৩ রা পৌষ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৮/১২/৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে তাসুতে বসে আছেন । আজ সবার আসতে একটু দেরী হয়েছে । তবে শীতের দিন ব'লে অাশ্রম - প্রাঙ্গণে এত সকালে এখনও লােকজন তেমন দেখা যাচ্ছে না । কয়েকটা গরু , কুকুর ও ছাগল নিশ্চিন্ত মনে এদিক - ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে । পায়রাগুলি মাতৃমন্দিরের শীর্ষদেশে ‘ বক্ - বকম্ বক্ - বকম্ করছে । সােনাল গাছটার পাতাগুলি বায়ুভরে ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছে । পূর্বদিকের বাঁশবনে কিছু গ্রাম্য পাখী কিচির - মিচির করছে । চরে এক - আধজন লোক দেখা যাচ্ছে যারা শৌচাদির জন্য গেছে । কেউ - কেউ ঘরে বসে বিনতি - প্রার্থনাদি করছেন । তাদের সেই ভক্তি - বিগলিত বিনতির সুর ভেসে আসছে — শীতল প্রভাত - সমীরকে আশ্রয় করে । এদিকে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রশান্ত বয়ানে বসে আছেন পদ্মাপারের ছােট্ট টিনের তাসুতে , দেখে মনে হয় , বসে আছেন ভক্তগণের প্রতীক্ষায় ! তােরা খোঁজ করিস বলে আমি খোঁজ করি , আমি খোঁজ করি ব'লে তোরা খোঁজ করিস্।’
ক্ষিতীশদা ( সান্যাল ) ও তপােবনের শিক্ষকবৃন্দ আসলেন । তারা প্রণাম ক'রে শ্রীশ্রীঠাকুরের চৌকীর সামনে মাটিতে বসে পড়লেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সবাইকে পেয়ে খুব খুশি । হাসিখুশি হয়ে কথা বলছেন । হঠাৎ বললেন আচ্ছা ক্ষিতীশদা ! এই শীতের রাতে আউস চাল ও কলায়ের ডালের খিচুড়ী আপনার কেমন লাগে ?
ক্ষিতীশদা — বেশ লাগে । •••••• আপনার কেমন লাগে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর -- সে আর কবেন না । শালা মনে হলিই জিবে জল আসে । পালিই দোয়ারে বসান দিয়ে দিই ।
শুনে সবাই হাসতে লাগলেন ।
কালিদাসীমা - খান তাে কতটুকু তা তাে দেখেছি , পাখীর আহার বললেও চলে । মুখে বলেন বটে , কিন্তু খেতে তাে পারেন না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) -মায়েদের রকমই ঐ । এদিকে পেট চিরে খাওয়াবে আর বলবে , খেলে কই ? আমাকে খাওয়াবার বেলায় বড়বোও অমনি করে । বড়বৌ কাছে ব'সে যখন খাওয়ায় , তখন টেরই পাই না কতটা খেলাম , খাওয়ার পরে টের পাই । তাই খাবার সময় বড়বৌ কাছে না থাকলে আমার খাওয়াই হয় না। বড় বৌয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে না হলি আমি গিছিলাম আর কি ! আমার হাতে পড়ে ওকে আজীবন তাফাল কম সইতে হয়নি , কিন্তু ও বরাবর সমানে খুশি , আমার চলার পথে কোন অন্তরায় তাে সৃষ্টি করেইনি , বরং হাসিমুখে আমার সহায়করূপে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে । আর , গিন্নীও বড় পাকা গিন্নী , বড়বো যেমন সুশৃঙ্খলভাবে অল্পের মধ্যে সংসার চালায় , অমন আজকাল খুব কম দেখা যায় । কৰ্ত্তামার গালাগালই ওকে মানুষ করে দিয়ে গেছে । কৰ্ত্তামার কড়া শাসন ছিল , আবার ভালও বাসতেন খুব । বাবাও বড়বোকে খুব ভালবাসতেন । বাবার ধারণা ছিল , আমার ও মার কোন সাংসারিক বুদ্ধি নেই । বুদ্ধিমতী বলে বড়বৌয়ের উপর তার আস্থা ছিল খুব । বড়বৌয়ের সঙ্গে সাংসারিক ব্যাপার নিয়ে পরামর্শ - টরামর্শ করতেন । বড়বৌয়ের সংরক্ষণ বুদ্ধি তিনি খুব পছন্দ করতেন , আবার বলতেন , “ তােমার কাছে যদি কিছু থাকে , তা ’ কিন্তু অনুকলকে বা তোমার শাশুড়ীকে কয়ো না , একবার টের পেলে আর রক্ষে নেই ।'— এই ব'লে শ্রীশ্রীঠাকুর নিজেই হাে - হো করে হেসে উঠলেন , সঙ্গে সঙ্গে সবাই উচ্চৈঃস্বরে হাসতে লাগলেন , হাসতে - হাসতে শ্রীশ্রীঠাকুরের ডান চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো । শেষের দিকে হাসির মধ্যে যেন আনন্দ ও বেদনার একটা মিশ্রসুর ধ্বনিত হয়ে উঠলাে । মনে হলো — পিতা - মাতার কথা বলতে বলতে তার মনের এক সুগভীর কোমল পর্দ্দা যেন আন্দোলিত হ’য়ে উঠেছে ।
এরপর সরােজিনীমা তামাক সেজে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খাচ্ছেন । এমন সময় কিশােরীদা এসে প্রণাম করলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর স্নেহ - কোমল কণ্ঠে বললেন — ও ডাক্তার । বােঝো - টোঝো কেমন ? কিশােরীদা ( হাত জোড় করে ) —দয়াল ! বুঝবের চাইনে কিছু , আপনি যা কন , তাই যেন কাটায় - কাঁটায় পালন করে যেতে পারি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( আড়চোখে কিশােরীদার দিকে চেয়ে ) —শালার দুনিয়াডাই পাগল । তবে এই পাগলামােই ভাল । কি কও ডাক্তার ? ( ঘাড় ঝাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ) ।
কিশােরীদা- —আমি অতােশতাে বুঝি না । এইটুকু জানি যে , আপনি যা কন তাই ঠিক ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( খুশির হাসি হেসে ) —তােমরা সকলেই শেয়ানা হয়ে গেছ । আমি কিন্তু বেকুবই রয়ে গেলাম , আমার আর জ্ঞানটান হলো না । জানি ব'লে বুঝতে পারি না , তবে কেষ্টদারা যখন চাপে ধরে , নানারকম প্রশ্ন উথাপন করে , তখন নিজের যা মনে আসে ক'য়ে দিই । কী কই নিজেই ঠাওর পাই না । সকলে তাে খুব ভাল - ভাল করে , আমাকে খুশি করবার জন্য কয় কিনা তাও তাে বুঝি না । কেষ্টদা যখন ইংরেজীতে কিছু বলবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগলাে , প্রথমটা আমি তো কিছুতেই ঘাড় পাতি না , পরে যখন দেখলাম কেষ্টদা নাছোড়বান্দা , তখন ভাবলাম — আবোলতাবোল যা মনে আসে , দুই - একদিন কই , তখন কেষ্টদা নিজেই বুঝবে যে আমাকে দিয়ে ওকাজ হবে না , তখন আর ওভাবে অনুরােধ করবে না । পরে যখন কইতে সুরু করলাম , তখন দেখি আর ওরা ছাড়ে না । পরমপিতা যা জোয়াতেন , আমি সেইগুলি শুধু ফেলে - ফেলে যেতাম । কী বলেছি , পরে জিজ্ঞাসা করলে আর বলতে পারতাম না । এখনও কেউ ওগুলির মনে করতে দিলে , মানে করতে পারি না । তারপর , ছড়া যে আমি কোনদিন বলতে পারব , তাও কোনদিন ভাবিনি । কেষ্টদার আগ্রহাতিশয্যে বলতে সুরু করলাম । বলেছি , কেমন ক'রে যে কী বলি , কী করি , কিছুই টের পাই না । শুধু এইটুকু বুঝি — পরমপিতার মর্জি হ'লে সব হয় ।
তপােবনের নিয়মকানুন , আইন - শৃঙ্খলা কেমন হবে , সেই সম্বন্ধে ক্ষিতীশদা প্রশ্ন করলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আইন - কানুন যা করবেন , তা করবেন to fulfil the wishes of the Guru and not to fulfil the advent of com plexes ( গরুর ইচ্ছাকে পূরণ করতে ; কিন্তু প্রবৃত্তির আবির্ভাবকে পূরণ করতে নয়কো ) । আইন - কানুন প্রয়োজনবশে normally evolve করে ( সহজভাবে বিবর্ত্তিত হয়ে ওঠে ) —সেই - ই ভাল । জোর করে কতকগলি , উপর থেকে চাপাতে গেলে , মানুষ পীড়িত বোধ করে , তাতে প্রাণের উল্লাস ক'মে যায় । আর , এটা ঠিক জানবেন , আপনারা যদি true disciple ( খাটি শিষ্য ) হন , discipline ( নিয়মানুবত্তিতা ) আপনাদের মধ্যে spontaneously( স্বতঃই ) গজিয়ে উঠবে , আর সেটা হবে normal discipline ( সহজ নিয়মানুবত্তিতা ) , formal discipline ( বাহ্যিক নিয়মানুবত্তিত ) -এর উপর বেশী ঝোক দিলে অনেক সময় normal discipline ( সহজ নিয়মানু বত্তিত ) -কে হারাতে হয় । Formal disciplinc ( বাহ্যিক নিয়মানুবত্তিতা ) যদি enforce ( কার্যকরী ) করতে হয় , তবে তা এমনভাবেই করতে হবে , যাতে তা ’ normal discipline ( সহজ নিয়মানুবর্ত্তিতা ) -কে উস্কে তুলতে সাহায্য করে । প্রধানরা যত disciplined ( নিয়মানুবর্ত্তী ) হয় , অন্য সকলেও সেটা তেমনি imbibe ( নিজেদের মধ্যে গ্রহণ ) করে । আপনি যতখানি । ordination- এর ( ক্রম বা ধারার মধ্যে আসবেন , আপনার সহকারী যারা ততখানি আপনার sub - ordination- এর ( অধীনতার ) মধ্যে আসবে , এর ভিতর - দিয়েই আসবে coordination ( সঙ্গতি ) । নিয়মকানুন যা'ই করুন , চোখটা নেবেন আমার । আমি সব সময় ভাবি , কাউকে যদি উপযুক্ত করে তুলতে না পারি , সুশৃঙ্খল করে তুলতে না পারি , তার মধ্যে আমার ক্রটি কতখানি ও কোথায় । তার জন্য আমার যতখানি করার তা আমি করতে পেরেছি কিনা , করেছি কিনা । এই যখন ভাবি , তখন সে কী করেনি , তার জন্য মন খারাপ হয় না , মন খারাপ হয় এই ভেবে যে হয়তাে আমার করায় কোথাও কোন খাঁকতি অাছে । অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় , আমার সাধ্যে যা কুলার , তার ক্রটি করিনি , তবু মনে আপসােস হয় , আরাে বেশী কেন করতে পারিনি । আর , আমি যে এমন করি , এ আমার নিজের interest- এই ( স্বার্থেই ) করি । তার কারণ , আমি জানি , আপনাদের প্রত্যেককে নিয়েই আমি , এমন - কি কুকুরটা - বিড়ালটাকেও পৰ্য্যন্ত এ - থেকে বাদ দিতে পারি না । মনে হয় কেউ যদি down ( অবনত ) হয়ে থাকে , আমিই down ( অবনত ) হ'য়ে রইলাম । এই interest ( স্বার্থ বোধ ) ও sympathy ( সহানুভূতি নিয়ে করেন , চলেন ; দেখেন পরমপিতা আপনাকে কোথায় নিয়ে দাড় করেন ।
এক - এক করে পর - পর অনেকেই আসতে লাগলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তাদের নানাজনের কাছে নানা বিষয়ের খোঁজ - খবর নিতে লাগলেন ।
বহিরাগত একটি মা শ্রীশ্রীঠাকুরকে পাঁচটি টাকা দিরে প্রণাম করে বললেন— বাবা , মাঝে আমি খুব অসুখে পড়েছিলাম , ডাক্তার - কবিরাজ প্রায় ফেল পড়ার মত অবস্থা , আমি তখন বিছানায় শুয়ে - শুয়ে কেবল কাঁদতাম আর আপনাকে ডাকতাম । একদিন রাত্রে স্বপ্ন দেখি যে আপনি আমার কাছে পাঁচটি টাকা চাচ্ছেন । তার পরদিনই সকালে উঠে কাপড় - চোপড় ছেড়ে আপনার নাম করে পাঁচটি টাকা উঠিয়ে রেখে দিই , মনে - মনে সঙ্কল্প করি — আমি সুস্থ হয়ে আপনার কাছে এসেই এই টাকা দিয়ে আপনাকে প্রণাম করব । সেইদিন থেকে সর্বদাই আমি ভাবতাম , কবে আপনার কাছে এসে টাকাটা দিতে পারব । চিঠিতেও আমি এ - কথা লিখে জানিয়েছি । কিন্তু আপনার দয়ায় তখন থেকেই আমি তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে লাগলাম । আপনার কাছে যে এত শীঘ্র এসে হাজির হতে পারব , তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি । নেহাৎ আপনার দয়া , তাই এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — পরমপিতার দয়া ।
একটু পরে শ্রীশ্রীঠাকুর ঐ মায়ের দিকে চেয়ে বলছেন — অচ্ছা , এ কেমন ! তুই রােগে ভুগছিস — সেখানে গিয়েও তোর ঠাকুর ভিক্ষের জন্য হাত পাতছে ?
