[ P - 9 ] 📌 নামের আগে একাধিক শ্রী কেনো বসানো হয় ?

📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,

🎗️ মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের আদর্শ কী ? 
🎗️নামের আগে  শ্রী কেনো বসানো হয় ?
🎗️শ্রী কথার মনে ?
🎗️ নরাধম কারা ...

         কথায় - কথায় কেষ্টদা cultural conquest ( কৃষ্টিগত বিজয়) সম্বন্ধে কথা তুললেন । 

          শ্রীশ্রীঠাকুর- University ( বিশ্ববিদ্যালয় ) , থিয়েটার , সিনেমা , পুস্তকালয় , খবরের কাগজ , রেডিও , সভা - সমিতি এবং অন্যান্য যে - সব স্থান cultural conquest ( কৃষ্টিগত বিজয় ) -এর মূল ঘাঁটি , সে - সবগুলি mould ( পরিবর্তন ) করুন , খুব ক’রে যাজন চালান , বেতাল কথা শুনলেই ডাঙ্গস মারুন , আর তা ’ যেন হৃদ্য হয় ।

            রত্নেশ্বরদা ( দাশশর্মা ) —মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের আদর্শ কী ? 

            শ্রীশ্রীঠাকুর — ব্যবহার হবে , enchanting ( মনোমুগ্ধকর ) , invigorating ( উদ্দীপনী ) । লক্ষ্য রাখতে হবে , যেমনটি আমি অন্যের কাছ থেকে চাই তেমনটি অন্যের প্রতি করছি কিনা । 

