[ P -5 ] 📌 মানুষকে একবার কিছু দিলে সে যেন পেয়ে বসে , কেবলই চায় , তার উপায় কী ?

📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড

🔶 একজন জিজ্ঞাসা করছেন — মানুষকে একবার কিছু দিলে সে যেন পেয়ে বসে , কেবলই চায় , তার উপায় কী ? শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —সে আর বলতে ?

          ৩০ শে অগ্রহায়ণ , সােমবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৫/১২/৪১ ) 

         স্থান — বঁধের ধারের তাসু ( পাবনা আশ্রম ) 

         কাল — প্রাতঃকাল 

         খণ্ডকালের খণ্ডচেতনায় , ক্ষুদ্রস্বার্থে , ক্ষুদ্রপ্রচেষ্টায় পরিব্যাপ্ত থেকে ভিতরটা আমাদের মাঝে - মাঝে হাপিয়ে ওঠে , মনে হয় কোথায় যেন কী তাল কেটে গেছে , বেসুরা লাগে , রসের অভাবে একটা শুদ্ধ কঠোরতার বােধ মনকে নিরন্তর পীড়া দিতে থাকে , সার্থকতার পরিতৃপ্তি অন্তরের মাঝে ধরা দেয় না , সবই যেন ভূতের বেগার খাটার মত মনে হয় , স্বচ্ছন্দ বিচরণের একটা ভূমিই যেন মেলে না , নৌকো যেন চড়ায় ঠেকেছে , মাছ যেন জলছাড়া হয়ে পড়েছে , প্রাণ আইঢাই করতে থাকে । মানুষ অন্তর ভ’রে প্রার্থনা করে তখন কে আছ কোথায় ? আমার এ জীবন - মরুভূমিকে সরস করে দাও , শীতল করে দাও , সলীল করে দাও , চিরস্রোতা করে তােল , সুখে , সুধায় , সার্থকতায় ভরে দাও । অনেকে এই ক্ষুদ্র , খণ্ড , ছিন্ন , খিন্ন জীবনের সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্তি পাবার আশায় , দুনিয়ার সংশ্রব ত্যাগ করে ভূমার সন্ধানে ফেরে , কিন্তু বঞ্চিত হয় তারাও । তাহলে উপায় কী ? পথ কোথায় ? হ্যাঁ । পথ আছে , আছে উপায় । শুধু পথ নয় , উপায় নয় , গন্তব্য ও পথ , উদ্দেশ্য ও উপায় সংগ্রথিত হয়ে আছে একসত্তায় , —ওঁকেই বলে মূৰ্ত্ত নারায়ণ , শ্রীবিগ্রহ পুরুষােত্তম । ক্ষুদ্র ও খণ্ডকালের মধ্যে বিচরণ করেও , মানুষের ক্ষুদ্রতম অগণিত প্রয়োজন - পূরণে পরিব্যাপ্ত থেকেও তিনি অখণ্ড ও ভূমায় চির - সমাসীন । ক্ষুদ্রকে বাদ দিয়ে বৃহৎ নেই , কিন্তু ক্ষুদ্রকে যখন আমরা বৃহৎ  থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি , ক্ষুদ্রের জন্যই ক্ষুদ্রকে খুজি , তার প্রতি আসক্তি ও মােহ তার সেবায় উৎসর্গ করতে চাই নিজেদের বিরাট সত্তাকে , সেইখানেই হয় ছন্দপতন । মানুষের ভগবান তাই মানুষকে দেখিয়ে দেন — কেমন ক'রে অখণ্ড একের জন্য ক্ষুদ্র , খণ্ড , ছিন্ন বহুকে নিয়ােজিত করে একসূত্র - সঙ্গতিতে যা - কিছুকে অর্থপূর্ণ করে তখন মানুষের সরসতার অভাব হয় না , শক্তির অভাব হয় না , হয় অভাব শান্তির , অমৃতময় হয়ে ওঠে জীবনটা , কাণায় - কাণায় ভরে যায় প্রত্যেকটি কোষ - অণুকোষ , দুঃখ - কষ্টের দাবানলের মধ্যেও তখন ভিতরটা আর শুষ্ক মনে হয় না । খুটিনাটি সব - কিছুর ভিতর - দিয়ে ঠাকুর আমার সবার ভিতরে এই একায়নী অমৃতােৎসারণে নিত্য - নিরত — যা কিনা প্রতিটি জীবের জীবন , বদ্ধন ও বিবর্তনের আদিম সম্পদ । তাই চল !  এ পুণ্য প্রভাতে বৃথা কালক্ষেপ না করে ত্বরায় তার কাছে যাই — উপাসনা করি তার । সেখানে গিয়ে দেখবো , বুঝবো , জানবাে — কেমন ক'রে সর্বসঙ্গতিসম্পন্ন সার্থকজীবন যাপন করতে হয় ।

