📚 আলোচনা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ড,
🔶 মানুষ যদি ভগবানের বাঁধনে বাধা না থাকে , তাহ'লে শয়তানের বাঁধনে বাঁধা পড়বেই , যে - কোন না কোন রকমে
🔶 প্যারীদা — মানুষের জীবনে Ideal ( আদর্শ ) না থাকলেই যে তার বাঁচা বাড়া বিপন্ন হবে তার মানে কী ?
🔶 অমর ভাই উঠে পড়লেন । বহিরাগত একটি ভাই এসে বললেন — টেষ্ট দিয়ে এসেছি । তিন মাস পরে final ( শেষ ) পরীক্ষা , যত পড়ি কিছুই তাে মনে থাকে না ।
২৭ শে অগ্রহায়ণ , শুক্রবার , ১৩৪৮ ( ইং ১২/১২/১৯৪১ )
স্থান — বঁধের ধারের তাসু ।
কাল — প্রাতঃকাল , সৰ্যোদয়ের প্রাক্কাল ।
‘ মন চল নিজ নিকেতনে ।’ প্রিয়জন - পরিবেষ্টিত নিজের গৃহকোণেও মানুষের মন ক্ষণে - ক্ষণে উতলা আকুল হয়ে ওঠে , মনে হয় -- এ তার চিরকালের ঘর নয় , এ তার চিরদিনের পরিবেশ নয় । সহস্র বান্ধব মাঝে নিজেকে মনে হয় নিঃসঙ্গ , একাকী । তার মনের কথা বুঝবার , প্রাণের ক্ষুধা মেটাবার , তার অন্তহীন আগ্রহ - আকূতি ও ভালবাসার বিনিময়ে তার সত্তাকে সার্থক করে তুলবার কেউ নেই সেখানে । তাই , মানুষ খোঁজে সেই ঘর , সেই মানুষ , যেখানে তার অন্তরাত্মা অখণ্ড মহিমায় বিকশিত হয়ে আপন বিভাবৈভবে বিরাজ করতে পারে , যেখানে সত্তা পেতে পারে তার সুসম্পূর্ণ সৰ্ব্বাঙ্গীণ আশ্রয় , যেখানে এক প্রেমে মিটতে পারে সৰ্বপ্ৰেমতৃষা , যিনি শান্ত হ'য়েও অনন্ত , যার কেন্দ্র আছে কিন্তু পরিধি চিরদিনের মত সীমায়িত হয়ে যায়নি অর্থাৎ অনন্ত বিস্তার ও গভীরতাই যার স্বরূপ - কথা । এক কথায় , মানুষ চায় সেই ঘর , মানুষ চায় সেই মানুষ , যেখানে যাঁতে আবদ্ধ হ'য়ে শুদ্ধ , বৃদ্ধ , মুক্ত , শাশ্বত সত্তা ক্ষিন্ন , ক্ষুন্ন , বিপন্ন ও সঙ্কোচশীর্ণ না হয় , বরং সে তার সুস্থ , সুস্থ , লীলায়িত জীবন নিয়ে বিশ্ব - বিবর্তনের তালে - তালে পা ফেলে চলতে পারে ।
বিংশ শতাব্দীর মানুষের এই চাওয়া আজ নিরন্তর পরিপূরিত হচ্ছে বাংলার এক নিভৃত কেন্দ্রে । সে কেন্দ্র - পাবনা সৎসঙ্গ । তার প্রাণপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে তাই জীবনকামী সবাই আসে । তঁাকে , তার আশ্রমকে বিশ্ব - মানব মনে করে আজ — আপন জন , আপন স্থান — নিজ নিকেতন । এই অনিন্দনীড়ে সমবেত হ'য়ে সবাই অনিন্দ - সুধা পান করে ।
বিশ্বের ভাণ্ডারী যিনি — তিনি সুধাসত্র খুলে বসে আছেন । পিয়াসী প্রাণ যত , তারা আসে , অন্তরের আকাঙ্ক্ষা নিবেদন করে , পায় তার অমৃত - অবদান , তা আস্বাদন করে , —ধন্য হয় , তৃপ্ত হয় , পরিপূরিত হয় ।
