📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔶 নগেনদা ( বসু ) -আরাধনা ও তপস্যায় কী প্রভেদ ?
🔶 প্রশ্ন — কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলবে না , এইতো বড় মুশকিলের কথা ।
২৮ শে অগ্রহায়ণ , শনিবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৩/১২/৪১ )
স্থান — বাধের ধারের তাসু ( পাবনা আশ্রম )
কাল — প্রাতঃকাল ।
মানুষের মন চিরদিন সঙ্গ - পিয়াসী । একান্ত নিঃসঙ্গ জীবনে নেই তার আমোদ , নেই তার আনন্দ । সে চায় সমব্যথী সাথী , যে তার সুখে হবে সুখী , দুঃখে হবে দুঃখী , দরদী , যার অন্তর অনুরণিত হয়ে উঠবে তারই অন্তরতম অনুভূতির ছন্দানুক্রমণায় । এমন মানুষ না পেলে তার সবই আলুনি লাগে , বৃথাই সে জীবনভার ব’রে নিয়ে চলে , থাকে না তার কোন নিবিড় উপলব্ধি ও উপভােগের উন্মাদনা বা সার্থকতা । তাই মানুষ খোঁজে সাথী , মানুষ খোঁজে বন্ধু , মানুষ খোঁজে আত্মীয় , মানুষ খোঁজে প্রিয় পারিবারিক পরিবেশ , মানুষ খোঁজে প্রণয়বান দরদী , সে খোঁজে সম - মননশীল আড্ডা , মজলিল , সদ্য , সমাজ , রাষ্ট্রীয় সংস্থা । যেখানে পায় না ত ’ , সেখানে গড়ে তুলতে চায় অনুরুপ কিছু । মােটের পর সত্তা - পােষণী , বৈশিষ্ট্যপূরণী জ্যান্ত পরিবেশ না হলে মানুষের চলবে না । পোষণহারা হয়ে , প্রেরণহারা হয়ে সে শুকিয়ে উঠবে ।
তাই সঙ্গ খুজতে খুজতে মানুষ সেই সঙ্গে সব চেয়ে বেশী আকৃষ্ট ও অসক্ত হয় , যেখানে তার সত্ত্বার সপ্ত স্বর্গ , সপ্ত ভুবন , সপ্ত পাতাল আমান তরঙ্গায়িত , ছন্দায়িত , বোধি - দীপ্ত , সক্রিয় সুবিন্যস্ত ও সার্থক এক - সূত্র - সঙ্গত হ'য়ে ওঠার সুযােগ পায় । কারণ , এমনতর সর্বাঙ্গীণ বিবর্তন , বিবন্ধন ও উপভোগ - বিলাসের অভিলাষী হ'য়েই সে বেরিয়েছে পথ - পরিক্রমায় অগণিত জন্ম মৃত্যুর অসহনীয় ক্লেশ হেলায় তুচ্ছ করে । ঐটুকু না হ'লে যে তার তান জীবনের সব কষ্টই মিছে । তাই যুগে - যুগে বার - বার মানুষের অন্তর মথিত হ'য়ে আকুল প্রার্থনা উৎসারিত হয়ে উঠেছে , ভগবান ! তুমি আবিভূত হও , ‘ পুরুষােত্তম ! তুমি এস ’ । মানুষের ঘরে , মানুষ মায়ের গর্ভে মানুষী তনু ধ'রে , মানুষের আপন জন হয়ে তার হাত - ধরে - তোলা পরমপথের সাথীয়া হ'য়ে যখন তিনি আসেন , তখন সেখানে তাই মানুষের মহামহোৎসব লেগে যায় । কারণ , সত্তা ও বৈশিষ্ট্যের অমনতর সুসম্পূর্ণ , সমীচীন পূরণ , পােষণ আর কোথাও পাবার জো নেই । তার সঙ্গ - নেশায় মানুষ তাই মসগুল হয় , মাতাল হয় । অন্য নেশা ছাড়া যায় , ছাড়ান যায় , কিন্তু এ নেশা একবার ধরলে আর ছাড়ে