📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔷 জ্যোতিষ শাস্ত্র
🔷 দৈব ও পুরুষকার কী
(p171-179)পরবর্তী অংশ
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার উঠে একবার বেড়িয়ে আসলেন । একবার ডিসপেনসারীর দিকে আসলেন , ডিসপেনসারীর বারান্দায় উঠে বললেন — ঐ কোণায় অতাে ঝুল জমেছে , তােদের চোখে পড়ে না ? মনে করসি্ না শুধু ওষুধ খাইয়েই মানুষের রােগ সারাতে পারবি , যদি তাদের সদাচারী করে না তুলিস্ । সদাচারের মধ্যে আছে পরিচ্ছন্নতা । এসব দিকে লক্ষ্য রাখতে হয় । তােরা নিজেরা যদি না করিস , অন্যকে করাবি কি করে ? ডাক্তারখানা হবে স্বাস্থ্য ও সদাচার সম্বন্ধীয় নীতিশিক্ষার একটা ঘাঁটি - বিশেষ । এখানে কতকগুলি ভাল - ভাল মটো টানিয়ে রাখতে হয় , যা দৈনন্দিন জীবনে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য পালনীয় । আর , এখানটা হবে পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন , ছিমছাম ।
ভগীরথদা লজ্জিত হয়ে বললেন — ওদিকে আমার নজর পড়েনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যেখানে থাক , তার চারিদিকে কোথায় কী আছে , কোথায় কী হচ্ছে — তা যদি নজরে না থাকে , নজরে না পড়ে , তবে দিন - দিন dull ( বােকা ) হয়ে যাবে । ওতে মনে মরচে পড়ে যাবে । তােমার ভাল অভ্যাস অনেকগুলি আছে , তাই নিয়েই যদি খুশি থাক , মাথা যদি না খাটাও , আরাে সদভ্যাস যদি অর্জন না কর , দিনের পর দিন গতানুগতিকভাবে যদি চল , তবে জীবনটা স্থূল ও স্থবির হয়ে উঠবে , অগ্রগতি আর হবে না , প্রাণের উৎসাহ - উল্লাসও কমে যাবে ।
ভগীরথদা - ঝুলটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে ফেলব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ফেলব কি ? এখনই কাউকে দিয়ে করে ফেলা । হেমগোবিন্দ !
হেমগোবিন্দদা কলে জল তুলছিলেন । তাকে ডাকা হ’লাে । তিনি ছুটে আসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওই ঝুলটা এখনই ঝেড়ে ফেল তো ! হেমগােবিন্দদা একটা লাঠির মাথায় ঝাঁটা বেঁধে ঝুলটা ঝাড়তে লাগলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দেখিস্ , চোখ সাবধান । আর নাকে যেন বেশি ধূলাে না যায় । ওখান থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর , জ্ঞান চৌধুরীর বাড়ীর দিকে গেলেন । জ্ঞান চৌধুরীমহাশয়কে ডেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে - দাঁড়িয়েই তার বাড়ীর সবাই কে কেমন আছেন খোঁজ - খবর নিলেন । একজনের অসুখ শুনে প্যারীদাকে দেখাতে বললেন । বললেন — তুমি খবর দিও , আমার মনে থাকলে আমিও কবোনে ।
ওখান থেকে বাগানের পাশ দিয়ে বড়দার বাড়ীর সামনে আসলেন ।
বড়দার বাড়ীর সামনে অশোককে দেখে বললেন — দাদু ! শীতকালে এত সকালে খালি গায় বের হওয়া কিন্তু ভাল না । ঠাণ্ডা লাগতি পারে । যাও ! মার কাছে যেয়ে গেঞ্জীটা পরে নাও গিয়ে । গেঞ্জী প'রে খেলা কর । আর রাস্তার মধ্যে খেলার থেকে একপাশে খেলা করা ভাল , ওতে তােমাদেরও সুবিধা , হবে , যারা রাস্তা দিয়ে যাবে তাদেরও অসুবিধা হবে না । আবার , রাস্তার পর খেললে কেউ হঠাৎ সাইকেল ক'রে যাবার সময় চাপা পড়ার ভয় থাকে ।
