ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্ত্তী :-
🔷 মৃত্যুমুখী ত্রৈলোক্যনাথ ঠাকুরের নাম পেয়ে পুনর জীবন লাভ করেন ...
🔷শ্রীশ্রীঠাকুর ত্রৈলোক্যনাথ কে নাম দিয়েছিলেন - "গুপ্ত তাপস", তাঁরই বার্তাবহ ...
🔷 ঠাকুরের কথায় ভবিষ্যৎ ইতিহাস একে ভিত্তি করেই হবে ‘যাজন পথে’ বইটি দেখে বললেন...
🔷 একজন অপদস্থ করার চেষ্টা করেন গীতার একটি শ্লোক এর ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে...
মানবকল্যাণার্থে মর্ত্যে অবতরণকারী অবতার পুরুষ তাঁর কল্যাণযজ্ঞের ঋত্বিককুল সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাঁর অভীষ্ট-পূরণের জন্য প্রয়োজন হয় পরার্থব্রতী উচ্চ আধারের কিছু ব্যক্তিসত্তা, যাঁরা তাঁকে কেন্দ্র করে নিত্য চলৎশীল হয়ে থাকেন, মনের উচ্চ বৃত্তিসমূহ নিয়োজিত করেন তাঁরই স্বার্থে, যিনি তাঁদের প্রিয়পরম পুরুষোত্তম। পুরুষোত্তমও তাঁদের ছলে-বলে কৌশলে ইষ্ট-অজ্ঞাবাহী করে জীবমঙ্গলব্রতে নিযুক্ত করেন অফুরান প্রেরণার উৎসরূপে। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবনকল্যাণ- মহাব্রতের এমনই একজন ঋত্বিক তাঁর প্রথম যুগের অন্যতম পার্ষদ, গুপ্ত তাপস, তাঁরই বার্তাবহ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।
ফটিকচন্দ্র চক্রবর্তী ও বগলাসুন্দরী দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান ত্রৈলোক্যনাথ ১২৯২ বঙ্গাব্দের ১লা অগ্রহায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। আদি নিবাস অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত পাইকারা গ্রামে। শিক্ষা-জীবনের শেষে ত্রৈলোক্যনাথ গ্রামে 'হোমিও রিসার্চ লেবরেটরি' নামে একটি দেশীয় ওষুধের কারখানা করেন। এই ওষুধের প্রচারের জন্য তাঁকে বিভিন্ন জেলায় ডাক্তার মহলে যেতে হত। সমাজের বিভিন্ন স্তরে তিনি যাতায়াত করতেন। এই সময় তিনি লক্ষ করেন, স্কুলের শিক্ষক বা ছাত্রদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর একান্ত অভাব, তাদের মানসিকতা নিতান্তই পরনির্ভরশীল; কোনরকমে চাকুরি পাওয়াই যেন পরমার্থ তাদের কাছে।
স্বাধীনচেতা ত্রৈলোক্যনাথ এরকম মানসিকতায় অত্যন্ত পীড়িত বোধ করেন। তিনি বিদেশী রঞ্জক দ্রব্যের সাহায্য না নিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে সুতিবস্ত্র রং করার প্রণালী উদ্ভাবন করেন। এছাড়াও কুটির শিল্পের মাধ্যমে নব নব উদ্ভাবনী বিষয়ে ভাবনাচিন্তা আরম্ভ করেন। তাঁর স্বনির্ভরতার চেতনা ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারণের উদ্দেশ্যে এবং হাতেকলমে তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জেলার স্কুলে স্কুলে যেতে থাকেন। এই কর্মসূচীতে তিনি আত্মনিয়োগ করেন ১৩২৪ সালে। তাঁর কুটির শিল্পের ও বিজ্ঞান পর্বের প্রচারাভিযান সাবলীল গতিতে চলতে থাকে।