না । এই নেশায় মাতাল যারা , তারা ক্রমাগত পরিবেশকেও অমনতর মাতাল করে তােলে , আর একযােগে মজাসে আস্বাদন করে সেই সৰ্বোত্তম পুরুষকে , যিনি রসো বৈ সঃ ' । সেই উপভােগেরই আসর চলেছে এখন । সুষমামণ্ডিত সুপ্রভাতে শ্রীশ্রীঠাকুর বিছানায় বসে আছেন — অনিন্দ্যসুন্দর অপরূপ শােভা বিকিরণ করে । ভক্তবৃন্দ মুগ্ধ নয়নে তাকে নিরীক্ষণ করছেন ।
নগেনদা ( বসু ) -আরাধনা ও তপস্যায় কী প্রভেদ ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আরাধনা মানে সম্যকপ্রকারে নিষ্পন্ন করা , আর তপ মানে সেই পথে বাধা - বিঘ্নকে অতিক্রম করতে গিয়ে effort ( প্রচেষ্টা ) -র দরুন যে তাপের সৃষ্টি হয় , তাই । তপস্যা মনে to bestow efforts to perform something ( কোনকিছু সম্পন্ন করতে চেষ্টা করা ) । এই তপস্যার সার্থকতার একটা কেন্দ্র চাই , সেই কেন্দ্র যদি না থাকে এবং আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা যদি তাতে সার্থক হ'য়ে না ওঠে , তবে যত তপস্যাই আমরা করি না কেন , কাটাকাটা হয়ে যাবে , তার ভিতর দিয়ে সংহত শক্তির সমাবেশ হবে না , ব্যক্তিত্বও দানা বেঁধে উঠবে না । তপপ্রবুদ্ধ ইন্দ্রিয়গ্রাম ও মস্তিষ্ককোষগুলি সূক্ষ্মতর শক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হয়তো প্রবৃত্তি - প্ররোচনায় বিপথে পরিচালিত হবে , এবং ঐ শক্তি বলে অপকর্ম হয়তাে আরো বেশী করে করবে । তাই গোড়ায় চাই ইষ্টস্বার্থ প্ৰতিষ্ঠাপন্ন হওয়া , ঐটি হ'লে তুমি ধৰ্ম্মরাজ্যে ঢোকবার চাবিকাঠিটি হাতে পেলে , তখন আর বেচালে পা পড়বে না । তোমার যতটুকু ক্ষমতাই থাক — তাই - ই কল্যাণের পথে নিয়ােজিত হবে । আর , ঐ ইষ্টকে খুশি করার আকুতি থেকে , তুমি আরাে - আরাে আরাধনা ও তপস্যা করবে , তাতে তােমার সামর্থ্যও বেড়ে যাবে , আর সে - সামর্থ হবে কল্যাণকল্পতরু । নইলে দুনিয়ায় আরাধনা , তপস্যা বা সামর্থ্যের কি অভাব আছে ? কিন্তু থাকলে কি হবে ? রাবণের শক্তি , সামর্থ্যে কার কী উপকার হয়ে থাকে ? শিবহীন দক্ষযজ্ঞে কার কী সুবিধা হয়ে থাকে ? যদি বাঁচতে চান , বাচাতে চান , নিজের ও পরিবেশের জীবনে balance ( সামঞ্জস্য ) অনতে চান , তবে নিজেরা ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠাপন্ন হন , অন্যকেও ক'রে তােলেন তাই — সেটা intellectually ( বুদ্ধিগতভাবে ) বা philosophically ( দার্শনিকভাবে ) নয় ; বাস্তবে , প্রতিটি মুহূর্তে , প্রতিটি ব্যাপারে । ঐ নেশা করে নিতে হয় , তাতে যা থাকে কপালে । সব প্রত্যাশা ছেড়ে পাগলের মত লেগে যেতে হয় , তখন বুকখানা , মুখখানা ডগমগ হ'য়ে থাকে — ভাবে , ভাষায় , আনন্দে ।
