📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔷 ভাল ডাক্তার হতে গেলে করণীয়...
🔷 ছেলেদের মধ্যে পরাক্রম জিনিসটা ফুটবে কি করে ?
🔷 মানুষ চেনার সহজ উপায় কী ?
🔷 কোথাও যাবার সময় ভাল দিন দেখে যাওয়া কী ভাল ?
৮ ই পৌষ , মঙ্গলবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৩/১২/৪১ )
[189-193]
একে শীতের দিন , তায় আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে , আশ্রমের " সামনের দিকে দুরন্ত ঠাণ্ডা হাওয়া , তাই ভােরে লোকসমাগম কমই হয়েছে । প্যারীদা ( নন্দী ) ও সেবকবৃন্দের মধ্যে কতিপয় আছেন । পদ্মাপাড়ের তাসুর দরজা - জানালার বেশীর ভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । শ্রীশ্রীঠাকুর ক্যালেণ্ডারের দিকে চেয়ে করুণভাবে বলছেন , আজ কেবল ৮ ই পৌষ , এখনও পৌষ মাসের কতদিন বাকী , তারপরে আছে মাঘ , এই শীত পাড়ি দেব কিভাবে তাই তাে ভাবি ।
সরোজিনীমা — আজ মেঘলা দিন বলে এত ঠাণ্ডা , রােজ তাে এত ঠাণ্ডা পড়বে না । দেখতে - দেখতে কেটে যাবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কেটে তো যাবে , কিন্তু সামাল দিতে পারলে সে হয় । যাক, তুই ভাল করে এক কলকি তামুক খাওয়া , দেখি তা'তে একটু গরম হতে পারি কি না ।
সরোজিনীমা — হ্যাঁ । তামাক দিয়ে তারপর আপনার পা’টা ভাল করে ঘষে দিচ্ছি । দেখবেন তাতে একটু আরাম পাবেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর একটু টেনে বললেন — তাই - ই দাও ।
আশ্রমের স্বাস্থ্য - সম্বন্ধে কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে প্যারীদাকে বললেন — দ্যাখ , প্যারী : ভাল ডাক্তার হতে গেলে অনেক কিছু করা চাই । রোগ হলে চিকিৎসা ক'রে আরাম করাটাই ডাক্তারীর সব নয় । যাতে অসুখবিসুখ না হয় এবং লােকের স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও উন্নত হয় , সে - দিক দিয়েও ডাক্তারের অনেক কিছু করবার আছে । এ - সব বিষয়ে মানুষের জ্ঞান অতি সীমাবদ্ধ । তাই তোমরা সচেতন হয়ে সবাইকে বার-বার বলবে এবং তাদের দিয়ে যা ’ করবার করিয়ে নেবে ।
প্যারীদা — কোন - কোন দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে , বলে যদি দেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কতবার কতভাবে বলেছি । প্যারীদা — আর একবার গুছিয়ে যদি বলেন , ভাল হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভাবতে গেলে , তার মার পেটে আসার আগে থেকে ভাবতে হবে । প্রথম চাই উপযুক্ত বিবাহ , উপযুক্ত দাম্পত্য জীবন । পিতা - মাতার বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনে যদি অসঙ্গতি থাকে , তবে ছেলেমেয়ে শরীর - মনে সুস্থ হতে পারে না । তারপর , মেয়েদের জানা চাই , ঋতুকালে ও গর্ভাবস্থায় কিভাবে চলতে হয় । সহবাস কাকে বলে — পুরুষ , মেয়ে কেউই জানে বলে মনে হয় না । ক্ষণিক উত্তেজনার বশে মিলনটাই সহবাস নয় । স্বামী - স্ত্রী উভয়ের মধ্যে গভীর আদর্শপরায়ণতা , গভীর অনুরাগই এর মূল জিনিস । তখন উভয়েরই থাকে প্রীত করে প্রীত হওয়ার বুদ্ধি , তা'তে লাগে অনেকখানি সংযম ও সাধনা , নিজের সুখের কথা সেখানে গৌণ , অপরের সুখই মুখ্য । এইটে হ'লো প্রেমের রীতি । আর , স্বামী - স্ত্রী যেখানে আদর্শপরায়ণ , তাদের যৌন - মিলনের পিছনেও বুদ্ধি থাকে — এর মধ্যদিয়ে যদি সন্তানের আবির্ভাব হয় , সে - সন্তানও যেন ইষ্টের পূজায় লাগে । স্বামী - স্ত্রীর দৈহিক মিলনের পটভূমি যদি সহজভাবে এমনতর হয় , ইষ্টের স্মৃতি , কৃষ্টির স্মৃতি , ধর্মের স্মৃতি , পূর্বপুরুষের স্মৃতি যদি জাগ্রত থাকে , আত্মসুখস্পৃহার থেকে প্রীণন - স্পৃহ যদি প্রত্যেকের মধ্যে প্রবল থাকে , তবে সেখানে সন্তান দেহ - মনে বলিষ্ঠ হবেই । পুরুষ যদি ইষ্টনিষ্ঠ হয় , স্ত্রী যদি হয় স্বামীপ্রাণ , ইষ্টপ্রাণ , তথা সহধর্মিণী ; ইষ্টপ্রসঙ্গ , ধর্ম্মচৰ্য্যা , পরিবার ও পরিবেশের ইষ্টানুগ সেবা , সর্বপ্রকার উন্নয়নী আনন্দদায়ক অনুশীলন — এইগুলি যদি তারা যৌথভাবে করতে অভ্যস্ত হয় , —প্রত্যেকে তার বৈশিষ্ট্যমত , —তবে তাদের কামকলার ক্ষেত্রও অনেকখানি সুস্থ , উন্নত ও পবিত্র হয় । পিতা - মাতার এই এমনতর শ্রদ্ধানুগ অনুশীলন - তৎপরতার ভিতর - দিয়ে যে বৈধী মিলন সংঘটিত হয় , তার ভিতর দিয়ে সন্তান সুষ্ঠ , জৈবী - সংস্থিতির অধিকারী হয়ে ওঠে । ঐ জৈবী - সংস্থিতিই হচ্ছে জীবনের আকর । জাতকের রােগ - নিরােধক্ষমতা , আযু় ও বর্দ্ধন - তৎপরতা ঐ জৈবী - সংস্থিতির উপরই নির্ভর করে । আর , অমনতর যৌনচর্যার ফলে স্বামী - স্ত্রীর শরীর - মনও সুস্থ ও দীপ্ত হয়ে ওঠে । রুগ্ন কাম অনেক বিপর্য্যয়ের সৃষ্টি করে ।