১৩২৭ সালের বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি এই প্রচার উপলক্ষে ত্রৈলোক্যনাথ প্রথমে পাবনা শহরে ও পরে কুষ্টিয়ায় আসেন। এই সময়েই তাঁর শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গে শুভ যোগাযোগ হয়। যোগাযোগের পূর্ব দিন অর্থাৎ ৩১শে বৈশাখ কুষ্টিয়া হাইস্কুলে "জ্ঞান ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ”-এই বিষয়ের উপর তিনি বক্তৃতা করেন। সেখানে ছাত্র ও শিক্ষক ছাড়াও শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। পরদিন সেখান থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় ডাঃ সতীশচন্দ্র জোয়ারদার এলেন। তিনি জানান, তিনি তাঁর গুরুর নির্দেশে এসেছেন ত্রৈলোক্যনাথকে তাঁর গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁর গুরুদেব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন ডাঃ জোয়ারদার।
ঐদিন বিকেলে সতীশচন্দ্র ভক্ত অশ্বিনী বিশ্বাসের বাড়িতে ত্রৈলোক্যনাথকে নিয়ে যান। সতীশচন্দ্রের গুরুদেব অর্থাৎ ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তখন ঐ বাড়িতেই ছিলেন। বাইরের ঘরে বসে আছেন ঠাকুর, প্রবেশ করলেন ত্রৈলোক্যনাথ। প্রথম দর্শনেই মনে হল-এমনটি আর দ্বিতীয় কোথাও দেখেননি। ঠাকুর তাঁর সুমিষ্ট সম্ভাষণে বলেন-বসুন ত্রৈলোক্যদা। তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করে সতীশচন্দ্রের পাশে গিয়ে বসেন। নয়ন ভরে দেখতে থাকেন তাঁকে, তৃপ্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে দেহ ও মন, যেন কিছুটা আত্মহারা ভাব পেয়ে বসে তাঁকে।
কিছুক্ষণ পরে আত্মস্থ হয়ে ঠাকুরকে বলতে থাকেন ত্রৈলোক্যনাথ-সংসারের ভিতরে থেকেই ভগবানকে চাই। পিতামাতা-স্ত্রীপুত্র ত্যাগ করে পাহাড়ে জঙ্গলে গিয়ে শীততাপে কষ্ট পাওয়া বা নিষ্কর্মা ভবঘুরে সেজে দেশে দেশে নিরর্থক ভ্রমণ করার ইচ্ছা আমার নেই। পূরক-কুম্ভকাদি কসরৎ করে শেষকালে হাঁপানি-যক্ষায় ধরুক, এমনও আমি চাই না। আর ভগবান যদি ভাবহীন বোধাতীত বা সাড়াহীন নিনড় কিছু হন, তবে তাঁকে পেয়েই বা আমার লাভ কি? আমি চাই কর্মময় মানুষ ভগবান, যিনি প্রতি কর্মে আমার হাত ধরে চালিয়ে নেবেন- যেমন হনুমানের রাঘবেন্দ্র, অর্জুনের শ্রীকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দের শ্রীরামকৃষ্ণ। আর এমন ভগবান তো সংসারে থেকেই পাওয়া যায়।
ঠাকুর হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দিলেন-আমারও সংসারী সন্ন্যাসী চাই, ত্রৈলোক্যদা! জঙ্গলের সন্ন্যাসী চাই না-নিতাই চাই। সন্ন্যাস মানে বনে যাওয়া নয়কো, সন্ন্যাস হয় মনে, ইষ্টযুক্ত কর্মই সন্ন্যাস। ভগবান পেতে হলে পাহাড়ে জঙ্গলে যেতে হবে কেন, কসরতরেই বা প্রয়োজন কী? তিনি আছেন আপনার কাছেই- screen খানা একবার সরে গেলেই হয়। ঠাকুরের এই কথায় ত্রৈলোক্যনাথ কিছুটা ভরসা পেলেন।
