📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড
🔶 উমদা ( বাগচী ) —আত্মরক্ষার বুদ্ধি তাে সবারই আছে , তবু চেতন - চলনের অভাব হয় কেন ?
🔶 অভাব যখন মারবে ছো , যা জোটে দিস — পাবিই জো '
১ লা পৌষ , মঙ্গলবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৬/১২/৪১ )
আজ ভােরে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে তাসুর ভিতর গিয়ে দেখা গেল , তিনি যেন কেমন বিমর্ষভাবে বিছানায় বসে আছেন , চোখ - মুখে কেমন যেন একটা দুশ্চিন্তার ছাপ , মন ভারাক্রান্ত । কী ব্যাপার বুঝতে না পেরে , সবাই চুপচাপ রইলেন । হঠাৎ প্যারীদা ( নন্দী ) আসতেই শ্রীশ্রীঠাকুর উৎকণ্ঠা - জড়িত ভঙ্গীতে জিজ্ঞাস্য করলেন — খ্যাপা এখন কেমন আছে ?
প্যারীদা — এই ভােরে একটু ঘুম এসেছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ঘুম এসেছে তাে ?
প্যারীদা - হ্যা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়াসনি তাে ?
প্যারীদানা , এমনিই । ঘুম এসেছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ঘুমোলে অনেকটা সুস্থ বোধ করবে । •••• • এইবার তামাক সাজ দেখি । ••••••••• ওখানে কাছে কাউকে রেখে এসেছিস তো ?
প্যারীদা - হা ! শরবিন্দু আছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তুইও নজর রাখিস । এদিকে বেশী সময় থাকি না ।
প্যারীদা — আমি তামাক সেজে দিয়ে যাচ্ছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( তামাক খেতে - খেতে ) আমার যে কী উৎকণ্ঠা , কী উদ্বেগ , কেউ বুঝবে না । সকলের জন্য সব সময় যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকি । আর , অমঙ্গলটাই যেন আমার মনে বেশী করে ডাকে । সবসময় ভাবি — সবাই সুস্থ থাক , সুস্থ থাক , সুদীর্ঘ জীবন উপভােগ করুক । কিন্তু রােগ - শােকের খবর লেগেই আছে — তাই আমি নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারি না , মনে হয় , কোন্ সময় আবার কার কী খারাপ খবর শুনব । পরমপিতা আমাকে মমতা দিয়েছেন অসীম , সেই সঙ্গে - সঙ্গে উদ্বেগেরও আমার শেষ নেই । তবে আপনাদের জন্য আমার এত দুর্ভাবনা হতো না , যদি আপনারা যেমন - যেমন বলি , কাঁটায় - কাঁটায় সেইভাবে চলতেন । পরমপিতার দয়ায় আপনারা যা ’ চলার রাস্তা পেয়েছেন , সেই রাস্তায় চললে অনেক বাঁচোয়া । কিন্তু তা কি আপনার কথা শােনেন ? আপনাদের প্রত্যেকের যে নিজের খেয়াল আছে । তবু আপনারা যজন , যাজন , ইষ্টভৃতির সূত্র ধরে আছেন বলে যে কত দিক দিয়ে কতভাবে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন তার ইয়ত্তা নেই । যজন , যাজন , ইষ্টভৃতি , করলে কাটে মহাভীতি । এ - সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই ।
এমন সময় কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) আসলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - বসেন কেষ্টদা ।
কেষ্টদা — তরুমার কাছে শুনলাম , কাল রাতে আপনার ভাল ঘুম হয়নি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - খ্যাপা অসুখের যন্ত্রণায় ঘুমোতে পাচ্ছে না শুনে , আমারও আর ঘুম আসলাে না । প্যারী একটু আগে ব'লে গেল ‘ ও ঘুমিয়েছে ’ , শুনে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম । কেষ্টদা - খাওয়া - দাওয়ার অনিয়মে পেট খারাপ থেকে এই অবস্থাটা হয়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) —আমি যেমন অনেক সময় লােভ সামলাতে পারি না , ওরও তেমনি আছে । আর বড় বৌয়ের বুদ্ধি হলাে — আমাকে খুশে - খুশে খাওয়াবে । পাতের সামনে এনে এমন করে বলে , আর একটু খাও ’ , ‘ আর একটু খাও । আমি তখন কেমন কাৎ হ'য়ে পড়ি , বলি — ‘ দাও একটু । পরে অনেক সময় বেসামাল হয়ে পড়ি । সেইদিন পাঁচখানা গােকুল পিঠে বসান দিয়ে অম্বলের ঠেলায় অস্থির ।
উপস্থিত সবাই নীরবে হাসতে লাগলেন ।
কেষ্টদা - এর মধ্যে Medical Digest- এ acidity ( অম্বল ) -এর কি একটা ভাল ওষুধ বের হয়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — খুঁজে বের করেন তো । আর , ভাল বুঝলে আজকেই কলকাতায় কয়েক ফাইল আনতে দেন ।
কেষ্টদা - আচ্ছা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আজকের ডাকেই চিঠি লিখে দেবেন ! প্রফুল্ল ! কেষ্টদাকে মনে ক’রে দিস ।
কেষ্টদা - আমার মনে থাকবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর —আপনার তো মনে থাকবেই , তবু ওর এদিকে খেয়াল থাকা ভাল , চার - চোখাে দৃষ্টি যদি না থাকে তবে আপনাকে assist ( সাহায্য) করবে কিভাবে ?
