[ P - 2 ] 📌 নামধ্যানের সময় একটা জঘন্য চিন্তা আমার মাথায় এলো , তখন কী করব ?

📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,

 🔶 স্বপ্নের ভিতর আমাদের নিরুদ্ধ গ্রন্থিগুলি আত্মপ্রকাশ করে ব'লে শুনেছি , কিন্তু স্বপ্নের সবটাই কি তাই ?
 🔶 শরৎদা ( হালদার ) —ধরুন , নামধ্যানের সময় একটা জঘন্য চিন্তা আমার মাথায় এলো , তখন কী করব ? 

         ২৬ শে অগ্রহায়ণ , বহিষ্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ১১/১২/৪১ ) 

          বেণুবনে পাখীর কাকলী অনাগত প্রভাতের আগমনী ঘােষণা করে , আর সুপ্তিমগ্ন আশ্রমবাসিগণ চকিতে জেগে ওঠে । শান্ত , মৌন , নিস্তব্ধ আশ্রমভূমি , তার মাথার উপরে জ্বলজ্বল করে জ্বলে ভােরের শুকতারা , মাটিতে ঝরে পড়ে শিশির - কণা , পদ্মাচরের শ্যাম তৃণবিতান গা এলিয়ে পড়ে থাকে , অদূরে ঝিলের জলরাশি নিস্তরঙ্গ নিথর হ'য়ে আলস্য - বিলাসে আপনমনে শোভা পায় , গরুগুলি , কুকুরগুলি — তারাও শুয়ে - শয়ে ঘুমায় , কারও কোন তাড়া নেই , নেই কোন ত্বরা , কাল যেন অফুরন্ত প্রত্যেকের হাতে । কিন্তু তারই মাঝে আশ্রমবাসিগণ চকিত চঞ্চল হয়ে ওঠে । ভাবে — বুঝিবা আজ দেরী হয়ে গেল । কত কথা হয়ে । গেল তার কাছে , আমরা সময়মত পৌছাতে পারলাম না । নেশাখোরের যেমন নেশার সময় এলে দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না , নেশার বস্তুু পাওয়াই চাই তক্ষুণি— এও যেন তেমনি । একজন মানুষের জন্য নেশা — তাকে দেখতে ভাল লাগে , শুনতে ভাল লাগে , তার জন্য কষ্ট সয়েও আরাম লাগে । এই যাদু - মানুষটির মধুপর্শ না হলে প্রাণ সবার উপবাসী থাকে , ভাল লাগে না কারও কিছু । তাই ছুটে আসে , তাকে দেখে , তাকে শােনে , আর মৌতাত জমে ওঠে । 

        প্রশ্ন — স্বপ্নের ভিতর আমাদের নিরুদ্ধ গ্রন্থিগুলি আত্মপ্রকাশ করে ব'লে শুনেছি , কিন্তু স্বপ্নের সবটাই কি তাই ?         স্বপ্নদৃষ্ট সব ব্যাপারের তাে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না । 