           এরপর সংহতি - সম্বন্ধে কথা উঠতে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — এক আদর্শে অনুরতি - সম্পন্ন হলে তারা সংহত না হয়ে পারে না , প্রত্যেকে প্রত্যেককে মানিয়ে নিয়ে চলে । সতীনের যদি কোন দোষ - ত্রুটিও থাকে , কিন্তু স্বামীর প্রতি যদি সে সেবামুখর ও টানসম্পন্ন হয় , তবে সতী - স্ত্রী স্বামীর স্বার্থের দিকে চেয়ে , তার সব দোষ সহ্য করে । আবার , সতী যে , তার সব কাজ - কর্ম , এমনকি ঝগড়াঝাটি , মুখব্যাঁকা করা পর্যন্ত তার স্বামীরই জন্য । আর , স্বামীর সবখানির প্রতিই কিন্তু তার সমান নজর , চার - চোখে দৃষ্টি , —একটা দিক দেখছে , অন্য সব দিক দেখছে না বা সেদিকে খেয়াল নেই , এমন হয় না । স্বামীর সব - কিছুতেই ব্যাপ্ত ও ব্যাপৃত করে তােলে সে নিজেকে । এই হ'লাে টানের লক্ষণ । এখানে যারা তপােবনের কাজ করছে তারা যদি মনে করে , অন্য department (বিভাগ ) -এর সম্বন্ধে তাদের কোন দায়িত্ব বা কৰ্ত্তব্য নেই , তবে বুঝতে হবে ঠাকুর তাদের interest ( স্বার্থ ) হ'য়ে ওঠেনি । ঠাকুর interest ( স্বার্থ ) হ'লে ঠাকুরের দুনিয়ার যা - কিছু সব দিকে মমত্বদীপ্ত দায়িত্বপূর্ণ শ্যেনদৃষ্টি থাকবেই , এবং তারা পরস্পর fulfilling ( পরিপূরণী ) হবেই । প্রত্যেকে তার নিজস্ব কর্তব্য ও দায়িত্ব তো সুষ্ঠভাবে উদ্যাপন করবেই , সঙ্গে - সঙ্গে তার জ্ঞানবুদ্ধি ও সামর্থ্য - মতন অপরকে সাহায্য করতে চেষ্টা করবে — অনধিকারচৰ্চ্চা না করে । এমনতর চৌকস দৃষ্টি যদি থাকে , তবে প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবেও বেড়ে উঠবে ঢের । তবে অনেকের ব্যক্তিগত ভাবে তারিফ পাওয়ার বুদ্ধি প্রবল থাকে । তার দরুন নিজে efficient ( দক্ষ ) হ'লেও অন্যকে efficient ( দক্ষ ) করে তােলার চেষ্টা থাকে না । সে কিন্তু ভাল নয় । কেউ ইষ্টস্বার্থ - প্রতিষ্ঠায় স্বার্থান্বিত হলে , সহকর্মীদের efficient . ( দক্ষ ) করে তােলবার ধান্ধা তার থাকবেই । কারণ , সে জানে যে একক তার পক্ষে ইষ্টের বিরাট বহুমুখী ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব নয় , তাই সকলকেই সে তাজা করে তুলতে চায় । বাহবার কাঙ্গাল হয় না সে , সে করে নিজে কিন্তু বাহবা দেয় অন্যকে । নিজস্ব নাম , কাম বা স্বার্থের ধার ধারে না সে , সে কেবলই ভাবে , বাঞ্ছিতের ইচ্ছা পূরণ হবে কেমন করে , আর তেমনি করে নিজেকে adjust ( নিয়ন্ত্রিত ) করে । তার বা অপরের কোন প্রবৃত্তিই তখন তার কাজের পথে বিশেষ একটা বাধা সৃষ্টি করতে পারে না । কোথাও এড়িয়ে , কোথাও ডব মেরে , কোথাও ডিঙ্গিয়ে , কোথাও মিষ্টি ক'রে ডাঙ্গস মেরে অন্তরায়গুলিকে সুকৌশলে অতিক্রম করে চলে সে । তার সান্নিধ্যে কতজন আবার এমনতর নিয়ন্ত্রণ - কৌশল - অভ্যস্ত হ’য়ে ওঠে । এরা অমোঘভাবে নিজেরা করে , অন্যকে দিয়েও করায় , যার যেমন যোগ্যতা , তাকে দিয়ে তেমনতর । organising skill (সংগঠনী কৌশল ) । এমনতর চরিত্রসম্পন্ন লােক যতই বেড়ে যাবে , সংগঠন ও সংহতি ততই দানা বেঁধে উঠবে । পাতলা ধরণের অনেক মানুষ থাকে , তারা অনেক সময় বিশেষ কোন উদ্দেশ্যপ্রণােদিত না হয়েও এমনভাবে চলে , যে - চলনা সংগঠন ও সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাড়ায় । এগুলি সব - সময় repair (জোড়া লাগান ) , adjust ( নিয়ন্ত্রণ ) ও resist ( নিরােধ ) করার তালে থাকতে হয় । তাই , কতকগুলি খাটি লােকের রীতিমত খাটনি চাই , এরা positive push ( বাস্তব - উচ্চেতনী প্রেরণা ) দেবে , আবার , সংহতি - বিরোধী যা - কিছু ঘটে সেগুলি counteract (প্রতিকার ) করবে । fanatic ( গোড়া ) , sympathetic (সহানুভূতিপূর্ণ ) ও impartial ( পক্ষপাতশূন্য ) না হয় , কান - কথায় যদি রঙ্গিল হয়ে ওঠে , মােকাবিলায় মিলিয়ে নেবার অভ্যাস যদি এদের না থাকে , তাহ'লে কিন্তু হবে না । 

          শ্রীশ্রীঠাকুর কথা বন্ধ করে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে পা - দুটো টানটান করে ছড়িয়ে দিয়েছেন , পায়ের উপর কাঁথা দেওয়া , পা - দুটো ঈষৎ নাড়াচ্ছেন , তাই দেখে তরুমা পা ঘ’সে দিচ্ছেন , যা’তে পায়ে বেশী শীত না লাগে । 

        শ্রীশ্রীঠাকুর স্মিত মুখে বললেন - তরু কাঁপায় বড় সুন্দর , যেন তবলা বাজিয়ে যায় । 

         বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) —কেউ যদি বলেন , ঠাকুর এই বলেছেন , আপনি যদি তা না মানেন , তবে গুরুদ্রোহিতা হবে , কিন্তু আমি যদি বুঝি যে তা ’ আপনার interest ( স্বার্থ ) -এর বিরুদ্ধে যাবে , সেখানে আমার করণীয় কী ? 

