শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় :-
🔷একবার তৎকালীন গভর্নর শ্যামাচরণ এর আমন্ত্রণে সৎসঙ্গ পরির্দশনে আসেন...
🔷 “... গোপালদা দুর্গাদা মারা যাওয়ার পর আশ্রমে গুঞ্জন উঠল, গোপালদার মত ভক্তরাজের এভাবে জীবনাবসান ঘটল কেন? ঠাকুর কেন এটা ঠেকাতে পারলেন না?
🔷 নির্বিচারে আমার কথা মেনে চলে যে সে লাখ মূর্খ হ’লেও মহাজ্ঞানী। আর নিজ খেয়ালে চলে যে, সে মহাজ্ঞানী হ’লেও বাস্তবে পাগল ও বেকুব।
🔷 শ্যামাচরণের গভীর ধীশক্তি এবং প্রগাঢ় মননশীলতা তাঁর রচিত “Nature’s Dharma” নামক একটি ইংরেজি পুস্তিকার মাধ্যমে সুপরিস্ফুট হয়েছে...
সাধারণভাবে আয়ু এবং জীবন সমার্থক প্রতিভাত হলেও আয়ুষ্কালের পরিমাপ এবং জীবনের পরিধি এক নয়। অদ্বৈতবেদান্তী শঙ্করাচার্য্য, কবি কীটস্, সমাজ সংস্কারক ডিরোজিও, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের স্বল্পকালীন আয়ুষ্কালের মধ্যে যে মহাজীবন বিম্বিত হয়েছে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে তা বহুসংখ্যক শতাতিক্রান্ত মানুষের সম্মিলিত জীবনের চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী ফলদায়ী। তবে এ সমস্ত মহাপ্রাণের আয়ুর সীমা বর্ধিত হলে জগতের পক্ষে তা অধিকতর কল্যাণপ্রসূ হত-এ ভাবনা স্বতঃই উদিত হয়। সৎসঙ্গ জগতের পরিমণ্ডলে অল্পায়ু অথচ মহৎ জীবনের অধিকারী এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন মেধাবী বিজ্ঞানী শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়-যাঁর জীবনী আলোচনা করলে তাঁর অকাল প্রয়াণের বেদনা আজও যেন আচ্ছন্ন করে আমাদের।
শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষ ছিলেন হালিশহরের বাসিন্দা। তাঁর পিতামহ নন্দকুমার মুখোপাধ্যায় এক ব্রিটিশ সংস্থায় কর্মরত ছিলেন; চাকুরির সুবিধার জন্য তিনি উত্তর কলকাতার বাগবাজারে বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। শ্যামাচরণের পিতা নগেন্দ্রনাথ তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর আবগারি বিভাগের কালেকটর ছিলেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রী একটি শিশু পুত্র ও নবজাত কন্যা রেখে পরলোকগমন করার পরে দুর্গাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিণয় হয়। ১৯০৫ খৃষ্টাব্দে শ্যামাচরণের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন দুর্গাসুন্দরীর একমাত্র সন্তান। শ্যামাচরণের বয়স যখন সাত বছর মাত্র, তখন তাঁর পিতা নগেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। শিখরবাসিনী ও মায়ালতা নাম্নী দুই বোন ছিলেন দুর্গাসুন্দরীর-ঘটনাচক্রে এঁরা তিন বোনই অল্প সময়ের ব্যবধানে পতি- বিয়োগের নিদারুণ দুর্ভাগ্য-কবলিত হন। উত্তর কলকাতার গোয়াবাগানে চারনম্বর ঈশ্বর মিল লেন-এ এঁদের পিত্রালয়ে শোকাতুরা ভগ্নীত্রয় কয়েকটি শিশুসন্তানসহ থাকতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দ্বিতীয় ভ্রাতা পূজনীয় ক্ষেপুদা সেসময় ঐ বাড়ির একটি অংশ ভাড়া নিয়ে কলকাতায় আইন পড়তেন। ঠাকুর জননী মনোমোহিনী দেবী মাঝে মাঝেই কলকাতায় এসে ঐ বাড়িতে উঠতেন। মাতা মনোমোহিনী ছিলেন যেমন ব্যক্তিত্বশালিনী তেমনই পরিপার্শ্ব-সচেতন। তিনি ঐ তিনটি পতিহীনা তরুণীর অবস্থা লক্ষ করেন। দুর্গাসুন্দরীরা এমনই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে মাঝে মাঝেই রান্না খাওয়াও বন্ধ থাকত; শিশুগুলিকে হয়তো সামান্য কিছু খাওয়াতেন, নিজেরা উপবাসে শোকাচ্ছন্নতায় দিন কাটাতেন। মাতা মনোমোহিনী একরকম জোর করেই তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তাঁর অসাধারণ মমতাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাঁদের আপন করে নেন। যেদিন দেখতেন তাঁদের রান্নাবান্নার উদ্যোগ নেই, সেদিন গিয়ে বলতেন- আজ ভাবছি তোমাদের সঙ্গে একমুঠো খাব, অসুবিধে হবে না তো? তাঁকে ফেরানোর সাধ্য দুর্গাসুন্দরীদের ছিল না। অপরিসীম ভালবাসা এবং প্রবল জীবনীশক্তির
অভিঘাতে জননী মনোমোহিনী তাঁদের অবসাদ মোচন করতে থাকেন; ধীরে ধীরে হিমাইতপুরের সৎসঙ্গ আশ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে তিন বোনের। মাতা মনোমোহিনীকে এঁরা ‘দিদি’ বলে ডাকতেন। মাতৃদেবী তাঁদের কাছে নিজ পুত্র অনুকূলচন্দ্রের কথাও বলেন-অনেকেই যে অনুকূলচন্দ্রকে গুরু স্বীকার করে ‘ঠাকুর’ অভিধায় অভিহিত করেন, তাঁর মধ্যে ঈশ্বরত্বের সন্ধান পান তাঁর ভক্তবৃন্দ, বলেন সে কথাও। এঁরা তিন বোন যখন প্রথম অনুকূলচন্দ্রকে দর্শন করেন, তখন তিনি নিতান্তই যুবা; কান্তির কমনীয়তার জন্য তাঁর বয়সের চেয়েও কম দেখাত তাঁকে। তাঁকে দেখে দুর্গাসুন্দরী মাতা মনোমোহিনীকে বলে ওঠেন-দিদি, এর কথাই এত শুনি? এ তো দেখছি আমার গোপালী! তিনি তাঁর পুত্র শ্যামাচরণকে ‘গোপাল’ বলে ডাকতেন। মাতৃদেবীকে ‘দিদি’ সম্বোধন করতেন বলে ঠাকুর ঐ ভগ্নীত্রয়কে ‘মাসিমা’ সম্বোধন করতেন; সে কারণে আশ্রমে এঁরা শেখরমাসিমা, দুর্গামাসিমা এবং মায়ামাসিমা পরিচয়েই খ্যাত ছিলেন। এঁরাও ঠাকুরকে ‘গোপালী’ বলেই ডাকতেন এবং ‘গোপালী’-ই হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের প্রাণের ধন, জীবনের কেন্দ্র।
এরপর থেকে প্রায়শই দুর্গাসুন্দরী হিমাইতপুরে থাকতেন। কলকাতায় অবশ্য আসাযাওয়া ছিল সবসময়েই-কারণ শ্যামাচরণ কলকাতায় থেকেই পড়াশুনো করতেন। তাঁর বয়স যখন বারো বছর তখন মাতা মনোমোহিনী দেবী তাঁকে সৎনামে দীক্ষা দেন। এটি ১৯১৭ খৃষ্টাব্দের ঘটনা। শ্যামাচরণ মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে হিমাইতপুর আশ্রমে যেতেন। তাঁর মা-মাসিমাদের পরম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু স্বরূপ ঠাকুরের প্রতি আশৈশব সহজ স্বাভাবিক অনুরাগ ও শ্রদ্ধা গড়ে উঠেছিল তার মনে। তবে তারুণ্যের প্রবল জোয়ারে সেসময়কার বাংলার বিপ্লবী রাজনীতির ছোঁয়াও সঞ্চারিত হচ্ছিল তাঁর অন্তরে।
হিমাইতপুর আশ্রমে তখন শ্রীশ্রীঠাকুরের কর্মকাণ্ডের যুগ চলছে। অখ্যাত এক পল্লীর প্রত্যন্ত প্রদেশে বিশ্ববজ্ঞিান কেন্দ্র, সৎসঙ্গ কেমিক্যাল ওয়ার্কস্, মেক্যানিকাল ওয়ার্কশপ ইত্যাদি নানা অভাবনীয় বিজ্ঞানমুখী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে অথবা হচ্ছে। রসায়নবিদ বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য (একমুখ দাড়ির জন্য যিনি ‘দাড়ি-বীরেনদা’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন) ঠাকুর-প্রদত্ত ফর্মুলা বাস্তবায়িত করে ‘প্রিভেন্টিনা’ মলম তৈরির প্রয়াস চালাচ্ছেন সেসময়। মলমের দাহ্য অংশের স্বচ্ছতা কিছুতেই আসছিল না। শ্যামাচরণ তখন কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে বি. এস সি. পড়ছেন-আশ্রমে এসে কেমিক্যাল ওয়ার্কস-এ গেছেন ‘প্রিভেন্টিনা’ তৈরির অগ্রগতি দেখতে। প্যারাফিন নিয়ে কাজ হচ্ছিল তখন-রসায়নের ছাত্র শ্যামাচরণও হাত লাগিয়েছেন তাতে, হঠাৎ আগুন লেগে ভয়ানকভাবে ঝলসে গেল তাঁর সর্বাঙ্গ। সেই সময়েই ঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত ডাক্তার সুবোধ সেন আশ্রমে এসেছেন। তাঁকে ঠাকুর বলেন- দ্যাখ, দ্যাখ, ওষুধ তৈরি করতে গিয়ে কী অবস্থা!
