পঞ্চানন সরকার
মানুষের সপরিবেশ বেঁচে 6থাকা ও বেড়ে ওঠার পক্ষে যা কিছু সহায়ক, তা-ই ধর্ম, আর তার বিরোধী যা, তা অধর্ম-শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রদত্ত ধর্মের এই অভিনব ব্যাখ্যা ‘ধর্ম’ শব্দটিকে প্রচলিত সঙ্কীর্ণতার গণ্ডী থেকে মুক্ত করেছে। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানুষের সমগ্র জীবনই ধর্মের অধিকারভুক্ত। শ্রীশ্রীঠাকুর জীবনধর্মের প্রধান তিনটি ভিত্তিস্তম্ভকেও চিহ্নিত করেছেন সুনির্দিষ্টভাবে; মানব-সৃজন ও মানব-গঠনের এই তিনটি স্তম্ভ হল বিবাহ, দীক্ষা ও শিক্ষা। ঠাকুরের সুদূর-প্রসারী দৃষ্টিতে ও চিন্তায় শিক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। শিক্ষাদর্শের ব্যাপারে তাঁর বিশদ চিন্তা তৎরচিত বিভিন্ন গ্রন্থে, কথোপকথন বা প্রশ্নোত্তরে, বিশেষত ‘শিক্ষা-বিধায়না’ গ্রন্থে বিধৃত আছে। পাবনার হিমাইতপুর আশ্রমে ঠাকুরের শিক্ষা- সংক্রান্ত ভাবনা বহুলাংশে রূপায়িত হয়েছিল মূলত অধ্যাপক পঞ্চানন সরকারের মাধ্যমে, বাস্তব প্রয়োগে। সেই সময়ের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ঠাকুরের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে অধ্যাপক নিজেকে তৈরি করেছিলেন শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ক’রে; তাঁর জীবনালেখ্য ছাত্র তৈরির ইতিহাস নয়, এক শিক্ষকের আত্মগঠনের অভিনব বিবরণ। আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে সে-কাহিনী চিরন্তন হয়ে থাকবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অধীন বরিশাল জেলার হবিবপুর গ্রামে কাশীনাথ সরকারের পুত্র পঞ্চাননের জন্ম ১৮৯২ খৃষ্টাব্দের ৩রা আগস্ট। বরিশালেই শিক্ষাজীবনের শুরু তাঁর। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে পড়াকালীন পঞ্চানন মহাত্মা অশ্বিনী দত্ত ও অন্যান্য খ্যাতনামা অধ্যাপকবৃন্দের সংস্পর্শে আসেন। অসাধারণ মেধাবী এই ছাত্রটি তাঁদের বিশেষ স্নেহধন্য ছিলেন। বরিশাল কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম. এ. হন তিনি। একান্ত অল্প বয়স থেকেই পাঠ্য বিষয়ের বহির্ভূত নানা বিষয়ে বহু বই ও পত্রপত্রিকা তাঁর নিত্যপাঠ্য ছিল। স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পরে খুলনা জেলার বাগেরহাট কলেজে অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন।
১৯২৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। ব্যক্তিত্ব ও চারিত্র্যগুণে পিতা পঞ্চাননের জীবনে ছিলেন আদর্শস্বরূপ, এক অনন্য আশ্রয়স্থল। তাই তাঁর প্রয়াণে পঞ্চানন মানসিক ভাবে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন, শূন্যতা ও অস্থিরতায় হৃদয় জর্জরিত হয়ে ওঠে।
তাঁর অগ্রজ অমৃতলাল আশৈশব সাধুসন্ন্যাসীসঙ্গ-পিয়াসী ছিলেন, গৈরিক বসনধারী যে-কোন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেলেই তাঁকে সমাদরে নিজ গৃহে নিয়ে আসতেন। অমৃতলাল এবং পঞ্চানন, উভয়েরই অধ্যাত্ম সন্ধান ছিল প্রবল। বিশেষত পিতৃ- বিয়োগের শূন্যতায় উভয়েই সদ্গুরু লাভের আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। একদিন
এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসীকে দেখে বিশেষ সম্ভ্রমের উদ্রেক হওয়ায় উভয়ে সস্ত্রীক তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন; কিন্তু কিছুদিন পরেই সে দীক্ষা অন্তঃসারশূন্য বলে প্রতীয়মান হয়। এরপরে এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ ফকিরকে দেখে ও তাঁর সুন্দর তত্ত্বপূর্ণ কথায় মুগ্ধ হয়ে দু’ভাই তাঁর কাছে পঞ্চরসিক মতে দীক্ষা নেন। কিন্তু অল্পদিন পরে ঐ সম্প্রদায়ের এক উৎসবে উপস্থিত হয়ে সেখানকার অন্যান্যদের কুরুচিকর আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সে পথও পরিত্যাগ করেন তাঁরা। অমৃতলালের অবশ্য এতেও অনুসন্ধিৎসায় ছেদ পড়ে না, তিনি সদ্গুরুর আশায় বেশধারী সাধুসন্ন্যাসীসঙ্গ করেই চলেন। কিন্তু পরপর দু’বার এভাবে প্রতারিত হওয়ায় পঞ্চাননের অন্তরে তীব্র নঞর্থক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়-যে-কোন ধর্মগুরু সম্বন্ধেই বিদ্রূপাত্মক অনীহা দেখা দেয় তাঁর মধ্যে। ফলতঃ তিনি সাধারণ সনাতন মূল্যবোধের দ্বারা লালিত ও স্থিরীকৃত যে- সব সংযত আচরণবিধি, স্বেচ্ছায় তা লঙ্ঘন করে বিপরীত পথে যেতে শুরু করেন। বস্তুত প্রকৃত বস্তু লাভের অপ্রাপ্তি জনিত হতাশাই তাঁকে এমন অস্থির করে তুলেছিল। সহজাত মেধাবলে যে-কোন বিষয়ে ব্যুৎপত্তি-লাভ ছিল তাঁর পক্ষে অনায়াসসাধ্য। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ে তাতেও বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন এবং অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে কুষ্টিয়ায় এসে চিকিৎসা শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই যশ ও প্রতিষ্ঠা, দুই-ই প্রাপ্তি হয় তাঁর। কিন্তু প্রবল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে, ফলে কুষ্টিয়া ছেড়ে কলকাতায় আসেন জীবিকার সন্ধানে। নতুন জায়গায়, বিশেষত কলকাতার মত বড় শহরে চিকিৎসকরূপে পশার জমাতে কিছু সময় লাগতে পারে মনে করে তিনি ছাত্র-অধ্যাপনা আরম্ভ করেন। তাঁর মত বহু শাস্ত্র-পারঙ্গম পণ্ডিত ব্যক্তির অধ্যাপনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না; অচিরেই সারাদিন কেটে যেতে লাগল পড়ানোর কাজে। কিন্তু অন্তরের শূন্যতা ও অস্থিরতা দূর হল না। সন্ধ্যার পর থেকে অখণ্ড অবসর এবং সে অবসর তাঁর কাছে হয়ে উঠল অভিশাপ। একদিকে শূন্যতা, হতাশা এবং তজ্জনিত ‘যা-খুশি-তাই’ করার বেপরোয়া ঝোঁক, অপরদিকে পিতার অলক্ষ্য আদর্শবাদের অনুশাসন ও শিক্ষকতার সুনাম, উভয়ের দ্বন্দ্বে যন্ত্রণায় পীড়িত, দগ্ধ হতে লাগলেন পঞ্চানন অবসরের প্রতিটি মুহূর্তে; সারারাত্রি ঘুমোতে পারতেন না, ছুটে বেরিয়ে পড়তেন পথে, অস্থির পদচারণায় কাটত বিনিদ্র রজনী। এ সময়ে দৈনিক বসুমতীতে রাত্রিকালীন সম্পাদকের কাজ পেয়ে গিয়ে কর্মব্যস্ততায় অবসর-যন্ত্রণার কিছু সমাধান হলেও মানসিক যন্ত্রণার নিরসন হয় না; কাজের মধ্যে প্রবলভাবে ডুবে থেকেও একরকমের হাল ছেড়ে দেওয়া হতাশা অন্তরে পোষণ করতে করতে বয়ে চলে পঞ্চাননের জীবনতরী।
ইতিপূর্বে কুষ্টিয়া থাকাকালীন সেখানকার হোমিও চিকিৎসক জ্ঞানচন্দ্র প্রামাণিকের ঘরে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের একখানি প্রতিকৃতি দেখে তাঁর উজ্জ্বল চোখ দুটি পঞ্চাননকে আকৃষ্ট করে। জ্ঞানচন্দ্র তখন অনতিদূরেই হিমাইতপুরে অবস্থিত শ্রীশ্রীঠাকুরকে একবার দর্শন করে আসার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানালে তিনি
তৎকালীন মানসিকতা অনুযায়ী বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গীতেই ঠাকুর সম্বন্ধে মন্তব্য করেন। পরে বাড়ি গিয়ে দাদা অমৃতলালের কাছে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেই তিনিও বিরূপ- ভাবে বলেন যে ঠাকুর সম্বন্ধে অনেকের কাছেই তিনি নানা বিরুদ্ধ কথা শুনেছেন; ঠাকুর এবং তৎজননী মনোমোহিনী দেবী নাকি যাদু শক্তির অধিকারী, যে-কেউ এঁদের আওতায় গিয়ে পড়লে এঁরা তাকে বশীভূত করে ফেলেন। প্রতিভাধর বিজ্ঞানী কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য তাঁদের কাছে গিয়ে একেবারে বশীভূত হয়ে গেছেন, অত্যন্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সম্পন্ন জীবন ত্যাগ করে গ্রাম্য আশ্রমে মেষতুল্য জীবনযাপন করছেন। কৃষ্ণপ্রসন্ন পঞ্চাননেরই সমসাময়িক এবং পরিচিত ছিলেন। দাদা আরও বলেন, সদ্গুরুর সন্ধানে আর নিজেদের ছোটাছুটি করে লাভ নেই, অদৃষ্টে থাকলে তিনি স্বয়ং এসে ধরা দেবেন। এর ফলে সে-যাত্রায় পঞ্চানন শ্রীশ্রীঠাকুর-দর্শন প্রয়াসে নিরস্ত হন। প্রকৃত প্রস্তাবে, তাঁর জীবনে পরমপ্রাপ্তির লগ্নটি তখনও আসেনি।