        তখন তার কাছে প্রাণমাতানাে আলাপ - আলোচনা চলছে । তিনি আনন্দে মাতোয়ারা হ'য়ে অমৃত - পরিবেষণ করছেন । 

        একজন জিজ্ঞাসা করছেন — মানুষকে একবার কিছু দিলে সে যেন পেয়ে বসে , কেবলই চায় , তার উপায় কী ? শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —সে আর বলতে ? আমারও খুব দেখা আছে । তাই যাকে দাও , অন্যের প্রয়ােজনে তাকে দিয়ে যদি না দেওয়াতে পার , তার অভাব কিন্তু ঘুচবে না । পাওয়ার বুদ্ধি , নেওয়ার বুদ্ধিই তাকে পেয়ে বসবে । আবার , না ক'রে দুঃখের কাঁদুনি গেয়েই পেতে চাইবে , তাতে তার বুদ্ধিবৃত্তি , কর্মশক্তি কিছুই খুলবে না , সে পঙ্গু হয়েই থাকবে । এতে তারও লাভ নেই , তোমারও লাভ নেই , সমাজেরও লাভ নেই । তাই , দেওয়ার অভ্যাস গজিয়ে দিতে হবে , যেন তেন প্রকারেণ । দেওয়া - নেওয়ার সামঞ্জস্য থাকলেই , সত্তার স্বস্থতা বজায় থাকে । কাউকে যদি কিছু দাও , অন্যের প্রয়ােজনে আবার তার কাছ থেকে নেবে , তার activity ( কৰ্ম্ম ) বাড়িয়ে তাকে তােমার স্বার্থ করে তুলতে হবে , ঐজন্যই আমি মানুষের কাছে চাই । তোমরা পাঁচজন আছ , যে সহজে দিতে পারে , তার কাছে হয়তো চাইলাম না , যার দিন চলে না , তার কাছেই হয়তাে কার জন্য কিছু চেয়ে বসলাম , আবার খামকাও চাই । ঐ বুদ্ধি , মানুষের যা'তে যােগ্যতা বাড়ে । আমি দেখেছি , যে নিজের ধান্ধায় হয়তো হতভম্ব , দিশেহারা , পথ পাচ্ছে না , সে অন্যের অভাব - পূরণে বাস্তবতঃ যদি কিছু করে , কিছু সংগ্রহ করে যদি দেয় , তার ভিতর - দিয়ে তার যে আত্মপ্রসাদ , আত্মপ্রত্যয় গজায় , তার ফলে , তার নিজেরও পথ খুলে যায় । মানুষের যদি ভাল করতে চাও , এ তােমার করাই লাগবে । তার অসামর্থ্যের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হ'য়ে , তুমি যদি তার উপর প্রীতিকর চাপ দিতে নারাজ হও , তাহ'লে তার অপারগতাকেই কায়েম ক'রে তুলবে তুমি । আবার , চাইতে জানা চাই — এমন সহজ , স্বাভাবিক প্রাণস্পর্শী ভঙ্গীতে চাইবে , যে - চাওয়ার ভঙ্গী দেওয়ার একটা উদগ্র আবেগ সৃষ্টি করে , সেই আবেগই তাকে শক্তি যোগাবে , বুদ্ধি যােগাবে । তখন যত অসুবিধাই থাক না , ঐ প্রচেষ্টাই তার কাছে প্রীতিকর মনে হবে । কিন্তু তুমি যদি চাওয়ার সময় ‘ কিন্তু কিন্তু কর , তােমার মনে যদি দ্বিধা - দ্বন্দ্ব থাকে , দৈন্য ও সঙ্কোচ - পীড়িত চেহারা নিয়ে যদি তার সামনে দাড়াও , তােমার ঐ ভাবই তার মধ্যে চারিয়ে যাবে , তার প্রাণে তুমি কোন উৎসাহ - উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারবে না , যার প্রেরণায় পারটা তার কাছে সহজ হয়ে ওঠে । তাই ইষ্টার্থী ভিক্ষা ছিল আমাদের । শিক্ষার একটা প্রধান অঙ্গ । আচাৰ্য্য - গৃহে গিয়ে বিদ্যার্থীকে নিত্য ভিক্ষা করে আচাৰ্য্যকে খাওয়াতে হতাে । এতে পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে , তাদের অভাব , প্রয়ােজন ও সমস্যার সঙ্গে একটা বাস্তব পরিচিতি ঘটতাে । লােক ব্যবহার কী , কেমন করে কোন মানুষটির সঙ্গে চলতে হয় , বলতে হয় , হৃদ্য ব্যবহারে কেমন ক'রে তার হৃদয় জয় করতে হয় , সে - সম্বন্ধে তাদের একটা অভিজ্ঞতা জন্মাতাে । আবার , মানুষের বাস্তব নানা সমস্যার সমাধান কেমন করে করতে হয় , মানুষকে কেমন করে সেবায় সমুদ্ধিত করতে হয় , সে - সম্বন্ধেও তারা আচার্যের কাছ থেকে নির্দেশলাভ করে , হাতে - কলমে তা ' করে জ্ঞানের অধিকারী হতাে । তাই , শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে তাদের আর বেকার থাকা লাগতাে না , যে - পরিস্থিতির মধ্যেই তারা পড়ুক , সেখানে থেকেই বৈশিষ্ট্যসঙ্গত সেবায় পারিপার্শ্বিকের স্বার্থকেন্দ্র হয়ে নিজের সত্তা ও স্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখতে তারা । তারা বুঝতাে , মানুষই তাদের পরম স্বার্থ । তাই , যে - শিক্ষা মানুষকে লােকস্বার্থী না করে অর্থস্বার্থী ও ভােগস্বার্থী করে তােলে , তা কিন্তু ব্যর্থ হতে বাধ্য । আবার , ঐ ইষ্টার্থী ভিক্ষা আত্মনিয়ন্ত্রণেরও পরম সহায়ক । অমনতর ভিক্ষায় অষ্টপিশ শিথিল হয়ে যায় । অষ্টপাশ হলাে ঘৃণা , লজ্জা , মান , অপমান , মােহ , দম্ভ , দ্বেষ , পৈশুন্য । এইগুলি মানুষের সহজ ও সলীল গতিকে নিরুদ্ধ করে রাখে , তার উন্নতিকে খর্ব করে তােলে । তোমাদের অনেকের যে ভিক্ষা করতে বাধা - বাধাে ঠেকে , তার কারণ ঐ অষ্টপাশ । আবার , ভরণ - দীপনায় অন্যকে যে উদ্দীপ্ত , অনুপ্রাণিত ও উচ্ছল করে তুলতে পারে না , সেও মানুষের কাছে প্রাণখুলে চাইতে পারে না । মানুষের মঙ্গল যে চায় , তার ইষ্টার্থী ভিক্ষায়

