📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔶 ভিক্ষা কথার পেছনে আছে ভজন অর্থাৎ ভক্তি , অনুরাগ , সেবা , দান , প্রাপ্তি ।
🔶 go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি )
৬ ই পৌষ , রবিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২১/১২/৪১ )
pag no 117- 123
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে উঠে বাঁধের ধারে তাসুতে বিছানায় বসে আছেন । তাঁর চোখে - মুখে আনন্দের লহর এবং আপন - করা হাসির ছটা । সেই আনন্দ , সেই হাসি সকলকেই আমন্ত্রণ করে , সকলকেই আকর্ষণ করে । বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করলেন । শ্রীশ্রীঠাকর ইঙ্গিত করে বসতে বললেন । বিমলদা তাসুর ভিতর ঢুকে একপাশে বসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর বিমলদার দিকে চেয়ে মৃদু - মদু হাসছেন , কেবলই হাসছেন । আকুল করা , পাগল - করা অনির্ব্বচনীয় সে হাসি । বিমলদাও চোখ ফেরাতে পারছেন না , বিহবল হয়ে চেয়ে আছেন শ্রীশ্রীঠাকুরের পানে । মুখে তার সলজ্জ ঔজ্জ্বল্য , চোখে তার আনন্দের অশ্রু । চেহারা দেখে মনে হয় , ভিতরে যেন কি রূপান্তর চলেছে । এমনি ক'রেই বােধ হয় স্রষ্টার গুঢ় পর্শে সৃষ্টির বুকে জাগে গভীরতর জীবন । প্রভাতের এই শুভক্ষণে এখন জাগরণের পালা , জেগে উঠেছেন সবিতৃদেব , জেগে উঠেছে এই ধরণী তার সমগ্র জীব - জীবন নিয়ে , আর ধরণীধর জেগে বসে আছেন সবাইকে ‘ ‘জাগৃহি ’ মন্ত্রে উদ্বোধিত করে তুলতে । শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ পায়ের নীচে কোলবালিশটা টেনে দিয়ে অঁটসাঁট হ'য়ে ব'সে বললেন — তামুক খাওয়াও ।
হরিপদদা ( সাহা ) তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করতে লাগলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যসা্ কোথায় ?
হরিপদদা — টিকে ফুরিয়ে গেছে , টিকে আনতে যাচ্ছি । শ্রীশ্রীঠাকুর টিকে নেই , তা ’ আগে এনে রাখতি হয় । সব ব্যাপারে সজাগ থাকা লাগে । ছােটখাট কাজে , সব ব্যাপারে সজাগ প্রস্তুতি যদি না থাকে , তবে চৈতনের রাজ্যেরও দরজা খুলবে না ঠিক জেনো । ( সহাস্যে ) —যা’, দৌড় মেরে নিয়ে আয় ।
হরিপদদা তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলেন টিকে আনতে , এক মিনিটের মধ্যে টিকে নিয়ে এসে হাজির হলেন । আস্তে - আস্তে কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , ঈষদাদা ( বিশ্বাস ) প্রভৃতি অনেকে আসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ছুটে আসতে কষ্ট হ'লো ?
হরিপদদা (সহাস্যে) —না , কষ্ট কি ?
দৌড়ে যাওয়া - আসায় এত শীতের মধ্যেও আমার গরম লাগছে । — হরিপদদা আলেয়ানটা তার পশ্চিমদিকের জানলার পাশে রেখে তাড়াতাড়ি তামাক সেজে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( তামাক খেতে - খেতে ) —এই যে টিকে না থাকার দরুন আমাকে তামাক দিতে একটু দেরী হ’লাে , উঠে - প’ড়ে লেগে এই অগোছাল অভ্যাসটা যদি না তাড়াও , তাহলে অন্যান্য ব্যাপারেও কিন্তু এটা ঢুকে পড়বে । আমি যখন যা বলব , তখন তা ক'রে উঠতে পারবে না । ফলে অশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে । অভ্যাসের গোলমালে এইভাবে অনেক অসঙ্গতি আসে । সেইজন্য নিজের এতটুকু ত্রুটিকেও ক্ষমা করতে নেই । যখনই যেটা চোখে পড়ে , তখনই সেইটে ঠিক করে ফেলতে হয় । আবার , ত্রুটি হ’লো ব'লে ঘাবড়ে যেতে নেই , তখন আরো রোখে ক’রে লাগতে হয় , কেমন করে এর হাত থেকে রেহাই পাব।
হরিপদদা এবং উপস্থিত সবাই শ্রীশ্রীঠাকুরের কথাগুলি মনােযোগ দিয়ে শুনলেন ।
বিমলদা তপােবনের prospectus ( অনুষ্ঠানপত্র ) শ্রীশ্রীঠাকুরকে পড়ে শােনালেন । শ্রীশ্রীঠাকুর কোন - কোন জায়গায় ভাষা পরিবর্তন করে দিতে বললেন ।
কথায় - কথায় বিমলদা বললেন — টাকার consideration- এ ( চিন্তায় ) অনেক সময় আমরা তপােবনের Ideal ( আদর্শ ) থেকে deviate করি ( বিচ্যুত হই ) ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ও ভাল না । শালা ওতে কি কাম হয় ? তা’তে চিরকাল ছ্যাঁচড়ামি করে চলতে হবে । জাতও যাবে , পেটও ভরবে না । তার চাইতে কিছুদিন কষ্ট করে খাঁটি জিনিসটা যদি দাঁড় করাতে পারেন , তখন দেখবেন আর অভাব থাকবে না । অভাব যদি থাকেও , লাখ কষ্টও যদি করেন , আর দেশের সামনে , দুনিয়ার সামনে , মানুষগড়া - শিক্ষার নমুনাটা যদি দেখিয়ে যেতে পারেন , সে - অভাব , সে - কষ্টেরও একটা সার্থকতা আছে । হাজার - হাজার , লাখো - লাখাে , কচিকচি শিশুরা আপনাদের দৌলতে , আপনাদের প্রবর্তনায় , আনন্দে মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে , সেই সুখের দৃশ্য কল্পনা ক’রেও তাে তৃপ্তিতে পেট ভরে ওঠে । আর ১৩০ টাকার স্বাক্ষরকারী , যা আপনারা সংগ্রহ করবেন ব'লে পরিকল্পনা করেছেন , তা’ শেষ ক’রে ফেলেন । দেখেন আমি বাজের মত লেগে যাবোনে । মন্তরের মত কাম হ’য়ে যাবি । ( হাতে তুড়ি দিয়ে , চোখ মুখের বিচিত্র ভঙ্গী ক’রে উল্লাস সহকারে ) —আর কি পারে , আঁখি ঠেরে উধাও যাই চ'লে ।’
প্রতিটি কথার উচ্চারণে অনন্ত আশা , আশ্বাস ও ভরসার অনুরণন । সবাই মাতোয়ারা ।
কলকাতা থেকে আগত একটি দাদা তাঁর কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ মহাসান্তপন করছেন । তাঁকে লক্ষ্য ক'রে শ্রীশ্রীঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন — তাের কদিন হ'লো রে ?