কলকাতায় থাকাকালীন তাঁর বন্ধু ঈষদানন্দ বিশ্বাস একদিন এসে বলেন যে তিনি একবার পাবনা সৎসঙ্গে যাবেন বলে স্থির করেছেন। তা শুনে পঞ্চানন তাঁকে ভাল করে না জেনেবুঝে ঝোঁকের মাথায় দীক্ষা না নিতে পরামর্শ দেন। এও বলেন যে সব দেখেশুনে যদি ভাল মনে হয়, তবে বরং দু’বন্ধু একসঙ্গে দীক্ষা নেওয়া যাবে। ঈষদানন্দ বিশেষভাবে কবি হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের উল্লেখ করে জানান যে অমন বেহিসাবী মদ্যপ কবি নিজেকে সম্পূর্ণ সংশোধিত করে এখন সপরিবারে আশ্রম- নিবাসী, এ ঘটনা তাঁকে বিশেষ আলোড়িত করেছে। এ ঘটনা পঞ্চাননেরও জানা ছিল।
ঈষদানন্দ চলে যাওয়ার পরে এক রবিবার পঞ্চানন ছুটির দিনের বিড়ম্বনা অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে আপার সার্কুলার রোডের এক মেসে বন্ধুবান্ধবদের তাসের আড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে ঘটনাচক্রে কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। অমনি পঞ্চাননের তার্কিক বুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে-অধ্যাত্ম অনুভূতি প্রসঙ্গে কৃষ্ণপ্রসন্নের সঙ্গে জুড়ে দেন তীব্র বিতণ্ডা। সবিস্ময়ে এও লক্ষ করেন যে কৃষ্ণপ্রসন্নকে আদৌ বশীকৃত মেষ বলে বোধ হচ্ছে না, বিপরীতে তাঁর উজ্জ্বলতা এবং প্রখরতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যা-হোক, তর্কাতর্কি হতে হতে বেলা সাড়ে দশটা বেজে যাওয়ায় কৃষ্ণপ্রসন্ন অন্যত্র কাজ আছে বলে চলে গেলেন। কিন্তু তর্কপ্রিয় পঞ্চানন তখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন, কার ওপরে বাকি ঝালটুকু ঝাড়া যায়। ঠিক তখনই ঐ মেসে কানাই নামে একটি তরুণ জানায় যে মহারাজ নামে ঠাকুরের এক বিশিষ্ট ভক্ত এসেছেন কলকাতায়, অখিল মিস্ত্রী লেন-এ উঠেছেন, যে-কোন মানুষকে অল্পক্ষণের মধ্যে নিজের মতে এনে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা রাখেন ভদ্রলোক। পঞ্চানন তা শুনে লাফিয়ে উঠলেন একজন উপযুক্ত তর্কসঙ্গীর আশায়। অল্পক্ষণের মধ্যেই গিয়ে হাজির হলেন অখিল মিস্ত্রী লেন-এর সেই বাড়িতে। ঘরে প্রবেশ করে কম্বলের আসনে উপবিষ্ট এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোককে দেখতে পান। আশেপাশে উপবিষ্ট ছিলেন আরও কয়েকজন। তিনি ঘরে ঢোকামাত্র ঐ দীর্ঘদেহী অত্যন্ত আন্তরিকভাবে তাঁকে
অ্যাপায়ন জানান; তিনি রূঢ় ভঙ্গীতে প্রশ্ন করেন-‘মহারাজ’ বলে এখানে কে আছেন, আগে তাই বলুন তো! এই রূঢ়তার প্রত্যুত্তরে স্মিত কোমলতায় ভদ্রলোক বলেন-দাদারা আমাকেই ‘মহারাজ’ বলে থাকেন; তবে মহারাজ বলতে যা বোঝায়, আমি তার কোনটাই কিন্তু নই দাদা! এবারে আসল পরিচয় দিই, আমার নাম শ্রীঅনন্তনাথ রায়, সাকিন হিমাইতপুরের পাশের গ্রাম কাশীপুর। আমার সাজা তামাক ঠাকুর ভালবাসতেন, তাই থেকে আমার ইয়ার বন্ধুরা আমাকে আদর করে বলতেন, “তামাক সাজার মহারাজ।” তারপর ব্যাঙাচির যেমন ল্যাজ খসে যায় বড় হলে, সেরকম আমার বেলাতেও ‘তামাক সাজার’ কথাটি খসে গিয়ে শুধু মহারাজটুকুতে এসে ঠেকেছে-এই আর কী! (মহারাজ কৌতুকচ্ছলে নিজের সম্বন্ধে এভাবে বললেও প্রকৃতপক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুর নিজেই তাঁকে ‘মহারাজ’ অভিধা দিয়েছিলেন। ঠাকুর বলেছিলেন-সন্তমতের পূর্ব পূর্ব গুরুদের নামের সঙ্গে ‘মহারাজ’ শব্দ যুক্ত দেখা যায়, যেমন, স্বামীজি মহারাজ, হুজুর মহারাজ প্রভৃতি; অনন্তনাথও ঐ জাতীয় একজন সাধক, সুতরাং তাকেও মহারাজ বলে ডাকা উচিত।)
তাঁর কথার ভঙ্গীতে উপস্থিত সকলে-পঞ্চাননও-হেসে ওঠেন। এঁর কথা বলার ধরনটি মনে ধরে পঞ্চাননের, ভাবেন এঁর সঙ্গে বোধহয় মন খুলে কথা বলা যায়। সে- কথা প্রকাশ করতেই অনন্ত মহারাজ তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। পঞ্চাননও শুরু করেন তাঁর কূটতর্ক বাধাহীন, দ্বিধাহীনভাবে। অনন্ত মহারাজের অসীম ধৈর্য এবং উৎসুক আগ্রহ, কখনও মধ্যপথে হস্তক্ষেপ না করার সংযম, তাঁর প্রসন্ন সহৃদয় পোষকতায় পঞ্চানন মনে মনে বিস্মিত না হয়ে পারেন না; আরও বিস্মিত হন তাঁর আশ্চর্য সমাধানী শক্তিতে। তাঁর স্থৈর্য, অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সুগভীর জ্ঞান, অনন্য বাচনভঙ্গী সবই পঞ্চাননের তৃষিত সত্তার উপরে যেন এক মোহন প্রলেপের কাজ করে। কিন্তু সহজে কিছু মেনে নেওয়ার মানুষ তিনি নন। একদিন নয়, দু’দিন নয়, পরপর দশ দিন একাদিক্রমে এই তর্কযুদ্ধ চালান তিনি অদ্ভুত এক অহং-প্রদর্শন অভিলাষে-কিন্তু অবশেষে শান্ত, স্থিতথী, অসাধারণ সেই মহারাজের কাছে পরাভব স্বীকার করেন তিনি। তবে এ পরাজয়ে কোন গ্লানি নেই, আছে পরম গৌরব। এই তর্কযুদ্ধ চলাকালীনই ঈষদানন্দ হিমাইতপুর থেকে ফিরে পঞ্চাননের কাছে এসে ঠাকুর এবং তৎজননী সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগে ভালবাসায় অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন। পঞ্চাননের বক্র দৃষ্টিতে অবশ্য মনে হল- শৈশবে মাতৃহীন ঈষদা একটু আদরযত্ন পেয়েই অতিরিক্ত বিগলিত হয়ে পড়েছে।
যাহোক, অনন্ত মহারাজের কাছে অবশেষে দীক্ষা নিতে ইচ্ছা হয় পঞ্চাননের যদিও অহংয়ের তাড়না তখনও যথেষ্ট প্রবল। কানাইয়ের মাধ্যমে মহারাজের কাছে দীক্ষার অভিলাষ ব্যক্ত করেন তিনি এক শর্তে তিনি দীক্ষা নেবেন গোপনে এবং তিনি যে দীক্ষা নিলেন, একথা এখনই কারও কাছে প্রকাশ করা চলবে না। সেসময় তাঁর স্ত্রী ভবতারিণী কলকাতায় তাঁর কাছে এসে ছিলেন, বাড়ি ফিরে তাঁকে জানালেন যে তিনি দীক্ষা নিচ্ছেন এক জায়গায়, তবে আগে তিনি দীক্ষা নিয়ে কিছুদিন দেখে বুঝে তারপর ভবতারিণীর দীক্ষার ব্যবস্থা করবেন।
দীক্ষার পরে যথাবিধি নামজপ ও ধ্যান শুরু করেন মহারাজের নির্দেশ অনুযায়ী। এক্ষেত্রেও ঠাকুরের ছবি সম্মুখে রেখে তাঁরই ধ্যান করতে হবে শুনে একজন মানুষের ধ্যান করার কথায় পঞ্চানন কিছুটা বিরূপ ভাব প্রকাশ করেন। মহারাজ তখন তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যে শ্রীরামচন্দ্র অথবা শ্রীকৃষ্ণ ভক্তদের ধ্যেয়, কিন্তু তাঁরাও প্রকৃতপক্ষে মানুষই ছিলেন, একইভাবে ঠাকুরও তৎপর্যায়ভুক্ত মানুষ এবং বর্তমান পুরষোত্তমরূপে তিনিই ধ্যেয়। দীক্ষা গ্রহণের পরে পঞ্চাননের শুষ্ক, তৃষ্ণার্ত, রিক্ত প্রাণে নবীন আশা, নব চেতনার উন্মেষ হতে লাগল, চতুষ্পার্শ্বস্থ অপ্রীতিকর হতাশাদ্যোতক সবকিছুই কী এক অজানা প্রীতির মুকুলে ভরে উঠতে লাগল।
কিন্তু ঠাকুরকে তখনও প্রত্যক্ষ করা হয়নি, ধ্যান যেন ক্রমে কিছুটা নিষ্প্রাণ হয়ে আসতে থাকে। অনন্ত মহারাজ কিছুদিন পর হিমাইতপুর ফিরে গেলেন-যাওয়ার সময় একবার ঠাকুর-দর্শনে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে গেলেন তাঁকে। ইতিমধ্যে হেমকবি (মুখোপাধ্যায়) একবার কলকতায় আসেন। কবিকে পঞ্চানন আগে থেকে চিনতেন -তাঁর উচ্ছৃঙ্খল, বেহিসাবী জীবন, মদ্যপ চরিত্র আবার অসাধারণ কাব্য- প্রতিভা এবং পাণ্ডিত্য, সবকিছুই জানা ছিল। কিন্তু এবারে কলকাতায় যাঁকে দেখলেন তিনি যেন এক অন্য মানুষ। বর্তমানের হেমকবির এই আমূল পরিবর্তিত সত্তা পঞ্চাননকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সেসময় কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি হলে আমন্ত্রিত হয়ে হেমকবি ‘ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার মূলসূত্র’-এই বিষয়ের উপর সপ্তাহব্যাপী অত্যন্ত সারগর্ভ বক্তৃতা করেন। তাঁর বক্তব্যের সারাৎসার পঞ্চানন বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশ করায় পত্রিকা কর্তৃপক্ষ অসন্তোষ প্রকাশ করেন-পঞ্চাননও এককথায় বসুমতীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
মহারাজ কলকাতা থেকে চলে যাওয়াতে পঞ্চাননের সব কিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল, কলকাতা যেন আকর্ষণহীন হয়ে পড়ল তাঁর কাছে। অবেশেষে ১৯২৬ এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হিমাইতপুর রওয়ানা হন। কুষ্টিয়া থেকে নৌকায় বাজিতপুর হয়ে সেখান থেকে হিমাইতপুর যেতে হত। পথে কুষ্টিয়াতেই আলাপ হল অবিনাশচন্দ্র পাল নামক শ্রীশ্রীঠাকুরের এক ভক্তের সঙ্গে, তাঁর সঙ্গে উঠে বসলেন বাজিতপুরের নৌকায়। খানিকক্ষণ পরে অকস্মাৎ পদ্মাবক্ষে ঝড় উঠল; পদ্মার বুকে ঝড়ের ভয়াবহতা অচিন্তনীয়-ঝড়ের বেগে নৌকা একদিকে কাত হয়ে গেল, চরম সর্বনাশের আশঙ্কায় যাত্রীরা চিৎকার করে উঠল, মাঝিদের মুখও গেল পাংশু হয়ে। শুধু ঠাকুরের দুই ভক্ত শান্তভাবে নাম করে চললেন; পঞ্চাননের মনে এক গভীর প্রত্যয় জন্মালো-ঠাকুর আছেন, তিনি রক্ষা করবেন। অকস্মাৎ পদ্মার বুকে এক অদৃশ্য চরে ঠেকে গেল নৌকা, রেহাই পাওয়া গেল অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে। ঝড় থামলে নৌকা বাজিতপুর পৌঁছল।