উক্ত মা — আমাদের বাঁচাবার জন্যই তাে চান ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কি জানি তোরা কী কোস্ ! তবে ভিক্ষা আর আমাকে ছাড়ল না। আর - একটা মজা দেখি — যারা দেয় , তারা কিন্তু সব দিক দিয়ে বেড়েই ওঠে । দেবার আগ্রহই তাদের কর্মকৌশল খুলে দেয় । আবার , ইষ্টকে দেবার ধান্ধায় যারা কৰ্ম্ম - ব্যাপৃত হ'য়ে ওঠে , ঐ বুদ্ধি ফন্দী - ফিকির নিয়ে ঘােরে , আকুল প্রচেষ্টাই তাদের গ্রহবৈগুণ্য অর্থাৎ প্রবৃত্তি - অভিভূতিকেও অনেকটা কাবু করে দেয় । তাই শ্রেয়কে দেওয়ার বুদ্ধি যত বাড়ে ততই ভাল । মা - বাবাকে দেওয়ার বুদ্ধি যাদের থাকে , তাদেরও ভাল হয় ।
কথা বলতে - বলতে শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ বললেন --- হাগা পেয়ে গেছে । ( সকলের দিকে চেয়ে ) —এইবার তাহলে উঠি ।
সবাই বললেন — হ্যা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর উঠে দাঁড়িয়ে হরিপদদাকে বললেন- “ দ্যাখ তো হরিপদ ! কাপড়ে হেগে ফেললাম নাকি ! বিছানা নষ্ট হল নাকি !
হরিপদদা কাছাটা সরিয়ে দেখে বললেন — না , কিছু না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — বিছানাটা দেখলি না ?
হরিপদদা — তেমন কিছু হলে তো কাপড়েই দাগ থাকত ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আচ্ছা চল । — এই বলে নিভৃত - নিবাসে পায়খানায় গেলেন ।
নিভৃত - নিবাসের ভিতরে পূব - দক্ষিণ কোণে ছােট একটি ঘরে কমােড - পাতা পায়খানা , শ্রীশ্রীঠাকুর শৌচাদি সারলেন । তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে বড় একখানি জলচৌকীর উপর বসে পাউডার দিয়ে ভাল করে দাঁত মাজলেন দাঁত মেজে মুখ ধুলেন , তারপর হাত - পা ভাল করে ধুলেন , সরােজিনীমা গাড়ু থেকে জল ঢেলে দিলেন , হরিপদদাও সঙ্গে - সঙ্গে থেকে সাহায্য করতে লাগলেন । পরে মুখ - হাত - পা মুছে শ্রীশ্রীঠাকুর কাপড় বদলালেন । এমনভাবে কাপড় বদলালেন যাতে পায়খানার কাপড়টির সঙ্গে নূতন কাপড়টির ছোঁয়া না লাগে । কোঁচান সাদা ধবধবে কালপেড়ে শান্তিপুরে ধুতিটি পরে , সামনের ঝুলে - পড়া কোঁচাটি আবার উঠিয়ে বামদিকের মাজার কাছাকাছি গুজে দিলেন । কাপড়টি নাভির বেশ একটু উপরেই পরলেন । ধুতিটি ৫০ ইঞ্চি প্রশস্ত এবং ১১ হাত লম্বা , কোঁচাটি কাছাটির সুষম বিন্যাসে বেশ মানানসইভাবেই পরলেন তিনি , পরার ধরণে একটা আটপৌরে সরল সৌন্দৰ্য্য , —অভ্যস্ত অভিজাত রুচিবোধের পরিচয় । এরপর একটি আদির ফতুয়া গায়ে দিলেন , ফতুয়াটির তৈরীর ধরণ বেশ সুন্দর , হাতাটি কনুই পর্যন্ত , নীচের ঝুল বেশীও নয় , কমও নয় , শরীরের সঙ্গে বেশ সহজভাবে খাপ খেয়ে গেছে । কাপড় ও ফতুয়া পরে চটিটি পায় দিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর থপথপ করে বেরিয়ে এলেন অস্তিকায়ন ( নিভৃত - নিবাস ) থেকে । সিধে হ'য়ে হাঁটেন তিনি , হাঁটার সময় দীর্ঘ নাতিস্থূল দেহটি একটু সুঠামভাবে দুলে - দুলে ওঠে । নজর তার খুব তীক্ষ্ণ , যে - পথ দিয়ে যান , তার সামনে আশে পাশে কী আছে , কিছুই তার চোখ এড়ায় না । অস্তিকায়ন থেকে বেরিয়ে উত্তরাস্য হ’য়ে মাতৃমন্দিরের দিকে চলেছেন — অস্তিকায়নের উত্তর - পশ্চিম কোণে নজর পড়তেই দেখতে পেলেন সেখানে শেয়ালে বাহ্যি করে রেখে গেছে । শ্রীশ্রীঠাকুর মণিদাকে ( ঘােষ ) সামনে দেখতে পেয়ে বললেন - হেমগােবিন্দকে ডাক তো ! শেয়ালের গু - টা ফেলে দিক ।
মণিদা ডাকতে গেলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর ওখানে দাড়িয়েই রইলেন , “ হেম গােবিন্দদা আসার পর তাকে ব’লে , ওখান থেকে নড়লেন । যাবার আগে একবার হেমগােবিন্দদাকে জিজ্ঞাসা করলেন — কিরে , আমি যাব তাে ? হেমগােবিন্দদা বিনীতভাবে বললেন — আপনি যান ঠাকুর , আমি এখনই ফেলে দিচ্ছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃমন্দিরের সামনের বারান্দায় গিয়ে চৌকিতে বসলেন দক্ষিণাস্য হ'য়ে । প্যারীদা এসে ব্লাডপ্রেসারটা দেখলেন , তারপর একটা ওষুধ দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর ওযুধটা খেয়ে , ওষুধের গ্লাসে করে একটু , জলও খেলেন । এরপর একে - একে এসে অনেকে প্রণাম করে যেতে লাগলেন , কেউ - কেউ কাছে বসে রইলেন ! শ্রীশ্রীঠাকুর একদৃষ্টে আকাশের দিকে কিছু সময় চেয়ে রইলেন , যেন বিশেষ কিছু দেখছেন — পরে বললেন , দেখ , ঐযে আকাশে পাতলা মেঘের স্রোত ভেসে যাচ্ছে , ওটা দেখতে কিসের মত বল তাে ?
প্রফুল্ল সামনে এগিয়ে এসে ভাল করে দেখে বলল — বিশেষ কিছুর সঙ্গে সাদৃশ্য তো মনে হচ্ছে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দ্যাখ , ভাল ক’রে দেখে বলাই চাই ছাওয়াল । ও - কথা অামি শুনব নানে । প্রফুল্ল যেন ফাঁপরে পড়ে গেল , আরও কিছুসময় নিবিষ্ট মনে দেখে বলল দেখতে কতকটা যেন একটা বিরাট হাতীর মত ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( উল্লসিত কণ্ঠে ) —যা , পেরে গিছিস্ , এই বলে কিছুর সঙ্গে মিল পাচ্ছিলি না । সেইজন্য ধিইয়ে - ধিইয়ে দেখার অভ্যাস করতে হয় । সংশ্লেষণী দৃষ্টি , বিশ্লেষণী দৃষ্টি দুই - ই চাই । সংশ্লেষণী দৃষ্টি হচ্ছে বহুকে জোড়াতাড়া লাগিয়ে , সম্পর্কন্বিত করে এক করে দেখা , আর বিশ্লেষণী দৃষ্টি হ’ছে একের অন্তনিহিত বহুত্বকে দেখা , নানাজাতীয় বিশিষ্ট উপাদান - সামগ্রী , যার সংহত সমবায়ে জিনিসটি গড়ে উঠেছে , তাকে বিশ্লিষ্ট করে অর্থাৎ আলাদা করে দেখা । সংশ্লেষণী , বিশ্লেষণী দুইরকম দৃষ্টি যদি না খােলে , তাহ'লে কোন জিনিসকেই পুরােপুরি দেখা হয় না । এই সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের আবার নানা পৰ্য্যায় আছে , এর পরিধি যার যত ব্যাপক , গভীর ও সূক্ষ্ম , সে হয় তত বুদ্ধিমান । কাব্য বল , বিজ্ঞান বল , সাহিত্য বল , ব্যবসা - বাণিজ্য বল , রাজনীতি বল , ঘর - সংসার বল — জীবনের সবক্ষেত্রেই এই দুমুখাে দৃষ্টির প্রয়ােজন আছে । সমান তালে এ দুটোর অনুশীলন যারা করে , তাদের প্রবীণ চক্ষু খুলে যায় । এরপর কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , চুনিদা ( রায়চৌধুরী ) , বীরেনদা ( মিত্র ) , কিরণদা ( মুখােপাধ্যায় ) , পণ্ডিত ( ভট্টাচাৰ্য্য ) , দেবী ( চক্রবর্তী ) প্রভৃতি শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এসে বসলেন । কেষ্টদা আসার পর হিটলার , মুসােলিনীর আত্মজীবনী- - সম্বন্ধে গল্প করতে লাগলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর -- আমি একটা জিনিস দেখি , যে যেখানে বড় হয় , শ্রেয় কারও না কারও প্রতি তার বিশেষ শ্রদ্ধা থাকেই । এর একটাও exception ( ব্যতিক্রম ) দেখি না । এই glowing point ( দীপনদ্যোতনা ) -টা যদি পরিস্ফুট করে তােলা না যায় , তবে সে - ইতিহাস বা জীবনীর কোন দাম নেই । এই শ্রেয় আবার যতখানি শ্রেয়নিষ্ঠ , বৈশিষ্ট্যপূরণী ও সমষ্টি - উৎসারণী হন এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা যত গভীর ও সক্রিয় হয় , ততই মানুষের উন্নতির সম্ভাবনা বেশী থাকে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর দেবীকে ধমক দিয়ে বললেন — চাদর গায় দিয়ে আসিস্ নি কেন ? ওদিকে তো খক্ - খক্ ক'রে কাশছিস্ । যাঃ ! এখুনি যা ! দৌড়ে গিয়ে চাদর নিয়ে আয় ! ছাওয়াল - পাওয়াল এত অসাবধান !
দেবী ( চক্রবর্তী ) তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন চাদর আনতে ।
মণিদা ( শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যম পুত্র ) তার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছেন ? দাড়িয়ে - দাঁড়িয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা শুনছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের লক্ষ্য পড়তেই সস্নেহে বললেন — তাের পেট এখন কেমন?
মণিদা — আগের থেকে ভাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মিষ্টিটিষ্টি বেশী খাবি না কিন্তু ।
মণিদা — আজকাল তো তেমন খাই না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কেষ্টদার দিকে চেয়ে বিমল হাসিতে সকলের মনে আনন্দের ছোঁয়া লাগিয়ে বললেন — মিষ্টি খাওয়ার নেশা ওর কতকটা আমার মত । আমার থেকেই পাইছে ।
পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করলেন — থিয়েটারের মস করছসি্ না আজকাল ?
মণিদা — হ্যাঁ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ভাল করে লাগা । ( কেষ্টদার দিকে চেয়ে ) করেও কিন্তু বড় সুন্দর !
কেষ্টদা — অপূৰ্ব !
৪ ঠা পৌষ , শুক্রবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৯/১২/৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর অতি প্রত্যুষে বিছানা থেকে উঠে দক্ষিণাস্য হ'য়ে বাঁধের উপর একাকী দাড়িয়ে আছেন । অন্যদিন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আসতেই তিনি নিজে থেকে হেসে কথা কন , কিংবা তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে যেন তেমন ভয়সঙ্কোচ হয় না । কিন্তু আজ এমন মৌন - গম্ভীর বিরাটমূত্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন দিগন্তবিসারী প্রান্তরের শেষ প্রান্তে দিগ্বলয়ের দূর বিন্দুতে উদাস দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যে তার কাছে এগুতেই যেন সাহস হচ্ছে না । তিনি কাছে থেকেও যেন কতদূরে , সীমার মাঝে থেকেও যেন অসীমে আত্মহারা — আমাদের ধরা - ছোয়া নাগালের বাইরে । তিনি এমনতরভাবে আপন মনে আপনি বিচরণ করেন যখন , তখন সেই বিরাট পুরুষকে দূর থেকে ভয়মিশ্রিত ভক্তি নিয়ে প্রণাম করা যায় , কিন্তু কাছে এগুনো যায় না । ‘ অতি সৌম্যাতিরৌদ্রায়ৈ নতাস্তস্যৈ নমাে নমঃ । সকলে প্রণাম করলেন , প্রণাম করে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলেন । স্বচ্ছন্দমনে জোরে নিঃশ্বাস নিতেও কেমন সঙ্কোচ বােধ হচ্ছিল । স্তব্ধ , থমথমে , গুরুগম্ভীর আবহাওয়া । এমন সময় বোঝা যায় যে , তিনি দয়া করে আমল দেন তাই সেই দুরবগাহ , দুর্ব্বার ব্যক্তিত্বের কাছে এগোন যায় , নিশ্চিন্ত হয়ে তার সঙ্গে মেশা যায় , নতুবা কার সাধ্য আছে , তিনি ইচ্ছা না করলেও , তার সামনে গিয়ে দাড়াতে পারে ?
এইভাবে কিছু সময় কাটল , পরে উত্তর দিকে মুখ করে শ্রীশ্রীঠাকুর সহজ ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা কখন আসলে ?
