা বা পেন্সিল আছে তোদের কাছে?
প্রফুল্ল-হ্যাঁ, এই নিন।
শ্রীশ্রীঠাকুর তখন খাতায় এ'কে দেখালেন-Atom ( অণুর) negative pole (রিচী মেরু)-গুলি positive pole (ঋজী মেরুর) দিকে এগুতে থাকলে, তার থেকে quanta (দদ্রুতিকণা) কিভাবে ছিটকে ছিটকে বেরোয়। আবার দেখালেন একটা কোষের রিচী মের ঋজী মেরুর দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে কেমন ক'রে নূতন রিচী মেরু ও ঋজী মেরু সৃষ্টি হ'তে হ'তে কোষ-বিভাজন হ'য়ে চলে।
শ্রীশ্রীঠাকুর যখন চিত্র এঁকে বোঝাচ্ছিলেন, তখন সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝাঁকে পড়ে আগ্রহভরে দেখতে লাগলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর দেখাবার সময় বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন- 'বুঝলি তো? বুঝলি তো?'
সবাই বোঝার পর শ্রীশ্রীঠাকুর ক্ষান্ত হলেন। তখন শ্রীশ্রীঠাকুর ও সবার চোখে-মুখে এক অপার তৃপ্তি। প্রত্যেকে পুনরায় যথাস্থানে উপবেশন করলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর (সহাস্য বদনে)-গানে আছে (সুর ক'রে) 'যখন যেখানে যাই, সঙ্গে থাকে গো রাই।' (হাত দুখানি নেড়ে বিস্ময়ের ভঙ্গীতে) এ এক অশৈলি কান্ড। positive (ঋজী) যেখানে থাকবে, negative (রিচী) তার, পোঁদে-পোঁদে ছুটবে, সেই অবলম্বন ছাড়া সে যেন চলতেই পারে না। একেই বলছিলাম কেন্দ্রানুগ আকর্ষণ বল। Positive (ঋজী) যেন negative (রিচী)-র কেন্দ্র, এই কেন্দ্রানুযায়ী হ'য়ে ছাড়া তার টিকবার জো নেই, সেই টানে সে ছোটে সেই দিকে। এই ছোটাছুটি, টানাটানির ভিতর দিয়ে ছিটকে বেরোয় কত কি অনন্ত কোটি বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে-গ্রহ-নক্ষত্র-তারা, ক্ষিতি অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম, গাছপালা, পশু-পাখী, মানুষ, তুমি-আমি কত কি, মায় ঐ ফড়িংটা পর্য্যন্ত (তাসুর মধ্যে একটা ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছিল)। অবশ্য এর নানা পৰ্য্যায় আছে, নানা স্তর আছে, নানা ক্রম আছে। সদ্গুরুকে ধ'রে তাঁর নির্দেশমত বিহিতভাবে সাধন করলে ওগুলি ক্রমে ক্রমে ফুটে ওঠে। সবই চোখে দেখা যায় কানে শোনা যায়। এ সব হোঁয়ালী কথা কিছু না। এ হল বিজ্ঞান। আমি যেভাবে দেখছি, তোমরাও তেমনি দেখতে পার। তবে গুরুসর্বস্ব না হ'লে, সর্বতোভাবে গুরুমুখী না হ'লে তথাকথিত সাধনার কসরতে এ হবার নয়। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন-তোমার অনেক জন্ম অতীত হ'য়ে গেছে, আমারও অনেক জন্ম অতীত হ'য়ে গেছে, তোমাতে আমাতে ভেদ নাই, ভেদ এইটুকু যে তুমি তা' জান না, কিন্তু আমি জানি অর্থাৎ আমার স্মৃতি-চেতনায় আছে তা'। সদ্গুরু হলেন সেই জানা লোক, স্মৃতি-চেতনাওয়ালা লোক, জীবনের সব রহস্যই তাঁর করতলগত। তাই তাঁর উপর প্রাণের টান হ'লে, তাঁর সঙ্গ করলে, সেবা করলে, অনুসরণ করলে, তাঁর প্রীতি-কর্ম' করলে, নিজেকে তন্মুখী ক'রে নিয়ন্ত্রিত ক'রে চললে, নাম-ধ্যান, ষজন-যাজন করতে থাকলে, তাঁর সুখ-সাধ-আহলাদের দিকে লক্ষ্য রেখে চললে, বেমালুমভাবে তাঁর জানা কত কী-ই যে নিজের জানার মধ্যে এসে যায়, তা' ঠাওরই পাওয়া যায় না। পথ ঐ সোজা পথ, সদগুরু হলেন মুর্ত্ত বেদ, কোন-কিছুর বালাই নিয়ে তাঁর পিছে ঘুরো না, তাঁর পায়ে নিজেকে উজাড় ক'রে ঢেলে দাও, তাঁরই হও তুমি সর্বতোভাবে তোমার কিছুই ভাবতে হবে না, তোমার যা' হবার তা' আপনিই হ'য়ে উঠবে।
(আঃ প্রঃ ২ খঃ)
শব্দ-বিজ্ঞান
অযুত-কোটি শব্দ ভাসে
মহাশূন্যের ঢেউ ধ'রে,
বেছেগুছে পারলে নিতে
সুফল দিয়ে সুষ্ঠু করে।
তোমার সত্তার একটি অণু
একটি শব্দ-ঝঙ্কার,-
ভরদুনিয়ার অর্থ' আছে,
সাধ, ধর-তুকু তা'র।
নাম সাধা মানেই-নিষ্ঠানতি
অন্তর-শব্দে রেখে মন,
দীপ্ত বেগে সজাগ থেকে
শুনতে থাকা-নাদ- ধ্বনন;
নিষ্ঠা-আনুগত্য-কৃতি
ইষ্টে অটুট না হ'লে,
শিষ্ট-শুদ্ধ অন্তর-নাদে
থাকে নাকো মন, যায় চ'লে;
ডা'ন কানে যে নাদ পাবি তুই
সেইটি কিন্তু শ্রেয় নাদ,
বামের নাদে হয় না সিদ্ধ
ঘটেও অনেক পরমাদ;
ভাববৃত্তির পাকে প'ড়ে
মানুষ অনেক দেখে-শোনে,
নাম-নাদেরই ত্বরিত জেল্লা
অস্তিসত্তাক্ ক্রমে আনে;
ইষ্টনেশার কৃতী চলন
যেমনতর জাগে যা'র,
রাগদ্যুতির উচ্ছলাটি
জেগেও থাকে তেমনি তা'র;
ইন্টনিদেশ ভেঙ্গে দিয়ে
কামকামনায় থাকবে যত,
অস্তিত্বটাও ঘূর্ণিপাকে
তেমনতরই ঘুরবে তত;
ইষ্টার্থ' সাধাই নিষ্ঠা নিয়ে
ঐ সবগুলির শিষ্ট হাল,
নামের হাওয়ায় নাদতরীতে
চল্ না ওরে, টেনে পাল;
জীবনদ্যুতির প্রশস্তিসুর
ঠিক জানিস্ তুই, ঐ নাদ,
শিষ্টকর্মা হ'য়ে ধ্যানে
চল্ কেটে চল্ সব প্রমাদ।
অণুসঙ্গতির যে তাৎপর্য্যে
পুরাণপুরুষ ব্যক্ত হন,
সে-তাৎপর্য্যের বিধায়নায়
তিনিই তেমন মুর্ত্ত' হন;
মুর্ত্ত' ব্রহ্মই পরব্রহ্ম
বেদদীপ্ত তাঁ'র শরীর,
তাঁ'রই ভক্তি তাঁ'রই পূজায়
হ'য়ে ওঠ তুমি সুধীর;
এমনতর পুরাণপুরুষ
ছেড়ে-কোথাও দীক্ষা নেওয়া,
তা'র মানেই কিন্তু সত্তাটাকে
অধঃপাতে বিলিয়ে দেওয়া;
অন্য স্থানে শিক্ষা নিয়ে
পুরাণপুরুষ আঁকড়ে ধরা-
সেটা কিন্তু ক্রমে-ক্রমে
শিষ্ট পথে এগিয়ে চলা;
জ্যান্ত থাক, মূর্ত্ত থাক,