এই সময় একজন ভক্ত বছরের নতুন ফল, কিছু লিচু এনে ঠাকুরকে নিবেদন করেন। ঠাকুর তার অর্ধেক ত্রৈলোক্যনাথকে দিয়ে নিজে কয়েকটা লিচু খান। তারপর হাতমুখ ধোওয়ার জন্য কুয়োর পাড়ে গিয়ে তিনি নিজেই ত্রৈলোক্যনাথের হাতে জল ঢালতে গেলে ত্রৈলোক্যনাথ সসংকোচে নিজেই জল নিয়ে নেবেন বলেন; উত্তরে ঠাকুর অন্তরঙ্গ মধুর স্বরে বলেন, আপনি নিজে নেওয়াও যা, আমি দেওয়াও তাই। তাঁর এই কথার মধ্যে কী মমত্ববোধ, তা গভীরভাবে অনুভব করেন ত্রৈলোক্যনাথ। ঠাকুর জল ঢালতে ঢালতে অস্ফুট স্বরে বলেন-আপনি করিয়ে সেবা, অপরে করায়। শিক্ষা পেলেন নবাগত, নিজে সেবাপরায়ণ হলে তবেই অপরকে সেবা করার উপদেশ দেওয়ার অধিকার জন্মায়।
ক্ষণিকের দর্শনের জন্য এসেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ, কিন্তু অদ্ভুত এক ভাল লাগার আকর্ষণে তাঁর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা সাময়িকভাবে লুপ্ত হয়। পুনরায় তিনি ঠাকুরের কাছে এসে বসলেন। বহুদিন পর হারানো সন্তানকে ফিরে পেলে মা যেমন আকুল উন্মাদনায় তাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রাখেন, কিছুতেই ছাড়তে চান না, ঠাকুর ত্রৈলোক্যনাথকে সেইভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাখলেন। এই সময় সর্বাঙ্গ পুলকিত হয়ে ত্রৈলোক্যনাথ এক অপরিসীম আনন্দ প্রবাহে নিমগ্ন রইলেন। এই অবস্থায় ঠাকুর তাঁকে কয়েকবার ‘নাম’ শোনালেন। প্রায় দশ বারো মিনিট এভাবে কাটল। ত্রৈলোক্যনাথ কিছুটা প্রকৃতিস্থ হলে শ্রীশ্রীঠাকুর শব্দতত্ত্বের অবতারণা করে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন যে সাধনার মাধ্যমে মস্তিষ্ক কোষগুলিকে সাড়াপ্রবণ করে তুলতে পারলে এই শব্দতত্ত্ব অনুভূতির আয়ত্তে আনা সম্ভব।
ঠাকুরের কাছ থেকে পাওয়া এই নাম ত্রৈলোক্যনাথ পূর্বেই স্বপ্নাবস্থায় পেয়ে নামের মহিমায় মৃতকল্প অবস্থা থেকে পুনর্জীবন লাভ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর war-fever-এর সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তিনি। তখনকার সময়ে এই রোগের প্রতিষেধক না থাকায় বহু লোকই মারা যেত এই অসুখে। ১৩২৫ সনের আশ্বিন মাসে এই নিদারুণ ব্যাধির শেষ প্রান্তে ত্রৈলোক্যনাথ, প্রাণের কোন আশা নেই। অন্তিম লগ্নে নিরূপায় হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। ঐ অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন এক উজ্জ্বলকান্তি দিব্যপুরুষ সহসা আবির্ভূত হয়ে তাঁর মাথায় হাত রাখলেন এবং একটি মন্ত্র বলে অন্তর্হিত হলেন। ঐ তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অন্তর্জপ চলতে থাকে ঐ মন্ত্রের এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রোগের লক্ষণগুলি কমতে থাকে। নিদ্রাভঙ্গের পর সুস্থ বোধ করলেও নামের স্মৃতি অবচেতন স্তরে চলে যায়। ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে পুনরায় সেই স্মৃতি জাগ্রত হয়। ত্রৈলোক্যনাথ ঠাকুরের কাছে এই ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ দেন।