ডাক্তার বললেন- ওষুধ ওর জন্যই তো বানানো হচ্ছিল, না? ঠাকুর হাসেন- কী যে কও তুমি! কিন্তু ঐ প্রিভেন্টিনা লাগিয়েই শ্যামাচরণের দগ্ধ ক্ষত সম্পূর্ণ নিরাময় হল।
স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে বি. এস সি. পাশ করে প্রেসিডেন্সী কলেজে এম. এস. সি. পড়তে শুরু করলেন শ্যামাচরণ। সুন্দর চেহারা, মেধাবী ছাত্র, সম্ভ্রান্ত বংশ, পরিশীলিত আচরণ ও বচন। কিন্তু বাহ্যত শান্ত যুবকটির অন্তঃস্থলে দেশজোড়া স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন এমনভাবে সংক্রামিত হয়েছিল যে অভিভাবক পরিজনবর্গের অগোচরে গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। হঠাৎ একদিন বাগবাজারে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়, সরকারি মতে আপত্তিজনক কাগজপত্রের সন্ধানে। তীক্ষ্ণধী শ্যামাচরণের সতর্কতায় তেমন কিছু অবশ্য পাওয়া গেল না-কিন্তু তাঁর গোপন সন্ত্রাসবাদী চলন অভিভাবকবৃন্দের, বিশেষত তাঁর মায়ের গোচরে আসে। শঙ্কিতা মা ছেলেকে নিয়ে যান তাঁর গোপালী অর্থাৎ ঠাকুরের কাছে। শ্যামাচরণ এ ব্যাপারে ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনায় আদৌ ইচ্ছুক ছিলেন না। আবাল্য পরিচিত স্বজনের প্রতি যেমন সহজ ভালবাসা থাকে, ঠাকুরের প্রতি তাঁরও ছিল তেমনি; কিন্তু কিছু উদাসীনতা বা গুরুত্বহীনতার ভাবও ছিল হয়তো নবীনত্বের স্বাভাবিক নিয়মে -বিশেষত, স্বাধীনতা সংগ্রামই যে প্রতিটি ভারতবাসীর তৎকালীন মুখ্য কর্তব্য, এ বিষয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় নিশ্চিত। তবুও মায়ের জোরাজুরিতে ঠাকুরের কাছে গেলেন শ্যামাচরণ। ঠাকুর তাঁকে প্রশ্ন করেন-দেশ তো স্বাধীন করবি, স্বাধীন দেশে কী করবি, ঠিক করেছিস কিছু? এ প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে ছিল না। এরপরে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঠাকুর তাঁকে বোঝান প্রকৃত স্বাধীনতার অর্থ কী এবং কীভাবে তা অর্জন করা যায়। আরও বলেন, ধ্বংসাত্মক কাজের মাধ্যমে কারও কোন প্রকৃত লাভ হয় না, বরং ওই ধরনের কাজ যে করে তার মনুষ্যত্ব বিধ্বস্ত হয়। গঠনাত্মক সদর্থক চলনই মানুষকে আকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি এনে দিতে সক্ষম এবং গঠনমূলক কাজের জন্য উপযুক্ত মানুষ গড়ে তোলাই প্রকৃত স্বাধীনতার বাস্তব ভিত্তি। শ্রীশ্রীঠাকুরের অনন্য বিশ্লেষণী বক্তব্যে শ্যামাচরণের সম্বিত ফেরে; বিস্মিত হয়ে ভাবেন-এতো সহজ সত্য তো কারও কাছে শুনিনি! তাঁর একান্ত কাছের এতদিনকার দেখা মানুষটি যেন এক আশ্চর্য আলোকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন তাঁর কাছে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে পরিপূর্ণভাবে ঠাকুরকে গ্রহণ করলেন শ্যামাচরণ-তাঁর জীবনের সবখানি হয়ে ওঠেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে রসায়নশাস্ত্রে এম. এস সি. পাশ করার পরে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ পেয়েছিলেন গবেষণার জন্য, কিন্তু মা দুর্গাসুন্দরীর সম্মতি না থাকায় জার্মানি যাননি শ্যামাচরণ। কিন্তু ঠাকুরের ইচ্ছে ওঁকে দিয়ে গবেষণা করানোর-অতঃপর জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের অধীনে রিসার্চ শুরু করেন। আশ্রমের সঙ্গে বন্ধনও বাড়তে লাগল। ১৯২৭-এ তৎকালীন সৎসঙ্গ সেক্রেটারি সুশীলচন্দ্র বসু কার্যান্তরে বেশ কিছুদিনের জন্য অন্যত্র যান- তখন সৎসঙ্গের সেক্রেটারি হন বাইশ বছরের যুবক শ্যামাচরণ।
ইত্যবসরে নবদ্বীপের অশ্বিনী চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা পঞ্চদশী রেণুর সঙ্গে শ্যামাচরণের পরিণয় সম্পন্ন হয়। পাত্রী নির্বাচনের জন্য জননী দুর্গাসুন্দরী বেশ কিছু সম্ভ্রান্তবংশীয়া সুন্দরী পাত্রীর ফটো সংগ্রহ করেছিলেন- রেণুর ফটোও ছিল তার মধ্যে। তবে রূপের বিচারে তিনি অন্যান্য কয়েকজনের তুলনায় ন্যূন ছিলেন। দুর্গাসুন্দরীর খুব সাধ ছিল রূপবান একমাত্র পুত্রের জন্য পরমা সুন্দরী বধূ আনবেন। কিন্তু ঠাকুরের সম্মতি ছিল যে-কোন কাজের প্রথম শর্ত। দুর্গাসুন্দরী সব ক’টি ফটো নিয়ে ঠাকুরকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন যে কাকে নির্বাচন করবেন। ঠাকুর রেণুর ফটোটি নির্বাচন করলেন। দুর্গাসুন্দরী বললেন-এ তো তেমন সুন্দরী নয়, এর চেয়ে আরও কত সুন্দরী রয়েছে। ঠাকুর বললেন-না, না, ঐ ভাল, ঐ ভাল। ব্যাস, পাত্রী স্থির হয়ে গেল।
রেণু বারো বছর বয়স পর্যন্ত স্কুলে যান এবং বাড়িতে পিতার তত্ত্বাবধানে ম্যাট্রিক পর্যায়ের বাংলা, সংস্কৃত ও গণিত শিক্ষা করেন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীঠাকুর হিমাইতপুর আশ্রমে মেয়েদের শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং তাদের তিন বছরের মধ্যেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসার উপযুক্ত করে তোলার ব্যবস্থা করেন। এই প্রকল্পে অপর আরও কয়েকজনের সঙ্গে রেণুও ছিলেন প্রথম ব্যাচের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থিনীদের একজন। এরপরে তিনি ঠাকুরেরই ইচ্ছানুযায়ী আই. এস সি. এবং বি. এস সি. পাশ করেন এবং বৈজ্ঞানিক স্বামীর গরেষণাকর্মে সহায়তা করে সর্বার্থে প্রকৃত সহধর্মিণী হয়ে ওঠেন।
তখন হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রমে বিভিন্ন ওষুধের জন্য উপযোগী গাছগাছালির বাগান ছিল-সেখান থেকে যে-সময়ে যে-গাছের গুণ সর্বাধিক পাওয়া সম্ভব সে- সময়ে সে গাছ তোলা হত ওষুধ তৈরির জন্য। এই উদ্দেশ্যে গাছ বা লতার নির্যাস নিষ্কাশিত করা হত অ্যাকটিভ অ্যালকোহলের দ্বারা। ঠাকুর শ্যামাচরণকে এই অ্যালক্যালয়েড এক্সট্রাকশন পদ্ধতিটির সরলীকরণ করার কথা বলেছিলেন। রসায়নের ছাত্র হিসাবে বিভিন্ন ভেষজ রাসায়নের গুণাগুণ বিচার এবং তাদের আরোগ্য ক্ষমতা সম্বন্ধে নানা গবেষণা করেন তিনি ঠাকুরের নির্দেশে হিমাইতপুর আশ্রমের সীমিত পরিসরের ল্যাবোরেটরিতে।