যেমন সম্ভব তোমাতে,
মুর্ত্ত' হ'য়ে ব্যাপ্ত থাক
সব সত্তারই অস্তিতে,
অঙ্খলিত নিষ্ঠারাগে
ভক্তি-পূজা তাঁ'কেই কর,
জেগে উঠুক তোমার প্রাণে
নাদব্রহ্ম দীপ্ত দড়।
(অনুশ্রুতি)
পিন্ড, ব্রহ্মান্ড ও চৈতন্যদেশের
মোক্তাবিবরণ
দোলায়মান আকুঞ্চন-প্রসারণী সম্বেগ/আকর্ষ'ণ-বিকর্ষ'ণ-সঙ্গর্ভী১ যোগাবেগ-সম্ভূত/ঝঙ্কার-প্রাবৃট্-পরিক্রমায়২ তরঙ্গায়িত হ'য়ে / সংহিত সংঘাতে / তদনুপাতিক বিন্যাস লাভ ক'রে / ছন্দ-অনুক্রমণায় ধূমায়িত হ'য়ে / মঞ্জুল তালে / বোধবেদনায় যেখানে উদ্দীপ্ত হ'তে লাগল-/ চেতনদীপনী শব্দ ও জ্যোতি-নিক্কণে, বিচ্ছুরিত শ্বেত-বিভায়,/ অপ্রেমেয় উদাত্ত চেতনায়,/ অস্ফুট স্ফুরণে/ মণ্ডল সৃষ্টি ক'রে,-/সেই হ'চ্ছে নির্ম্মল চৈতন্যভাণ্ডার-/দয়ী৩ দেশ,/ আর, চিদ্-অণুর প্রাক্-প্রকাশ ওখান থেকেই; / ঐ কম্পন-সম্বেগ-সংঘাত হ'তেই আসে / শব্দ ও জ্যোতি,/ আর, ঐ আকুঞ্চন-প্রসারণী সম্বেগের প্রতিক্রিয়ায় হয়/ আকর্ষণ, বিকর্ষণ, / ঐ প্রসারণা যখন চরম-সীমায় উপস্থিত হয়,-/ তখন থেকেই / আকুঞ্চনী আবেগ আরম্ভ হ'তে থাকে; / আবার, ঐ আকুঞ্চন বা সঙ্কোচন / যখন চরম সীমায় উপস্থিত হয়, / আর যখন আকুঞ্চিত হ'তে পারে না / এমনতরভাবেই জমাট বেধে ওঠে, / তখন থেকেই তা'র অন্তঃশায়ী / প্রসারণী সম্বেগ সুরু হ'তে থাকে;/ আর, এর ভিতর-দিয়েই/অমনি ক'রেই প্রত্যেকটি স্তরেরই/ দুটি মেরু সৃষ্টি হ'য়ে ওঠে,/ তা'র নাম দেওয়া যা'ক/একটি ঋজী৪ অর্থাৎ স্থাসু মেরু,/ আর একটি রিচী৫ অর্থাৎ চরিষ্ণু মেরু, ঐ ঋজী ও রিচীর লীলায়িত রসলোলুপ/সংশ্রয়ণী৬ সম্বেগকেই/শক্তি বলা যেতে পারে/এই রিচী-মেরু
__________ __________ ____________
(১) আকর্ষণ ও বিকর্ষণ আছে যা'র মধ্যে (২) শব্দ সমন্বিত বর্ষাধারার মত গতি (৩) দয়াল (৪) positive (৫)negative (৬) আশ্রয় ক'রে চ'লেছে যা'
হ'চ্ছে/একটা পরম সঙ্কোচনী জমাট অনুবদ্ধ৭/যা' হ'তে প্রসারণ-সম্বেগ/সৎ-সন্দীপনায় উদ্দীপিত হ'য়ে চলে; আর, এই আকুঞ্চন-প্রসারণের মাঝখানেই আছে/বিরমণ,/ এই বিরমণ অবস্থার থেকেই / মেরু হ'তে আরো প্রসারণী/বা সঙ্কোচনী সম্বেগ-সংগৃহীত হ'য়ে / আরো হ'তে আরোতে/উদ্ভিন্ন হ'য়ে চ'লতে থাকে; /এই সৎলোক বা সত্যলোক/নির্ম্মল চৈতন্যের জমাট আধারেরই/একটি সঙ্কোচনী পরিণাম/ যেখান থেকে আবার সুরু হ'লো প্রসারণী সম্বেগ,/ ঐ প্রসারণী আবেগ/ প্রসারণায় সম্যক-সম্বেগী হ'তে না পেরে/ খানিকটা আকৃষ্ট হ'তে লাগল / সেইআ দিমের বা নির্ম্মল-চৈতন্যভাণ্ডারের দিকে, / সৎলোকের দিকে, /