হিমাইতপুর পৌঁছতে রাত্রি হয়ে যাওয়ায় সেদিন আর ঠাকুর দর্শনে গেলেন না পঞ্চানন। বিশেষত শুনলেন, ঠাকুরের শরীর অসুস্থ, ঘুসঘুসে জ্বরে ভুগছেন বেশ কিছুদিন। পরদিন সকালে সৎসঙ্গের তদানীন্তন সেক্রেটারি সুশীলচন্দ্র বসু তাঁকে ঠাকুরের কাছে নিয়ে গেলেন। ঠাকুর সেসময় ভক্তপ্রবর বিরাজকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে ছিলেন। বারান্দায় চৌকিতে অর্ধশায়িত শ্রীশ্রীঠাকুর, হাতে একখানি ছোট পুঁথি। পঞ্চাননের মনে হয়, জ্ঞানচন্দ্রের বাড়িতে ঠাকুরের যে ছবি দেখেছিলেন, তাতে কেমন সুন্দর চেহারা দেখেছিলেন, এখন তেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে না তো! চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত উজ্জ্বল হলেও চোখের কোল ঘিরে কেমন কালো কালো রেখা। হঠাৎই তখন ঠাকুর হাতের বইটির দিকে চেয়ে বলে উঠলেন- বাঃ, এটাও তো বেশ সুন্দর কবিতা!
‘দূরে থেকে দেখা যায় ভালো, কাছে গেলে রেখা কালো কালো!’
একথা শুনে তাঁর তৎকালীন মনোভাবের সঙ্গে ঠাকুরের পঠিত ছড়ার হুবহু মিল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান পঞ্চানন; ভাবেন, এই কি তবে অর্ন্তর্যামিত্ব?
ইতিমধ্যে সুশীলচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে বসে পড়েছেন সামনে। পঞ্চানন বিস্ময়ের ঘোরে প্রণাম করতেও ভুলে যান; পরমুহূর্তে ভাবেন, তাঁকে তো এখানকার কেউ চেনে না, এখন বরং চুপি চুপি চলে গিয়ে পরে এসে ঠাকুর-প্রণাম করলেই হবে। ভাবমাত্রই ঠাকুর তাঁর দিকে চেয়ে বলেন, আপনি তো প্রফেসারি করেন, তাই না দাদা! ঠাকুরের কথায় স্বস্তি পেলেন তিনি, উত্তর দিলেন-করতাম, ছেড়ে দিয়েছি। এই বলে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করে সম্মুখে বসলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর একটিও কথা না বলে তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। পঞ্চাননের কী যে হল তিনি নিজেও জানেন না-অনর্গল বলে যেতে লাগলেন নিজের এতদিনকার সঞ্চিত যত বেদনা-অবসাদ-হতাশা-অভিমানের কথা-যেন হঠাৎ মুক্তি পাওয়া ঝর্ণার মত ঠাকুরের পায়ের কাছে ঝরে পড়ল তাঁর অবরুদ্ধ যন্ত্রণার স্রোতস্বিনী। ঠাকুর নীরবে আশ্চর্য গভীর চোখ দুটি মেলে শুনে যেতে লাগলেন তাঁর সব কথা। কথা শেষ হয়ে এলে পঞ্চানন আত্মগত আফশোষের সুরে বলে ওঠেন-এখন আর আমায় দিয়ে কী হবে!
একথা শোনামাত্র ঠাকুর শায়িত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠে বসে ধমকের সুরে বলেন, নিজের ভাবনা যদি নিজেই এত ভাববেন, তবে আমি আছি কী করতে? আমি যদি কিছু হই-ই আপনার, তবে নিজেকে এতটা নিঃসহায় ভাবা কি চলে নাকি আর? তাছাড়া এখানে যে এসে পড়েছেন, তাও কি আপনার নিজের ইচ্ছায়? কেউ যদি টেনেই এনে থাকেন আপনাকে, তাহলে সবকিছুর চাবি-কাঠি তো তাঁরই হাতে-আর তাঁর ইচ্ছায় অঘটনও তো ঘটতে পারে চোখের পলকে। আমার কথায় এতটুকু আস্থা রাখাও কি শক্ত মনে করেন আপনি?
সেই গভীর সুপ্রত্যয়ী তিরস্কারে পঞ্চাননের অন্তরের সমস্ত বিষাদ-অবসাদ- গ্লানি ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মত কোথায় উড়ে গেল, পলকে উধাও হল মনের গ্লানিমা-এক অপরূপ নিশ্চিন্ততায় মন ভরে উঠল কানায় কানায়। তাঁর মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট ফুটে উঠল তাঁর অন্তরের অবস্থা। তখন ঠাকুর সুশীলদাকে লক্ষ্য করে বলেন-উদ্ধার-উদ্ধার করে এতটা ব্যস্ত না হয়ে মানুষ যদি একটু বিশ্বাস করত সুশীলদা, তাহলে উদ্ধার কিন্তু আপনি এসে হাজির হত, না চাইতে। সহজ অবস্থায় মানুষ কিন্তু এ সহজ পথে পা বাড়াতে চায় না, অথচ নদীর মাঝে ভীষণ ঝড়ে যখন নৌকা ডুবু-ডুবু, তখন মানুষ কেমন অক্লেশে বিশ্বাস করে ফেলে, আর প্রাণপণে চালিয়ে যেতে থাকে নাম। এদিকে নামের অন্তরে তো রয়েছেন নামী স্বয়ং-সুপ্ত হয়ে। বিশ্বাসের আকুল আহ্বানে তিনি জেগে ওঠেন আর দেখতে দেখতে মাঝ-দরিয়ায় কোথা থেকে ঠেলে ওঠে এক চর, আর তুলে নেয় নাওটাকে তারই বুকের ওপর। এমন তো কত দেখেছেন আপনারা, তাই না সুশীলদা?
একথা বলেই ঠাকুর রহস্যভরা ইঙ্গিতে তাকান পঞ্চাননের দিকে। মহা বিস্ময়ে ভাবেন পঞ্চানন, পথের ঘটনা তো এখনও কাউকে বলা হয়নি! শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্তর্যামিত্ব বিষয়ে বিশ্বাস এ ঘটনায় তাঁর মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হল।
প্রথমবার আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর-দর্শন এবং তাঁর কাছে নিজেকে উজাড় করে ঢেলে দেওয়া তো হলই, হল ঠাকুর-জননী মাতা মনোমোহিনী দেবীর বিশ্বজননীত্বের আস্বাদন লাভ, হল আশ্রমস্থ অন্যান্য অনেকের সঙ্গে পরিচয় ও প্রীতি। পঞ্চাননের নিজেকে ঢেলে দিয়ে কথা বলার রকমটি লক্ষ ক’রে সোহাগভরে ঠাকুর বলতেন, ওটা একটা রাজলক্ষণ। আর একটি ব্যাপার লক্ষ করে যৎপরোনাস্তি বিস্ময় বোধ করেন তিনি- ঠাকুরের প্রতি প্রত্যেকটি ভঙ্গিমা, কথা, তাকানো, হাসি সবই অনেকদিনের চেনা বলে মনে হয়, যেন কতবার কতদিন দেখেছেন তাঁকে! কিন্তু এই তো প্রথম এলেন তিনি আশ্রমে। ঠাকুরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ হয়, জিজ্ঞাসা করেন সুশীলচন্দ্রকে। তিনি হেসে উত্তর দেন যে ঠাকুরের অমোঘ আকর্ষণে যাঁরা এখানে না এসেই পারেননি, তাঁদের প্রত্যেকেরই এই একই অবাক-করা অভিজ্ঞতা হয়েছে, আশ্রমে এ কাহিনী নিত্যদিনের।
দিন তিনেক পরে কলকাতা ফিরে এলেন। কিন্তু আর তো মন লাগে না কোন কিছুতে, ভেতরটা কেবলই ছটফট করে সেখানে আবার যাবার জন্য। শেষ পর্যন্ত আর নিজের সঙ্গে নিজেই পেরে উঠলেন না-১৯২৭-এর এপ্রিলে আবার পৌঁছলেন হিমাইতপুরে। মানুষ-পাগল শ্রীশ্রীঠাকুর তো আহ্লাদে আটখানা আর একটি মানুষ পেয়ে। পঞ্চাননেরও মনে হয়, যেন নিজের জায়গায় ফেরা হল।
তখন জননীদেবী মানুষের স্বতঃস্বেচ্ছ দানে অথবা তেমন না পাওয়া গেলে নিজে ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করে আনন্দবাজার (আশ্রমের যৌথ ভোজনালয়) চালাতেন। কোন কোনদিন ভিক্ষা করে অর্থসংগ্রহ করে আনন্দবাজারের ব্যবস্থা হতে হতে সারাদিন পার হয়ে রাত্রি হয়ে যেত। দিনান্তে একবার মোটা আউস চালের ভাত আর জলের মত পাতলা ডাল জুটত-মহানন্দে সকলের সঙ্গে পঞ্চাননও তাই খেতেন। মা খোঁজ নিতেন প্রত্যেকের আহার সম্পন্ন হয়েছে কি না। শেষ ব্যক্তিটিরও আহার শেষ হলে তারপর তিনি নিজে অন্ন গ্রহণ করতেন। গরমের দিন, পদ্মার ঘাটে এক সিমেন্টের বেদিতে রাত্রে শয়নের ব্যবস্থা করে নেন পঞ্চানন-কোনদিন বৃষ্টি এসে গেলে এক ছুটে মাতৃমন্দিরের বারান্দায়! বিছানা বলতে শুধু একখানি মাথার বালিশ, তাও আবার বৃষ্টি এলে ভিজে যায়। ঠাকুরকে সে-কথা জানাতে তিনি বলেন-ইটের বালিশ মাথায় দিলে কিন্তু আর বালিশ ভিজে যাওয়ার সমস্যা হয় না। এ সমাধান খুবই মনঃপূত হয় পঞ্চাননের, এরপর থেকে একখানি ইট-ই হ’ল তাঁর বিছানার একমাত্র উপাদান।
নাম করেন, ধ্যান করেন, অতীতের অসহ তিক্ত জীবন যেন বিস্মৃত দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়-নতুন আনন্দে, নবীন উৎসাহে দিনগুলি যেন হাওয়ায় ভর করে ভেসে যায়। ঠিকমত নামধ্যান হচ্ছে কিনা, মা নিত্য প্রত্যেকের কাছে সে-বিষয়ে খোঁজ নিতেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। মনে করিয়ে দিয়ে বলতেন-বাড়িঘর ছেড়ে এখানে এসেছিস, এটাই তো প্রধান করণীয়। নিয়মিতভাবে নাম না করলে নিজেদের মলিনতার গায়ে হাতই পড়বে না। অনুকূল যখন যা করতে বলে, তা তো করবিই; তবে তোদের ঠাকুর যা বলে তার কী উদ্দেশ্য, তা বুঝে উঠতে পারবি না, যদি ঠিকমত নামধ্যান না করিস।...