আশ্রমের কর্মকাণ্ড বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের সংখ্যাও বাড়তে লাগল, বাড়তে লাগল বাড়িঘর। সব মিলিয়ে এক বৃহদায়তন ক্রিয়াযজ্ঞ, যার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর অর্থের। এসময় জানা গেল গ্রামে গ্রামে ডীপ টিউবওয়েল বসানোর জন্য বেঙ্গল গভর্নমেন্ট টেন্ডার আহ্বান করেছে। আশ্রমিক রাধারমণ জোয়ারদার ছিলেন এ বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষ-তিনি বললেন, কোটেশন দেওয়া হোক। ডীপ টিউবওয়েল বসাতে গেলে দেড়শ ফুট থেকে তিনশ ফুট পর্যন্ত খনন করতে হত। সবাই তিনশ ফুটের হিসাবেই কোটেশন দিত। রাধারমণ বললেন, আমরা দেড়শ ফুটের কোটেশন দেব। সেই হিসাবে টিউবওয়েলের দাম পড়ে গেল অবিশ্বাস্য কম। নিম্নমূল্যের কোটেশন দেওয়াতে সৎসঙ্গই টেন্ডার পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হল। কিন্তু অত কম খরচে কীভাবে হবে-এ বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ সন্দিহান ছিলেন। শ্যামাচরণ ছিলেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগকারী। তিনি এই সন্দেহের কথা জানিয়ে রাধারমণকে কিঞ্চিৎ সংশয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন-সত্যিই এত কম খরচে হবে তো? রাধারমণ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন-নিশ্চয়ই হবে। আপনি সরকারকে জোর দিয়ে বলুন -নিশ্চয়ই হবে। শ্যামাচরণ সেভাবে জানানোর পরে কর্তৃপক্ষ একটি শর্তসাপেক্ষে সৎসঙ্গকে টেন্ডারটি দিতে রাজি হলেন। শর্তটি হল-ঐ খরচের হিসাবে পাঁচটি গ্রামে নমুনা নলকূপ বসিয়ে দেখাতে হবে। যদি ঐ পাঁচটি নমুনা যথাযথভাবে জল তুলতে পারে তাহলে ঐ পাঁচটির দাম সহ পুরো টেন্ডার সৎসঙ্গকে দেওয়া হবে। কিন্তু যদি ব্যাপারটি সার্থক না হয় তাহলে ঐ পাঁচটির দামের লোকসান সৎসঙ্গকেই বহন করতে হবে। সেই শর্ত অনুযায়ী পাঁচটি গ্রামে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ঐ খরচে নমুনা নলকূপ বসানোর পরে টেণ্ডার সৎসঙ্গের করায়ত্ত হল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঐ নলকূপ বসানোর কাজ তৎপরতার সঙ্গে সমাপ্ত করার ফলে সৎসঙ্গের তহবিলে কিছু টাকা এল। কিন্তু টাকার প্রয়োজন বেড়েই চলল। বেশ কিছু স্যানিটারি ল্যাট্রিন তৈরির একটি সরকারি পরিকল্পনাও জানা গেল। পূর্বোক্ত কর্মসমাপনের সুনামের সুবাদে এবারে টেণ্ডার সহজেই পাওয়া গেল এবং এবারেও কম খরচে কম সময়ে উন্নত মানের কর্মদক্ষতা দেখানোর সুযোগ পেলেন সৎসঙ্গের কর্মীবৃন্দ। এ সমস্ত কাজ যে এত সুষ্ঠুভাবে নৈপুণ্যের সঙ্গে নিষ্পন্ন হত তার কারণ এসব কাজে যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই বিশিষ্ট সামাজিক-আর্থিক-সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে আসা উন্নত গুণমানসম্পন্ন ব্যক্তি এবং এঁরা ছিলেন আশ্চর্যরকমের আত্মস্বার্থবোধশূন্য; তাঁদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি অসীম ভালবাসাই ছিল তাঁদের সর্ববিধ কর্মপ্রণোদনার চালিকা শক্তি।
সমসময়েই পদ্মানদীর উপর দিয়ে সারা ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে ইংরেজ সরকার। এই প্রকল্প রূপায়ণে বহু তরতাজা প্রাণ বলি হয় অশান্ত পদ্মার খরস্রোতে। কিন্তু সারা ব্রিজ তৈরি হলে ইংরেজের ব্যবসার পথ আরও সুগম হবে- সুতরাং যে-কোন মূল্যে এই ব্রিজ সমাপ্ত করতে ইংরেজের বণিক বুদ্ধি কৃতসংকল্প ছিল। সারা ব্রিজের উপর দিয়ে রেললাইন পাতা হবে লাইন-যাবে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত -সেই লাইনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের তক্তা বা স্লিপারের জন্য টেন্ডারের আহ্বান করা হল। এই টেন্ডারের ব্যবস্থাপক ছিলেন রেলের ইঞ্জিনীয়ার অমলেশ চট্টোপাধ্যায় -তিনি শ্যামাচরণের শ্যালক। শ্যামাচরণ তাঁকে গিয়ে ধরলেন- এই টেণ্ডার সৎসঙ্গের চাই। কিন্তু এ কাজের জন্য প্রয়োজন বিপুল আর্থিক সঙ্গতি, তা তো সৎসঙ্গের নেই; কীভাবে এত বড় দায়িত্ব তাদের দেওয়া সম্ভব? কিন্তু সৎসঙ্গীবৃন্দের অভিধানে সেসময় অসম্ভব শব্দটি ছিল না। সৎসঙ্গের কর্মকুশলতার সুনামের জোরে এবং শ্যামাচরণের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আংশিক টেন্ডার পাওয়া গেল। দায়িত্ব পাওয়া তো গেল-সময়ের তুলনায় কাজের আকার এবং দায়িত্ব এবারে অনেক বেশি, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কার্যসিদ্ধির পন্থা রূপায়িত করতে হবে। অবিলম্বে শ্যামাচরণ সমস্ত কাজটির পরিকল্পনা করে ফেললেন। একজনকে পাঠানো হল তরাই অঞ্চলে, সেখান থেকে বড় বড় গাছ কেটে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি করে বেঁধে ভাসিয়ে দেওয়া হল নদীতে-গঙ্গা, পদ্মা হয়ে তা পৌঁছল হিমাইতপুর। পদ্মার ঘাট থেকে ঐ বড় বড় গাছের গুঁড়ি আশ্রম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল গড়িয়ে গড়িয়ে। ব্যাপারটি যত সহজশ্রাব্য, আদৌ তেমন সহজসাধ্য নয়, এ কথা বলা বাহুল্য। কাঠ তো পৌঁছল, কিন্তু অত অল্প সময়ের মধ্যে কাঠ চিড়ে অত তক্তা বানানো হস্তচালিত করাতের সাহায্যে সম্ভব নয়, শক্তিচালিত দ্রুতগতি করাতের ব্যবস্থা করা না গেলে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না নির্দিষ্ট সময়ে। কিন্তু শক্তি পাওয়া যাবে কোথা থেকে? সৎসঙ্গে তখনও ইলেকট্রিক ডায়নামো আসেনি। শ্যামাচরণ আবার গেলেন শ্যালক অমলেশের কাছে,-তোমাদের পরিত্যক্ত ইঞ্জিন একটা দাও। কয়েকটা রেললাইনও দিতে হবে। টাকা দিতে পারব না, কাজ শেষ হলে আমাদের পাওনা টাকা থেকে শোধ হবে।
তাঁর কথায় ইঞ্জিনীয়ার অমলেশ চ্যাটার্জি একটি বাতিল হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন এবং কিছু রেল লাইন ওয়াগনে করে পাঠিয়ে দিলেন ঈশ্বরদি স্টেশনে। ঈশ্বরদি স্টেশন থেকে পাবনা শহর, শহর থেকে হিমাইতপুর আশ্রম-প্রায় একুশ মাইল দূরত্ব। রেলপথ ছাড়া ঐ বিপুল ওজনের ইঞ্জিন কীভাবে এতখানি দূরত্ব অতিক্রম করবে? আবার স্মরণ করা যায়- সৎসঙ্গীদের তখনকার অভিধান থেকে অসম্ভব শব্দটি মুছে গিয়েছিল। যে রেললাইন গুলি চাওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে এক জোড়া দু পাশে পাতা হল, বহু কসরৎ করে ঐ লাইনের উপর ইঞ্জিনটি ঠেলে তোলা হল, তারপর সবাই মিলে ঐ লাইনের উপর দিয়ে ইঞ্জিনকে ঠেলে গড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। কিছুটা এগোনোর পর আবার সামনে আরেক জোড়া রেল পেতে ইঞ্জিনকে তার উপর দিয়ে গড়ানো হতে লাগল, ততক্ষণে পিছনের দিকের রেলগুলি খুলে আবার সামনে পাতার ব্যবস্থা হল। এভাবে রিলে পদ্ধতিতে ঠেলতে ঠেলতে ঐ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইঞ্জিন নিয়ে পৌঁছনো হল আশ্রমে। পাবনা শহরের চওড়া পিচের রাস্তার উপর দিয়ে রেললাইন পেতে তার উপর দিয়ে একটি ইঞ্জিনকে ঠেলে নিয়ে চলেছেন একদল ভদ্রলোক, যাঁদের মধ্যে বিলেত ফেরত ইঞ্জিনীয়ার, মস্ত ডিগ্রিধারী পণ্ডিত, ম্যাজিস্ট্রেটের পদ প্রত্যাখ্যান করা মানুষ, এমনকী স্বয়ং ঠাকুরও আছেন-এমন অভাবনীয় দৃশ্য বা ঘটনা আজকের প্রযুক্তি-সর্বস্ব একান্ত আত্মস্বার্থী পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কল্পনায় আনাও কষ্টসাধ্য। বস্তুত, একটি মানুষের ভালবাসা যে অতগুলি মানুষকে কীভাবে সব-ছাপানো, সব-ভোলানো প্রেমের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাঁদের সফল সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে তুচ্ছতায় পর্যবসিত করে নিতান্ত কৃচ্ছতা-সংকুল আশ্রমিক জীবনে অবিশ্বাস্য সব কর্মকাণ্ডে তাঁদের মাতিয়ে তুলতে পারে- আজকের সংকীর্ণ দুনিয়াদারির প্রেক্ষাপটে তা যেন অবিশ্বাস্যই মনে হয়!