দাদাটি ক্ষীণস্বরে উত্তর দিলেন — আজ চার দিন । শ্রীশ্রীঠাকুর ( উৎসাহভরে ) -তাহলি তাে পাড়ি দিছিস্ আর কি ? ••••• কি , খুব দুর্বল লাগে নাকি ?
উক্ত দাদা — মাঝে - মাঝে খুব তেষ্টা পায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তেষ্টা পেলেই পট করে তখনই জল খেয়ে বসসি্ না যেন । যেমন - যেমন নিয়ম আছে , কাটায় - কাঁটায় মেনে চলবি । এ কিন্তু এক রকমের treatment ( চিকিৎসা ) । এর প্রত্যেকটা বিধানের সার্থকতা আছে । Sodomy ( পুং - মৈথুন ) ইত্যাদি অবৈধ আচরণের ফলে psychical ( মানস ) ও physiological plane- এ ( শারীর - স্তরে ) যে - সব damage ( ক্ষতি ) হয় , এই প্রায়শ্চিত্তে তার অনেকখানি প্রতিকার হয় । শ্রীশ্রীঠাকুর দেবীকে বললেন — তুই ওর পর লক্ষ্য রাখিস । প্রায়শ্চিত্তের ব্যাপারে যা দরকার হয় , জোগাড় করে দিস্ । দেবী ( চক্রবর্তী ) —আচ্ছা ।
কেষ্টদা — ব্রত , প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদির যে কি অমােঘ প্রভাব , তা’ না করলে বোঝা যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তা’হলে ভেবে দেখুন , আমাদের ঋষিরা কী জিনিস দিয়ে গেছেন , কী জিনিস রেখে গেছেন । জীবন - গঠনের এমন বিজ্ঞান আর পাবেন না। আপনারা যে - সব পরিবারে যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি , সদাচার ইত্যাদি চারিয়ে দিয়েছেন , তাদের দিকে চেয়ে দেখেন , তাদের মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র ফুটে উঠেছে । ভুলভ্রান্তি , দোষত্রুটি সত্ত্বেও তারা প্রতিদিন মনুষ্যত্ব অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে । বংশ - পরম্পরায় এইভাবে যদি চলে , দেখবেন দেশ সোনার দেশ হ’য়ে উঠবে । স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্ৰায়তে মহতাে ভয়াৎ ।’ এই সঙ্গে - সঙ্গে যদি বর্ণাশ্রম , উপযুক্ত সবর্ণ ও অনুলোম অসবর্ণ বিবাহ , উপনয়ন - গ্রহণ এবং দশবিধ - সংস্কারের অন্যান্য সংস্কারগুলি যথাযথভাবে চারিয়ে দিতে পারেন , তাহলে দেখতে - দেখতে ভােল বদলে যাবে । জানবেন , এ - কথা আমার শুধু হিন্দু , মুসলমান বা ভারতীয়ের জন্য নয় , এ - কথা পৃথিবীর প্রত্যেকের জন্য । আপনাদের শাস্ত্র সত্তা - সম্বর্দ্ধনার অনুশাসনে ভরা ! সত্তা - সম্বর্দ্বন যারাই চায় , তারাই এ - থেকে জীবনীয় লওয়াজিম সংগ্রহ করতে পারে।
শ্রীশ্রীঠাকুর এরপর একবার প্রস্রাব করতে উঠলেন । প্রস্রাব করে ফেরার পথে পূজনীয়া ছােটমার কাছে খোঁজ নিলেন কাজলা কেমন আছে ?
ছােটমা বললেন — একটু ঠাণ্ডা লেগেছে । গলাটা ভার হয়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওষুধ দিচ্ছ ?
ছােটমা — না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — প্যারীকে দেখাও । গোড়া থেকে সাবধান হওয়া ভাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আশুকে বললেন — প্যারীকে ডাক তাে । প্যারীদা না আসা পর্য্যন্ত শ্রীশ্রীঠাকুর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন ।
অশু ( ভট্টাচাৰ্য্য ) প্যারীদাকে ডেকে আনলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - কাজলাকে দেখ্ তো ভালাে ক’রে । ( এই ব’লে শ্রীশ্রীঠাকুর ওখান থেকে তাসুতে এসে বসলেন । )
ক্রমেই লোক বাড়তে লাগলাে ।
মালদহের এক দাদা আজ বাড়ী ফিরে যাবেন । শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে বিদায় নিতে এসেছেন । তিনি করুণ কণ্ঠে বললেন — বাবা ! অজি বাড়ী যেতে হবে , কিন্তু অপিনাকে ছেড়ে , এ আন্দধাম ছেড়ে যেতে মন আমার সরছে না । সংসারে অনেক শােক - তাপ - দাগা পেয়েছি , অকৃত্রিম ভালবাসা আর কোথাও পাইনি , এক আপনার কাছে ছাড়া ( বলতে - বলতে ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ) ।
—লক্ষ্মী আমার ! কাঁ’দো না । পরমপিতার নাম কর । সুখে থাক । যখন ফাঁক পাও , চলে আসে । কাছেই তো — আদরের সুরে বললেন শ্রীশ্রীঠাকুর ।
ভদ্রলোক শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে চাইলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর একটু ; হাসলেন । বললেন — তােমাদের ওখানে খুব ভাল আম পাওয়া যায় , তাই না ?
উক্ত দাদা — হ্যাঁ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমের সময় কিছু ভাল আম পাঠিও । •••••• কি রে ইয়াদালি , ফজলি খাবু নাকি ? ( ইয়াদালি অদুরে দাড়িয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলছিল ) ।
ইয়াদালি শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা বুঝতে না পেরে
প্রশ্নসূচকভাবে বললাে — জে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ফজলি , ফজলি •••••••• ফজলি আম খাবু ?
