📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔶 প্রশ্ন — দেবলােক কী ? দেবলোক বলে কিছু আছে নাকি ?
🔶 প্রশ্ন — প্রেতলোক কী ? তাদের সঙ্গে যােগাযোগের কি কোন উপায় নেই ?
🔶 প্রশ্ন — গয়ায় পিণ্ডদানে কী হয় ?
২৫ শে অগ্রহায়ণ , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ১০/১২/৪১ )
‘ তােমার প্রীতি ছিন্ন জীবন গেঁথে - গেঁথে আনে । ছিন্ন জীবন গ্রথিত হয় তার মঙ্গল - কর - স্পর্শে , ব্যক্তিত্ব যাদের প্রবৃত্তি - বিচ্ছিন্ন , বিখণ্ডিত , তার প্রতি অনুরাগে , তা ’ সংহত , সম্পূর্ণ ও সংগ্রথিত হতে থাকে , আবার মানুষ যারা পরস্পর - বিচ্ছিন্ন , যাদের মধ্যে নেই কোন যােগ - সুত্র , প্রীতি - সুত্র , তাকে কেন্দ্র করেই তারা মালাকারে গ্রথিত হ'য়ে ওঠে , গভীরভাবে প্ৰীতি - নিবদ্ধ হয়ে ওঠে । তিনি এসেছেন , হারান যা ’ , ছড়ান যা ’ , তা কুড়িয়ে নিতে । এইভাবে তার মঙ্গল - মঞ্জিলে পূজারীর দল নানা দিক - দেশ হ'তে নানা ভাব নিয়ে এসে সমবেত হয় , প্রত্যেকের থাকে স্বতন্ত্র লক্ষ্য , স্বতন্ত্র চাহিদা , কিন্তু তাকে ভালবেসে তারা একৈক - লক্ষ্য , একৈক - সঙ্কল্প হয়ে উঠতে থাকে । সেই ঐকায়নী সূত্র - বেদীমূলে তাই তারা বার - বার সমবেত হয় , বার - বার মিলিত হয় , কারণ ঐ মহামণ্ডপই তাদের সুখস্বর্গ । আজ প্রভাতেও তার ব্যত্যয় হয়নি — ভক্তবৃন্দ মিলিত হয়েছেন শ্রীমন্দির - অঙ্গনে । মধুস্রবা তিনি — অবারিত ও অবিরত জীবনের মধু বিলিয়ে চলেছেন তিনি । অকুণ্ঠভাবে , আর দৈন্য - পীড়িত মানব তা ’ আকণ্ঠ পান করে ধন্য হচ্ছে , কৃতকৃতার্থ হচ্ছে , তৃপ্তি - পুষ্ট হয়ে উঠছে । কোলের শিশুকে স্তন্য - পরিতৃপ্ত করে মায়ের যে সুখ , সেবায় , সােহগে , শাসনে , ভৎসনে , অমৃত নির্দেশদানে মানুষের জীবনকে সর্ব্বাঙ্গীণভাবে পরিস্ফূর্ত্ত ও নধরকান্তি - বিশিষ্ট করে তুলে তার সেই সুখ , এ না করে তার নিস্তার নেই , এই তার স্বভাব , এই তার প্রকৃতি — এতেই নিত্যনিরত তিনি ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —মানুষের তাে প্রবৃত্তির অন্ত নেই , তা নিয়ন্ত্রিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা মিলেমিশে আপনার পথে চলব কিভাবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সবার common interest ( একই স্বার্থ ) থাকলে difference ( অনৈক্য ) die out করবেই ( তিরােহিত হবেই) , difference ( অনৈক্য ) থাকলেই বুঝতে হবে কোথাও তা থেকে deviation ( বিচ্যুতি ) হয়েছে । Difference ( অনৈক্য ) sincere ( খুঁটি ) insincere ( অখাঁটি ) মধ্যে , এবং insincere (অখাঁটি ) insincere ( অখাঁটি ) -এর মধ্যে