যাহোক, ইঞ্জিন তো পৌঁছল। ইঞ্জিনের বয়লারে জ্বালানি হিসাবে দেওয়া হল অনেক পরিমাণে কাঠ-কয়লা ছিল দুষ্প্রাপ্য। সেই বয়লার থেকে শক্তি সংগ্রহ করে সেই শক্তিচালিত চক্রাকার করাতের সাহায্যে কাঠ কেটে তক্তা বানিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ নিষ্পন্ন হল। তীক্ষ্ণধী শ্যামাচরণের সুব্যবস্থিত পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ ক্রিয়াযজ্ঞটি সম্পাদিত হয়।
সুনিপুণ কর্মকুশলতা ও সহজাত নেতৃত্বই শুধু নয়, শ্যামাচরণের অসাধারণ হৃদয়বত্তাও ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। একবার কলকাতা থেকে হিমাইতপুর ফিরছেন, বর্ষাকাল; পাবনা থেকে চার মাইল কর্দমাক্ত পথ ভেঙে যেতে হবে। তাঁর পরিধানে ছিল প্যান্ট-শার্ট, জুতোমোজা। একটি সিমেন্টের বেদিতে বসে জুতো মোজা খুলে হাতে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে তৈরি হচ্ছেন হাঁটার জন্য-অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। হঠাৎ লক্ষ করেন একজন রমণী তাঁর সামনে এসে হাত মেলে দাঁড়াল-তিনি পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা হাতে উঠল দিয়ে দিলেন তার হাতে। কিন্তু সেই রমণী দাঁড়িয়েই রইল- হাতখানি মুঠি করতেও যেন খেয়াল নেই তার। শ্যামাচরণ তার দিকে তাকিয়ে দেখেন মধ্যবয়স্কা এক প্রৌঢ়া, অদ্ভুত এক শূন্য চোখের দৃষ্টি, যেন স্থান-কালেরও বোধ নেই তার, বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে তার সারা শরীর। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন-কী মা, আপনার কী হয়েছে? প্রৌঢ়া যন্ত্রচালিতের মত বলে-আমার একমাত্র ছেলে গত সপ্তাহে মারা গেছে-আমার আর কেউ নেই!
শ্যামাচরণ তার বাহুটি ধরে কোমল স্বরে বলে-এই বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে যাচ্ছেন, চলুন মা, আমি আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। উত্তরে সেই মা জানায় যে তার বাড়িঘরও কিছু নেই, খাজনা না দিতে পারায় জমিদার বাড়ি নিয়ে নিয়েছে।
উদ্বিগ্ন শ্যামাচরণ তখন তাকে তাঁর সঙ্গে আশ্রমে যেতে বলেন। সে বলে- সে কোন্ কাজে লাগবে যে আশ্রমে তার স্থান হবে! শ্যামাচরণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন- আমাদের ঠাকুরের আশ্রমে সবার জন্য কাজ আছে, সকলের আশ্রয় আছে।
এই কথা বলে সেই মহিলাটিকে সঙ্গে নিয়ে ঐ পথ পাড়ি দিয়ে জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের সামনে নিয়ে গিয়ে বলেন-ঠাকুর, এই মা-টির ছেলে মারা গেছে গত সপ্তাহে-
এ-কথা শুনেই সেই রমণী এতক্ষণ পরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। ঠাকুর মধুর গভীর স্বরে বলেন-মারে, এই তো আমি তোর ছেলে, তোকে যে আমার ভীষণ দরকার! যা, -এখন ভেতরে গিয়ে নেয়েধুয়ে আয়। শ্যামাচরণ লক্ষ করেন-ঐ একটি কথায় সে পুত্রশোকাতুরা বিভ্রান্ত রমণীর মুখের ভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেল-আশ্বস্ততার ও নির্ভরতার ছবি ফুটে উঠলো সেখানে। তদবধি সে ঠাকুরের আশ্রয়েই ছিল।
১৯৩৫-এ একবার বাংলার তৎকালীন গভর্নর জন অ্যান্ডারসন পাবনায় আসেন কোন কার্যোপলক্ষে; সেসময় তিনি পদ্মাবক্ষে বজরায় কিছুদিন বিশ্রামের জন্য অবস্থান করছিলেন। সৎসঙ্গের সেক্রেটারি শ্যামাচরণ স্থির করলেন-অ্যান্ডারসনকে একবার সৎসঙ্গ আশ্রম দেখতে আসার আমন্ত্রণ জানাবেন। সুন্দর ধুতি পাঞ্জাবীতে সজ্জিত হয়ে, তাঁর একটি সোনা বাঁধানো ছড়ি ছিল, সেইটি হাতে নিয়ে একখানি নৌকায় করে গভর্নর-এর বজরার কাছে গেলেন। সামনে গভর্নরের রক্ষী নৌকা ছিল-তারা তাঁর নৌকা আটকাল। তিনি বললেন, তিনি গভর্নরের সঙ্গে দেখা করতে চান। রক্ষীরা প্রথমে রাজি হচ্ছিল না-কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বপূর্ণ কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়ে তারা তাঁকে অ্যান্ডারসনের সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে দেন। সেক্রেটারির হাতে শ্যামাচরণ নিজের ভিজিটিং কার্ড দেন। ঐরকম গ্রাম্য পরিবেশে একজন সুসজ্জিত মানুষকে দেখে এবং তাঁর কাছ থেকে ভিজিটিং কার্ড পেয়ে সেক্রেটারি অবাক হয়ে যান। পরে তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপের পর তাঁর পরিমার্জিত ইংরেজি শুনে সেক্রেটারির বিস্ময় আরও বৃদ্ধি পায় এবং গভর্নর অ্যান্ডারসনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। অ্যান্ডারসন শ্যামাচরণের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা এবং বিশেষত রসায়ন শাস্ত্রে তাঁর গভীর ব্যুৎপত্তি দেখে যৎপরোনাস্তি বিস্মিত এবং প্রীত হন। শ্যামাচরণ তখন তাঁকে একবার সৎসঙ্গ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান। অ্যান্ডারসন জানান যে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী নির্দিষ্ট থাকায় সেবারে তিনি যেতে পারবেন না, তবে তিন/চার মাস পরে আর একবার তাঁর ঐ অঞ্চলে আসার কথা, সেসময় তিনি অবশ্যই সৎসঙ্গ দর্শনে যাবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন-নির্দিষ্ট সময়ে সৎসঙ্গ আশ্রম দেখতে এসেছিলেন। সময়টি ছিল বর্ষাকাল, কাঁচা মাটির রাস্তা সেসময়ে এমন কর্দমাক্ত হয়ে থাকে যে তাতে গাড়ি চলাচল করা মুস্কিল। গভর্নর আশ্রমে যাবেন বলে তাঁর যাতায়াতের সুবিধার জন্য পাবনা শহর থেকে হিমাইতপুর আশ্রম পর্যন্ত কাঁচা মাটির রাস্তা সরকারি উদ্যোগে পিচ ঢেলে পাকা করে দেওয়া হল। যথাসময়ে অ্যান্ডারসন আসেন এবং আশ্রমের কর্মকাণ্ড দেখে অত্যন্ত প্রীত হন। তাঁর মুগ্ধতা ও প্রসন্নতা ফুটে ওঠে তাঁর মন্তব্যে — “.
.......The Satsang is doing excellent work in Education, Art, Social Service and Religion.
I am sure the Asram is a force with great potentialities for the moral and physical betterment of Bengal and I wish it every success in surmounting the difficulties which face it. As far as it may lie in my power to do so I shall be glad to assist in this connection.”
আশ্রমের কলাকেন্দ্রের চিত্রশিল্পী অ্যান্ডারসনের একটি তৈলচিত্র অঙ্কন করেন। পরে শ্যামাচরণ তাঁর মাসতুত ভাই হরেরাম চক্রবর্তী এবং আরও একজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই তৈলচিত্রটি কলকাতার রাজভবনে পৌঁছতে যান। রাজভবনে যে-ঘরে গভর্নরের দর্শনার্থী বিভিন্ন বিশিষ্ট এবং সমাজের উচ্চবর্গের ব্যক্তি অপেক্ষা করছিলেন, সেখানে প্রথমে তৈলচিত্রটি নিয়ে তাঁরা প্রবেশ করেন। শ্যামাচরণ ভিজিটিং কার্ড পাঠানোর পরে অন্যান্য দর্শনার্থীদের বিস্মিত ও ঈর্ষান্বিত দৃষ্টির সামনে আগে শ্যামাচরণকে ডেকে পাঠান অ্যান্ডারসন। তৈলচিত্রটি ভিতরে পৌঁছে দিয়েই হরেরাম ও অপরজন বাইরে চলে আসেন; শ্যামাচরণ থেকে যান অ্যান্ডারসনের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল দশ মিনিট, কিন্তু কথাবার্তার পরে তিনি যখন বেরোলেন তখন আধ ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। শ্রীশ্রীঠাকুরকে কেন্দ্র করে সুসংহত চলনের মধ্য দিয়ে শ্যামাচরণের সহজাত সুন্দর ব্যক্তিত্ব এমন এক অনন্য মাত্রা অর্জন করেছিল যে, যে-কোন শ্রেণীর মানুষই তাঁর সঙ্গে আলাপে মুগ্ধ হতেন, তাঁর সান্নিধ্য ছিল সকলের পক্ষেই কাম্য।