          শ্রীশ্রীঠাকুর — মস্তিষ্কে যে ইচ্ছা , চিন্তা , কল্পনা ও স্মৃতির ছাপ থাকে , তাই স্বপ্ন আকারে দেখা দেয় । আমাদের অপূর্ণ বহু ইচ্ছা স্বপ্নের মধ্যদিয়ে তৃপ্তির সন্ধান খোঁজে । জোড়াতালি দিয়ে চিন্তামফিক নানাভাবে হাজির হয় । জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে নেই , এমন কত জিনিসও স্বপ্নের মধ্যে দেখা যায় । আমাদের মাথাটা হ’ল চিত্রগুপ্তের খাতা । অনন্ত জীবনের ইতিহাস লেখা আছে ওর পাতায় - পাতায় । নাম - ধ্যানের সাহায্যে মস্তিষ্কের কোষগুলি যদি উপযুক্ত ভাবে জাগ্রত করে তােলা যায় , পূৰ্ব্বপূৰ্ব্ব জীবনের অনেক কিছু স্মৃতিই স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্থায় ধরা দিতে পারে । আমাদের মন যখন যে ভাব - ভূমিতে থাকে , সাধারণতঃ তখন তঞ্জাতীয় স্বপ্ন দেখা যায় । স্বপ্নে যে কেবল অতীতকেই দেখা যায় তা নয় , ভবিষ্যৎকেও জানা যায় , কোন আত্মা এসে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে গেল । একই স্বপ্ন simultaneously ( যুগপৎ ) কয়েকজন দেখছে এমনতরও দেখা যায় । এ - সব tuning ( একতানতা ) -র ব্যাপার । যা আমরা চোখে দেখি না , কানে শুনি না , ইন্দ্রিয় দিয়ে বোধ করি না , তা যে নেই , তা নয় । আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির শক্তি সীমাবদ্ধ , তাই তার উপরে যা ’ , তা আমাদের কাছে না - থাকা হয়ে আছে । কিন্তু এই ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্কের শক্তি অনুশীলনের সাহায্যে অফুরন্তভাবে বাড়ান যায় , তখন আমাদের অনুভবের রাজ্যও অতোখানি বিস্তার লাভ করে । তখন একটা মানুষের বাহ্যে - প্রস্রাব এ দেখেই হয়তো তার চরিত্র ও চেহারা পর্যন্ত বলে দিতে পারবে । আমি একবার ছেলেবেলায় একজনের গু পাড়িয়েছিলাম , পাড়া দিয়েই মনে হলাে এ ভাসার গু ’ , পাড়া দেওয়ার সঙ্গে - সঙ্গেই যে হেগেছে তার চলন - চরিত্র , চেহারা , প্রকৃতি সবই যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো , আমি নির্ঘাত বুঝলাম কে হেগেছে । তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করতে সে হাসতে - হাসতে বললাে- -তুই আবার ওখানে গছিলি কেন ? ”

        প্রশ্ন — আমাদের নিরুদ্ধ গ্রন্থিগুলি নিরসন ও সমাধানের উপায় কী ?

        শ্রীশ্রীঠাকুর — উপায় ঐ ইষ্টস্বার্থ - প্রতিষ্ঠার urge ( অকূতি ) । নামধ্যানে ওগুলি জেগে উঠতে থাকে , এবং তার নিয়ন্ত্রণ , সামঞ্জস্য , সমাধানের পথ আবিষ্কৃত হয় । ইষ্ট আর ইষ্টস্বার্থে মনের আনাগোনা , এমনি করে ধ্যানে আসে চিত্ত - সংযােজনা । মস্তিষ্ককোষগুলি নামের তরঙ্গে যতই আন্দোলিত ও আলােড়িত হতে থাকে , ততই ওগুলির ভিতর অনুস্ত নানা ছাপ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে । অনেক বীভৎস চিন্তা , কল্পনা ও প্রবৃত্তি হাজির হতে থাকে । অনেকে ঐ সব দেখে আঁতকে ওঠে , ভাবে আমার বুঝি অধোগতি হচ্ছে , আবার কেউ - কেউ , মন একাগ্র ও সংযত হচ্ছে না , মনের চঞ্চলতা ও মলিনতা বেড়ে যাচ্ছে , ইত্যাদি ভেবে নাম করা ছেড়ে দেয় । তা কিন্তু ঠিক নয় । নামে সুপ্ত গুপ্ত যা ’ , তা যে আত্মপ্রকাশ করে , সেইটেই লাভ , তখন বােঝা যায় নামের ক্রিয়া হচ্ছে , কিন্তু ধ্যান - সমন্বিত নাম চাই । মনের কোণে যাই উকি মারুক না কেন , ধ্যানের সাহায্যে সেটাকে ইষ্টের সঙ্গে সঙ্গতিশীল ও ইষ্টার্থপূরক করে তোলার কায়দাটা মাথায় এচে নিতে হয় , আবার বাস্তব কর্মক্ষেত্রে হাতে - কলমে করতেও হয় তেমনি । এমনতর করে চলার মধ্যদিয়ে ওগুলির সমাধান ও নিরসন হয় , নচেৎ ধামাচাপা দেওয়া অবস্থায় থাকে । কখন যে কোন্ প্রবৃত্তি বেঘােরে ফেলে তার ঠিক নেই ।

        শরৎদা ( হালদার ) —ধরুন , নামধ্যানের সময় একটা জঘন্য চিন্তা আমার মাথায় এলো , তখন কী করব ? 

        শ্রীশ্রীঠাকুর -- অস্তি - বৃদ্ধির বিরােধী যা ’ , ইষ্টম্বার্থপ্রতিষ্ঠার প্রতিকূল যা ' , তাকেই বলতে পারেন জঘন্য । এখন আপনার কাছে যা জঘন্য হয়ে আছে , তাকেই আপনি সুষ্ঠু ও সুন্দর করে তুলতে পারেন , যদি তাকে অস্তিবৃদ্ধি - অনুগ ও ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার সহায়ক করে তুলতে পারেন । ধরুন , কোন মেয়েছেলের প্রতি অবাঞ্ছিত অনুরাগ আছে আপনার , এবং এটা আপনার মনের তলায় চাপা আছে , নাম - ধ্যানের সময় সেই চিন্তাটা ভেসে উঠলাে , তখন ঐ চিন্তায় অস্থির হ'য়ে আপনি ওটাকে যতই তাড়াতে চেষ্টা করছেন , ততই যেন ওটা আপনাকে পেয়ে বসছে । কিন্তু তখন যদি আপনি চিন্তা করেন , আমি যদি ভালই বাসি কাউকে , তার যাতে ভাল হয় তাই তো আমার করণীয় । পরমপিতার কাছে তার মঙ্গলের জন্য যদি প্রার্থনা করেন , সে যা’তে ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠাপন্ন হয় , সুখী হয় , সেজন্য আপনার যদি কিছু করবার থাকে , সম্মানযােগ্য ব্যবধান বজায় রেখে আপনার বংশ - মৰ্যাদা ও ইষ্টগৌরব স্মরণে রেখে তা কিভাবে করা যায় তার কোন উপায় যদি আপনি চিন্তা করেন তা তাে দোষণীয় হবে না । বরং ঐ চিন্তা ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে গ্রথিত হওয়ার দরুন মঙ্গলপ্রসুই হবে । একেই বলে নিয়ন্ত্রণ , সামঞ্জস্য , সমাধান । সমাধান শুধু মাথায় আসলেই হবে না , তাকে কাজের মধ্যদিয়ে বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে । ধরুন , একজনের প্রতি গভীর বিদ্বেষভাব পােষণ করেন , ধ্যানের সময় ঐ চিন্তা আপনাকে পীড়া দিচ্ছে । আপনি হয়তো ধ্যানে বসে ঠিক করলেন , তার সঙ্গে এরপর থেকে বন্ধুর মত মিশব , আজই তার বাড়ীতে যাব আমার গাছের একটা লাউ হাতে করে নিয়ে , আর তার ছেলেপেলেদের জন্য কিছু চিনেবাদাম নিয়ে যাব । কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভিতরের নিরােধ - প্রবৃত্তির দরুন তা ’ আর আপনি করলেন না , আর মনে - মনে হয়তাে ভাবলেন , আমার অন্তরে বিদ্বেষ না থাকলেই হলো , বাইরে এসব করার দরকার কি ? কিন্তু James বলেছেন— It is purpose that God looks at , and not the intention . Purpose- এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে set forth , অর্থাৎ কী উদ্দেশ্য নিয়ে কী কাজের মধ্যে তুমি নিজেকে ন্যস্ত করেছ সেইটে হলো কথা , তােমার অলস ইচ্ছার কোন দাম নাই । 

          প্রফুল্ল — নাম - ধ্যানের সময় চঞ্চল মনের পিছনে যদি ছুটতে হয় , তাহলে চঞ্চলতা বেড়েই যাবে , মন আর স্থির হবে না । 