উভয়তঃ আসতে পারে । Sincere ( খাঁটি ) মানুষ যারা , তারা হয় uncom promising ( আপােষরফাহীন ) , তাই তারা insincerity ( কপটতা ) বরদাস্ত করতে পারে না , সেখানে তারা রুখে দাড়ায় , কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে কারও প্রতি তাদের এমনতর আক্রোশ থাকে না , যে তাদের স্বভাব শােধরালেও তাদের নিয়ে তারা মিলেমিশে চলতে পারবে না । বরং মানুষকে পরিশুদ্ধ করে নেবার ঝোঁক তাদের মধ্যে খুব প্রবল দেখা যায় । তাই খাঁটি ও অখাঁটির মধ্যে যে অনৈক্য তার একটা সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে । কিন্তু অখাঁটি অখাঁটির মধ্যে যে অনৈক্য , সে অনৈক্যের সমাধান দুরুহ , —শেয়ানায় - শেয়ানায় কোলাকুলির মত মাঝখানে মুঠুমহাত ফাক থেকেই যায় । তাদের মধ্যে যে অনৈক্য , প্রকৃতির তরফ থেকেই তার একটা প্রয়োজন আছে । তারা যদি অসদুদ্দেশ্য সাধনের জন্যও স্থায়ীভাবে পুরােপুরি ঐক্যবদ্ধ হতে পারতাে , তাহলে সেই ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে জগতের অনেক বেশী ক্ষতি করতে পারতো । অবশ্য অনেক সময় যে তারা ঐভাবে সমশত্রু নিধনের জন্য ঐক্যবদ্ধ না হয় , তা নয় , কিন্তু সেখানেও থাকে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সন্দেহ ও অবিশ্বাস , তাই সে মিতালি ধােপে টেকে না । অাদত কথা , Ideal ( আদর্শ ) -এর interest ( স্বার্থ ) prominent ( প্রধান ) হ'য়ে ওঠা চাই , তখনই সব adjusted ( নিয়ন্ত্রিত হয় , একটা complex ( প্রবৃত্তি ) interest ( স্বার্থ ) হ'য়ে উঠলে দেখেন না মানুষ কি করে । ঐ কানী বােষ্টমীর কথাই হয়তাে কতভাবে কয় , তার জন্য সবকিছু ignore ( উপেক্ষা) করে তাকেই সতী - সাবিত্রীর আসনে বসাতে চায় । বুকখানা যদি একবার কাবেজ হয় , ইষ্টের মুখখানা অহরহ যদি চোখের সামনে ভাসে , তিনিই যদি সবের বাড়া হন , তখন আপনা থেকেই বেয়াড়া যা ’ তা adjusted ( নিয়ন্ত্রিত ) হয় । Adjust ( নিয়ন্ত্রণ ) করে কি তারপর interested ( অন্তরাসী ) হয় ? তা কখনো হয় না , আর এ ছাড়া adjustment ( নিয়ন্ত্রণ ) -এর পথও নেই । প্রফুল্ল — মনুষ্যেতর যা - কিছু সম্বন্ধে আমাদের যা - কিছু ধারণা তা তাে anthropomorphic ( মনুষ্যাচিত ) —সে সবের সত্যতা কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমরা যখন মানুষ তখন মানুষের standard- এ (মাপকাঠিতে ) ভাবা ও চলা ছাড়া আমাদের উপায় নেই — এই গণ্ডীর মধ্যে আমরা আবদ্ধ , তবে আমাদের knowledge ( জ্ঞান ) ও experience (অভিজ্ঞতা ) -র accuracy ( যথার্থতা ) বুঝব — তা দিয়ে আমাদের কতখানি ঈশত্ব বা আধিপত্য বিস্তার হয় — সেই মাপকাঠি দিয়ে । কোন বিষয়ে আমরা যদি শুধু মনগড়া ধারণা নিয়ে চলি , তাহলে বাস্তব প্রয়ােগ বা উপযােগিতার ক্ষেত্রে ফল মিলবে