উত্তর দেওয়া হল — এই এখন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর স্নেহকোমল কণ্ঠে বললেন — চল , ভিতরে যেয়ে বসিগে । — এই ব’লে শ্রীশ্রীঠাকুর অগ্রসর হলেন , আর সকলেও পিছু - পিছু গেলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তাসুর ভিতর ঢুকে বিছানায় উপবেশন করলেন । আর সবাই চৌকির চারিপাশ ঘিরে মাটিতে বসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ বললেন— ( কথার মধ্যে কেমন যেন একটা অন্তরঙ্গ রহস্য গভীর সুর ) দ্যাখ , দুনিয়ায় সবই কিন্তু চেতন , অচেতন কোথাও নেই কিছু । সবার সঙ্গেই তাই আদান - প্রদান চলে , ভাববিনিময় চলে । অবার , মাঝে - মাঝে আমার মনে হয় সবই যেন মানুষ — গুরু - মানুষ , গাছ - মানুষ , ঘাস - মানুষ , চাদ মানুষ , সূৰ্য - মানুষ এমনি কত কী ! কখনও আবার দেখি — সবই যেন আমি গাছ - আমি , পোকা - আমি , রাম - আমি , শ্যাম - আমি , এক আমি এত হ'য়ে আছি , আমিই আমার সঙ্গে এত কাণ্ড করছি — এ বড় বিচিত্র ব্যাপার । তাই কেউ যখন কারও ক্ষতি করতে চায় , আমার বড় হাসি পায় । ভাবি — পরমপিতা ! এ তােমার কী খেলা ? মানুষ নিজেরই ক্ষতি করতে চায় নিজে । কারও ক্ষতি করা মানে যে নিজেরই ক্ষতি করা — এইটুকুই বোঝে না । তত্ত্বদৃষ্টি বাদ দিলেও একথা খাটে । তোমার পরিবেশকে তুমি যদি ক্ষুন্ন কর , প্রতিক্রিয়ায় তারাও তােমাকে ক্ষুন্ন করতে চেষ্টা করবে , আর তা যদি না - ও করে , তারা ক্ষুন্ন হ'লে আগের মত জীবনীয় পোষণ যােগাতে পারবে না তোমাকে ও অন্যান্যকে । ফলে, তোমারই তাে ক্ষতি সব থেকে বেশী । তাই বলে দুষ্টবুদ্ধি নিয়ে চলছে যারা তাদের যে নিরস্ত করবে না , তা কিন্তু নয় । সেখানে প্রতিরোধ না করাই দুব্বলতা , ঐ দুর্বলতা অধর্মেরই নামান্তর । ধর্মের নামে কত যে অধৰ্ম প্রশ্রয় পাচ্ছে দুনিয়ায় , তার কি ঠিক আছে !
শ্রীশ্রীঠাকুর গড়গড়ার নল টানতে - টানতে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন- “ধূর্জটিকে দেখি না দু ' - একদিন । ও ভাল আছে তো ?
ইন্দুদা — শুনেছি খুব সন্দি হয়েছে । তাই আসেন না । শ্রীশ্রীঠাকুর অমরভাইয়ের দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করতেই অমরভাই গেলেন খবর নিতে।
অমরভাই ( ঘােষ ) খবর নিয়ে একটু পরে এসে বললেন — সর্দ্দি আগের থেকে কম ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — পেট ভাল আছে তাে ? বাহ্যে পরিষ্কার হয় তাে ? ওষুধ কী খাচ্ছে ? আগের তুলনায় ক ’ আনা কমিছে ?
অমরভাই — আমি তাে অতাে খবর নিইনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যা ভাল করে শুনে অায় গিয়ে ।
যে - কোন কাজে যাস্— মাথা খাটিয়ে সব দিকের খোঁজ - খবর নিবি । একেই বলে অনুসন্ধিৎসা । এই অনুসন্ধিৎসা যদি থাকে , তাহলে দেখবি — এক - একটা দিন পেরিয়ে যাবে আর তাের জ্ঞানের পরিধি কত বেড়ে যাবে । আমি এটা শুধু ওকে বলছি না— আপনারা প্রত্যেকেই এদিকে খেয়াল রাখবেন । আর , ছেলেপেলেরাও যাতে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে , সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন । মানুষ যদি চৌকস না হয় , অনুসন্ধিৎসু না হয় , তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন না হয় , তবে তাদের দিয়ে গতানুগতিক কাজ চলতে পারে , কিন্তু বড় কাজ হওয়া মুশকিল । আজ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য দেশে আন্দোলন চলছে , দেশকে স্বাধীন করে তুলতে যেমন হিম্মতের প্রয়ােজন , একটা স্বাধীন রাষ্ট্রকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে গেলেও ততােধিক যোগ্যতার প্রয়োজন । সে - শিক্ষা আমাদের কোথায় — যে - শিক্ষা এই উপযুক্ততা ' এনে দেয় । তাই ব্যক্তিত্ব বেড়ে ওঠে যা'তে , নেতৃত্বের ক্ষমতা গজিয়ে ওঠে যা’তে , সমস্ত প্রতিকূল অবস্থাকে উপচয়ী করে তোলা যায় যা'তে , তেমনতর শিক্ষার আমদানি করতে হবে । ধর , তুমি শিক্ষক , তোমার একটি ছাত্র অাজ বাদে কাল হয়তাে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রদূত হ’য়ে যাবে আমেরিকায় । সে - কাজ কিন্তু সােজা কাজ নয় , শুধু পৃথিপড়া বিদ্যায় কুলাবে না । অবস্থা ও পরিস্থিতি বুঝে তখন তাকে অামেরিকাকে ভারতের interest- এ ( স্বার্থে ) mould ( নিয়ন্ত্রণ ) করতে হবে । এই যে করতে হবে , এতে শুধু নিজের কোলে ঝোল টানলেই চলবে না , তাদের বোঝাতে হবে যে এর ভিতর - দিয়ে তাদের স্বার্থ কতখানি পরিপূরিত হচ্ছে । আবার , শুধু ; আশুলাভ দেখলে হবে না , দীর্ঘদৃষ্টি থাকা চাই । আকার - ইঙ্গিতে মানুষের মনের কথা টের পাওয়া চাই । কূটনীতি যদি তার চরিত্রগত না হয় , তবে বেকুব ভালমানুষেমিতে কিন্তু চলবে না । আবার , সকলেই সব কাজ পারে না । প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বুঝে প্রত্যেককে এমনভাবে nurture ( পোষণ ) দিতে হয় , যাতে প্রত্যেকে তার মত করে এক একটা দিকপাল হয়ে ওঠে । তােমার তাহলে কতখানি নজর থাকা চাই ভেবে দেখ । তােমার ছাত্রদের কেউ হয়তাে হবে ঋত্বিক , ঋত্বিকের প্রধান কাজ যাজন, যে যাই নিয়েই থাক , তাকে তার ভিতর দিয়েই Ideal- এ ( আদর্শে ) interested ( অন্তরসী ) করে তুলে জীবনের পথে , যোগ্যতার পথে , আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে বাড়িয়ে তুলতে হবে । দেশের অবস্থা এমনতর , এ অবস্থায় ‘হয় না’ , ‘হবে না’ ইত্যাদি রকম থাকলে তার চলবে না । সে নিজেই যদি অন্যের অন্ধকারে কালো হয়ে যায় , তবে কাজ করবে কী ? তার appearance ( চেহারা ) , activity ( কর্ম ) , every footstep ( প্রতিটি পদক্ষেপ ) এমন ধরণের হবে , যা দেখে প্রত্যেকে elated ( সন্দীপ্ত ) হ'য়ে ওঠে , তার দীপ্তির প্রভা সবার চোখ ফটিয়ে দেবে — তবেই তাে সে ঋত্বিক — তবেই তাে সে পুরুষোত্তম - পতাকাবাহী দেবকোটি সােনার মানুষ । তার conviction ( প্রত্যয় ) -এর স্পর্শে সমস্ত darkness (অন্ধকার ) , depression ( অবসাদ ) , moroseness ( বিষাদ ) যেন ঊষার আলােয় পা ফেলবে , দেখতে - দেখতে বিলীন হয়ে যাবে । একটা ছেলেকে যদি এতখানি করে তােলা লাগে , তাহলে তোমার কোথায় ওঠা লাগবে — ভেবে দেখছ ? ফলকথা , তােমার সহজ চরিত্র যদি প্রতিটি মুহূর্ত্তে আলাের চমক দিতে - দিতে চলে ইষ্টানুগ উদ্দীপনা সঞ্চার করে — তবে তােমার প্রত্যেকটি ছাত্রই তােমার কাছথেকে তার বৈশিষ্ট্যমাফিক অনুপ্রেরণা আহরণ করবে , সে - বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই । দেখ না ? War - field- এ ( যুদ্ধক্ষেত্রে ) একটা general ( অধিনায়ক ) -এর appearance ( চেহারা ) , এক - একটা কথা কেমন puss * ( উচ্চেতনী প্রেরণা দিয়ে যায় — সবাই যেন জ্বলে ওঠে । ‘কয়লা কি ময়লা ছোড়ে যব আগ করে পরবেশ ।’ আগুন কালো কয়লাকে , লোহার গোলাকে পর্যন্ত লাল ডগডগে করে ছেড়ে দেয় । মানুষের বেলায় conviction ( প্রত্যয় ) ও urge ( আকূতিই ) হলাে সেই আগ বা আগুন , যার ছোয়ায় সব কিছু glowing ( উজ্জ্বল ) হ'য়ে ওঠে ।
বলতে - বলতে শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখ - মুখ আবেগােদ্দীপ্ত হয়ে উঠলাে । বলার পর তিনি তামাক খেলেন । তামাক খেতে - খেতে মৃদু - মৃদু এর - ওর দিকে চেয়ে হাসতে লাগলেন । এর মধ্যে কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , অবিনাশদা ( ভট্টাচাৰ্য ) প্রভৃতি আসলেন ।
নিবারণদা ( বাগচী ) কথাপ্রসঙ্গে খুব করুণভাবে তঁার অভাব - অভিযোগের কথা শ্রীশ্রীঠাকুরকে দীর্ঘ সময় ধরে বলছিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কিছুক্ষণ ধরে নীরবে ঐ কথা শুনবার পর ও - কথায় বিশেষ আমল না দিয়ে স্নেহ - মধুর দৃপ্তকণ্ঠে ঝাঁকি দিয়ে বলে উঠলেন — ধ্বজভঙ্গের মত কথা ক’সনে তাে । তুই একটা বামুনের ছেলে , তার পর ঋত্বিক । সৎসঙ্গের বাজারে পাছা ঘসটাচ্ছ কম বছর না । জান - বােঝও নিতান্ত কম না । তোমার একটু খ্যাতি - খাতিরও আছে । একখানে দাড় করিয়ে দিলি মুখ দিয়ে খই ফোটে , মানুষ মনে করে , মা সরস্বতী যেন কণ্ঠে বসেছেন । চেহারাটাও অাছে খুবসুরৎ । কোনদিক দিয়েই কম যাও না । কেবল নিজের পরিবার চালাবার বেলায় হিমসিম খেয়ে যাও — তার মানে চরিত্রের অভাব , কথায় অর করায় মিল , নেই । ওইটুকু শুধরে ফেল বাছা ! নিজেকে ফাঁকি আর কতকাল দেবে ?
নিবারণ - দা যুগপৎ লজ্জিত ও উল্লসিত হয়ে উঠলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তুই এ - পর্যন্ত দীক্ষা দিয়েছিস্ কত ?