অশােক খুশি হ'য়ে মাথা ঝাকিয়ে বলল — আচ্ছা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বঙ্কিমদা , বীরেনদা প্রভৃতির দিকে চেয়ে মধুর হাস্যে বললেন— ওদের মধ্যে যেন আমি আমাকে খুজে পাই । ছাওয়াল খুব তুখোড় ছাওয়াল । যেমন মিষ্টি , তেমনি তেজী , আবার বুদ্ধিও রাখে খুব ।
বঙ্কিমদা — হ্য ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —অতি সুন্দর স্বভাব । ভালবাসা যেন কেড়ে নেয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Third generation ( তৃতীয় পুরুষ ) কিনা , (শ্রীশ্রীঠাকুর থেকে সুরু ক’রে ) । আচ্ছা বঙ্কিম ! শুনেছি যে third generation ( তৃতীয় পুরুষ ) অনেকখানি inherit করে (গুণাবলীর অধিকারী হয় ) , কোন পুথিপত্রে তার নজির আছে কিনা দেখিস্ তাে ।
বঙ্কিমদা — ঠিক ঐ ভাবের কথা কোন বইয়ে দেখিনি । খুঁজে দেখব ।
এইভাবে কথা বলতে - বলতে শ্রীশ্রীঠাকুর খেপুদার বাড়ীর কাছে এসে পড়লেন । ওখানে এসে খেপুদার বারান্দায় একটা হাতলওয়ালা বেঞ্চে দক্ষিণাস্য হ'য়ে বসলেন ।
ব'সে জিজ্ঞাসা করলেন — আকু কাল এসেছিল , চ'লে গেছে নাকি ?
খেপুদা — হ্যাঁ । আজ কাছারী আছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আকু আসলে ওকে দিয়ে একখানা কোষ্ঠী বিচার করাতাম ।
খেপুদা — আমার তাে কোষ্ঠীতে বড় বিশ্বাস হয় না । প্রায়ই মেলে না । তাছাড়া মানুষ ওতে বড় অদৃষ্টবাদী হ’য়ে পড়ে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার মা'র ঐ কথা মনে পড়ে । মা খুব বলতেন—
“ যেখানে দেখিবে ছাই ,
উড়াইয়া দেখে তাই ,
পাইলেও পাইতে পার
অমূল্য রতন । ”
কোন্টার মধ্যে কী আছে , না দেখে - শুনে বিদায় দেওয়া ভাল না । জ্যোতিষকে শাস্ত্র হিসাবেই দেখ , আর বিজ্ঞান হিসাবেই দেখ , ( অবশ্য শাস্ত্র ও বিজ্ঞান আলাদা বলে আমি মনে করি না ) , এটা যখন আবহমানকাল ধ'রে চলে আসছে , এর মধ্যে যে কোন মাল নেই , একেবারেই যে গাঁজাখুরী , তা আমার মন কখনও মেনে নিতে চায় না । প্রাচীনের তফিলে যা’ - কিছু ছিল প্রায় সবই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ । অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না বলে আমাদের ভাল লাগে না , কিন্তু বুঝতে গেলেও তার পিছনে সাধনা চাই । আমাদের এমনতর ধারণা থাকা ভাল না যে , আমরা একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারব না ; বিহিতভাবে চেষ্টা করলে বোঝার সম্ভাবনাই বেশী । আবার , এমনতর দম্ভও ভাল নয় যে , আমার এই মস্তিষ্ক নিয়ে সহজে যা বুঝতে পারি না , তা কিছুই নয় বা তার মধ্যে কোন মালই নেই । বুঝতে গেলে শ্রদ্ধা চাই , চেষ্টা চাই , অনুশীলন চাই , বিনীত মনোভাব চাই । ভৃগুর কোষ্ঠীর মধ্যে আমরা যে সম্পদ পাই , তাতে তাে জিনিসটাকে ভুয়ো বলেও উড়িয়ে দিতে পারি না । আমার মনে হয় , সবগুলি factor ( উপাদান ) ঠিকমত consider { বিবেচনা করতে পারলে mathematical accuracy ( গাণিতিক যথার্থতা ) নিয়ে সব জিনিস বের করা যায় । তবে অদৃষ্টবাদী