[ P - 12 ] 🔷 গালমন্দ যে এত মিঠে লাগে...🤔 🔷 বিনয় মানে...

 

📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,

🔷 গালমন্দ যে এত মিঠে লাগে...🤔
🔷 বিনয় মানে...
🔷 বিরূপাক্ষ কথাটার মানে ...

      pag no 132-145

     শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনান্তে কলতলার পাশে পূজনীয়া ছােটমার খড়ের ঘরের বারান্দায় মােড়র উপর বসেছেন , তাঁর অমর - বাঞ্ছিত পদযুগলে প্রভাতের রোদ এসে পড়েছে । ভক্তবৃন্দও রোদপিঠ ক’রে তাকে ঘিরে বসেছেন ।

      এমন সময় প্যারীদা এসে কথায় - কথায় বললেন — একটি টাইফয়েডের রােগীকে অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে অ্যাজামঞ্জিট দিয়ে খুব উপকার পেয়েছি । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর — খুব ভাল । তুমি কম রোগীর চিকিৎসা করনি , আর অভিজ্ঞতাও তোমার কম নয় । তবে মাঝে - মাঝে খেই হারিয়ে ফেল । কারণ , কোন্ বিশেষ ক্ষেত্রে কোন্ পৰ্য্যায়ে , কোন্ মাত্রায় , কী - কী ওষুধ প্রয়ােগ করে তুমি কী ফল পেয়েছ , সে - সম্বন্ধে তোমার একটা analysis ( বিশ্লেষণ ) নেই । ভাল ডাক্তার হতে গেলে case - note ( চিকিৎসার বিবরণ ) নিজের মত করে লিখে রাখা লাগে । আর , মাঝে - মাঝে সেগুলি পড়তে হয় , সেগুলি নিয়ে ভাবতে হয় । কী করলে আরো ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে , তাও ভেবে দেখতে হয় । বিভিন্ন গ্রুপের অসুখের নোট বিভিন্ন chapter (অধ্যায় ) -এ লিখতে হয় , যাতে প্রয়ােজনমত তাড়াতাড়ি খুজে পাওয়া যায় । লিখে না রাখলে , সব কথা মনে থাকে না । নূতন যা পড় তার মধ্যে যা মনে ধরে , তাও লিখে রাখতে হয় । আর , colleagues ( সহকর্মী ) যারা আছে , তাদের সঙ্গেও পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় ভাল । কার কাছ থেকে কখন কী পাওয়া যায় , তার ঠিক কি ? আবার , তোমার অভিজ্ঞতা দিয়েও আর পাঁচজন ডাক্তার উপকৃত হতে পারে । 

       প্যারীদা — শেখবার বুদ্ধি তো বড় কারও দেখি না , প্রত্যেকেই এক - এক জন মাতব্বর । বললেও শুনতে চায় না , inferiority- তে ( হীনম্মন্যতায়) ভরা ।

      শ্রীশ্রীঠাকুর — সেজন্য তুমি নিজেকেই দায়ী করতে পার । তােমার ভিতর যদি ছাত্রত্বের বোধ জাগরুক থাকে , তুমি যদি সশ্রদ্ধভাবে , আগ্রহসহকারে , অন্যের কথা শােন , এবং যার কাছ থেকে যেটা গ্রহণীয় সেটা বিনীতভাবে গ্রহণ কর , আবার তা প্রয়ােগ করে ফল পেলে দশজনের কাছে মুক্তকণ্ঠে যদি তার প্রশংসা কর , এইভাবে যদি বল ‘ আমার এটা জানা ছিল না , অমুকের কাছে শুনে ভেবে দেখলাম , suggestion ( নির্দেশ ) -টা তাে মন্দ নয় , পরে apply ( প্রয়ােগ ) ক'রে খুব ফল পেয়েছি , তখন দেখবে , যার যত inferiority ( হীনম্মন্যতা ) -ই থাক , সে কাবেজ হয়ে যাবে । তখন তােমার কাছ থেকে শুনতে বা শিখতে তার আর কোন আর থাকবে না । নিজে rigid ( অনমনীয় ) হয়েছ কি আর পারবে না ।

      প্যারীদা — অনেক সময় মানুষ ভুল suggestion ( নির্দেশ) দিয়ে mislead করে ( ভুল পথে নেয় ) , আবার এমনই তাদের অহঙ্কার যে সেইটে কেন শুনলাম না , তার জন্যে চটে যায় । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর — ভুল ব'লে যেটা বোঝ , সেটা গ্রহণ করতে যাবে কেন ? কিন্তু সেখানে তাকে directly ( সরাসরি ) oppose ( বিরোধ ) না করে , তােমার positive experience ( বাস্তব অভিজ্ঞতা ) যেটা কারণসহ সেইটে মিষ্টি করে বলবে , with all respect to the person ( মানুষটির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা দেখিয়ে ) । ন্যায়সঙ্গত ভাল কথাও যদি তুমি অকারণ রূঢ় ও রাগতভাবে বল , তাও মানুষ শুনতে চাইবে না । আবার , নিজের মেজাজ ঠিক রেখে , অন্যের মেজাজের প্রতি লক্ষ্য রেখে খেলিয়ে - খেলিয়ে , রসিয়ে - রসিয়ে তুমি কিন্তু অনেক কথা বসিয়ে দিতে পার তার মাথায় । নিজের উপর নিজের লাগাম যদি ঠিক না থাকে , তাহলে আর কাউকে কিন্তু তােমার পথে আনতে পারবে না । তোমার পথে মানে কল্যাণের পথে , সত্যের পথে , সত্তা - সম্বর্ধনার পথে , অভ্রান্তির পথে , বিজ্ঞানের পথে ; আর , সে - পথ সবারই পথ । আমাদের অহং - এর খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মানুষ যেন আমাদের অনুসৃত সত্যপথ হ'তে বঞ্চিত না হয় । ‘ বিদ্যা দদাতি বিনয়ং । মানুষের জানা যদি বিহিত বিনয় - সমন্বিত না হয় , তবে সে - জানা দিয়ে সে অন্যকে উদ্বুদ্ধ ও উচ্চতিত ক’রে তুলতে পারে না । বিনয় মানে বিশেষভাবে নিয়ে যাওয়া । তুমি তোমার পরিবেশকে তোমার জানার রাজ্যে যদি নিয়ে যেতে চাও , তবে প্রতিটি বিশেষকে বিশেষভাবে অনুধাবন করে বিশিষ্ট পথে ঘটিয়ে তুলতে হবে তা ' । বিদ্যা আছে , অথচ বিনয় অর্থাৎ বিনয়ন কৌশল নেই , তার মানে সে - বিদ্যা আয়ত্ত হয়নি তােমার । এই বিনয় মানে কিন্তু একটা নির্জীব নরমভাব নয় । যেখানে , যখন , যে - ক্ষেত্রে , যার সঙ্গে , যেমনতর ব্যবহার করলে তুমি তাকে তােমার আদর্শ ও উদ্দেশ্যানুগ পন্থায় আনতে পারবে , তেমনতর আচরণটাই বিনয় । তাই , বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ নানাক্ষেত্রে নানারকম হতে পারে । তবে তার সঙ্গে থাকা চাই দরদ ও শ্রদ্ধা । তা কিন্তু সাধারণতঃ মানুষের মনকে স্পর্শ করেই । 