বর্ষা শুরু হলে কাদায় নাজেহাল অবস্থা গ্রাম্য পথের; ঠাকুরের ইচ্ছে, তপোবন বিদ্যালয় পর্যন্ত পথের যতটা সম্ভব ভরাট করে নেওয়া। ঠাকুর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পোড়া ইটের টুকরো ঝাঁকায় বোঝাই করাচ্ছেন- আশ্রমের ছেলেবুড়ো সবাই মহা-আনন্দে মাথায় করে ঝাঁকা নিয়ে তপোবনের সামনে নিয়ে ফেলছে। পঞ্চানন শ্রীশ্রীঠাকুরের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছেন, তখনও সকলের সঙ্গে মিলে কায়িক শ্রমে যোগদানের মত একাত্মতা আসেনি তাঁর মধ্যে। একটা বোঝাই ঝাঁকা দেখিয়ে ঠাকুর কর্মী অটল দাসকে জিজ্ঞাসা করেন-ঝাঁকাটা কত ভারী হয়েছে বলে মনে হয় রে অটলা?
অটল ‘মণটাক হবে’ জানালে তাঁর সঙ্গে ধরে ঠাকুর ঝাঁকাটা হঠাৎ করে পঞ্চাননের মাথায় তুলে দেন। তিনি এই আকস্মিক ব্যাপারে কিছুটা হতচকিত হলেও তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে ঝাঁকাটা দু’হাতে সাপটে ধরেন। ঠাকুরের উল্লাস আর দেখে কে! বলেন- দেখলি তো? সাধে কি বলে ‘বাঘা বরিশাল’! এই বলে ঠাকুর পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলেন, পিছনে পিছনে ঝাঁকা মাথায় পঞ্চানন। পথের দৈর্ঘ্যও মন্দ নয়। তপোবনে পৌঁছে দেখেন, কর্মোদ্দীপনার আনন্দঘন এক উৎসব-বাসর যেন সেখানে; মাথায় বোঝা তুলে দিয়ে তাঁর মনের বোঝা আরও লঘু করে দেন দরদী দয়াল।
অমল আনন্দে দিন কাটে আশ্রমে; মনে ভাবেন, মাস দুই থেকে ভাল করে ঠাকুরের সংস্পর্শ হৃদয়ে-মনে গ্রহণ করে কলকাতা ফিরবেন।
কথাটা যেদিনই মনে হয়েছে সেদিনই শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে ডেকে বলেন-এই যে পঞ্চাননদা! আপনি তো শুনেছি খুব ভাল পড়ান?
পঞ্চানন উত্তর দেন যে তিনি পুঁথিগত বিদ্যার পঠন-পাঠন করেন বটে, তবে প্রকৃত বিচারে তার কোন সারবত্তা নেই।
ঠাকুর উদ্দীপনার সঙ্গে বলেন যে শিশু বয়স থেকে পৃথিবী এবং জীবন সম্বন্ধে নিজের মত করে বাস্তব বোধ তৈরি না করে কেবল কিছু বই হাতে তুলে দিলে শিশুদের শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়, তাদের স্বাভাবিক বোধ নষ্ট হয়, বই পড়ে তারাও বই হয়ে ওঠে, বাস্তবের সঙ্গে শিক্ষার কোন সংযোগ থাকে না। লেখাপড়া শেখানোর প্রচলিত প্রথাটিই ত্রুটিপূর্ণ বলে নির্দেশ করেন ঠাকুর। এই প্রথাগত শিক্ষায় মানুষের স্বাধীন সত্তার উন্মেষ তো হয়ই না, বরং তা লুপ্ত হয়ে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে একধরনের দাস-মনোবৃত্তি সৃষ্টি হয়-এই অভিমত প্রকাশ করে ঠাকুর বলেন, ছেলেদের আট/ নয় বছর পর্যন্ত স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দিয়ে, বাপ মায়ের সঙ্গে দৈনন্দিন সাংসারিক কাজকর্মে যুক্ত করে স্বাভাবিক সাধারণ বোধ গজিয়ে দিয়ে দশ বছর থেকে পড়াশুনো শুরু করালে ম্যাট্রিকের পাঠ্যক্রম তারা হয়তো তিন বছরের মধ্যেই শেষ করতে পারে। এর সঙ্গে তাদের কিছু কার্যকরী শিক্ষাও দেওয়া প্রয়োজন যাতে বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতেকলমে কিছু করে নিজের এবং পরিপার্শ্বের দায় সে বহনক্ষম হয়।
একেবারে প্রথম থেকে শুরু করে তিন বছরের মধ্যে ম্যাট্রিক পরীক্ষার উপযোগী হয়ে ওঠা সম্ভব কি না, এ-বিষয়ে পঞ্চানন কিছুটা সংশয় প্রকাশ করলে ঠাকুর অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলেন-এই কল্পনা, (অর্থাৎ তিন বছরে ম্যাট্রিক দেওয়া সম্ভব, এই কল্পনা) যা আমায় ভূতের মত ধাওয়া করে এসেছে এতকাল-তা কি এতই অসম্ভব?
ঠাকুরের আগ্রহের তীব্রতা ও আকুলতা দেখে পঞ্চানন নেতিবাচক উত্তর দিতে পারলেন না, বললেন- ভেবে দেখতে হবে।
ঠাকুর ভেবে নিয়ে তাঁকে জানাতে বলে চলে গেলেন। আধ ঘন্টার মধ্যেই ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, ভাবা হয়েছে নাকি। পঞ্চানন তখনও কিছুই ভাবেননি, কিন্তু সংকোচবশত তা না বলে, বলে ফেললেন যে অত্যন্ত মেধাবী হলে তিন বছরে ম্যাট্রিক পাস করা সম্ভব বলে মনে হয়। সে-কথার পৃষ্ঠে ঠাকুর বলেন যে মেধাতত্ত্বে তিনি বিশ্বাসী নন। শিক্ষক আদর্শগত প্রাণ হলে তাঁর প্রতি আকুল টানে যে কোন ছাত্রেরই মেধা গজিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। শেষে আবার বলেন-তাই তো আমার জিজ্ঞাসা-তিন বছরে পারা যায় কিনা!
উত্তরে পঞ্চানন বলে ফেলেন- চেষ্টা করে দেখলে হয়!
আর যায় কোথা-সোৎসাহে ঠাকুর বলে ওঠেন- দেখবেন চেষ্টা করে? দিই তাহলে ক্লাস তৈরি করে?
পঞ্চানন দেখলেন যে তিনি যেভাবে জড়িয়ে গেলেন, তাতে এখন আর পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঠাকুর ততক্ষণে যত আশ্রমিক মেয়েদের পেলেন-বারো থেকে বাষট্টি-সবাইকে ডেকে বলছেন, স্লেট পেনসিল খাতা-কলম নিয়ে আজই দুপুরে যা সব, কবিরাজ-বাড়ির দরজায় গাছতলায় ক্লাস! ফার্স্ট ক্লাস মাস্টার পেয়ে গেছিস রে পরমপিতার দয়ায়-তিন বছরেই ম্যাট্রিক পাশ!