প্যারীদা — এ বিষয়ে ডাক্তার হিসাবে আমরা কী করতে পারি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তােমাদের সুবিধা অনেক । বিপদে পড়ে তোমাদের কাছে মানুষ আসে। তাদের যেমন সেবা দাও , সঙ্গে - সঙ্গে তাদের মাথায় যদি ঢুকিয়ে দাও — তাদের প্রাণে ব্যথা না লাগে , —এমনতরভাবে , তাহলে তারা উপকৃত হবে । বিশেষ - বিশেষ মুহূর্ত আছে , যখন কায়দামত কথা বলতে পারলে , মানুষের মাথায় ধরে । তোমাদের জীবনে সেই সুযােগ বেশী আসে । উপদেষ্টার মত বলতে নেই , বলতে হয় দরদীর মত । আর , যে - কথা গোপনে বলবার , সে - কথা গােপনেই বলতে হয় । এ ছাড়া মানুষের খাদ্য , কাজকর্ম , আমােদ - প্রমোদ , খেলা - ধূলা , ঘুম , বিশ্রাম ইত্যাদির সুষ্ঠ রকম - সম্বন্ধেও বুঝিয়ে দিতে হয় । খাদ্যের গুণাগুণ খুব কম মায়েরাই জানে , শরীরের কখন কোন অবস্থায় কোন্ খাদ্য উপযােগী , সে - সম্বন্ধে মায়েদের মুখে - মুখে ওয়াকিবহাল করে দিতে হয় । যখনই কোন বাড়ীতে কোন রােগী দেখতে যাও , ব্যাপক দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য করতে হয় , জানতে হয় , তাদের খাওয়া - দাওয়া , রান্নাবান্না , চলাফেরা , সদাচার , পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি কেমন । কোন - কোন বাড়ীতে হয়তো পেট খারাপ অথচ খুব তেল , মসলা ও ঝাল দেয় । এটা যদি তুমি নিবারণ না কর , তবে শুধু ওষুধ দিয়ে রােগ সারাতে পারবে না । বাড়ীঘর করার সময় অনেকে টাকা - পয়সা যথেষ্ট খরচ করে , কিন্তু আলাে - হাওয়ার ব্যবস্থা কেমন রাখলে , পােতাটা কতটুকু উচু হ'লে স্বাস্থ্য ভাল থাকে , তা হয়তাে জানে না , সেগুলি বলে দিতে হয় । অনেক বাড়ীতে অন্য ঘর থাকা সত্ত্বেও গাদা দিয়ে একঘরে বহু লোক হয়তাে থাকে , তা ভাল নয় । কোন - কোন বাড়ীতে এমন দেখেছি , রান্নাঘরটা এমনভাবে করে যে , সেখানকার কয়লার ধোঁয়া বাসঘরগুলির মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই , অথচ এতে স্বাস্থ্যের অনেকখানি ক্ষতি করে । পাকা রান্নাঘর করবার সময় একটা চিমনির ব্যবস্থা করা এমন - কিছু কঠিন নয় । জল - নিকাশের ব্যবস্থা - সম্বন্ধে যতটুকু আমাদের করবার তা আমরা করি না । ফলে , বাড়ীর কাছে জল জমে মশা হয় , ম্যালেরিয়া হয় । এগুলি - সম্বন্ধে তােমরা যদি প্রত্যেককে সাবধান করে না দাও , তবে শুধু কুইনাইন দিয়ে ম্যালেরিয়া কত সারাবে ? সকলকেই এগুলি ' বলতে হয় । অবশ্য রােগ - নিরােধক্ষমতা যত সুন্দর ও শক্ত হয় ততই ভাল । রােগসংক্রমণ - সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের তাে কোন ধারণাই নেই । বহু শিক্ষিত লােককে দেখেছি — টলটলে সর্দি নিয়ে বহু লোকের মধ্যে এসে নির্বিবাদে ব'সে যাচ্ছে । এতে যে কত লােকের ক্ষতি করছে , তা সে বোঝে না , আর , যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে , তারাও বুঝে সাবধান হয় না । আমাদের এখানে টিউবওয়েল থেকে বাঁচোয়া , কিন্তু জল - সম্বন্ধে বহু জায়গায় মানুষের খেয়াল নেই । বাইরে গ্রামে যেখানে রোগী দেখতে যাও , খোজ নিও , কোন্ জল খায় , কোন্ জলে রান্না করে। অবশ্য তােমাদের দৌলতে আশেপাশে বহু জায়গাতেই টিউবওয়েল হ'য়ে গেছে । ফলকথা , একটা রােগী দেখতে তার হাঁড়ি - হেঁসেল থেকে পায়খানা প্রস্রাবের জায়গা , গােয়াল পর্য্যন্ত দেখবে । প্রত্যেকের বাড়ীর আশেপাশের জঙ্গল যা’তে সাফসাফাই ক'রে রাখে , সে - বিষয়েও মানুষকে বলবে । প্রতিষেধক হিসাবে যখন যে ইনজেকসন , টিকে ইত্যাদি নেওয়া দরকার , সে - সম্বন্ধে মানুষকে অবহিত আর স্বাস্থ্য , সদাচার ইত্যাদির বিষয়ে আমি যেগুলি বলছি সেগুলি ভাল করে পড়ে রাখবে , এবং প্রত্যেকে যাতে পালন করে চলে , সে - বিষয়ে তাদের বুঝিয়ে দেবে । কোন্ রােগে কোন্ বিধি - নিষেধ মেনে চলতে হয় , শুশ্রূষাকারীকে কেমনভাবে চলতে হয় , সব পইপই করে শিখিয়ে দিতে হয় । প্রত্যেক গৃহস্থ - ঘরে এ্যাজামঞ্জিট , প্রিভেন্টিনা , অইিডিন , ফেনাইল , কার্বলিক সাবান ইত্যাদি কতকগুলি প্রয়ােজনীয় জিনিস রাখার কথা বলে দিতে হয় । আমি যে এত কথা তােকে বলছি তার কারণ , তাের বাড়ীতে - বাড়ীতে যাওয়া পড়ে । তাের মানুষের জন্য করা আছে ঢের , তােকে মানুষ ভালবাসে । তুই অন্যান্য ডাক্তারদের নিয়ে যদি চেষ্টা করিস , হাওয়া ফিরিয়ে দিতে পারিস , । ধর্ম্ম কা’কে কয় , ধার্ম্মিক কাকে কয় , তোদের মধ্যদিয়ে আমার সবাইকে দেখতে ইচ্ছা করে । ধার্মিক বলতে আমি বুঝি সেই মানুষ , যে নিজের ও অশিপাশের সবার বাঁচা বাড়ার জন্য যা যা করণীয় তা ’ করে ও করায় — সুকেন্দ্রিক সার্থক - তৎপরতায় । অনেকে জানে না , বাঁচা - বাড়ার জন্য কতখানি করতে হয় , আবার জেনেও অনেকে । করে না , করায় না । তোমরা যদি সবদিক খেয়াল রেখে কঠোর পরিশ্রম না কর , তাহলে আমার সব চেষ্টা অরণ্যে রােদন হ'য়ে যাবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কয়েক মিনিট চুপ ক’রে রইলেন । তারপর হঠাৎ বললেন — এমন দিনে পিঠে - পায়েস , না হয় খিচুড়ি , এইসব খেতে হয় ।
কালিদাসীমা — খাবেন ? বড়মাকে ব’লে আসি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —সে - কথা আর জিজ্ঞাসা কর কেন ?
কালিদাসীমা — কী করতে বলব ? শ্রীশ্রীঠাকুর — সে কী আমি বলতে পারি ? সে বড়বৌ জানে । আমি তাে পেলেই মেরে দেব। কী খাওয়া উচিত , কী খেলে সহ্য হবে , সে বড়বৌ জানে । আমার পছন্দ কী তাও তার জানা আছে । আমার পেটের অভিভাবক বড়বৌ ।
এরপর নানারকম পিঠে - সম্বন্ধে গল্প উঠলো , কোন্ পিঠে কেমন করে করে , কোনটার আস্বাদ কেমন ইত্যাদি ।
[P 193-204]
শ্রীশ্রীঠাকুর এরপর প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে নিলেন । পরে আবার তাসুতে এসেই বসলেন । কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , শরৎদা ( হালদার ) প্রভৃতি অনেকে আসলেন । হিন্দুমহাসভা - সম্বন্ধে কথা উঠলাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — হিন্দুমহাসভা যা ’ করছে ভাল , তবে ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যদি না থাকে , তবে কোন আন্দোলনই জয়ী হতে পারে না । আচারে , ব্যবহারে প্রত্যেকটি হিন্দুকে খাঁটি হিন্দু করে তুলতে হবে । খাঁটি হিন্দু , খাটি মুসলমান , খাটি খ্রীষ্টানে কোন বিরােধ নেই । আমরা পূর্বতন মহাপুরুষ প্রত্যেককে মানি , রসুলকেও মানি , যীশুকেও মানি । সে - হিসাবে মুসলমান , খ্রীষ্টান , সবাই আমাদের পরিবারভুক্ত । সবারই উন্নতি যা’তে হয় সেজন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে । সমাজ - ব্যবস্থা , বিবাহ - ব্যবস্থা ইত্যাদি - সম্বন্ধে ঋষিরা সংহিতায় যে বিজ্ঞানের নির্দেশ ক'রে গেছেন , তা সবার মধ্যে চারিয়ে দিতে হবে । প্রতিলােম - সম্বন্ধে খুব হুশিয়ার হতে হবে , আর , বিধিমাফিক অনুলােম অসবর্ণ বিবাহ যত হয় , ততই ভাল । পরিপূরণী এক আদর্শের অনুসরণ ও বিহিত সবর্ণ ও অনুলোম অসবর্ণ বিবাহ — এই দুটি জিনিস সব সমাজের মধ্যে , সব সম্প্রদায়ের মধ্যে চারিয়ে দেন , দেখেন কী হয় । সামনে কনফারেন্স আসছে , প্রত্যেককে এমন করে ক্ষেপিয়ে দেবেন যে , সে যেন তার জায়গায় গিয়ে আর সকলকে মাতিয়ে তােলে , আর যাজনের ঢেউগুলি ক্রমশঃ বিভিন্ন স্থান থেকে বিস্তার লাভ করে পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে সারা দেশের রন্ধ্রে - রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করে । কয়েকটা মানুষ মরিয়া হয়ে লাগলে সারা দেশকে বাচান যায় , সারা পৃথিবীকে বাঁচান যায় । আপনারা তো আমার এত আছেন বিদ্বান , বুদ্ধিমান , গুণী । আমি যা কই , বোধ - দৃষ্টি নিয়ে যদি ক'রে যান , অন্য কোন ধান্ধা , অন্য কোন ইচ্ছা , অন্য কোন খেয়াল , অরাম , আলস্য ইত্যাদি বুদ্ধি যদি না থাকে , দেখবেন খুব কঠিন কিছু নয় । সময় থাকতে যদি না করেন , পরে অনেক জিনিস হাতের বাইরে চলে যাবে । তখন হাজার গুণ পরিশ্রম করেও পেরে উঠবেন না । এখনও সময় আছে , আর দেরী করলে । বরাবরের মত পস্তাতে হবে । এই কনফারেন্সের পর যে বাংলার সব জেলাতে কর্মী পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন , সে খুব ভাল । আপনি এখান থেকে চিঠিপত্র দিয়ে তাদের সবসময় মাতিয়ে রাখবেন । অরি , শরৎদা ও প্রফুল্ল জায়গায় জায়গায় যেয়ে যাজনের ঢেউ তুলে ওদের কাজে সাহায্য করবে । একটা উৎসাহ , উদ্দীপনা ও সঙ্কল্পের ভাবকে সবসময় জাগিয়ে রাখতে হয় । ক্রমাগত push ( ঠেলা ) দেওয়া দরকার , একটা মানুষও যেন ঝিমিয়ে পড়ার অবকাশ না পায় । Take it for granted ( এটা ধ’রেই নেবেন ) যে - মানুষের জড়তা আছে , fatigue ( ক্লান্তি ) আছে , কিন্তু আপনাদের এতখানি অতন্দ্র হ'য়ে চলতে হবে যে , আপনাদের স্ফুৰ্ত্তিদায়ক তাড়না ও প্রবোধনায় সবার সব অবসাদ ছুটে পালায় । কাজ যদি আশানুরুপ না হয় , তবে জানবেন , আপনারা মাথা - মাথা যারা তারাই দায়ী । সৎসঙ্গীদের মত এমন সোনার চাদ মানুষ দেখি না । এমন সব মানুষ হাতে পেয়ে এদের দিয়ে যদি করিয়ে না নিতে পারেন , তবে আপসােসের সীমা থাকবে না । আর , এই কনফারেন্সে ১৩০ টাকার ব্যাপারটা জোরসে চারিয়ে দেন । আস্তে - আস্তে প্রতিষ্ঠানগুলি সব জাকিয়ে তুলুন , বইপত্র গুলি ছাপিয়ে ফেলুন , আর জমিটমিও আরাে কেনা দরকার , তা না হলে লােকজন আসলে তারা খাবে কী ? যুদ্ধের ব্যাপার যেমন ঘােরল হ'য়ে দাড়াচ্ছে তাতে কী হয় বলা যায় না ।
সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছেন ।
নগেনদা ( বসু ) জিজ্ঞাসা করলেন — ছ'বছরে ১৩০ টাকা আমাদেরও কি দিতে হবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — টান থাকলে আপনা - থেকেই দান আসে , তখন আর জিজ্ঞাসা করে না ।
নগেনদা — যারা এখানে পড়ে আছে , টান না থাকলে তারা থাকবে কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — অনেকের hypocrisy of attachment (টানের ভান ) আছে , real ( সত্যিকার ) টান অন্য জিনিস । আপনি যেমন খোকনকে ভালবাসেন , তার আলােয়নটার উপর পর্য্যন্ত আপনার যতখানি টান , খােকনের জন্য আপনার বুকখানা যেমন করে , তার জন্য যতখানি উদ্ব্যস্ত হয়ে ঘোরেন , আমার জন্য কি ততটা হয় ? একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারেন । আমার এ - সব কথা বলা ভাল না । এগুলি বড় রুঢ় সত্য , মানুষের প্রাণে লাগে । আমারও বলতে ইচ্ছা করে না । তবু বলি আপনাদের আত্মবিশ্লেষণের সুবিধার জন্য । এ - কথা মনে করবেন না যে আপনার ছেলেপেলেদের ভালবাসেন , তা ’ আমি পছন্দ করি না । সে আমি ঢের পছন্দ করি । ছেলেপেলের জন্য বাপের প্রাণ কেমন করে , সন্তানের পিতা হিসাবে সে আমি খুব বুঝি । তাদেরটা যদি আমি না বুঝতাম , তাহলে আপনাদেরটাও বুঝতে পারতাম না । আমার কথা হচ্ছে , মানুষের জীবনে মুখ্য হওয়া উচিত তার ইষ্ট , তবেই তার মাথা ঠিক থাকে , যার প্রতি