কেষ্টদা — প্রফুল্লও তো কদিন পরে বাইরে যাচ্ছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাই তো কতদিন থেকে আপনাদের — মাহুতদের বলছি প্রত্যেকের জনকয়েক ক'রে ভাল assistant ( সহকারী ) তৈরী করতে , বেশ কয়েকজন থাকলে , তার মধ্য - থেকে ২|১ জন বাইরে গেলে অসুবিধা হয় না । তবে আপনার চুনি , বীরেন অাছে , আর কিরণও অল্পদিনে অনেকখানি তৈরী হয়ে উঠেছে ।
কেষ্টদা - ওদেরও হয়তো বাইরে পাঠান লাগবে । বাংলার সব জেলায় কর্মী পাঠাতে গেলে কাউকে বড় এখানে রাখা সম্ভব হবে না । থাকবার মধ্যে বোধহয় দেবী ( চক্রবর্তী ) থাকবে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর- -তা ভাল । তবে প্রফুল্ল , বীরেন , চুনি — এদের মত আরাে জোগাড়ের তালে থাকুন , এরা আপনার কাছে থেকে কিন্তুু কম equipped (যােগ্য ) হয়নি । আর , এইভাবে হাতে - কলমে সাগরেতি না করলে কিন্তু এতখানি মাথায় ঢুকতো না । আচার , অভ্যাস , ব্যবহার , চলন , চরিত্র — এগুলি যদি দুরস্ত না হয় , যে - সব কথা বলবে , তার কিছু - কিছু যদি আচরণে না আসে , তবে মানুষের মনে তা ’ প্রভাব বিস্তার করে না ; আর , অতন্দ্র অনুশীলন ছাড়া তা ' হবার নয় । আগ্লে আমলে আপনাদের নিয়ে কম ডলাই - মলাই করিনি । এক - এক তাল তুলেই রাখতাম । সব সময়ে তালের উপর থাকতেন । এমনিভাবে আজ কতখানি ধাতস্থ হয়ে গেছেন । নুতন যারা আসবে , তাদের পিছনে আপনাদের অমনি খাটা লাগবে । কিভাবে কী করা লাগে , আপনার বােধের মধ্যে অাছে । তাইতাে নুতন যারা আসে , তাদের আপনার সঙ্গে যুতে দেই ।
কেষ্টদা — যার যা হয় , আপনার contact ( সাহচর্যে ) -ই হয় , আমি আর কী করি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তবু আপনার মনে রং ধরেছে বলে আপনি অনন্যর ম’নে রং ধরাতে পারেন ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদির জন্য গাত্রোন্থান করলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর যখন উঠে দাড়ালেন , দেখা গেল তার কাছাটা খুলে গেছে । কেষ্টদা তাড়াতাড়ি কাছাটা গুজে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনান্তে আবার খেপুদার খবর নিলেন । পরে পরে বাবলা-তলায় এসে রােদে পিঠ ক’রে একটা বেঞ্চে বসলেন । অনেকে শ্রীশ্রীঠাকুরকে এসে প্রণাম করতে লাগলেন , শ্রীশ্রীঠাকুরও স্বাভাবিকভাবে সঙ্গে - সঙ্গে পরমপিতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে লাগলেন ।
পাড়ার মুসলমান রমজান এসেছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কি রে রমজান , কেমন আছিস ?