নিবারণ - দা — হাজারের উপর । শ্রীশ্রীঠাকুর ( হাসতে - হাসতে ) —শোন কথা , হাজারের উপর যার যজমান , সে নাকি খেতে পায় না । আরে বাপু , এদের পিছনে তুই যদি একটু , খাটিস — এদের মধ্যে শতকরা পঁচিশ জনও যদি ইষ্টভৃতি করে এবং নিজেরা দাড়িয়ে যায় , অর্থাৎ যােগ্যতার অধিকারী হয় , দক্ষনিপুণ হয়ে ওঠে , তাহলে তাে তাের আর ভাবনা থাকে না । আর দ্যাখ ! নিতান্ত প্রয়ােজন হলে বরং সহজভাবে তাের প্রয়ােজনের কথা বলে ভিক্ষা করবি , কিন্তু ধার - কর্জ করে go - between ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) করতে যাবি না । অবশ্য , নিজের জন্য মানুষের কাছে যত কম চেয়ে পারিস সেই ভাল । যজমানদের অভাব - অভিযােগে , তারা তাের কাছে কিছু না চাইতেও পাঁচজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে যাকে যতটুকু পারসি্ সাহায্য করবি , আর যেভাবে প্রত্যেকে দাঁড়াতে পারে , তার উপায় করে দিবি । এতে দেখবি স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তােকে দেবার প্রবৃত্তি আসবে তাদের । এই প্রীতি - অবদান বামুনের বড় আদরের জিনিস । এমনতরভাবে একটি পয়সাও যদি তুমি পাও , সেই এক পয়সার মাল তোমাকে যে পুষ্টি দেবে , ছ্যাচড়ামি করে পাওয়া হাজার টাকার জিনিসেও তা তুমি পাবে না ! আর , ঋত্বিকের কাজ ভালভাবে করতে গেলে অরাে সহ - প্রতিঋত্বি , অধ্বর্য্যু ও যাজক করে ফেল ' । ঢাল নেই , তরােয়াল নেই , নিধিরাম সরদার — তা কি হয় ? Assistant . ( সহকারী ) -দের আবার properly ( যথাযথ ) equip ( প্রস্তুত ) করা চাই । এখানে নিয়ে আসবি , তামি যতটা পারি কথাবার্তা কব । আর , কেষ্টদার কাছে নিয়ে যাবি । আবার , যজমানদের একটা Register ( তালিকা ) রাখবি , দুরে যখন থাকসি্ তখন তাদের কাছে চিঠিপত্র দিবি । একজনের হয়তো মেয়েটা বড় হয়েছে — তার গােত্র , বংশ , বয়স ইত্যাদি তোর কাছে লেখা আছে । ঘুরতে- ঘুরতে কোথাও গিয়ে হয়তাে দেখলি , তার উপযােগী একটি পাত্র আছে , তখন হয়তো যোগাযােগ করে দিলি । তোমার একজন যজমান হয়তাে Tube - well contractor ( নলকুপ - ঠিকাদার ) , আর একজন হয়তাে District Board ( জিলবোড ) -এর মেম্বার ( সভ্য ) ; একজনকে দিয়ে আর একজনকে কিছু -contract ( ঠিকাকাজ ) জুটিয়ে দিলে । Contract ( ঠিকাদারী ) যে পেল , তাকে হয়তো বলে দিলে — ' দ্যাখো , বেশী লাভ খেতে যেও না । বরং এমনভাবে কাজ করা চাই , যাতে লোকের খুব সুবিধা হয় । অর - একবার contract ( ঠিকাদারী ) দিতে গিয়ে তােমাকে না ডেকে যেন পারে না । তেমনি কেউ হয়তাে আছে রােগী , কেউ হয়তাে আছে ডাক্তার , কেউ হয়তো আছে মক্কেল , কেউ হয়তো আছে উকিল — পরস্পরের মধ্যে যােগাযােগ করে দিয়ে প্রত্যেকের সেবা দিতে হয় । তুমি জান , কারােও হয়তাে পুরানাে তেতুল খাওয়া দরকার , তুমি ঘুরতে - ঘুরতে একজায়গায় এক - বাড়ীতে গিয়ে খবর পেলে যে সেখানে “ পুরানাে তেতুল আছে , সেখান থেকেই হয়তাে কাউকে দিয়ে খানিকটা পুরানো তেতুল ওর কাছে পাঠিয়ে দিলে । অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ এমন পেলে মানুষের কেমন মিষ্টি লাগে বল তাে ? আর , শুধু যজমান বলে কথা নয় , সৎসঙ্গীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে এটা চারিয়ে দেওয়া চাই । তোমরা নিজেদের মধ্যে যতখানি পার তা তাে করবেই , এমন - কি তােমাদের আওতার বাইরে যারা , তাদেরও সাধ্য মতন সেবা দিতে ত্রুটি করবে না । তবে যাকে যে সেবাই দাও , সব সময় স্মরণ রাখবে , ধর্মদানই শ্রেষ্ঠদান ।
ইতিমধ্যে কালিদাসীমা কাজলকে কোলে ক’রে এসে দাড়িয়েছেন ।
কাজল শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখে ঝাপিয়ে বিছানার উপর আসতে চায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( টেনে - টেনে ) —বাপাই সোনা ! বাপাই সোনা ! —বলে দূর থেকে আদর করলেন ।
কালিদাসীমা — দেব বিছানায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — এখন গােল করিস্ না । বিছানায় মুতে - টুতে দেবে । এরা সবাই আছে — এদের সঙ্গে বসে একটু , খোয়াড়ি ভাঙ্গি । নেশা তাে করিনসি্ নি কোন দিন ।
সবাই হেসে ফেললেন । কালিদাসীমা - ও হাসতে - হাসতে কাজলকে কোলে করে অন্য দিকে গেলেন । জ্ঞান চৌধুরী - মহাশয়ের বাড়ীতে রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল , সেখান থেকে একটা মিষ্টি মনোহর গন্ধ অাসছিল ভুরভুর করে , সে গন্ধ ' কেবলই শুকতে ইচ্ছা করে । সেই গন্ধেরই মত মনােলােভা শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গ । তার সঙ্গসুখ একবার পেলে নিরন্তর তা ’ আস্বাদন করতে ইচ্ছা করে । একটা লােলুপ তৃপণা উদগ্র হয়ে ওঠে । সবাই তাই জমে গেছেন । কারও অার " উঠবার ইচ্ছাটি নেই । শ্রীশ্রীঠাকুর ঐ ভাব - তন্ময়তা লক্ষ্য করে আপন মনে । গিরিনির্ঝরের কলধারার মত মত্ত - অনন্দে ব’লে চলেছেন —
complex- সমন্বিত ( প্রবৃত্তি - সমন্ধিত ) being ( সত্তা ) থাকে , অার । থাকে objective world ( বস্তুগত দুনিয়া ) । Being- এর ( সত্তার ) ভিতর থাকে will to live ( বাচার ইচ্ছা ) , will to enjoyment ( উপভােগের ইচ্ছা ) , will to activity ( কর্মের ইচ্ছা ) । মানুষ দুনিয়াকে enjoy ( উপভােগ ) করে complex- এর ( প্রবৃত্তির ) সাহায্যে । কিন্তু একবার যদি প্রবৃত্তির কবলে পড়ে যায় তাহলে কিন্তু আর তার কোন enjoyment . . ( উপভােগ ) থাকে না । Enjoyment ( উপভােগ ) -এর জন্য দরকার হয় । আধিপত্য , অমরা ঈশ্বরের বাচ্চা , তিনি আধিপত্যময় ভিতরে - বাইরে সর্বত্র , তাই তিনি আনন্দময় , অামরাও তেমনি সর্বতোমুখী আধিপত্যের পথে যতখানি এগিয়ে যাব , ততখানি উপভােগ - সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হব । এর জন্যই দরকার হয় আদর্শ গ্রহণ ও তা’তে অনুরাগ । যাঁর মধ্যে পরতে - পরতে সব সাজান রয়েছে , যাঁকে দেখে সব - পাওয়ার পথে চলতে পারি , তিনিই হলেন আদর্শ । এই অাদর্শ না থাকলে মানুষের অভিজ্ঞতা হয় না । Complex ( প্রবৃত্তি ) -ই তাকে guide ( পরিচালনা) করে , complex (প্রবৃত্তি ) থেকে আলাদা করে সে নিজেকে ভাবতে পারে না । পােষা কুত্তা যদি রসগোল্লা দেখে , তবে তার খাওয়ার ইচ্ছা হলেও প্রভুর দিকে চেয়ে থাকে । যার প্রভু নেই , সে রসগােল্লা দেখা মাত্রই তা’তে মুখ দেয় — পরে ডাণ্ডা খায় , তখনকার মত বােঝে , আবার ভােলে , আবার খায় আবার আঘাত পায় , সারা জীবন এমনি চলে । Ideal ( আদর্শ ) থাকা সত্ত্বেও complex ( প্রবৃত্তি ) অনেক সময় screen- এর ( পর্দার ) মত মাঝখানে এসে দাঁড়ায় ; Ideal ( আদর্শ ) চোখের সামনে তখন থাকেন না । মানুষ এমনভাবে treacherous (বিশ্বাসঘাতক ) হয়ে দাড়ায় , তাই সব ছাপান টান না থাকলে হবে না । তাই বলে আমি এ বলছি না যে complex . ( প্রবৃত্তি ) থাকবে না , তাদের full healthy vigour ( পূর্ণ সুস্থ তেজ ) থাকা চাই যমন - দীক্ষু – হ'য়ে , নচেৎ মানুষ তাে subman ( অমানুষ ) হ'য়ে যাবে । আর - একটা জিনিস হয় — মানুষ অনেক সময় ভুল করে হঠাৎ হয়তো একটা প্রতিজ্ঞা করে বসে , inferiority ( হীনম্মন্যতা ) -র দরুন তা আর কিছুতেই ছাড়তে পারে না , ফলে জীবন - বৃদ্ধিকেও আলিঙ্গন করতে পারে না । এটা কীন্তু ভাল নয় । প্রতিশ্রুতি হবে আদর্শ বা আদর্শপ্রতীকের প্রতি — তারই পরিপূরণের জন্য , নচেৎ সে প্রতিশ্রুতির মূল্য কী ? শাস্ত্রী দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত পৈতে গলায় দেবে না বলে গলার পৈতে খুলে হাতে পরলাে । আমার শুনে মনে হলো , যার সাহায্যে তুই চলবি , কাজ করবি , সেই কৃষ্টিচিহ্নই যদি তুই স্থানচ্যুত করলি , জীবনের ভিত্তিই যদি তুই টলিয়ে দিলি , তবে তুই দাড়াবি কিসের উপর ? এমন তর দেখলে , তাকে দিয়ে কাজ যে কতখানি হবে , তা আমার বুঝতে বাকী থাকে না । চাণক্যের জীবনে কিন্তু এমনতর প্রতিজ্ঞা দেখতে পাবে না , যা কৃষ্টিকে অবদলিত করেছে , কারণ , কৃষ্টি মানেই হলাে আদর্শে কষিত হওয়া — যা কিনা ‘ অভ্যুদয়ের একমাত্র অমৃত - উৎস !
৫ ই পৌষ , শনিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২০/১২/৪১ )
মানুষের মনের কামনা—
‘ প্রভাতে প্রথম নয়ন মেলিয়া তােমারে হেরিব আমি
ওগো অন্তরযামী ।’
মূৰ্ত্ত অন্তর্যামী যিনি , যাঁর প্রতি অনুরাগে মানুষের সমগ্র অন্তর নিয়ন্ত্রিত হয় , সুষম ছন্দে ছন্দায়িত হ’য়ে ওঠে , অন্তরের কলুষ বিদূরিত হয় যাঁর মঙ্গল করস্পর্শে , ঊষার আলােয় চোখ মেলে কার না দেখতে ইচ্ছে করে তাঁকে ? তিনি কোথায় ? তাঁকে কি দেখা যায় ? হ্যাঁ ! তাঁকে দেখা যায় , তাঁর সঙ্গে কথা কওয়া যায় । আমাদেরই একজন হয়ে আমাদের ঘরের দোরে বিরাজ করছেন তিনি । সেখানে । তাঁর নিত্যলীলা অজস্রধারে উৎসারিত হয়ে চলেছে । এস , দেখরে এখানে পদ্মা তীরে নিখিল - হৃৎপদ্ম ফুটে আছে কী অপূর্ব্ব শােভা বিকিরণ করে ! দেখবে কী অগাধ শান্তি , অনাবিল আকর্ষণ ! তাঁর ছোঁয়ায় , তাঁর হওয়ায় তােমারও হৃদয় শতদল বিকশিত হয়ে উঠবে পাঁপড়ির পর পাঁপড়ি মেলে ।
ঠাকুরকে ঘিরে আনন্দের মেলা বসেছে এখন । মধুর কলতানে সংলাপ চলেছে । মিহি পর্দায় ।
ঈষদাদা ( বিশ্বাস ) —গণ্ডগোলের ভয়ে আগে আমি মানুষকে কিছু বলতে ভয় পেতাম , এক - এক সময় compromise ( অপােষ ) করে যেতাম , আজকাল সে ভয় কেটে যাচ্ছে , আদর্শ - বিরােধী কোন কথা হ'লেই চেপে ধরি — সে যিনিই হউন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষের ভিতরে moral weakness ( নৈতিক দুর্বলতা ) থাকলে সে sweet compromising ( মিষ্টি আপোষকারী ) হয় । Strictly (কঠোরভাবে ) চলতে ভয় পায় , পাছে তার weakness ( দুর্বলতা ) disclosed এ প্রকাশিত ) হয়ে যায় , তাই নিজেদের মান বজায় রাখার জন্য পরস্পর পরস্পরের weakness ( দুর্বলতা ) support ( সমর্থন করে । যার conscience ( বিবেক ) strong ( সবল ) , সে হয় sweet ( মিষ্টি ) , invigorating ( তেজ সন্দীপী ) but uncompromising ( কিন্তু আপোষরফাহীন ) তাঁর রুঠো প্রতিবাদের মধ্যেও একটা শ্রেয়ােনিষ্ঠা - সমন্বিত দরদী ব্যক্তিত্বের পৌরুষ - দৃপ্ত অভিব্যক্তি থাকে , যা মানুষকে শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধাসম্পন্ন ক'রে তোলে তাঁর প্রতি । অবশ্য inferiority ( হীনম্মন্যতা ) -ওয়ালা একদল থাকবেই , যারা কিছুতেই তাকে বরদাস্ত করতে পারবে না , কিন্তু বরদাস্ত না করতে পারলে কি হয় ? “ ভিতরে - ভিতরে তাঁকে ভয় ও ভক্তি করবেই । যাকে প্রয়োজনমত কড়া কথা শুনিয়ে দিলে , তারই বিপদে - আপদে , দুঃখে - কষ্টে তুমি যদি আবার দরদীর মত তার পাশে গিয়ে দাড়াও , তােমার সাধ্যমত তার প্রতিকারের চেষ্টা কর , তখন দেখবে সে আপনা - থেকেই কাবু হয়ে পড়বে ।
কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —শােনা যায় , হিটলার নাকি যাকে ধরে , একেবারে বাঘের মত ধরে , sweetness- এর ( মিষ্টতার ) নামগন্ধও সেখানে পাওয়া যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Man of conviction ( প্রত্যয়বান মানুষ ) বাঘের মতই হয় , সে sweet ( মিষ্ট ) না হলেও , invigorating ( প্রেরণাসন্দীপী ) তাে হয়ই , মানুষ ঐ দেখেই moved হয়ে যায় ।
কেষ্টদা— Superficial dealings ( বাহ্যিক চাল ) দেখিয়েও তো অনেকে ‘ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয় , famous(খ্যাতিসম্পন্ন) হ'য়ে দাঁড়ায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( কতকটা অসহিষ্ণুভাবে মাথা নাড়িয়ে ) —তা কখনও হয় না । আপনারা একটা case ( দৃষ্টান্ত ) খুজে বের করুন তাে , যার principle- এ (আদর্শে ) fanatic attachment ( অটুট অনুরাগ ) বলে কিছু নেই , অথচ সত্যিকার বড় হয়েছে , বহু মানুষের অন্তরে গভীর শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে । শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খাচ্ছেন আর কথা বলছেন , মাঝে - মাঝে তামাকের কতকটা ধোঁয়া মুখের মধ্যে পুরে নলটি মুখ থেকে সরিয়ে আস্তে - আস্তে ফুসফুস করে ধোঁয়াটা মুখ থেকে বের করে দিচ্ছেন । বালকের মত কৌতুকভরে নিজেই আবার স্বমুখনিঃসৃত ধোঁয়াটার পানে চেয়ে - চেয়ে দেখছেন । তামাকের গন্ধে ঘর আমোদিত , সেই সঙ্গে মিশে আছে তাঁর শ্রীঅঙ্গের সুবাস ।
পূবদিকের জানালা দিয়ে তরুণ অরুণের উজ্জ্বল আভা এসে লুটিয়ে পড়েছে তাঁর শুভ্র শয্যায় , সোনার বরণ তনু তাঁর আরো অপরুপ শােভা ধারণ করেছে । সুধানিষ্যন্দী মধুর কণ্ঠে কথা কইছেন তিনি । মধুময় গন্ধে , বরণে , গানে এক অভিনব মায়ালােক সৃষ্টি হয়েছে মাটির বুকে ।
একটু পরে বিশ্বম্ভরভাই ( শীল ) অসলাে শ্রীশ্রীঠাকুরের ক্ষৌরকর্মের জন্য । শ্রীশ্রীঠাকুর বিশ্বম্ভরকে দেখেই বললেন — কি রে , তুই এর মধ্যেই চ'লে আইছিস ? এত শীতে কামাবােনে কি ক’রে ?