যা করণীয় ঠিকভাবে করতে পারে । আমরা বৌ - ছেলেপেলের পেছনে ছুটি , বোঁ - ছেলেপেলে প্রবৃত্তির পেছনে ছােটে , এতে সবারই অশান্তি । বৌ - ছেলেপেলে যদি দেখে যে আমি দেহ - মনে ইষ্টকে নিয়ে ব্যাপৃত এবং তাদের প্রতিও স্নেহশীল , তখন তারাও আমামুখী হয় , ইষ্টমুখী হয় , এতে দুঃখ - কষ্টের মধ্যদিয়ে চলতে হ'লেও পরিণামে ফল ভালই হয় । আর , কেউ যদি উপচয়ী হয় , কৃতী হয় , তার দুঃখ - কষ্ট বেশীদিন ভােগাও লাগে না । ধরেন , এখানকার কোন কৰ্ম্ম - প্রতিষ্ঠানের সংস্রবে থেকে আপনি দু’পয়সা নেন , আপনার যদি ঐ কর্মের ভিতর - দিয়ে আমাকে উচ্ছল ও লাভবান করে তােলার বুদ্ধি থাকে , না চাইতেই আমাকে দেবার বুদ্ধি থাকে , এবং সেই বুদ্ধি থেকে আপনি যদি আরাে কর্মঠ হয়ে ওঠেন , আর এইরকম যদি বেশীর ভাগ কৰ্ম্মীই হয় , তাহলে আমিও আপনাদের পূরচার করে দিতে পারি , আর অক্ষম , অযােগ্য যারা তেমন বহুকেও টানতে পারি । তাই আমার মনে হয় , আমার প্রতি টান থাকলে , আমার সবকিছুর পর টান থাকতাে , কৰ্ম্মপ্রতিষ্ঠানগুলির আজ এই অবস্থা হতাে না । প্রত্যেকেই আপনার বােধে খাটতাে , নিতো , দিতো নিজেরাই লাভবান হতাে , উচ্ছল হতাে । মানুষ এই সােজা কথাটাই বােঝে না যে , ইষ্টার্থী হওয়াই আত্মস্বার্থসম্পূরণের শ্রেষ্ঠ পথ । ইষ্টের স্বার্থের মধ্যে সবার স্বার্থই নিহিত আছে । তাঁর সুমহান বিপুল স্বার্থকে যদি আমার স্বার্থ করে নিই এবং তা পূরণ করার জন্য যদি লাভজনকভাবে খাটি , তবে আমার ভাত মারে কে ? আপনারা বড় হন , সুখে - স্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন , লােভনীয় দেব - চরিত্রের অধিকারী হয়ে ওঠেন — এই আমার স্বার্থ , সেই স্বার্থের খাতিরেই তাে আপনাদের পেছনে এমন করে লেগে থাকি ।
নগেনদা — আমাদের এই টানটুকু হয় না কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — কোন প্রশ্ন নেই , যে করে তার হয় । মানুষ যে পােষ্যপুত্র গ্রহণ করে , ক’দিনেই পরের ছেলে আপন ক’রে নেয় । দারােগাদা যে বিড়ড়ল পােষে , বিড়েলের জন্য কত করে , দারােগাদার কাছে তার কত আদর , সেখানে সেই বিড়েলের ভাগ্যি কি আমার আছে ?
সকলে হেসে ফেললেন । এমন সময় ছােট মসীমা আসলেন , —শ্রীশ্রীঠাকুর দেখেই উল্লসিত হ’য়ে বললেন — ভেলকুর মা আইছ ? আসো , ( নিজের পাশে জায়গা দেখিয়ে দিয়ে ) এখানে ব'সো ।
মাসীমা — আমার যে এখন কাজকর্ম আছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) “ কাজকর্ম্ম তাে নিত্যি আছে । ও কিছু না । তুমি বসে মােনে ।
মাসীম হেসে বললেন — তোমার সঙ্গে পারবার জো নেই । —(এই ব'লে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসে বসলেন । )
দুই - এক মিনিট নীরবে কাটলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর ( করুণ কণ্ঠে ) —মা যেয়ে আমি যেন ডানা - ভাঙ্গা হ’য়ে পড়েছি । দুনিয়াটা যেন মনে হয় ফাকা । সবার ব্যথার কথা আমাকে বলে , কিন্তু আমার ব্যথার কথা বলার জায়গা নেই । মা আমাকে অকারণ কত বকতেন , তবু মাকে ভাল লাগতাে , আমার একটা আশ্রয় ছিল । এখন যেন মনে হয় নিরাশ্রয় । গোপাল ছিল , সে আমার মনের অবস্থা খুব বুঝতাে । আমার যখন মনটন খারাপ দেখতাে , আমার কাছ থেকে নড়তে চাইতো না । নানারকম গল্পটল্প করে আমাকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করতো । হয়তাে বিজ্ঞানের কোন নূতন আবিষ্কার - সম্বন্ধে গল্প সুরু করে দিতো , দেশ - বিদেশের কত রকমারি খবর বলতো । ওর ওই প্রচেষ্টা দেখে আমার ভাল লাগতাে ।
মাসীমা ব্যথিত দৃষ্টি মেলে শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে চেয়ে রইলেন ।
ইতিমধ্যে সুধীরদা ( দাস ) এসে কারখানার কাজকৰ্ম - সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জেনে গেলেন । সুধীরদা একটা কাজে গরমিল করে ফেলেছেন তাই শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন — শালা তেইশ মারিছে কামের ।
সুধীরদা লজ্জিত হয়ে বললেন — এখন গিয়ে ঠিক করে ফেলব । আমি আগে আপনার কথা ভাল করে বুঝতে পারিনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বুঝে কামে হাত দিতি হয় ।
এরপর মাসীমা তখনকার মত বিদায় নিলেন ।
কেষ্টদা— Psychology- তে ( মনােবিজ্ঞানে ) আছে যে ছেলেপেলেদের এক এক বয়সে , এক - এক instinct ( সহজাত সংস্কার ) -এর উদয় হয় , সেগুলি আবার বেশী দিন স্থায়ী হয় না , শিক্ষার ক্ষেত্রে সেগুলিকে কেমনভাবে কাজে লাগান যায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — যখনই যেটা জেগে ওঠে , তখন - তখনই সেটাকে সত্তা - সম্পােষণী রকমে পোষণ দিতে হয় । অনেক সময় জোড়া - জোড়া আসে , যেমন আগে সাহসিকতা , তারপর ভয় । সাহসিকতার সংস্কারকে পােষণ দিলে ভয়ের সংস্কার আর তেমন মাথা - তােল দিতে পারে না । এক সময় হয়তো গড়ার সংস্কার জাগলো , তারপর হয়তাে ভাঙ্গার সংস্কার জাগে । গঠনপ্রবৃত্তি যখন জাগে , তখন নানারকম সুযােগ দিতে হয় । হয়তাে কাঠ এনে দিলেন , হাতুড়ি , বাটাল এনে দিলেন , তাই দিয়ে একটা পিড়ি তৈরী করলো । শক্ত কাগজ এনে দিলেন , তাই দিয়ে ঘর বানালাে । মাটি দিয়ে একটা পুতুল তৈরী করলো , রং এনে দিলেন , তাই দিয়ে মনোমত ক'রে রং চড়ালো । একটা ছবি কিভাবে বাধাতে হয় , শিখিয়ে দিলেন । একটা কলসী ফুটো হয়ে গেছে , তা ’ ঝালাই করতে হয় কিভাবে , কারিগরকে দিয়ে দেখিয়ে দিলেন । বই বাঁধান , জামাকাপড় সেলাই করা , জামায় বােতাম লাগান , ঘড়ি মেরামত করা , টর্চ সারা , বাগানে বেড়া দেওয়া , রাজমিস্ত্রীর কাজ - সুযােগ - সুবিধামত নিত্য প্রয়ােজনীয় কত কাজই তখন শেখাতে পারেন । ঐ বিশেষ সংস্কার সজাগ থাকায় তখন গঠনমূলক যে - কোন কাজ শেখাতে গেলে সে গােগ্রাসে তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করতে চেষ্টা করবে । আর , ঐ কাজগুলি ভাল করে আয়ত্ত করার প্রয়োজনে তাকে পুঁথিগত যা - কিছু পড়তে বলেন , তাও সে আগ্রহের সঙ্গেই পড়বে । আবার , ঐ গঠন - প্রবৃত্তিকে যদি পুষ্ট হতে না দেন , পরে হয়তাে ভাঙ্গার প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠবে । ঐ ভাঙ্গন - প্রবৃত্তি যদি প্রবল হয়ে ওঠে , তখনও সেটাকে লাভাবহভাবে কাজে লাগাতে হয় । ধরেন , তাকে দিয়ে জঙ্গল সাফ করালেন , প্রয়ােজনীয় জায়গায় একটা গর্ত খোঁড়ালেন , একটা ঘর একভাবে সাজান আছে , জিনিসপত্রগুলি ওলট - পালট করে সুরুচিসম্পন্ন করে অন্য ভাবে সাজাতে বললেন , যাতে জায়গার অনটন না হয় , চলাফেরার অসুবিধা না হয় , অথচ দেখতে সুন্দর হয় । হয়তাে দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য আছে , সেই মনোমালিন্য ভেঙ্গে দেবার কাজে তাকে নিযুক্ত করলেন । এইভাবে যা - কিছু প্রবৃত্তি ও সংস্কারকে জীবনীয় রকমে ব্যবহার করবার কায়দা শিখিয়ে দিতে হয় । এইজন্য শিশু - শিক্ষকদের দায়িত্ব খুব বেশী । তাদের সর্বদা তরতরে , সজাগ ও অনুসন্ধিৎসু থাকতে হয় , অন্তদৃষ্টি নিয়ে চলতে হয় , উপযুক্ত মুহূর্তে profitable instinct ( লাভজনক সংস্কার ) মাফিক কাজ করিয়ে ছেলেপেলেদের habit ( অভ্যাস ) form ( গঠন ) ক'রে দিতে হয় , সেইটে লেখাপড়া শেখানর ব্যাপারে কাজে লাগাতে হয় । যেমন , আরােহণ - আগ্রহের দরুন ছেলে বেড়া বেয়ে উঠতে চাচ্ছে , তখন মারধর করে তাকে থামিয়ে না দিয়ে ধাপে - ধাপে বেড়া বেয়ে ওঠার সঙ্গে - সঙ্গে যদি তাকে ১ , ২ , ৩ , ৪ গােণা শিখিয়ে দেওয়া যায় , একসঙ্গে দুই কাজ হয়ে যায় । মা'র উচিত ৫|৭ বছরের মধ্যে ছেলের অভ্যাস , ব্যবহার , ঝোঁকসই করে দেওয়া । মানুষের একটা প্রধান প্রবৃত্তি হলাে অর্জন - প্রবৃত্তি । এই অর্জন - প্রবৃত্তির দরুনই মানুষ শিখতে পারে , কাজকর্ম করতে পারে , আহরণ করতে পারে । তাই , আগের কালে যে ছাত্রেরা ভিক্ষা করে , অহরণ করে গুরুকে খাওয়াতাে এবং তার প্রসাদ খেয়ে জীবন ধারণ করতাে , এ একটা মস্ত জিনিস ছিল । তখন তারা শিখতাে , কেমন করে পরিবেশের সেবা করতে হয় , পরিবেশকে জীবনের সহায়ক করে তুলতে হয় । মানুষের বাস্তব অভাব ও প্রয়োজনের সঙ্গে তারা পরিচিত হতাে এবং তার পূরণে তারা যত্নবান হতাে , এমনি করে বন্ধু ও বিষয়ের সম্পর্কে তাদের কার্যকরী জ্ঞানের অধিকারী হতে হতাে । তাছাড়া , মানুষকে খুশি করে আহরণ করতে হ’তাে ব’লে তারা শিখতো , কেমনভাবে মানুষ নিয়ে চলতে হয় । এর জন্য অনেকখানি আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হতো । কারণ , আত্মনিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা যার নেই , সে অপরকেও নিয়ন্ত্রিত করে নিজের অনুকূল করে তুলতে পারে না । এমনি করে তাদের ব্যক্তিত্ব বেড়ে উঠতো । তাই , আপনারা শিক্ষার মধ্যে ইষ্টভৃতি জিনিসটা ভাল করে ঢুকিয়ে দিতে পারেন এবং ইষ্টভৃতি যদি ছেলেমেয়েরা নিজেদের আহরণের উপর দাড়িয়ে করতে অভ্যস্ত হয় , তখন দেখবেন তাদের মাথা কতখানি খুলে যায় । শুধু ইষ্টভৃতি নয় , পিতামাতা ও শিক্ষককে দেওয়ার অভ্যাসও করতে হয় । মা’র বলা উচিত — ছেলে যা’তে ? বাবাকে কিছু দেয় , বাবার বলা উচিত — ছেলে যা'তে মা’কে কিছু দেয় । আবার , উভয়ের বলা উচিত ইষ্ট ও শিক্ষককে দেবার কথা । প্রত্যেক বাড়ীতে - বাড়ীতে কিছু - কিছু কুটিরশিল্পের ব্যবস্থা রাখাই ভাল । ছেলেপেলেদের বলতে হয় , তােমরা এমনভাবে কাজ কর , যাতে তােমাদের কাজের আয়ের উপর দাড়িয়ে ইষ্টভৃতি করতে পার । একটু বড় যারা তাদের হয়তো এক কাঠা জমিতে আলুর চাষ করতে দিলেন , দিয়ে বললেন — অলুি চাষের নিয়ম - কানুন ভালভাবে জেনে নিয়ে ভাল করে চাষ কর , এই জায়গাটুকুর ফসল হবে তােমাদের ঠাকুর পূজার অর্ঘ্য । এমনিভাবে ছেলেবেলা থেকে দায়িত্ব নিয়ে শ্রেয়ের জন্য যদি পরিশ্রম করতে শেখে , লাভজনকভাবে কাজ সুসম্পন্ন করতে শেখে , তাতে যে অভিজ্ঞতা জন্মাবে , যে আত্মপ্রত্যয় জন্মাবে , তা পরীক্ষা পাশের থেকে টের দামী ।
কেষ্টদা — ছেলেদের মধ্যে পরাক্রম জিনিসটা ফুটবে কি করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তারা যাতে অন্যায় বা ইষ্টবীরােধী কোনকিছুর সঙ্গে আপােষ রফা না করে , তেমনভাবে তাদের প্রবুদ্ধ করতে হয় । অবশ্য এই প্রতিরােধ জিনিসটা যত হৃদ্য হয় , ততই ভাল । ছেলেদের শারীরিক ও মানসিক বল , সাহস , বিচারবুদ্ধি ইত্যাদি যা’তে বাড়ে তেমনতর খেলাধূলা ও কাজকর্মের প্রবর্তন করতে হয় । ছেলেরা কিছুতেই যেন না দমে , বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হ'য়ে তাদের সম্বেগ যেন আরাে বুদুৰ্বার হ'য়ে ওঠে । বেশী কিছু না , কাজ কর্মে , কথায় - বার্তায় , ভাবনা - চিন্তায় স্বতঃ - অনুজ্ঞার কথাগুলি যদি অভ্যস্ত করে দিতে পারেন , তাহলে দেখবেন , প্রত্যেকের চেহারার মধ্যদিয়ে জেল্লা ফুটে বেরুবে । আর , military training ( সামরিক শিক্ষা ) ছেলেদের কিছু - কিছু দেওয়া ভাল ।
সবাই এখন আনন্দ - মকরন্দ পানে মত্ত । একটা গভীর ভাবতন্ময়তায় সকলের মন - প্রাণ আচ্ছন্ন । শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখ - মুখ দ্যুতিদীপ্ত — একটা অমােঘ আকর্ষণে তিনি যেন বিশ্ব - দুনিয়াকে টানছেন শ্রীভগবানের পানে । তাঁর কাছে এসে বসলেই মন সক্রিয় অন্তর্মুখীনতায় নিলীন হয়ে উঠতে চায় , অন্তরের সকল জড়তা ভেদ করে নামের প্রবাহ উৎসারিত হয়ে চলে লীলায়িত গতিভঙ্গিমায় । এই অমৃতসায়রে অবগাহন করে মানুষের সব জ্বালা জুড়িয়ে যায় , বাঁচার প্রলোভন বেড়ে ওঠে দুরন্ত বেগে । আগ্ৰহমদির হ'য়ে তাই সবাই শুনছেন তাঁর অমিয় - কথন ।