সঙ্কোচবােধের কোন কারণ থাকতে পারে না । কেউ অমনতর ভিক্ষা করতে পারে না , তার মানে , অষ্টপাশ তাকে ঘিরে আছে কিংবা ভিক্ষা দিতেও সে কৃপণ । সে - কথা তো সে বলবে না , অজুহাত দেখাবে মানুষের অভাব , অসুবিধার কথা বলে , যেন সে কতই দরদী তাদের । আরে , মানুষের কী অবস্থা তা ’ কি আমি জানি না ? —জানি বলেই তো আরাে বেশী করে বলি , ও - ছাড়া যে তাদের যােগ্য করে তোলার পথ নেই । ফলকথা , এই অষ্টপাশকে যদি না কাটাই , কার্পণ্যকে যদি অপসারিত না করি , আমরা তেলাপােকার মতই ছােট্টটুকু হয়ে থাকবো , এবং সেটা জীবনের সবক্ষেত্রে । আবার , সংগ্রহের বেলায় এটাও লক্ষ্য রাখবে , যাতে , যার কাছে যতটুকু নিচ্ছ , তার হাজার গুণ তাকে আপূরিত করে তুলতে পার । তাকে বুদ্ধি দেবে , বল দেবে , ভরসা দেবে , এমনতর যােগাযােগ সৃষ্টি করে দেবে — যাতে সে ক্ৰম - উচ্ছল হয়ে ওঠে । তাহলে তোমার পাওয়ার উৎস শুকিয়ে উঠবে না , অফুরন্তভাবে পাবে তার কাছ থেকে , অবশ্য পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে কিছু করতে যেও না । এখানেও ঐ দেওয়া - নেওয়ার সঙ্গতি চাই , বরং মানুষকে দেওয়া , তার জন্য করা — এইটেই যেন ডাইনের দিক থাকে । নিজেরা এই বুদ্ধি নিয়ে চল , সবার মধ্যে এই বুদ্ধি ঢুকিয়ে দাও , তখন দেখবে pauperism ( দারিদ্রব্যাধির কাম তখন দেখবে কেউ proletariat ( সৰ্বহারা ) থাকবে না , আর তাদের জন্য দাবী - দাওয়ার আন্দোলনও করা লাগবে না । ইদা ( বসু ) —আমাদের আয় ও প্রয়ােজন এ - দুইয়ের মধ্যে তাে সামঞ্জস্য নেই , তাই যতই হিসেব করে চলি না কেন , কিছুতেই তাে পেরে উঠি না । শ্রীশ্রীঠাকুর — তােমার উপার্জনই তােমার demonstrated ability ও activity ( প্রদর্শিত যােগ্যতা ও কর্মশক্তি ) -র মাপকাঠি , এতে বােঝা যায় , তুমি কতখানি করেছ , কতখানি যােগ্যতা দেখিয়েছ । সেই অনুযায়ী প্রয়ােজনানুরুপ উপার্জনের জন্য , আরাে কতখানি করতে হবে , হতে হবে , তাও বুঝতে পার । অফুরন্ত সম্ভাব্যতা তােমাদের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে , তাকে যদি জাগ্রত করে না তোল , তাহলে হবে কেন ? একটা পরিবার কেন , ১০২০ টা পরিবার প্রতিপালন করার মত ক্ষমতা তােমাদের মধ্যে আছে , তা যদি কাজে না খাটাও , তাহ'লে টের পাবে কি করে ? শুধু নিজের পরিবারের কথাই ভাব , তাই ঐ ছােট্ট পরিবারটা চালাতেই হিমসিম খেয়ে যাও । তোমার যদি মাথায় থাকে যে , নিজের সংসারটা তাে ভালভাবে চালাবই , সেই সঙ্গে - সঙ্গে আরাে ৫১০ টা সংসার টেনে নেব , বহু মানুষকে প্রতিপালন করব , ঠাকুরের ভার লাঘব করব , ফর্সা ,