প্রফুল্ল — মানুষ আনন্দ আনন্দ করে , কিন্তু পদে - পদেই তো পাহাড় - প্রমাণ বাধা । শ্রীশ্রীঠাকুর — সংগ্রামই তাে জীবন , বিরুদ্ধতাগুলি যেন মৃত্যুর রেশ , তাই সে গুলিকে জয় করার মধ্যে আমাদের এত আনন্দ — এই হলো জীবনের বিধি । কিন্তু আজকাল আমাদের ধারণা বিকৃত হয়ে গেছে , সুখ - শান্তি - স্বাচ্ছন্দ্য বলতে আমরা বুঝি নিঝঞ্জাট জীবন , কোন ঝামেলা থাকবে না , বাধা থাকবে না , কষ্ট থাকবে না , অভাব থাকবে না , আরামে খাব - দাব আর ফুৰ্ত্তি করব , তা কিন্তু নয় । বাধা , অভাব - অভিযােগ , সমস্যা ইত্যাদিকে অতিক্রম করতে গিয়েই আমাদের শক্তিবৃদ্ধি হয় , আর তাতেই আনন্দ । প্রতিকূলকে নিয়ন্ত্রণ , সামঞ্জস্য , সমাধান যে যত করতে পারে , সে নিজেকে ততখানি অনুভব ও উপভোগ করতে পারে , তার বুদ্ধিও ততখানি বিকশিত হয়ে ওঠে , ব্যক্তিত্বও বেড়ে যায় , evolution ( বিবৰ্ত্তন ) বা becoming ( বিবদ্ধন ) অমনি ক'রেই সম্ভব । বহুদিন ধরে পরাধীনতার ফলে , আমরা কেমন আতুরে , অলস , অপােগণ্ড মত হয়ে গেছি । বীর্য্যের জীবন , পরাক্রমের জীবন , জয়মুখর সংগ্রামের জীবন আমাদিগকে আজকাল আর প্রলুব্ধ করে না । তাই , ভয়কাতুরে হয়ে বাস্তবতাকে এড়িয়ে ফাঁকি দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে চাই । এইভাবে সমস্যাকে যত এড়াতে চাচ্ছি , তার থেকে যত গা বাঁচাতে চাচ্ছি , ততই নানা সমস্যার আঘাতে জর্জরিত , ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি । ধর্ম করতে আসি , সেখানেও আমাদের ঐ ফাঁকিবুদ্ধি । আমি কিছু করব না , ভগবান তুমি কৃপা করে সব পাইয়ে দাও । ওরে পাগল । বিধির দরবারে ও - সব চালাকি কি খাটে ? না করে কি হয় ? না , তাতে কিছু পাওয়া যায় ? ফলকথা , ধর্মের মূৰ্ত্তিই আমরা দেখিনি , ধর্ম যেখানে , সেখানেই বীৰ্য্য , জয় , যশ , ঐশ্বৰ্য্য । ভক্তি কখনও মানুষকে দুর্বল করে না , সে মানুষকে করে তোলে চিরপরাক্রমশীল উর্জ্জী অনুরাগ - সম্পন্ন । ভক্ত কখনও ইষ্টের বােঝা হয় না , ভার হয় না , গলগ্রহ হয় না , সে হয় তার বল , ভরসা , সম্পদ , আশা - উদ্দীপনার মাণিক । হনুমানকে দেখ না ? রামচন্দ্র মুসড়ে যান তো সে দমে না । তার যে মা জানকীকে উদ্ধার না করলেই নয় । সব দায়িত্ব মাথায় নিয়ে যেমন করে যা করলে মা জানকীর উদ্ধার হয় , সে তাই করলো । এতে সে পাপ - পুণ্য , ইহকাল পরকাল , স্বর্গ - মােক্ষ , ভগবান - লাভ কিছুরই ধার ধারেনি । রামচন্দ্রকে সুখী করা , তার মুখে হাসি ফোটান , তার ইচ্ছা