নতুন পথে যাত্রা শুরু হল ত্রৈলোক্যনাথের-আনুষ্ঠানিক দীক্ষার আর প্রয়োজন হয়নি। সতীশচন্দ্র জোয়াদার আনুষ্ঠানিক দীক্ষার কথা উত্থাপন করলে ঠাকুর স্বয়ং বলেন দীক্ষা হয়ে গেছে, এখন অশ্বিনীদার সঙ্গে আলাপ করলেই হয়। সৎনাম যে সর্বোচ্চ এবং সমস্ত বীজনামের আদি, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।
ইতিমধ্যে তিনি বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছেন। আনুপূর্বিক দীক্ষার সব ঘটনা জানিয়েছেন পরিবারস্থ সকলকে; সবাই মেনে নিয়েছেন সানন্দে। তাঁর ব্যবহার কথাবার্তার মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে তা পাড়া প্রতিবেশী সকলের নজরে এসেছে; এক প্রদীপ থেকে সহস্র দীপ জ্বলে ওঠার মত ত্রৈলোক্যনাথকে দেখে তাঁর পরিজন- প্রতিবেশী বন্ধুস্বজন ঠাকুরের বিষয়ে অবগত হয়ে ছুটে গেছেন তাঁর কাছে অমৃতসিন্ধু হতে অমৃত আহরণের জন্য।
তখন আশ্রম বলতে পদ্মাতীরে দুখানি টিনের চালের ঘর এবং সেখান থেকে আনুমানিক একশ গজ দূরে ঠাকুর পরিবারের টিনের চালের বসতবাড়ি। চারদিক বাবলাগাছের জঙ্গল ও আগাছায় পূর্ণ ছিল। শিয়াল, সজারু, বরাহ, বাঘডাঁশা প্রভৃতি জন্তু সেখানে দিনের বেলাতেই স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াত। রাত্রে মাঝে মধ্যে বাঘের ডাকও শোনা যেত। ‘আনন্দবাজার’ নামে সাধারণ ভোজনালয়ের ব্যবস্থা তখন হয়নি, আশ্রমবাসী ও অভ্যাগত সকলেই ঠাকুরবাড়িতেই আহার করতেন। তখন আশ্রমবাসী ছিলেন ছ’জন। অপর ভক্তরা আশেপাশের গ্রাম থেকে সুবিধামত ঠাকুরের সঙ্গ করতে আসতেন। ঠাকুরের অন্তরঙ্গ সাহচর্যে প্রত্যেকেই আপ্লুত হয়ে থাকতেন। কখনও তিনি কারও কোলে বসতেন, কারো বা হাঁটুতে অর্ধশায়িত হতেন, আবার কখনও সাদরে কারও গলা জড়িয়ে ধরে কথা বলতেন। ভক্তদের স্বহস্তে তেল মাখিয়ে দিয়ে পদ্মায় স্নানের সময় গাত্রমর্দন ও স্নানান্তে স্বহস্তে জুতো পরিয়ে দিতেন। সেকালের এই বালসুলভ লীলারস উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছিল ত্রৈলোক্যনাথের। ঠাকুরকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে চান না কেউ। সর্বদাই তাঁর সঙ্গসুধা উপভোগের তীব্র নেশা।
নামের নেশা পেয়ে বসেছে ত্রৈলোক্যনাথকে। চলতে ফিরতে স্নানে আহারে নিদ্রায় জাগরণে ‘নাম’ হয়ে চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। শেষ রাত্রে ধ্যানে বসেছেন, অকস্মাৎ শিহরণ সর্বাঙ্গে, কম্পন সমস্ত শিরা উপশিরায় ও স্নায়ুমণ্ডলে তীব্র আলোড়ন-যার বর্ণনা ভাষার অগম্য। মস্তিষ্ক কোষগুলি আগের চেয়ে অনেক সতেজ ও সূক্ষ্ম সাড়াপ্রবণ হয়েছে, তা তিনি নিজেই বোধ করতে থাকেন। পূর্বে যা বোধগম্য ছিল না, এখন তা সহজবোধ্য হতে থাকে। গাছপালা-আকাশ-মাটি যেদিকে দৃষ্টি পড়ে তাতেই যেন এক নতুন প্রতীতি। এক অফুরন্ত ভালবাসায় মন সিক্ত হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। নাম এবং নামীই তাঁর একমাত্র উপভোগ্য বিষয়।