আর নিজের সংসারের জন্য যেমন বুকভরা দরদ ও দায়িত্ব বােধ কর , তাদের জন্যও যদি তেমনি কর , নিজেকে যদি সেইভাবে ভাবিত করে তােল , তাহ'লে দেখবে , urge ( আকূতি ) -ই তোমার activity ( কর্মশক্তি ) ও efficiency ( দক্ষতা ) বাড়িয়ে তুলবে । নিজের সংসার চালাতে কষ্ট তো হবেই না , আরাে পাঁচজনকে সম্ভব মত সাহায্য করতে পারবে । এটা ঠিক জেনো — নিজের বৃহত্তর পরিবেশকে যদি সুস্থ , সুস্থ রাখার দায়িত্ব গ্রহণ না কর , লাখ চেষ্টা করেও তুমি তােমার পরিবারকে ভালভাবে রাখতে পারবে না । নিজেকে ছােট করে ভেবেই তো ঠকে যাও । মনে রেখাে তুমি তােমার ইষ্টের , তাই তুমি সবার , কারণ সকলের জন্যই তিনি , আবার তুমি যদি সকলের হও , সবাই তােমার । তোমার কি কোন ইতি আছে ? ইয়ত্তা আছে — যে তুমি থেমে যাবে ? ঘরে - ঘরে তোমার পরমাত্মীয় , দেশে - দেশে তোমার ভাই - বন্ধু , মানুষের হৃদয়ে - হৃদয়ে তােমার বাড়ীঘর , সকলের ক্ষেতখামার - গােলায় তোমার খাবার অন্ন , তোমার আবার পরােয়া কিসের ? তাই বলি , অভাব কিছুরই নেই , অভাব আছে শুধু ভাবের , ভাব মানে চিন্তা নয় , ‘ হওয়া । ইষ্টে তোমার ভাব হোক , অর্থাৎ তুমি সক্রিয়ভাবে ইষ্টসৰ্বস্ব হ'য়ে ওঠ , আর সেই সঙ্গে - সঙ্গে ইষ্টের যারা , তারা তােমার আপন হ'য়ে উঠুকবাস্তবে , দেখবে মা - লক্ষী তোমার সুসার করতে নিজ হ'তেই এগিয়ে আসবেন । বলতে - বলতে শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখমুখ আবেগে স্ফীত , বিস্ফারিত ও অরক্তিম হ'য়ে উঠেছে --- প্রত্যেকটি কথার মধ্যে তীব্র প্রেরণার তড়িৎপর্শ । এক বিশাল অনুভূতি সবার অন্তর পরিপ্লাবিত ক'রে তুলেছে — নির্বাক - বিস্ময়ে ভাবমুগ্ধ দৃষ্টিতে সবাই চেয়ে আছেন তার পানে , সে - চোখের ভাষায় লিপিবদ্ধ আছে , আনন্দ , কৃতজ্ঞতা , অনুরাগ , অনুগত্য । হরিপদ - দা ( সাহা ) তামাক সেজে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর অন্যমনস্কভাবে তামাক খাচ্ছেন , হঠাৎ লক্ষ্য পড়লো যে ডান হাতের একটা আঙ্গলের একটা নখের কোন একটু উঠে আছে , দুটো পাশ সমান নেই , তখনই প্যারীদাকে নরুন আনতে বললেন । প্যারীদা নরুন এনে দুটো পাশ সমান করে দিলেন । চাপার কলির মত চারুগঠন তার আঙ্গুলগুলির , সুঠাম সুন্দর তার প্রতিটি অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ , সেবকগণ যারা ঐ নয়নলোভন , নিখিল - পুণ্যালয় , ত্রিলােকপাবন , দিব্য বরবপু স্পর্শ করার অধিকার পেয়েছেন তারা কতই না ভাগ্যবান ! রোদ উঠে গেছে , ধীরে - ধীরে আরাে লোকজন এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করে যার - যার মত বসে যেতে লাগলেন । একটি মা তার নিজের আনীত একখানি আসন একপাশে পেতে বসলেন । তাকে লক্ষ্য করে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন আসনখানা অমন ছ্যারা - ভ্যারা করে পাতলি কেন , সুন্দর করে পাততে হয় । প্রত্যেকটি কাজের মধ্যে সৌন্দৰ্য - বােধ , শৃঙ্খলাবোধ দরকার , সামান্যতম ব্যাপারেও যদি এলােমেলো রকম থাকে , তাহলে ঐ অভ্যাস অন্য ব্যাপারেও চারিয়ে যায় , তাই ওটা ভাল না । তারপর তােরা মা , তােদের দেখেই তাে ছাওয়াল - পওয়াল শিখবে । তােদের খুব হুশিয়ার হওয়া লাগে , ( সহাস্যে ) —আবার যেখানে । বসেছ , ওখানেও কিন্তু তােমার অসুবিধা হবে , এরা বার - বার ওখানে তামাক সাজতে যাবে , আর তােমার বার - বার ওঠা লাগবে । হাটা , চলা , বসা , শোয়া , কথাবার্তা , কাজ - কর্ম সবকিছুর মধ্যে লক্ষ্য রাখা লাগে — সেটা যেন শােভন হয় , সুন্দর হয় , সুষ্ঠ হয় , সমীচীন হয় , হৃদ্য হয় , কারউ অসুবিধার কারণ না হয় , কারউ স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত না ঘটায় । কয়েকটা দিন একটু হিসেব করে চল , তখন দেখবে তােমার স্বভাবই ঐরকম হয়ে গেছে । তখন যেখানে যাবে , মানুষ তোমাকে পেলে বর্তে যাবে । ( হাত নেড়ে গানের সুরে বললেন ) বলবে , এসাে মা লক্ষ্মী , বসো মা লক্ষ্মী , থাক মা লক্ষ্মী ঘরে । শ্রীশ্রীঠাকুরের পুলকিত ভঙ্গী দেখে , সবাই মুখ টিপে - টিপে হাসতে লাগলেন । নগেনদা ( বসু ) —আপনি মানুষকে তার কর্মশক্তির উপর দাড়াতে বলছেন , কিন্তু মানুষ তাে বরাবর সমানভাবে পারে না ।

          শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষের government ( শাসনতন্ত্র ) -এর মত ভগবানের government- এও ( শাসনতন্ত্রেও ) pension- এর ( ভাতার ) ব্যবস্থা আছে । কর্মফল reserved ( জমা ) থাকে , আগের করার ফল তখন পাওয়া যায় । সেবার ভিতর - দিয়ে কতকগুলি মানুষের স্বার্থকেন্দ্র হয়ে উঠেছে যে , তার আবার ভাবনা কিসের ? তার এতটুকু দুঃখ দেখলে তারা তা দূর করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে , এবং নিজেদের দায়েই তারা তা করে — নিজেদের জীবনের জন্য , সুখ - সুবিধার জন্যই যে তাকে সুস্থ , সুস্থ রাখা দরকার , কারণ , সেবা দিয়ে সে তাদের এতখানি হয়ে দাড়িয়েছে যে , তাকে বাদ দিয়ে তাদের চলে না । অনেক সময় এমন হয় , যাদের জন্য করেছে , তারা হয়তো অকৃতজ্ঞতার দরুন কিছু করলে , কিন্তু অন্য কতলোকে করলো । এ বাবা প্রকৃতির বিধান । তবে ইটপ্রাণ সেবা না হলে অর্থাৎ সেবার ভিতরে ইষ্টার্থপ্রতিষ্ঠার বুদ্ধি না থাকলে , আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের বৃত্তিতে তেল মালিশ করে সেবা করে বেড়ালে , সে - সেবার ফল দানা বেঁধে ওঠে না , কারণ , মানুষকে সে নিজের প্রতি যতই আকৃষ্ট ও অনুগত করে তুলতে চায় , মানুষ ততই ছিটকে যার তার থেকে , তার ঐ অাত্মপ্রতিষ্ঠার বুদ্ধিই তার প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । এই সব মানুষ সাধারণতঃ এতই আত্মপ্রশংসা করে , নিজ কৃতিত্বের কথা , পরােপকারের কথা নিজ মুখেই এত বলে যে তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা স্বতঃই বিরূপ হ'য়ে ওঠে । অাবার , কেউ - কেউ মানুষকে তাদের খেয়াল , দম্ভ ও ইতর অহমিকার ইন্ধন - রূপে পেতে চায় , আর তাতে তার দ্বারা উপকৃত কারও কাছ থেকে এতটুকু বাধা পেলেই ‘ নেমকহারাম ’ , ‘ অকৃতজ্ঞ ’ বলে জাহির করে দেয় তাকে , কিন্তু সেই হয়তাে তার প্রকৃত হিতাকাক্ষী ; এইভাবে আত্মীয়কে দূরে ঠেলে দেয় তারা । আবার , যে হয়তাে দুষ্ট মতলব নিয়ে তাদের প্রবৃত্তির পোষকতা করছে — আত্মস্বার্থ বাগাবার জন্য এবং সেজন্য প্রয়ােজন হলে তাদের সর্বনাশ সাধন করতেও কুণ্ঠিত নয় , তাকেই তারা হয়তাে পেয়ারের লােক মনে করে খুব সাহায্য করবে । ফলকথা , তাদের সেবার মূলে আন্তরিকতা নেই , তাই কারও মধ্যে আন্তরিকতা আছে - আছে , তা বুঝবার ক্ষমতাও তাদের নেই । এমনতর খেয়ালী সেবাপ্রাণ যারা , তারা বিধ্বস্ত হবে না তো অার কে বিধ্বস্ত হবে বল ? অমনতর সেবাকে অনেকে সৎকর্ম মনে করে , কিন্তু সেবার সঙ্গে ধর্মদান যদি