         শ্রীশ্রীঠাকুর ( চকিতে সােজা হয়ে উঠে বসে আবেগভরে বলতে লাগলেন । আগে ঠাকুর , তারপর তার কথা । যেমন শােনা যায় । ‘ ' resist no evil ( অন্যায়ের প্রতিরােধ করাে না ) এই কথার দোহাই দিয়ে , এই কথা মান্য করার ভান দেখিয়ে যীশুখ্রীষ্টের শিষ্যবর্গ নীরবে তাকে ক্রশবিদ্ধ হতে দিল , একটা আঙ্গুলও নাড়াল না , পরম ঔদার্য্যে নির্ব্বিকারচিত্তে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল , কিন্তু মেরী ম্যাকডালিনই রুখে দাড়াল যীশুখ্রীষ্টকে বাঁচাবার জন্য , তার কাছে যীশুখ্রীষ্টই বড় । তার কথা মেনে পুণ্য সঞ্চয় করবার লোভে তাকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয় সে , তাকে বাঁচাতে গিয়ে লাখ নরকেও যদি যেতে হয় , তাও সে রাজী । এই হলাে ভালবাসার নিশানা , প্রেষ্ঠ সেখানে মুখ্য , তাকে বাদ দিয়ে ভাল - মন্দ , পাপ - পুণ্যের কোন চিন্তাকেই সে আমল দেয়া না । ইষ্ট বিপন্ন যেখানে , সেখানে ঐসব নীতিবাদিতার দোহাই দিয়ে চুপ করে থাকা মানেই স্বার্থপরতা ও ভীরুতা । প্রেম যেখানে , সেখানে পরাক্রম ও প্রিয়ার্থ তৎপরতা মুখর হয়ে উঠবেই কি উঠবে । শুনেছি , শ্রীকৃষ্ণ একবার মু্র্চ্ছিত হ'য়ে পড়েছিলেন । গােপীরা খবর পেলেন যে ভক্তের পদধূলি তার মাথায় দিলে তিনি সেরে উঠবেন । যেই শোনা , সেই কাজ , পাপ - পুণ্যের কোন চিন্তাই কিন্তু তাদের মাথায় ঠাই পেল না । মুনি , ঋষি , সাধকরা কিন্তু সে সাহস পেলেন না , অপরাধের ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়লেন । তাই , রক্তমাংসসঙ্কল ইষ্ট যার কাছে মুখ্য ও কেবল হয়ে ওঠেননি , সে কিন্তু ইষ্টপ্রেম তথা ধর্মের দেউড়ি থেকে অনেক দূরে । — এই বলে শ্রীশ্রীঠাকুর ভাবমুগ্ধ অন্তরে ললিতভঙ্গিমায় মাথা দোলাতে - দোলাতে আবৃত্তির সুরে টেনে - টেনে বললেন— “ মরম না জানে , ধরম বাখানে এমন আছয়ে যারা , কাজ নাই সখি তাদের লইয়া বাহিরে থাকুক তারা ।’

            তপোবনের কথা উঠতে কেষ্টদা বললেন — তপােবন বলতে শ্রীশ্রীঠাকুর যা ’ বােঝেন , তাতে এই এখানে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে দিন - রাত যা চলে , এই - ই তো প্রকৃত তপোবন । তপােবন বলতে যদি কেউ কোন নির্দিষ্ট এলাকা বোঝেন , যে - স্থানটা তপােবন ব’লে পরিচিত , অথচ তপােবনের আদর্শ মূৰ্ত্ত করে তোলার প্রয়াস নেই সেখানে , তা’হলে তো ভুল হবে । 

           শ্রীশ্রীঠাকুর — তা তাে ঠিকই । তপােবনের পরিকল্পনা যেখানে রূপায়িত হ'চ্ছে , তার তপােবন নাম থাক বা না থাক , তপােবন সেখানেই । আর , যেখানে তা ’ হচ্ছে না , সেখানে তা ফুটিয়ে তুলতে পারলেই সেই স্থান পােবন নামের যোগ্য হবে । 

         কেষ্টদা — যে - চরিত্র , যে - কৰ্ম্মপটুতা , যে - কাৰ্যকরী জ্ঞানর ভিত্তি আপনি তপােবনের শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের জীবনে সুদৃঢ় ক’রে তুলতে চাচ্ছিলেন , তা থেকে তাে আমরা অনেক পেছনে প’ড়ে আছি । আর , যারা তিন বৎসরে ম্যাট্রিক পাশ করছে , তাদের অনেকে খুব কাচা থেকে যাচ্ছে । 