     প্যারীদা — বিনয়ের expression ( অভিব্যক্তি ) নানারকম হতে পারে , সে কেমন ?

     শ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —আমার নিজের কথাই বলি । সে ভারি মজার কাণ্ড হইছিল । তখন আমি ডাক্তারি করি । একবার এক রােগীর বাড়ী থেকে কয়দিন খবরও দেয় না , ওষুধও নিয়ে যায় না । অথচ বলবৎ রোগী । আমি ভেবে - ভেবে সারা । নিজে যে যাব , সে ফুরসুতও নেই । ওরাও আসে না । উৎকণ্ঠায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত । শেষটা তিনদিন পরে রোগীর বাড়ী থেকে ওষুধ নিতে এলো । লােকটাকে দেখে প্রথমে রােগীর খবর নিলাম , তারপর রেগে আমি এইছান গালাগালি সুরু করে দিলাম , সে আর কথা কবে কী ? আমাকে তিনদিন ধরে এতখানি দুশ্চিন্তায় ভুগিয়েছে , আমিও মনের ঝাল মিটিয়ে বকলম । যা মনে আসলো , বললাম । সে - বলার মধ্যে উদ্দেশ্য ছিল তাদেরই মঙ্গল । আমার বকা খেয়ে সে বলে , “ বাবু ! আপনি আর একটু গালান । আমার ঘাট হইছে বাবু , আর এমন করব না । তবে গালমন্দ যে এত মিঠে লাগে আমার । জানা ছিল না , আপনি আর একটু গালান । আপনার মুখে কথাগুলি কত ভাল শােনালাে , আর কেউ আমাকে এমন কথা কলি তার ঘাড়ডা আমি ছিড়ে ফেলতাম না এতক্ষণ ! কিন্তু আপনি কেমন সুন্দর ক’রে ক’লেন । তখন আমার মনে হলো পরমপিতা তাহলে আমাকে গালাগালি দিতে শিখিয়েছেন বটে । এখানে গালাগালিই কিন্তু তাকে ঈপ্সিত বোধে উপনীত করে দিয়েছে । তাই এটা বিনয়বহির্ভূত নয় । তবে এ বড় কঠিন ব্যাপার । পট করে যদি নকল করতে যাও , কেউ ঘাড়টাই ছিড়ে ফেলতে পারে । তবে এইটুকু লক্ষ্য রাখবে , যদি কোথাও তিক্ত কথাও বলা প্রয়োজন হয় , তা বলবে যথাসম্ভব হৃদ্য করে । চ’টে আত্মহারা হয়েছ কি আর মাত্রা ঠিক রাখতে পারবে না , তখন আর মানুষকে পথে আনতে পারবে না । তোমার ক্রোধের সংস্পর্শে তারও ক্রোধের উদ্দীপন হবে । মনের যে - দরজা খোলা থাকলে মানুষ ভাল কথা মাথায় নিতে পারে , সে - দরজায় তখন কপাট পড়ে যাবে । তখন তুমি লাখ ভাল কথা কও , তা ’ তার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না । সে ভাববে , তুমি তাকে খাটো করবার জন্য সব কথা বলছ । তাই , মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে খুব হুশিয়ার । 

      প্যারীদা - অতাে হিসাব করতে গেলে তো কাজ করাই মুশকিল । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন — ওখানেই তাে বাহাদুরি প্যারীচরণ ! ওখানেই তাে বাহাদুরি ! কাৰ্য্যক্ষেত্রে সংঘাতের মধ্যে প’ড়ে কার কতখানি মাথা ঠিক থাকে , সেইটেই তো চরিত্রের পরখ । আর , কাজের কোন মানে হয় না , সে - কাজের সঙ্গে যদি আত্মনিয়ন্ত্রণবুদ্ধি না থাকে । সে - কাজ তখন ভিতরে - বাইরে জঞ্জাল সৃষ্টি করে।  নিরখ - পরখ ঠিক রেখে কাজ করো , তাহলে দেখবে , সে - কাজে নিজেও বিশেষ । শান্তি পাবে , অন্যকেও শান্তি দিতে পারবে । একদিনেই মানুষ নির্ভুল হ'য়ে যায় না , তবে ভুল সংশােধনের দিকে লক্ষ্য থাকলে আস্তে - আস্তে ঠিক হয়ে আসে । ইষ্টপ্রীতিকে লক্ষ্য করে কাজ করলে তখন প্রত্যেকটা কাজ হয় তার আরতি সেখানে অহমিকা বা প্রবৃত্তি বেশী মাথাতোলা দিতে পারে না । তাই দ্বন্দ্ব , বিরােধ , বিরক্তি , দম্ভ , বিদ্বেষ স্বতঃই প্রশমিত হয় । মানুষ কঠোর , ক্ষিপ্র , অনন্তকৰ্ম্ম হয়েও হয় নিরভিমান ও নির্ব্বিরােধ : তাই বলে সে অন্যায়ের সঙ্গে কিন্তু আপােষ ক’রে না , দৃপ্ত বিনয়ে প্রতিরােধ করে সেখানে । তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে থাকে এমন একটা ঔজ্জ্বল্য যা মানুষের অন্তরের জটিল অন্ধকারকে আলোকিত করে তােলে । তেমনি হ'লে তুমি যা খুশি তাই করতে পার । তখন তােমাকে দেখে লোকে বলবে ( শ্রীশ্রীঠাকুর মাথা দুলিয়ে - দুলিয়ে সুর করে গাইলেন ) —যাদুকরের ছেলের মত প্যারী কত রঙ্গ জানে ।

     শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার রহস্য করে বললেন — অনেক বকাইছ , এইবার ভাল করে এক কলকে তামাক খাওয়াও 

     প্যারীদা তামাক সেজে দিলেন ।

     শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে ভিড় জমে উঠেছে । তার মধুর আলাপন শুনে সবাই আনন্দে মসগুল । এইবার তিনি নলটি মুখে দিয়ে ধীরে - ধীরে টানছেন অর স্নেহল দৃষ্টিতে সবার দিকে চেয়ে - চেয়ে দেখছেন । উপস্থিত সকলের দৃষ্টিও তা’তে নিবদ্ধ । কেমন যেন একটা চৌম্বক - আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে আছেন সবাই ।

      এমন সময় শ্রীশ্রীঠাকুর দেখতে পেলেন , একদল বাবুই পাখী মুখে ক'রে খড় নিয়ে যাচ্ছে । শ্রীশ্রীঠাকুর দেখে প্রীতিভরে বললেন — দ্যাখ , বুদ্ধি কারও কম নয় । মুখে ক'রে খড় নিয়ে যাচ্ছে । সেই খড় দিয়ে গাছের ডালে বাসা বাধবে । সেখানে কাচ্চাবাচ্চা , আত্মীয় - স্বজন নিয়ে নিরাপদে থাকবে । পরম পিতার রাজ্যে যে - দিকে চাওয়া যায় সেই দিকেই বিস্ময়ে ভরা । ••••••••• ( আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে ) —ঐ যে কচি দূর্বাঘাসটি অঙ্কুরিত হয়ে উঠছে , জীবনের এই যে নবীন উদ্ভেদ , এর মধ্যেও লুকিয়ে আছে প্রকৃতির অনন্ত রহস্য , বিজ্ঞানের অগণিত তত্ত্ব । •••••••••••• এর সামান্য একটা ব্যাপারকেও যদি সামগ্রিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে চাও — যাবতীয় যা - কিছুর সঙ্গে সম্পর্কান্বিত ক'রে , তবে সেই আদিকারণকে জানতে হবে , অনাদিরাদি - গােবিন্দে যেয়ে পৌঁছাতে হবে । তাকে না পেলে তাই কিছুই পাওয়া হলাে না , তাকে না জানলে কিছুই জানা হ’লাে না । বলতে - বলতে শেষের দিকে তার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ মর্মভেদী হয়ে উঠলো , চোখে - মুখে ফুটে উঠলো একটা দীপ্ত আরক্তিম আভা , কপালখানা চকচক করতে লাগলো । লােচনলােভন সেই অনুপম মূৰ্ত্তির দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে রইলেন সবাই। 

      একটু পরে বাবরালী ঘরামী যাচ্ছিল শ্রীশ্রীমায়ের কুটিরের পাশ দিয়ে । শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন — কি রে বাবরালী ! ঘরের কতদূর ? 

      বাবলী — হচ্ছে । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর — দরজা , জানালা পাইছিস্ তাে ?

      বাবরালী — না ।

      শ্রীশ্রীঠাকুর — সে কি কথা ! আমি যে সেদিন হরেনকে কয়ে দিলাম পাবনা থেকে আনবার কথা । ডাক্ তো হরেনকে ( ভদ্র ) । 

      হরেনদা আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — বাবরালী কয় , ঘরের দরজা - জানালা ব’লে এখনও আ’নে দিসনি । আমি সেদিন অতাে ক’রে ক'লাম । আমি ভাবছি , হরেনকে যখন কইছি তখন সব ঠিক আছে । তােকে কাজের ভার দিয়েও আমি যদি নিশ্চিন্ত না হতে পারি , তা’হলে বল তাে আমি দাড়াই কোথায় ? তুই তাে আগে এমন ছিলি না , বলতে যতটুকু দেরী , বলার সঙ্গে - সঙ্গে ক’রে ফেলতিস্ । 

      হরেনদা — আমি ভবানীদার কাছে টাকা চাইলাম , সে টাকা দিল না , আমি তাই রাগ ক'রে আনিনি । সে বলে , তুমি টাকা যােগাড় ক’রে আন গিয়ে , আমি অতো টাকা যোগাড় করব কোথা থেকে ? 

     শ্রীশ্রীঠাকুর — ভবানী যদি না দিতে পেরে থাকে , আর তুইও যদি যােগাড় করতে না পেরে থাকি তাহলে আমাকে তাে বলা লাগতো । তখন যা' হয় একটা ব্যবস্থা করতাম । 

      হরেনদা ভবানীদা না করায় আমার রাগ হইয়া গেল , ভাবলাম — ‘ থাকগা , ঠাকুরের কাছে যদি যাইতে হয় , তবে আসামী হইয়াই যাইব । 

      হরেনদার কথা শুনে শ্রীশ্রীঠাকুর - সহ সবাই হেসে ফেললেন । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন — আসামী তাে তুই হাে’সনি। আসামী যে আমাকে বানাইছিস্ । ওদের যদি সময় মত জোগান দিতে না পারি , তাহলে যে কাজে দেরী প'ড়ে যাবে , পয়সা বেশী লাগবে ।

     হরেনদা লজ্জিত হ’য়ে বললেন — সে কথা ভাবিনি । যাহাে'ক , টাকা হ'লে তো আজই এনে দেওয়া যায় । গোলায় তো নানান মাপের দরজা - জানালা তৈরীই থাকে ।

      শ্রীশ্রীঠাকুর — কত টাকা ?