রমজান — ভাল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - এবার কলাই কেমন হলো ?
রমজান - মন্দ না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আচ্ছা , বেশীর ভাগ জমিতে তাে আউশ ধান ও কলাই এই দুটো ফসল করিস্ । কলাই - এর পর আউশ ধানের মাঝে যে ফাকটা থাকে , তার মধ্যে আর - একটা ফসল করা যায় না ?
রমজান — কী ফসল ? শ্রীশ্রীঠাকুর — একটু উচু জমি যে - গুলি আছে , সেগুলিতে ধর একটু আগে আগে যদি কলাই উঠে যায় , তারপর ভাল করে চাষ করে , সার দিয়ে আলু কি ঐ জাতীয় জিনিস যদি বুনিস তাে হয় না ?
রমজান — কি জানি , করিনি তাে কোন দিন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — চেষ্টা করে দেখিস , তো । একটা ফসল বেশী ফলাতে পারলে তোদের আয় অনেক বেড়ে যাবে , ছাওয়াল - পাওয়াল নিয়ে খেয়ে বাচবি ।
রমজান — অাচ্ছা দেখব ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ ব্যস্তভাবে বললেন — দ্যাখ তাে । দ্যাখ তাে ।
কী দেখতে হবে বুঝতে না পেরে সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ঐ - যে কলতলার ওদিকে কে কাদছে দ্যাখ তাে । বােধ হয় কেউ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে ।
তখন ছুটে গিয়ে দেখা গেল একটি ছেলে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে কঁদছে ।
তাকে উঠিয়ে শান্ত করে পরে শ্রীশ্রীঠাকুরকে এসে বলা হলাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তােদের চোখ - কান কেন যেন সজাগ থাকে না ? চারিদিকে নজর না থাকলে কি হয় ? সন্ধানী চোখ , সন্ধানী কান , সন্ধানী মন না থাকলে অনুসন্ধিৎসু সেবা হয় না , তা না হলে ব্যক্তিত্বও বাড়ে না । কে কতখানি চেতন , কে কতখানি সজাগ , কে কতখানি সক্রিয় তাই দেখে বােঝা যায় , সে নাম - ধ্যান কতখানি করে । চৈতন্যের রাজ্যে যে যতখানি অগ্রসর হয় , তার জড়ত্ব ততখানি চ'লে যায় । নিজেদের নিরাপত্তার দিক দিয়েও এই ছশিয়ার চলন একান্ত প্রয়োজন । বিপদ - আপদ ঘাড়ের উপর এসে পড়লে তখন যে আমরা টের পাই , আগে যে তার সঙ্কেত পাই না , নিরাকরণী প্রস্তুতিও যে আমাদের থাকে না , নানাভাবে যে আমরা বিধ্বস্ত হই , তার কারণও ঐ চেতন - চলনের অভাব ।
উমদা ( বাগচী ) —আত্মরক্ষার বুদ্ধি তাে সবারই আছে , তবু চেতন - চলনের অভাব হয় কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — প্রবৃত্তি - অভিভূতি আমাদিগকে আচ্ছন্ন করে রাখে , তাই আমরা অসাড় হয়ে থাকি । নেহাৎ যখন সত্তা বিপন্ন হয় , তখন হুশ হয় , তার আগে খেয়াল থাকে না । বার - বার ঠেকি , তবু শিখি না । ফল কথা , শুধু আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিই মানুষের সত্তাসংরক্ষণে