ইয়াদালি একগাল হেসে সম্মতি জানালাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এখন না কিন্তু । সময় অসুক । যদি পরমপিতা জোগান । এই ভাইয়ের বাড়ীতে ভাল-ভাল ফজলি হয় , সময়মত পাঠাবে বলছে ।
ইয়াদালি — আচ্ছা ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখের এই আদেশ পেয়ে ভদ্রলােক খুশি হ’য়ে উঠলেন ।
চোখ - মুখের বিষন্নভাব বদলে গেল , আনন্দদীপ্ত মুখশ্রী নিয়ে আর একবার প্রণাম ক’রে তিনি বিদায় নিলেন । ভদ্রলোক অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কেউ যখন চলে যায় , আমারও মনটা তখন ফাঁকা - ফাঁকা লাগে । মানুষ যত আসে , যত কাছে থাকে , ততই আমার ভাল লাগে । যেখানে যত মানুষ আছে , সবাই আসে , সকলে মিলে একত্র গুলতানি করতে পারি , আনন্দ করতে পারি , তাহলে বেশ হয় ।
ঈষদাদা - ইষ্টভৃতির অঙ্গ হিসাবে ইন্ট , ইষ্টভ্রাতা ও ভূতগণের জন্য তিনটে আলাদা নৈবেদ্য রোজ বাস্তবভাবে নিবেদন করলে আমার মনে হয় ইষ্টভৃতি ঠিক হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ভ্রাতৃভােজ্য ও ভূতভােজ্যও উৎসর্গ করতে হবে ইষ্টপ্রীতিকে লক্ষ্য করে , সবটা মিলে integrated ( সংহত ) একটা জিনিস । নিজের ভরণের কথা ভাববার আগে আমরা ভাবব আমাদের ইষ্ট , গুরুজন , গুরুভ্রাতা ও ভূতগণের ভরণের কথা , ও বাস্তবভাবে যেজন্য যতটা পারি করব । এর ভিতর দিয়েই আমাদের মগজে ঢােকে যে , ইষ্টসেবা ও ইষ্টার্থে পরিবেশের সেবাই আমাদের জীবনে মুখ্য । এই চিন্তাটা যদি আমাদের মাথায় ও আচরণে ঢােকে , তাহলে কিন্তু দারিদ্র্য , অযােগ্যতা ও অলক্ষ্মী আর সেখানে ঠাঁই পায় না । ইষ্টভৃতি তাই ধর্মের অর্থাৎ জীবন - বৃদ্ধির একটা corner stone ( প্রধান ভিত্তিপ্রস্তর ) । ইষ্টভৃতি হিসাবে নিত্য ভোজ্য বা নৈবেদ্য উৎসর্গ করাই বিধি । তবে তা ' রাখা এবং ঐ জিনিসই মাসান্তে ইষ্টস্থানে পৌছে দেবার বাস্তব অসুবিধা আছে । তাই ভােজ্যের অনুকল্পে পয়সা রাখা চলে ।
ইষ্টভৃতি করার সময় নিত্য ইষ্টভৃতি , ভূতভােজ্য ও ভ্রাতৃভােজ্য যদি আলাদা - আলাদা করে আলাদা তিনটে কোটায় বা ন্যাকড়ায় বেঁধে earmark ( চিহ্নিত ) ক’রে রাখ , তাতেও কোন দোষ নেই । সারা মাসে যে - বাবদ যেমন নিবেদিত হ'লাে , সেই অনুযায়ী মাসের শেষে দেবে । তবে স্মরণ রাখতে হবে ইষ্টভরণই মুখ্য , ঐটেই গুঁড়ি , ভূতভোজ্য ও ভ্রাতৃভােজ্য ওরই শাখা । শুধু ভূতভােজ্য বা ভ্রাতৃভােজ্যের কোন দাম নেই , যদি একজন ইষ্টভৃতি না করে । ইষ্টভৃতির আনুষঙ্গিক হিসাবেই ভূতভােজ্য ও ভ্রাতৃভােজ্য । অবশ্য , ইষ্টভৃতির পূর্ণাঙ্গতার জন্য ভূতভোজ্য ও ভ্রাতৃভােজ্য অবশ্য দেয় । তিনটি আলাদা নৈবেদ্য উৎসর্গ করার প্রসঙ্গেই আমি এত কথা বলছি । আলাদা নিবেদন করা যেতে পারে বলে কেউ যেন মনে না করে যে ঐগুলি তুল্য মূল্যের । আলাদা হলেও আলাদা নয় , সবটা মিলে ইষ্টভৃতি পূর্ণ হয় , এই যা ’ কথা । এবং ভ্রাতৃভােজ্য , ও ভূতভোজ্য , ইষ্টভৃতি ও ইষ্টপ্রীতিকেই লক্ষ্য করে প্রত্যেক ৩০ দিনের দিন দক্ষিণা ও সংগঠনী - সহ ইষ্টভৃতি দেওয়াই বিধি । আগে ইষ্টভৃতি দিয়ে বা পাঠিয়ে তারপর ভ্রাতৃ ভাজ্য ও ভূতভোজ্য দানের কথা । আবার , কেউ যদি ভ্রাতৃভােজ্য ও ভূতভােজ্য রোজ না রাখে , এবং মাসের শেষে নিবেদিত ইষ্টার্ঘ পুরোপুরি ইষ্টস্থানে পাঠিয়ে আলাদা করে ঐটে দেয় , তাহ'লেও চলতে পারে । পরিবেশের সেবার ব্যাপারে আমরা যেন এই concentric ( সুকেন্দ্রিক ) ধাঁজটা অক্ষুন্ন রাখি । তাকেই বলে ইষ্টপ্রাণ সেবা । তার মাধ্যমেই মানুষকে সুকেন্দ্রিক করে তোলা যায় , ইষ্টপ্রাণ করে তােলা যায় । তাতেই মানুষ ত’রে যায় । নচেৎ মানুষের বৃত্তিতে তেল মালিস করাই সার হয় । তুমি নিজেকে উজাড় করে দিয়েও কারও সত্যিকার কিছু করতে পার না । তােমাকে সবাই exploit ( শােষণ করতে সুরু করে দেয় , নিজেদের প্রবৃত্তি - পােষণের জন্য । তাতে নিজের ও অন্যের খারাপ ছাড়া ভাল কিছু হয় না । ওতে তারাই যোগ্য হয় না , শক্তিমান হয় না , সুনিয়ন্ত্রিত হয় না।