এ যেন একটা ডিমের দুটো মেরু; / ওর ফলেই ঐ প্রগতি/ জমাট আকুঞ্চনী কেন্দ্র হ'তে / প্রসারণী সম্বেগের ধাক্কা পেয়ে/আর এক ধাপ নীচেয় নেমে আসল, / এখানেই অস্তি / অহংবোধিতে উদ্ভিন্ন হ'য়েউ ঠল-/ঐ চৈতন্যভাণ্ডারের ঝঙ্কার-অনুবন্ধনায়৮ / যে-শক্তি পেয়ে / সে সত্যলোকের নীচে / আর, এক ধাপ নেমে আসল-/শ্বেত হ'তে শ্যামলী বর্ণে উদ্ভিন্ন হ'য়ে; / ঐ সত্যলোকের প্রতি আকর্ষ'ণ থেকে/সে যখন আর নীচে নামতে পারল না, / লীলায়িত জীবন-জলুস নিয়ে / সৎপুরুষেই আকৃষ্ট হ'তে লাগল/ তখন ঐ শ্যামলী ধারার সঙ্গে / পুনরায় নেমে এলো একটা পীতাভ প্রদীপনা; / সংনিবদ্ধ সমাবর্ত'নী অনুক্রমণায় / চলন্ত হ'য়ে উঠল ব'লেই / তা'কে ধারা বলা হয় । ঐ শ্যাম ধারা ও পীত ধারার / সহজ আকুঞ্চন-প্রসারণী সম্বেগ-সংঘাত নিয়ে / মিলন-বিরহের উচ্ছ্বাস-সঙ্গমে / সে ব্রহ্মাণ্ড-সৃজনী অভিসম্বেগ নিয়ে / চলতে লাগল-/স্তর-পারম্পর্য্যে; / এর
________ _________________ _____________
(৭) সংযুক্তকরণী কেন্দ্র (৮) ঝঙ্কারের অনুবন্ধন বা সংযোগ
কেন্দ্রপুরুষই হ'লো 'সোহহং পুরুষ'/-সাধকরা ব'লে থাকেন,-/সংখ্যান- সম্বেগী৯ ব'লে একে অনেকে /কালপুরুষ বলেন; আর, প্রত্যেক স্তরের কেন্দ্র বা মেরুই হ'চ্ছে তা'র নিয়মন-পুরুষ; আবার, যমন বা সঙ্কোচনের সম্বেগ/যেখানে যত গাঢ়, / অনুভূতিও সেখানে তত খিন্ন / অন্তরাবেগ,/ তীর তমসাও সেখানে তত বেশী,-/যা' প্রত্যেকটি মন্ডলের শেষসীমায় দেখা দেয় / আবার, নূতন স্তর বা মণ্ডল বিকাশোম্মুখ যত/ অনুভূতিও সেখানে স্ফোটন-সম্বেগী তত, / শব্দ ও দ্যোতন-দীপনাও/ ক্রমশঃ স্ফূটতর হ'তে থাকে/তেমনি,/এখানে ঐ ব্যোম-বিজৃম্ভী১০ চিদ্- অণুগুলি/সঙ্কলিত হ'য়ে/নানাগুচ্ছ সৃষ্টি ক'রে / সমবিপরীত তাৎপর্য্য নিয়ে / সম্মিলনী পর্যায়ে ভাঙ্গাগড়ার বিচিত্র বিন্যাসে/সন্নিবেশিত হ'য়ে/ নানা স্তর সৃষ্টি ক'রতে লাগল; / যে-কেন্দ্র বা রণ্ধের ভিতর-দিয়ে/এই সম্বেগ-উৎসৃজন-অনুস্রোতা হ'য়ে / এই স্তরের বিকাশ আরম্ভ হ'ল-/ঐ সোহহংপুরুষের নিম্নকেন্দ্র থেকে,-/হয়তো তা'কেই সাধকরা/'ভ্রমরগুহা' বা 'গুফা' ব'লে থাকেন; এমনি ক'রে নানা স্তরে উদ্ভিন্ন হ'য়ে /ঐঅণু- সঙ্কলন / ক্রমে ঘনায়িত হ'তে হ'তে/কণায় পর্য্যবসিত হ'তে লাগল,/এই কণা হ'তেই উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠলো/পিন্ডিকা অর্থাৎ সুসংহত কণারাশি,/ যা'র যথাবিহিত নিবদ্ধ পরিক্রমায়/ফুটে উঠলো এই জগৎ বা পিন্ডদেশ,/ যা' অবস্থামাফিক চেতন-দীপনার ভিতর-দিয়ে / জৈবী-নিয়মনে উদ্ভিন্ন হ'য়ে/তা'র পরিবেশকে তেমনতরই অনুভব ক'রতে লাগল; ফল কথা, ঐ চিদু-অণু /চিদ-অণু-সঙ্কলিত পরমাণু,/ পরমাণু-সঙ্কলিত অণু! অণু-সঙ্কলিত কণা, / ও কণা-সঙ্কলিত পিণ্ডিকার/ ওতপ্রোত সংস্রব-