           শ্রীশ্রীঠাকুর — যতটুকু করছে , ততটুকু ভালভাবে করলে , তাতেও লাভ আছে । তিন বছরে যে পাকা করে তৈরী করা যায় সে - সম্বন্ধে conviction ( প্রত্যয় ) আসলে অন্যান্য সব দিকেও নজর পড়বে । এটা যে হয় তা তাে আমি দেখিয়েই দিয়েছি , আপনাদেরও বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে । যে - ভঙ্গীটা নিয়ে যেভাবে করতে হয় , সেই ধাঁজে না দাড়িয়ে মামুলি চলনে কাজ হাসিল করতে চাইলে তাে চলবে না । কেমিক্যাল ওয়ার্কস - এরও ঐ কথা । তেমন চেষ্টা ক’রে দেখল না । বিশেষ কিছু না করেই যা পায় , তাতেই খুশি আছে । বাড়াবার কথা বললে বলে , “ টাকা না হ’লে হয় না’ । কেউ যদি মন করে , তাহলে কি টাকার অভাবে কাজ আটকে থাকে ? এখন তাে আপনাদের সুযোগ আগের থেকে কত বেড়ে গেছে । আপনাদের মানুষ বাড়ছে ক্রমাগত , টাকার অভাব হবার তাে কথা নয় ! এতখানি যে আজ হয়েছে , টাকার জোরে তাে কিছু হয়নি , হয়েছে প্রয়ােজনের তাগিদে , অগ্রহের আবেগে । প্রত্যেকটি বিভাগের কর্মীদের বিশেষতঃ পরি চালকদের যদি আগ্রহ থাকে কেমন করে তারা আরাে অগণিত লোকের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করবে , তাদের কাজের ভিতর - দিয়ে সারা দেশকে সেবায় সমৃদ্ধ করে তুলবে কিভাবে , সর্বোপরি নিজেদের ভিতরের দুনিয়া ও বাইরের দুনিয়ার সর্বত্র ইষ্টপ্রতিষ্ঠা করবে কেমন ক'রে , তবে তাদের সেই আগ্রহ - সম্বেগই সাফল্যকে সহজ করে তুলবে । এই প্রয়ােজনবোধ যদি না থাকে , এই নেশা যদি না থাকে , নিজেদের প্রয়োজন মিটলেই যদি সব আবেগ ঠাণ্ডা মেরে যায় , তাহলে যেমন চলছে , তেমনই চলবে । অবশ্য , একটা বিভাগের কাজও যদি ঠিক মত চলে , তা অন্যান্য বিভাগের কাজকেও এগিয়ে দেবে । একের সাফল্যের দৃষ্টান্ত অন্যকেও প্রবুদ্ধ করবে । আপনার ঋত্বিক - আন্দোলন অর্থাৎ লােক - সংগ্রহ লােকসংগঠন কাজ যদি ঠিকভাবে আশানুরুপ এগিয়ে চলে , আরাে ভাল লােক যদি পান , তবে দেখবেন — এর ভিতর - দিয়েই সব আবার গজিয়ে উঠবে । এখন এন্তার লাগান যাজন , দোয়ারে দীক্ষা দিয়ে যান , আর আড়ে - হাতে লেগে প্রত্যেককে বাড়তির পথে ঠেলে দেন ।

             বলতে - বলতে শ্রীশ্রীঠাকুরের বদনমণ্ডল দীপ্ত - বিভামণ্ডিত হয়ে উঠলাে — তাঁর ডাগর চোখ দু’টি তীব্র আবেগে জ্বলতে লাগল । 

          মানদামা ( প্রফুল্লর মা ) আসছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করতে । ‘ অমন খুড়িয়ে হাটছিস্ কেন ? ’ — দূর থেকে জিজ্ঞাসা করলেন শ্রীশ্রীঠাকুর ।

         ‘ পায়ে একটা কাটা ফুটেছিল ' — এই ব'লে এসে প্রণাম করলেন ভূমিষ্ঠ হয়ে । প্রণাম করে উঠে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে , গভীর কৃতজ্ঞতা ও আনন্দের অভিব্যক্তি । যেন ভাবছেন — সবার প্রতি এমন স্নেহদৃষ্টি , প্রত্যেকের জন্য এমন ব্যথাবোধ ও তার নিরাকরণ - প্রচেষ্টা , একি কখনও মানুষে সম্ভব ? 