না , । উল্টো হয়ে যাবে । গ্রহ , উপগ্রহ , জল , বায়ু , সাপ , বিড়াল , বাঘ , কুমীর , যত বিষয়ে আমাদের যত জ্ঞানই থাক না কেন , সেই জ্ঞানের সাহায্যে ওগুলিকে কাবেজে এনে আমাদের কাজে যদি লাগাতে পারি , তখন বুঝব সে জ্ঞান সত্য ও বাস্তব । এমনতর জ্ঞানকেই বলে বিজ্ঞান , তাই বিজ্ঞান মানুষকে করে তােলে শক্তিমান । কিন্তু এই জ্ঞান ও শক্তি যদি কাউতে সার্থক হ'য়ে না ওঠে , আত্ম ভোগােপকরণ আহরণই যদি তার কাম্য হয় , তবে মানুষ দানব হয়ে ওঠে , তাই আসে ধর্মের প্রয়ােজন । আদর্শানুগ না হলে জ্ঞান , বিজ্ঞান , শক্তি কোনটারই আবার , আদর্শ ও ধর্মের অনুসরণ আছে , কিন্তু জ্ঞান , বিজ্ঞানশক্তির বিকাশ নেই — সেও এক অজগবী ব্যাপার । ধর্মানুগ , আদর্শানুগ জ্ঞান , বিজ্ঞান ও শক্তির পথে চলাই আমাদের অমৃত অভিযান ।
প্রশ্ন — দেবলােক কী ? দেবলোক বলে কিছু আছে নাকি ? শ্রীশ্রীঠাকুর - দেবতা মানে যিনি দীপ্তি পান । দেবলােক মানুষের life ( জীবন ) -এর একটা plane ( স্তর ) -বিশেষ । মানুষ যখন with all his characteristics সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার পারিপার্শ্বিকের fulfilment ( পরিপূরণ ) -এর ভিতর - দিয়ে তাদের প্রত্যেকের object of regard and interest ( শ্রদ্ধা ও অন্তরাসের পাত্র ) হয়ে দাড়ায় , মানুষের ইষ্টানুগ সেবায় তার জীবন যখন দীপ্তি পেতে পেতে এগিয়ে চলে — স্বতঃস্ফুর্ত্ত চারিত্রিক অভিব্যক্তি ও অনুরঞ্জনায় , তখন সে দেবলোকে বাস করে । ঐ active ( সক্রিয় ) characteristics ( বৈশিষ্ট্যগুলি ) -ই হয় তার plane ( স্তর ) । ভারতকে এক সময় পৃথিবীর লোকে দেবভূমি বলতো , তার মানে ভারতবর্ষে যে - সব লোক বাস করতো , তাদের বেশীর ভাগ লোকের চরিত্রই ছিল দেবোপম । এই ভারতবর্ষই আবার দেবভূমি , দেবলােক হতে পারে যদি তােমরা আৰ্য্যাচারে চল । বৈশিষ্ট্যপালী অপূরয়মাণ পুরুষােত্তমের অনুবৰ্ত্তন , বর্ণাশ্রম , দশবিধ সংস্কার , নিত্য পঞ্চমহাযজ্ঞ , আদর্শ বিবাহ , আদর্শ শিক্ষা , অনুলোম অসবর্ণ বিবাহ , দৈনন্দিন জীবনে যজন , যজন , অধ্যয়ন , অধ্যাপনা , দান , প্রতিগ্রহ , পারিপার্শ্বিকের সেবা , সদাচার পালন , ব্রত ও তীর্থের অনুসেবন — এই সবগুলি হলো অৰ্যাচারের অঙ্গীভূত । এইগুলির অনুসেবনে মানুষ ধীরে - ধীরে বংশ পরম্পরায় দেবতুল্য হ'য়ে ওঠে । এবং সে শুধু এক - আধ জন নয় , গোটে - গোটে হতে থাকে , ঘরে - ঘরে হতে থাকে । অর , আজ যে সম্প্রদায়ে - সম্প্রদায়ে এত হানাহানি , বৈশিষ্ট্যপালী আপুরয়মাণ যুগ - পুরুষোত্তমকে ধ'রে চলার রীতি যদি থাকে , তাহ'লে বিভিন্ন সম্প্রদায় থাকলেও সাম্প্রদায়িকতা থাকে না , প্রত্যেকে প্রত্যেককে মনে করে , আমারই একজন , কারণ যুগপুরুষোত্তমের