প্রশ্ন — শুনি যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা ’ আছে ভাণ্ডে , তার অর্থ কী ? এবং ভাণ্ডে যা আছে তা সব জানতে পারি কী করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - এ ওই microcosm ( মনুষ্য - শরীর ) ও macrocosm ( ব্রহ্মাণ্ড ) -এর কথা । বিশ্বজগতে যা আছে , মানুষের শরীরেই তা আছে কেন্দ্রীভূত হয়ে । আবার , মানুষের সমগ্র শরীরে যা আছে , শরীরের একটি কোষের মধ্যেও তা আছে । একটা অণুর যা ’ গঠন , বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠনও মুলতঃ তাই । স্থূল যা ’ দেখছ , তার মধ্যে সুক্ষ্মতম যা - কিছু গুর - পারম্পৰ্য্যে ওতঃপ্রোতভাবে অনুস্যূত হ'য়ে অাছে । প্রত্যেকটি যা - কিছু আজ যে - আকারে দেখছ , হয়তাে এ - আকারে ছিল না , কিন্তু এই হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল তাতে , সেই সম্ভাব্যতাই বিবর্তিত হতে - হ'তে চলেছে প্রকৃতির বক্ষে , পরিবেশের মধ্যে , তাই বর্তমানের মধ্যে অতীতের ছাপ সুপ্ত , লুপ্ত হয়ে থাকলেও আছে । একই বহুর মধ্যে বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে আছে । একই বহু হ'য়ে আছেন , আরাে হ'য়ে চলেছেন । সেই ঐক্যসত্রটি ধরতে হবে , যা ’ বহুতে রূপায়িত । সেই মূল জিনিসটি হ’ল কেন্দ্রানুগ আকর্ষণ । কেন্দ্রের প্রতি সক্রিয় আকর্ষণকে বাদ দিয়ে কিছুই আত্মরক্ষা করতে পারে না । এই আকর্ষণের আবার একটা সুসীম সীমারেখা আছে , সেটাকে অতিক্রম করে সে যখন কেন্দ্রকেই আত্মসাৎ করতে চায় , তখনই আসে বিকর্ষণ , এই আকর্ষণ - বিকর্ষণের টানাটানি ও সংঘাতের মধ্যদিয়েই নূতনের আবির্ভাব হয় । এইভাবে পারস্পরিক আকর্ষণ - বিকর্ষণ ও সংঘাতের মধ্যদিয়ে আরও নূতনের অভ্যুদয় হয় , এমনি করেই সৃষ্টি গুণিত হয়ে চলে । এই তার লীলা । লীলা মানে আলিঙ্গন - গ্রহণ , দেওয়া - নেওয়া , মিলন - বিরহ , । সব হারিয়ে সব পাওয়া , সব পেয়েও নিজের বলতে কিছু না - রাখা , কিছু না - থাকা । ‘ যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি , সে মুহূর্তে কিছু তব নাই , তুমি তাই পবিত্র সদাই ।
' ধু্র্ণ্জটিদা ( নিয়োগী ) -এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটা যেন ঠিক বুঝতে পারছি না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — দাড়া , দেখিয়ে দিচ্ছি । খাতা , পেনসিল বা কলম আছে তোদের কাছে ?
প্রফুল্লহ , এই নিন । শ্রীশ্রীঠাকুর তখন খাতায় একে দেখালেন— Atom- এর ( অণুর ) negative pole ( রিচী মেরু ) -গুলি positive pole ( ঋজী মেরু ) -র দিকে এগুতে থাকলে , তার থেকে quanta ( দ্যুতিকণা ) কিভাবে ছিটকে ছিটকে বেরােয় । আবার দেখালেন একটা কোষের রিচী মেরু ঋজী মেরুর দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে কেমন ক'রে নূতন রিচী মেরু ও ঋজী মেরু সৃষ্টি হ'তে - হ’তে কোষ - বিভাজন হ'য়ে চলে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর যখন চিত্র একে বোঝাচ্ছিলেন , তখন সবাই দাড়িয়ে - দাড়িয়ে ঝুকে পড়ে আগ্রহভরে দেখতে লাগলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর দেখাবার সময় বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন — ' বুঝলি তো ? বুঝলি তো ?