কেষ্টদা — ইষ্টভৃতি ভাল ক’রে পালন যারা করে , তারা এই যুদ্ধে বােমা চাপা পড়বে না ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — না পড়াই সম্ভব । ভাল করে কিছুদিন এ - সব করলে একটা intuition ( অন্তদৃষ্টি ) develop করে ( বিকশিত হয় ) , তার দরুন আগে থাকতে টের পেয়ে সাবধান হতে পারে । James ( জেম্স্ ) কী বলেছে তো ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ইঙ্গিত করতেই কেষ্টদার বাড়ী থেকে প্রফুল্ল উইলিয়ম জেম্সের Selected Papers ( নির্বাচিত নিবন্ধরাজি ) বইখানি নিয়ে আসলেন ।
কেষ্টদা সেই বই থেকে পড়লেন— Keep the faculty of effort alive in you by a little gratuitous exercise everyday. That is, be systematically ascetic or heroic in little unnecessary points, do everyday or two something for no other reason than that you would rather not do it, so that when the hour of dire need draws nigh, it may find you not unnerved and untrained to stand the test. Asceticism of this sort is like the insurance which a man pays on his house and goods. The tax does him no good at the time, and possibly may never bring him a return. But if the fire does come, his having paid it will be his salvation from ruin. So with the man who has inured himself to habits of concentrated attention, energetic volition and self-denial in unnecessary things. He will stand like a tower, when everything rocks around him, and when his softer fellow-mortals are winnowed like chaff in the blast. অর্থাৎ , মানুষ । যদি স্বতঃস্বেচ্ছ আগ্রহে নিত্য তপস্যা পরায়ণ হয় , শুভার্থে উৎসর্গপরায়ণ হয় , তবে ঐ তপ্রাণতায় তার মধ্যে এমন শক্তি সঞ্চিত হয় যে , তার বলে সে হেলায় বহু বিপদ , আপদ ও দু্র্দ্দেবকে অতিক্রম ক’রে যেতে পারে । যাদের অমনতর তপসঞ্জাত শক্তি নেই , তারা অমনতর অবস্থায় প’ড়ে ধূলিসাৎ হ’য়ে যায় ।
pag no 123-132
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর ২|৩ মিনিটের মধ্যে পর - পর কয়েকজনকে কয়েকটি কথা বললেন —
— বীরেনদা ! এখন কুলেখাড়া পাওয়া যায় না ? রোজ যদি যােগাড় । করতে পারেন খুব ভাল হয় । আমাদের সবটির লিভার খারাপ । কুলেখাড়া পালি কুলেখাড়ার ঝােল খেয়ে দেখতাম কিছুদিন ।
বীরেনদা - চেষ্টা করব । বোধ হয় পাওয়া যাবে ।
—বকিম । আর দুটো ডে - লাইট আনিয়ে দিবি ?
সামনে কনফারেন্স আসছে , তখন আরো আলোর দরকার হবে । দুটো - একটা হাতে থাকা ভাল , কোন্ সময় কোন্টা নষ্ট হয়ে যায় ?
বঙ্কিমদা — আচ্ছা । সে তাে কলকাতা ছাড়া সুবিধা হবে না ।
—আরে , মন করলি কাউকে পাঠায়েই তো দেওয়া যায় । অজি যাবে , কাল নিয়ে চলে আসবে ।
বঙ্কিমদা — দেখি ।
তাড়াতাড়ি আ’নে দাও মণি ! •••••••• আর ফিলানথ্রপীর বিল্ডিংয়ের জন্য ইট কত লাগবে হিসাব করিছ নাকি ?
বঙ্কিমদা — এখনও হিসাব করিনি ।
“ কয়লা পাওয়া গেলি নিজেরাই ইট কাটা যেত । ইট কাটার কি যুগই গেছে । এখন এ তো সামান্য ব্যাপার । আর , প্রকাশকে ব’লে দিও , সিমেন্টের পারমিট যা’তে পাওয়া যায় তার জন্য চেষ্টা যেন করে ।
ভগীরথদাকে বললেন — চারিদিকে জ্বর - জ্বারি হ’চ্ছে , ভাল কুইনাইন্ কিন্তু যোগাড় রাখিস্ ।
ভগীরথদা — আজকাল যে ভাল জিনিস পাওয়াই মুশকিল ।
—তোর আবার আটকায় নাকি ? —স্নেহল কণ্ঠে বললেন শ্রীশ্রীঠাকুর ।
উমাদা এসে দাড়াঁতেই বললেন — তাের মা আজ কেমন ?
উমাদা - সর্দ্দি আগের থেকে কম !