ভক্তরা অনেকেই চান ত্রৈলোক্যনাথ যাজনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুন। বিশিষ্ট ভক্ত সুশীলচন্দ্র বসুও বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন এ ব্যাপারে। ত্রৈলোক্যনাথ বিনীতভাবে বলেন, সৎসঙ্গে তিনি নতুন আগন্তুক, কিছুটা জেনে বুঝে পাকা হলে হয়তো কিছু কাজ হতে পারে। শ্রীশ্রীঠাকুর ছিলেন কাছেই, উদ্দীপ্ত হয়ে বলেন- আগুন তো ধরানো হয়ে গেছে, এখন লেগে গেলেই হয়। হনুমানের মত লেজে মুখ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও লঙ্কা জয় করা চাই। একবার কাজে লেগে দেখুন তো ত্রৈলোক্যদা, পারেন কিনা সেটা পরে বোঝা যাবে।
দিনটা ছিল ইংরেজির ১৯২০ খৃষ্টাব্দের ২১শে জুন, সোমবার। নতমস্তকে ঠাকুরের এই আদেশ শিরোধার্য করেন ত্রৈলোক্যনাথ এবং নিয়ত কর্মীরূপে তাঁর ভাবধারার যাজন ও বিস্তারে আত্মনিয়োগে বদ্ধপরিকর হন।
বহুধা বিস্তৃত বর্তমান ঋত্বিকমণ্ডলীর প্রথম ঋত্বিক ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্ত্তী। ঠাকুর যে তাঁর প্রতি কত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন তা পরবর্তীকালে কথিত ঠাকুরের কথাতেই বোঝা যায়। ১৯৬৬ সালের নববর্ষ উৎসব, ঠাকুর বসে আছেন পার্লারে অসুস্থ শরীরে, ত্রৈলোক্যনাথ এসে প্রণাম করতেই তিনি উপস্থিত একজন সেবকের দিকে ফিরে বললেন, “হ্যাঁরে..., ইনি আমার প্রথম ঋত্বিক না? ওনার একটা ফটো এক্ষুনি তুলে রাখ; আমার শাণ্ডিল্য ইউনিভার্সিটি হলে, সেই ছবি তার front gate- এ টাঙানো থাকবে।” দেশ ভাগের পর ১৯৪৯ এ দেওঘরে ত্রৈলোক্যদাকে দেখে ঠাকুর বলেন, “কাছে-কোলে একটা জায়গা পেতাম, তা হলে ত্রৈলোক্যদাকে সেখানে নিয়ে আসতাম। কিন্তু ন স্থানং তিলধারণং। ত্রৈলোক্যদা কাছে না থাকলে জমে না। এক গ্লাসের ইয়ারের মত কিনা।”
ঠাকুরের কাছ থেকে নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর ঠাকুরের নির্দেশে আর কিছুদিন থেকে গেলেন হিমাইতপুর আশ্রমে। এই সময়ে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যা সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ইষ্টভ্রাতা শ্রীশচন্দ্র নন্দী ছিলেন রেলওয়ের ইঞ্জিনীয়ার। বিশ্বগুরু উৎসবের আগে থেকেই তিনি আশ্রমে ঠাকুরের আশ্রিত। দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। হাঁপানির টান বাড়ায় ত্রৈলোক্যনাথ ঠাকুরকে ওষুধ নির্বাচন করে দিতে অনুরোধ করেন। ঠাকুর মৃদু হেসে বলেন-আপনি নিজে এত ওষুধের আবিষ্কারক, আপনি ওষুধ দিলেই সেরে যাবে। শ্রীশচন্দ্র ব্যাকুলভাবে বলেন- ঠাকুর যখন আপনাকে ওষুধ দিতে আদেশ করেছেন তখন আপনি যা দেবেন তাতেই আমি রোগমুক্ত হব, এ বিশ্বাস আমার আছে। অগত্যা তাঁর কথার উপর নির্ভর করে একটি অজ্ঞাত আগাছার সরু একটি ডাল ভেঙ্গে চার টুকরো করেন ত্রৈলোক্যনাথ। একটি করে টুকরো পর পর তিন দিন বেটে খেতে বলেন এবং চতুর্থটি মাদুলিতে ধারণ করে নিত্য স্নানকালে ‘নাম’ সহ জলপানের বিধান দেন।