প্রায় শূন্য থেকে যেভাবে ঠাকুরকে কেন্দ্র করে হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রম সমাজের সর্বস্তরের অতগুলি মানুষকে নিয়ে অকল্পনীয় কর্মকাণ্ড সাধন করে বেড়ে উঠতে লাগল, তা অনেকের পক্ষেই ঈর্ষণীয় ছিল। বিশেষত মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো এবং অন্যান্য অনেক দিক দিয়ে তাঁদের স্বাবলম্বী করে তোলার যে প্রগতিশীল পদক্ষেপ শ্রীশ্রীঠাকুর গ্রহণ করেছিলেন, সংকীর্ণ গণ্ডীবদ্ধ পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীতে তা প্রায়শই নিন্দিত হত। তাই ঠাকুরের প্রতি এবং আশ্রমের প্রতি আকৃষ্ট মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর সৃষ্টি হয়েছিল অনেক। আশ্রমের মিথ্যা অপযশ ছড়ানোর জন্য এদের যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। আশ্রমের মধ্যে নানাধরনের সমাজবিরোধী কার্যকলাপ সাধিত হয়, মেয়েদের নিয়েও যথেচ্ছাচার চলে-এ ধরনের নিন্দাবাদ পল্লবিত হতে হতে সরকারি পর্যায়ের উচ্চস্তর পর্যন্ত পৌঁছয়। পাবনা তখন প্রশাসনিক ভাবে রাজশাহী ডিভিশনের অন্তর্গত ছিল। রাজশাহী ডিভিশনের কমিশনার ছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ আই. সি. এস. অফিসার এফ. ডব্লু. রবার্টসন। তিনি ১৯৩৬-এর এপ্রিল মাসে একদিন হঠাৎ করে কোন পূর্ব অবগতি ছাড়াই ম্যাজিস্ট্রেটকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রমে এলেন পরিদর্শনে। উদ্দেশ্য-আশ্রম বিষয়ক অপবাদগুলি হাতেনাতে যাচাই করা। এসে দেখেন, কুঁড়েঘরে টিমটিমে আলোয় বসে একান্ত ঘরোয়া অল্পবয়সী ক’জন গৃহবধূ ক্যালকুলাস করছেন। কোথাও মেয়েদের সেলাইয়ের ক্লাস হচ্ছে, কোথাও বা পঞ্চাশ ষাট বছরের মহিলারা পড়াশুনো করছেন। তপোবন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখলেন ছেলেরা এখানে ওখানে মাটি কোপাচ্ছে, কোথাও ক্লাস হচ্ছে। সেক্রেটারি শ্যামাচরণ সঙ্গে করে তাঁকে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। রবার্টসন বিস্ময় বিমুগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করলেন-এ কী স্বপ্নপূরী নাকি? কেমিক্যাল ওয়ার্কস-এ নিয়ে গিয়ে রসায়নে সুপণ্ডিত শ্যামাচরণ কোন গাছ থেকে কোন ওষুধ কীভাবে হয় বোঝালেন। দৃশ্যতই বিমূঢ় রবার্টসন বলেন-এসব কী দেখছি! আপনাদের ঠাকুর এখানে শুধু ফিলজফির চর্চা করান না? তপোবন ঘুরে বলেন-এখানে পড়াশুনার ধারার সঙ্গে আমাদের অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ ধারার মিল আছে। মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে তখন বিরাট ডায়নামো ছিল। একদিকে লেদের কাজ হচ্ছে, আর একদিকে ঢালাইয়ের কাজ চলছে। রবার্টসন যত দেখেন তত অবাক হন। সপ্রশংস গভীর বিস্ময়ে বলেন-এই অজ পাড়াগাঁয়ে আপনাদের ঠাকুর এত কিছু করান? শ্যামাচরণ সপ্রত্যয় বিনয়ে উত্তর দেন-আজ্ঞে হ্যাঁ; আমাদের ঠাকুর বলেন -ইংরেজ তাড়িয়ে তো স্বাধীনতা হয় না, এই হল প্রকৃত স্বাধীনতা।
রবার্টসনকে ঠাকুরের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। একটি পরিচ্ছন্ন কুঁড়েঘরে বসেছিলেন ঠাকুর। রবার্টসনকে একটি চেয়ারে বসতে বলা হল। যে দুর্ধর্ষ কমিশনারের সামনে বড় বড় ইংরেজ অফিসাররাও কাঁপত, ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে তাঁর মধ্যে এমন এক ভাবান্তর উপস্থিত হল যে তিনি চেয়ার ছেড়ে মাটিতে বসে পড়তে চাইলেন। অনেক অনুরোধে তাঁকে চেয়ারে বসানো হল। রবার্টসন ঠাকুরের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন, দোভাষীর কাজ করেন শ্যামাচরণ-ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন- মনে হচ্ছে যেন একটা নীল আলো দেখতে পাচ্ছি। পরে শ্যামাচরণকে বলেন-ইয়ং ম্যান, তোমাকে আমার প্রতিশ্রুতি দেওয়া রইল, সৎসঙ্গের জন্য যখন যা দরকার হবে, আমার কাছে যাবে। তিনি প্রকৃতই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে রবার্টসন মন্তব্য করেন, “The Asram will prove a real force in the province for combating unemployment and improving the condition of the people both materially and morally. I shall be glad to give the Asram all the help in my power.”
পরবর্তীকালে রবার্টসন রাইটার্সে চীফ সেক্রেটারি হয়ে যান। ঠাকুর বাংলা ভাগ রোখার জন্য বহু আগে থেকেই হিন্দু-মুসলমান অনুপাত যাতে সমান সমান হয় সে উদ্দেশ্যে বাইরে থেকে হিন্দু এনে বসানোর কথা বলেছিলেন। এজন্য তিনি অন্তত দুই আড়াই হাজার বিঘা জমির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। বাংলায় তখন ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা। লীগ মন্ত্রিসভার সৎসঙ্গকে জমি দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি ছিল; তা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রবার্টসন সৎসঙ্গকে প্রচুর পরিমাণে জমি দিয়েছিলেন। বাইরে থেকে ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পরিবারকে সেসব জায়গায় বসানো হল। কিন্তু এত বড় প্রকল্প রূপায়ণের জন্য যে সংঘবদ্ধ বৃহৎ উদ্যোগের প্রয়োজন, ঠাকুরের অথবা সৎসঙ্গের একক প্রচেষ্টায় তা সম্ভব ছিল না। শ্রীশ্রীঠাকুর জনসংঘ নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে এই পরিকল্পনার কথা বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ যথাযথ গুরুত্ব দিলেন না বিষয়টিতে, দিলে ইতিহাসের গতি পরিবর্তিত হতো হয়তো।
একবার হিমাইতপুর আশ্রমে জ্যোতিষ চর্চার বিশেষ ঝোঁক হয়। শ্যামাচরণ নিজেও এই বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন, ভাল ঠিকুজি কোষ্ঠীও প্রস্তুত করতে পারতেন। নিজের কোষ্ঠীও তিনি করেছিলেন এবং যে-বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে, বিস্ময়করভাবে সে-বয়স পর্যন্তই কোষ্ঠীফল গণনা করেন, তারপর আর কোন গণনা তাতে করেননি। যাহোক, ঠাকুরের ভৃগুকোষ্ঠীও সংগৃহীত হয়েছিল ভক্তবর সুশীলচন্দ্র বসুর প্রচেষ্টায়। সেই কোষ্ঠী বিচার করে কোন জ্যোতিষী বলেন, ঠাকুরের সময় খারাপ, হীরে ধারণ করলে হয়তো বা কিছুটা প্রতিকার হতে পারে। তখন দু’বেলা সকলের পর্যাপ্ত আহারেরই সংস্থান ছিল না, হীরের আংটি স্বভাবতই বিবেচনা- বহির্ভূত। শ্যামাচরণ কর্যোপলক্ষে প্রায়ই হিমাইতপুর থেকে কলকাতা যেতেন। একবার কলকাতা গিয়ে কিছুদিন বাদে যখন ফিরলেন, ঠাকুরের জন্য একটি হীরের আংটি এনে তাঁকে ধারণ করতে বললেন। আংটি কীভাবে যোগাড় হল-সে বিষয়ে প্রশ্ন করেও বিশেষ সদুত্তর পাওয়া গেল না তাঁর কাছে।
এর কিছুদিন পরে শ্যামাচরণের জননী দুর্গা দেবী জ্যেষ্ঠ পুত্র পান্নালালের (নগেন্দ্রনাথের প্রথমা স্ত্রীর সন্তান) কাছে বাগবাজারের বাড়ির দলিলটি চান। নগেন্দ্রনাথেরা মোট বারো ভাই ছিলেন-তাই একেক জনের ভাগে বাড়ির কিছু কিছু অংশ ছিল। নগেন্দ্রনাথের অংশটির দলিল জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছেই থাকত। দুর্গাসুন্দরী দলিল চাইলে তিনি বলেন-মা, দলিল তো আমার কাছে নেই, গোপাল (শ্যামাচরণের ডাক নাম) নিয়ে গেছে। দুর্গাসুন্দরী অবাক হয়ে বলেন-সেকী! ও দলিল নিয়ে কী করবে? পান্নালাল বলেন-তা তো জানি না! এরপর দুর্গাদেবী শ্যামাচরণের কাছে দলিল চাইলে তিনি বলেন-দলিল তো আমার কাছে নেই, এখন দিতে পারব না। মা জিজ্ঞাসা করেন-কী হয়েছে দলিলের, কোথায় তা? শ্যামাচরণ নিরুত্তর থাকেন। বহুবার প্রশ্ন করেও উত্তর না পেয়ে মা শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের কাছে গিয়ে নালিশের সুরে বলেন-গোপালী, তোমার আশকারা পেয়েই ছেলেগুলো এমন হয়েছে; দলিল কোথায়, কিছুতেই বলছে না গোপাল। ঠাকুর তখন শ্যামাচরণকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন-গোপাল, দলিল নিয়ে কী করেছিস? অগত্যা শ্যামাচরণ উত্তর দেন-ওটা বন্ধক দিয়ে আপনার জন্য হীরের আংটি গড়িয়েছি। শুনে ঠাকুর তো স্তম্ভিত! বলে কী পাগলটা! বাড়ি বাঁধা দিয়ে হীরের আংটি! শ্যামাচরণ বলেন -তা কী করব-আপনার সময় খারাপ, হীরের আংটিতে যদি উপকার হয়...। ঠাকুর তো একেবারে সোরগোল ফেলে দিলেন-ওরে, গোপালের বাড়ি বাঁচা তোরা সবাই মিলে। তখন সবাই মিলে চাঁদা তুলে চেয়েচিন্তে ভিক্ষে করে টাকা দিয়ে বাড়ির দলিল ছাড়ানো হল।