বড় বেশী একটা সহায়তা করতে পারে না , যদি ইষ্ট ও পারিপার্শ্বিককে রক্ষার প্রবৃত্তি তার প্রবল হয়ে না ওঠে । সব অবস্থায় । ইষ্টের সত্তা , স্বার্থ ও ঈপ্সাকে যদি আমরা প্রাধান্য দিয়ে চলতে অভ্যস্ত হই , এবং তারই প্রীতি ও প্রতিষ্ঠা - কামনায় পারিপার্শ্বিকের সংরক্ষণ ও সম্বর্দ্ধনায় যত্নবান হই , তখনই আমরা আত্মসংরক্ষণ আত্মসম্বর্দ্ধনায় যা’ - যা’ করণীয় তা ঠিকভাবে করতে পারি । তার আগ পর্যন্ত প্রবৃত্তিই আমাদের ঘিরে থাকে , আমাদের চলার পথ আমাদের চোখের সামনে ঠিক - ঠিক ফুটে ওঠে না । অাবার , ইষ্ট ও পরিবেশ সম্বন্ধে যার কোন কর্মঠ দরদ ও দায়িত্ববোধ নেই, নিজের ‘ সত্তা - পােষণী দরদ ও দায়িত্ববোধও তার তেমনি শিথিল হয়ে ওঠে । তার দরদ ও দায়িত্ববোধ যতটুকু থাকে , তার বেশীর ভাগ প্রযুক্ত হয় প্রবৃত্তি - পােষণে , প্রবৃত্তি - সংরক্ষণে । তাই তথাকথিত স্বার্থপর মানুষ যারা , তারা প্রতিনিয়তই নিজের স্বার্থকে বিঘ্নিত ক’রে চলে — স্বার্থপরিপূতি হবে যাতে তার মূলে কুঠারাঘাত ক’রে ।
এ - কথা কখনই ভুলে যেও না যে ইষ্ট ও পরিবেশরক্ষণী প্রচেষ্টায় উদ্দাম হয়ে ওঠাই আত্মরক্ষণী অনুশীলন , ও বাদ দিয়ে শুধু নিজের জন্য যাই করতে যাও তাই হবে অন্ধ , বধির । তােমার আত্মরক্ষণী বা সত্তাসংরক্ষণী বোধ , কৌশল ও প্রতিভার স্ফুরণই হবে না , যদি তা যথাস্থানে নিয়ােজিত না হয় ।
প্রফুল্ল — আমাদের আয় - উপার্জন সম্বন্ধেও কি ঐ কথা ?
শ্রীশ্রীঠাকুর মুখ থেকে গড়গড়ার নলটি নামিয়ে প্রসন্ন বদনে বললেন তা ’ বৈকি ? মানুষের আমিত্ববােধ যদি ইষ্টকে কেন্দ্র করে পরিবেশে প্রসার লাভ না করে , তাহলে তার মগজ খোলে না , প্রচেষ্টাও স্তিমিত হয়ে থাকে । যার আমিত্ববােধ যতখানি ব্যাপ্তিলাভ করে — সুকেন্দ্রিক হয়ে , —তার বুদ্ধি ও প্রয়াসও হয় তত গভীর ও সুদূরপ্রসারী , কারণ , আমি বলতে সে যতকে বােঝে , ততর সুখ - সুবিধা বিধানে সে বাস্তবে উঠে - পড়ে লাগে । ঐ ধান্ধা তার পারগতা ও উপার্জ্জনকে বাড়িয়ে তােলে । কিন্তু গােড়ায় যদি শ্রেয় - প্রীতি না থাকে , ঐ জীবন্ত - কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ও পরিপূরণ - আকাক্ষা না থাকে , তবে তার ব্যক্তিত্ব সংহত ও সুগঠিত হয়ে ওঠে না । সে - অবস্থায় সে পরিবেশকে আপন করতে গিয়ে বা তাদের সেবা করতে গিয়ে তাদের প্রবৃত্তির খোরাক হয়ে ওঠে , স্বার্থকেন্দ্র হয়ে তাদিগকে বা নিজেকে বাড়িয়ে তুলতে পারে না , তার বুদ্ধি ও কর্ম হয় এলো মেলো , কাটা - কাটা , আবােল - তাবােল , তাই সে জমিয়ে তুলতে পারে না । আবার , নেহাৎ নিজের স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে শ্রেয়কে আশ্রয় করলেই যে হয় , তাও নয় , শ্রেয়ের