       ‘ কাটাটা বের ক’রে ফেলসি্নি ? ” আবার প্রশ্ন করলেন শ্রীশ্রীঠাকুর ।

          মা বললেন— “ ফেলেছি কিন্তু তবু ব্যথা যাচ্ছে না , হয়তাে আগা - টাগা ভেঙ্গে আছে । ‘ একটু আইডিন দিয়ে রাখিস্ । দেখিস্ পেকে - টেকে না যায় । যা , ভগীরথের ওখান থেকে একটু আইডিন লাগায়ে আয়গে , আর বাড়ীতে যদি না থাকে , যাবার বেলায় একটা শিশিতে করে একটু আইডিন নিয়ে যাস্ । বারেবারে ওটা লাগাবি ।'— স্নেহকোমল কণ্ঠে বললেন শ্রীশ্রীঠাকুর ।

           মা তখনই ডিসপেনসারীতে গেলেন আইডিন লাগাতে । বিমলদা — অনেকে মহাপুরুষদের নামের আগে দু'টো শ্রী বসান - সম্বন্ধে আপত্তি তোলেন , তাদের ধারণা , ওতে তাদিগকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয় ।এ - সম্বন্ধে আপনি কী বলেন ? 

        শ্রীশ্রীঠাকুর — যে যেমন পছন্দ করে , সে করেও তেমন , এবং সে সম্পদ্ তার - ই । বিহিত শ্রদ্ধা মানুষকে কখনও বঞ্চিত করে না । কারও নামের আগে একাধিক ‘ শ্রী দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো — ওর দ্বারা তার অসামান্যতা ও বিশেষ বিভূতি সূচিত করা । ‘শ্রী ’ মানে সেবা । ভগ এসেছে , ভজ্ধাতু থেকে , ভজ্ ধাতুর একটা প্রধান অর্থ হলাে সেবা , তাই ভগবান মানে বলা যায় সেবাবান । সত্তাসম্বর্ব্ধনী সেবা অর্থাৎ পরিপালন , পরিপােষণ ও পরিরক্ষণই যাঁর জীবন বৈশিষ্ট তিনিই ভগবান । যিনি এই সেবা - বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন , তিনিই হ'লে মানুষের মুখ্য সেবনীয় , অর্ঘ্যণীয় মানুষ - ভগবান । তাই তার নামের গােড়ায় একাধিক ‘ শ্রী ’ যােগ করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে তিনি আমাদের সেব্যপরম । 

           কেষ্টদা — গীতায় আছে , ‘ ন মাং দুস্কৃতিনাে মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ ' — এই নরাধম কারা ?

শ্রীশ্রীঠাকুর --- নরাধম তারাই যাদের will to becoming ( বিবৃদ্ধির ইচ্ছা ) stunted ( খাটো ) হ'য়ে গেছে , বৃত্তি - বেহুশ হ'য়ে যারা সঙ্কোচ ও মরণাভিসারে এগিয়ে চলেছে , প্রতিলােম - সঞ্জাত জাতক যারা তারা কিন্তু স্বভাবতঃই শ্রদ্ধাহারা , আদর্শবিমুখ ও প্রবৃত্তি - অভিভূত হয়ে ঐ দিকে ঢলে পড়ে । 

           বিমলদা --- will to live ( বাঁচার ইচ্ছা ) তাে সবার মধ্যেই আছে । 

          শ্রীশ্রীঠাকুর— Will to becoming ( বিবৃদ্ধির ইচ্ছা ) যাদের কম , will to live- ও ( বাঁচার ইচ্ছাও ) তাদের কম । Becoming - এর বৃদ্ধির urge ( আকুতি ) না থাকলে being ( সত্তাই দুর্ব্বল হয়ে পড়ে । 

          বিমলদা — টাকার লোভে যদি কেউ আপনার ভক্ত সাজে ?  