মধ্যে পূর্ধ্বতন প্রত্যেকটি অবতার মহাপুরুষই জীয়ন্ত থাকেন । তাকে ভালবাসলে আমরা পূর্বতন কাউকেই অবজ্ঞা করতে পারি না — প্রত্যেককেই মনে করি , আমার ঠাকুর । তাই গুরুভাইয়ের প্রতি যে প্রীতি , সেই প্রীতিরই জাগরণ হয় সকলের প্রতি । সাম্প্রদায়িকতা সেখানে আসবে কোথা থেকে ? তাই দেশকে যদি এ বিষ থেকে বাঁচাতে চাও , যাজনের ভিতর - দিয়ে সৰ্ব্বত্র ছড়িয়ে পড় , সকলের চোখ খুলে দাও , যাতে শয়তান তার প্রভাব বিস্তার করতে না পারে । এখনই যদি কোমর - বেঁধে না লাগ , পরে আর সামাল দিতে পারবে না । অনৈক্য ও বিভেদই কায়েম হয়ে চলবে ।
এর মধ্যে একটি নূতন দাদা বাইরে থেকে এইমাত্র এলেন , তিনি মাতৃমন্দিরের ও মায়ের কুটিরের মাঝখান অতিক্রম করতে না করতেই শ্রীশ্রীঠাকুর উচু গলায় উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন — কিরে । কখন আলি ? আয় , আয় ।
দাদাটি এই প্রথম এসেছেন আশ্রমে , শ্রীশ্রীঠাকুরের স্নেহসিক্ত কণ্ঠের প্রাণকাড়া মধুর আহবান শুনে তিনি আনন্দে ডগমগ হয়ে দ্রুতপদে এগিয়ে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করলেন , প্রণাম করে উঠে বললেন , ‘এইমাত্র আসছি ‘।
শ্রীশ্রীঠাকুর — যা । যা ! তাহলে গেষ্ট হাউসে যেয়ে জিনিসপত্র রেখে হাতমুখ ধুয়ে ঠিকঠাক হ'য়ে আয় গিয়ে । পরে শুনবোনে সব খবর । ওরে ভূষণ ! (ভূষণদা দাড়িয়েছিলেন ) এরে নিয়ে যা তাে ! ও নতুন মানুষ , ভাল করে দেখাশুনাে করিস্ । আর দ্যাখ ( উক্ত দাদাটিকে ) , এখানে কিন্তু অনেক সময় চুরিটুরি হয় , টাকা - পয়সা , ঘড়ি , কলম সাবধানে রাখিস ।
ভূষণদা ( চক্রবর্ত্তী ) দাদাটিকে নিয়ে গেষ্ট হাউসের দিকে রওনা হলেন । দাদাটির এক হাতে একটি বিছানা , আর হাতে একটি সুটকেশ — তার তেমন কষ্ট হচ্ছিল না নিতে , কোনটাই তেমন ভারি নয় ।
কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর ভূষণদাকে বললেন — একটা জিনিস তুই হাতে নে , বুঝি , রাতে জেগে গাড়ীতে এসেছে , শীতে কষ্ট হচ্ছে ।
ওরা চলে যাবার পর গেষ্ট হাউসের ( অতিথিশালার ) চুরি - সম্বন্ধে আবার কথা উঠলো
শ্রীশ্রীঠাকুর — এই চুরিটা যে তোমরা বন্ধ করতে পারছ না , এ তােমাদেরই দোষ । চোর তাে চুরি করবেই , চুরি করা তার পেশা , কিন্তু গৃহস্থ সজাগ থাকবে না কেন ? চোর ঠেকাবার মত সজাগ ও সাবধান যদি আমরা না থাকি , তবে সব ব্যাপারেই ঐ শৈথিল্য ও অসাবধানতা রয়ে যাবে , এবং তাতে কত ক্ষতি যে হ'তে পারে তার ইয়ত্তা নেই । অনেকে বানরের উৎপাতের কথা বলে , আমি ইচ্ছা করেই বানরগুলি রেখে দিয়েছি । বানর তো উৎপাত করেই , কিন্তু যা'তে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে , ততখানি alert ( হুশিয়ার ) থাকা লাগবে । এই হুশিয়ার ও সপ্রতিভ থাকার অভ্যাস একান্ত প্রয়ােজন । পরের service ( সেবা ) নিয়ে - নিয়ে আমরা পঙ্গু , হয়ে গেছি , একেই বলে পরাধীনতা । আমাদের সবকিছুর জন্য আমরা পরমুখাপেক্ষী , আত্মরক্ষা ও বাচা - বাড়ার জন্য যা - যা প্রয়ােজন , সেগুলি যত আমরা নিজেরা করতে পারব , ততই আমরা স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাব । স্বাধীনতার মধ্যেও instinctive capacity ( সহজাত সামর্থ্য) অনুযায়ী বৃত্তিবিভাগ থাকবে , পরস্পর নির্ভরশীলতা থাকবে , কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষ বর্ণোচিত কর্মদক্ষতার ভিত্তির উপর যত চৌকস হ'য়ে ওঠে ততই ভাল । শিক্ষার ধারাকেও ঐ ভাবে মোড় ফিরিয়ে দিতে হয় — তাই আমি হাতে - কলমে কাজের উপর অত জোর দিই । বাজার - হাট , ক্ষেত - খামার , ঘর - বাড়ী , দোর , পুকুর , রাস্তা - ঘাট , স্বাস্থ্য , খাদ্য - খানা , আয় - উপার্জন , আমোদ , আনন্দ , কাজ - কারবার সব দিক সুষ্ঠুভাবে বজায় রাখতে গেলে একটা active acquaintance ( সক্রিয় পরিচিতি ) রাখা লাগে বাস্তব ব্যাপারগুলির সঙ্গে । শিক্ষা - ব্যবস্থার যদি এগুলির সঙ্গে সংস্রব না থাকে , তবে তা কার্যকরী হয় না , জীবন - রক্ষণী হয় না । তাই আমরা যত বেশী স্বাবলম্বী হতে পারি , সতর্ক হ'তে পারি , অতন্দ্র হতে পারি , সেই চেষ্টা করা লাগবে ।
প্রশ্ন — প্রেতলোক কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমার মনে হয় , মানুষ মরে গেলেও বেঁচে থাকে এবং সেই অবস্থাকে প্রেতলোক বলে ।
প্রশ্ন — তাদের সঙ্গে যােগাযোগের কি কোন উপায় নেই ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — কত কী - ই তাে শুনি । গোপাল COT investigation (গবেষণা ) করছিল । গােপাল নাকি পড়েছিল — একটা কাচের tube ( নল ) এর মধ্যে একটা ইদুর মারার পর rodopsin screen ( রডপসিনের পদ ) -র উপর নাকি হুবহু ইদুরের shape ( আকৃতি ) -র একটা সুক্ষ্ম ছায়া পড়েছিল । আমি একদিন বেলগাছতলার ঘরে শুয়েছিলাম । যেন দেহ থেকে বেরিয়ে গেলাম । রাস্তায় দুধওয়ালার সঙ্গে দেখা হলো , তার সঙ্গে কথা বললাম , আরাে কি - কি হ'লো সব মনে নেই , পরে এসে বহু কষ্টে আবার দেহের মধ্যে ঢুকে পড়লাম । পরে মিলিয়ে দেখলাম — দুধওয়ালাকে যে কাজ করতে বলেছিলাম , সে ঠিক তাই করেছে । একলা দেখলে তো হয় না , স্বপন দেখার মত হয় । স্বপন একজনের ব্যক্তিগত বোধ । জিনিসটা যদি এমন হয় যে , environment ( পরিবেশ এর কারও বোধ করার কোন অন্তরায় না থাকে , তবেই তার যথার্থতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় , সেইজন্য scientific research ( বৈজ্ঞানিক গবেষণা ) দরকার । গােপাল আরম্ভ করেছিল , চলে গেল , সে মানুষই বা কোথায় পাই ?