      হরেনদা –৫০ টাকা আন্দাজ লাগবে । কিছু কম - বেশী হইতে পারে । শ্রীশ্রীঠাকুর উপস্থিত ৫ জনকে বললেন ১০ টাকা করে সংগ্রহ করে দিতে । হরেনদাকে বললেন একটু পরে ভবানীদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতে । 

      এক - এক জন টাকা যোগাড় করে আনার পর শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন প্রফুল্লর হাতে দে । সব টাকা যোগাড় হবার পর বললেন- “ ভবানীর কাছে দিয়ে বলিস্ , দরজা , জানালার জন্য হরেনকে  দেয় যেন । 

      পরে জানা গেল , গ্রামস্থ এক জনের ঘর তৈরী করে দিচ্ছেন শ্রীশ্রীঠাকুর এবং সেই ঘরের জন্যই ঐ দরজা - জানালা ।

      টাকা যােগাড় হবার পর শ্রীশ্রীঠাকুর ওখান থেকে উঠে ফিলানথ্রপি অফিসের দিকে গেলেন , ওখানে যাবার পর শশধরদা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বসবার আসন ও তাকিয়ে দিতে গেলেন , শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — না , এখন বসব না । কিশােরীদার ঘরের পাশে গিয়ে স্নেহ - মধুর কন্ঠে ডাক দিলেন — ডাক্তার !  কিশােরীদা ‘ অজ্ঞে ' বলে ডাক শুনে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে ছুটে বাইরে আসলেন । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর — কাজকাম করতিছিলে নাকি ? 

     কিশােরীদা — না ! এমন কিছু না । একটু ওষুধ - টষুধ দিচ্ছিলাম । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর — তাহ'লে যাও , কাজ সেরে আস গিয়ে । 

     কিশােরীদা — ওদের ওষুধ পরে দিলেও ক্ষতি হবে না । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর — না , যাও । তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সেরে এস । আমি এখানে আছি । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর বাবলা গাছটির ওদিকে রােদ - পিঠ ক’রে একটা হাতলওয়ালা বেঞ্চে বসলেন । বসার পরক্ষণেই হাতে - হাতে গাড়ু , গামছা , তামাক , টিকে , গড়গড়া , পিকদানি , সুপারির কৌটা , দাতখােটা ও জলের ঘটিও এসে উপস্থিত হলো । একটু বাদে কিশােরীদা ওষুধ দেবার কাজ মিটিয়ে ওখানে এসে উপস্থিত হলেন । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — তােরা একটু সর তো , আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা কই । সবাই স’রে গেলেন । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর চোখ - মুখ ঘুরিয়ে ঠারে-ঠোরে কিশােরীদাকে কী যেন বলছেন । উভয়ের মুখেই খুব হাসি । শেষটা দূর থেকে শােনা গেল শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন— পারবা তো ?

     কিশােরীদা সহজভাবে বললেন — আপনার দয়ায় এ এমন একটা কঠিন কাজ কী ? 

     শ্রীশ্রীঠাকুর উল্লসিত হ’য়ে — তােমার শালার বরাবর ঝুন ঠিক আছে । ঝড় - ঝাপটা গেল , তুমি বড় একটা হেলদোলনি । সমানে চালায়ে যাচ্ছ বরাবর । তােমার পুণ্যি আছে খুব । 

     কিশােরীদা — পুণ্যি যা আমার আছে , সে আপনিও জানেন , আমিও জানি । নেহাৎ দয়া করে চরণে ঠাই দিছিলেন , তা না হলি কোথায় ভাটায়ে যাতাম , তার কি ঠিক আছে ?

     শ্রীশ্রীঠাকুর ( ও - কথা যেন শোনেননি এমনতর রকমে ) —তুমি এইবার বারায়ে পড় , কাজ হাসিল ক’রে আসা চাই । 

     কিশোরীদা প্রণাম করে বিদায় নিলেন ।

     ফরিদপুর থেকে একটি দাদা এসেছেন তাঁর স্ত্রী ও ছােট ছেলে সহ । আজ তার মুখে ভাত । 

     দাদাটি খােকার একটা নাম রেখে দেবার জন্য 

     শ্রীশ্রীঠাকুরকে অনুরোধ জানালেন ।

     শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর নাম ও তাঁর বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন । দাদাটি বললেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সাধারণতঃ পিতা ও পিতামহের নামের সঙ্গে সঙ্গতি ও সম্পর্ক রেখে নামকরণ করেন । 