         কেষ্টদা কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন — গোড়ায় সেই ভাব নিয়ে আসলেও , পরে ঠাকুরে interested ( স্বার্থান্বিত ) হ'য়ে ওঠে । শ্রীশ্রীঠাকুর — পরিবর্তন হবার নয় , এমন লোকও আছে । অলাের কাছে কতকগুলি পােকা আসে আলাের জন্য , আলােতে আত্মাহুতি দিয়েই তারা সুখী , আবার ব্যাঙ , টিকটিকি ইত্যাদি আসে সেই পোকা খেতে , আলােয় কোন লোভ নেই তাদের , তারা আসে অহারের লোভে । ভক্ত সেজে তেমন লােকও আসে , যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো অন্যান্য ভক্তদের এবং গুরুর goodness- এর ( সদাশয়তার ) advantage ( সুযােগ ) নেওয়া । অন্য লোভে গুরুতে অনুরক্ত হতে পারে না যারা , দুস্কৃতিসম্পন্ন লোক তারা । যাদের ভিতরে মাল আছে , তার বিশেষ কোন বাসনা - কামনা নিয়ে গুরুসান্নিধ্যে আসলেও পরে গুরুতেই আসক্ত হ’য়ে ওঠে , যেমন হয়েছিল হনুমানের । হনুমানের মনে কত সাধ লুকিয়ে ছিল , আর তারই পূরণের আশায় ধরেছিল রামচন্দ্রকে , কিন্তু রামচন্দ্রকে তার এতই ভাল লেগে গেল , তঁাকে খুশি ও সুখী করার সাধ তার এতই প্রবল হয়ে উঠলো যে ব্যক্তিগত সুখ - সুবিধা ও উন্নতির আকাঙ্ক্ষা তার তলিয়ে গেল । রামচন্দ্রকে নিয়ে মাতাল হয়ে , তাকে নিয়েই কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন — আর সে শুধু ভাবের ঘোরে নয় , প্রচণ্ড কর্ম্মোৎসবের মধ্যদিয়ে । হনুমানের কথা ভাবলেও বুকখানা বড় হয়ে ওঠে । 

         কেষ্টদাগীতায় I আছে , ‘ নাহং প্রকাশঃ সর্ব্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ । মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লােকো মামজমব্যয়ম — এই যোযগমায়াসমাবৃত মানেই বা কী আর জন্মেও বা তিনি অজ , অব্যয় কেমন করে — ব্যাপারটা বুঝতে পারি না । 

         শ্রীশ্রীঠাকুর — যােগমায়াসমবৃত মানে স্ব - অয়নসূত বৃত্ত্যভিধ্যান - সমন্বিত ; সাধারণ মানুষের মত তিনিও পুরুষ এবং নারীর cohesive affinity ( সঙ্কর্ষণী সঙ্গতি ) -র মধ্যদিয়েই মানুষ হয়ে উদ্ভূত হয়েছেন । সে - দিক দিয়ে অন্য মানুষের সঙ্গে তার কোন পার্থক্য নেই । তাই প্রবৃত্তিরঙ্গিল যারা , তারা ভাবে , তিনিও মানুষ , আমরাও মানুষ — তঁা'তে আমাদিগেতে প্রভেদ কোথায় ? সিদ্ধাই বা অলৌকিকত্বের তাক - লাগান চটক যদি বা খুব দেখতে পায় , তাহলে বরং খানিকটা মাথা নােয়তে রাজি থাকে । কিন্তু তিনি তো আসেন প্রেমের ঐশ্বর্য নিয়ে , চরিত্রের ঐশ্বৰ্য্য নিয়ে , মানুষকে ঐ প্রেম ও চরিত্রের অধিকারী করে ধন্য করে তুলতে । মানুষকে অজ্ঞ ও দুর্বল রেখে , তাদের সামনে রকমারি ক্ষমতা দেখিয়ে , তাদের কাছ থেকে পূজা পাবার লােভ নেই তার । তাই মূঢ় যারা , তাদের কাছে তার বিশেষত্বই ধরা পড়ে না । ওতে একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টি লাগে । তিনি যে মানুষ হয়েও অজ , অব্যয় , তা’ আর তারা বুঝতে পারে না । মানে , তিনিই সব হয়ে আছেন , হয়ে চলেছেন , এতৎসত্ত্বেও তিনি তিনিই আছেন , যা ছিলেন আমনি তাই - ই আছেন , নূতনত্ব কিছুই হয়নি বা যা ’ ছিলেন তা ’ থেকে নূন্যতাও কিছু ঘটেনি , তাই তিনি জন্মগ্রহণ করেও অজ অর্থাৎ জন্মেন না , অর্থাৎ দেশ - কাল - নাম - রুপের অধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করবার দরুন স্বরূপতঃ ও তত্ত্বতঃ তার কোন ব্যত্যয় ঘটেনি , আর অব্যয় মানে তাঁর ব্যয় নেই , ক্ষয় নেই , যা - কিছু আছে তাতেই আছে , নানা পরিবর্তনের ভিতর - দিয়ে তাঁতেই বিধৃত হয়ে আছে । 

           এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে পাশ ফিরে আরও আঁটিসাট ক’রে বসলেন । তাই দেখে একজন বললেন , আজ তাে বেশ বেলা হ’য়ে গেল , পায়খানায় যাবেন না ?