—ওষুধ ঠিক মত দিস্ ।
মায়েদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন । এইবার নিস্তারিণীমা আসলেন । নিস্তারিণীমা এসে প্রণাম করতেই শ্রীশ্রীঠাকুর চোখ টিপে ইশারায় কি যেন বললেন ।
নিস্তারিণীমার মুখে একটা রহস্যজনক হাসির রেখা ফুটে উঠলো — ভিতরে ভিতরে কি যেন কৌতুককর মতলব অাঁটছেন । এইবার তা’তে আরাে জোর বাঁধলো ।
হরিপদদা তামাক সেজে দিয়েছেন । তামাক খেতে - খেতে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাশি আসলো । কাশতে - কশতে শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখ - মুখ লাল হ’য়ে উঠলাে । পরে ' বললেন — তামাকটা বড় কড়া হয়ে গেছে । আর - একটু জল দিয়ে ভাল ক’রে ড’লে দিস্ । নেশাখাের মানুষ , নেশার মাল ঠিক না থাকলে দুনিয়া অন্ধকার । ( ‘ দুনিয়া অন্ধকার কথা বলার সঙ্গে - সঙ্গে চোখে - মুখে এমন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলাে , যেন দুনিয়া সত্যই অন্ধকার হয়ে গেছে ) ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাব দেখে সবাই হেসে ফেললেন ।
সলীল গতিতে আলোচনার স্রোত ব’য়ে চলেছে ।
ঈষদাদা নিজের সম্বন্ধে বললেন — কেউ ভালবেসে সহজভাবে আমাকে কিছু দিলেও তা ’ নিতে সঙ্কোচ মনে হয় কেন বুঝি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) থাকলে inferiority ( হীন স্মন্যতা ) আসে , তার থেকে অমন হয় । ভাল কথা বললেও মনে হয় taunt ( বিদ্রুপ ) । বিমলদা হয়তাে আপনাকে দেখে বলল , “ কি ঈষদাদা ! আপনার শরীরটা খারাপ হ’য়ে যাচ্ছে কেন ?’ তখন হয়তাে ভাবলেন — আমার অবস্থা খারাপ , তাই পরিহাস করছে । যদি বলে — আপনার শরীরটা তো আজকাল ভাল হ’চ্ছে , আপনি ভেবে বসলেন , আমি মানুষের সঙ্গে কথা ঠিক রাখতে পারি না অভাবে , তাই মনে করেছে , আমি মানুষ ঠকিয়ে ঘি - দুধ খেয়ে মোটা হচ্ছি! হয়তাে আপনি দু’দিন আগে বিমলদার কাছে দু'টো টাকার জন্য গিয়েছিলেন । Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) -এর জন্য ভিতরে থাকে weakness ( দুর্বলতা ) , তাই মনে হয় , সবাই বােধ হয় আমাকে হীন ভাবে । নিজের কাছেই নিজে পালিয়ে - পালিয়ে চলতে হয় , এ এক নরক - যন্ত্রণা বিশেষ । Go between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) -এর চাইতে অনেক জিনিস , এমন কি চুরি - ডাকাতি পৰ্যন্ত ঢের ভাল । তাই বলে যে আমি চুরি - ডাকাতি করতে বলছি , তা কিন্তু নয় । আমার মনে হয় , চুরি - ডাকাতির অভ্যাস থেকে একটা মানুষ যত সহজে রেহাই পেতে পারে , go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) -এর অভ্যাস থেকে রেহাই পাওয়া তার থেকে দুষ্কর । Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) ছাড়তে গেলেও আগের go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) চেপে ধরে । তখন খুব শক্ত না হলে , পরা মুশকিল । ‘যাই আসুক , go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) আর করছি না ’ এমনতর কঠোর সঙ্কল্প নিয়ে দাঁড়াতে হয় , আর সে - সঙ্কল্প থেকে এক চুলও নড়তে নেই — মাথার উপর দিয়ে যদি ঝড় বয়ে যায় তাও নয় । মানুষের কাছে খ্যাপন করলে ফল ভাল হয় । কেউ যদি তােমার কাছে কিছু রাখতে চায় , তা ’ রাখতে গেলে আগে থাকতে সব বলে নিতে হয় , হয়তাে আমি খরচ করে ফেলতে পারি , সময় মত না - ও পেতে পারেন , তা’ জেনেও যদি দেন , দিতে পারেন । নির্দিষ্ট কথা দিতে নেই । ‘চেষ্টা করব ’ এই পর্যন্ত বলা চলে , কথার ধাঁজ গুলি ঠিক ক’রে নিতে হয় । ইংরেজদের এ - সব national characteristics- এ ( জাতীয় চরিত্রে ) পরিণত হয়ে গেছে । Both in word and action ( কাজে ও কথায় ) cautiously ( সাবধানে ) go - between avoid করতে হবে ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি এড়িয়ে চলতে হবে ) । যেটা যে উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে , সেটা সেই উদ্যেশ্যেই ব্যয় করা উচিত । Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) ক'রে যদি দান - ধ্যান বা সৎকাজ করা যায় , তাতেও কিন্তু অপরাধ Go - between- এর নাম দেওয়া যায় মিথ্যাচার , কারণ , এটা সত্তা সম্বৰ্ধনাকে হনন করে । Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) অসম্ভব ব্যাপার , এতে treachery ( বিশ্বাসঘাতকতা ) -র vibgyor ( সাতটি রং ) আছে । আর যা ’ হােক , বা না হােক , go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) ধর্ম রাজ্যের জিনিস নয় । Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) যার আছে — সত্তাপােষণী উপচয়ী চলনার ব্যাপারে , বিশেষ করে personal profit ( ব্যক্তিগত লাভ ) হ'তে পারে এমন কোন কাজের বেলায় — সে blundering move ( ভুল চাল ) নেবেই , হয়তাে সেই মুহূর্তে হাগা চেপে যাবে ।
বহু মানুষ এসে বলে , ঠাকুর । আমার এখন সময় খারাপ , গ্ৰহবৈগুণ্য । এক সময় ছিল যখন ছাইমুঠো ধরলে সোনামুঠো হ’য়ে যেত , যে - কাজে হাত দিতাম সহজেই সিদ্ধ হতাে , কিন্তু এখন আর কিছুই জমিয়ে তুলতে পারি না , সবই ভেস্তে যায় , সোনামুঠো ধরলে ছাই হয়ে যায় । এর মধ্যে করা ও চলার অন্যান্য ত্রুটি তাে থাকেই , কিন্তু অনেক সময় লক্ষ্য করে দেখবেন , মানুষটা হয়তো আগে অনেক go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) করেছে , এবং এখনও go - between এর অভ্যাস আছে । জমায়েৎ go - between- এর ফল যখন মানুষকে চেপে ধরে , তখন পদে - পদে সে ব্যর্থ ও ব্যাহত হতে থাকে । সে - চিত্র ভাবতে আমার গা শিউরে উঠছে ( শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখে - মুখে একটা আর্ত আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠলো ) । খুব সাবধান !
যা হােক , কেউ ভালবেসে কিছু দিলে নেবেন , বিশেষতঃ আপনি না নিলে যদি সে ক্ষুন্ন হয় । জিনিসের পরে আমাদের লােভ না থাকা ভাল , কিন্তু যে আদান - প্রদানের মাধ্যমে প্রীতি ও বান্ধবতা পুষ্ট হয় , তাকে রহিত করা ভাল নয় ।
শ্রীশদা ( রায়চৌধুরী ) এসে প্রণাম করে বসলেন , শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে স্মিতমুখে বললেন — কি শ্রীশদা , কি খবর ? Plan ( পরিকল্পনা ) করিছেন না কি ?