    শ্রীশ্রীঠাকুর — এখন কিছু মনে পড়ছে না , পরে আবার স্মরণ করিয়ে দসি্ । মা’টি বললেন - আমার বড় ছেলেটা বড় দুষ্ট , মোটে পড়তে চায় না , একদম কথা শােনে না । আট বছর বয়স হলো , এখনও প্রথম ভাগ শেষ করতে পারলো না । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর — পড়ার জন্য তাড়না করিস না । আর , পদে - পদে নিষেধ ক'রে কথা না - শোনাটা কায়েম করে তুলিস্ না । যে - ভাবে চলুক চলতে দে , শুধু এইটুকু লক্ষ্য রাখবি , কোন বদ অভ্যাস যেন আয়ত্ত না করে বা নিজেকে বিপন্ন করে না তােলে । ছেলে - পেলে একটু ডানপিটে হয় , সে ভাল । তবে ঐ ডানপিটেমিকে যত তুমি তােমার শিক্ষাদানের হাতিয়ার ক’রে নিতে পারবে , ততই সে আমােদ পাবে , এবং শিক্ষাটাও তার কাছে আনন্দদায়ক হবে । সে সবসময় মার্বেল খেলতে ভালবাসে , অনেকগুলি মার্বেল তাকে কিনে দিলে , মার্বেলগুলি দিয়ে তাকে গােণা শেখালে , হাতে - কলমে যােগ - বিয়ােগ শিখিয়ে দিলে । প্রথমে হয়তো মুখে - মুখে বলল , সেটা তাকে দিয়ে লেখায় অনালে । এইভাবে ঝোঁকগুলিকে হাতিয়ার ক’রে নিতে হয় । ওগুলি যদি ভাঙ্গ তবে পরে দেখবে ছেলে লেখাপড়া শিখেও অথৰ্ব্ব হ'য়ে থাকবে । আমাদের মায়েরা , অভিভাবকরা জানে না কেমন করে ছেলে - পেলে মানুষ করতে হয় । তাই , শিব গড়তে গিয়ে তারা বানরই গড়ে বেশীর ভাগ । বহুর ভাগ বাবা - মা ছেলে পেলেকে যেমনভাবে শিক্ষা দেয় , যেমনভাবে শাসন করে , তারা তা আদৌ যদি  না করতো , তাহলে ছেলে - পেলেদের পক্ষে ঢের ভাল হতো । নিষেধ করতে হ'লে জানা চাই , কখন , কোন অবস্থায় , কেমন করে নিষেধ করতে হবে । আবার , যদি আদেশ বা অনুরােধ করতে হয় , তারও রীতি আছে । সেগুলির দিকে লক্ষ্য না রেখে হরদম বলেই যাচ্ছি , তার মানে ছেলেকে অবাধ্য হ'তে বাধ্য করছি । অর্থাৎ , আমিই তাকে অবাধ্য করে তুলছি । শুধু তাই নয় , মা - ই আবার হয়তো যেখানে - সেখানে যার - তার কাছে বলে বেড়ায় খোকা আমার কথা শোনে না । সে - কথা আবার তার কানে যায় । প্রত্যেকেরই একটা অহং আছে তো ? ছােট ছেলে হলে কি হয় ? তারও একটা আত্মমর্যাদা বােধ আছে । ঐভাবে যদি তাকে উৎক্ষিপ্ত কর , অবমাননা কর , তখন দেখতে পাবে , ক্রমে - ক্রমে সে বেপরােয়া হয়ে উঠছে , তােমার বাগের বাইরে চলে যাচ্ছে , তখন আর তাকে সামাল দিতে পারবে না । মা - বাপের উপর ভালবাসা যদি থাকে , তাহলে লেখা পড়া তো এক তুড়ির ( হাতে তুড়ি দিয়ে দেখালেন ) কাজ । তাই সব সময় লক্ষ্য রেখো , তোমাদের চক্ষুষ্মান সুসঙ্গত চলন ও আচরণ যেন তার শ্রদ্ধা - ভালবাসাকে স্ফীত করে তোলে । তখন ছেলেকে অতো তাড়া দেওয়া লাগবে না । ছেলে তোমাদের খুশি করবার গরজে নিজে থেকেই পড়বে ।

     এর মধ্যে রমজানকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — কোনে গেছিলু রে ও রমজান ?

     রমজান মাঠে । 

     একটু পরে নগেনদা ( বসু ; ) এসে জিজাসা করলেন — ঠাকুর ! বিরূপাক্ষ কথাটার মানে ভাল করে বুঝতে পারি না ।

    শ্রীশ্রীঠাকুর — বিরূপ মানে বিরুদ্ধ , প্রতিকূল । একটা কথা আছে ‘ পরপর বিরুদ্ধধৰ্ম্মাশ্রয়ত্বং হি ভগবত্বম্ । তেমনি যাবতীয় বিরুদ্ধ গুণ যার মধ্যে fulfillingly adjusted ( পরিপূরণীভাবে বিন্যস্ত ) , বাঁচা - মরা , পাপ - পুণ্য , ন্যায় - অন্যায় , ভাল - মন্দ সব - কিছু যিনি মঙ্গলে নিয়ন্ত্রিত করেন তিনিই বিরূপাক্ষ । 

     নগেনদা —— যিনি মঙ্গলময় শিব , তিনি আবার বিরূপ অক্ষিযুক্ত হতে যাবেন কেন? 

    শ্রীশ্রীঠাকুর — বিরূপ , বুদ্রভাব দেখিয়েও তিনি মঙ্গল করেন , তাই তিনি শিব । ছাওয়াল যখন অন্যায় করে তখন মাঝে - মাঝে আপনিও বিরুপাক্ষ হন না ? 

    এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর চিঠিপত্র দেখে তেল মেখে স্নান করতে গেলেন । স্নান করে শ্রীশ্রীঠাকুর বাড়ীর মধ্যে শ্রীশ্রীবড়মার ঘরে খেতে গেলেন । খেয়ে - দেয়ে বিশ্রাম নিতে আসলেন মাতৃমন্দিরে । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর আহারাদি সমাপনান্তে মাতৃমন্দিরের উত্তরদিকের দরদালানে তক্তপোষের উপর পাতা বিছানায় বসে প্রসন্নবয়ানে সুপুরি চিবোচ্ছেন । দালানের উত্তরদিকে পাশাপাশি কয়েকখানি দরজা । দরজাগুলি খুলে দেওয়া হয়েছে । বাইরে বকুলতলায় অনেকে দাড়িয়ে - দাড়িয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখছেন । অনেকে দরদালানের ভিতরে এসে বসেছেন । ঘরের ভিতর জায়গা অপেক্ষাকৃত কম , পূবদিক দিয়ে মাতৃমন্দিরের দোতলায় সিড়ি উঠে গেছে । শ্রীশ্রীঠাকুরের তক্তপোষ ফেলে জায়গাটা জুড়ে গেছে অনেকখানি । তারই পাশে মায়েদের মধ্যে অনেকে ঠাসাঠাসি করে বসেছেন । শ্রীশ্রীঠাকুর ডান হাতের দুটি আঙ্গুলের মধ্যে আলগােছে গড়গড়ার নলটি মুখে ধরে তামাক টানছেন । চোখে - মুখে খুব একটা আমেজের বােধ । স্নেহল দৃষ্টিতে মায়েদের দিকে চাইতে - চাইতে বলছেন— যদি হয় সুজন , তেঁতুলপাতায় তিনজন । তাের এতজন এইটুকু জায়গার মধ্যে বসেছি , কিন্তু কারও কোন অসুবিধা - বােধ নেই । তােদের বসার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে , তােরা ব্যক্তিগতভাবে কেউ তাে কোন অসুবিধা বোধ করছিসই না , প্রত্যেকেই ভাবছিস্ — অন্যের অসুবিধা না হয় , এই ভেবে নিজে যথাসম্ভব কম জায়গার মধ্যে বসে অন্যের সুবিধে করে দিতে চেষ্টা করছিস । এই জিনিসটা কত মিষ্টি । ঘর - সংসারে , সমাজে এই ভাবটা ফুটে উঠলে মানুষের জীবন ঢের বেশী আনন্দের হয়ে ওঠে । খেয়ােখেয়ি ক’রে সুখ নেই । সুখ আছে অন্যকে যথাসম্ভব সুখ সুবিধা দেওয়ায় । এতে আত্ম - সংযম আসে , নিজের প্রয়ােজন - বাহুল্য কমে যায় । তােমরা যদি এইভাবে চল , তােমাদের ছেলেপেলেরাও এইভাবে গজিয়ে উঠবে । 

      শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা শুনে মায়েরা খুব খুশি হয়ে উঠলেন । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর একটুক্ষণ চুপ করে বাইরে বাবলা গাছটার দিকে উদাসভাবে চেয়ে রইলেন ।

     পরে রহস্য করে একটি মা’কে বললেন — তাের কাপড়ের রংটা তাে করিছিস বেশ । 

     মা - টি লজ্জিত হয়ে বললেন — কাপড়টা ময়লা হয়ে গেছে , কাচা হয়নি অনেকদিন ।

     শ্রীশ্রীঠাকুর এইবার গম্ভীরভাবে বললেন — আমার এইরকম নোংরা লক্ষ্মীশ্রী হীন ভাব ভাল লাগে না । তােরা সব সময় পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন থাকবি , সদাচারে চলবি , তবেই না সংসারে লক্ষ্মীশ্রী আসবে । তােদের অনেককে দেখি চুলটা ভাল করে আঁচড়াস্ না , সিথিতে সিন্দূরটা রীতিমত দিস না , কপালে সিন্দুরের টিপটা ভাল করে পরিস্ না , অগোছাল চলনায় চলিস্ । তোদের দেখে ছেলেমেয়েদের অভ্যাস অমনি হয় । এটা ভাল না । সব কাজের মধ্যে চাই সৌন্দর্য্য ও শৃঙ্খলাবোধ । প্রাণের অনুরাগ ঢেলে দিয়ে সব কাজ করবি , চলবি , বলবি — নিজেদের বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখে । তাতে দেখবি নেই - নেই , হাহা - টাটা - ভাব , রােগবালাই ক’মে যাবে , গায় বল পাবি , কাজে অনিন্দ পাবি । সংসারে যাই করিস্ , তা আরাে ভাল করে , আরো নিপুণ ও ক্ষিপ্রভাবে কেমন করে করতে পারি , সেই নিয়ে মাথা খাটাবি , আর কাজেও করবি তেমনি । সুসঙ্গতভাবে মাথা খাটানটা , চিন্তা করাটাই ধ্যান । একজনের চলা - বলা কাজ কর্শের রকম দেখেই বোঝা যায় , সে নামধ্যান করে কিনা । নিয়মিত নামধ্যান যে করে , তার সবকিছুই দিনের পর দিন সুষ্ঠ ও সুন্দর হবেই - কি - হবে । তুমি হয়তাে রান্না কর , তােমার ভাব লাগে , তোমার সঙ্গতির মধ্যে রান্নাটা কিভাবে আরো ভাল করে করতে পার । এই ভাল করে রান্না করার মধ্যে অনেকগুলি দিক ভাববার আছে । প্রথম কথা হচ্ছে — যাদের জন্য রান্না কর , তাদের বিভিন্ন জনের রুচিটা কী , তারপর শরীরের জন্য কার প্রয়ােজনটা কী , কোন্ ঋতুতে কোন্ জিনিস বিশেষভাবে গ্রহণীয় , একই জিনিস দিয়ে রকমারি কতরকম করতে পার , ইত্যাদি । এর জন্য তােমাকে অনেক বিষয় জানতে হবে , খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে কোন্ জিনিসটার কী গুণাগুণ , শরীরের কোন অবস্থায় কোন জিনিসটা বিশেষভাবে উপযােগী , কোন্ আবহাওয়ায় শরীরের উপর কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং তার প্রতিবিধানই বা হয় কি করে , সংসারে কার রুচি ও পছন্দ কেমন— এই সব সম্বন্ধে তােমাকে অনুসন্ধিৎসা নিয়ে ওয়াকিবহাল হতে হবে । 