          শ্রীশ্রীঠাকুর “ তুমি তাে মনের পিছনে ছুটবে না , ছুটবে ইষ্টের পাছে , —তােমার যা আছে তাই নিয়ে তােমার ভালমন্দ সবকিছুকেই ইষ্টের হাতিয়ার ক'রে নিতে হবে । ইষ্টকে কেন্দ্র করে তােমার ভালমন্দ সবকিছুকে re - adjust ( নবীনভাবে বিনায়িত ) করে তুলতে হবে । এই যদি না কর , তবে তােমার undivided personality ( অখণ্ড ব্যক্তিত্ব ) গ'ড়ে উঠবে না । তোমার তথাকথিত ভালটাকে যদি ইষ্টের কাজে লাগাতে পার , তথাকথিত মন্দটাকেই বা লাগাতে পারবে না কেন ? সব প্রবৃত্তিকেই যে তার কাজে লাগান যায় , আর এই লাগানটাই ধর্ম । জীবনের ক্ষেত্রে সব - প্রবৃত্তিরই উপযােগিতা আছে , যদি তা ধর্মানুগ হয় , ইষ্টানুগ হয় । তুমি যেটাকে ছেটে - কেটে বাদ দেবে — সেইটের সেবা ও সুফল থেকে ততখানি বঞ্চিত হবে । ধর , তুমি ক্রোধী , এই ক্রোধ বিসর্জন দিতে গিয়ে যদি তুমি righteous indignation অর্থাৎ পরাক্রমকে বিদায় দাও , তাহ'লে তােমার জীবনই দুর্ব্বহ হয়ে উঠবে , আর দিন - দিন অসৎকে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হবে । আবার , একটা প্রবৃত্তিও যদি তোমার ইষ্টার্থ - সংন্যস্ত হ’তে বাকী থাকে , অসংলগ্ন থাকে , তবে তার প্ররােচনায় তুমি কখন যে কী করতে পার , তার ঠিক নেই , অমনতর বিচ্ছিন্ন জীবন কখনই নির্ভরযােগ্য নয় । চঞ্চলতা হলো মনের ধৰ্ম্ম , চঞ্চলতা লাখ বাড়ুক তাতে ক্ষতি নেই , যদি তা ইষ্টার্থে হয় । বিভিন্ন প্রকারের চঞ্চলতা যখন ইষ্টার্থী হয়ে আসে তখনই আসে স্থৈর্য , তখনই আসে সাম্যভাব , অর্থাৎ balance . তখন লাখাে কৰ্ম ও দায়িত্বের মধ্যেও আমরা দিশেহারা হই না , সবটাকে সুসামঞ্জস্যে অন্বিত করে তোলার শক্তি গজায় অসীম । আর এটা খুব ঠিক কথা , মানুষ যতই ইষ্টময় হয়ে উঠতে থাকে , ততই তার শরীর - মনের অবান্তর বিক্ষেপ ও বিশৃঙ্খলা স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে । উত্তাল কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যেও সে গভীর প্রশান্তি অনুভব করে । তথাকথিত ভাল - মন্দের দ্বারা সে বড় একটা আবিষ্ট হয় না , সাক্ষীস্বরুপ সবই দেখে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ , সামঞ্জস্য , সমাধান , বিনিয়ােগ , প্রত্যাহার , উপেক্ষা বা তিতিক্ষা যেখানে যেমন প্রয়ােজন তাই - ই করে চলে । জীবনকে নিয়ে সে তখন আর বিব্রত বােধ করে না । তাই বলে ‘ যোগঃ কর্মসু কৌশলম্ । এই যুক্ত যে , তার জীবনে বৈচিত্র্যের অভাব থাকে না , কিন্তু তাই বলে ব্যতিক্রমী চলন থাকে না । কারণ , একের জন্যই সে বহুকে চায় , সর্বাবস্থায় একের অর্থাৎ ইষ্টের পরিপূরণ ও পরিচর্যাই তার লক্ষ্য । তাই সব বৈচিত্র্য সূত্রে মণিগণ ইব ’ মালাকারে গ্রথিত হয়ে ওঠে , chaos ( বিশৃঙ্খলা ) cosmos- এ ( শৃঙ্খলায় ) পর্যবসিত হয় । 

        শ্রীশ্রীঠাকুর তাসুতে তক্তপােষে ব'সে উত্তরাস্য হয়ে কথা বলছেন , কাথা দিয়ে গা - টা ঢেকে বসেছেন , একটা হাটুর নীচে একটা কোলবালিশ , আর - একটা হাটু আসন - গাড়া অবস্থায় । কথা যখন খুব জমাট বেঁধে উঠছে তখন মাঝে - মাঝে ঝুকে - ঝুকে কথা বলছেন — মুখখানি হাসি - হাসি আনন্দে ভরা । চোখের চৌম্বক চাহনি সকলের মনপ্রাণ হরণ করে নিচ্ছে — সে চোখে আছে করুণা , আছে মমতা , আছে আশ্বাস , আছে ভরসা , আছে উদ্দীপনা , আছে আপনকরা আত্মীয়তা , আছে সুখে - দুঃখে , বিপদে - আপদে সর্বাবস্থায় একান্ত - নির্ভরযোগ্য পরম - স্নেহাশ্রয় । তক্তপোষের চারিপাশে ঘিরে ভিতরে - বাইরে দাদা ও মায়ের বসে অনিমেষ নয়নে ভক্তি - আপ্লুতচিত্তে তার সেই লােচনলোভন মনােহর রূপ দেখছেন , আর মন্ত্রমুগ্ধবৎ তার আলাপন শুনছেন । শ্রাবক চিত্ত আনন্দে , বেদনায় বিগলিত হয়ে উঠছে । তাকে পেয়ে আনন্দ , আবার তাকে পেয়েও তার মনােমত হ'য়ে উঠতে না পারায় বেদনা । মিলন ও বিরহ , আনন্দ ও বেদনা যেন গাঁটছড়া বেঁধে আছে মানুষের জীবনে । উপস্থিত সবার উচ্ছ্বাসহীন স্বল্প - তরঙ্গ চেতনার সৰ্বাঙ্গ ব্যেপে ছড়িয়ে পড়েছে এক গভীর প্রশান্তি ও দানাবাধা অনুভবযােগ্য বাস্তব সার্থকতা - বােধ । মন তাদের ধ্যানমগ্ন , বাইরের কোন বিক্ষেপ বা ঝামেলা তাই তাদের তখন ভাল লাগবার কথা নয় ।