এরপর একাদিক্রমে তিন বছর ব্রহ্মদেশে যাজনে নিযুক্ত থাকার পর ফিরে এসে শ্রীশচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাতে জানতে পারেন, ঐ ওষুধেই তিনি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছেন। কিন্তু আরও আশ্চর্যের বিষয় যে ঐ সাক্ষাতের কয়েক মাস পর থেকেই ত্রৈলোক্যনাথ প্রবলভাবে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হন। ছ’মাস রোগভোগের পর ডাঃ শশিভূষণ মিত্র (ঠাকুরের মাস্টার মহাশয়)-র চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করেন।
কিন্তু ইষ্টনির্দেশ ব্যতীত কোন আকস্মিক এ ধরনের ওষুধ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত সমীচীন নয়। কারণ এতে ব্যক্তি-অহং-এর প্রাধান্য এবং প্রকৃতির ওপর খবরদারির নেশা পেয়ে বসার সম্ভাবনা থাকে। ফলে অর্থ, মান, যশের লোভে ইষ্ট বা মঙ্গলের পথ থেকে বিচলন ঘটতে পারে। একবার ত্রৈলোক্যনাথ যাজনকর্মে পাবনার সাজাদপুরে যান। সেখানে জমিদার কাছারির ম্যানেজার সতীশচন্দ্র মুখার্জি কাছারির কর্মচারি রাজনাথ দত্তের মাধ্যমে ত্রৈলোক্যনাথকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান একবার তাঁর বাড়ি আসার জন্য। রাজনাথের কাছে ত্রৈলোক্যনাথ জানতে পারেন, ম্যানেজারবাবুর এক কন্যা ফিটের অসুখে আক্রান্ত এবং তাঁর অপর এক কন্যা স্বপ্ন দেখেছে পাবনা থেকে বিশ্বগুরুর শিষ্য এসে ওষুধ দিলেই অসুখ সেরে যাবে। এখানে উল্লেখ্য, শ্রীশ্রীঠাকুরের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর শিষ্যরা ঠাকুরের জন্মোৎসব
বিশ্বগুরুর আবির্ভাব উৎসবরূপে কুষ্টিয়ায় মহাসমারোহে পালন করেন। ত্রৈলোক্যনাথের এই অসুখের কোন ওষুধ জানা নেই বলা সত্ত্বেও কর্মচারিটি একথা কিছুতেই বিশ্বাস না করায় অগত্যা তাদের মনস্তুষ্টির জন্য অচেনা একটি গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ রোগিণীর গলায় সেটিকে মাদুলি করে পরিয়ে দিতে বলেন এবং প্রতিদিন স্নানের পর মাদুলি ধুয়ে তিন গণ্ডুষ জল পান করতে নির্দেশ দেন। এই ঘটনার দু’বছর পরে রাজনাথ দত্ত পাবনা আশ্রমে এসে ত্রৈলোক্যনাথকে জানান যে ঐ মাদুলি ধারণ ও জলপানে মেয়েটির ফিটের অসুখ সম্পূর্ণ সেরে গেছে। ঠাকুরকে এ কথা জানানোয় তিনি বলেন, যেখানে-সেখানে ঐভাবে ওষুধ দেওয়া ঠিক নয়। ত্রৈলোক্যনাথ বুঝলেন, শ্রীশচন্দ্রকে হাঁপানির ওষুধ দিয়েছিলেন ইষ্টনির্দেশে, কিন্তু এখানে পরিস্থিতির চাপে তিনি যা করেছেন তা আদৌ উচিত হয়নি।