প্রতি আসক্তি চাই । তখনই ঐ শ্রেয়ের প্রতিষ্ঠা ও পূরণের আগ্রহেই সে পরিবেশের প্রতি সেবা - মুখর হয়ে ওঠে । এমনি করেই তার আমিত্ববােধ বিস্তার লাভ করতে থাকে । তখন সে আর অলস থাকে না । অকর্ম্মণ্য থাকে না । ভিতরের তাগিদেই সে উপচয়ী , কর্ম্মঠ হয়ে ওঠে । আবার, এই করার মধ্যদিয়ে পাওয়াও তার অঢেল হ'য়ে ওঠে । গােড়ায় সম্বেগ যদি না থাকতো , তাহলে কিন্তু তার মাথা অতোখানি খেলতো না , কর্ম অতোখানি খুলতো না । ধর না , এই ইষ্টভৃতি , স্বস্ত্যয়নীর মধ্যদিয়েই যে কত লোকের কত কর্মপ্রয়াস খুলে গেছে , তার কি লেখাজোখা আছে ? আমার কাছে কতজনে যে এসে গল্প করে ! তাদের সে আত্মপ্রসাদমাখা কাহিনী শুনতে বড় ভাল লাগে । নিছক নিজের দিকে যে মুখ করে আছে , তার দৃষ্টিটা সেখান থেকে ফেরাও ।
নিজের পেটের চিন্তা বা অভাবের চিন্তা কাউকে কোনদিন বড় - মানুষ কর না । তা ’ তাকে কোনদিন খেতে - পরতেও দেয় না । তাকে শ্রেয়ের কথা , অপর দশজনের কথা ভাবতে দাও , তাদের জন্য কিছু করতে দাও , তাদিগকে দেওয়াও তাকে দিয়ে , আর তার বৈশিষ্ট্যমাফিক মানুষের উপযােগী যােগ্যতা - অনুশীলনী কর্মে ব্যাপৃত থাকায় যে কি মজা , কি আনন্দ , তা তাকে বুঝতে দাও । উপচয়ী কর্ম - মাতাল করে তোল তাকে , সেই মত্ততায় পেটের কথা , পয়সার কথা ভুলে যাক সে , তখন দেখবে , বানের জলের মত খাওয়া আসবে , পয়সা আসবে তার ঘরে । যােগ্যতা যদি থাকে , মানুষের , সুকেন্দ্রিক কর্মঠ যদি হয় সে — তাকে রুখবে কে দুনিয়ায় ? মানুষ উল্টোপথে চলে – পয়সার কথা , পেটের কথাই অযথা এত করে ভাবে যে তা'তে তাদের সহজ কর্মোৎসাহই নিভে যেতে থাকে , কাজই ঠিকমত করতে পারে না , ফুৰ্ত্তিও পায় না তাতে । তাই তাদের দ্বারা কেউ লাভবান হয় না । অন্যে যদি তােমাকে দিয়ে লাভবান না হয় , তাহলে তুমি তার দ্বারা লাভবান হবে কি করে ?
প্রশ্ন — অন্যের দিকে যে নজর যেতে চায় না । শ্রীশ্রীঠাকুর ( জোরের সঙ্গে) তার মানে তুমি বাঁচতে চাও মরার পথে চলে । তােমার আহরণের ক্ষেত্ৰই হ'লে তােমার পরিবেশ , তাকে শুকিয়ে রেখে তার রসে পুষ্ট হতে চাও সে কেমন কথা ? এ কি ফাজলামি ? পাওয়া - না - পাওয়ার প্রশ্ন - নিরপেক্ষ হয়ে তােমার স্বভাবই যদি না হয় তােমার শক্তি ও সামর্থ্য মতন মানুষের ভাল করা , তাহলে দিন - দিন তুমি নিজের ভাল করার ব্যাপারেও অসাড় হ'য়ে পড়বে , সে শক্তিও তোমার থাকবে না । প্রশ্ন - সে কেমন ? শ্রীশ্রীঠাকুর - ধর , তােমার প্রতিবেশীর ক্ষেত থেকে গরুতে ধান খেয়ে যাচ্ছে , তুমি সেই পথ দিয়ে যাচ্ছ , দেখলে তা ’ , কিন্তু দেখেও গরুটা তাড়ালে না , ভাবলে , তাড়িয়ে আমার লাভ কি ? —এই ভেবে নির্বিবাদে ঐ পথ দিয়ে চলে গেলে । একদিন নয় , দু’দিন