          এমন সময় একটি মা হাঁকপাক করে ছুটে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিবেদন করলেন যে , তার ছেলেটি খুব অসুস্থ , ডাক্তার বলছে এখনই ৪০ টাকার ওষুধ লাগবে । 

         শ্রীশ্রীঠাকুর তখনই উপস্থিত যারা ছিলেন , তাদের মধ্যে বিশিষ্ট দু'জনকে লক্ষ্য করে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন — যা তো ! ২০ টাকা করে নিয়ে আয় তো এক্ষুণি । তাড়াতাড়ি আনবি , দেরী করিস না কিন্তু । তাই বলে ধার করবি না বা ধাপা দিয়ে আনবি না — মানুষকে খুশি করে নিয়ে আসবি । 

         যাদের টাকা নিয়ে আসতে বললেন — তারা যেন শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গসুখ ত্যাগ করে এবং নিজেদের ভাবমুগ্ধ আমেজটা নষ্ট করে তখনই যেতে খানিকটা অস্বস্তি বােধ করছিলেন ।

        শ্রীশ্রীঠাকুর তাই লক্ষ্য করে বললেন আমার কাছে ব'সে লাখ ধর্মকথা শােন , তাতে কিছুই হবে না , যদি আমি যা বলি তা ' না কর । না বলতেই যদি কর , সেই - ই সব থেকে ভাল । “ না বলিতে কাজ বুঝিয়া করিবে সেই সে সেবক নাম , সেবক হইয়া কহিলে না করে , তাহার করম বাম । আমাকে যদি ভালবাস তবে আমার দায়িত্বগুলো তােমাদের মাথায় নাও । আর , আমার দায়িত্ব ব'লে নয় , এ তোমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব । মনে রেখাে , তােমরা তোমাদের পারি পার্শ্বিকের কাউকে পড়তে দেবে না । পরিবেশকে সুস্থ , সমর্থ , করে রাখা মানে নিজেরই স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখা । তোমার ভাল থাকা একলা তোমার হাতে নেই , এর অনেকখানি রয়েছে পরিবেশের হাতে । তাই পরিবেশকে সব দিক দিয়ে ভাল ও উন্নত করে তোলা তােমার আত্ম - সংরক্ষণী নিত্য কর্মের অঙ্গীভূত । এ যদি না কর তবে ধর্ম হবে না , অর্থাৎ বাঁচা - বাড়ার পথে চলা হবে না , বিন্যাস - বিভূতি লাভ করা যাবে না । তবে এ সব - কিছু করা চাই সুকেন্দ্রিক হ'য়ে , ইষ্টস্বার্থপ্রতিঠামুখর হ'য়ে , আর তাই - ই ধর্ম । নচেৎ ইটের সঙ্গে সঙ্গতি নেই , খুব সেবা করে বেড়াচ্ছি , ও কিন্তু প্রবৃত্তির সেবা । আবার ,  পরের জন্য খুব করি , নিজের দিকে মােটেই খেয়াল নেই , নিজেকে বিপন্ন ও বিধবস্ত করে তুলছি , তারও কোন মানে হয় না । আমাকে নিজেকেও সুস্থ রাখতে হবে , সক্রিয় রাখতে হবে , চলৎশীল রাখতে হবে । আমি নিজে যদি ঠিক না থাকি তবে ইষ্টার্থী সেবা করব কিভাবে ? মনে রাখতে হবে — আমার এ জীবনও আমার ইষ্টের , তাই একে অবিহিতভাবে নিপীড়িত করবার অধিকার আমার নেই ।