শ্রীশদা — হ্যা , করছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( উৎসাহভরে ) —তাড়াতাড়ি ক’রে ফেলেন , শালা লাগায়ে দেবনে কাণ্ড ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের হাসিখুশিভাব দেখে সবাই খুব স্ফুর্ত্তিযুক্ত হ’য়ে উঠলেন । Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) -সম্বন্ধে যেভাবে আলোচনা হচ্ছিল , তাতে প্রত্যেকে স্ব - স্ব অপরাধের কথা চিন্তা ক'রে খানিকটা যেন অবসন্ন ও নিস্তেজ হ’য়ে পড়ে ছিলেন , আবহাওয়া অত্যন্ত ভারী লাগছিল , হঠাৎ একটা মিষ্টি হালকা হাওয়ার আমেজ ভেসে আসলো শ্রীশ্রীঠাকুরের কথার ভঙ্গীকে আশ্রয় ক’রে ।
কেষ্টদা পূ্র্ব্ব কথার সূত্র ধ’রে প্রশ্ন করলেন— Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) এর কোন প্রায়শ্চিত্ত নেই ? Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) আর না করা ছাড়া তাে প্রায়শ্চিত্ত দেখি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দেখি না তাে ! খুঁজে দেখবেন তাে পান নাকি ।
শােনেননি এমন ভূত আছে যা ’ ওঝা মানে না , এও সেইরকম । Shortcut ( সহজ ) প্রায়শ্চিত্ত আছে ব’লে মনে হয় না । •••••• ( চিন্তিতভাবে ) এ যে কি সর্ব্বনেশে জিনিস , ইহকাল - পরকাল ঝর - ঝরে করে দিয়ে যায় , চরিত্রে একরত্তি বল থাকে না । Conviction ( প্রত্যয় ) বলে জিনিস থাকে না , সে যত ভাল কথাই হােক , মনে হয় ফাঁপা , ফাঁকা আওয়াজ , কোন বস্তু নেই তাতে , তাই মানুষের অন্তরে গভীরভাবে , স্থায়ীভাবে দাগ কাটতে পারে না ।
আবার , পরিবেশ আমাকে অনেক সময় সূক্ষ্মভাবে go - between করিয়ে " ছাড়ে । আমি হয়তাে ইচ্ছা করলাম তরুর হাতে জল খাব , ইঙ্গিতও করলাম তেমনি , তরুও দিতে প্রস্তুত , তখন হয়তাে মাঝখান থেকে আর একজন এসে জলের ঘটি ধ'রে বসলাে । তরুও কিছু বলতে পারে না , পাছে ঝগড়া বাঁধে , এই নিয়ে একটা অনর্থ ঘটে । আর আমার তাে কিছু করার উপায়ই নেই । আমি যখন যাকে দিয়ে যেটা চাই , তখন তাকে দিয়ে সেটা না পেলে আমার ভাল লাগে না । রীতিমত অসুবিধা হয় । কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না , পাছে কেউ মনে ব্যথা পায় । তবে এতে আমার কষ্ট হয় । অনেকে আবার এমনই প্রবৃত্তি - ঝোকা ও আমার পছন্দ - অপছন্দ , সুবিধা - অসুবিধা সম্বন্ধে এতই খেয়ালহারা যে , তাদের কিছু বলে দিলেও তা তাদের মাথায় থাকে না । ফলকথা , তারা অন্যের সম্বন্ধে অন্ধ , তারা জানে নিজেদের খেয়াল চরিতার্থ ক'রে সেবা করার দম্ভ নিয়ে চলতে । সে - সেবায় আমারও সুখ - সােয়াস্তি নেই , তাদেরও সার্থকতা নেই । নইলে যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সুকেন্দ্রিক হ'য়ে মানুষ সামান্য তম কাজ পর্যন্তও যদি নিখুতভাবে শ্রদ্ধাসহকারে করে , তবে তার ভিতর - দিয়ে যে বােধ , জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণশক্তি লাভ হয় , তাই - ই তাকে ভূমার মন্দিরে পৌঁছে দিতে পারে , স্বর্ব্বোপরি লাভ করে সে অনাবিল আত্মপ্রসাদ , একজনকে খুশি ক’রে খুশি হবার আনন্দ । অহঙ্কারের সেবা যারা করে , তারা সে সার্থকতার সন্ধান পাবে কেমন করে ? তাই বলে সার্থকতার লোভে যদি কেউ সেবা করে , তার সেবা কিন্তু সার্থক হয় না — ভালবেসে যে করে , সেইই সার্থক হয় ।
শীতের মধ্যে একভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকার দরুন শ্রীশ্রীঠাকুরের ডান পাটা ধরে গেছে , তাই পা বাড়িয়ে দিয়ে প্যারীদাকে বললেন — একটু টেনে দে তাে ! প্যারীদা টেনে দিলেন । টেনে দেবার সময় একটু জোর লাগাতে শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন — শালার পাগল , করে কী রে ? অতাে জোরে না ।
প্যারীদা - লাগলো নাকি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — না , তেমন কিছু না , আর একটু আস্তে দে ।
ঋণ - পরিশোধ সম্বন্ধে কথা উঠতে বললেন — পাওনাদার আসলে যাই থাক্ কিছু দিতে হয় , সে যত সামান্যই হােক , তা সে নিতে না চাইলেও জোর করে দিতে হয় । নির্দিষ্ট ওয়াদা করতে নেই , বলতে হয় অমুক দিনের মধ্যে কিছু দিতে চেষ্টা করব । চেষ্টা করব যদি বল , তাহ’লে অবশ্য দেয় — এই ভেবে সময়ের পূর্ব্বেই দেবে । আর , পাওনাদারকে তাগাদা করবার সুযোগ দিয়ে , তুমি নিজে তার বাড়ীতে গিয়ে দিয়ে আসবে । তখন টাকা দেবার কথা নেই , হঠাৎ হয়তো তােমার হাতে কিছু জুটে গেল , নিজেই গিয়ে দিয়ে আসলে , বললে , ‘ আজ এই তিনটে টাকা হাতে এসে গেছে , তাই ভাবলাম আপনাকে দিয়ে যাই । আমার যে টানের সংসার , সবই তাে জানেন , হাতে থাকলেই খরচ হয়ে যাবে । পাওনাদারকে তুমি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছ , এইটে যেন সে কিছুতেই না বুঝতে পারে। ওয়াদামত