পূরণ করা — এই ছাড়া অন্য কোন চাহিদার বালাই ছিল না তার । নিজেকে ভুলে গিয়ে ইষ্টের তৃপ্তির জন্য , তার প্রীতির জন্য এমন বেপরােয়াভাবে কৰ্মমাতাল হয়ে ওঠাটাই ধৰ্ম । ওই পথে আত্মনিয়ন্ত্রণ , ভগবানলাভ , সুখ - শান্তি , আনন্দ , জয় , যশ , ঐশ্বৰ্য্য , সাফল্য , সার্থকতা সবই এসে সহজে ধরা দেয় , কিন্তু কোনটার জন্যই মাথা ঘামাতে হয় না ।
প্রশ্ন — কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলবে না , এইতো বড় মুশকিলের কথা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যেটাকে মুশকিল বলছ , আমি তাে সেইটেই দেখি আসানের কথা । বিহিত তপস্যার ভিতর - দিয়ে যা ’ আমরা লাভ না করি , যেটা আমরা এমনিই পেয়ে যাই , যার জন্য যোগ্যতা অর্জন করি না , তা পেলেও তার মূল্য ও মৰ্যাদা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না , আর সেটা আমরা ধরেও রাখতে পারি না। তাই তেমন পাওয়ায় লাভ কী ? কিন্তু অনলস অনুশীলনায় চরিত্র যদি তৈরী হয় , তবে তা কেউ কেড়ে নিতে পারে না । আর , চরিত্র ও স্বাস্থ্য যদি ঠিক থাকে , তবে মানুষ out of nothing ( কিছু - নার ভিতর - দিয়ে ) সব create ( সৃষ্টি ) করতে পারে । এইজন্য Bible ( বাইবেল ) -এ আছে— Seek ye first the kingdom of heaven and all other things shall be added unto you . ( প্রথমে স্বর্গরাজ্যের অন্বেষণ কর , তাহলে সব - কিছুর অধিকারী হবে । ) স্বর্গরাজ্য অন্বেষণ মানে সপরিবেশ ইষ্টনিষ্ঠ , সুসঙ্গত , প্রীতিদীপ্ত , যোগ্য জীবন ও চরিত্র লাভের চেষ্টা । অতন্দ্র প্রয়াসে এই পথে অগ্রসর হতে হবে । কারও প্রতি ভালবাসায় আমরা যদি কিছু করি , তবে কষ্ট বা পরিশ্রম গায়ে লাগবে না , ঐটেকেই উপাদেয় ও মধুর ব'লে মনে হবে , ঐটুকু বাদ দিলে বরং সুখের উপাদান বলে কিছু থাকবে না জীবনে । মোদ্দা কথা এই যে , effort ( প্রচেষ্টা ) -র ভিতর দিয়ে ছাড়া আমরা কিছুই লাভ করতে পারি না , সে যে - কোন দিকেই হোক না কেন । শরীর বাড়াতে গেলে যথাবিধি exercise ( ব্যায়াম ) করতে হয় , শক্তি বাড়াতে গেলে বিহিত রকমে শক্তির ক্ষয় করলেই তা সম্ভব । Rifle of becoming ( বিবর্দ্ধনের রাইফেল ) হাতে with an armoured move ( সশস্ত্র চলনে ) , beyond ( অনাযত্ত ) -কে হস্তগত করার পথে আমাদের অমৃত অভিযান । কষ্ট দেখে ঘাবড়ালে চলবে না , বিবেকানন্দ স্বামী যা ’ বলেছেন— Iron muscles and nerves of steel ( লৌহের মত পেশী এবং ইস্পাতের মত স্নাযু় ) নিয়ে চলতে হবে ।