            শ্রীশ্রীঠাকুর কৃত্রিম বিরক্তির সঙ্গে বললেন — রাখ ! বেলা দিয়ে আমি করব কী ? ঘড়ি দেখে কি আডডা মারা যায় ? এমন মরসুমের আসর ভেঙ্গে কি ওঠা যায় ? ফূ্র্ত্তির সময় বাগড়া দিস কেন ? আর , হাগা পেলে এমনিই উঠে পড়বোনে ।

            এরপর কেষ্টদা জিজ্ঞাসা করলেন — ‘ বহনং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্ মাং প্রপদ্যতে , বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুলভঃ ' — এর মানে কী ?

           শ্রীশ্রীঠাকুর — বসুদেবের ছেলে শ্রীকৃষ্ণ , রক্তমাংস - সঙ্কুল এই প্রতীকই যা’ - কিছু সব , এই বোধই চরম বোধ । তার ভিতরই সব revealed ( প্রকাশিত ) হয় , analytically and synthetically ( সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ - সহ ) with all one's emotion , sentiment , activity and rationality ( মানুষের সমগ্র আবেগ , ভাবানুকম্পিত্য , কর্ম ও যুক্তি নিয়ে) আর তা ” আবার তাতেই সার্থক হয়ে ওঠে । আমি যদি মাকে তেমন ভালবাসি , তবে দুনিয়ায় যা দেখি তা দেখেই মনে হতে থাকে , মা’র শরীর যে - যে উপাদান দিয়ে গড়া , মা’র গায় যা রক্ত , মাংস , অস্থি , চৰ্ম্ম , তার ঢলঢল মুখখানি হ'য়ে বিরাজ করছে — তা - ই তাে এখানে অন্যরুপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে । একই উপাদান সামগ্রী নানা রূপান্তরের মধ্যদিয়ে কোথায় কিভাবে কোন্ বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফুটে আছে , একই বহতে পর্যবসিত হয়েছে কি করে , একই বহুতে আছে কোথায় কেমন ক'রে — এ বােধই মানুষের ভিতর গজায় না , যদি অমনতর সত্তাপ্লাবী সর্বগ্রাসী প্রীতি কোন উপযুক্ত শ্রেয়তে কেন্দ্রায়িত না হয় । মা'র প্রতি যদি অমন টান হয় , তখন সব তাতেই মা’র স্ফুরণ হতে থাকে , তখন conviction ( প্রত্যয় ) আসে , realisation ( অনুভূতি ) আসে — মাই ভগবতী । তবে বস্তুগুণ চাই - ই । তাই সদ্গুরুর প্রয়ােজন হয় , যাঁতে সব - কিছুই জাগ্রতদীপনা নিয়ে জাগরুক । তাঁতে তেমন অনুরাগ থাকলে একটা গাছ দেখলেও মনে হয় গাছটাও ঠাকুরের এক মূর্তি ' । শোনা ধারণা আরােপ করলে কিন্তু হবে না , টানের তোড়ে সহজ বােধ ফুটে ওঠে — বস্তু , তত্ত্ব , ভাব , গুণ , রূপ , স্বাদ , গন্ধ , স্পর্শ সব - কিছুর অন্বিত সঙ্গতি নিয়ে । যা - কিছু দৃশ্য বস্তু তাঁর স্মৃতিরই উদ্রেক করে , তখন সে ঐ বোধের দাঁড়ায় বস্তুজগৎকেও সত্যি করে দেখতে পারে , জানতে পারে , বুঝতে পারে — প্রতিটি যা - কিছুর বৈশিষ্ট্যসহ । তার আগে কিছুই জানা হয় না — সামগ্রিক সঙ্গতি নিয়ে । 

৫ ই পৌষ , শনিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২০/১২/৪১ ) 

#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড 
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1