প্রশ্ন — গয়ায় পিণ্ডদানে কী হয় ? ওটা তো একটা সংস্কার বই আর কিছু নয় । পৃথিবীর কতলােক ওসব করে না , তাদের তাে কোন অসুবিধা হয় না । শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যবদনে ) -গয় রাজার রচিত পুরী গয়া , গয় এসেছে ‘ গৈ ’ - ধাতু হ'তে , গৈ - ধাতু মানে , গান , কীত্তন । আমার মনে হয় , মানুষের নামগুলি accidental ( আকস্মিক ) নয় , নামের অর্থের সঙ্গে নামধারীর প্রকৃতির সামঞ্জস্য থাকে । উক্ত গয় রাজার যে special activity ( বিশেষ কর্ম ) , সেখানেও তার ছাপ থাকা সম্ভব অর্থাৎ গয়া এমন একটি স্থান যেখানে মানুষের স্মৃতি , মানুষের গুণ গীত হয় , কীর্ত্তিত হয় । আবার , ওখানে রয়েছে সব্ববন্ধনবিমোচন বিষ্ণুপাদপদ্ম , গদাধরের পাদপদ্ম । ওস্থানের এমনই মহাত্ম্য , ওর সঙ্গে এমনই tradition ( চিরপ্রচলিত রীতি ) জড়িত যে ওখানে গেলেই মানুষ স্বতঃই যুগপৎ শ্রীহরি ও বিগত প্রিয়জন যারা তাদের স্মরণ , মনন , গুণকীর্ত্তনে বিভাের হয়ে ওঠে । Hypnotism ( সম্মােহন ) -এর ব্যাপারে দেখ না — একটা বােতাম সম্বন্ধে এমন suggestion ( সঙ্কেত ) হয়তাে দিয়ে দিল যে , ১৫ বছর পরেও সে বােতাম দেখলে hypnotised ( সম্মোহিত ) হয়ে যায় । যা হােক , গয়ায় গিয়ে নানা ceremony ( অনুষ্ঠান ) -এর ভিতর দিয়ে ঐভাবে মন concentrated ( কেন্দ্রীভূত) হয় । তাছাড়া , গয়ায় পিণ্ডদান হিন্দুদের ঘরে এমনই একটা important ( গুরুত্বপূর্ণ) ব্যাপার যে , কেউ গয়ায় গেলে আত্মীয়স্বজন , বন্ধুস্থানীয় যারা তারাও হয়তাে তার গয়ায় যাওয়া উপলক্ষ্য করে সেই বিগত আত্মার চিন্তা নিয়ে জড়িত থাকে , সঙ্গে - সঙ্গে পতিতপাবন বিষ্ণুর মাহাত্ম - চিন্তনও ওর সঙ্গে মিশে থাকে । বিগত আত্মার প্রিয়জন যারা তাদের স্ত্রী - পুরুষ সবার মধ্যে যদি এমন ভাব থাকে , তবে তার পিণ্ড ধরণের অর্থাৎ ঐ বিদেহী সত্তার disintegrated ( বিশ্লিষ্ট ) molecules ( পিণ্ডিকা ) -গুলির integrated ( সংহত ) হবার , দেহ ধারণ করবার , ecto - plasmic body (অতিবাহিক দেহ ) -এর protoplasmic body- তে ( জৈবী শরীরে ) রূপ পরিগ্রহ করবার সুবিধা- হবারই কথা । ঐ বিষ্ণুপাদপদ্ম হলো সার্থক বিবৰ্ত্তনী ও কেন্দ্রায়নী সূত্র । বিগত আত্মার স্মৃতির সঙ্গে ঐ বিষ্ণুচিন্তা জাগরুক থাকায় , সেই জীবাত্মা তার ভালমন্দ সব নিয়ে ও একটা সুকেন্দ্রিক উদ্বর্ত্তনী সুর নিয়ে