ও নিষ্ক্রিয় হওয়ার কথা যে বলছ , সেটা আমাদের উপর নির্ভর করে । পুরুষকার তাে চাই - ই । পুরুষকার না হলে অদৃষ্টকে খণ্ডন করব কী দিয়ে ? অদৃষ্ট যেটা সৃষ্টি ক’রে রেখেছি , সেও তো পুরুষকার ও কর্মের ভিতর - দিয়ে । পূর্বের কর্ম ফল প্রসব করবে আর বর্তমানের কর্ম কোন ফল প্রসব করবে না , এর কি কোন মানে হয় ? কৰ্মই মানুষের ভাগ্যবিধাতা । তবে আমাদের সঞ্চিত শুভ - অশুভ কী আছে , আমাদের প্রকৃতি , প্রবৃত্তি কিভাবে আমাদের চালিত করছে , বিশ্ব - প্রবাহ আমাদের ব্যক্তিজীবনের উপর কী প্রভাব বিস্তার করছে , এগুলি যদি আমাদের জানা থাকে তবে দৈব ও পুরুষকার উভয়কে উভয়ের অনুকুল করে সুনিয়ন্ত্রিত করে তুলতে পারি , এবং দৈবের মধ্যে জীবনের প্রতিকূল যা আছে তাকেও প্রয়োজনমত প্রতিরােধ করবার জন্য প্রস্তুত হতে পারি ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —দৈব ও পুরুষকার উভয়কে উভয়ের সহায়ক ক'রে তোলা মানে কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ধরেন , আপনি আপনার profession (জীবিকা ) choose নির্বাচন করবেন । আপনার সামনে অনেকগুলি পথ খােলা আছে । এখন কোনটা নেবেন সেইটে নিয়ে আপনার সমস্যা । সাধারণতঃ আপনার রুচি , পছন্দ ও সংস্কার যে - দিকে , সেই কাজ বেছে নেওয়াই আপনার পক্ষে ভাল । আপনার হয়তো অনেক কিছুই ভাল লাগে । ঠিক হয়তাে ঠাওর পান না , কোন্টা আপনার বিশিষ্ট পথ , কোন পথে আপনি উন্নতি করতে পারবেন । তখন যদি বৈজ্ঞানিকভাবে কেউ নির্ধারণ করে দেয় যে ডাক্তারীই আপনার নিজস্ব লাইন , তখন তাে আপনি অন্য দিকে শক্তির অপচয় না করে ডাক্তারীর দিকে যেতে পারেন , এবং একদিন হয়তো এতে বিশেষ কৃতিত্বও লাভ করতে পারেন । এখন ধরুন , ডাক্তারীতে ভাল করার সম্ভাব্যতাটা আপনার দৈব , দৈব মানে তা ’ আপনার চরিত্রে দেদীপ্যমান । এই দেদীপ্যমান সম্ভাব্যতার ভিতের উপর আপনি আপনার পুরুষকারের খুটি যদি গাড়েন , অর্থাৎ ঐ পথে আপনার প্রচেষ্টাকে পরিচালিত যদি করেন , তাহলে আপনার কৃতকাৰ্যতার সম্ভাবনাই বেশী । একেই বলে দৈব ও পুরুষকারকে পরস্পরের সহায়ক করে তােলা । আজ বিলেতে psychological test ( মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষা ) নানারকম করে মানুষের বুদ্ধি , কর্মক্ষমতা , বিশিষ্ট রুচি ইত্যাদি বিষয়ে পরীক্ষা ও পরিমাপ আমরা যদি astrologically ( জ্যোতিষসম্মত পথে ) সেটা নিখুতভাবে নিদ্ধারণ করতে পারি , তাহ'লেই বা তা মেনে নেওয়ায় আপত্তি কী ? এটা শুধু এক দিক দিয়ে বললাম । তাছাড়া আরো অনেক দিক আছে । বিশ্ব জীবনের প্রবাহের সঙ্গে আমাদের একটা গভীর যােগ আছে । সুদূর গ্রহ , উপগ্রহ , তারকা , নক্ষত্র , কাছের ও দূরের বিরাট পরিবেশ , জলবায়ু , আবহাওয়া , বিশ্বের যত - কিছু ঘটনা - প্রবাহ , আমার অতীত , সবার অতীত — সবই কিন্তু জ্ঞাতসারে , অজ্ঞাতসারে আমার জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করছে । উপর কী কী প্রভাব ক্রিয়া করছে , তার কোন্টাই বা ভাল , কোটাই বা মন্দ , তা জেনে তার প্রতিবিধান ও বিন্যাস যদি না করি , তবে তাে অন্ধকারে পথ হাতড়ানর