প্রশ্ন — অতো তাফালের কথা চিন্তা করলে মন যে দমে যায় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কি তাে আছে- ‘ ইষ্টটানটি নিভুনিভু ’ ।
কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) পুরো ছড়াটি আবৃত্তি করে বললেন
ইষ্টটানটি নিভুনিভু
বাধায় নাজেহাল ,
এমন হ'লে দেখিস খুজে
কোথায় কামের জাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মন দমবে কেন ? মন তো মাতাল হয়ে থাকবে । বাধা - বিঘ্ন আসলে রুখে দাড়াবে । তা ’ যখন দাড়ায় না , তখন বুঝতে হবে , কামকামনার জালে জড়িয়ে পড়েছ । ( সহাস্যে ) হয়তাে টগর সুন্দরীর চোখের টান মনকে টেনেছে তোমার , কাজে না হলেও হয়তো ভাবনা - চিন্তায় সেই রাজ্যে বিচরণ করছ । কল্পনার সৌধ গড়ছ । পাছে সেই সুখস্বপ্ন ভেঙ্গে যায় , তা কি তুমি সইতে পার ? ( সকলের হাস্য ) । তখন তো ঘূৰ্ত্তির কসরৎ যেটা , তাকেও মনে হবে অনাহুত উৎপাত ব'লে । এইভাবে এক - একটা প্রবৃত্তি - অভিভূতিকে আশ্রয় করে মানুষের জগৎ সংকীর্ণ হয়ে ওঠে , সে জড়ত্বের দিকে এগিয়ে চলে , উদার উদাত্ত কর্মঠ ব্রাহ্মী - চলন অর্থাৎ বৃদ্ধিমুখী চলন , তখন তার আর পছন্দ হয় না । তাই সব সময় নিরখ - পরখ করতে হয় , যাতে কোন প্রবৃত্তি আমাদের পেয়ে না বসে অর্থাৎ মূল থেকে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত না করে । প্রবৃত্তি - চলনকে একবার যদি প্রশ্রয় দেওয়া যায় , সে যে ধাপে - ধাপে আমাদের কতদূর টেনে নামাতে পারে , তার ঠিক নেই । একটার পর একটা ফ্যাকড়া বেরুতে থাকে । শুনেছি , এক সাধু ছিল , তার কৌপীন রােজ ইন্দুরে কেটে দিত । তখন ইন্দুরের হাত থেকে কোপনি বাঁচাবার জন্য সে এক বিড়াল পুষলাে । বিড়ালের এখন দুধ লাগে , করা যায় কি ? অগত্যা একটা গরু কিনতে হলো । গরু কিনে তাকে রাখে কোথায় ? গোয়ালঘর তুলতে হলো । গরু বিড়াল ইত্যাদির সেবা সে একলা করে কিভাবে ? তখন সে বিয়ে করল । বিয়ে করে স্ত্রীর ভরণ পোষণ করতে হবে , কাজ - কর্ম রুজি - রােজগার তো কিছু চাই । সে তখন সেই ধান্ধায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো । কোথায় গেল তার সাধন - ভজন , কোথায় গেল তার ভগবদারাধন , কোথায় গেল তার লোকসেবা । মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল , সে তখন হন্যে হয়ে ছুটছে পরিবারের জন্য । আর , যে জিজ্ঞাসা করে , তাকে বলে- বিয়ে করেছি , স্ত্রীর প্রতি একটা কৰ্ত্তব্য আছে তো ? কত কর্তব্যে বিব্রত সে তখন , কিন্তু ইষ্টকে নিয়ে যে তার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য , সে - কৰ্ত্তব্যের কথা তার একবারও মনে