বিশ্বম্ভর — গরম জল দিয়ে কামালে আপনার অসুবিধে হবে না । সেই বুধবারে কামিয়েছি , অজি শনিবার , তিন - চার দিনে দাড়ি কত বড় হয়ে গেছে । গরম জল দিয়ে কামিয়ে দিলে শীতও লাগবে না তেমন , আর কামান হ'য়ে গেলে , অারামও পাবেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তা ' বেশ ! তবে আয় ! কী বলেন কেষ্টদা ! কাজটা সেরে নেওয়া যাক ।
কেষ্টদা — হ্যা ! তাই ভাল । আপনি কামিয়ে নেন , আমরা বসি ।
বিশ্বম্ভর শ্রীশ্রীঠাকুরের আলাদা ক্ষুর , সাবান , ব্রাস , স্টপ , তােয়ালে ইত্যাদি । বের করে প্রস্তুত হ’তে লাগলাে । তোয়ালেটা শ্রীশ্রী ঠাকুরের গলায় বেঁধে দিল । এরপর সে জলের জন্য ইতস্ততঃ করতে লাগলাে , কারণ , জল গরম করতে সে কাউকে বলেনি । শ্রীশ্রীঠাকুর অবস্থা বুঝে বললেন — যাই করি , তার জন্য প্রস্তুতি চাই , গােছান ব্যবস্থা চাই , কোটার পর কোন্টা লাগবে , সেটা যদি আগে ঠিক না । রাখি , তাহ'লে তােরও অসুবিধা , যার করবি তারও অসুবিধা । যা ! তাড়াতাড়ি জলের ব্যবস্থা কর ।
বিশ্বম্ভর গরম জলের জন্য ছুটে যাচ্ছে , এমন সময় কালিদাসীমা একটা বাটিতে । করে গরম জল নিয়ে এসে হাজির হলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর দেখে খুব খুশি হয়ে একগাল হেসে বললেন- “ না বলিতে কাজ বুঝিয়া করিবে , সেই সে সেবক নাম । একেই বলে অনুসন্ধিৎসু সেবা । মেয়েদের এই জিনিসটা খুব দরকার । মায়েদের মধ্যে এই অভ্যাস থাকলে ছেলেপেলেরাও imbibe ( গ্রহণ ) করে । কালিদাসীর অনেক জিনিস ধরে গেছে । অনুশীলনের উপর যদি থাকে আরো অনেক শিখবে । মানুষ অকালে মুরুব্বি যদি হয় , তাহ’লে আর এগুতে পারে না ।
ঈষদাদা — আমি , নগেনদা ও ভূদেবদা টাকার জন্য মিলিত হয়েছিলাম মাতৃ বিদ্যালয়ে , কিন্তু দেখলাম , টাকার জন্য জোট বাঁধালে সে মিল টেকে না , পরস্পরের মধ্যে বিরোধ বাধেই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Sincerity ( আন্তরিকতা ) না থাকলে consolidation (সংহতি ) হয় না । একটা গুণ্ডার দল বা ডাকাতের দল করতে গেলেও sincerity ( আন্তরিকতা ) দরকার , দলপতির প্রতি টান দরকার । যেখানে sincerity (আন্তরিকতা ) সেখানেই consolidation ( সংহতি ) ।
কেষ্টদা — পরস্পর বিরোধ - বিবাদ - বিসম্বাদের মূল কারণ হলাে তিনটে sex - complex ( যৌন - প্রবৃত্তি ) , টাকাপয়সা ও অহমিকা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Sex - complex ( যৌন - প্রবৃত্তি ) হলো মূল , তার থেকেই অর্থলোলুপতা ও অহমিকা । মেয়েমানুষের জন্যই টাকা , মেয়েমুখতার জন্যই ইষ্টবিমুখতা , প্রবৃত্তিপরতন্ত্রতা এবং তদ্দুরনই অহমিকার উগ্রতা — আবার , তার ফলেই গণ্ডগোল । অনেকে বলে , বেঁচে থাকার জন্য টাকার প্রয়োজন , তাই টাকা চায় । কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই দেখবেন—
‘ পুরুষ মাগে নারীর প্রণয়
নারী মগে টাকা ,
এমনি করেই চলতি জগৎ
বাচা - বাড়ায় ফাঁকা ।’
কথাটা খাঁটি । মেয়েমানুষের কাছে টাকার জন্য হােক্ খায় , শেষটা করে কী ? যেন - তেন প্রকারে জোগাড় করতেই হবে । তখন আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না । যার সঙ্গে বিরােধ বাধালে তার নিজের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে , তার সঙ্গেই হয়তো বিরােধ বাধিয়ে বসে , হিতাহিত জ্ঞান থাকে না । Sex - complex- এর ( যৌন প্রবৃত্তির ) আওতায় পড়ে তখন ঐ অর্থের প্রয়ােজনবােধটা তাকে আর সুস্থপথে পরিচালিত করে না , নিজের অজ্ঞাতে চলন তার unbalanced ( সাম্যহারা ) হ'য়ে যায় । সুস্থ মস্তিষ্কে , স্থির চিত্তে বিচার - বিবেচনা ও কর্ম ক'রে প্রয়ােজন মেটাবার সামর্থ্য অনেকটা নষ্ট হয়ে যায় । আবার , অহমিকা যে উগ্রভাবে এক - এক জনকে পেয়ে বসে , তার পেছনে অনেক সময় থাকে বিশেষ কোন মেয়েছেলের কাছে হিম্মতদার পুরুষ হিসাবে অধিষ্ঠিত থাকার বুদ্ধি । মেয়ে ছেলেটা হয়তো ওকে তত খাতির করে না , কিন্তু সে দেখাতে চায় তাকে যে , সে সমাজের দশজনের কাছে খুব একটা মস্ত মানী মৰ্যাদাসম্পন্ন মানুষ । পরিবেশের কারও কাছ থেকে এ ব্যাপারে এতটুকু বাধা পেলেই সে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে । হামবড়ায়ী চালে নিজের প্রাধান্য জাহির করতে উঠে - পড়ে লেগে যায় । এইভাবে যে নিজেকে হাস্যাস্পদ করে সেটা বোঝে না । তার লঘুগুরু ভেদ থাকে না , আপনকে পর করতে , উপকারীর উপকার অস্বীকার করতে সে ডাইনে - বাঁয়েচায় না । ফল কথা , নিজের বাহাদুরীর জন্য , আত্মপ্রাধান্যের জন্য , আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সে যা - খুশি তাই করতে পারে । তাই , এদের নিয়ে চলতে খুব সাবধান । Wounded sex - complex ( আহত যৌন - প্রবৃত্তি ) থেকে যে ego ( অহং ) ও inferiority ( হীনম্মন্যতা ) , তা সপিল গতিতে মানুষকে জাহান্নমের সদর দরজায় নিয়ে হাজির করে । একরকম আছে ডাকারেখা অহঙ্কারী । তাদের একটা আত্মমুগ্ধতার ভাব থাকে , অন্যকে down ( খাটো ) করে বড় হবার প্রবৃত্তি তাদের খুব একটা উগ্র হয়ে থাকে না । কিন্তু নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধির উপর খুব একটা বলিষ্ঠ আস্থা থাকে , সেটাকে আঘাত করলে তারা রীতিমত চটে যায় , সামনা - সামনি দু'কথা শুনিয়ে ছেড়ে দেয় । এরা কিন্তু লোক ভাল । এদের নিয়ে চলতে খুব অসুবিধা নেই , আর , এদের mould ( নিয়ন্ত্রণ ) করাও সহজ । তবে যার যে - দোষই থাক , শ্রেয় - অনুরাগে পরিশুদ্ধ হয় না , এমন দোষ জন্মায়নি পৃথিবীতে । শুনেছি St. Augustine ( সাধু অগষ্টিন ) নাকি মস্ত বড় rogue ( বদমাইস ) ছিল । সে কিন্তু এক father ( ধর্মযাজক ) এর প্রতি sincere attachment ( একনিষ্ঠ অনুরাগ ) -এর দরুন sa ved ( উদ্ধার ) হ'য়ে গেল , মস্ত saint ( সাধু ) হ'য়ে দাঁড়ালো , শুনেছি Christian world- এ ( খ্রীষ্টান - জগতে ) তার position ( মর্যাদা ) হলো next to Christ ( যীশুখ্রীষ্টের পরই ) । তাই , যে যাই থাক , তার টানের মােড় ইষ্টের দিকে ফিরিয়ে দিতে পারলেই সব ফরসা ।
খুব তােড়ের সঙ্গে আলােচনা চলছে , এমন সময় হঠাৎ একটি মা এসে বললেন — বাবা ! ছেলেটা কেমন বেহুশ হয়ে পড়েছে , কাল রাত্রে খুব জ্বর হয়েছিল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আলােচনা থামিয়ে ব্যাকুলভাবে বললেন — বেহুশ হয়ে পড়লো কেন রে ? প্যারীকে নিয়ে যা , ভাল করে দ্যাখ । ও প্যারী!
প্যারীদা তখন একটু ঘরে গেছেন , তাকে ঘর থেকে ডাকা হলাে ।
প্যারীদা আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর গভীর উদ্বেগ নিয়ে চিন্তিতভাবে বললেন— ও প্যারী ! যা দেখে আয় তো , ওর ছাওয়াল বেহুশ হয়ে পড়লো কেন । কাল রাত্রে ব'লে জ্বর হয়েছে । দেখিস্ তাে ম্যালিগ্ন্যান্ট ম্যালেরিয়া - ট্যালেরিয়া নাকি । তাড়াতাড়ি ভাল করে দেওয়া চাই । ওর জন্য যা লাগে ব্যবস্থা করবি , নিজে না পারসি্ তো আমাকে বলবি ।
উক্ত মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই ২৪ পরগণা থেকে আগত একটি গরীবের ছেলে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে ধ'রে পড়লো — বাবা ! আমার বড় পড়ার ইচ্ছা , আমার বাবা নেই , বিধবা মা আছেন , তিনি পড়াতে পারেন না । আমি আপনার এখানে থেকে তপােবনে পড়ব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে সস্নেহে বললেন — এখানে থাকবি তো ! এখানে কিন্তু কষ্ট খুব । যদি স'য়ে থাকতে পারিস , থাক্ । ক্ষিতীশদার সঙ্গে দেখা করিস্ ।
ছেলেটি শ্রীশ্রীঠাকুরের কথায় খুব আশ্বস্ত হয়ে উঠলাে ।
বহিরাগত একজন আসিলেন মেয়ের বিয়ের সমস্যা নিয়ে , তিনি বললেন আমি কন্যাদায়গ্রস্ত গরীব ব্রাহ্মণ , আপনার হাতে একটি ভাল ছেলে আছে , আপনি মুখে বলে দিলেই বিনাপণে মেয়েটিকে দিতে পারি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কোন্ ছেলে ?
উক্ত ভদ্রলোেক — ছেলেটির বাড়ী ফরিদপুর । তাদের বাড়ীর সবাই সৎসঙ্গী , ছেলে নিজেও সৎসঙ্গী । তারা বললেন — ঠাকুর যদি বলেন , তবে করব , আমাদের দাবিদাওয়া কিছুই নেই , কারণ , কন্যাপক্ষকে চাপ দিয়ে পণ বা যৌতুক আদায় করা ঠাকুর পছন্দ করেন না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ঘর , বর সব দিক দিয়ে মিল যদি হয় , আর তারা যদি কাজ করতে চায় , সে তাে ভালই । বয়স্থা মেয়েদের বিয়ে যত হ'য়ে যায় , ততই তো ভাল । আজকাল তাে বামুন - কায়েতের মেয়ের বিয়ে দেওয়াই এক দুরুহ সমস্যা হ'য়ে দাড়িয়েছে । যা হােক দেখবেন — ছেলের বংশ যেন আপনার থেকে নীচু না - হয় । সমান - সমান যদি হয় , সেও বরং কিঞ্চিৎ নীচু বলে গণ্য হবার যােগ্য , আপনার বংশ থেকে কিছুটা উচু হয় সেইটা দেখবেন ; তা একান্ত সম্ভব না হ'লে সমান - সমান হওয়া চাই - ই । আর , ছেলেমেয়ের স্বাস্থ্য , বয়স , চরিত্র , প্রকৃতি , শিক্ষা ইত্যাদির সঙ্গতির দিকেও লক্ষ্য রাখতে হয় ।
উক্ত ভদ্রলোক - বংশের দিক দিয়ে ঠিকই আছে ,
ওরা আমাদের থেকে উচু ।
শ্রীশ্রীঠাকুর- -দেখেশুনে যদি পছন্দ হয় , করেন গিয়ে ।
উক্ত ভদ্রলােক — আপনি একখানা চিঠি লিখে দেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কেষ্টদার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে যান যেন ।
এর মধ্যে প্যারীদা এসে বললেন — দেখে তাে আসলাম , আপনি যা মনে করেছেন সত্যিই তাই , ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার case ( রোগী ) , এখন তাে অন্ততঃ ২০|২৫ টাকার ওষুধ লাগবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - হরিপদ ! ও হরিপদ ! পঁচিশটে টাকা দিবি লক্ষ্মী ?