মত হবে । আমি যে অনন্ত বাঁধনে জড়িয়ে আছি জগতের সঙ্গে , প্রতিকূল শক্তিরও অভাব নেই , এর ভিতর - দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে চলা চারটিখানি কথা নয় । জ্যোতিষশাস্ত্র যদি analytically ( বিশ্লেষণাত্মক ) ও synthetically ( সংশ্লেষণাত্মকভাবে ) চৰ্চ্চা ও প্রয়ােগ করা যায় , তবে এসব সম্বন্ধে অনেক হদিশ মিলতে পারে । জ্যোতিষের সবকিছুর একটা সুসঙ্গত , rational ( যুক্তিযুক্ত ) ও common-Sanse(সহজবুদ্ধি-সম্মত) inter pretation ( ব্যাখ্যা ) বের করা দরকার । এ - সম্বন্ধে অনেক কিছু করবার আছে । শুধু গতানুগতিক মামুলিভাবে এর চর্চা করলে হবে না । আমার মনে হয় , গ্রহ - সংস্থানের সঙ্গে আমাদের জীবনে আমাদের প্রবৃত্তি - সংস্থানের একটা সম্পর্ক আছে । তবে প্রবৃত্তি একাধারে আমাদের বন্ধু , একাধারে আমাদের শত্রু । প্রবৃত্তি যখন ইষ্টের সেবায় লাগাই , তখন সেগুলি হয় বন্ধু , আবার সেগুলি যখন নিজেদের খেয়াল - খুশির সেবায় লাগাই , তখনই হয় শত্রু । আমাদের প্রবৃত্তি যদি আমাদের সঙ্গে শত্রুতা না করে বা বাইরের শত্রুর সঙ্গে সহযােগিতা না করে , তাহলে কিন্তু ক্ষতির সম্ভাবনা আমাদের কমই থাকে । বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের প্রবৃত্তি - চলনাই ক্ষয় , ক্ষতি ও বিপদ - আপদকে আমন্ত্রণ ক'রে আনে । ইষ্টীচলন আবার তেমনি বহু ক্ষয় , ক্ষতি ও বিপদ আপদের সম্ভাব্যতাকে নাকচ করে দিয়ে জীবনের পথ কণ্টকমুক্ত করে তােলে । তাই বলে— “ কিং কুর্ব্বন্তি গ্রহাঃ সর্ব্বে যস্য কেন্দ্রে বৃহস্পতিঃ’ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার একবার তামাক খেলেন । একটি দাদা এসে তার অভাবের কথা জানালেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে বললেন — দ্যাখ , অভাব হ'লেই যে আমার কাছে এসে হাত পাতিস্ , ও কিন্তু ভাল না । তাছাড়া , মিতব্যয়িতা জিনিসটা শিখতে হয় । তোর যা ’ সংসার , তাতে তুই যা ’ পাস , তাতে তো তাের কষ্ট হবার কথা নয় । অথচ নিত্যই তুই অভাবে পড়িস্ । তার মানে , তোর চলনায় গোল আছে । আর , অভাব যদি হয়ই , পরিবেশের জন্য এতখানি করা লাগে , যাতে পরিবেশ থেকে আহরণ ক’রে নিতে পারিস্ । অবশ্য , পাবার বুদ্ধি থেকে করা ভাল না । স্বভাবটাকেই সেবাবুদ্ধিসম্পন্ন করে তুলতে হয় । তাহলে আর কষ্ট থাকে না । আমি তো টাকার পরোয়া করি না । আর টাকার মানুষও আমি না। আমি মানুষের , মানুষ আমার । ভাই আমার যারা , তাদের যা আছে তা আমারই নিজস্ব সম্পদ বলে আমি মনে করি । আমি ভাবি , কেমন করে তাদের দক্ষ করে তুলতে পারি , উচ্ছল করে তুলতে পারি । নইলে আমিই যে নিঃস্ব হয়ে রইলাম । তােরা কেউ যদি হীন - সামর্থ্য হয়ে থাকিস , তাহলে আমার কাছে সেটা বড় insulting (অপমানজনক) লাগে , আমার আপসােস হয় , দুঃখ হয় । অনেক সময় নিজের গায়ের মাংস নিজে কামড়ে তুলে ফেলতে ইচ্ছা করে ।
( শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখে - মুখে একটা তীব্র বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠলো ) । মাঝে - মাঝে মনে হয় , তোদের চাবকে ঠিক করি । পথ পেলি , বুঝলি , শুনলি অথচ চললি না , করলি না , এ দুঃখ আমি রাখব । কোথায় ? এক - একজন শুধু কথার সাগর হ'য়ে থাকলি । চরিত্র গঠন করলি না। ও - কথা তােদের পােছে কে রে ? তাই কই , আর শয়তানী করিস না , মানুষ হ ! দেখে আমার প্রাণ জুড়াক । দ্যাখ , জন্মে অবধি আমি আর কিছু চাইনি — আমি কেবল চেয়েছি , প্রত্যেককেই যেন বড় করে তুলতে পারি , প্রত্যেককেই যেন সার্থক করে তুলতে পারি । তোরা এক - একজন অন্তরে- বাইরে রাজরাজেশ্বরের মত সুখী হ , তা'তেই আমার সুখ । তােরা নিজেরাও সুখী হলি না , আমাকেও সুখ পেতে দিলি না । আমার ভাগ্যিই খারাপ ।
এই ব'লে শ্রীশ্রীঠাকুর ছল - ছল করুণ নেত্রে চেয়ে রইলেন দাদাটির দিকে ।
দাদাটি বললেন — আমি যা পারি , তা তো সাধ্যমত করি । আর কী করব ?
শ্রীশ্রীঠাকুর গুরু - গম্ভীর স্বরে , ধীরে উদাত্ত কণ্ঠে বললেন—
ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা ।
নিরাশীর্নির্মমাে ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ৷৷
স্বার্থবুদ্ধি ছেড়ে দাও , প্রত্যাশাপরায়ণতা ছেড়ে দাও , ইষ্টেকশরণ হও , নইলে বিগতজ্বর হতে পারবে না । আর , ঐ জ্বরের ঘােরে যাই কর না , তা সফল হবে না । মূলে হাত দাও । তাকে ভালবাসো , আর যা ’ করবে তাঁর জন্যই কর । ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির নােঙর ফেলে যতই দাড় টান না , এগুতে পারবে না । তা'তে কারও অন্তরকে স্পর্শ করতে পারবে না । তুমি যদি বাস্তবে সক্রিয়ভাবে ইষ্ট সৰ্বস্ব হও , তাহ'লেই মানুষকে তেমন করে তুলতে পারবে । নিজেকে ও অন্যকে অমন করে তােলাটাই , সবাই মিলে অমন হ'য়ে ওঠাটাই হ'লো কাজ । তাছাড়া আর সব ফক্কাবাজী । ফক্কাবাজী , ফাঁকিবাজীতে তােমারও কিছু হবে না , কারাে কিছু হবে না । তােমার ফাঁকি ধরা পড়ে যাবে মানুষের কাছে । যে পেল না তোমার কাছ থেকে কিছু , যাকে দিতে পারলে না কিছু তােমার চরিত্র দিয়ে , সে তােমার সম্পদ হবে কি করে ? মনে রেখে —যাযন মানে তোতাপাখীর মত কথা কওয়া নয় । যাজন মানে , তোমার সুকেন্দ্রিক , সুগঠিত চরিত্রটাকে মানুষের সামনে তুলে ধরে সুযুক্ত , সক্রিয় সেবা - সম্পােষণয় ও নিয়ন্ত্রণে তাকে সুকেন্দ্রিক ও সুগঠিত ক’রে তোলা । নিজে হবে না , কথার কারসাজিতে বাজীমাৎ করবে , প্রকৃতির রাজ্যে তেমন অঘটন ঘটে না । তুমি যেমনতর প্রকৃত হবে , প্রকৃতিও পুরস্কৃত করবে তোমাকে তেমনতর ।
কথা হ’চ্ছে , বহুলােক দাড়িয়ে - দাড়িয়ে শুনছেন । কথাগুলির তীব্র অনুরণন সবার অন্তরে শাণিত ফলকের মত বিঁধছে । মনে হ’চ্ছে , দেওয়ালগুলিও যেন সেই মর্মভেদী বাণী - মন্ত্রের প্রতিধ্বনিতে ঝনঝন ক'রে উঠছে । চতুর্দিকে একটা থমথমে আবহাওয়া । সবাই নির্বাক , নিস্তব্ধ ।
একটু আগেই শৈলমা এসেছেন । শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার শৈলমার দিকে চেয়ে আদরের সুরে সোহাগ করে টেনে - টেনে বারবার বলতে লাগলেন — ঘুটুন , ঘুটুন , ঘুটুন , ঘুটুন , ঘুটুন , ঘুটুন ।
শৈলমা হেসে কুটিপাটি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — সকালে কিছু খাইছিস ?