পড়ে না । এক কৌপীন কো ওয়াস্তে সে জীবনকে জলাঞ্জলি দিল । এইভাবে এক - এক কৌপীন নিয়ে আমরা এক - একজন আটকে যাই , আর বৃহৎ চলা ব্যাহত হয় । তাছাড়া , শারীরিক অবস্থার উপর উৎসাহ , উদ্যম ও কর্মশক্তি অনেকটা নির্ভর করে । তাই বিহিত আহার - বিহার , শ্রম , নিদ্রা , ফুৰ্ত্তি , সদাচার ও মিত - চলনে শরীরটাকে সুস্থ , সহনপটু , কর্মঠ করে রাখতে হবে । এটা ধর্মেরই একটা অঙ্গ , তাই বলে শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম্মসাধনম্ ’ ।
একটি দাদা তার ছেলে - বৌ অবাধ্য ও হৃদয়হীন বলে শ্রীশ্রীঠাকুরকে জানালেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ওরা যদি তোমার প্রতি সশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে , তাহ'লেই এর প্রতিকার হয় । তা ’ যতক্ষণ না হচ্ছে , তুমি লাখ উপদেশ দিয়েও কিছু করতে পারবে না । অবশ্য , তাদের শ্রদ্ধা - ভালবাসার পরােয়া না রেখে তুমি যদি তােমার ইষ্টকে নিয়ে সক্রিয়ভাবে মত্ত থাকতে পার এবং তারা যদি বােঝে যে , তুমি এমন একটা ভূমিতে দাড়িয়েছ , যেখানে তােমার অন্তর স্বতঃই ভরপূর , তাদের কাছে কোন প্রত্যাশা পর্যন্ত রাখ না তুমি একমাত্র তাদের মঙ্গল ছাড়া , অথচ তাদের সম্বন্ধে তােমার যা করণীয় তাও যদি হৃদ্য প্রসন্ন - চিত্তে ক'রে চল — কোন অনুযোগ বা অভিযােগ না করে , তখন তারা ধীরে - ধীরে শায়েস্তা হয়ে যাবে । দুদণ্ড তােমার সঙ্গলাভ করবার জন্য , তোমার সেবা করবার জন্য তারা লালায়িত হয়ে উঠবে । এটা ঠিক জেনো — দুনিয়া তেলােমাথায় তেল দিতেই ভালবাসে । যখন তুমি ইষ্টকে নিয়ে মাতােয়ারা হয়ে আছ , কেউ তােমাকে শ্রদ্ধা , সম্মান বা তােয়াজ করলাে বা না - করলাে সেদিকে চেয়ে দেখবার অবকাশ নেই , তখনই দেখবে তােমাকে শ্রদ্ধা ও মান্য দিতে সকলেই উঠে - পড়ে লেগেছে । যখন তুমি নিজের পেটের ধান্ধা ভুলে , সকলের পেটের ধান্ধায় ব্যস্ত হয়েছ , তখন তােমাকে কিছু খাওয়াতে পারলে , দিতে পারলে মানুষ যেন বর্তে যাচ্ছে । তাই বলে ‘ বীরভােগ্যা বসুন্ধরা ' ।
স্মরজিৎদা কলকাতা থেকে এলেন — কফি , কড়াইশুঁটি , আপেল , দ্বারিকের দোকানের নুতন গুড়ের সন্দেশ , ভাল দই ইত্যাদি নিয়ে । তাছাড়া শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্য ভাল shaving soap ( দাড়ি - কামানর সাবান ) , মাথায় মাখার গন্ধতেল ইত্যাদিও নিয়ে এসেছেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সুরজিৎদাকে দেখে মহাখুশি । হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন— কি মাল আনছিস্ রে ?