_______ __________________ ____________
(৯) গুণিত হয়ে বর্দ্ধিত হবার আবেগ-সম্পন্ন গতিযুক্ত
(১০) ব্যোম অর্থাৎ আকাশের প্রকাশক
সন্দীপনা থেকে / বিভিন্ন পরিক্রমায় / সংস্রব-সংশ্রয়ের ভিতর-দিয়ে। মাতৃক জগৎ উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠল,/ যা' সমবিপরীত সঙ্গমের ভিতর-দিয়ে। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য-পরিক্রমায়/নানা বৈশিষ্ট্যে প্রকটিত হ'য়ে/প্রকট হ'তে লাগল, / আর, এ হ'তেই/ ঐ ব্রহ্মাণ্ড ও পিন্ডের মোহনাতেই/ত্রিধারার উৎপত্তি হ'য়ে উঠল, / ইড়া অর্থাৎ গতিসম্বেগ / পিঙ্গলা অর্থাৎ জ্যোতিসম্বেগ / আর, সুষ ম্না অর্থাৎ অব্যক্ত শব্দে/অতিশায়িনী সম্বেগ। বা প্রবর্ত্ত'না/স্তরে স্তরে । নানাপ্রকার স্থুল দেহ অবলম্বন ক'রতে ক'রতে। স্থূল হ'তে স্থূলতরে অভিব্যক্ত হ'তে লাগল,/ এই ত্রিকূটিতে / বিরাট শূন্যের ভিতর দিয়ে । ঐ কণাগুলির নানা পরিক্রমা/ সঙ্কোচনার বিরাট্ অন্ধকার ভেদ ক'রে / সহস্রারে স্ফুটন-দীপনায় / আত্মপ্রকাশ ক'রতে লাগল, / এই সহস্রারই হ'চ্ছে / স্থূল জগতের সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি,/ একেই বোধ হয় সাধকরা / 'জ্যোতিনিরঞ্জন' ব'লে থাকেন; তা'র-পর যথাক্রমে অন্যান্য লোক, স্তর, / কমল বা মণ্ডল সৃষ্টি হ'য়ে/স্থূলতরে আত্মবিকাশ লাভ করল-/জীবনদীপনা নিয়ে- বীপ্সানুগ আবর্তনে১১ এর প্রত্যেকটি স্তরে / শব্দ, রাগ বা রং ও জ্যোতি/বিভিন্ন প্রকারের; এই জীবনপ্রভা-বিস্ফুরণের সাথে-সাথেই / আত্মসংরক্ষণ, আত্মসম্পোষণ/ ও আত্মবিস্তারণ-প্রবোধনা / ক্রমশঃই জেগে উঠতে লাগল- নানা ছন্দের লীলায়িত সংঘাতের ভিতর-দিয়ে/নানা বৈশিষ্ট্যে উদ্ভিন্ন হ'তে হ'তে/বোধ সঙ্কলনী তাৎপর্যে একটা দৃপ্ত জীবনীয় তালে, / এই ছন্দ এক-এক পরিস্থিতিতে/সেই পরিস্থিতিতে যেমন সম্ভব / তেমন ক'রেই আত্মপ্রকাশ করতে লাগল; আর, এরই অন্তনিহিত অণুগুলি ঐ আত্মরক্ষণ, আত্ম- পোষণ / ও আত্মবিস্তার-তাৎপর্যে'র ভিতর-দিয়ে/ নিয়ন্ত্রিত হ'য়ে বিন্যাস
__________ _______________ _____________
(১১) যুগপৎ ব্যাপ্তি-ইচ্ছা পুনঃ পুনঃ আবর্ত'ন