কিছু বোঝার আগেই কীভাবে যেন আটকে গেলেন পঞ্চানন আশ্রমে-ভাগ্নে ক্ষিতীশকে চিঠি লিখে দিলেন কলকাতার বাসা ছেড়ে দিতে। শুরু হল এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের-একান্ত ঘরোয়া মেয়েদের-তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধা- একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে তিন বছরে ম্যাট্রিক পাশ করানোর অকল্পনীয় উপাখ্যান।
পঞ্চাননের দাদা অমৃতলাল কুষ্টিয়ার কাছে চড়াইকোল স্টেশনের স্টেশনমাস্টার ছিলেন-তিনি একদিন আগে থেকে কোন সংবাদ না দিয়ে হিমাইতপুরে দেখতে এলেন, সদ্গুরুর আশ্রয়ে ভাই কেমন আছে। তিনি পৌঁছেছেন রাত্রে-দেখেন পদ্মার ধারে সিমেন্টের বেদিতে ইটের বালিশ মাথায় ভাইটি সুখনিদ্রার আয়োজনে রত। দেখে তো তাঁর চক্ষুস্থির! পঞ্চাননকে ডেকে তুলে যথাসাধ্য তিরস্কার করলেন সদ্গুরু-প্রাপ্তিতে এহেন দুর্দশা-কবলিত হওয়ার জন্য। পরে অবশ্য আশ্রমকর্মী শ্রীশ্রীঠাকুরের নিত্যসহচর বঙ্কিম রায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং তাঁর সঙ্গে নানা কথাবার্তা বলে অমৃতলালের বিরূপতা অনেকখানি হ্রাস পায়। ঐ-রাত্রেই তিনি কর্মস্থলে ফিরে গেলেও কিছুদিন পরপরই আশ্রমে আসতে লাগলেন এবং অবশেষে অনন্ত মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়ে তাঁর আশৈশব সদ্গুরু সন্ধানের পরিসমাপ্তি ঘটল, পরম পাওয়ায় তৃপ্ত হল এতদিনকার আকাঙ্ক্ষা।
মাতৃবিদ্যালয়ের ক্লাস মহা উৎসাহে ও সাফল্যের সঙ্গে চলতে লাগল। সমস্যা, অসুবিধা দেখা দেয়, পঞ্চানন ছুটে যান মহাশিক্ষক শ্রীশ্রীঠাকুরের পদপ্রান্তে, অভিনব সমাধান লাভ করেন।
এরই মধ্যে নিত্যকার নানা সংঘটনের মধ্য দিয়ে তাঁকে নিত্যশিক্ষা দিয়ে চলেন ঠাকুর। একদিন একটি তরুণ একা এসেছে আশ্রম পরিদর্শনে, পঞ্চানন উপযাচক হয়ে তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠান দেখিয়ে চলেছেন উৎসাহে। তার মধ্যে অবশ্য তেমন আগ্রহ বা সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছিল না, কিছুটা ঔদাসীন্যের সঙ্গেই সব দেখে চলেছে সে। সেসময় একটি খাঁচায় কয়েকটি বাঁদর রাখা ছিল, হঠাৎ সেটি দেখে এবং বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্রের বারান্দায় শুয়ে থাকা একটি কুকুর দেখে সে উল্লসিত হয়ে উঠল। পঞ্চানন মনে মনে বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন তার মূঢ়তায়। এরপর সে যখন আশ্রম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তিনি তরুণটির দু’কান মলে দিলেন। সে বেচারী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির এই আচরণের কোন প্রতিবাদ করতে পারল না, নীরবে চলে গেল। কিন্তু পঞ্চানন নিজেই নিজের এই দুর্ব্যবহারে অনুতপ্ত হয়ে ঠাকুরের কাছে সব কথা খুলে বললেন। ঠাকুর সব শুনে মৃদু হেসে বললেন-হয়নি বিশেষ কিছু, কেবল কর্মফল একটু সৃষ্টি হয়ে রইল, এই যা।
পঞ্চানন সে-কথার অর্থ বুঝতে না পারায় তিনি বুঝিয়ে বলেন যে তরুণটি সামনে প্রতিবাদ করতে না পারলেও হয়তো বাইরে গিয়ে একথা অনেককে বলে বেড়াবে এবং ঐ কানমলা তার নিজস্ব গতিতে চলতে থাকবে পঞ্চাননের দৃষ্টির ও জ্ঞানের অগোচরে। ফলে হয়তো বা বহু বছর পরে পঞ্চানন যদি কখনও কাশী যান, হঠাৎ কোন গলিতে কোন আড়াল থেকে কেউ তাঁর মাথায় বসিয়ে দিল এক লাঠির বাড়ি। তিনি তখন কিন্তু ভেবে উঠতে পারবেন না যে বহু বছর আগের তাঁর নিজের দুষ্কর্মই এই অদৃষ্টের সৃষ্টি করেছে।
ঠাকুরের কথায় পঞ্চাননের বোধোদয় হয় যে জগতের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহই কার্যকারণ-সম্বদ্ধ-কারণের জ্ঞান না থাকাই অদৃষ্ট। তবে ঠাকুরের মুখে ঐ কথা ক’টি শুনে তাঁর মনে এমনই এক শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল যে তিনি কখনও কাশী যাননি।
মাতৃবিদ্যালয়ের সম্মিলিত ক্লাস ছাড়াও সারাদিনের প্রায় সবখানি ঠাকুরের নির্দেশে কোন-না-কোন ছাত্রীকে পৃথকভাবে পড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে হত মাস্টারমশাই পঞ্চাননকে। একদিন ঠাকুর তাঁকে ডেকে বলেন ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা পূজনীয়া সাধনাকে অঙ্ক শেখানোর জন্য। পঞ্চানন জানান যে সারাদিনে তো আর কোন সময় ফাঁকা নেই, রাত বারোটা থেকে দেড়টা-এই সময়টুকু অবকাশ আছে। ঠাকুর শুনে মহা খুশি হয়ে মেয়েকে ডেকে বলেন-মাস্টারমশাই ফার্স্ট ক্লাস টাইম বের করেছেন-রাত বারোটা থেকে দেড়টা! কেউ জাগবে না, চারদিক নিস্তব্ধ, অঙ্ক কষার পক্ষে চমৎকার।
সাধনাও রাজি। পঞ্চানন তাঁকে ‘মাগো’ বলে সম্বোধন করতেন। মাতৃমন্দিরের বারান্দায় রাত বারোটায় শুরু হল ‘মাগো’-র অঙ্ক ক্লাস। একদিন দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী একখানি ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাসের অঙ্ক শেষ হওয়ার পর মাস্টারমশাই লক্ষ করেন, তাঁর ‘মাগো’ ভারী অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তাঁর মুখের দিকে। কারণ জানতে চাওয়ায় সাধনা জানান যে অঙ্কটি নির্ভুলভাবে কষতে কষতে মাস্টারমশাইয়ের নাক ডাকছিল ঠিক ঘুমন্ত মানুষের মত। জবাবে পঞ্চানন জানান, কথাটা ঠিকই। একটা অঙ্ক কষতে যতটুকু অঙ্গের প্রয়োজন-একটা চোখের একটা কোণ, মাথার খানিকটা আর ডান হাতখানা জাগিয়ে রেখে বাকি শরীরটাকে তিনি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলেন। তাঁর এ কথায় আরও বিস্মিত হয়ে সাধনা জানতে চান যে এটা কীভাবে সম্ভব হয়। পঞ্চানন উত্তর দেন-সাধারণ ক্ষেত্রে হয়তো হয় না, কিন্তু তোমার বাবার ঠেলায় পড়ে এটা হওয়াতে হয়েছে। একে একরকম সার্কাসের কসরৎ বলতে পার; শক্ত কিছু নয়, অভ্যাসে আয়ত্ত করা যায়।
এর দু’একদিনের মধ্যে ঠাকুর ইঞ্জিনীয়ার শ্রীশচন্দ্র রায়চৌধুরীর পত্নী তরুবালা দেবীকে পড়ানোর জন্য পঞ্চাননকে একটু সময় বার করতে বলেন। ভোর পাঁচটা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত কোন সময় নেই শুনে ঠাকুরের সহাস্য উক্তি-আহা! মানুষের will-টা তো time and space-এর বহু ঊর্ধ্বের জিনিস! পরমপিতার দয়ায় এতদিনে আপনি তা বুঝেও ফেলেছেন!
অগত্যা পড়ানোর সময় স্থির হল রাত তিনটেয়। তরুকে ডেকে বলেন উল্লসিত ঠাকুর-তরু! ফার্স্ট ক্লাস টাইম বেরিয়ে গেছে তোর ভাগ্যে-একেবারে ব্রাহ্মমুহূর্ত!
অতঃপর এভাবে রাত তিনটে থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত সাড়ে বাইশ ঘন্টা ছাত্রী পরিবৃত হয়ে দিন কাটতে লাগল পঞ্চাননের; একটানা সাড়ে দশ বছর এভাবে কেটেছে। পরবর্তীকালে একসময় ঠাকুরের কাছে জানতে চান পঞ্চানন যে ঠাকুর তাঁকে অতবছর ঐভাবে নারীবেষ্টিত করে রেখেছিলেন কেন।
সহজভাবে জবার দেন ঠাকুর-যে-সাপে কামড়েছিল, সেই সাপ দিয়েই বিষ তুলে নিতে হল, নইলে আর উপায় কী?
এ প্রসঙ্গের পটভূমিকাটি ঈষৎ বিস্তারিত করা প্রয়োজন। বরিশাল কলেজে যখন পঞ্চানন পড়তেন, তখন মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত, জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সাধক কালীশচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে তাঁর মনে এঁদের মত চরিত্রবান, জিতেন্দ্রিয় ও সংযত প্রকৃতির হয়ে ওঠার দুর্মর বাসনা দেখা দেয়। ফলে বয়সোচিত স্বভাবধর্মের বিপরীতমুখী চলনে তাঁর মধ্যে এক স্নায়বিক ও মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন এবং নিষিদ্ধতার অন্তরাল সৃষ্টি হয়। এর ফলে, নারীসংস্পর্শ সর্বথা দোষাবহ এবং বর্জনীয়, এরকম এক অস্বাভাবিকতার চাপে তাঁর মানসিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনই পরিস্থিতিতে তাঁকে অহর্নিশি নারী পরিবৃত করে রাখেন ঠাকুর। প্রথম দিকে অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করতেন পঞ্চানন। তিনি তখন মধ্য তিরিশের এক যুবক- একান্ত নিরালায়, গভীর রাত্রে অন্য কোন লোকচক্ষুর অন্তরালে তরুণী ছাত্রীকে মুখোমুখি বসে পড়াতে গিয়ে তাঁর ভারী অস্বস্তি বোধ হত। ঠাকুরকে সে-কথা জানাতে গেলেন-এত নিরালায়, শুধু দু’জন মুখোমুখি হয়ে বসে পড়ানো খুবই মুশকিল, ঠাকুর!
ঠাকুরের রহস্যগম্ভীর উত্তর-শুধু দুজন? তৃতীয় কাউকে দেখতে পান না? ঠাকুর কি এতই বেকুব, পঞ্চাননদা, সাপ নিয়ে খেলছেন আপনি, আর তাঁর নির্নিমেষ নজরটি আপনার উপর নেই?