সমরজিৎদা এক - এক করে উল্লেখ করলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর ( উল্লসিত হ'য়ে ) —জবর কাম করিছিস , যা , বড়বৌ - এর ( শ্রীশ্রীবড়মা ) কাছে দিয়ে আয় গিয়ে।
স্মরজিৎদা শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করে জিনিসগুলি নিয়ে শ্রীশ্রীবড়মার কাছে গেলেন । ওখানে জিনিস দিয়ে আবার এসে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে তার পাশে দাঁড়ালেন । শ্রীশ্রীঠাকুর স্নেহমুগ্ধ দৃষ্টিতে বার - বার স্মরজিৎদার দিকে তাকাচ্ছেন , মুখে তার করুণাদীপ্ত ঈষৎ হাসি , সে হাসির ছোয়ায় , সকলেরই অন্তর যেন নির্মল ও নিষ্কলুষ হ’য়ে উঠছে । শ্রীশ্রীঠাকুর অন্তরঙ্গ স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বলছেন — ও ঐ তালেই আছে । আর জিনিসপত্র কেনাকাটায় ওর আর জুড়ি নেই । হ্যাঁ ! আর , আর আছে সুশীলদা । ওদের দু'জনের taste ( রুচি ) -ই আলাদা । যা ’ কেনে , তা সহজ , সুন্দর , অথচ টেকসই , অাবার ব্যয়বহুল্যও করে না । সুন্দর ' বলতে কী বােঝায় , অনেকের সে ধারণাই নেই , clumsily gorgeous ( জাবড়াভাবে জাঁকজমকপূর্ণ ) যা ’ , অনেকে তাকেই সুন্দর মনে করে ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর খুটিয়ে - খুটিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন ।
—মাষ্টারমশায় ( শ্ৰীশশিভূষণ মিত্র — শ্রীশ্রীঠাকুরের ডাক্তারী পড়ার সময়কার শিক্ষক , বর্তমানে শ্রীশ্রীঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত ও শিষ্য , এবং কলিকাতা এলাকার ভারপ্রাপ্ত ঋত্বিক ) কেমন আছেন ?
স্মরজিৎদা — ভাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — রবি , যতীনদা , হীরালাল , ধীরেন — এরা ভাল আছে তাে ?
স্মরজিৎদা — হ্যা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - কলকাতায় কাজকাম কেমন হচ্ছে ?
স্মরজিৎদা — মােটামুটি ভালই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মােটামুটি ভাল হলে চলবে না , খুব ভাল হওয়া চাই । আর , ১৩০ টাকার ( শ্রীমন্দির - নির্মাণ ও পুস্তকাদি প্রকাশের জন্য ছয় বৎসরে ১৩০ টাকা দানের প্রতিশ্রুতি ) move ( আন্দোলন ) জোরসে চালাও । বইগুলি দোয়ারে ছাপায়ে ফেলাও , ইংরাজী ও হিন্দীতে translation ( অনুবাদ ) -এর ব্যবস্থা করা লাগবে । ইসলাম - প্রসঙ্গে উর্দুতে ছাপান ভাল । কেষ্টদারা এবার ঠিক করছে যশাের , খুলনা , বরিশাল , ফরিদপুর ইত্যাদি জায়গায় যেখানে বেশী whole - time worker ( নিয়তকর্মী ) আছে , সেখান থেকে কিছু টেনে এনে , এবং centre ( কেন্দ্র) থেকে যাকে - যাকে পারে দিয়ে , বাংলার সব জেলাতেই কাজ শুরু করে দেবে । জেলায় - জেলায় দু ’ একজন করে থাকবে , আর তাদের কাজে push ( উচ্চেতনী প্রেরণ ) দেবার জন্য , শরৎদা ও প্রফুল্ল — এই দু’জনের দুটো touring batch ( ভ্রাম্যমাণ দল ) হবে । আর , কেষ্টদা centre (কেন্দ্র ) থেকে সবাইকে চিঠিপত্র লিখে guide ( পরিচালনা) করবে । প্রয়োজন মত কোন - কোন সময় কেষ্টদা ও খ্যাপাও বাইরে যাবে । এরা সব গেলে তো আমি কাণা হয়ে পড়ব । তাছাড়া , বাইরে ও এখানে আরো অনেক intelligent (বুদ্ধিমান ) , devoted ( ভক্তিমান ) , selfless ( নিঃস্বার্থ ) , painstaking (কষ্টসহিষ্ণু ) , efficient ( যোগ্য ) worker ( কর্মী ) প্রয়ােজন । তাই , তাড়াতাড়ি worker ( কর্মী ) যােগাড় কর । তারা অবিবাহিত হলেই ভাল হয় । ময়ি সৰ্ব্বাণি কর্মাণি সংন্যসাধ্যাত্মচেতসা , নিরাশীর্নির্ম্মম ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ — এই হবে তাদের motto ( নীতি ) । পিছটান যদি বড় হয় , তাহলে এ - কাজ পারবে না । রামকেষ্ট ঠাকুর বলেছেন — এ - কাজ ঈশ্বরকোটী পুরুষের কাজ । ইষ্টস্বার্থ ও ইটপ্রতিষ্ঠা যাদের জীবনে normally primary and prominent ( স্বতঃই প্রথম ও প্রধান ) , তারাই ঈশ্বরকোটী পুরুষ । এমনতর যারা , তারা কোন selfish consideration- এই ( স্বার্থচিন্তাতেই ) deviated ( ব্যতিক্রান্ত) হয় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কথাগুলি শুনতে - শুনতে সবাই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন । সৌরজগৎ , পৃথিবী , চন্দ্র , সূৰ্য্য ইত্যাদি বিষয় কথা উঠলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর atlas ( ভূচিত্রাবলী ) চাইলেন , কেষ্টদার বাড়ী থেকে এনে দেওয়া হলো । অমাবস্যায় চন্দ্র কেন দেখা যায় না , শ্রীশ্রীঠাকুর atlas ( ভূচিত্রাবলী ) দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন । পরে বললেন — সৌরজগৎ ক’য়ে দেয় , মানুষ তুমি মূলকেন্দ্রের দিকে চেয়ে তাকে অনুসরণ করে চল , কক্ষচ্যুত হবে না , dynamic energy (গতিশীল শক্তি ) পাবে ; আর বৃত্তি - রঙ্গিল অহং নিয়ে চলো না , তাহ'লে কাউকে বা কিছুকে যথাযথভাবে দেখতে পাবে না , বুঝতে পারবে না , তােমার বিকৃত ধারণাকেই দেখবে সর্বত্র , কিন্তু সত্তারঙ্গিল অহং যদি থাকে , অস্তিত্ব , জ্ঞান ও বােধ তােমার অটুটই থাকবে ।
শরৎদা fine arts ( চারুশিল্প ) -সম্বন্ধে কথা তুললেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আনন্দ ও স্ফুৰ্ত্তির exposition- ই ( প্রকাশই ) art ( শিল্প ) , তা হওয়া চাই সুন্দর , সরস , হৃদয়মনােগ্রাহী , জীবনের পক্ষে হিতকর । মানুষের ইন্দ্রিয়ের কাছে তার একটা pleasing appeal ( প্রীতিকর অাবেদন ) থাকবে , কিন্তু তাই বলে তা মানুষকে ইদ্রিয় - পরায়ণ বা ইন্দ্রিয়পরবশ করে তুলতে প্রেরণা যোগাবে না । বরং তা মানুষকে জোগাবে ইন্দ্রিয়াদি ও জগতের যা - কিছুর ধীশ্বর হওয়ার প্রেরণা , তাকে দেবে আশা , ভরসা , উদ্দীপনা ; মানুষের জীবনকে , মানুষের সংসারকে , মানুষের সমাজকে নূতন করে , সুন্দর করে , উন্নততর করে গড়ে তােলার সক্রিয় স্বপ্ন । এই জন্যই আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যে tragedy (বিয়ােগান্ত নাটক ) -এর সমাদর ছিল না , tragedy ( বিয়ােগান্ত নাটক ) হ'লো জীবনের বৈকল্যের exposition ( প্রকাশ ) । এমন অনেক শক্তিমান লেখক ও শিল্পী আছেন , যারা tragic end ( বিয়ােগান্ত পরিণতি -র উপর একটা আসক্তি জন্মিয়ে দিতে পারেন , তা কিন্তু সর্বনেশে , মানুষ তখন সেই ভাবের বােলচাল ধরে সেই পথে অগ্রসর হয় ।
কথা হচ্ছে , এমন সময় যােগেনদা ( সরকার ) খবরের কাগজ নিয়ে আসলেন , তখন কাগজ পড়া হলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর আগ্রহ - সহকারে যুদ্ধের খবর শুনতে লাগলেন ।
#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1
10