নয় , বার - বারই হয়তাে ঐ রকম দেখ , কিন্তু পরের ক্ষেত বলে ও - দিকে নজরই দাও না । এমনি করতে - করতে অমনতর শৈথিল্য হয়তো তোমার চরিত্রে এমন গেঁথে যাবে যে , পরে নিজের ক্ষেত থেকে যখন গরুতে ধান খেয়ে যাবে , তখন পাশ দিয়ে গেলেও তোমার চোখ এড়িয়ে যাবে তা । তোমার । সামনে একজন হয়তো একজনের উপর অন্যায় অত্যাচার করছে , জুলুম করছে । তা ’ দেখেও তুমি কোন প্রতিবাদ করলে না , মঙ্গলপ্রসূ বাধার সৃষ্টি করলে না , ভাবলে , এতে আমার কী ? এমনতর বহু ক্ষেত্রেই হয়তো নীরব থেকে গেলে । পরে তােমার নিজের উপরও যদি অমনতর অন্যায় জুলুম বা অত্যাচার হয় , তখন হয়তো তুমি দেখতে পাবে — অন্যায়কে নিরােধ করার ক্ষমতাই তুমি হারিয়ে ফেলেছ । তাই , অন্যের ভাল করার সুযোেগ যেখানে যখনই যতটুকু পাও , তােমার সাধ্য - মতন তার সদ্ব্যবহার করে — অবাঞ্ছিত অনধিকার - চৰ্চ্চা না করে বা নিজের সত্তাকে অযথা বিপন্ন না করে । এতে তােমার নিজের ভাল করার সামর্থ্যই অটুট থাকবে । একটা কথা আছে , বসে থাকার থেকে বেগার খাটা ভাল কথাটা খুব তাৎপৰ্যপূর্ণ । আলস্যে অভ্যাস নষ্ট হয় , যােগ্যতা নষ্ট হয় , সেইটেই মন্ত ক্ষতি , তাই বেগার খাটার মধ্যদিয়েও যদি সদভ্যাস ও যোগ্যতা বজায় থাকে সে - ও যথেষ্ট লাভ । আবার , বেগার খাটায় স্বার্থনিবদ্ধ দৃষ্টি বাস্তবভাবে একটু প্রসারিত হয় , সেও কম কথা নয় । দৃষ্টির ঐ প্রসারণার ফলেই বোধ - বিবেচনা ও কর্মশক্তি অনেকখানি সুস্থ থাকে , তাই পারার পথে , পাওয়ার পথে কপাট পড়ে যায় না । ঐ কথা মাথায় রেখেই বলেছি , ‘ অভাব যখন মারবে ছো , যা জোটে দিস — পাবিই জো ' । অভাবে মানুষ কেবল নিজের পাওয়ার কথাই ভাবে , ও যেন একটা দহ বিশেষ , ওই পাকের থেকে না উঠতে পারলে অভাব মোচন হয় না । অভাবের মধ্যেও নিজের সাধ্যমতন কিছু দেওয়ার বুদ্ধি বা করার বুদ্ধি যদি সজাগ থাকে , তাতে মানুষ সহজেই ঝেড়ে দাড়াতে পারে , নিজের অভাবের চিন্তায় নিষ্ক্রিয় ও নিষ্ফলভাবে আবর্তন করতে হয় না তাকে বেশী দিন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আগুনঢালা আবেগ নিয়ে কথাগুলি বলে চললেন — তীক্ষভাবে প্রত্যেকের অন্তরকে বিদ্ধ করে । শীতে অসুবিধা হচ্ছে বুঝে বঙ্কিমদা ( রায় ) এসে শ্রীশ্রীঠাকুরের পা - দুখানি ঘসে দিতে লাগলেন । কলকাতার একটি দাদা শ্রীশ্রীঠাকুরকে এসে বললেন — বাবা , আমার তাে ফিরে যাবার গাড়ী ভাড়া নেই । শ্রীশ্রীঠাকুর — দেখ তত ভূষণ ! একটা ব্যবস্থা করতে পারিস নাকি ।
ভূষণদা ( চক্রবর্তী ) যেতে উদ্যত হয়েছেন । এমন সময় আসামের একটি দাদা বললেন — আমার কাছে আছে , আমি দিতে পারি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তোর আবার কম পড়বে না তো ?