আসবার সুযােগ পায় । আমার এই রকম মনে হয় । তাই সপরিবেশ ভাব - সমন্বিত হয়ে গয়ায় পিণ্ডদানের একটা বিশেষ উপযােগিতা আছে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস । তাছাড়া পিতৃতর্পণ হিন্দুদের নিত্যকরণীয়ের মধ্যে । এতে পিতৃপুরুষের স্মৃতি আমাদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে জাগ্রত থাকে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাও সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে । জীয়ন্ত শ্রদ্ধা ও আভিজাত্যবােধ আমাদের চরিত্রকে অনেকখানি উন্নত করে তােলে । আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলি করার প্রয়ােজন আছে এইজন্য যে , অনুষ্ঠান গুলি আমাদের ভিতরের ভাবকে পুষ্ট করে তােলে । আচার , অনুষ্ঠান ও অভিব্যক্তি যদি বন্ধ করে দেওয়া যায় , তবে ভিতরের ভাবও আস্তে - আস্তে শুকিয়ে যেতে থাকে । আমাদের দেশে রীতি আছে , স্বামী বা গুরুজন বাইরে থেকে আসলে শ্রী যদি বসে থাকে তবে তখনই উঠে দাড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে বসাবে এবং তিনি বসতে আদেশ করলে বসবে ।
( শ্রীশ্রীঠাকুর কথা বলতে - বলতে চকিতে চৌকি ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে দেখালেন — কেমন স্তব্যস্ত হয়ে উঠে দাড়িয়ে , কি ভঙ্গিতে , কেমন আগ্রহ ও বিনয় সহকারে গুরুজনকে অভ্যর্থনা করতে হয় ) । এই অভিব্যক্তিটুকু যদি না দেখায় , আর যদি বলে — অন্তরে শ্রদ্ধা থাকলেই হ'ল তাহলে কিন্তু অন্তরের শ্রদ্ধাও ধীরে - ধীরে উবে যেতে থাকে । গয়ায় পিণ্ডদান বা পিতৃতর্পণ আমাদের মধ্যে যেমন করে যেভাবে আছে , অন্য দেশে বা অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনভাবে না থাকলেও , তাদের মধ্যেও পূৰ্বপুরুষের স্মৃতিপূজা তাদের মত করে আছে । পিতৃপুরুষের স্মৃতি - তর্পণ যদি না থাকে , তবে কোন জাতিই বড় হতে পারে না । ওই - ই তাে মানুষকে প্রেরণা জোগায় । তােমরা যে ইতিহাস পড় , সেও তাে ঐ জিনিস । জাতের ইতিহাসের প্রতি মানুষের সত্যিকার শ্রদ্ধা হয় না , যত দিন মানুষ নিজের বংশের , নিজের পিতৃপুরুষের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে না ওঠে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সে - শ্রদ্ধা নিবেদন না করে ।
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1



10