এরপর দুর্গাসুন্দরী তাঁর নিজের এবং পুত্রবধূ রেণুর প্রায় সমস্ত গহনা বিক্রি করে উত্তর কলকাতার ডাফ লেন-এ একটি বাড়ি কেনেন; কিন্তু এ বাড়ি যে তাঁদের, একথা শ্যামাচরণকে জানাননি। তাঁকে বলা হয়েছিল বাড়িটি তাঁর ভগ্নী (মাসি শিখরবাসিনীর কন্যা) ঈশ্বরীর বাড়ি এবং তা জেনে শ্যামাচরণ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর এই ভুল ধারণা আমৃত্যু ছিল। কী তীব্র ইষ্টানুরাগ এবং কত মহৎ অন্তঃকরণ ছিল তাঁর, এ ঘটনা তার অন্যতম উদাহরণ। ডাফ লেনের সেই বাড়িতেই কিছুকাল আগে পর্যন্তও শ্যামাচরণের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুপণ্ডিত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডঃ অরুণাদিত্য মুখোপাধ্যায় বাস করতেন।
ঠাকুরের আশ্রয়ে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে নানাধরনের মানুষ ছিলেন এবং সকলের অভিপ্রায় বা দৃষ্টিভঙ্গী সবসময় স্বচ্ছ ছিল না। এর ফলে ঠাকুরকে এবং তাঁর একান্ত কাছের যাঁরা তাঁদের বহু বেদনাময় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ভোগ করতে হয়েছিল। এমনই একটি ঘটনা এখানে বিবৃত হচ্ছে। সৎসঙ্গের কোন একটি তহবিলে একবার বারো হাজার টাকা জমা পড়ার কথা। শ্যামাচরণ সেই অর্থ অপর একজনের মাধ্যমে জমা দেওয়ার জন্য পাঠান। কিন্তু যে-কোন অজ্ঞাত কারণে সে টাকা যথাস্থানে জমা পড়েনি। সৎসঙ্গের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যম ভ্রাতা পূজনীয় ক্ষেপুদা বিষয়টি ঠাকুরের গোচরে আনেন এবং সর্বসমক্ষে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যাতে শ্যামাচরণই যেন এ ব্যাপারে দায়ী, এমনটি প্রতিপন্ন হল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর নিকটজনের দোষের শাস্তি দিতেন নিজেকে আঘাত করে; এক্ষেত্রেও তিনি নিজের পাদুকা দিয়ে নিজেকে আঘাত করলেন সর্বসমক্ষে। বেদনায়, বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে গেল নিরপরাধ শ্যামাচরণের অন্তরাত্মা, নীরবে নিজ গৃহে ফিরে এলেন তিনি। তারপরই তাঁর জ্বর হল, সঙ্গে কাশি এবং অপরিসীম শারীরিক দুর্বলতা। হিমাইতপুরে চিকিৎসায় বিশেষ ফল না হওয়ায় সপরিবারে কলকাতা গেলেন শ্যামাচরণ। স্ত্রীর পিত্রালয়ে স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বাগবাজারের বাড়িতে রইলেন। বিখ্যাত বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ নেতাজি সুভাষ-অগ্রজ ডাঃ সুনীল বসু তাঁকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলেন যে তাঁর যক্ষা হয়েছে। এ কথা জেনে নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্র সম্পূর্ণ পৃথক করে নিলেন, ঘরে কাউকে প্রবেশ করতে দিলেন না এবং স্ত্রীকে খবর পাঠালেন পুত্রসহ পিতৃগৃহেই থাকতে। ঠাকুরকে সমস্ত সংবাদ জানানো হলে তিনি তৎক্ষণাৎ সবাইকে নিয়ে শ্যামাচরণকে হিমাইতপুর ফিরে আসতে বলেন। শ্যামাচরণ তাই করলেন। আশ্রমিক হোমিও চিকিৎসক অমরলাল বসু (যিনি টালার কর্তা নামেই পরিচিত ছিলেন)-কে ডেকে ঠাকুর ইগনেশিয়া নামক ওষুধটির গুণাগুণ ভালভাবে দেখতে বললেন। তিনি দেখে জানালেন যে গভীর মানসিক আঘাতজনিত কারণে শারীরিক পীড়ায় এ ওষুধ বিশেষ কার্যকর। ঠাকুর তখন শ্যামাচরণকে ইগনেশিয়া দিতে বললেন এবং ঐ ওষুধেই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। প্রকৃতপক্ষে শ্যামাচরণ যে নির্দোষ এ কথা ঠাকুর খুব নিশ্চিতরূপেই জানতেন, কিন্তু যাঁরা তাঁকে অপরাধী সাজিয়ে নিজেদের আড়াল করতে চেয়েছিলেন, তিনি তাঁদের আঘাত করার জন্যই নিজেকে আঘাত করেছিলেন। পরে শ্যামাচরণ এ সত্য অনুভব করেন।
শ্যামাচরণের গভীর ধীশক্তি এবং প্রগাঢ় মননশীলতা তাঁর রচিত “Nature’s Dharma” নামক একটি ইংরেজি পুস্তিকার মাধ্যমে সুপরিস্ফুট হয়েছে। নিয়তির অমোঘ আকর্ষণে ইষ্টাদেশ পালনের সামান্য ব্যত্যয়ে ভয়ঙ্কর জীবনাবসান না ঘটলে তাঁর কাছ থেকে মানবজাতির আরও বহু প্রাপ্তি হতে পারত। তিনি ইংরেজিতে পুস্তিকাটি লিখলেও এটির বঙ্গানুবাদ যে অত্যন্ত প্রয়োজন, তা অনুভব করে শ্রীশ্রীঠাকুরের অপর সুযোগ্য ভক্ত প্রফুল্লকুমার দাসকে বলেছিলেন ঐ বাংলা অনুবাদের কাজটি করতে। প্রফুল্লকুমার দাস যথাযথভাবে সে অনুবাদকর্ম সমাধা করেন। তা “প্রাকৃত ধৰ্ম্ম” নামে প্রকাশিত হয় শ্যামাচরণের প্রয়াণের পরে। “প্রাকৃত ধৰ্ম্ম” থেকে অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে শ্যামাচরণের স্বচ্ছ দৃষ্টি এবং আদর্শপ্রাণতার দৃষ্টান্তরূপে।
মানবজাতির যথার্থ মঙ্গলের স্বরূপ এবং তা সাধনের উপায়ই তাঁর রচনাটির উপজীব্য। এই প্রসঙ্গে জীবনের মৌলিক শক্তি অনুরাগ বা সুরতের প্রকৃতি নিরূপণ করে তার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশের মাধ্যমে জগতের সর্বাধিক কল্যাণ সাধনের পন্থা নির্দেশ করেন তিনি নিম্নরূপে —
“আমরা এখন অনুরাগের মনস্তত্ত্ব অর্থাৎ এর উদ্ভব ও বিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করব-কারণ জীবনের যথার্থ উন্নতির সারকথা ও মর্মবাণী এতেই নিহিত। গোড়ার কথা হচ্ছে, একটা শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তার সুরত অর্থাৎ আসক্তিধারা তার আকর্ষণের একমাত্র বস্তু মায়েতেই যুক্ত থাকে। তারপর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাবা এবং অন্যান্য ব্যক্তি, যা’দিগকে তার মা শ্রদ্ধা করেন, ইত্যাদিকে ভালবাসতে সুরু করে। মাতার প্রভাব এমনি করে অজ্ঞাতসারে সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। মানুষের সহজ সুরত মাতা হতে উদ্ভূত হয়ে এক পরিপূরক হতে আর এক পরিপূরকের দিকে অগ্রসর হয়ে চলে, এবং শেষটা যে মহাপুরুষ তার সমগ্র সত্তাকে অনুরঞ্জিত করতে পারেন, তাঁতেই নিবদ্ধ হয়। আসক্তির পাত্র যত নিখুঁত হবেন-আমাদের পূর্ণতাও হবে তত গভীরতর; চরমোৎকর্ষপ্রাপ্ত পরমপরিপূরণী শক্তিসম্পন্ন যুগপ্রবর্তকের প্রতি যদি কেউ ভক্তি ন্যস্ত করতে পারে, তার পক্ষে তখন শ্রেষ্ঠ সাফল্য ও বিকাশ লাভ সম্ভব হয়ে ওঠে-কারণ তিনিই পরমপিতার প্রিয় সন্তান, মানুষের মুক্তির একমাত্র রাজপথ।....
........বর্তমান যুগে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, মানুষের চরিত্র এত কুটিল ও জটিল হয়ে উঠেছে, ব্যক্তির সুখশান্তির ধারণা এত বিকৃত হয়ে পড়েছে, বিজ্ঞানের মারণাস্ত্র সকল এত দ্রুতগতিতে উদ্ভাবিত হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতবাদসমূহ দেশে এমন প্রাধান্য লাভ করছে যে এমনতর পারিপার্শ্বিকতায় জীবনধারণ যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এখন প্রয়োজন-পীড়িত জনসমক্ষে জানাবার দিন এসেছে যে সহস্র সহস্র ক্লিষ্ট মানবের আকুল প্রার্থনার ফলে এমন এক ব্যক্তি ব্যক্ত হয়েছেন, যিনি ঋষিদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নিজে যে আদর্শ প্রচার করেন, বাস্তবজীবনে তা কাঁটায় কাঁটায় পালন করেন এবং তিনিই সৎসঙ্গ আন্দোলনের প্রাণপ্রদীপস্বরূপ!... হিন্দু তাঁকে স্বীয় আদর্শের মূর্ত বিগ্রহ হিসাবে গ্রহণ করে, তাঁকে দেখে মহম্মদকে গভীরভাবে অনুভব করা যায় বলে মুসলমানরা তাঁর ভক্ত হয়, যীশুখ্রীষ্টের প্রকট প্রকাশজ্ঞানে খ্রীষ্টানরা তাঁকে অনুসরণ করে।... তাঁর মতে তথাকথিত ধর্মান্তরগ্রহণ মহাপাপবিশেষ, কারণ এর মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার বীজ নিহিত। ব্যক্তিগত দৃষ্টান্তের সাহায্যে উদ্বুদ্ধকরতঃ প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যমাফিক তাকে জীবনবৃদ্ধির উন্নত পরিক্রমণায় পরিচালিত করাই তাঁর সহজ পদ্ধতি। তাঁর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তিগত চরিত্রমাধুর্যের প্রভাবে আজ সহস্র সহস্র লোক তাঁর আকর্ষণে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তৎপ্রবর্তিত সহজ সরল বৈজ্ঞানিক বাস্তবতামূলক মত ও পথের অনুসরণে নিজেদের জীবনগঠনে ব্যাপৃত। শ্রীশ্রীঠাকুরই এই সৎসঙ্গ- আন্দোলনের প্রাণবস্তু এবং কেন্দ্রশক্তি!...