না থাকে , ইষ্টের স্বার্থ , ইষ্টের প্রীতি , ইষ্টের প্রতিষ্ঠা যদি না থাকে , মানুষকে যােগ্য ও মহৎ ক'রে তােলার প্রচেষ্টা যদি না থাকে , এক কথায় সেবা যদি সুকেন্দ্রিক না হয় , তবে সে - সেবার কোন দাম নেই , তা অসৎ কর্মেরই সামিল । অসৎ মানে — যা ’ জীবন বৃদ্ধির পরিপন্থী । ও - সেবায় নিজের বা পরের কারউ ভাল হয় না । সদাচার - সম্বন্ধে কথা উঠলো । শ্রীশ্রীঠাকুর সুশীলদার স্বপাক খাওয়ার কথা উল্লেখ করে বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করলেন । সুশীলদা ( বস ) —স্বপাক খাওয়ার খানিকটা কষ্ট আছে , কিন্তু খুব তৃপ্তি লাগে । শ্রীশ্রীঠাকুর - কষ্ট হলেই নষ্ট পায় না । কষ্ট না করেই বরং নষ্ট পায় । কোথার থেকে কি infection ( সংক্রমণ ) যে টোকে , তার কি ঠিক আছে ? তাই অন্ততঃ বাইরে গিয়ে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াই ভাল , একটা কুকার থাকলে তাে কোন হাঙ্গামাই থাকে না । চাপিয়ে দিয়ে কাজে বেরিয়ে গেলাম , এসে নামিয়ে গরম - গরম খেলাম । সময়ও নষ্ট হয় না , কোন অসুবিধাও নেই । অনেকে এই কুকার চাপানটাকে কঠিন কাজ মনে করে , সে শুধু অনভ্যাসের ফল । ফলকথা , যাকিছু করণীয় , সবই অতি সহজ । পূর্বের করাগুলি , অভ্যাসগুলি barrier ( অন্তরায় ) সৃষ্টি করে রেখেছে , তাই কঠিন মনে হয় । চেষ্টা করে নুতন অভ্যাস তৈরী করে সেগুলিকে অতিক্রম করতে হবে , নিরসন করতে হবে । আর , হাতেকলমে কিছু - কিছু কাজ করার অভ্যাস থাকা ভাল , ওতে nerve( স্নায় ; ) , muscle ( পেশী ) ইত্যাদি adjusted ( নিয়ন্ত্রিত ) হয় , অন্যের সাহায্য - নিরপেক্ষ হয়ে চলার অভ্যাসটা ধীরে - ধীরে গজিয়ে ওঠে , আবার অসময়ে অন্যের সাহায্য - সেবাও করা যায় । অনেকে এমন আছে যে , প্রয়ােজন মত একটা স্টোভ ধরিয়ে একটা রােগীকে একটু বার্লি জ্বাল দিয়েও দিতে পারে না । অথচ তারা হয়তো খুব শিক্ষিত । কিন্তু শিক্ষিত লোক বলতে আমি তাে বুঝি , কাজের লোক । যে নানা পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে পড়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে উপযােগীভাবে , সম্বন্ধনী রকমে , আবার যেখানে প্রয়ােজন পরিস্থিতি ও পরিবেশকেও নিয়ন্ত্রিত করতে পারে — অমনতর রকমে । তাই আমি বলি নিত্য বেদাভ্যাসের কথা । বেদাভ্যাস মানে শুধু পড়া নয় , জানার অভ্যাস , চলতি প্রয়ােজনীয় কাজগুলি অভ্যাসে আয়ত্ত করাও ঐ বেদাভ্যাসের অন্তর্গত । কথায় - কথায় নগেনদা বললেন — সুশীলদা তার ব্যবহার দিয়ে আমায় conquer ( জয় ) করেছেন । 

         শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —Conquered ( বিজিত ) কি আপনি হয়েছেন ? আমি আপনাদের যেমন conquer ( জয় ) করেছি , —সুশীলদাও তেমনি conquer ( জয় ) করেছে — আপনারা খুশি হয়েছেন এই পর্যন্ত । Conquer ( জয় ) করলে habits ( অভ্যাসগুলি ) , behaviour ( ব্যবহার ) , urge ( আকৃতি ) বদলে যায় । আগুন যা'তেই লাগুক , তাই আগুন হয়ে ওঠে । 

        এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর পায়খানায় গেলেন । পরে এসে মাতৃমন্দিরে বসেছেন । দোখল প্রামাণিককে ( গ্রামের একজন বৃদ্ধ মুসলমান ) দেখেই শ্রীশ্রীঠাকুর সােল্লাসে বলে উঠলেন — ও পরামাণিক , কেমন আছ ? আসো আসো , তোমারে যে দেখবের পাই না । 

       দোখল — আর , ঠাকুর ! কাজকামে ব্যস্ত থাকি , সময়ই পাইয়ে উঠি না । শ্রীশ্রীঠাকুর — তুমি বুড়াে হইছাে , তােমার অতো কাজকাম দিয়ে কি হবি ? এখানে আসবা , গল্প - সল্প করবা , অাড্ডা মারবা । বােঝ না তুমি । তুমি আসিলি ভাল লাগে , সুখ - দুঃখির কথা - টথা কওয়া যায় । 

      দেখিলের গায় একটা গেঞ্জি , কাপড়ের খােট গায় , বুড়ো মানুষ শীতে একটু - একটু কাপছে । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর — তোমার চাদর নেই ? 

      দোখল - চাদর পাব কোনে ? 

      শ্রীশ্রীঠাকুর — আমারে কও না ক্যান্ । হরেনকে ( ভদ্র ) ডাক । 

      হরেনদাকে ডাকা হলো ।

      হরেনদা আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — পরামাণিকের জন্য ভাল একখানা চাদর নিয়ে আসাে গে । দেখে - শুনে আনবা । 

      হরেনদা পাবনা - বাজারে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন ।

      শ্রীশ্রীঠাকুর একটু পরে কারখানার দিকে বেড়াতে বেরুলেন , সঙ্গে ২৪ জন রইলেন । ইমিস্ত্রী একখানা চেয়ার বানাচ্ছিলেন । চেয়ারটা দেখেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — হাতলটা উচু হয়েছে । আর , পেছন দিকটা যদি একটু slanting ( হেলান করে দিস তাহ'লে হেলান দিতে আরাম হবে । সুন্দর করে করবি , ভাল করে শিরিষ দিবি , বার্ণিশ করবি । যে তাের চেয়ার দেখবে , সেই যেন তারিফ না করে পারে না । 

      ইমিস্বীদা খুশি হয়ে জোরসে কাজে লেগে গেলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সেখানে থেকে ফিরলেন — রাস্তার পাশে একটি মায়ের ঘর । শ্রীশ্রীঠাকুর তার ঘরের কাছ দিয়ে যাবার সময় বললেন — কিরে । ছাইগুলি ওখানে ফেলেছিস ? ওখান থেকে তাে পায় - পায় তাের ঘরে গিয়ে ঢুকবে , আর ওখানে থাকলে রাত্রিবেলায় যারা অন্ধকারে পথ চলে , তাদের অসুবিধা হবে । সরিয়ে ফেল ।

    

       মাটি লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি ছাই সরাতে গেলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর এসে খেপুদার বারান্দায় বসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর কানুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন পড়াশুনা কেমন হচ্ছে রে ? 

       কানু — ভালই । 

       শ্রীশ্রীঠাকুর - খুব ভালাে করে পড়াে , ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করা চাই । 

      ডাক আসার পর ভবানীদা কতকগুলি চিঠি এনে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখালেন । 

      শ্রীশ্রীঠাকুর কতকগুলি চিঠি সম্বন্ধে সংক্ষেপে নির্দেশ দিয়ে দিলেন , ভবানীদা সেগুলি পাশে টুকে নিলেন । এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর স্নানে গেলেন ।

#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড 
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1