হরিপদদা —হ্যাঁ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাহ'লে এখনই নিয়ে আয় ।
হরিপদদা ঘর থেকে টাকা নিয়ে আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — প্যারীরা হাতে দে ।
তারপর প্যারীদাকে বললেন — দেখাশুনো করার জন্য ভাল লোক মোতায়েন রাখিস , আর তুই নিজে গিয়ে বার - বার খবর নিবি । বরফের দরকার হলে কাউকে ঈশ্বরদী পাঠিয়ে বরফ আনবার ব্যবস্থা করবি ।
প্যারীদা হ্যাঁ ।
আলোচনার ধারা ব্যাহত হচ্ছে বলে অনেকেই বিরক্ত হচ্ছেন । ফাঁকে - ফাঁকে তাঁরা প্রশ্নাদি উত্থাপন করবার জন্যেও উসখুস করছেন । কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর সে দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য না দিয়ে প্রপীড়িত , অৰ্ত্ত ও অর্থার্থীদের যারা এসে পড়েছে , তাদের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতেই ব্যস্ত । তা না করে তার সােয়াস্তি নেই ।
সবাই মনে করছেন এখনকার মত ঝামেলা কেটে গেল — এইবার আবার আলােচনাদি সুরু হবে ।
এমন সময় শৈলমা এসে কোনদিকে লক্ষ্য না করে হঠাৎ কেঁদে পড়ে বললেন ঠাকুর , নিস্তারিণী আমাকে যা ’-তা ’ বলে অপমান করে , এ কিন্তু আমি সইব , না, আপনি এর প্রতিকার যদি করেন ভাল , নয় তাে আমি কিন্তু ছাড়ব না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হেসে বললেন — আমি কী করব রে ? তোকে নিস্তারিণী অপমান করে , আমি তার করব কী ? তােকে খুব ভালবাসে কিনা , তাই তার অধিকার দেখায় তোর উপর । তা ’ তুই চটিস্ কেন ? অরি চটসি্ই যদি , তাকে বলিস না কেন ? পাছে পিরীত চটে যায় , তাই তাকে বলতে সাহস পাও না , যত ঝাল অামার উপর ঝাড় , তাই না ?
শৈলমা — ছাই ভালবাসি আমি ওকে , ওই ইল্লতের সঙ্গে আবার পিরীত ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( মধুর কণ্ঠে ) —ওকে ছাড়াও তো তোমার চলে না ।
শৈলমা ( গর্ব্বভরে ) —ওই তাে আমার পোঁদে - পোঁদে ঘােরে । আমি ওকে থােড়াই কেয়ার করি । ( সকলের হাস্য )
এরপর ইয়াদালি ( গ্রামস্থ মুসলমান ) এসে জানালো — তার একখানা ঘর তােলা দরকার , সাহায্যের প্রয়ােজন । শ্রীশ্রীঠাকুর তখন ভবানীদাকে ( ক্যাশিয়ার , সৎসঙ্গ ফিলান্থ্রপি অফিস ) ডাকিয়ে তাকে প্রয়োজনমত সাহায্য করতে বললেন । নিরন্তর চলেছে তার এই দান । সেবা , সম্পােষণা , অন্ন , বস্ত্র , বাসস্থান , ঔষধ , পথ্য , অর্থ , শিক্ষা , সদুপদেশ ইত্যাদি সর্ব্বপ্রকার বাস্তব সাহায্য - দানে তিনি জাতিধর্ম নির্ব্বিশেষে প্রত্যেকটি প্রয়ােজন - পীড়িত নরনারীকে অক্লান্তভাবে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করে চলেছেন। অজস্র , অবিরাম তার এই অবদান । নিজের শরীরে মানুষের কোন ক্ষত হ'লে মানুষ যেমন তা সারাবার জন্য উঠে - পড়ে লাগে , প্রত্যেকটি ব্যক্তির যে - কোন প্রকার দুঃখ - ব্যথা দেখে তার নিরসনের জন্যও তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন । তার প্রধান কাজ হলো ধর্মদান , যার ভিতর - দিয়ে মানুষ ঈশ্বরমুখী হয়ে ওঠে , ইষ্টপ্রাণ সেবামুখর হয়ে ওঠে , যােগ্য হয়ে ওঠে জীবনে । তার সক্রিয় ঈশ্বরনিষ্ঠ লোককল্যাণব্রতী জীবনই আজ সৎসঙ্গ - আন্দোলনে রূপায়িত । তার জীবনধারাই লক্ষ - লক্ষ নরনারীর জীবনকে স্পর্শ করে , প্রভাবিত করে ইষ্ট , অহং ও পরিবেশের সমন্বয়ে এক নূতন সঙ্গতিমুখর প্রেমপ্রতুল জগৎ রচনার কাজে অমোঘভাবে এগিয়ে চলেছে।সে - জগতে “ সকলের তরে সকলে আমরা , প্রত্যেকে আমরা পরের তরে । ” এই নূতন জগতের ধারক , বাহক , রক্ষক ও প্ৰমূৰ্ত্ত বিগ্রহ তিনি স্বয়ং । তাই দেখতে পাই , সব থেকেও নিজের জন্য তার কিছুই নয় । তার জ্ঞান , গুণ , শক্তি , সামর্থ , সময় , যা - কিছু সবই ঈশ্বরের জন্য , মানুষের জন্য । নিজের বলতে তার কিছুই নেই । ‘ যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্তে কিছু তব নাই , তুমি তাই পবিত্র সদাই । মানুষের অন্তরের স্বতঃ উৎসারিত বাস্তব অবদান তাঁতে অর্ঘ্যান্বিত হয়ে ধন্য হ'তে আসে , কিন্তু তার এক কপর্দ্দকও তিনি স্পর্শ করেন না , সবই ব্যয়িত হয় প্রয়ােজন - পীড়িত মানুষের জন্য । বিশ্বম্ভর তিনি , বিশ্বকে ভরণ করার আকুতি তাকে কিছুতেই ছাড়ে না । তাই স্বতঃই যা আসে , তাও ফিলান্থপির মাধ্যমে লােককল্যাণে ব্যয়িত হয়ই । তাছাড়া , নিত্য ভিক্ষা করেও কি তিনি কম লোকের অভাব মেটান ? তবে , যখন যার জন্য বা যে - জন্য যাকে দিয়ে যা ’ সংগ্রহ করেন , কারও মাধ্যমে তাকে তা দিয়ে দেন । নিজ হাতে পয়সা ছােঁন কমই । এত ভিক্ষা করেন তিনি , কিন্তু নিজের জন্য চান না তিনি কিছুই । তিনি নিজেকে নিঃশেষে উজাড় ক’রে দিয়েই খুশি । পরমপুরুষই যা - কিছু হ'য়ে আছেন , প্রতি দেহে দেহী তিনিই , প্রান তার পরিব্যাপ্ত ঘটে - ঘটে । তাই প্রত্যেকের উপভোগের মধ্য দিয়েই যেন তার প্রকৃষ্ট আত্মোপভোগ — যেমন , ভাল জিনিসটা নিজেরা না খেয়ে সন্তানকে খাইয়েই তার আস্বাদটা বেশী করে উপভােগ করেন মা - বাপ । উপভোগের নেশাই তাকে ধাবিত করে চলেছে পরিবেশের সর্বতোমুখী সুখ , সন্তোষ ও কল্যাণ সাধনে । ‘ ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ ' কথাটার মানে কী , তা তার জীবন দেখলেই বােঝা যায় ।
এমনতর লোকস্বার্থী পুরুষকে কেন্দ্র করে উদ্ভিন্ন হয়ে ওঠায় সৎসঙ্গের আওতায় জাতিধৰ্ম - নিবিশেষে দীক্ষিত - অদীক্ষিত কত লোক আজ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে পরম নির্ভাবনায় অানন্দে জীবন যাপন করছে । সৎসঙ্গ ফিলান্থ্রপি , ঋত্বিক্ সঙ্ঘ , স্বস্তিসেবকসঙ্ঘ , দাতব্য চিকিৎসালয় , পােবন বিদ্যালয় , বিজ্ঞানালয় , কেমিক্যাল ওয়ার্কস্ , মেকানিক্যাল ওয়ার্কস্ , ইঞ্জিনীয়ারীং ওয়ার্কস্ , প্রেস , আর্ট স্টুডিও , কুটির - শিল্পবিভাগ , কৃষিক্ষেত্র ইত্যাদি প্রত্যেকটি জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান ( যা প্রয়োজনের তাগিদে উদ্ভিন্ন হ'য়ে উঠেছে স্বতঃ - উৎসারণায় তাঁকে কেন্দ্র করে ) ও লক্ষ - লক্ষ ইষ্টপ্রাণ সেবাব্রতী সৎসঙ্গীর সেবালাভে সম্পু্ষ্ট হচ্ছে তারা । সর্বোপরি আছে সৎসঙ্গের জীবন্ত - বিগ্রহ শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রেম , প্রেরণা , প্রয়ােজনােপযােগী সেবা ও দেবত্ব - উদ্দীপী পরশ । তার স্পর্শে কত জীবন যে আজ ভাগবতচেতনায় উন্নীত হয়ে উঠছে , তার লেখাজোখা নেই । পৃথিবীতে এক নূতন দৈবী - সংহতির অভ্যুদয় হচ্ছে তাকে আশ্রয় করে । তাই কেবলই মনে হয় , এমনতর প্রেমজ্ঞানমূর্ত্তি নিখিলস্বাৰ্থী কোন মানুষ যদি আজ বিশ্বের যাবতীয় ব্যাপারের নিয়ামক হয়ে থাকতেন তাহলে পৃথিবীতে মানুষের জীবন কতই না সুখ , শান্তি ও আনন্দময় হয়ে উঠতাে ; হয়তাে আজকের মত যুদ্ধবিগ্রহ , পারিবারিক বিদ্বেষ ও স্বার্থ - সংঘাতের উদ্ভবই হতাে না ।
এরপর খলিলদা আসিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর আদর ক’রে খলিলদাকে ডেকে বসালেন ।
খলিলদার দিকে চেয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর সস্নেহে বললেন — আজকাল নামটাম খুব করছেন , তাই না খলিলদা ?
খলিলদা — আর তো কোন কাজকর্ম নেই , যতটা পারি করি , আর বেশ ভালই লাগে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — চেপে নাম - ধ্যান যদি করা যায় , আর কিছু না হোক , শরীর ভাল হবেই ।
খলিলদা — মনটা খুব ভাল থাকে , তাই তার জন্য শরীরও ভাল হয়ে ওঠে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আপনারই দেখেন না ! এসেছিলেন কেমন শুটকি চেহারা নিয়ে , অল্প কয়দিনে কেমন নধরকান্তি হ'য়ে উঠিছেন । খুব চেপে করেন । কী পেলেন না - পেলেন , দেখলেন না - দেখলেন , সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে মনের আনন্দে নেশার মত করে যান । অবসাদের ভাব আসলেও ছাড়বেন না , দ়াঁড় টেনে চলবেন । দেখবেন স্তরের পর স্তর অতিক্রম করে অপসে - আপ কতদূর এগিয়ে যাবেন । •••••••••••• ( শ্রীশ্রীঠাকুর একটু , থেমে মিষ্টি হেসে অন্তরঙ্গ সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ) —আচ্ছা খলিলদা ! মােস্তাফা - চরিতে ও কোরাণে যে নূর ও আওয়াজের কথা পড়েছেন , তার সঙ্গে মিল পান না ?