কেষ্টদা প্রশ্ন করলেন — গীতায় আছে মাত্ৰাস্পর্শান্তু কৌন্তেয় শীতােষ্ণসুখ দুঃখদাঃ , আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত । এই ধরণের আরাে কত লােক আছে । শীত , উষ্ণ , সুখ , দুঃখ , ভাল - মন্দ এ - সবের আলাদা - আলাদা বোধ কি থাকবে না ? এর প্রকৃত অর্থ কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের যােগ হ'লে সত্তা ও বিষয়ের বােধ ফুটে সাধারণতঃ অনুকুলের প্রতি আসে অনুরাগ , প্রতিকুলের প্রতি আসে বিরাগ । এই দ্বন্দ্ব নিয়ে আমরা চলি । তাই অনুকুলের দিকে ঝুঁকে পড়ি , প্রতিকুলের বিদ্বেষ পােষণ করি । অনেক সময় প্রবৃত্তির অনুকূল ও সত্তার প্রতিকূল যা তা'তে আকৃষ্ট হই , এবং প্রবৃত্তির প্রতিকূল ও সত্তার অনুকূল যা ’ তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে চলি । এতে করে আমাদের balance ( সাম্য ) নষ্ট হয় । তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন — সব দেখে যাও , utilize ( সদ্ব্যবহার ) কর , ভেসে যেও না , কোনটার সঙ্গে মিশে যেও না , সবটাকে সমানভাবে ইষ্টস্বার্থ - ইষ্ট প্রতিষ্ঠার কাজে লাগিয়ে equally fulfilling to your entity ( সমভাবে তোমার সত্তার পরিপূরক ) করে তুলতে চেষ্টা কর । যেখানে তা সম্ভব নয় , সেখানে তাকে বর্জন বা নিরােধ করতে তিনি নিষেধ করেননি । তাহ'লে অর্জুনকে ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে অত চেষ্টা করবেন কেন ? তিনি চান সাম্য সিদ্ধ চলন , সাম্য মানে অবৈকল্য অবস্থা , অচ্যুত অবস্থা । ইষ্ট থেকে মন বিচ্যুত হ'লে , তখন সে অবস্থার দাস হয় , সুখ - দুঃখ কোনটাকেই সত্তাপরিপােষণী করে তুলতে পারে না । সাম্য মানে এই নয় যে , মানুষ তিতােকে তিতাে ব'লে , মিষ্টিকে মিষ্টি ব'লে বােধ করবে না , সেটা তাে অসুস্থতার লক্ষণ , যথাযথ বোধ – শক্তি না থাকলে তো সে subman ( অপমানব ) । ধর্ম করা মানে ইন্দ্রিয় গুলিকে , বােধ - বিবেচনাকে নিথর করে তােলা নয় , ধর্মের অনুপালনে সেগুলি বরং তাজা ও তরতরে হয়ে ওঠে , কিন্তু বশে থাকে । বিবশ বা বিবোধ হওয়া কথা নয় , তীব্র বােধই চাই , কিন্তু সঙ্গে - সঙ্গে চাই সহনশীলতা । স্নায়ুর স্থৈর্য্য যদি না থাকে , তবে আমরা সুখ - দুঃখ সব - কিছুতেই দিশেহারা , আত্মহারা হয়ে পড়ি । আর , জীবনধারণ করতে গেলে অনিবার্যভাবে কতকগুলি দুঃখ আসবেই । আমাদের সহ্য , ধৈৰ্য্য যদি না বাড়ে , তবে ঐ দুঃখ দুর্বহ হয়ে উঠবে । তাই বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে সহ্যশক্তি বাড়াবার কথাই বলা হয়েছে ।
কেষ্টদা — দুঃখকে অনিবাৰ্য্য বলে মেনে নেওয়া তাে মানুষের একটা পরাজয় , তাই তাে বিজ্ঞানের বলে মানুষ আজ নানাভাবে দুঃখকে অতিক্রম করতে চেষ্টা করছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ধৰ্ম্মও তো সেই চেষ্টা করছে । ধর্ম ও বিজ্ঞানের সঙ্গে তো । কোন বিরােধ নেই । মানুষের অস্তিত্বের ধৃতিকে যা অ’ পুষ্ট করে তাই তাে ধর্ম । ধৰ্ম্মের কাজই হ’ল অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাকে তিক্রম করা , কিন্তু মানুষ জ্ঞানের রাজ্যে যতই অগ্রসর হােক , beyond ( অজ্ঞাত ) চিরকালই থাকবে , এবং তার জন্য দুঃখও থাকবে । কিন্তু মানুষ যদি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রনির্ভরশীল হ'য়ে দুঃখকে এড়াতেই চায় , তবে তার আয়ত্তে আছে বিধাতার দানস্বরূপ যে সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক যন্ত্র , অর্থাৎ তার প্রাণবন্ত দেহযন্ত্র , সেটারই বা সে সদ্ব্যবহার করবে না কেন ? তাই দেহ - মনকে সুস্থ , সাড়াশীল ও সহনপটু ক'রে তোলার অনুশীলন বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুশীলন সম্পূর্ণতা লাভ করে না । এক হিসাবে ধর্মকেও আপনি বলতে পারেন বিজ্ঞান ।
কেষ্টদা - আপনি সাড়াশীলতার কথা বলছেন , কিন্তু বহুত্বের বােধকে ঐক্যে পর্যবসিত করাই নাকি অনুভূতির পরাকাষ্ঠা ? সবই যখন এক তখন তা অনুভব করার জন্য এত মাথা - ঘামান কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন ) —তাই তাে কথা । সেই এক কোথায় , কী পরিক্রমায় , কী পরিণতি নিয়ে , কী বৈশিষ্ট্যে , কোন্ সংস্থিতিতে , কেমনভাবে বিরাজ করছে , এবং সৃষ্টির বিচিত্র বিকাশের মধ্যে ঐক্য - সঙ্গতির সূত্রটি কী ও কোথায় , তা বুঝতে গেলে সব একাকার করে ফেললে হবে না । প্রতিটি যা - কিছুর সংস্থিতি , সংগঠন ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে হবে । তা না হলে সব এক , এ কথার কোন মানে নেই । বৈশিষ্ট্য - বিবর্ণ্জিত পক্ষাঘাতগ্রস্ত অসাড় ঐক্যবােধ কিন্তু জ্ঞান বা অনুভূতির লক্ষণ নয় । •••••••••••
শাস্ত্রগুলির সুসঙ্গত ব্যাখ্যা দিয়ে আপনারা যদি বই - টই লেখেন , তাহলে ' ভাল হয় । এত misconception ( ভুল বোধ ) চারিয়ে আছে তা বলবার নয় ।
কেষ্টদা — আমরা লিখতে গেলে গোলমাল করে ফেলব । তার চাইতে আপনার কাছে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ অবলম্বন করে প্রশ্নাদি যদি করি এবং আপনি তার উত্তর যদি দেন , সেই ভাল হবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর- —তাও করতে পারেন । তবে আপনারা করলেও লাইন - মতই হবে ।
এমন সময় বঙ্কিমদা ( রায় ) একবার এদিকে আসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বঙ্কিমদাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন — কিরে , কী খবর ?