যে সময় যা ’ দেবার , সবটা যদি না দিতে পার , তাহ'লেও একটু , আগে তার কাছে গিয়ে যা ’ পার দিয়ে , তােমার অবস্থার কথা তাকে জানিয়ে তার কাছ থেকে ক্ষমা ভিক্ষা করে আসবে । ঐ অবস্থায় একটু আগে তার কাছে যাবার কথা বলছি এই জন্য যে , শেষ মুহূর্তে তুমি যদি তার কাছে হাজির হয়ে তােমার অক্ষমতার কথা জানাও , তখন সে হয়তো বিব্রত হ’য়ে পড়তে পারে , বিশেষতঃ তােমার কথার উপর দাড়িয়ে সে যদি আর কাউকে কথা দিয়ে থাকে , কিংবা বিশেষ কোন প্রয়োজনীয় কাজের পরিকল্পনা ক’রে থাকে । এইভাবে যদি চল , তবে পাওনাদারের সহানুভূতি থাকবে তােমার উপর এবং : তুমি মানুষটাকে হারাবে না । একটা মানুষকে হারান মানে কিন্তু একটা দুনিয়াকে হারান । আবার , তােমরা কখনও কাউকে যদি ঋণ দাও , ধরেই নেবে সে হয়তো ঐ টাকা পরিশােধ করতে পারবে না । যে - পরিমাণ টাকা ঋণকারী পরিশােধ না করলে তুমি আর্থিক ও মানসিক জীবনে বিধবস্ত হবে না , সেই পরিমাণ টাকা বা জিনিস তুমি ধার দিতে পার । মানসিক জীবনের কথা উল্লেখ করছি এই জন্য , তুমি টাকা বা জিনিসের ক্ষতিটা হয়তাে সামলে নিলে , কিন্তু মনের সঙ্গে লোকটাকে হয়তাে ক্ষমা করতে পারলে না । তখন লােকটার সঙ্গে ব্যবহারে সেটা ফুটে বেরুবেই ! ফলে , সে হয়তাে তোমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে । তাকে ঋণ দিয়ে একাধারে তুমি টাকা তাে থােয়ালেই , মানুষটাও হারালে । গাঁটের পয়সা খরচ করে এই অপ - ফল কুড়িয়ে লাভ কী ? ওর চাইতে ধার না দিয়ে তুমি যা পার যদি এমনি দাও , সেই সব থেকে ভাল । ধার নেবার বেলায়ও ঐ কথা । ধার না নিয়ে বরং এমনি চেয়ে নাও । আমি সেইজন্য সাধারণতঃ যা মানুষকে দিই তাও নিই না , আবার মানুষের কাছ থেকে যা ’ নিই তাও তাকে দিই না । তার প্রয়ােজনমত অনেক বেশী দেবার জন্যই প্রস্তুত থাকি । কিন্তু ঋণের ভিত্তিতে আদান - প্রদানের কথা আমি ভাবি না ।
আমাদের দেশে আরো একটা জিনিস আছে — ভাগে কারবার করা । প্রায় ক্ষেত্রেই দেখি partnership business- এ ( ভাগে কারবারে ) পরে গােলমালের সৃষ্টি হয় , কিছুদিন যেতে না যেতেই পারস্পরিক বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব চটে যায় । তখন পরস্পরের মধ্যে আসে সন্দেহ ও অবিশ্বাস । তাই আমার মনে হয় , ব্যবসায়ের ব্যাপারে জাতীয় চরিত্রের বর্তমান অবস্থায় একক ব্যবসা করাই ভাল । বড় জোর একজন আর একজনকে working partner ( কর্মী - অংশীদার ) রাখতে পারে । ২/৩ জনের মূলধন একত্র মিলিয়ে মিলিত পরিচালনায় ব্যবসা করতে গেলে প্রায় ভেস্তে যায় । উদ্দেশ্য যদি অসাধু না হয় , এবং পরিচালনা যদি ঠিক থাকে , তবে Limited concern ( দায়িত্বশীল যৌথ কারবার ) বরং এর থেকে নিরাপদ । Limited concern ( দায়িত্বশীল যৌথ কারবার ) ভাল চলছে , এ অনেক ক্ষেত্রে শােনা যায় , কিন্তু partnership business ( ভাগে কারবার ) দীর্ঘদিন ধরে ভালভাবে চলছে , এ আমাদের বাঙ্গালী - জীবনে বড় বেশী শুনি না । অবশ্য , থাকতে পারে , আমার হয়তো জানা নেই , আমি আর কতটুকুই বা খবর রাখি । তবে আমার সাক্ষাৎ সংস্রবে যত লােক এসেছে , তাদের মধ্যে যা প্রত্যক্ষ করেছি , সে অভিজ্ঞতা আমাকে partnership business ( ভাগে কারবার ) -এর ব্যাপারে উৎসাহ দিতে দেয় না । ধার , ভাগে কারবার — এগুলি সব go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) -এর বাহন ।
প্রফুল্ল — কারও যদি খুব talents ( ক্ষমতা ) থাকে , মানুষকে খুব- service ( সেবা ) দেওয়া থাকে এবং সেই সঙ্গে - সঙ্গে go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) থাকে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — কোন talent ( ক্ষমতা ) , কোন service ( সেবা ) দেওয়ায় কিছু হবে না । অমনিভাবে service ( সেবা ) দিয়ে যাকে পঙ্গু ; ক'রে তুলেছ , সেই - ই তােমাকে বলবে ‘ চোর কাহে কা ! তুই - ই তাে আমাকে টাকা দিয়ে সর্বনাশ করেছিস্ , নইলে আমি এতদিনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম ।
Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) -ওয়ালারা যে psychology ( মনােবিজ্ঞান ) ও philosophy ( দর্শন ) আওড়ায় , তাও go - between- এ ( দ্বন্দ্বীবৃত্তিতে ) ভরা , scheme ( পরিকল্পনা ) -ও করে সেই ধরণের , প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে । কেষ্টদা ! পাঞ্জা দেবার সময় খুব লক্ষ্য রাখবেন , মানুষটার go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) আছে কি না । Go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) থাকলে সে এ কাজে successful ( কৃতকাৰ্য্য ) হতে পারবে না , কামের থেকে অকাম বেশী করবে , আর যেখানে - সেখানে ভণ্ডল বাধাবে , আর আপনার হবে জ্বালা ।