         কথাগুলি শ্রীশ্রীঠাকুর খুব আবেগের সঙ্গে বললেন , দাদা দুটি লজ্জিত হয়ে ভিক্ষায় বেরিয়ে গেলেন । 

         শ্রীশ্রীঠাকুর পুনরায় ঐ মাকে জিজ্ঞাসা করলেন — তের ছাওয়ালের কী অসুখ ? কে দেখেছে ? 

         উক্ত মা — জবর , বুকে - পিঠে বেদনা , হয়তাে নিউমােনিয়া হতে পারে । প্যারীদা দেখেছেন , আমাকে কিছু বলেননি । শুধু তাড়াতাড়ি টাকা জোগাড়ের কথা বলেছেন ।

         শ্রীশ্রীঠাকুর — এই ঠাণ্ডায় নিউমােনিয়া হয়ে থাকলে খুব সাবধান । কোনমতে ঠাণ্ডা যেন না লাগে । আর বেশী নড়াচড়া করতে দিবি না । বেডপ্যানে ঘরেই যেন পায়খানা করে । অন্য ছেলেপেলেদের রােগীর কাছে যেতে দিবি না । আর তুই নিজে যদি সেবা - শশ্রুষা করিস — সুস্থ যারা তাদের রান্নাবান্না ও পরিবেশন তোর না করাই ভাল । আর , ঠাণ্ডা ঠেকাতে গিয়ে ঘরের হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা যেন নষ্ট করিস না । 