বঙ্কিমদাভাল । আপনি যে - কাজের কথা বলেছিলেন , সে - কাজ অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর চোখ ঘুরিয়ে কী যেন ইঙ্গিত করলেন ।
বঙ্কিমদা হাসতে - হাসতে বললেন - আচ্ছা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর রহস্য করে বললেন — বঙ্কিম যদি কারও সঙ্গে সহজভাবে কথা বলে , তাহলে সে নতুন লোক হ'লে মনে করবে — ভদ্রলােক আমার উপর চটে গেল কেন ? কিন্তু অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা হ'লে মানুষ পরে বােঝে যে , ওর ঐ লাঠেলি ধাঁজের মধ্যে কতখানি আন্তরিকতা আছে । আমরা অনেক সময় তাই মানুষ চিনতে ভুল করি , মােলায়েম কথা শুনলেই মনে করি ভাল লােক , আর রোখা তীব্র রকম দেখলেই ভাবি খারাপ লোক । এইভাবে ঠকে যাই ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —মানুষ চেনার সহজ উপায় কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — দেখতে হয় , কথার সঙ্গে কাজ ও ব্যবহারের মিল আছে কিনা । আর দেখতে হয় , কথাবার্তার মধ্যদিয়ে সে নিষ্ঠাকে অটুট রেখে মানুষকে প্রীত করে প্রীত হতে চায় , না , হামবড়ায়ী চালে নিজের প্রাধান্যকে জাহির করতে চায় । ভালমানুষের একটা প্রধান লক্ষণ হলো , সে আদর্শে অটুট থেকে , পরিবেশকে আনন্দ দিয়ে আনন্দ পেতে চায় । নিজের অহমিকার বালাই নিয়ে সকলকে আঘাত করে না । একরকম আছে ব্যক্তিত্বহীন বিনয় , সব কথাতেই সায় দিয়ে যায় , সে কিন্তু ভাল নয় । সৎব্যক্তিত্বসম্পন্ন যারা , তারা হৃদ্য ব্যবহার ও সেবানুসন্ধিৎসা নিয়ে চললেও আদর্শকে কখনও বিসর্জন দেয় না বা অন্যায়ের সঙ্গে আপােষরফা করে না ।
বীরেনদা — যারা আদর্শ গ্রহণ করেনি ? শ্রীশ্রীঠাকুর — কেউ আদর্শ গ্রহণ করুক বা না - করুক , ভাল মানুষ যে , তার মহতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবেই কি থাকবে । একটা মানুষ যদি শ্রদ্ধাহীন হয় , সে যতই হােমরা - চোমরা হােক , ধ'রে নিতে পার , তার ভিতরে গোলমাল আছেই ।
কেষ্টদা — মহৎ ব'লে সমাজে যাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন , তাঁদের কারও মধ্যে যদি কৃষ্টিবিরোধী চলন দেখি , তাহলেও কি তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — মহৎ লােক কখনও কৃষ্টি - বিরােধী হতে পারেন না । যাহােক , কোন লোক যদি জনচিত্তে শ্রদ্ধার আসন অধিকার করে থাকেন , এবং তার যদি গুরুতর ত্রটিও থাকে এবং সমাজের হিতের জন্য তার সমালােচনা করা যদি প্রয়ােজন হয় , তাও সশ্রদ্ধভাবে করা সমীচীন । শ্রদ্ধা জিনিসটাই মানুষের সম্বল , তাকে কখনও আচমকা থেতলে দিতে নেই । তাকে যত সাৰ্থকতায় গতিশীল করে তোলা যায় , ততই ভাল । একটি মা বাপের বাড়ী যাবার জন্য অনুমতি নিতে এসেছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দিন - টিন দেখেছিস্ তো ?