উক্ত দাদা - না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তবে দে । ••••••••• ক’টাকা লাগবে বল ।
কলকাতার দাদা — গোটা পাঁচেক টাকা হলে চলে ।
আসামের দাদাটি পাঁচটি টাকা দিলেন । টাকার ব্যবস্থা হচ্ছে দেখে ভূষণদা আর গেলেন না । শ্রীশ্রীঠাকুর ভূষণদার দিকে চেয়ে বললেন — ওর কাজ মিটে গেল ব'লে তুই নিশ্চিন্ত থাকসি্ না । সংগ্রহ করার যে - সম্বেগ নিয়ে তুই বেরুচ্ছিলি তেমনিভাবে বেরিয়ে পড়ে যােগাড় করে নিয়ে আয় , কারউ ঠেকা হ'লে দিবি , নিজে খরচ করিস না । যখন সংগ্রহ করবি বলে মনস্থ করেছিস , তখন তা করাই ভাল ।
—বলে শ্রীশ্রীঠাকুর ভূষণদার দিকে চেয়ে একটু হাসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুরের স্মিত মুখখানি দেখে ভূষণদা উৎফুল্ল অন্তরে বেরিয়ে পড়লেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর এরপর উঠে পিছন দিককার দরজা দিয়ে বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করলেন । দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই শ্রীশ্রীঠাকুর মধুমাখা স্নেহল কণ্ঠে ডাকলেন ‘বড়বৌ! ও বড়বৌ! ’ ।
শ্রীশ্রীবড়মা ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাসিমুখে এগিয়ে আসতে - আসতে বললেন— ‘ এই যে । হাতে তার একখানি আসন , শ্রীশ্রীবড়মা আসনখানি দাওয়ায় পেতে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সেই আসনের উপর বসলেন ।
সানুদি এসে দাড়ালেন কাছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সোহাগজড়িত কণ্ঠে বললেন — লক্ষ্মী সােনা ! মাণিক সুনু•••• তুমি এত সকালে নেয়ে ফেলিছ ?
সানুদি - মা'র সঙ্গে চান করেছি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর - বড়বৌ ! আজ তােমার কী বরাদ্দ ?
শ্রীশ্রীবড়মা - ডাল , চচ্চড়ি , ছানা দিয়ে কফি দিয়ে আলু দিয়ে ঝােল , ভাজা আর ভাল দই ও মিষ্টি আছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — ব্যাপার তো গুরুতর । •••••• আচ্ছা , বড় থােকা কেমন আছে ? ওকে আজ কদিন দেখি না ।
শ্রীশ্রীবড়মা — ওর তাে শরীর ভাল না , ইজেকসন চলছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মণি কেমন আছে ? শ্রীশ্রীবড়মামণিরও তো মাঝে - মাঝে পেট খারাপ করে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( ম্লানমুখে ) —আমার সকলটির এক দশা । ওদিকে খেপুও অসুস্থ । আমি যেন সােয়াস্তি পাই না ।
শ্রীশ্রীবড়মা - পাঁচটা থাকলে অসুখ - বিসুখ হয়ই । অসুখ - বিসুখ হ'লে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে ওঠে , ওর জন্য অতো ভাববার কী আছে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তুমি যখন বলো , মনে যেন খানিকটা বল হয় । কিন্তু দুশ্চিন্তা যখন পেয়ে বসে , কিছুতেই যেন ছাড়তে চায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর সন্ধ্যায় তাসুতে কাত হয়ে উত্তর দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন — শীতে কন্কনে হাওয়া দিচ্ছে — শ্রীশ্রীঠাকুরের গায়ে একখানি মাত্র পাতলা কাথা , কাথাখানি নিয়ে নাকের নীচে পর্যন্ত হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছেন । অবিনাশদা । ( ভট্টাচাৰ্য ) ও কেষ্টদা পাশে বসে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর হঠাৎ বললেন — মানুষের চাল - চলন , বেশ - ভূষা , স্নানাহার , চলা ফেরার রকম দেখে তার rhythm of life ( জীবনের ছন্দ ) অর্থাৎ mental flow- র ( অন্তঃস্রোতের ) rhyme ( ছন্দ ) বোঝা যায় । আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ রইলেন । কেষ্টদা মুখে - মুখে যুদ্ধের খবর বলতে লাগলেন , শ্রীশ্রীঠাকুর গভীর আগ্রহ সহকারে সেগুলি শুনলেন ।
#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1
10