ঈষদাদা — একজনের কথার উপরে বিশ্বাস করে থাকলে সে যদি go between ( দ্বন্দীবৃত্তি ) , করে , তবে সেই সঙ্গে - সঙ্গে আর একজনের between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) হয়ে যায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তােমরা যাকে বল বিশ্বাস , সেটা বিশ্বাস নয় । বিশ্বাস মানে সম্পূর্ণ প্রশ্নশূন্য হওয়া । বিহিত করণের ভিতর দিয়ে তা ’ হয় । এমন ব্যবস্থা করতে হয় , যাতে তুমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হতে পার সে - বিষয়ে , অন্য আর কোন অবকাশ না থাকে । আলস্যের দরুন তা আমরা করি না , পরে ঠকি । আলস্য আর বিশ্বাস এক কথা নয় । তাই বলছিলাম , without any condition ( নিঃসৰ্তে ) দেওয়া ভাল , তা ছাড়া পেলাম পেলাম , না - পেলাম না - পেলাম এভাবে দেওয়া চলে । এটা ঠিক জেনো , তোমাকে যদি কেউ deceive (প্রতারণা করে) , সে জন্য প্রথমতঃ ও প্রধানতঃ দায়ী তুমি নিজে , আর একজনকে সে - সুযোগ তুমি দিলে কেন ? তোমার সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও তুমি যদি দান কর বা ভিক্ষা দাও , তাতে তোমার ততখানি অপরাধ হয় না , যতখানি অপরাধ হয় নির্ব্বুদ্ধিতা - বশতঃ নিজেকে প্রবঞ্চিত হতে দেওয়ায় । আর , অপারগ অবস্থায় আবোল - তাবােল করার চাইতে , মানুষকে ফাঁকি দিয়ে নেওয়ার চাইতে ভিক্ষা করা ঢের ভাল ।
কেষ্টদা - আপনি তো বলেন , জাতটা যদি চাকরী না ক’রে ভিক্ষা করে খেত , এর চাইতে ভাল থাকতো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার তাই মনে হয় । ভিক্ষা করতে চাকরীর চাইতে ক্ষ্যামতা লাগে । মানুষের খুশির দান আহরণ করা সহজ কথা নয় । আর , শুধু কথায়ও তা’ হয় না । সুখে - দুঃখে , বিপদে - আপদে মানুষকে দেখা লাগে । তাদের জন্য সাধ্যমত করা লাগে । ভিক্ষা কথার পেছনে আছে ভজন অর্থাৎ ভক্তি , অনুরাগ , সেবা , দান , প্রাপ্তি । আপনার ইষ্টে ভক্তি থাকবে , অনুরাগ থাকবে , সেই অনুরাগ অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরই স্বার্থপ্রতিষ্ঠা ও প্রতিকামনায় সশ্রদ্ধভাবে মানুষকে আপনি আপনার সামর্থ্য , বৈশিষ্ট্য ও যােগ্যতা - অনুযায়ী সেবা করবেন , তাকে আপনার যা ’ দেবার তা ’ দেবেন — তার প্রয়োজন - পূরণে লক্ষ্য রেখে এর ফলে আপনার যে সহজ স্বতঃ - উৎসারিত প্রাপ্তি — তাকে বলে ভিক্ষা । ভিক্ষা চারটিখানি কথা নয় । এতে চাকরীর চাইতে অনেক বেশী মাথা খাটান লাগে , অনেক বেশী চৌকস হতে হয় , অনেক বেশী দক্ষ হ'তে হয় , অনেক বেশী দায়িত্ব নিতে হয় । শাস্ত্রে আছে , ব্রাহ্মণ রাজার চাকরী করবে না , তাতে বাধ্যবাধকতায় রাজার প্রতি leaning- এর ( অনতির ) দরুন অন্যায় ব্যাপারেও তার পক্ষ অবলম্বন করতে পারে — দ্রোণাচার্যের যা হয়েছিল , ওতে greater cause ( বৃহত্তর উদ্দেশ্য ) suffer করে ( ক্ষতিগ্রস্ত হয় ) ।
বেলা হয়েছে , চরে বহু গরু চরে বেড়াচ্ছে । চারিদিকে রোদ ছেয়ে গেছে , আশ্রম - প্রাঙ্গণে লােকজনের আনাগােনাও বেশ বেড়ে গেছে , শ্রীশ্রীঠাকুরের এখনও পায়খানা যাওয়া হয়নি , তবু সমানে আলাপ চলছে ।
কেষ্টদা বললেন — যে - সব ব্রাহ্মণ চাকরী করেছে , তাদের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত ।
বিমলদা তখন একটু বাইরে গিয়েছিলেন , একটু পরে এসে জোরের সঙ্গে বললেন — ব্রাহ্মণের ছেলে পরের চাকরী করে যে মহাপাতক করছে , তার তুলনা হয় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর শুনে হেসে বললেন — বিমলদা , কেষ্টদার দপ্তরের মানুষ , কথার মধ্যে যেন ঠিক কেষ্টদার ঝলক । ••• •• একটু , পরে স্মিতহাস্যে বললেন অতাে কঠোর হতে গেলে চলবে কেন ? স্থান , কাল , পাত্র ও অবস্থা বিবেচনা ক'রে রয়ে - সয়ে চলতে হবে । আপদ্ধৰ্ম ব'লেও তাে একটা জিনিস আছে । কেষ্টদা ঠাকুরের চাকরীর দরখাস্ত করার কথা উল্লেখ করলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হাসতে - হাসতে বললেন — সবাই চাকরীর দরখাস্ত করে , আমিও একবার হাউস করে শিলাইদহ ঠাকুর - ষ্টেটে একখানা দরখাস্ত করেছিলাম । আমি ভাবিওনি যে ওর উত্তর আসবে , কিন্তু কিছুদিন পরে appointment letter ( নিয়ােগ - পত্র) আসলো , ৫০ টাকা মাইনে , free quarters ( বিনা ভাড়ায় বাস ) , private practice allowed ( সরকারী কাজ ছাড়া নিজের মত ডাক্তারী করা চলবে ) । চিঠি পেয়ে বন্ করে আমার মাথাটা ঘুরে গেল , চোখে সরষের ফুল দেখতি লাগলাম । মনে হলাে , বাবা ও - চিঠি দেখলি তাে রক্ষে নেই , অমনি কচ - কচ করে ( হাত দিয়ে দেখালেন ) ছিড়ে ফেললাম , তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি ।
#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1
10