    সুরমামা—বাড়ীর কর্তার একরকম পছন্দ তাে ছেলেমেয়েদের এক - এক জনের এক - এক রকম পছন্দ , আবার সবার শরীরের জন্য প্রয়ােজনও একরকম নয় , এতসব ভাবতে গেলে তো খেই পাওয়া যায় না । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর — এর মধ্যে কিছু - কিছু পাবে , যাতে সবারই মিল আছে । তাছাড়া , বিশিষ্ট রুচি ও প্রয়ােজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে , টুকটাক এটা - ওটা একটু ক'রে দিলে । কঠিন কিছু না , মাথা খাটিয়ে করলেই হয় । হয়তো স্বাস্থ্যপ্রদ রুচিকর নানারকম আচার , মােরব্বা ইত্যাদি করে রাখলে ঘরে , আমসত্ত্ব , কঁঠালসত্ত্ব  ইত্যাদি করে রাখলে , কফি যখন সস্তা তখন কফি শুকিয়ে রাখলে , রকমারি হজমি মশল্লা দিয়ে বড়ি ক'রে রেখে দিলে , কত রকম করা যায় , আমার চেয়ে তোমরাই তো ভাল জান । এতে খরচ এমন - কিছু নয় । আর , তোমাদের চাই সংরক্ষণ বুদ্ধি , প্রস্তুতি - বুদ্ধি । সংসারে যা ’ -যা’ লাগে , আগে থাকতে যােগাড় করে রাখতে হয় । হয়তাে সারা বছর তেঁতুল প্রয়োজন , তেঁতুলের সময় তেতুলটা কিনে রাখলে না । যখনই দরকার হয় , তখনই তেঁতুলের জন্য দোকানে দৌড়াও । এতে খরচও বেশী পড়ে আবার পরিষ্কার ভাল জিনিসটাও পাও না । মনে কর , ডাল - কলাইটা যদি সময়মত নিজেরা কিনে রেখে , ঝেড়ে শুকিয়ে নিজেরা যাতায় ভেঙ্গে নেও , তাহ'লে কতখানি সাশ্রয় হয় । ঢেকি থাকলে ধান কিনে নিজেদের ধান নিজেরা ভেনে নেওয়া যায় । তুষ আর গোবর দিয়ে ঘুটে দিতে পার । ক্ষুদ - কুঁড়াে গরু থাকলে তাকে খাওয়াতে পার । আর , গরু - পােষা খুব ভাল । গাে - পালন আমাদের আৰ্যঘরের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল । বাড়ীতে শাক সবজি , তরি - তরকারির বাগান নিজেরা করা ভাল । ওতে স্বাস্থ্য ভাল থাকে , একটা শিক্ষাও হয় । সঙ্গে - সঙ্গে দু'চারটে ফুলগাছ হয়তো লাগালে । টোটকা চিকিৎসার জন্য যে - সব গাছ - গাছড়া লাগে , তাও হয়তো লাগিয়ে রাখলে । দু'চারটে ফলের গাছ পুতলে । নিম , তুলসী , ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি যে - সব গাছের হাওয়া ভাল , সে - সব গাছ বাড়ীর মধ্যে পুঁতে দিলে । এককথায়  নিজেদের এবং আশেপাশের প্রয়ােজন নিজেরা কতখানি মেটাতে পার , সেইদিকে লক্ষ্য রেখে সাধ্য ও সঙ্গতিমতন যা - যা করা সম্ভব , যদি করতে সুরু করে দাও , তাহলে দেখতে পাবে , নিজেদের অজান্তে ঘরে - ঘরে কৃষি , শিল্প গজিয়ে উঠছে , প্রাচুর্যে ঘর ভরে উঠছে । তখন আরো  কতজনকে খাওয়াতে পারবে তোমরা । “ তোমরা প্রত্যেকে বহুপালক হও , বহুপোষক হও , তাই আমি দেখতে চাই । নইলে সংসারী হওয়াই মিছে । তাই আমার ইচ্ছা করে , তােরা সব ধানের জমি কর্ । মানুষের ঘরে খােরাকী ধান ও ডাল - কলাইটা থাকলে , তার মাজায় অনেকখানি জোর থাকে । ••••••••••• দেখছিস্ তাে যুদ্ধবিগ্রহের অবস্থা , কোন্ সময় কী হয় বলা যায় না । এমন দিন আসতে পারে , যে - দিন একমুঠো দানার জন্য বহুলােক হয়তো পথে - পথে পাগলের মত ঘুরে বেড়াবে । না খেতে পেয়ে কত লোক হয়তো মরে যাবে । 

     কালীষষ্ঠীমা — আমার সন্তুষ ব্যবসা - বাণিজ্য পছন্দ করে , কিন্তু ধানের জমি করা তেমন পছন্দ করে না । 

    শ্রীশ্রীঠাকুর — ব্যবসা - বাণিজ্য করা তাে খুব ভাল , সেই সঙ্গে ধানের জমি করাও ভাল । পয়সা তাে চাবায়ে খাওয়া যায় না । দুটো পেটে দিতি গেলি চাল ফুটিয়েই দিতি হয় । দুটো - চারটে পয়সা হাতে থাকলেই যে সব সময় , সব অবস্থায় সহজে ধান - চাল পাওয়া যায় তা কিন্তু নয় । 

    এরমধ্যে হরিপদদা । একবার তামাক সেজে দিলেন ও চিরুনি দিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের চুলটা আঁচড়ে দিলেন । 

    মানদামা ( প্রফুল্লর মা ) —আমি নিজেদের দেশবাড়ীতে দেখিছি , কোন একটা লােক যদি ভিক্ষা করতি আসে , তাহলি একমুঠ দেব মনে করলি দুই মুঠ চাল হাতে উঠে আসে , কিন্তু এখানে কেনা চাল , তাই দুই মুঠ দেব মনে করলিও , এক মুঠর বেশী হাতে উঠতি চায় না । নিজেদের ক্ষেতের ধান - চাল ও কেনা চালে এতখনি তফাৎ হয় ।

    শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যে বললেন — ঠিক কইছিস । 

    সুরমা - মা’র পাশে তার মেয়ে মুনকু বসেছিল ।

    শ্রীশ্রীঠাকুর সুরমা - মাকে জিজ্ঞাসা করলেন — মুনকু রান্না করতি পারে না ?

     সুরমা - মা - হ্যাঁ, পারে । ওর হাতের রান্না খুব ভাল । ওর খুব ইচ্ছে আপনাকে একদিন তরকারি রান্না ক’রে খাওয়ায় । 

    শ্রীশ্রীঠাকুর — তা’ খাওয়ালিই পারিস্ । মেয়েকে খুব ভাল করে মানুষ কর । লেখা - পড়া , নাচ - গান যতটা শিখুক - না - শিখুক , কাজকর্ম , চাল ' চলন , আচার - ব্যবহারে দুরস্ত করে তােল । তুমি গিন্নীবান্নী মানুষ আছ , তোমারটা যদি অনুসরণ করে , ঢের শিখে যাবে । শিক্ষায় প্রধান জিনিস হলো ভক্তি , তাই ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে মা - বাপের প্রথম কাজ হলো — নিজেরা বাস্তবভাবে শ্রেয়নিষ্ঠ হ'য়ে , গুরু ও গুরুজনে ভক্তিমান হ'য়ে , ভক্তির জীবন্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরা তাদের সামনে । এর ভিতর দিয়ে মাতা - পিতার প্রতিও ভক্তি সঞ্চারিত হয় ছেলেপেলেদের মধ্যে , আর গুরুভক্তি তাে গজিয়ে ওঠেই । এই হ'লাে শিক্ষার মূল জিনিস । কারও জীবনে এইটুকু যদি গেঁথে তুলতে পার , আর সে যদি কাগজের উপর কালির আঁচড় দিতেও না জানে , তাহ'লেও দেখবে সে কেইস্যান পেখম তুলে দাঁড়ায় । লােকে অবাক বনে যাবে তাকে দেখে । অবশ্য , লেখাপড়া তার পক্ষে একটা ফাও জিনিস , তা সে অনায়াসেই পারে । আমি কথার - কথা হিসাবে বলছিলাম । ফলকথা , লেখাপড়াটা শিক্ষার একটা গৌণ জিনিস । মুখ্য জিনিস হলাে অভ্যাস , ব্যবহার , ঝোঁক , নিষ্ঠা , নেশা , প্রত্যয় , চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যানুপাতিক কর্মদক্ষতার স্ফুরণ ও সুনিয়ন্ত্রণ ।