এভাবে ধীরে ধীরে তাঁর মনের অবরুদ্ধ আবেগ-জনিত স্নায়বিক চাপ ক্রমে শিথিল হতে থাকে এবং কখন তা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয় তা তিনি নিজেও আর টের পান না। মনঃসমীক্ষণ ও মনোচিকিৎসার এমন সফল ও বাস্তবোচিত প্রয়োগ কেবল সর্ববোধী মহাচিকিৎসকের পক্ষেই সম্ভব।
আশ্রমে স্থায়িভাবে থেকে যাওয়ার কিছুদিন পরে স্ত্রী ও শ্বশ্রূ-পরিজনের কাছ থেকে অনুযোগপূর্ণ চিঠি পান এভাবে দায়িত্ব-পলাতক হয়ে চলে আসার জন্য। সে- কথা ঠাকুরকে জানানোয় ঠাকুর বলেন তাঁদের কোমলভাবে বুঝিয়ে লিখে দিতে যে পঞ্চানন বুঝতে পারছেন যে তাঁদের কত অসুবিধা হচ্ছে, তা সত্ত্বেও তিনি বর্তমানে যে- নেশায় মজেছেন, তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া আর সম্ভব নয়। পঞ্চানন সেইমত জবাব দেন। ইতিমধ্যে দাদা চিঠি দেন একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসার কথা জানিয়ে। হবিবপুরের পৈতৃক বাড়িতে মা একাই থাকেন; ঠাকুর নির্দেশ দেন দাদার সঙ্গে একত্রে বাড়ি গিয়ে মাতৃদর্শন করে আসার জন্য।
ঠিক হল ভোরে আশ্রম থেকে যাত্রা করে দাদার কর্মস্থল পর্যন্ত হেঁটে যাবেন, সেখান থেকে দু’ভাই একসঙ্গে মায়ের কাছে যাবেন। ভোরে ঠাকুরের কাছে গেছেন পঞ্চানন প্রণাম করে বিদায় নিতে; ঠাকুর জানতে চাইলেন খাওয়া হয়েছে কি না; তিনি জানান যে অত ভোরে আর কী খাবেন, দাদার কাছে গিয়ে দুপুরে স্নানখাওয়া সারবেন। অত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকার কথায় ঠাকুর ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। পঞ্চাননকে বলেন পদ্মা থেকে স্নান সেরে আসতে। স্নান করে এসে পঞ্চানন দেখেন গরম ভাত, ঘি, আলুভাতে আর বেগুনভাজার ব্যবস্থা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সামনে শ্রীশ্রীঠাকুর বসে থাকেন স্নেহাতুর দৃষ্টি মেলে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আশ্রমিক খলিলর রহমান, বঙ্কিম ব্যানার্জি; তাঁদের দিয়ে চেয়ে ঠাকুর বলেন-পঞ্চান্নদার খাওয়া দেখি। খাওয়া যখন শেষ হওয়ার মুখে-তখনও পাতে কিছু ভাত অবশিষ্ট ছিল, সেদিকে লক্ষ করে ঠাকুর বলেন... তাই তো, আর একটু ঘি হলে যে হত!
খলিলর শুনে নিজের ঘর থেকে ঘিয়ের পাত্র নিয়ে এলে ঠাকুর ঢেলে দিতে বলেন-তিনিও সবখানি ঘি ঢেলে দেন। ইতিমধ্যে বঙ্কিম ব্যানার্জিও ছুটে গিয়ে নিজের ঘর থেকে ঘিয়ের হাঁড়ি নিয়ে এসে ঠাকুরের ইঙ্গিতে সবটুকু ঘি পঞ্চাননের পাতে ঢেলে দেন। পঞ্চাননের বিব্রত ভাব দেখে ঠাকুর তাঁকে অঞ্জলি করে ঐ ঘি সহ ভাত খেয়ে নিতে বলেন। ঠাকুরের নির্দেশ-অতএব তিনি তাই করেন।
রওয়ানা হয়ে পথে দুশ্চিন্তা হয়-অতখানি ঘি খেয়ে ফেললেন, শরীর অসুস্থ না হয়; কিন্তু সামান্যতম কোন অস্বস্তিও তাঁর হয় না। তাঁর সঙ্গে একই নৌকায় যাচ্ছিলেন ঠাকুরের অপর এক ভক্ত। তিনি সব শুনে বললেন-শ্রীশ্রীঠাকুর প্রতিটি গ্রাসে নিজে চোখ রেখে আপনাকে খাইয়েছেন। তাই ও খেয়ে আপনার অস্বস্তি আসবে কোথা থেকে? ও-যে মহাপ্রসাদ, ওতে অসুখ করে কখনও?
যা-হোক, দু’ভাই একসঙ্গে বাড়ি যাওয়াতে মা খুব খুশি। তখন অগ্রহায়ণ মাস। বাড়ির গাছে অকালে কয়েকটি কাঁঠাল হয়েছে, তার মধ্যে যেটি সবচেয়ে পুষ্ট এবং বড়, মা সেটা পাড়ালেন ছেলেদের জন্য-দু’একদিন ঘরে থাকলেই পেকে যাবে। অতবড় কাঁঠালটি দেখে পঞ্চাননের সাধ হয়- অকালের ফল, যদি ঠাকুরভোগে দেওয়া যেত! দাদা অমৃতলালের কাছে সে কথা তুলতেই দেখা গেল তাঁরও ঐ একই ইচ্ছা। কিন্তু আশ্রমে ফিরতে তখনও অন্তত পনের দিন বাকি; অতদিন ঐ কাঁঠাল না পেকে থাকবে কীভাবে, একথা বলতেই অমৃতলাল জোর দিয়ে বলেন-থাকবে না মানে? ঠাকুরভোগে যখন দেব বলেছি তখন এর মধ্যে ও কাঁঠাল কিছুতেই পাকবে না।
স্থির হল, অমৃতলাল কাঁঠালটি নিয়ে তাঁর কর্মস্থল চড়াইকোলে ফিরবেন। পঞ্চানন ঠাকুরের নির্দেশে আশ্রমে নলকূপ বসানোর কাজের ব্যাপারে কলকাতা যাবেন, সেখান থেকে ফেরার পথে চড়াইকোল হয়ে কাঁঠাল নিয়ে আশ্রমে ফিরবেন। কাজ সেরে চড়াইকোল ফিরতে ষোলো দিন লেগে গেল পঞ্চাননের; গিয়ে দেখেন, কাঁঠালটি সদ্য পেকে উঠেছে, ঘ্রাণেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে। পরের দিন অতি প্রত্যুষে কাঁঠাল নিয়ে রওয়ানা হলেন, যাতে সাড়ে দশটার মধ্যে আশ্রমে পৌঁছে যান, কারণ ঠাকুর সাধারণত এগারোটার মধ্যে আহারে বসেন। কিন্তু এমনই প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে বাজিতপুর ঘাটে পৌঁছতেই আড়াইটে বেজে গেল। পঞ্চানন হতাশ হয়ে ভাবেন- এত সাধ করে ঠাকুরের জন্য কাঁঠাল আনা হল, তাঁকে আর খাওয়ানো গেল না! কারণ সেদিনের মত ঠাকুরের আহার তো হয়েই গেছে-পরের দিন পর্যন্ত ঐ কাঁঠাল আর ভাল থাকা সম্ভব নয়।
প্রায় তিনটের সময় আশ্রমে পৌঁছে দেখেন, ঠাকুর যেন কারও জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি পৌঁছে প্রণাম করতেই মাকে ডেকে বলেন- মারে, পঞ্চাননদা আচ্ছা সময়ে কাঁঠাল এনে ফেলেছে। আর কাঁঠালও সেরকম, গন্ধে তার ভুবন একেবারে মেতে উঠেছে।
পঞ্চানন জানলেন, সেদিন নানা কাজে আটকে পড়ায় ঐ অত বেলা পর্যন্ত ঠাকুরের খাওয়া হয়নি। তখনই তিনি খেতে বসলেন এবং পঞ্চাননের আনা কাঁঠাল পরম পরিতৃপ্তি সহকারে খেলেন। আবেগে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে যায় পঞ্চাননের চোখ!
প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কীভাবে ঐ কাঁঠাল অতদিন না পেকে ঐ সময়ে পাকল এবং কেনই বা সেদিন ঠাকুর এগারোটার বদলে বেলা তিনটের পরে খেতে গেলেন-অনেকদিন পরে একবার এ প্রশ্ন করেছিলেন পঞ্চানন। ঠাকুর জানান যে গভীর প্রত্যয় থেকে কোন কথা বললে তা ফলবান হয়; তাই অমৃতলালের কথা- ‘ঠাকুরভোগে যখন দেব বলেছি তখন এর মধ্যে ও কাঁঠাল কিছুতেই পাকবে না’ এবং পঞ্চাননের ইচ্ছা ঐদিনই ঠাকুরকে কাঁঠাল খাওয়াবেন-দুটিই সত্য হয়েছে। তবে বিভূতি-প্রদর্শনের আশায় কেউ এ-কাজ করলে কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয় না।
এরপরে মাতা মনোমোহিনীর নির্দেশে পঞ্চানন স্ত্রী ভবতারিণী এবং আড়াই বছরের কন্যা শান্তিকে আশ্রমে নিয়ে আসেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে ভবতারিণী ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ সুপণ্ডিত চিন্তাহরণ দে-র কন্যা এবং তিনিও তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারিণী ছিলেন। আই. এস সি. পরীক্ষায় তিনি জেলার মধ্যে প্রথম হন। কিন্তু হয়তো পঞ্চাননের অবৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গী, রূঢ় সত্য বলার অভ্যাস এবং ভবতারিণীরও কিঞ্চিৎ অধীরতা-সব মিলিয়ে তাঁদের দাম্পত্য জীবন কিছুটা দ্বন্দ্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য শ্রীশ্রীঠাকুরের অমিয় করুণায় সে দ্বন্দ্বের হ্রাস হয়। আশ্রমে ভবতারিণী ‘ভবী-মা’ নামে পরিচিতা ছিলেন।
একবার পঞ্চানন কোন পারিবারিক দ্বন্দ্বের কথা ঠাকুরকে বলেন; ঠাকুর বলেন -এড়িয়ে চলতে হয়, নিজেকে আলগা রাখতে হয়। পঞ্চানন কথাটা শুনলেন, কিন্তু যেন পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম হল না তা। ঠাকুর তা লক্ষ করেন। একটু পরে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর বেরোন। হাঁটতে হাঁটতে আশ্রম-লাগোয়া একটি বাগানের মধ্যে ঢোকেন; সেখানে সাধারণত লোকে প্রাকৃতিক কর্ম সারত। সেই বিষ্ঠাপূর্ণ বাগানটি ঠাকুর পঞ্চাননকে সঙ্গে নিয়ে পার হলেন। পেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন-কি পঞ্চাননদা, পায়ে ময়লা টয়লা লাগেনি তো?
পঞ্চানন জবাব দেন- আপনার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে গা বাঁচিয়েই তো এলাম।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর বলেন-এই তো ধরে ফেলেছেন তুক!