     উক্ত মা — আচ্ছা । 

শ্রীশ্রীঠাকুর — তাহলে তুই এখন যা । ওরা আসলে আমি পাঠায়ে দেবেনে । 

মা’টি আশ্বস্ত হয়ে বিদায় নিলেন । 

আবার আলাপ - আলোচনা শুরু হল । 

      Clairvoyance ( অতীন্দ্রিয় দর্শন ) , Telepathy ( ইন্দ্রিয় বা যন্ত্র সাহায্য ব্যতিরেকে দূরবত্তী ব্যক্তিদ্বয়ের মনােভাবের যােগাযােগ ) —ইত্যাদি কী এবং কেমন ক'রে এ - সব সম্ভব হয় , তার উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — আমি নিজে একবার দেখলাম — একটা জাহাজে আগুন লেগেছে , পরে কাগজে দেখা গেল সত্যিই তাই ঘটেছে , আমি হয়তো তামাকের দরকার বোধ করছি , ঠিক তখনই একজন তামাক নিয়ে হাজির । এ - সব mental tune ( মানসিক একতানতা ) -র ব্যাপার । একটা wireless ( বেতার ) -এর transmitting centre ( প্রেরণ কেন্দ্র ) থেকে যে wave ( তরঙ্গ ) বের হয় , in tune ( সমতন ) যে receiving set ( গ্রহণ - যন্ত্র ) যেখানেই থাক না কেন , সেখানেই তা ’ reproduced ( পুনরুৎ পাদিত ) হয় । আমাদের brain- ও ( মস্তিষ্কও ) তেমনি একটা mechanism ( যন্ত্র ) , সেও ধরতে পারে — সামনাসামনি একটা ঘটনা না ঘটলেও , তার সূক্ষ্ম impulse- এ ( সাড়ায় ) brain- এর ( মস্তিকের ) visual centre ( দর্শন কেন্দ্র ) excited ( উত্তেজিত ) হ'য়ে প্রত্যক্ষ দর্শনই যেন ঘটে । অমাদের হয়  কি , এক উপলক্ষ্যে কাজ করতে - করতে প্রবৃত্তির দরুন deviated ( বিচ্যুত ) হয়ে যাই , বহু উপলক্ষ্য এসে পড়ে । আমি হয়তাে ইন্দুকে একটা কাজের ভার দিলাম , সে এক মা’র অনুরোধে একটা জিনিস কিনবার জন্য পাবনা চ'লে গেল । আমি তার উপর depend ( নির্ভর) করে বসে আছি , সে করল অন্যরকম , এমনি করে ভাল intention ( অভিপ্রায় ) থাকা সত্ত্বেও activity ( কর্ম ) insincere ( কপট ) ও treacherous ( কৃতঘ্ন ) হ'য়ে পড়ে । তুমি একটা কাজের ভার নিয়ে তা করতে গিয়ে , রাস্তায় বাধ্যবাধকতায় জড়িয়ে পড়লে , কোনটাই ঠিকভাবে করতে পারলে না , irresponsible ( দায়িত্বহীন ) হ'লে , go - between ( কথা - খেলাপ ) করলে । ঘুরলে , কিন্তু কোন ফয়দা হ'ল না । আমি আর কী করবো , আমি তত cruel ( নিঠুর ) হ'তে পারি না , তুমি নিজেই হয়তো তােমার কাজ justify ( সমর্থন ) করবার জন্য আমার কাছে কত কথা বলছ , আমার sympathy ও appreciation ( তারিফ ) চাচ্ছ , তোমার দিকে চেয়ে তখন তোমার complex- এর ( প্রবৃত্তির ) nurture ( পােষণ ) -ই দিতে হলাে , বললাম ( সহাস্যবদনে ) চেষ্টা তাে করেছিস্ — তুই আর কী করবি ? ' — তুমি খুশি হয়ে গেলে । ( গম্ভীর কণ্ঠে ) বলি , এতে তােমার কী হলো , তুমি তাে অহল্যা হয়ে চললে , পাষাণ হ'য়ে গেলে , নিজের দোষের গুরুত্ব সম্বন্ধে এতটুকু বোধও তােমার রইল না । খাঁটি কথাটা বলতে গেলে তখন তুমি আঁৎকে উঠবে , কিন্তু বস্তুতঃ তোমার activity ( কর্ম ) insincere ( কপট ) ও treacherous ( কৃতঘ্ন ) হ'লো , আবার , তোমার করা দিয়ে ছাড়া তোমাকে বিচার করার পথ নাই , তাই বলে with mere good intentions , hell is prover bially paved'— অর্থাৎ নিক্রিয় সদভিপ্রায় দিয়েই নরকের পথ মৰ্ম্মরখচিত । এইভাবে যদি চলতে থাক , নিজেদের চলনা যদি না বদলাও , তবে তার ফল যা ’ অাসবার , তা’ও   আসবে , lumps of disintegrated unadjusted experiences ( কতকগুলি অসংহত , অনিয়ন্ত্রিত , অভিজ্ঞতার বিচ্ছিন্ন দলা ) ছাড়া আর কিছুই পাবে না । চলার পথে পাকে - পাকে নানা অসংলগ্নতা জড়িয়ে যাবে , দুঃখ - দুর্দ্দৈব ঘিরে ধরবে , আর অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতে থাকবে , অথচ কোন হদিস পাবে না , জীবনে কেন এই দুভোগ ?  ফলকথা , যতদিন হাজার টানে ঘুরবে , ততদিন brain ( মস্তিষ্ক ) থাকবে scattered ( বিক্ষিপ্ত ) হয়ে , দৈনন্দিন জীবনের প্রয়ােজন ও সমস্যারও সমাধান করতে পারবে না । কিন্তু একের টানে একেরই জন্য যদি পারম্পর্যক্রমে যথাবিধি শত কাজও কর , হাজার ব্যাপারেও ঘােরো , তােমার brain ( মস্তিক ) সুস্থ থাকবে ,  সতেজ থাকবে , কোন সমস্যাকেই দুরূহ মনে হবে না , সমাধান - শক্তির বহির্ভূত মনে হবে না , struggle ( সংগ্রাম ) -এর মধ্যেও life ( জীবন ) enjoyable ( উপভােগ্য ) মনে হবে , তা ছাড়া তােমার brain- এর ( মস্তিষ্কের ) tuning- এর ( একতানতার ) tendency ( প্রবণতা ) বজায় থাকবে , বেড়ে যাবে , তুমি নিজেই কত কি বোধ করতে পারবে তখন । মানুষের active , normal , concentric ( সক্রিয় , সহজ , সুকেন্দ্রিক ) চলনার পথে , বহু বিভূতিই অনায়াসলভ্য হয়ে ওঠে , কিন্তু সে ওদিকে খেয়াল দেয় না , ওদিকে বেশী নজর দিতে গেলে মানুষ লক্ষ্যভ্রষ্ট হ'য়ে পড়ে।

#Alochona_prosonge_part_2
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড 
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1