লাভ ক'রতে লাগল,-/সেইগুলিই হ'ল জনি; প্রাথমিক জীবনে অনেক স্থলে/একই দেহে/স্ত্রী-পুরুষের সঙ্গতি সম্ভব হ'য়ে উঠল, / ওকেই বোধ হয় সাধকরা / 'অর্দ্ধনারীশ্বর' ব'লেছেন,/ পরে, পরিবেশ ও প্রাণন- পরিচর্য্যার/সংঘাতের ভিতর-দিয়ে/স্ত্রী-পুরুষের দেহ / আলাহিদাভাবে উৎক্রামিত হ'য়ে উঠল,/ আর, ঐ পুরুষেই নিহিত থাকল / স্ত্রীবীজ ও পুংবীজ উভয়ই ; / বিভিন্ন সংশ্রয়ে,/বিভিন্ন রকমের পরিস্থিতির ভিতর- দিয়ে/ঐ বীজই স্ত্রীগর্ভে'/পুরুষ ও নারীর বিভিন্ন সংগঠনে/উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠে। স্ত্রী ও পুরুষে ভেদ সৃষ্টি ক'রে চলল; স্ত্রী-ডিম্বকোষে রইল/ জনি-অনুপাতিক রজোবিন্যাস,-/ যা' পুরুষের বীজ-অনুস্যুত সম্ভাব্যতাকে/দেহে উদ্ভিন্ন ক'রে তোলে; / আর, পুরুষের বীজদেহে রইল জনি-/জীবন-গুণপনা; / আবার, যেমন-যেমন বিশেষত্ব যেমন- যেমন ক'রে/উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠল, তদনুপাতিক পুরুষ ও স্ত্রীর ভিতরে/ ঔপাদানিক সমাবেশ/তেমনতরই হ'য়ে রইল, / যা'তে তজ্জাতীয় পুরুষ ও স্ত্রী/ উভয়েই উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠতে পারে,/ এমনি ক'রেই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য/সংক্রমণশীল হ'য়ে নানা তাৎপর্য্য-তৎপরতায় চলতে লাগল-/ একটা বিবর্ত্ত'নী আবর্ত্তন-সংক্ষুধ সম্বেগে-/ছন্দানুবর্ত্তিতায়,/প্রত্যেকটি ছন্দ আবার/উপযুক্ত অভিব্যক্তি লাভ ক'রে/তা'র পারিবেশিক/প্রত্যেকটি ছান্দিক অভিব্যক্তির ভিতর/আত্মিক-সংশ্রয় লাভ ক'রে চলতে থাকল,/ তাই, প্রত্যেকটি অভিব্যক্তির/পরম আকুতিই হ'চ্ছে/নিজে থেকে বা বেঁচে সম্বৃদ্ধ হ'য়ে চলা,/ সম্বর্ধনায় আত্মনিয়ন্ত্রণ ক'রে চলা-/নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যমাফিক-/সর্বতোভাবে-/যে যেমন, সেই তাৎপর্য্যে/এমনি ক'রেই প্রতিটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে/ভর-দুনিয়া সচ্চিদানন্দে উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠল;/ ঈশ্বর মহান/তিনি অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান; আবার, সুকেন্দ্রিক
তদর্থ পরায়ণ তপানুচর্য্যার/ভিতর-দিয়ে/ জনিকে উদ্ভিন্ন ক'রে/সুসঙ্গত বোধি-তাৎপর্য্যে/কুশল-ধী হ'য়ে/সার্থক সমঞ্জস এই তত্ত্ব/যাঁ'তে উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠেছে,-/তিনিই বৈশিষ্ট্যপালী আপুরয়মাণ শ্রেয়-পুরুষ/ লোকপালী নরবিগ্রহ তিনি, / প্রেরিত বা তথাগত তিনিই,/ তিনিই মৈত্রেয়/-মানুষের স্বতঃ-সম্পদ,/সংহতির জীয়ন্ত কেন্দ্রকীলক, বিবর্ত্তনের পরম হোতা,/ এই হ'ল মোক্তা কথায়ー/পিণ্ড, ব্রহ্মাণ্ড ও চৈতন্য-দেশের মোক্তা বিবরণ, যা' প্রতিভাত হ'য়ে উঠেছে আমার কাছে।
(দর্শন-বিধায়না)
10