পঞ্চানন বুঝলেন- প্রত্যক্ষ উদাহরণ দিয়ে জীবন চলনার রীতি পরম যত্নে কীভাবে দয়াল অন্তরে গেঁথে দেন।
ঠাকুর একবার পঞ্চাননকে পরিবার-বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছুদিন একা থাকার নির্দেশ দেন। তখন মাতৃবিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়া ছাড়া তাঁর আর বিশেষ কিছু করণীয় ছিল না। একা থাকার দরুন নিজের সব কাজ-রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা সব করেও অবসর সময় কী করবেন ভেবে পেতেন না তিনি। কর্মবর্জিত থাকা তাঁর পক্ষে বরাবরই অসুবিধার। ঠাকুরকে গিয়ে জানান যে কর্মেন্দ্রিয়গুলি কাজ করার জন্য ছটফট করছে। ঠাকুর হেসে রসিকতার সুরে জবাব দেন যে ওরা পঞ্চাননের প্রভুত্ব স্বীকার না করে তাঁরই প্রভু হয়ে উঠতে চাইছে, তাই ওদের একটু জব্দ করা দরকার। তিনি পঞ্চাননকে নাম ব্যতীত অন্য কিছুতে মন দিতে নিষেধ করলেন। পঞ্চাননও তদনুযায়ী নাম করে চলেন সর্বক্ষণ। ঐ সময়ে অনন্ত মহারাজের পত্রাবলি ‘সান্ত্বনা’ প্রকাশনার পথে-মহারাজের ইচ্ছানুযায়ী নামধ্যান ছাড়াও ঐ বইয়ের প্রুফ দেখার দায়িত্ব নেন তিনি। কিন্তু আরও কিছু কাজের জন্য ভিতরে ভিতরে ছটফটানি তাঁর থেকেই যায়। তবুও ঠাকুরের নির্দেশ অনুযায়ী বিশেষ জোর দিয়ে নাম চালাতে থাকেন।
এর মধ্যে অকস্মাৎ এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হল-তাঁর মস্তিষ্ক যেন অসাড়, ধোঁয়াটে বোধ হতে লাগল, অতি সাধারণ সমস্ত পাঠন বিষয়ও অদ্ভুত জড়তার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। তিনি শঙ্কিত হয়ে ছুটে যান ঠাকুরের কাছে-ঠাকুর তাঁকে দেখেই বলে ওঠেন-থাক্ থাক্, কিছু আর কইতে হবে না, কইতে পারবেনও না। এখান থেকে পালান! এখানে আর আসবেন না!
কাতরভাবে পঞ্চানন বলেন- সইতে পারছি না যে!
শ্রীশ্রীঠাকুর অদ্ভুত এক কোমল গম্ভীর স্বরে বলেন-সইতেই হবে! এই সব তমসাচ্ছন্ন অবস্থার ভেতর দিয়েই যেতে হবে যে! মানিক আমার, সোনা আমার! কোন দিকে খেয়াল দিয়ে কাজ নেই, খুব জোর নাম চালিয়ে যান,- আরও জোরে চালান। আর এমুখো একেবারেই হবেন না। যান, এখুনি যান, এখানে আর দাঁড়িয়ে কাজ নেই!
অগত্যা চলে আসেন পঞ্চানন-যন্ত্রবৎ নাম করে চলেন, ‘সান্ত্বনা’-র প্রুফ দেখাও চলে। এভাবে দুসপ্তাহ অতিক্রান্ত হলেও কোন উন্নতির লক্ষণ না দেখা দেওয়াতে আবার ঠাকুরের কাছে যেতে উদ্যত হন। কিন্তু তাঁকে দূর থেকে দেখতে পাওয়ামাত্র ঠাকুর বলে ওঠেন-বলেছি না-এ মুখো আসবেন না! কথা বোঝেন না! এদিকে এলে শালা পালিয়ে যাবে, ধরতে পারব না। যান-এক্ষুনি পালিয়ে যান, আর খুব চালিয়ে যান নাম-শালাকে একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলুন!
অসহায় পঞ্চানন বলেন-আর যে সইতে পারছি না, ঠাকুর!
-আরে, আমি তো আছি, আপনার ভয়টা কীসের? পালিয়ে আর যাবেন কোথায়, আমার নজরের সীমানার বাইরে তো আর নয়!
আবার ফিরে আসেন, ঠাকুরের ‘আমি তো আছি’ কথাটিতে কিছু স্বস্তিবোধ হয়। আরও দু’সপ্তাহ পরে দুপুর বারোটা নাগাদ মহারাজের বইয়ের প্রুফ দেখে নিজের ঘরে ফিরেছেন ঘর্মাক্ত কলেবরে। হঠাৎ কোথা থেকে ঠাকুর এসে উপস্থিত হলেন। ঘরে ঢুকেই তাঁর ঘাড় ধরে জোর করে নীচু করে শিরদাঁড়ায় বিশেষ এক স্থানে সজোরে দংশন করলেন। বললেন-এঃ! পঞ্চাননদার গায়ে বড্ড লবণ; শিগগির জল এনে দিন, মুখটা ধুয়ে ফেলি!
পরক্ষণেই চলে গেলেন ঠাকুর। অকস্মাৎ একনিমেষে ভোজবাজির মত সব কিছু পাল্টে গেল পঞ্চাননের কাছে-এক অনাস্বাদিতপূর্ব মুক্তির উচ্ছলতায় উথলে উঠলো সমগ্র সত্তা, আশ্চর্য নির্ভার এবং নন্দিত বোধ হতে লাগল।
সেদিন রাত্রে হল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। দেহের দু’পাশ দিয়ে দুটি কী যেন বস্তু শরীর নিংড়ে বেরিয়ে গেল বলে মনে হল তাঁর। তখনই ছুটে গিয়ে ঠাকুরকে জানাতেই তিনি খুশি মুখে বলে ওঠেন- বেঁচে গেছেন, শালারা কী বাসাটাই না বেঁধেছিল দেহের অণু-পরমাণুকে গ্রাস ক’রে! এতদিনে তা গেল ছেড়ে।
ওগুলো কী-জানতে চাইলে ঠাকুর বলেন, ও গুলো হল beaten complexes বা পরাভূত বৃত্তি।
এভাবে ঠাকুরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সমস্ত দিক থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বায়িত করে তোলার পরম সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন পঞ্চানন। তিনিও তাঁর অসাধারণ মেধা- স্পর্শমণির ছোঁয়ায় বা আরও বহুগুণ বর্ধিত হয়েছিল এবং অকল্পনীয় শ্রম দিয়ে ঠাকুরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। শ্রীশ্রীঠাকুরের শিক্ষাদর্শ রূপায়ণের অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন পঞ্চানন। একেবারে গোড়া থেকে ধরে তিন বছরে ম্যাট্রিক পাস করানো তো বটেই, তারপরে আশ্রমের ছাত্রছাত্রীদের আই. এস সি., বি. এস সি. পড়ার সময়ও তিনি ছিলেন সকলের সর্বক্ষণের মাস্টারমশাই।
আশ্রম থেকে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ প্রায় চার মাইল রাস্তা, বর্ষায় যা অগম্য হয়ে ওঠে। সেজন্য আশ্রম থেকে এডওয়ার্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয় যে মেয়েরা বিজ্ঞানের প্র্যাকটিকাল ক্লাস করতে কলেজে যাবে, থিওরি আশ্রমেই আশ্রমিক অধ্যাপকদের কাছে পড়বে-কলেজ কর্তৃপক্ষ যেন তাতে অনুমতি দেন। তখন ব্রিটিশ অধ্যক্ষ; তিনি প্রথম এহেন অদ্ভুত প্রস্তাব নাকচ করে দেন। বারংবার অনুরোধ করায় শেষে বলেন যে ইংরেজি, অঙ্ক ও সংস্কৃত-এই তিন বিষয় যাঁরা আশ্রমে অধ্যাপনা করবেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়ে সন্তুষ্ট হলে প্রস্তাবটি বিবেচনা করা যেতে পারে। তদনুযায়ী স্থির হয় কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য, রত্নেশ্বর দাশশর্মা এবং পঞ্চানন সরকার যাবেন এডওয়ার্ড কলেজে সাক্ষাৎকার দিতে। কিন্তু সব শুনে পঞ্চানন ঠাকুরকে বলেন, আর কারও প্রয়োজন নেই, তিনি একাই যথেষ্ট। শ্রীশ্রীঠাকুর তাতে সম্মত হন। পঞ্চানন একাই সেখানে যান এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে উল্লিখিত তিনটি বিষয় ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে তাঁদের এমনভাবে প্রভাবিত করেন যে তাঁরা নির্দ্বিধায় সমস্ত থিওরি ক্লাস আশ্রমেই হওয়ার প্রস্তাব মঞ্জুর করলেন।
যে-কোন বিষয়ে কুশলতা লাভ ছিল তাঁর কাছে খেলার মত। একাধিক দেশী বিদেশী ভাষা, বিভিন্ন বিষয়, নানা শাস্ত্র, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, জ্যোতিষচর্চা, এমনকি তাস ও দাবা খেলা-সব কিছুতেই তাঁর অনায়াস গতিবিধি ছিল এবং প্রতিটিতেই তাঁর দক্ষতা ছিল সাধারণ স্তরের অনেক উপরে। তাঁর সময়কালীন আশ্রমিক প্রায় সমস্ত ছাত্রছাত্রীরই তিনি ছিলেন মাস্টারমশাই। পরবর্তীকালে তাঁর এক অগ্রজ-যিনি অধ্যাপনা সূত্রে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন-তাঁকে বলেন যে সদ্গুরু লাভ করে পঞ্চানন কী পেলেন-কলকাতা শহরে একখানি নিজের বাড়িও নেই, অথচ তিনি একাধিক বাড়ির মালিক। পঞ্চানন জবাব দেন-আপনি বিষয় চেয়েছেন, পেয়েছেন। আমি মানুষ চেয়েছি, পেয়েছি। আপনার অতগুলো বাড়ি রয়েছে, আমার রয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী-তারাই আমার বড় সম্পদ। এমনই নির্মোহ, পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গী ছিল তাঁর।
শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি বিষয় তিনি ঠাকুরের কাছ থেকে খুঁটিয়ে জেনে নিতেন। ছাত্রের মনোযোগের অভাব, কোন বিষয় বুঝতে না পারা, ক্লাসে অনুপস্থিতি, পড়া ভুলে যাওয়া-শিক্ষার্থীর যে-কোন ত্রুটির জন্যই ঠাকুর শিক্ষককে দায়ী সাব্যস্ত করতেন। বলতেন-শিক্ষকের চারিত্র্যগুণ যদি তেমন ছাত্রমুগ্ধকর হয় তবে তাঁর প্রতি টানেই ছাত্রের মেধার উন্মেষ হয়, পাঠ্যবস্তু এবং ক্লাসের প্রতি গজিয়ে ওঠে আগ্রহ ও ভালবাসা। পাঠ্যক্রম কীরকম হওয়া উচিত, প্রশ্নপত্রের ধরন কেমন হলে ঠিক হয়, খাতা কী ভাবে দেখা উচিত, প্রতিটি বিষয়েই শ্রীশ্রীঠাকুরের সুনির্দিষ্ট অভিমত পঞ্চানন সাগ্রহে নিজ জীবনে কার্যকর করার চেষ্টা করেছেন। ছাত্রের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও তার পরিবেশগত অবস্থান মাথায় রেখে তাদের সামনে উদাহরণ খাড়া করলে পাঠ তাদের পক্ষে অত্যন্ত জীবন্ত ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে-ঠাকুরের এই উপদেশ বাস্তবে প্রয়োগ করে তিনি আশাতীত ফল পেয়েছেন।