উক্ত মা না । আপনি বললে আর দিন দেখা লাগবে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — না ! কাচ্চা - বাচ্চা নিয়ে যাবি বিদেশ - বিভুইয়ে , ভাল দিন দেখে যাওয়া ভাল । আর , সকাল - সকাল চলে আসিস কিন্তু ।
উক্ত মা – আচ্ছা ।
মা'র কাছে যেয়ে এক মস্ত অসুবিধা , ছেলেপেলেদের মাছ খাওয়াবার জন্য বড় পীড়াপীড়ি করে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( একটু রাগত কণ্ঠে বললেন - নাতির যদি ভাল করে কর্ম নিকেশ করতি না পারে , তাহলি দিদিমার আদরের মাহাত্ম কী ? তুই ওসব হুচকিতে ভুলিস্ না কিন্তু , খুব সাবধানে রাখিস্ ।
মা - টি বললেন — হ্যাঁ । আমি লক্ষ্য রাখব ।
শরৎদা — সমাজবাদীরা সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকার করে না , ব্যক্তি - বৈশিষ্ট্য ততটা মানে না , পরিবেশের প্রভাবের উপরই খুব জোর দেয় , বলে , ব্যষ্টি পরিবেশেরই সৃষ্টি , তাছাড়া ব্যক্তি হিসাবে আদর্শ মানে না , রাষ্ট্রের জন্যই যা - কিছু করতে বলে । তাদের কথা হলো — প্রত্যেকেই যদি রাষ্ট্রের জন্য আপ্রাণ খাটে , তাহ'লেই তাে রাষ্ট্রের সম্পদ বাড়ার দরুন সবার অবস্থা ভাল হতে পারে , অথচ ধনতন্ত্রের সৃষ্টি হয় না । এ - সম্বন্ধে আপনার মত কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —আমি অজান মুখ্য মানুষ , আমি কি আপনাদের বাদ - টাদ অতাে বুঝি ? কিন্তু মানুষের সত্তা কি কয় , সত্তাবান আমি সেটা কিছু কিছু টের পাই । সত্তার আছে বাঁচার ইচ্ছা , উপভােগের ইচ্ছা । জীবনের ধর্ম হ'লে কাউকে উপভােগ করিয়ে উপভােগ করা , এবং এর ভিতর দিয়েই সে বাড়ার পথে এগিয়ে যেতে চায় । তাছাড়া তার কোন সার্থকতা নেই । তাঁর সব কর্ম ও অর্জন সেইজন্য । যাঁকে উপভােগ করাতে গিয়ে তাঁর এবং তাঁর পারিপার্শ্বিকের বাঁচা - বাড়ার প্রয়ােজন পরিপূরিত হয় , সেই মানুষটিই আদর্শ । নচেৎ যাকে তাকে খুশি করতে গেলে সে প্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়বে , তাতে তার এবং তার পারিপার্শ্বিকের জীবনবৃদ্ধি ক্ষুন্ন হবে । আর , স্বয়ং ও পারিপার্শ্বিক এ দুইয়ের মধ্যে বিভেদ না থাকলে পারিপার্শ্বিকের জন্য করবে কে ও করবে কি করে ? অন্যের কথা ভাবি আমার নিজের মাপকাঠি দিয়ে । তুমি ’ বােধ না থাকলে যেমন ‘ আমি ’ বােধ থাকে না , ‘ আমি ’ বোধ না থাকলেও তেমনি তুমি ’ বােধ থাকে না , সব লেপাপোছা হয়ে যায় । আর , বৈশিষ্ট্য - সমন্বিত ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ যদি না হয় , তবে জাত দেউলে হ’য়ে যায় । ব্যষ্টি নিয়েই তাে সমষ্টি । ব্যষ্টিগুলির জীবন যদি সার্থক না হয় , তাহলে লাভবান হবে কে ? সে বিধান ও ব্যবস্থা তবে কার জন্য ? মানুষের জন্য রাষ্ট্র , না , রাষ্ট্রের জন্য মানুষ ? প্রত্যেকটি মানুষ , প্রতিটি তুমি - আমি যাতে পরিপূরিত হতে পারি — অন্যের সঙ্গে সঙ্গতি নিয়ে , —তেমনভাবেই তাই রাষ্ট্রের কাঠামাে গ’ড়ে তুলতে হবে । এরই ভিত্তিস্বরূপ ঋষিরা বর্ণাশ্রমের বিধান দিয়েছিলেন , প্রকৃতপ্রস্তাবে বর্ণাশ্রম হলো প্রাকৃতিক বিধান , আর সমাজ - জীবনে সেই প্রাকৃতিক বিধানকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন ঋষিরা । বর্ণাশ্রম ব্যক্তি - বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তি - স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে , জন্মগত বৈশিষ্ট্যানুপাতিক কর্মের দ্বারা জীবিকা - অৰ্জন এর একটা প্রধান কথা , তাই বৃত্তি - হরণ সেখানে । মহাপাপ , সুতরাং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকলেও মানুষ উচ্ছৃঙ্খলভাবে যা - তা ক'রে সমাজের ক্ষতি করতে পারে না । তা’তে সে সমাজে পতিত হয় । বৈশিষ্ট্যের ধারা বংশপরম্পরায় যাতে বজায় থাকে , সেজন্য চাই বিধিমাফিক বিবাহ । আরাে বর্ণাশ্রমের একটা মুখ্য জিনিস হ'লো দ্রষ্টাপুরুষের নিকট দীক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক শিক্ষা । এ - সবগুলি যদি ঠিকভাবে চালান যায় , তবে ধন - সম্পদের উপর ব্যক্তিগত অধিকার থাকলে অসুবিধার কারণ কী হতে পারে তা তাে বুঝি না । বরং আমার মনে হয় , ব্যষ্টি - বৈশিষ্ট্যানুপাতিক স্বতন্ত্র , শিক্ষা , কর্ম , অর্জন , সংগ্রাম ও উপভােগ থাকলেই তার নিজত্ববোধ গজাতে পারে সুষ্ঠভাবে । সে - বোধই ছড়িয়ে পড়ে বিস্তারলাভ করে , চারিয়ে যায় সবার মধ্যে , কিন্তু নিজের জন্য করা না থাকলে অপরের জন্য করারও প্রবৃত্তি থাকে না । নিজের সম্বন্ধে অনুভূতি না গজালে অন্যের সম্বন্ধে অনুভূতি গজাবে কী করে ? আর , স্বতঃ - দায়িত্বে নিজের সামর্থ্যের সদ্ব্যবহারে মানুষ যদি প্রেষ্ঠকে নিত্যনূতন উপঢৌকন দেবার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয় , তবে তার কর্ম্মশক্তি বাড়বে কিসে ? সে ভূতের বেগার খাটতেই বা যাবে কেন ? জনতা , রাষ্ট্র , দেশ , কোন বাদ বা পদ মানুষ বােঝে না , সে চায় একটি বিশিষ্ট ব্যক্তি , যাকে খুশি করে সে খুশি হতে পারে । তাই , সমগ্রের মঙ্গলের মূর্ত প্রতীক রক্তমাংস - সঙ্কুল ইষ্ট বা বাঞ্ছিতের প্রয়ােজন । আর , তিনিই আমাদের ইষ্ট বা বাঞ্ছিত — যার দ্বারা আমরা nurture ( পােষণ ) পাই ও fulfilled (পরিপূরিত ) হই towards becoming ( বিবর্ধনের দিকে ) । ইষ্ট থাকলে মানুষ আর তখন পরিবেশের পুতুল হয় না , সে নিজে ইষ্টের টানে চ'লে সবাইকে সেই টানে তুলে ধরে , Ideal , individual ও environment ( ইষ্ট , ব্যষ্টি ও পরিবেশ ) -এর মধ্যে concordance ( সঙ্গতি ) নিয়ে আসে । প্রত্যেকটি individual ( ব্যষ্টি ) grow করে ( বেড়ে c ) according to his instincts in harmony with the environ ( তার সহজাত সংস্কারানুপাতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি নিয়ে ) । আর এতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি যতই হােক না , তার অধিকাংশ যদি স্বস্ত্যয়নীর ইষ্টোত্তর রূপে থাকে , তাতে লাভ বই ক্ষতি নাই । Individual ( ব্যক্তিগত ) ও social evolution (সমাজগত বিবর্তন ) -এর মূল এখানে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার প্রস্রাব করতে উঠলেন । যাঁরা উপস্থিত ছিলেন , তাদের অনেকেই গাত্রোত্থান করলেন । এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর একবার বাড়ীর মধ্যে শ্রীশ্রীবড়মার কাছে গিয়ে বসলেন । সেখানে টুকটাক ঘরসংসারের কথাবার্তা হলাে । ওখান থেকে এসে মাতৃ - মন্দিরের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় বসলেন ।
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10