সবাই বোঝার পর শ্রীশ্রীঠাকুর ক্ষান্ত হলেন ।
তখন শ্রীশ্রীঠাকুর ও সবার চোখে - মুখে এক অপার তৃপ্তি । প্রত্যেকে পুনরায় যথাস্থানে উপবেশন করলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্য বদনে) গানে আছে , ( সুর ক'রে ) ' যখন যেখানে যাই , সঙ্গে থাকে গো রাই । ( হাতদুখানি নেড়ে — বিস্ময়ের ভঙ্গীতে ) —এ এক অশৈলি কাণ্ড positive ( ঋজী ) যেখানে থাকবে , negative ( রিচী ) তার পোদেপোদে ছুটবে , সেই অবলম্বন ছাড়া সে যেন চলতেই পারে না । একেই বলছিলাম কেন্দ্রানুগ আকর্ষণ বলে । Positive ( ঋজী ) যেন negative ( রিচী ) -র কেন্দ্র , এই কেন্দ্রানুযায়ী হ'য়ে ছাড়া তার টিকবার জো নেই , সেই টানে সে ছােটে সেই দিকে । এই ছােটাছুটি , টানাটানির ভিতর - দিয়ে ছিটকে বেরােয় কত কি — অনন্ত কোটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড - গ্রহ - নক্ষত্র - তারা , ক্ষিতি - অপ - তেজ - মরূৎ - ব্যোম , গাছপালা , পশু - পাখী , মানুষ , তুমি - আমি কত কি , মায় ঐ ফড়িংটা পর্যন্ত ( তাসুর মধ্যে একটা ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছিল ) । অবশ্য এর নানা পর্যায় আছে , নানা স্তর আছে , নানা ক্ৰম আছে । সদ্গুরুকে ধ'রে তার নির্দেশমত বিহিতভাবে সাধন করলে ওগুলি ক্রমে - ক্রমে ফুটে ওঠে । সবই চোখে দেখা যায় , কানে শােনা যায় । এ - সব হেঁয়ালী কথা কিছু না । এ হলো বিজ্ঞান । আমি যেভাবে দেখছি , তােমরাও তেমনি দেখতে পার । তবে গুরুসর্ব্বস্ব না হলে , সর্ব্বতো ভাবে গুরুমুখী না হলে তথাকথিত সাধনার কসরতে এ হবার নয় । শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন — তােমার অনেক জন্ম অতীত হয়ে গেছে , আমারও অনেক জন্ম অতীত হয়ে গেছে , তোমাতে আমাতে ভেদ নাই , ভেদ এইটুকু যে তুমি তা জান না , কিন্তু আমি জানি অর্থাৎ আমার স্মৃতি - চেতনায় আছে তা ’ । সদ্গুরু হলেন সেই জানা - লোক , স্মৃতি - চেতনাওয়ালা লোক , জীবনের সব রহস্যই তার করতলগত । তাই তার উপর প্রাণের টান হলে , তার সঙ্গ করলে , সেবা করলে , অনুসরণ করলে , তার প্রীতি - কর্ম করলে , নিজেকে তমুখী ক'রে নিয়ন্ত্রিত করে চললে , নমি - ধ্যান , ভজন - যাজন করতে থাকলে , তার সুখ - সাধ - আহলাদের দিকে লক্ষ্য রেখে চললে , বেমালুমভাবে তার জানা কত কী - ই যে নিজের জানার মধ্যে এসে যায় , তা ঠাওরই পাওয়া যায় না । পথ ঐ সােজা পথ , সদ্গুরু হলেন মুক্ত বেদ , কোনকিছুর বালাই নিয়ে তার পিছে ঘুরে না , তার পায়ে নিজেকে উজাড় করে ঢেলে দাও , তারই হও তুমি সর্বতোভাবে — তােমার কিছুই ভাবতে হবে না , তোমার যা হবার তা আপনিই হয়ে উঠবে ।