শৈলমা — খাবার সময় পেলাম কোথায় ? শ্রীশ্রীঠাকুর (সহাস্যে ) —সে তাে ঠিক কথা ! কাজের লোক আবার খায় নাকি? তার খাবার সময় কোথায় ? •••••• যাক , এখন কি কিছু খাবার সময় হবে ? অবশ্যি যদি কাজের ক্ষতি না হয় ।
শৈলমা - এখন এত বেলায় আর কী খাব ? আর একটু পরেই তাে চান ক'রে ভাত খাব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তা’ কষ্ট হ’লে খেয়ে কাজ নেই । আমি ভাবছিলাম কয়েকখানা ভাল বিস্কুট যদি খেতিস্ ।
শৈলমা — এখন থাক ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রসঙ্গান্তরে মন দিলেন । কিন্তু শৈলমা উসখুস করে শ্রীশ্রীঠাকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করতে লাগলেন , শ্রীশ্রীঠাকুর কালিদাসী মাকে ইঙ্গিত করলেন । সেই সঙ্গে - সঙ্গে কয়েকজনের দৃষ্টি পড়লো শৈলমার উপর । তারা শৈলমার ভাবভঙ্গী দেখে মুখ টিপেটিপে হাসতে লাগলেন । কালিদাসীমা রহস্য করে বললেন — কি গো ডাক্তার । অমন ক'রে গা - মোড়া কাটছ কেন ? ঘুম পাচ্ছে নাকি ? শৈলমা ঝাঝিয়ে উঠলেন — আহলাদীর মত ঠাকুরের কাছে বসে থাক , টের তে পাও না ঠেলাটা কি । আমার মত এইরকম service ( সেবা ) দিতে হ’তো মানুষকে , তাহলে ঠিক পেতে । রুগী , গু , মুত , আতুড় — ঠেলতে হয় কি কম ? তারপর সময়ে নাওয়া নেই , খাওয়া নেই , ঘুম নেই , অনেক সময় সকালে চা - টুকু পর্যন্ত জোটে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন — ও , তুই চা বিস্কুট দুই - ই খাবি , শুধু বিস্কুট খাবি না , তা সে - কথা সােজা করে বললেই তাে হতাে । সােজা কথা অতো ঘুরিয়ে - পেচিয়ে বলছিস্ কেন ?
শৈলমা খানিকটা কান্নার সুরে — আপনি তো সব সময় আমাকে ঐ রকম ভাবেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — অতাে ভাবা - ভাবির কি আছে এতে ? ক্ষিদে পেয়েছে , খাবি । এর মধ্যে অসম্মানের ব্যাপার কী হ’লো ? আমার তাে ক্ষিদে পেলে তখনই চেয়ে খাই ‘ পেটে ক্ষিদে , মুখে লাজ ” —এতে লাভ কি ? দ্যাখ , —সহজ হ'তে না পারলে কিন্তু সুখ নেই । যত চাল দিয়ে চলতে যাবি , ততই চলন বেচাল হয়ে যাবে , এমন - কি বানচালও হ'য়ে যেতে পারে । খুব সাবধান ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ইতিমধ্যে সতীশদাকে দিয়ে চা ও বিস্কুট আনতে পাঠিয়ে দিলেন । সতীশদা ( দাস ) একটু পরেই চা ও বিস্কুট নিয়ে আসলেন , নিয়ে আসামাত্র শ্রীশ্রীঠাকুর পরম উল্লাসভরে বললেন — লাগাও !