খলিলদা — হুবহু মিল , আগে তাে মনে হতাে ওসব আজগবী ব্যাপার ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাই তাে একে বলে বিজ্ঞান । যে করবে , সেই পাবে , তারই হবে। সব শেয়ালের এক রা , যুগে - যুগে একই কথা , দেশকাল - পাত্রোপযােগী করে বলা । তবে ঐ নবীর প্রতি আনুগত্য চাই , নবীকে বাদ দিয়ে রসুলকে বাদ দিয়ে খােদার রাজ্যে পৌছাবার উপায় নেই । রসুলকে বুঝতে গেলে আবার বর্তমান যুগে প্রকৃত রসুলসেবী যে , খােদাসেবী যে , তার সান্নিধ্যে আসতে হয়। তা’ না হ’লে কিন্তু বােধই গজায় না ।
খলিলদা — সে আমি আমার নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর মসগুল হ'য়ে অনর্গল বলে চলেছেন । আয়ত আঁখি - যুগলে স্নেহ - করুণার পীযুষ - ধারা , মুখমণ্ডলে আনন্দের দীপ্তি , অধর - পল্লবে লাবণ্য মণ্ডিত হাসির বিজলী - রেখা , কণ্ঠস্বরে ললিত গাম্ভীৰ্য , প্রতিটি অঙ্গ - ভঙ্গীতে তার মােহন - মাধুৰ্য্য , ক্ষণে - ক্ষণে অভিব্যক্তিতে তার লীলায়িত বৈচিত্র্য , মনভােলান , ক্ষণভােলান , ভুবনভােলনি অপরূপ চরিত্র - ঐশ্বৰ্য্য নিয়ে রাজ - অধিরাজ বসে আছেন সম্মুখে , কার সাধ্য আছে তার দিক থেকে চোখ ফিরায় ? তাই মােহিত হ'য়ে , ভাববিভাের হ’য়ে , তঁদেকচিত্ত হয়ে তাঁর অনবদ্য কথামৃত আকণ্ঠ পান করছেন সমবেত ভক্তবৃন্দ , অনির্বচনীয় সুধা - সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গিয়ে খানিকটা সময়ের জন্য দুনিয়ার দুঃখ - জ্বালা - যন্ত্রণা ভুলে গেছেন তাঁর , পুণ্য - সঙ্কল্পের উগ্র আবেগে টলমল ক’রে কাঁপছে তাঁদের সারাটি সত্তা ।
অবিনাশদা ( ভট্টাচাৰ্য ) জিজ্ঞাসা করলেন — মূল সংঙ্কল্প আমরা যেমনভাবে গ্রহণ করি , ভবিষ্যৎ কাজ কি তারই উপর নির্ভর করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সংঙ্কল্প মানে শুধু মানসিক চিন্তা নয় , এর অর্থ চিন্তা ও কর্মের ভিতর - দিয়ে যোগ্যতায় চলা । সঙ্কল্প মানে নূতন সৃষ্টির আবেগময় কর্মমুখর পরিকল্পনা , কী করতে হবে , কেমন করে করতে হবে তার একটা চিত্র মাথায় একে নিয়ে তার উদ্যাপনে যখন আমরা বিধিবদ্ধ প্রণালীতে চলি , তাকে বলা যায় সঙ্কপের পথে চলা । সঙ্কল্প যখন আমাদের পাকা হয় , তখন কোনরকম প্রতিকূলতা আর আমাদিগকে তা’ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করতে কমই পারে , আমরা তখন নাছোড়বান্দা হয়েই লাগি । অবশ্য যা ’ তা ' সংঙ্কল্প করলে হবে না , সঙ্কল্প হওয়া চাই শুভ - সন্দীপী , ইষ্টার্থ - পােষণী । এমনতর সঙ্কল্প নিয়ে যখন চলি তখন আমাদের চরিত্র ও বুদ্ধিবৃত্তি উৎকর্ষ লাভ করে । কারণ , তখন বাধাবিঘ্নকে জয় করে , অতিক্রম করে , নিয়ন্ত্রিত করে , কাজ হাসিল করা আমাদের কাছে একটা স্ফূৰ্ত্তির ব্যাপার হ’য়ে দাড়ায় ।
প্রফুল্ল — দুর্ব্বলতা কি রক্তবীজের ঝাড়ের মত ? কিছুতেই যে যেতে চায় না , এক - এক স্তরে এক - এক ভাবে আবির্ভূত হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দুর্বলতা যেমন রক্তবীজের ঝাড় , পারগতাও তেমনি রক্তবীজের ঝাড় — একটা মরণের property ( সম্পদ্ ) আর - একটা তরণের property ( সম্পদ্ ) , যেটাকে nurture ( পােষণ ) দাও , সেইটাই বাড়বে । পারগতার পথ খােলাই আছে , চললেই হয় , করলেই হয় । এক পা এগুলে , দশ পা এগুবার পথ পরিষ্কার হয় । কিন্তু পূর্বের অকামগুলি বাধা সৃষ্টি করবেই , তাতে ঘাবড়াতে নেই । যা করণীয় , ফিঙ্গে হয়ে লেগে যদি করতে থাক — চলার পথে ভুলগুলিকে শুধরে - শুধরে — তবে কিছুদিন পরে দেখতে পাবে ঐ চলনই তোমার অভ্যাসগত হয়ে উঠেছে , তখন আর অতাে কষ্ট হবে না । হাতিঘােড়া কিছু না , করলেই হয় । জীবনের ধৰ্ম্ম বঁাচা - বাড়া , ভগবান আমাদের সব সম্পদ দিয়ে দিয়েছেন যাতে আমরা বাঁচতে পারি , বাড়তে পারি । যত অকামই করে থাকি , যত দুৰ্বলতাই আমাদের ঘিরে ধরুক , সবলতাই আমাদের সহজাত সম্প । যে - কোন অবস্থায় ইচ্ছা করলে , লহমায় আমরা চলনার মােড় ফিরিয়ে ঝেড়ে দাড়াতে পারি , সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সর্বদাই তাঁর শক্তি নিয়ে আমাদিগকে বাঁচার পথে চলতে সাহায্য করতে প্রস্তুত । কোন ভাবনা নেই , লেগে যাও , সব ঠিক আছে । আমাদের cell ( কোষ ) -গুলি leaden jar ( সীসার পাত্র ) -এর মত , energy ( শক্তি ) stored up ( সঞ্চিত ) থাকে , যত করবে , তত পারবে । প্রত্যেকটা করা তার effect ( ফল ) রেখে যাবে । শুনেছি ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলেছেন — বার বৎসর ব্রহ্মচর্য পালন করলে মেধানাড়ী গজায় । ব্রহ্মচর্য মানে বৃদ্ধির পথে চলা , ইষ্টের পথে চলা । ইষ্টের পথে চলতে - চলতে মানুষের বেভুল চলন , বিভ্রান্ত চলন , বিস্মৃত চলন খতম হয়ে যায় , ইষ্টস্বার্থ - প্রতিষ্ঠার বুদ্ধি তার এমনই মজ্জাগত হয়ে ওঠে যে কিছুতেই তা থেকে বিচ্যুত হয় না , ও - সম্বন্ধে খেয়াল - হারা হয় না সে কখনও , ঐ স্মৃতি - চেতনা তার টন্টনে থাকে ; ভুলেও সে অন্য চলনে চলে না , বেচালে পা পড়ে না তার কখনও , তার অবগুণ যদি থাকে , তাকেও ইষ্টস্বার্থ - প্রতিষ্ঠার কাজে লাগায় তখন । তাই বলেছেন , মেধানাড়ী গজায় অর্থাৎ ঐ স্মৃতি , ঐ ধৃতি স্বভাবগত হয়ে সর্বক্ষণ তাতে জাগ্রত ও সক্রিয় থাকে ।
একটু থেমে ইন্দুদার ( বসু ) দিকে স্নেহল দৃষ্টিতে চেয়ে মনোহর ভঙ্গীতে বললেন — সপ্রতিনিধি তোমরা সবাই যদি তপস্যাপূত পরিশ্রমের উপর থাক ও ছাত্রদেরও অমনতর পরিশ্রমের উপর রাখ , তবে আশ্রম ও তপােবন নাম সার্থক হবে। তখন বলতে পারবে — ‘ মানুষ হতেছি পাষাণের কোলে , যােগ্য হতেছি কাজে ’ | ( একটু ঘুরে ব'সে উল্লাসব্যঞ্জক দৃপ্তকণ্ঠে বললেন ) —কিছু ভাবনা নেই , আবার সব টেনে তুলবোনে চচ্চড় ক'রে ।
সবার মুখে তখন আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছে ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে সস্নেহে টালুস - টুলুস ক'রে এর - ওর মুখের দিকে চেয়ে - চেয়ে দেখছেন — চোখে - মুখে তার চতুর - চপল মনমাতানো ইশারা ও ইঙ্গিত । সবার মন খুশিতে ভরা । একটা খুশির তরঙ্গ ঢেউ খেলে যাচ্ছে তাসুর মধ্যে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন — কটা বাজে রে ?
একজন বললেন —৭ টা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর খানিকটা চিন্তিতভাবে বললেন — ভােলানাথদার আজ অাসার কথা ছিল আমনুরা প্যাসেঞ্জারে , এখনও তাে আসলো না ।
শরৎদা ( হালদার ) বললেন — এখনও আসবার সময় যায়নি , কোন - কোন দিন ট্রেন ‘ লেট ’ থাকে , অবার ‘ বাসে’ও অনেক সময় দেরী হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কি জানি ? কারও আসবার কথা থাকলে , সময় মত না আসলে , আমার বড় দুশ্চিন্তা হয় । ঘরপােড়া গরু সিন্দুরে মেঘ দেখলে ডরায় ।
কথাবার্ত্তা হচ্ছে এমন সময় ভােলানাথদা ( সরকার ) এসে হাজির হলেন ।
ভােলানাথদাকে দূর থেকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার ক'রে সোল্লাসে ব'লে উঠলেন — আইছেন ভােলানাথদা ! ওরে আমার মাণিক রে । আমি তো ভেবে - ভেবে সারা । কেবল ভাবছি — এত দেরী হচ্ছে কেন ?
ভােলানাথদা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে জুতাে খুলে প্রণাম ক’রে হাসিমুখে বললেন — আজ গাড়ী একটু , ‘ লেট ’ ছিল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সোয়াস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ) —যাক , এসে তাে গেছেন ।
কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —চলতে - চলতে মানুষের energy ঢলঢলে হয়ে যায় কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — যে যত বিকেন্দ্রিক , অথাৎ Ideal- কে ( আদর্শকে ) ধরণ ( ধরা ) যার যত কম , জীবন তার তত কম । কারণ , মানুষকে হয় আদর্শের পথে চলতে হয় , না - হয় প্রবৃত্তির পথে চলতে হবে , এ - ছাড়া কোন তৃতীয় পন্থা নেই । প্রবৃত্তির পথে মানুষ যত চলে , তার energy ( শক্তি ) তত dissipated (অপব্যয়িত ) হয় , তাই লাভজনক যা ’ , জীবনীয় যা ’ তেমনতর ব্যাপারে সে স্বতঃই শ্লথ হ'য়ে ওঠে । প্রবৃত্তি তার সত্তার রস খেয়ে শুষে নিয়ে যায় , তাই সত্তা সমৃর্দ্ধনী প্রচেষ্টায় তার খাঁকতি এসে পড়ে । ধর , তোমার শরীরে যদি রক্তক্ষয়ী কতকগুলি রােগজীবাণু এসে বাসা বাঁধে , তখন তারা তােমার রক্ত খেয়ে নিয়ে পুষ্ট হ'তে থাকবে , এর ফলে তােমার শরীর - পােষণেপযােগী রক্তে কমতি পড়বে । এ হ'তে বাধ্য । Ideal - centric urge ( ইষ্টকেন্দ্রিক আকূতি ) হ'লাে মানুষের সমস্ত শক্তির উৎস । ঐ urge ( আকূতি ) না থাকলে energy ( শক্তি ) থাকে না energy ( শক্তি ) না থাকলে depressed ( অবসন্ন ) হয় , অপটু হয় ।
কথাবার্তা হচ্ছে , এমন সময় আলিমদ্দি ( গ্রামস্থ জনৈক মুসলমান ) আশ্রমের উপর দিয়ে রস নিয়ে যাচ্ছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তাকে দেখে বললেন — দাড়া । তাের ভাঁড়ে কী ?
আলিমদ্দি — রস ।
শ্রীশ্রীঠাকুর- —ভাল আছে তো ?
আলিমন্দি — জে , ভাল আছে ।
পেরথম কাটের রস , মধুর মত মিঠে , আর দেখতিও খুব পরিষ্কার । এই দেখেন ( এই বলে ভাঁড় নিয়ে সামনে এগিয়ে আসলাে ) ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মাল তাে মনে হয় তোফা মাল । ও রূপু ! খাবি নাকি ?
শৈলমা — এত সকালে খাব ?
মুখটুক যে ধুইনি , কাপড় ছাড়িনি , ইষ্টভৃতি করিনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওরে পাগল ! খাবি তো তাড়াতাড়ি সা’রে আয় । ( চোখ মুখ ঘুরিয়ে ) এমন বাহারের মাল আর পাবি না ।
শৈলমা — দেরী হবে যে । অাজ থাক ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাহ'লে আলিমদ্দি তুই যা । ও তো খাবে না ।
আলিমদ্দি প্রস্থানেদ্যত ।
শৈলমা — আমি বলছিলাম — একটু দেরী হবে , অতো সময় কি ও দাঁড়াবে?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাই বল ! তাের খাবার ইচ্ছে আছে । অমন ঢং করিস্ কেন ?
যা , খাবি তাে তাড়াতাড়ি আয় । শৈলমা চকিতে উদ্ধশ্বাসে দৌড় মারলেন । সকলে হাসতে লাগলেন । শ্রীশ্রীঠাকুরও সেই সঙ্গে হাসছেন ।
একটু বাদেই শৈলমা এসে হাজির হলেন — একটা ঘটি নিয়ে ।
আলিমদ্দি রস ছেঁকে এক ঘটি ভ'রে দিল । শৈলমা ঢকঢক ক’রে খেয়ে ফেললেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ও উপস্থিত সকলেই তৃপ্তিভরে দেখতে লাগলেন ।
ও আলিমদ্দি ! আর - এক ঘটি লাগাও । — হেসে বললেন শ্রীশ্রীঠাকুর ।
আলিমদ্দি আর - এক ঘটি দিল । শৈলমা সে - ঘটিও ধীরে - ধীরে নিঃশেষ করে ফেললেন । খেয়ে - দেয়ে চোখ দুটো বিস্ফারিত করে শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে চেয়ে রইলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — চলুক !
শৈলমা ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন- আর না ঠাকুর । অার পারব না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মিষ্টি কেমন ?