প্যারীদা কি যেন প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সহাস্যবদনে বললেন , কাণ্ড গুরুচরণ , তুই আগে তামুক খাওয়া দেখি একবার । ( প্যারীদা তামাক সাজতে গেলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর পূর্বধারায় বলতে লাগলেন ) —অনুভূতি , জ্ঞান বা দর্শনের কথা ছেড়ে দিলেও সােজা কথায় মানুষ Ideal ( আদর্শ ) ছাড়া , অবলম্বন ছাড়া চলতেই পারে না , তার অস্তিত্বই বজায় রাখতে পারে না । প্রবৃত্তি তাকে কখন কেমনভাবে সাবাড় করে দেবে তার কি ঠিক আছে ? Ideal ( আদর্শ ) যেন positive ( ঋজী - কেন্দ্র ) আর সাধারণ মানুষ যেন negative ( রিচী - কেন্দ্র ) । তাই with all one's passions and complexes ( সমস্ত বৃত্তি নিয়ে ) , Ideal- এ অর্থাৎ পূরয়মাণ জীবন্ত মহাপুরুষে actively interested ( সক্রিয়ভাবে অন্তরাসী ) হ'লে সে powerful man ( শক্তিমান মানুষ ) হয়ে দাড়ায় , কিন্তু একটা passion ( প্রবৃত্তি ) -ও uninterested ( আলগা ) থাকলে ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে , individuality ( ব্যক্তিত্ব ) বলে কিছু থাকে না , individuality মানেই Ideal - a ( আদর্শে ) completely ( সম্পূর্ণভাবে ) integrated ( সংহত ) হয়ে থাকা , একমাত্র Ideal ( আদর্শ ) -এর attraction ( আকর্ষণ ) -এ চলা । তাই শুধু ইষ্টকে ধরে চলাই যথেষ্ট নয় , সমস্ত বৃত্তি - প্রবৃত্তি ও সত্তা দিয়ে তাতে অনুরক্ত হতে হবে , তাকে অনুসরণ করতে হলে , আর যেখানে ( ব্যক্তিত্ব ) যেটুকু ফাক , গরমিল বা গোঁজামিল আছে , সেটুকু ঠিক করে তুলতে হবে , একেই বলে unrepelling adherence ( অদ্ভুত অনুরাগ ) । Blessed is he who is not repelled by anything in me ( যে আমার কোন কিছুর দ্বারাই প্রতিহত না হয় , সেই ধন্য ) । এই অচ্যুত অনুরাগসম্পন্ন যারা , তাদের সম্বন্ধেই গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন , অপি চেৎ সুদুরাচারঃ ভজতে মামনন্যভাক্ , সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ , ব্যবসিতাে হি সঃ । সম্যকভাবে ইষ্টনিবদ্ধ না হলে মানুষ সাধুও হয় না , সন্ন্যাসীও হয় না ; আর সম্যকভাবে ইষ্টনিবদ্ধ হয়ে ওঠে যে , সে যদি লাখ দুষমণও হয় , তার দুষমণিও পুণ্যপ্রভা বিকিরণ করে ।
প্যারীদা তামাক সেজে এনে দিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খাচ্ছেন ।
প্যারীদা — মানুষের জীবনে Ideal ( আদর্শ ) না থাকলেই যে তার বাঁচা বাড়া বিপন্ন হবে তার মানে কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — জীব কৃষ্ণের নিত্য দাস যবে ভুলি গেল , মায়া পিশাচী তার গলে দড়ি দিলা । মানুষ যদি ভগবানের বাঁধনে বাধা না থাকে , তাহ'লে শয়তানের বাঁধনে বাঁধা পড়বেই , যে - কোন না কোন রকমে । শয়তান আবার অনেক সময় ধর্মের মুখােস প'রে আসে । সে বলে , কোন জীবন্ত আদর্শকে যে ধরতে হবে , তার মানে কী ? তুমি সৎপথে চললেই হ'লো , সৎকাজ করলেই হ'লো । এই যুক্তি মানুষের বেশ ভাল লাগে , মানুষ তাতেই সায় দিয়ে চলে । কিন্তু ওই ফাঁক দিয়েই প্রবৃত্তি তার রকমারি কারসাজি চালায় মানুষের সঙ্গে । মজা এমন যে , মানুষ ঐ অবস্থায় প্রবৃত্তি - অভিভূতিকে প্রবৃত্তি - অভিভূতি বলেই চিনতে পারে না । চিনবে কী করে ? সে যে তৎ - সারূপ লাভ করে তাতেই গুলিয়ে আছে । তাই সর্বশাস্ত্র বলছে প্রেরিত পুরুষে শরণাগতির কথা । গীতায় অাছে , ‘ সৰ্ব্বধৰ্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ । অহং ত্বাং সৰ্বপাপেভ্যো মােক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ॥ Bible- এ আছে— ' I am the way , the truth , the goal , none can come to the Father but by me ' , বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে— “ শ্রীকৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা , নরবপু তাহার স্বরূপ , গোপবেশ বেণুকর , নবকিশাের নটবর , নরলীলার হয় অনুরুপ ’ , চণ্ডীদাস বলেছেন , ' শুন হে মানুষ ! ! সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই ' , কোরাণে আছে - ‘ প্রেরিতকে বাদ দিয়ে ঈশ্বরের উপাসনা হয় না , বৌদ্ধদের আছে -- বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি , ধর্মং শরণং গচ্ছামি , সঘং শরণং গচ্ছামি ' । তাই গোড়ার কথাটা ঐ । আর , এই যে Ideal ( আদর্শ ) -এর selection( নিৰ্বাচন ) , তাতে সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে , তিনি পূর্ববর্তীতে নতি রেখে with all fulfilments ( সব পরিপূরণ - সহ ) চলেছেন কিনা । তেমনতর । সর্ববৈশিষ্ট্যের মহাপরিপূরণকারী মানুষকে অবলম্বন করেই whole mass ( সমগ্র জনমণ্ডলী ) integrated ( সংহত ) হয়ে ওঠে । ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনে তখন ধর্ম , অর্থ , কাম , মােক্ষ উপচে ওঠে , অভাব বা খাকতি বলে কিছু থাকে না । Ideal ( আদর্শ ) -কে অবলম্বন করে চলা অত্যন্ত normal ( স্বাভাবিক ) এবং সহজ , অন্যরকম চলাই বরং কঠিন , তাতে কষ্ট অনেক বেশী , তবু মানুষ কষ্ট করে বিপথে চলে , কারণ , পরিবেশটা অনেকখানি গোলমেলে হ'য়ে গেছে , বিকৃত বুদ্ধির বড় ছড়াছড়ি । ধর , go - between complex ( দ্বন্দ্বীবৃত্তি ) , এটা যেন সমাজে ব্যাধির মত ছড়িয়ে গেছে । এটা form ( গঠন ) করতেই কি মানুষের কম কষ্ট পেতে হয় ! কত খচখচানি , খুত খুতভাব । আর , habit form ( অভ্যাস - গঠন ) করেও যে কী ফল , তা'ও তো বুঝছ । তাই চলার সহজ পথটা মানুষকে ধরিয়ে দেবার জন্য দুনিয়াময় সহস্র - সহস্র ইষ্টনিষ্ঠ , আচারবান ঋত্বিক , অধ্বর্য্যু ও যাজকের প্রয়োজন । তাদের গায়ের হওয়া যেখানে যেয়ে লাগবে , সেখানেই ধর্ম মঞ্জুরিত হয়ে উঠবে । এটা ঠিক জেনো — তোমার microcosm -এ ( ব্যষ্টিজীবনে ) যদি ধর্মের জাগরণ না হয় , তোমার macrocosm- এ ( বিশ্বজীবনে তুমি ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না । কারণ , তুমি যদি আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ জান , তাহলেই তুমি দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে , নচেৎ নয় । তত্ত্বতঃ দেখতে গেলে microcosm ( ব্যষ্টিজীবনে ) -এর ভিতর - দিয়েই macrocosm ( বিশ্বজীবন ) -কে জানা সম্ভব । আবার , macrocosm ( বিশ্বজীবন ) -কে জানা যেটা বলছি , সেটা প্রকৃতপক্ষে microcosm ( আত্মজীবন ) -কেই জানা । কারণ , আমি ও আমা - অতিরিক্ত বস্তু ও ব্যক্তিগােষ্ঠির contrast ( দ্বন্দ্ব ) -এর ভিতর - দিয়ে আমি কেবল বাইরের সেগুলিকে জানছি না , তার ভিতর - দিয়ে আমি আমাকেও জানছি , আমাকেও বোধ করছি । আমার বাইরে