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন ধর্ম কখনও বহু হতে পারে না। ধর্ম এক এবং সর্বপ্রকার ধর্মমতের মূলতত্ত্ব অভিন্ন।... ধর্মই জীবনের আদিম উপাদান-দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনকে কৃতকার্য করে তুলতে হলেও ধর্মই প্রধান প্রয়োজন-কারণ ধর্মই আমাদের জীবনকে সর্বভাবে ব্যাপ্তি, বিকাশ ও উপভোগে উদ্বেল করে তোলে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের মতে গভীর ও ব্যাপকতম অনুভূতিসম্পন্ন কোন পুরুষের নিকট হতে দীক্ষা-গ্রহণ জীবনের অবশ্যকরণীয়-কারণ দীক্ষার ভিতর দিয়ে যুগপৎ শরীর ও মনের অনুশীলন-দ্বারা দক্ষতা অর্জনের বাস্তব কৌশল সঞ্চারিত হয়। দীক্ষার মূল কথা হল সত্যিকার শদ্ধা, অনুরাগ ও উপাসনা নিয়ে নিজেকে প্রিয়পরমে যুক্ত করা। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রবর্তিত দীক্ষাপদ্ধতিতে জপধ্যানের প্রথা জানিয়ে দেওয়া হয়। নিয়মিত জপ মানুষের মস্তিষ্ক-কোষকে সাড়াপ্রবণ করে তোলে এবং যথাবিধি ধ্যান মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে; সুতরাং জপধ্যান একত্রে সমগ্র মস্তিষ্কের সংবেদনশীলতা এবং গ্রহণসামর্থ্য ফুটিয়ে তোলে।
.........আমরা শুধু নিজেদের যুগের জন্যই দায়ী নই, ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রতিও আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের গুণাবলী উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি-এবং আমাদেরও উচিত সন্তান-সন্ততিকে মহত্তর দীপ্তি দান করা। সুতরাং সুপ্রজননের দৃঢ় ভিত্তিতে এমন এক সমাজব্যবস্থা গঠন করা প্রয়োজন যাতে পূর্বপুরুষের সাধনার ধন সর্বসমাধানী আর্যবিধান অনন্তকাল ধরে বিবাহ, ধর্ম ও কৃষ্টির ভিতর দিয়ে বিধিবদ্ধভাবে সঞ্চার ও সঞ্চালন করবার মত উপযুক্ত সুসন্তানের আবির্ভাব হতে পারে। আর্যসমাজ বিশিষ্ট চার বর্ণে বিভক্ত, যথা (১) বিপ্র, এঁরা ব্রাহ্মণের ঔরসজাত, ব্রাহ্মণত্বের যাবতীয় সম্ভাব্যতা এঁদের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় আছে; (২) ক্ষত্রিয়, মানুষকে রক্ষা করা এবং দুঃখ ও ক্ষত হতে ত্রাণ করা এঁদের কাজ; (৩) বৈশ্য, কৃষিশিল্পবাণিজ্যের সাহায্যে সমাজকে সেবা করা এঁদের কাজ; এবং (৪) শূদ্র, অর্থাৎ শুচীকৃত অনার্য। আদিমকাল হতে এই চার বর্ণ আর্যসমাজে বাস করছেন। প্রত্যেকে স্ব স্ব বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে অনুশীলনের সাহায্যে যাতে ব্রাহ্মণত্বে পৌঁছতে পারেন, এটাই ছিল তাঁদের লক্ষ। সৎসঙ্গ আজ তাই বিশেষ করে এই কথা বলছে যে যুগ যুগ ধরে ঋষিদের সতর্ক পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ফলে সমাজবিধানের যে নিখুঁত জীববিজ্ঞান-সম্মত তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, সেদিকে লক্ষ না রাখলে কখনও সমাজে সত্যকার শ্রেষ্ঠ ও উন্নত সন্তানের জন্ম হওয়া সম্ভব নয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন, একটা বৃক্ষকে সতেজ সুস্থ ও ফলবান করতে গেলে যেমন নূতন সারের প্রয়োজন হয়, মানবসমাজের ক্ষেত্রেও তেমনই উন্নত সন্তান লাভ করতে গেলে পোষণীয় পরিস্রুত নূতন রক্ত ক্রমিকভাবে সঞ্চারিত করতে হয়। তাঁর প্রণিধানলব্ধ অভিমত যে উচ্চবর্ণের নারী যখন নিম্নবর্ণের পুরুষে উপগত হয়, তখন সন্তান অবশ্যই হীন হয়, কিন্তু নারী যখন শ্রদ্ধাভক্তিতে মুগ্ধ ও বুদ্ধ হয়ে উচ্চবর্ণোদ্ভূত গুণবান পুরুষকে বরণ করে, তখন তার যে সন্তান হয় সে স্বাস্থ্যে, বীর্যে, বিদ্যায় উল্লম্ফী হয়েই চলে। বংশপরম্পরায় সমাজকে দৃঢ় বর্ধিষ্ণু ও সক্রিয় রাখতে হলে অনুলোম অসবর্ণ বিবাহ অবশ্য প্রবর্তনীয়।
....জন নিয়েই জাতি-তাই জাতির উন্নতি করতে গেলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বাস্থ্যে, শক্তিতে, চারিত্র্যে উন্নত করে তুলতে হবে-পরিপূরক নেতা বা প্রেরিত পুরুষের পতাকাতলে তাদের সমবেত করে প্রত্যেককে বাস্তবভাবে আদর্শানুবর্তিতায় উদ্দাম করে তুলতে হবে। তারপর এই আন্দোলন ব্যক্তিগত বিকাশকে সমাজে চিরন্তন করে এমন এক মহান জাতি সৃষ্টি করতে চায়, যা ধর্ম, কৃষ্টি ও উন্নতিপ্রবণতাসহ অনন্ত ভবিষ্যৎকাল ধরে স্বীয় অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখবে।... সৎসঙ্গের এই সপারিপার্শ্বিক ব্যষ্টি-আন্দোলন আজ শুধু নীতিতেই নিবদ্ধ নয়, পরন্তু এর দৈবী নেতার অমানুষিক উৎসাহ ও প্রযত্নের ফলে আজ এই আন্দোলন বাস্তবতায় মূর্ত ও প্রতিফলিত। সামনে বাকি আছে শুধু ক্রমবর্ধমান বিস্তার, যার ফলে সঙ্ঘসেবকগণের চরম ও পরম মঙ্গল অবধারিত। সৎসঙ্গের সমষ্টি সম্বলিত ব্যষ্টি-আন্দোলনের প্রত্যেক উৎসাহী কর্মীর কাছে অস্তিত্ব অসাড়, আড়ষ্ট বা নীরস নয়, বরং তা উদ্দেশ্যমুখর, কর্মময়, প্রাণচঞ্চল। তার জীবন আজ আর নিষ্ফল, নিশ্চল, ক্লীবত্ব-দুষ্ট নয়-আজ তা বিস্তার, বিবর্তন ও উপভোগে প্লাবমান, বীর্যবান, আপনহারা, পাগলপারা-এই অমর অভিযান এমনতরই সৃজনমুখী এবং দুর্জয় শক্তিশালী! তাই এ আন্দোলন ভীরু বা স্থবিরদের জন্য নয়- সাহসী এবং অভ্যুদয়লিঙ্গু লোকেরাই এতে যোগদান করে জীবন সার্থক করে তুলবে।”
শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের মত সর্বার্থে ইষ্টসর্বস্ব মানুষেরও ইষ্টনির্দেশ পালনের সামান্য শিথিলতার ছিদ্রপথে প্রবেশ করে নিয়তির করাল বাহু, আকস্মিক বেদনার্ত আয়ুসমাপ্তি ঘটে এই মহৎ প্রাণের। “আলোচনা-প্রসঙ্গে” মহাগ্রন্থের সংকলক নমস্য প্রফুল্লকুমার দাস রচিত অসাধারণ স্মৃতি-কথা “স্মৃতি-তীর্থে” এবং “আলোচনা-প্রসঙ্গে” থেকে তাঁরই অননুকরণীয় বর্ণনায় সে অপরিসীম বেদনার ঘটনা বিবৃত হচ্ছে।
“১৯৪০ সালের বর্ষাকালে গোপালদা (আশ্রমের তৎকালীন সেক্রেটারি শ্রীযুক্ত শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়) ও আশ্রমকর্মী দুর্গাচরণদা (সরকার) বিশেষ প্রয়োজনে ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ীতে যান শ্রীযুত প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। যাওয়ার সময় শ্রীশ্রীঠাকুর তাদিগকে পই পই করে বলে দেন তেসরা আগষ্টের মধ্যে আশ্রমে ফিরতে, কিছুতেই যেন দেরী না করেন। দুজনেই সেই সংকল্প করে রওয়ানা দেন। গোপালদা রাজবাড়ী গেলে প্রমথদা তাঁকে নাছোড়বান্দা হ’য়ে ধ’রে পড়েন তাঁর এক প্রিয়জনের চাকরির জন্য একবার কলকাতায় গিয়ে তদ্বির করতে। গোপালদার মিষ্টিমধুর মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্বের দরুণ তাঁর অসাধারণ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল হোমরাচোমরা সাহেবসুবাদের মহলে। যাহোক গোপালদা বললেন, ‘ঠাকুর তিন তারিখের মধ্যে আশ্রমে ফিরতে বলেছেন। তার অন্যথা করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।’ গোপালদার অনমনীয় মনোভাব দেখে প্রমথদা দুর্গাচরণদাকে ধরলেন গোপালদাকে ব’লে ক’য়ে রাজী করাতে। কলকাতায় যাওয়ার খরচ বাবদ প্রয়োজনাতিরিক্ত টাকা তাঁর হাতে গছিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমি টাকা কিছু বেশিই দিলাম। আমার অনুরোধ, কলকাতা থেকে আশ্রমে ফেরবার পথে ফুলমার জন্য একখানা পছন্দসই শাড়ি নিয়ে যাবেন।’ প্রমথদা চতুর মানুষ। তিনি জানতেন কাকে দিয়ে কেমনভাবে কাজ বাগাতে হয়। ফুলমা দুর্গাচরণদার দ্বিতীয়া পত্নী, তাঁকে খুশি করবার ধান্দায় তিনি সর্বদা একপায়ে খাড়া। এই মোক্ষম ওষুধ পড়ায় দুর্গাচরণদা প্রচণ্ড যাজন শুরু করে দিলেন গোপালদাকে গুরুভাইদের সেবাসাহায্য করা তো ঠাকুরেরই নির্দেশ। আপনার অমুক সাহেবকে বলে দেওয়ায় একজন বেকার যুবকের যদি চাকরি হয় তাহলে মালিক দারুণ খুশি হবেন। আর আমরা তো কলকাতায় দেরী করব না। আপনি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যতক্ষণ, তার পরের গাড়িতেই তো আমরা সোজা পাবনা রওয়ানা দেব। গোপালদা বললেন-ঠাকুরের আদেশ লঙ্ঘন করা কি ভালো হবে?