কথা হ’চ্ছে , এমন সময় হামলা করতে - করতে শৈলমা ও নিস্তারিণীমা এসে হাজির হলেন । শৈলমা ক্ষিপ্ত হয়ে হাতমুখ নেড়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বললেন — ও কিনা বলে , ও আমার স্বামী । আস্পর্ধা দেখেন , ছােট জাতের মেয়ে , আবার স্বামী ফলাতে আসে । আমি দেব একেবারে ঢিট্ ক’রে ।

 শ্রীশ্রীঠাকুর নিলিপ্তভাবে বললেন — নিস্তারিণী কয় , ও রাজী নয় , তুই - ই বলে ওকে গিয়ে সাধাসাধি করিস্ । 

শৈলমা ( রেগে আগুন হয়ে নিস্তারিণীমার দিকে ধাবিত হয়ে আমি তোকে কবে সাধাসাধি করতে গিছি রে ? শয়তান । পাপিষ্ঠ । জানিস আমি কায়েতের মেয়ে , আমি যাব স্বামী ব'লে তাের পা - পূজো করতে ?

     নিস্তারিণীমা — তুই তো গােপনে যাস্ রােজ আমাকে তােয়াজ করতে । মানুষের সামনে তেজ দেখাস্ , না ? আমার সাক্ষীও আছে , তাদের ডাকি , তারা বলুক সত্যি কি মিথ্যে ।

      শৈলমা — ডাক্ দেখি তাের কে সাক্ষী । 

      নিস্তারিণীমা উপস্থিত মায়েদের মধ্যে দুইজনের নাম করে বললেন — দিদি ? তােমরা তাে জান । সেই দিন ও যখন ঘরে গিয়ে সাধাসাধি করছিল , তখন তােমরা তাে গিয়ে হাজির হলে , তােমরা তো স্বচক্ষে দেখেছ সব ।

 তারা দুজন একবাক্যে চীৎকার করে বলে উঠলেন — হ্যা ! আমরা তো স্বচক্ষে দেখেছি ওর পিছু - পিছু ঘুরতে । 

শৈলমা ক্রোধে , ক্ষোভে , বিস্ময়ে হাত - দুটো উচু করে একটা লাফ দিয়ে আৰ্ত্ত চীৎকারে সপ্তমে গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন — ঠাকুর ! এরাও ঐ পাজির দলে , এদের কথা বিশ্বাস করবেন না ঠাকুর ! এদের কথা বিশ্বাস করবেন না । এরা সব ঢাকাই সাক্ষী । ( কেঁদে ফেলে ) —আপনি অন্তর্যামী ! আপনি তাে সবই জানেন । আমি সভ্রান্ত কায়স্থ - ঘরের মেয়ে । পড়েছিলামও বড় ঘরে । আজ না হয় আমি কপালদোষে অনাথা । তাহ'লেও নীচু বর্ণের মেয়েকে কেন যাব আমি স্বামী বলে স্বীকার করতে ? অথচ নিস্তারিণী সবার কাছে বলে বেড়ায় , আমি নাকি ওকে স্বামী বলে স্বীকার করেছি । 

     শ্রীশ্রীঠাকুর মুচকি - মুচকি হাসতে - হাসতে বললেন — আমিও তাে তাই কই ? তা ’ তুই ক’বের যাবি কেন ? 

      শৈলমা — আমি স্বীকার করিনি যে । 

শ্রীশ্রীঠাকুর — বেশ তাে । নাই যদি স্বীকার করে থাকিস্ , তাহলে ওরা যা কয় , কোক না , তুই অতো গায় মাখতে যাস কেন ? যদি না চটি , তাহ'লে নিস্তারিণীই তো হেরে যায় । রোজ এখান থেকে বুঝে ঠিক ক’রে যাস্ , কাৰ্য্যকালে যে মাথা ঠিক রাখতে পারিস্ না । তাইতো অযথা অশান্তি বাড়াস্ । এরপর শৈলমা , নিস্তারিণীমা বিদায় নিলেন । যাবার বেলায় শৈলমা নিস্তারিণীমাকে বলছেন — মিছেমিছি ওসব কথা আর বলিস না আমাকে। বুঝিস না , আমার দুঃখু হয় ।

      নিস্তারিণীম - তুমি যা’ বল , তাই - ই তাে বলি । 

শৈলমা আবার ঝাঝিয়ে উঠলেন — ফের ঐ কথা ! খবরদার বলছি , ভাল হবে না কিন্তু । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর — ঐ দ্যাখ , এইমাত্র বুঝে গেল , শুনে গেল আমার কাছে । এখনই আবার কেমন করছে । অভ্যস্ত চলন আমাদের মধ্যে এমন পাথরের মত শক্ত হয়ে থাকে যে তা ’ আর নাড়াতে পারি না , তাই খামাকা সব দুরূহ সমস্যার সৃষ্টি করি । অথচ সে - সমস্যা হয়তো সমস্যাই নয় । •••••••••••• তবে একটা জিনিস আছে — পাগল হােক , নির্বোধ হোক , শৈলর এই বুদ্ধিটা মাথায় আছে যে নিকৃষ্টকে কখনও স্বামী বলে স্বীকার করা যায় না । ঐটুকুও মন্দের ভাল । এরপর সবাই বিদায় নিলেন। 

     শ্রীশ্রীঠাকুর ধীরে - ধীরে ঘুমিয়ে পড়লেন । প্যারীদা ঘুমের সহায়তার জন্য শরীরটা কাপিয়ে দিতে লাগলেন । 

 

*********************************

#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_প্রসঙ্গে_দ্বিতীয়_খণ্ড 

#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1