শৈলমা — খুব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এমন জিনিস রােজ পাবি না । প্রাণডা ভ'রে খেয়ে নে ।
শৈলমা — না ! আর পারব না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — এ তাে জলের মত । প্রস্রাব হয়ে বেরিয়ে যাবে । অার - এক ঘটি রেখে দে । এখন না হয় পরে খাবি ।
শৈলমা — তা ’ রাখা যায় ।
আলিমদ্দি আর - এক ঘটি দিয়ে বিদায় নিল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ইঙ্গিত করতেই একটি দাদা আলিমদ্দিকে রসের দামটা দিয়ে দিলেন ।
নগেনদা ( বসু ) —আমার কী হ'লাে , আমি তাে অধঃপাতে চললাম ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — গেলে ঠেকাবে কে ? না গেলেই হয় ! ‘ সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ , কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে , ক্রোধাৎ ভবতি সম্মােহঃ , সম্মােহৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ । স্মৃতিভ্রংশৎ বুদ্ধিনাশো , বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ’ , ( সঙ্গ থেকে কামনা আসে , কামনা থেকে অাসে ক্রোধ , ক্রোধের থেকে আসে সম্মােহ , সম্মােহ থেকে আসে স্মৃতিবিভ্রম , স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ হয় এবং বুদ্ধিনাশ থেকে মানুষ নষ্ট পায় ) —এই একদিকে যেমন আছে , আবার আছে — সঙ্গাৎ সঞ্জয়তে শ্রদ্ধা , শ্রদ্ধয়া দৃষ্টিশুদ্ধতা , দৃষ্টিশুদ্ধোর্হি বিশ্বাসঃ , বিশ্বাস্যৎ নির্ব্বিচারতা , নির্ব্বিচারাৎ ভবেৎ প্রেম , প্রেম্নশ্চাত্মসমর্পণম্ ’ ( সঙ্গ থেকে আসে শ্রদ্ধা , শ্রদ্ধা থেকে আসে দৃষ্টিশুদ্ধতা , দৃষ্টিশুদ্ধি থেকে আসে বিশ্বাস , বিশ্বাস থেকে আসে নির্ব্বিচারতা , নির্ব্বিচারতা থেকে প্রেমের উদয় হয় । প্রেমের পরিণতি আত্মসমর্পণে ) । আপনি টাকার জন্য কাম করেন , তাই টাকা হয় না , কিন্তু মানুষের যদি interest ( স্বার্থ ) হ'য়ে উঠতে পারতেন , তা’তে সব হতাে । তাই বলে টাকার লােভে যদি তা করতে যান , তবে হবে না । মনে পড়ে সেই কাঠুরিয়ার গল্প ? কাঠ কাটতে - কাটতে তার কুড়োল পড়ে গেল জলে , সে তখন জলদেবতার কাছে কেঁদে প্রার্থনা করতে লাগলো । ঠাকুর ! আমি গরীব মানুষ , কাঠ কেটে খাই , কুড়ােলটা গেলে আমি না - খেয়ে মরব , আর - একটা কুড়োল কেনবার সাধ্যও আমার নেই। দয়াল ঠাকুর ! তুমি দয়া করে আমার কুড়োলটা ফিরিয়ে দাও । তুমি ইচ্ছা করলে সব পর । আমায় তুমি দয়া কর । জলদেবতা তখন এক সােনার কুড়ােল হাতে নিয়ে জল থেকে উঠে এসে বললেন — তুমি দুঃখ করাে না , এই নাও তোমার কুড়ােল । কাঠুরিয়া তখন কেঁদে বললাে — প্রভু ! এ কুড়ােল দিয়ে আমি করবো কী ? এতে তাে কাঠ - ফাড়া চলবে না । অর , এ তো অামার কুড়োল নয় । আমি এ নিই কি করে ? এরপর জলদেবতা বললেন — আচ্ছা ! তাহলে " তােমার কুড়ােল নিয়ে আসছি । জলে ডুব দিয়ে এইবার তিনি এক রুপাের কুড়োল নিয়ে এসে হাজির হলেন । কাঠুরিয়া বিনীতভাবে বলল — ঠাকুর , এ কুড়োলও তো আমার নয় । আপনাকে কী - ই বা বলি ? আপনি যখন সদয়ই হয়েছেন আমার প্রতি , আমার কু়ড়োলখানা দিন । এইবার জলদেবতা কাঠুরিয়ার নিজস্ব কুড়ােল নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন — এই কুড়ােল তােমার ? কাঠুরিয়া মহাখুশি হয়ে বললাে — হ্যা ! এই কুড়ােলই আমার । তখন জলদেবতা তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তিনখানি কুড়ােলই তাকে দিয়ে গেলেন । তাই শুনে আর একজন ফন্দী করে জলে কুড়োল ছুড়ে ফেললো । কুড়ােল ফেলে দিয়ে জলদেবতাকে ডাকতে লাগলো । জলদেবতা একটা সােনার কুড়োল এনে জিজ্ঞাসা করলেন — এই কুড়োল তােমার ? সে অমনি বললো — হ্যাঁ । এইটেই আমার । তখন দেবতা অন্তর্হিত হলেন । তার নিজের কুড়ােলটা পর্যন্ত সে পেল না । তাই লোভের পথে চলা , অসাধুতার পথে চলা মানেই আত্মপ্রবঞ্চনা করা । বেকুব - বেহেড যারা তারাই অমন ক’রে থাক । যাদের এতটুকু মাথা আছে তারাই পরার্থকে স্বার্থ ক’রে নেয় , সততার পথে চলে , ক'রে পেতে চায় তারা ।
করে পাওয়ার কথা শুনে যারা ঘাবড়ে যায় , বুঝতে হবে তাদের মগজে ঘুণ ধরে গেছে , তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন । অর্থাৎ টেনে - হেঁচড়েও তাদের কাজের মধ্যে নামাতে হবে , আর পেছনে লেগে থেকে কাজের মধ্য দিয়ে তাদের কৃতিত্বে পৌছে দিতে হবে । Nothing succeeds like ( সাফল্যের মত সফল হয় না আর কিছুই ) । সাফল্যের একটা নেশা আছে । একবার যদি মানুষ কৃতকার্য হয় , তার ভিতর দিয়ে তার একটা আত্মপ্রসাদ আসে । নানাব্যাপারে তেমনতর আত্মপ্রসাদলাভে ধন্য হ'তে চায় সে ।
আবার , দেওয়ার ফন্দি - ফিকির যদি কারও মাথাও থাকে , তবে সে নষ্ট পায় না । গুরুজনকে দেওয়ানর অভ্যাস ছােটবেলা থেকে করে দিতে হয় । মা শেখাবে বাপকে দিতে , বাপ শেখাবে মাকে দিতে — আলুটা , পটলটা , ফুলটা , ফলটা , পাতাটা , নুড়িটা , কুলটা কিংবা যাই - ই হােক । আবার , ছেলেপেলে কিছু দিতে আসলে বাহবা দিয়ে অগ্রহভরে সেটা নিতে হয় । মাকে যখন দিতে আসবে , মা উসকে দেবে বাবাকে দেবার জন্য , বাবাকে যখন দিতে আসবে , বাবা চেতিয়ে দেবে মাকে দেবার জন্য । মায়ের অসাক্ষাতে বাবা সন্তানের কাছে তার মায়ের কথা এমন লােভনীয় করে বলবে যে মায়ের জন্য শ্রদ্ধা - ভক্তি - ভালবাসায় তার বুকখানা ফুলে - ফেঁপে ওঠে । আবার , মা - ও অমন ক'রে বাবার সম্বন্ধে বলবে । এমন ক'রে ভালবাসার প্লাবন যদি এনে দিতে পার তাদের জীবনে , দেখবে কত সুখী হবে তারা , কত সুখী হবে তােমরা , প্রত্যেকটা বাড়ী - ঘর তখন দেব - দেউঁল হ’য়ে উঠবে। এ কি আমার পাগল অাশা ? এতটুকু আশা করা কি আমার অন্যায় ?
তার চোখ - মুখ যেন আবেগে ফেটে পড়ছে । সকলের অন্তর ভাবের আতিশয্যে দুলে - দুলে উঠছে ——
এইবার তিনি আপন মনে গান ধরেছেন —
‘ তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মাের প্রাণে
এ আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে ।
যত সব মরা গাছের ডালে ডালে
নাচে আগুন তালে তালে
আকাশে হাত তোলে সে কার পানে ?
আঁধারের তারা যত অবাক হ’য়ে রয় চেয়ে ,
কোথাকার পাগল হাওয়া বয় ধেয়ে ।
নিশীথের বুকের মাঝে এই যে অমল
উঠল ফুটে স্বর্ণকমল ,
আগুনের কী গুণ আছে কে জানে ।
গানের পর শিক্ষা - সম্বন্ধে আবার কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সহজভাবে বলছেন — পাঁচ বছরের মধ্যে অভ্যাস , ব্যবহার , ঝোঁক ঠিক করে ছেলেদের সাশ্রয়ী । সুন্দর অর্ঞ্জনপটু করে তুলতে হয় । ••••••••• স্বামীর যদি স্ত্রীর প্রতি স্নেহল মমত্বপূর্ণ ভাব থাকে , তাতে তার sexual life ( যৌন - জীবন ) অনেকখানি adjusted ( সুনিয়ন্ত্রিত ) হতে থাকে , abnormal sexual urge ( অস্বাভাবিক যৌন - সম্বেগ ) থাকে না , অন্য মেয়েদের প্রতিও তার normal attitude ( সহজ ভাব ) আসে , এতে দাম্পত্য - জীবন মধুর হ’য়ে ওঠে । অবশ্য , মা’র তাে ছেলের বাপের প্রতি অর্থাৎ তার স্বামীর প্রতি ভক্তি থাকাচাই - ই । পিতামাতার দাম্পত্য - জীবন যেখানে যত সুন্দর , সন্তানও সেখানে তত সব দিক দিয়ে ভাল হয়ে ওঠে , অবশ্য বিয়েটা ঠিক মত হওয়া চাই । আর , with every emphasis ( সমস্ত জোর দিয়ে ) , with every urge ( সমস্ত আকূতি দিয়ে ) , with every attitude ( সমস্ত ভাব দিয়ে ) , with every expression , ( সমস্ত অভিব্যক্তি দিয়ে ) বাঞ্ছিতপ্রাণতা effulge ( প্রোজ্জ্বল) করে দেওয়াই education- এর ( শিক্ষার ) মূল । Ideal centric urge ( ইষ্ট - কেন্দ্রিক অকূতি ) আসলে সবার character ( চরিত্র ) ফুটে উঠবে , একটা ছেলেও inferior ( নিকৃষ্ট ) থাকবে না , মিসমার কাণ্ড হয়ে যাবে ।
একটু আগে আদিত্য ও মঞ্চাই ( গােপালদার ছেলে ) এসে দাঁড়িয়েছে । মঞ্চাই ফুটফুটে ছােট্ট ছেলেটি , গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে প্রবীণ লোকের মত । শ্রীশ্রীঠাকুর আদরের সুরে পরপর তিন বার বললেন — মুঞ্চু রাজার গালে হাত , মুঞ্চু রাজার গালে হাত , মুঞ্চু রাজার গালে হাত ।
মঞাই হাসতে লাগলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আদিত্য , মঞ্চাইয়ের মধ্যে গােপালের ভাবটা টের পাওয়া যায় । এখনি যেন ঝুন দেয় । ••••••••• বড়খােকা , মণি , কাজল — এদের প্রত্যেকের মধ্যে লক্ষ্য করলেই আমাকে দেখতে পাবেন । এদের প্রত্যেকেরই দেখতে পাবেন সবার উপর খুব দরদ । কাজল যে অতটুকু ছেলে , ওর সামনে সেইদিন কামলারা বাঁশ কাটছে , ও তাই দেখে অস্থির , তাদের বারণ করে , বলে ব্যথা লাগছে , কেটো না , আবার ওর মাকে বলে — মা বাঁশটাকে মিনু দাও , ওর গা কেটে দিচ্ছে ।
কেষ্টদা - ওদের রকমই আলাদা । বড়খোকার গােপন দানের লেখা - জোখা নেই । নিজে না খেয়ে মানুষকে খাওয়ায় , এত কষ্ট করে থাকে ছেলেপেলে নিয়ে , সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই , প্রার্থী এসে ওর সামনে দাঁড়ালেই হলো ।
এরপর কেষ্টদা জিজ্ঞাসা করলেন — গুরুকে মানুষ ভাবা নিষেধ কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওতে urge ( আকূতি ) ক’মে যায় , তাই ব’লে অমানুষ ভাবতেও বলেনি । ওই অজুহাতে তঁার দুঃখ - ব্যথায় আমরা যদি বিচলিত না হই , এবং তার নিরাকরণের চেষ্টা যদি না করি , যেমনটা আমরা প্রিয়জনের বেলায় করে থাকি , তাহলে কিন্তু সেটা হবে ভণ্ডামি । তাই , মনগড়া ধারণা আরােপ না ক'রে , ভালবাসলে যেমন করে , তেমন করাই ভাল । এর সঙ্গে - সঙ্গে সাধন - ভজনও ‘ নিয়মিত করা চাই । এর মধ্যদিয়ে তত্ত্বতঃ তিনি কী ধীরে - ধীরে ফুটে উঠবে । আমাদের দেশে গুরুজন অনেককে বলে ঠাকুর , তার মানে তিনি ঠোক্কর লাগান , আবার টান থাকলে ঠোক্করের ফলে আমাদের complex ( প্রবৃত্তি ) -গুলি profitably (লাভজনকভাবে ) adjusted ( সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে with every meaning ( সমস্ত অর্থ নিয়ে ) ।
#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10