দুর্গাচরণদা বললেন-গুরুভাইয়ের আপদে বিপদে বুক দিয়ে পড়ার কথা তো ঠাকুর নিত্য বলেন। সেটা আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন গোপালদা? আপনি তো মহাপণ্ডিত বোদ্ধা ব্যক্তি। আপনি ঠাকুরের আদর্শের স্পিরিটটা বুঝে চলবেন তো। এতে দেখবেন ঠাকুর আপনার ওপর বেশি খুশি হবেন।
অগত্যা গোপালদা দুর্গাদা একসঙ্গে কলকাতায় রাত্রির গাড়িতে রওয়ানা দিলেন। ঐদিন ভোররাত্রে মাজদিয়া স্টেশনে ট্রেন কলিশনে গোপালদা দুর্গাদা ও আরও অনেক যাত্রী মারা যান। এতে শ্রীশ্রীঠাকুর একবোরে ভেঙে পড়েন। আহার নিদ্রা ত্যাগ করে শ্রীশ্রীঠাকুর অবিরাম দিবারাত্র উচ্চৈঃস্বরে রোদন ও বিলাপ করতে থাকেন।...” (স্মৃতি-তীর্থে, ১ম সং, ২৩-২৫ পৃঃ)
“... তাঁর অবিশ্রান্ত আর্ত ক্রন্দন, করুণ বিলাপ ও বুকফাটা আর্তনাদে আশ্রমের আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। শ্রাবণের দুর্যোগের সঙ্গে এক গভীর বিষাদের কালো ছায়া চতুর্দিক আচ্ছন্ন করে ফেলে। দিনরাত কাঁদতে-কাঁদতে শ্রীশ্রীঠাকুরের চোখমুখ ফুলে ওঠে, গলা ভেঙে যায়। তবু কান্নার বিরাম নেই। যিনি সবার সান্ত্বনা, তিনি আজ শোকে অধীর, তাঁকে সান্ত্বনা দেবে কে? তাঁর এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে গোপালদার মা ও মাসিমারা এসে বললেন-গোপালী! আমরা যে তোমার এ অবস্থা আর চোখে দেখতে পারি না। আমাদের মুখ চেয়ে তুমি শান্ত হও। কী আর করবে? ভাগ্যে যা ছিল তা হয়েছে। এখন তুমি ভাল না থাকলে, কার মুখ চেয়ে আমরা দাঁড়াব?
তাঁদের নিরন্তর প্রবোধনায় শ্রীশ্রীঠাকুর ধীরে-ধীরে শান্ত হলেন।...” (আলোচনা - প্রসঙ্গে, ১৩/৮/১৯৪০)
“... গোপালদা দুর্গাদা মারা যাওয়ার পর আশ্রমে গুঞ্জন উঠল, গোপালদার মত ভক্তরাজের এভাবে জীবনাবসান ঘটল কেন? ঠাকুর কেন এটা ঠেকাতে পারলেন না?
ঠাকুর তখন বলতেন, ‘গোপাল, দুর্গাচরণ গেল, সেইটেই মানুষ দেখছে, কতজন যে যমের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে, তা তো আর কেউ দেখছে না। সে-খবর জানেন একমাত্র পরমপিতা। আমাকে হ্যানডেল না দিলে আমি কিছুই করতে পারি না। হ্যানডেল হাতে পেলে সবার কুষ্টি ওলটপালট ক’রে দিতে পারি। নির্বিচারে আমার কথা মেনে চলে যে সে লাখ মূর্খ হ’লেও মহাজ্ঞানী। আর নিজ খেয়ালে চলে যে, সে মহাজ্ঞানী হ’লেও বাস্তবে পাগল ও বেকুব।
গোপালের সব ঠিক ছিল। কিন্তু দুর্গাচরণের ওপর ওর একটা দুর্বলতা ছিল। তাই ওর কাল হ’য়ে দাঁড়াল, রন্ধ্রগত শনির মতো কাজ করল।’...” (স্মৃতি-তীর্থে, ১ম সং, পৃঃ ২৫)
শ্যামাচরণের প্রতি ঠাকুরের অন্তঃকরণে ছিল সুগভীর প্রত্যয় ও প্রীতির উৎসারণ। আদর্শ নিয়ন্ত্রিত মানুষের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’-তে শ্যামাচরণের সম্বন্ধে বলেন- “... গোপালের তো কথাই নেই। আমার হাতের লাঠির মত ছিল, আমার ইঙ্গিত বুঝে চলতে চেষ্টা করত। যেমন ছিল বিদ্যে, তেমনি ছিল বুদ্ধি। তক্ষকের মত তুখোড় ছিল। আমার চোখের একটা ইশারা দেখেই বুঝত, কী আমি বলতে চাই।...” (আলোচনা-প্রসঙ্গে, ১৩/৮/১৯৪০)
তাঁর মত সুযোগ্য ভক্তকে অকালে হারানোর বেদনা ও আক্ষেপ ঠাকুরের অন্তরে গভীরভাবে রয়ে গিয়েছিল। শ্যামাচরণের মৃত্যুর দীর্ঘ ষোল বছর পরেও ‘আলোচনা- প্রসঙ্গে’ উল্লিখিত ঠাকুরের এই উক্তিতে তারই প্রকাশ ঘটেছে- ‘বাঘ যেমন শিকারের জন্য ঘোরে, ও (শ্যামাচরণ) তেমন নতুন মানুষের জন্য ঘুরতো। খুব চতুর ছিল, মানুষ পেলেই কাত করে ফেলত। ব্যাপারটা ছিল তার কাছে খেলার মত। ও কখনও আমার কথা না-শোনা হ’ত না। দুর্গাচরণের বুদ্ধিতে কলকাতায় গেল, তা যাওয়া উচিত ছিল না।... (আলোচনা-প্রসঙ্গে, ৮/২/১৯৫৬)
এরও ছ’বছর পরে তাঁর আর একটি মন্তব্য- “... গোপাল যদি বেঁচে থাকত, তাহলে এতদিনে এ্যাটম বোমা না হোক, অন্তত এ্যাটমিক এনার্জিটা বের করে ফেলত ঠিকই। তারপর আর ওরকম মানুষ পেলাম না। কী কী করত! বেলা বারোটা/একটার সময় ছাতা মাথায় দিয়ে মাঠে রোদের মধ্যে বসে থাকত। কী সব দেখত! ওখানে বসে আবার অঙ্কও কষত।...” (দীপরক্ষী, ২০/৬/১৯৬২) এছাড়াও কথাপ্রসঙ্গে আরও বহুবার বহু স্থানে ঠাকুর তাঁর এই অকালে বৃন্তচ্যুত ভক্তটির যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠা সম্বন্ধে সোচ্ছ্বাসে মন্তব্য করেছেন।
ইষ্টাদেশ পালনে তিলমাত্র বিচ্যুতির ফলে অকালে অসময়ে থেমে গেল বিপুল সম্ভাবনাময় জীবনের দুর্বার যাত্রা। কিন্তু যে নিবিড় ইষ্টানুরাগ, দীপ্ত কর্মপ্রেরণা এবং উজ্জ্বল মনীষা তাঁর মধ্যে উৎসারিত হয়ে উঠেছিল, তার বিনাশ নেই-কাল অতিক্রম করে তা’ প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত এবং প্রবাহিত হয়ে চলবে শাশ্বত ছন্দে।
___________________________
#শ্যামাচরণ_মুখোপাধ্যায়
10