শৈলমা চায়ের বড় গ্লাসটা মাথায় ঠেকিয়ে এক ঢোক খেলেন , আর সঙ্গে - সঙ্গে মুচমুচ করে বিস্কুট খেতে লাগলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর মহাতৃপ্তিভরে শৈলমার চা ও বিস্কুট খাওয়া দেখছেন । চোখে তাঁর স্নেহ - বিলোল দৃষ্টি । এমন সময় কয়েকটা বিভিন্নজাতীয় পাখী বাবলা গাছের ডালে বসে রীতিমত মারামারি শুরু করে দিয়েছে । শ্রীশ্রীঠাকুর পঞ্চানন ( বিশ্বাস ) -দাকে বললেন — ওদের সরিয়ে দে তাে । এখন একত্র থাকলেই ঝগড়া করবে । এখন ঝগড়ার বাতিক চেপেছে । এই ভাবটা কেটে গেলে পরে আবার বন্ধুভাবে থাকতে পারবে । আমি আবার এইসব পাখীগুলির মধ্যে দেখেছি খুব ভাব । কিন্তু ওদের দেখে মনে হয় , মানুষের যেমন মাঝে - মাঝে মেজাজ খারাপ ও খিটখিটে হয় , ওদেরও তেমনি হয় । ঐ ঝোঁকটাকে প্রশ্রয় দিতে নেই , বার - বার অভিব্যক্তি দিতে - দিতে , ওইটে পেয়ে বসে । সেইজন্য খারাপ যা - কিছু থেকে নিজেকে প্রত্যাহৃত করাই শ্রেয় । তােমাদের মুখে যদি কুবাক্য অসে , আমি বলি , তখন বরং চুপ করে যেও , বা মানুষের সংসর্গ থেকে দূরে সরে যেও । কিন্তু কু - বাক্য বলতে যেও না । কয়েকবার যদি বল , তখন সেটা অভ্যাসে দাড়িয়ে যাবে । তখন তার উপর তােমার দখল থাকবে না । অবশ্য , মুখে যখন কু - বাক্য আসছে , তখন - তখনই যদি মন ও জিহবার মােড় ফিরিয়ে শুভ - সম্বেগে হিতকর প্রিয় - বাক্য বলতে পার তাহলে তাে কথাই নেই । সাধারণভাবে এই কথাটা খেয়াল রাখবে যে , ভাল যা’ - কিছু তার অনুষ্ঠান , আচরণ ও অভিব্যক্তি যত বেশী ও যত ত্বরিত পার , করবে , আর খারাপ যা - কিছু তার অনুষ্ঠান , আচরণ , ও অভিব্যক্তি না করে পারলে আর করবে না । ওতে দেখবে তােমার শরীরবিধান , স্নায়ু , শিরা , উপশিরা , প্রত্যেকটি মস্তিষ্ক - কোষ সৎ - চলনে অভ্যস্ত ও মন্দ থেকে বিরত হয়ে তোমার সাধনার পথকে কত সহজ করে তুলবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ইতিমধ্যে ভবানীদাকে ডেকে অভাবগ্রস্ত দাদাটিকে কিছু টাকা , দিতে বলে দিলেন । তখন আবার বললেন — আমার কথায় ব্যথা - ট্যথা পাসনি তাে ? তাের যা দরকার ভবানীর কাছ থেকে নিয়ে যাস । তােদের যা'তে ভাল হবে তাই কিন্তু কই । তােরা কষ্ট পাস , তা কিন্তু আমার ইচ্ছে নয় । আবেগে দাদাটির যেন বাক্রোধ হয়ে আসলাে , কী বলতে গিয়ে বলতে পারলেন না , গলাটা ধ'রে আসলো , মুখটা নীচু করে চাদর দিয়ে চোখ মুছতে : লাগলেন ।
★ ★ ★ ★ ★★ ★ ★ ★ ★★ ★ ★ ★ ★
#আলোচনা_ প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10