আমাকে সাড়া দেবার মত কোন পরিবেশ যদি না থাকতো , তাহ'লে আমি - বোধই লুপ্ত হ'য়ে যেত , আমিও থাকতাম না সেখানে । তাই microcosm ( ব্যষ্টি ) -র যে faculties ( কার্যক্ষমতা ) ও capacities ( দক্ষতা ) , তা ’ play ( ক্রিয়া ) করার সুযােগ পায় macrocosm- এ ( বিশ্বজীবনে ) এবং এর ভিতর দিয়েই ব্যষ্টি নিজের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন হয় ও তা উপভোগ করে , যেমন দৃশ্যবস্তু বলে কিছু থাকার দরুন দৃষ্টিশক্তি সম্বন্ধে আমরা সচেতন হই এবং দৃশ্যবস্থও উপভােগ করি । তাই , ধর্মকে পরিবেশে ও বিশ্বজীবনে যতখানি প্রতিষ্ঠা করি , আমাদের অন্তরেও তা ততখানি প্রতিষ্ঠা লাভ করে । অতএব যাজন বা ধর্মদান পরােপকার নয় , কিংবা করলেও হয় বা না করলেও হয় , এমনতর কর্ম নয় , এটা হ’ল নিত্যকর্ম । তুমি যদি তােমার জীবনে ধর্মকে সঞ্জীবিত রাখতে চাও , তবে তােমাকে যজন ও ইষ্টভৃতি যেমন করতে হবে , যাজনও তেমনি অতি অবশ্য করতে হবে । এই যাজন - বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিতে হবে প্রত্যেকের অন্তরে । এতে প্রত্যেকের পরিবেশ তার বাচা - বাড়ার সহায়ক হয়ে উঠবে , আর এই নিত্য যাজনের ভিতর - দিয়ে প্রত্যেকের বােধ ও জ্ঞানের ভাণ্ডারও খুলে যাবে , ইহকালে ও পরকালে কিছুই অপ্রাপ্য থাকবে না তার ।
আর , যার আধিপত্য আমাতে থাকার দরুন জগতের যা - কিছু বােঝা যায় , জানা যায় , সত্তানুপােষণী করে নিয়ন্ত্রিত করা যায় ও সে - সবের উপর আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব হয় , এবং যাঁকে দিয়ে , যার দ্বারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত বৈচিত্র্যের সবৈশিষ্ট্য সংহতি আমার কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে , সেই তিনি হলেন আমার ইষ্ট , আমার ভগবান , আমার ঈশ্বর । সুতরাং এক পা - ও তাকে ছেড়ে চলা আমাদের সম্ভব নয় । বুঝলে প্যারীচরণ ? ( এই বলে শ্রীশ্রীঠাকুর প্যারীদার চিবুক ধরে মায়ের মত সােহাগ করলেন । ) প্যারীদা আহলাদে অবশ হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরকে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করলেন । পরে আবার তামাক সেজে নিয়ে আসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে গাঢ় প্রশান্ত দৃষ্টিতে সবার দিকে চাইতে লাগলেন — সবাই তখন আনন্দে আবিষ্ট , ভাবে ভরপুর , সেই মধুর লগ্নে তার সেই মধুমাখা , মমতাদীপ্ত আঁখিযুগল সকলেরই মনপ্রাণ হরণ করে নিচ্ছিল । এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করলেন । পরে তিনি মাতৃমন্দিরের বারান্দায় একখানি তক্তপােষের উপর এসে বসলেন । ধীরে - ধীরে বেলা হ'তে লাগল । ফিলান্থপী অফিসের কর্মীরা এসে অফিসের কর্মে যােগদান করলেন । তরকারিওয়ালারা মাতৃমন্দিরের পশ্চিম দিকে যার - যার তরকারির ঝুড়ি নিয়ে বসলো , কেউ - কেউ আবার নুতন নলেন - গুড় নিয়ে এসেছে বিক্রী করতে । মায়েরা ও দাদারা সেখান থেকে যার যেমন প্রয়োজন জিনিস কিনছেন । একদল ছেলে একপাশে ডাণ্ডাগুলি খেলছে । সম্মুখে পদ্মার বিস্তৃত