শিক্ষককে ঠাকুর তুলনা করেছেন চিকিৎসকের সঙ্গে; তিনি বলতেন, রোগের • চিকিৎসা করতে গিয়ে রোগীর অবস্থা দেখে বিরক্ত হলে চলবে কেন? ছাত্র পড়ানোও একধরনের ডাক্তরি; তাই বলি, তাদের ভুলভ্রান্তি দেখে বিরক্ত বা ক্লান্ত হলে চলবে না, মন খারাপ করলে বা হতাশ হলেও চলবে না।
নারীর উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে ঠাকুর বলেন, শিক্ষা পুরুষ ও নারীর সমান ভাবেই চলা উচিত-তবে তা হতে হবে বৈশিষ্ট্যবাহী। শিক্ষা যদি এমনতর হয় যাতে নারীর বৈশিষ্ট্যকে ব্যাহত করে, তবে তা সর্বতোভাবে পরিত্যজ্য, কারণ এতে অস্বাভাবিকতা আসে, আর এই অস্বাভাবিকতা থেকে উচ্ছৃঙ্খলতা জন্মে, আর তা থেকে জাতি ও সমাজের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
আবার অন্য এক প্রসঙ্গে ঠাকুর বলেন, মেয়েদের শিক্ষার ভিতর দিয়ে এমন সংস্কার তৈরি করতে হয় যাতে জাতি, বর্ণ, বংশ, বিদ্যা ইত্যদি বিবেচনা না করে কাউকে পতিত্বে বরণ না করে-আর অন্যায্য ও অবাধ পুরুষ মিশ্রণকে ঘৃণার চক্ষে দেখে। শ্রেষ্ঠকে কীভাবে বরণ করতে হয়, শ্রেষ্ঠকে কী করে চিনতে হয়, শ্রেষ্ঠের প্রতি সহজ শ্রদ্ধা কীভাবে হয় ইত্যাদি বিশেষ করে স্ত্রীশিক্ষার অঙ্গীভূত করা প্রয়োজন।
একবার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষণ বিভাগের তৎকালীন প্রধান অনাথনাথ বসু সৎসঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার নামডাক শুনে আশ্রমে এসেছিলেন এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য। তপোবন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরামর্শে তিনি ঠাকুরের শিক্ষাদর্শ-বিষয়ে বিস্তারিত অবগতির জন্য পঞ্চানন সরকারের সঙ্গে দেখা করেন। পঞ্চানন একনাগাড়ে দু’ঘন্টা ধরে ঠাকুর-নির্দেশিত শিক্ষাপদ্ধতির কথা বিস্তৃতভাবে বলেন; তিনি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনতে থাকেনা, আনন্দে তাঁর চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি বলেন-আপনারা ঠাকুরের দেওয়া এই জিনিসগুলো যদি সূত্রাকারে লিখে রেখে যেতেন, তবে আমার স্থির বিশ্বাস, জগত এক অমূল্য সম্পদ পেয়ে ধন্য হত। উত্তরে পঞ্চানন জানান যে এ কাজের জন্য যে technical knowledge ও দক্ষতা প্রয়োজন, তা তাঁদের নেই, অনাথবাবুর মত এ- বিষয়ে দক্ষ লোক যদি এ কাজের ভার নিতেন তবে হত। অনাথনাথ বসু সময়াভাবের কথা ব্যক্ত করে সখেদে বলেন-মাথায় রইল, দেখা যাক কতটা কী করা যায়।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ঐশী প্রেরণায় পঞ্চানন শিক্ষকতার যে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন-তা সর্বযুগে অনুসরণীয়। ঠাকুরের সংস্পর্শে তাঁর বিবর্তন তপোবনের শিক্ষাধারায় এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। মূলত শিক্ষকতার কাজে আত্মনিয়োগ করলেও তিনি ছিলেন সুকবি ও সুগায়ক। তাঁর বিভিন্ন সময়ে রচিত সংগীতাবলি ‘গীতিসম্বিতী’ নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়।
নারীপুরষের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক-আদর্শ দাম্পত্য, নারী:: বিভিন্ন ভূমিকা ও দায়িত্ব ইত্যাদি জীবনের বহু জটিল বিষয়ে পঞ্চানন পর পর এগারো দিন শ্রীশ্রীঠাকুরকে নানা প্রশ্ন করেন এবং ঠাকুরের কাছ থেকে প্রতিটির অমোঘ সমাধান লাভ করেন। এই প্রশ্নোত্তর-সংকলন ‘নারীর পথে’ নামক গ্রন্থে ১৯৩৪ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই বইটির অমূল্য কথোপকথন চিরদিন মানুষকে পথের সন্ধান দেবে। এই গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণের ভূমিকার কথাগুলি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য: ‘... রূঢ় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আর্ত আকুলতা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও তীব্র সন্ধিৎসা নিয়ে শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক ও প্রতিঋত্বিক শ্রীযুক্ত পঞ্চানন সরকার নারীজীবনের সঙ্গে জড়িত বহু জটিল বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে পরম প্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে তন্ন-তন্ন করে যে সব কূট প্রশ্নের অবতারণা করেছেন এবং উত্তরে ক্ষুরধার অকাট্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও অপূর্ব তত্ত্বদৃষ্টি সমন্বিত যে অভিনব সমাধান পরম দয়ালের দিব্য অবদানস্বরূপ পেয়েছেন-তা-ই এই ‘নারীর পথে’ পুস্তকে সন্নিবেশিত হয়েছে। সুপণ্ডিত প্রশ্নকর্তা শ্রীশ্রীঠাকুরের উক্তির সমর্থনে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শাস্ত্র, সাহিত্য ও দর্শনের ভাণ্ডার মন্থন করে বহু উদ্ধৃতি পাদটীকা সংযোজন করায় পাঠকবর্গের বিশেষ উপকার হয়েছে।...’
পঞ্চাননের আর এক উল্লেখযোগ্য কর্ম হল ‘ধাতু-দীপনী অভিধান’ সংকলন। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী পঞ্চানন ঠাকুরেরই নির্দেশে ঐ অভিধান সংকলন করেন। তাঁর অনবদ্য অকপট স্মৃতিকথা “আমার জীবনে শ্রীশ্রীঠাকুর” রচিত হয় ১৯৬৪-তে, দেওঘরে। এ শুধু এক অশান্তচিত্ত মানুষের স্থিতির উৎস সন্ধানের আত্মকথনই নয়, এতে ধরা আছে ঠাকুরের শিক্ষাদর্শের নির্যাস এবং সেসময়কার সৎসঙ্গের আংশিক ইতিবৃত্ত। বইটির কিছু অংশ শ্রীশ্রীঠাকুরকে পড়ে শোনানো হলে তিনি অত্যন্ত খুশির সঙ্গে বলে ওঠেন- Confessions of Saint Augustine নাকিরে! তাঁর কথা বলতে গেলে এমনই একান্ত নিজের জীবনে কথার মতই বলতে হয়। ১৯৪৬-এ শ্রীশ্রীঠাকুর দেওঘর চলে আসার পরেই পঞ্চাননও দেওঘরে চলে আসেন এবং ১৯৬৯-এ ঠাকুরের তিরোধান পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। তারপরে কলকাতায় এসে পুত্র খতেন্দ্রনাথের কাছে ছিলেন। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা স্পষ্টভাষী মানুষটি কলকাতাতেও ইষ্টভ্রাতাদের সান্নিধ্যেই বেশি সময় কাটাতেন। ১৯৭৫-এর এপ্রিল মাসে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে-পুত্র এবং পুত্রবধূ স্বভাবতই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। তিনি কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলেন-আমার এখনই কিছু হবে না -সূর্য যেদিন উত্তরায়ণে যাবে, সেদিন আমার যাবার পালা। সত্যি সত্যি তখনকার মত সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এর কিছুদিন পরে ২৩শে মে-সেদিনই সূর্যের উত্তরায়ণ ঘটে-হঠাৎই অসুস্থ বোধ করেন এবং স্বঘোষিত দিনে স্বজ্ঞানে চলে যান প্রিয়পরমের সঙ্গে চিরসম্মিলনে মিলিত হতে।
অস্তিত্বের সংকটের বিপন্নতা নিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের শরণে এসেছিলেন সুপণ্ডিত অধ্যাপক পঞ্চানন সরকার। তাঁর আদেশ নির্দেশ মাথায় নিয়ে, তাঁরই আলোকে বাস্তব চলনার মধ্য দিয়ে বিবর্তনের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, আদর্শ শিক্ষকের মূর্ত সংজ্ঞা হয়ে উঠেছিলেন; প্রাপ্ত হয়েছিলেন প্রতিঋত্বিকের পূত পাঞ্জা, পবিত্র নাম প্রদানে সার্থক করে তুলেছিলেন কত জীবন। তাঁর শুষ্ক পাণ্ডিত্যের বোঝা জ্ঞানের অমল স্বর্ণধারায় পরিণত হয়েছিল পরম জ্ঞানীর সুবর্ণ সান্নিধ্যে এসে এবং ইষ্টানুরাগদীপ্ত সেই জ্ঞানধারা তাঁর অসংখ্য ছাত্রের প্রাণে প্রাণে যে অনির্বাণ আলোকশিখা জ্বালিয়েছে, তারই অম্লান দীপ্তিতে শাশ্বত হয়ে থাকবেন তাদের মাস্টারমশাই।
_________________________
10