চরে গরুগুলি আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে । মাঝে - মাঝে ঝাঁকে - ঝাঁকে সাদা পাখী দলে - দলে নিরুদ্দেশভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা যেন বাধাবন্ধহীন কোন দূর পথের যাত্রী । পাশের বাঁশবনে এবং সামনের ঝাউগাছগুলিতে ছােট - ছােট রকমারি পাখীর দল কিচির মিচির করে মাঝে - মাঝে কলরবে ভেঙ্গে পড়ছে । ঝিলের জলরাশি উদার নীল আকাশের দিকে মুখ করে শীতের দিনে আরামে রোদ পোহাচ্ছে । শ্রীশ্রীঠাকুর তক্তপােষের উপর বসে দূর আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন । কালিদাসীমা তামাক , জল , সুপুরী দিচ্ছেন । কাছে আছেন বীরেনদা (মিত্র ) , চুণীদা ( রায়চৌধুরী ) ও পণ্ডিত ( ভট্টাচাৰ্য ) । এক - একজন মাঝে - মাঝে এসে প্রণাম করে যাচ্ছেন , আর শ্রীশ্রীঠাকুর তাদের সঙ্গে প্রয়োজনমত দু'চার কথা বলছেন ।
সুধীরদা ( দাস ) এসে প্রণাম করতেই শ্রীশ্রীঠাকুর কারখানার কাজকর্ম সম্পর্কে তাকে কিছু নির্দেশ দিলেন ।
পরে আবার অমূল্যদাকে ডাকতে বললেন । তমূল্যদা ( ঘোষ ) আসলে বললেন —১৩০ টাকার স্বাক্ষর - পত্রগুলি তাড়াতাড়ি ছেপে numbering ( নম্বর দেওয়া ) , perforating ( ছিদ্রকরণ ) , binding ( বাধান ) ইত্যাদি ঠিক করে দেখতে যেন খুব সুন্দর হয় । Conference- এর ( অধিবেশনের যত আগে হয় ততই ভাল । অাজ পারলে কাল পর্যন্ত দেরী করবি না । যা ভূতের মত লেগে যা গিয়ে ।
অমূল্যদা ‘ আচ্ছা বলে খুশি মনে বিদায় নিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর অমর ভাইকে ( ঘোষ ) বললেন — অমর , শুনলাম গেষ্ট হাউসের কলের পাড়ের ড্রেনটা বন্ধ হয়ে যেয়ে সেখানে খুব জল জমে , আর চারিদিকটা খুব পিছল হয়ে গেছে , হেমগােবিন্দ ওদের নিয়ে তুই যদি ওটা ঠিক করে দিস তো হয় , নয়তো ওখানে মশা হবে , তার থেকে ম্যালেরিয়া ছড়াবে , আর কে কখন জল আনতে গিয়ে আছাড় খাবে তার ঠিক নেই । তুই না করলে হবে নানে , তুই নিজে সঙ্গে থেকে যা’ যা ’ করা লাগে করবি । যা , এখনই যা ।
অমর ভাই উঠে পড়লেন । বহিরাগত একটি ভাই এসে বললেন — টেষ্ট দিয়ে এসেছি । তিন মাস পরে final ( শেষ ) পরীক্ষা , যত পড়ি কিছুই তাে মনে থাকে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — পরীক্ষার পড়া তৈরী করছিস , পরীক্ষা দিতে হবে , ওসব কথা মোটেই ভাববি না । বরং অনুরাগ নিয়ে বিষয়গুলিকে এমন ক'রে আয়ত্ত করতে চেষ্টা কর — যাতে যে - কোন মানুষকে তুই তা বুঝিয়ে দিতে পারিস । হয়তো তাের ছােট ভাই বা বোনকে গল্পের মত জিনিসগুলি বুঝিয়ে দিবি । অাবার ভেবে দেখবি বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে ঐ বিষয়গুলির উপযােগিতা কী , ঐ জ্ঞানকে কোথায় কি কাজে লাগাতে পারি । এই বুদ্ধি নিয়ে পড়িস — দেখবি মাথায় গেঁথে যাবে , ভুলবি না , অযথা উদ্বেগকে প্রশ্রয় দিবি না , নাম করবি , শরীরটা ঠিক রাখবি , স্ফূর্তিতে থাকবি ।
#আলোচনা_দ্বিতীয়_খণ্ড
#চতুর্থ_সংস্করণ
https://www.amritokatha.in/
Telegram https://t.me/amritokatha
www.facebook.com/Amritokatha.in1

10