ত্রৈলোক্যনাথের যাজন-পরিক্রমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। কুমিল্লার হরিসভায় দ্বিতীয় বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে বক্তৃতার আয়োজন হয়েছে। সভাপতিত্ব করছেন চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন সহকারী অধ্যক্ষ কৈলাশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। বক্তৃতার পর বিশিষ্ট গায়ক ক্ষীরোদ সাধুর কীর্তনের ব্যবস্থা। ত্রৈলোক্যনাথের বক্তৃতা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কিছু শ্রোতা কীর্তন শোনার জন্য ব্যস্ত হয়ে সভাপতিকে সেই মর্মে অনুরোধ করেন। সভাপতি মহোদয়ও বিচলিত হয়ে বক্তৃতা সংক্ষেপ করতে বলেন। বাধ্য হয়ে বিষয় অসমাপ্ত রেখে ত্রৈলোক্যনাথকে বক্তৃতা শেষ করতে হয়। কিছু বিশিষ্ট শ্রোতা এভাবে মাঝপথে বক্তৃতা বন্ধের প্রতিবাদ করেন। এদিকে ক্ষীরোদ সাধুকে কীর্তন পরিবেশনে অনুরোধ করায় তিনি ‘আমার গানের অন্তর্নিহিত ভাবরাজি এঁর বক্তৃতাতেই পরিস্ফুট হয়েছে’ বলে গাইতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন সভাপতি মহাশয় ঘোষণা করেন, আগামী দিনে অন্য কোন অনুষ্ঠানের পূর্বে ত্রৈলোক্যনাথকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বলার সুযোগ দেওয়া হবে। এরপরে সকলের অনুরোধে ক্ষীরোদ সাধু অল্প সময়ের জন্য কীর্তন করলেও তা বিশেষ হৃদয়গ্রাহী হয়নি। তিনি বলেন, পূর্ব-ঘটনায় চিত্তবিক্ষেপ হেতু এই অবস্থা হয়েছে। দ্বিতীয় দিনে যথাসময়ে পুনরায় ত্রৈলোক্যনাথের বক্তৃতা হয়েছিল-এবং বক্তৃতার পর অনেকেই তাঁর সঙ্গে একান্তভাবে আলোচনার জন্য আসেন।
যাজন পরিক্রমায় একবার ত্রৈলোক্যনাথ মুক্তাগাছায় আসেন, উদ্দেশ্য সেখানকার হাইস্কুলে বক্তৃতা দেওয়া। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের সঙ্গে দেখা করে তিনি আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন। সুরেনবাবু কিন্তু সংশয় প্রকাশ করে বলেন- চেহারা দেখে তো মনে হয় না আপনি বক্তৃতা দিতে পারবেন। এই মন্তব্যে বিচলিত না হয়ে নম্রভাবে ত্রৈলোক্যনাথ বলেন, কাজ না দেখেই এমন করে বলেন কেন দাদা, আগে আমায় বলার একটু সুযোগ দিন, পরে যা বলার বলবেন। প্রধান শিক্ষক উত্তরে বলেন-আমি আপনার যোগ্যতা বিচার করার কে? তবে স্কুলে উচ্চশিক্ষিত কয়েকজন শিক্ষক আছেন এবং আমন্ত্রণ করলে জমিদার বাড়িরও কেউ কেউ হয়তো আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে অপ্রস্তুত যাতে না হতে হয়, সেই চিন্তা করেই আমি ও-কথা বলেছি। ত্রৈলোক্যনাথও ছাড়বার পাত্র নন, বললেন-এসে যখন পড়েছি তখন আমায় বিমুখ করবেন না দাদা, বলতে যদি না-ই পারি তবে খানিকটা হাস্যরসের অবতারণাও তো হবে।
অগত্যা তিনি রাজি হলেন এবং বক্তৃতার সময় নির্ধারণ করে ক্লাসে ক্লাসে নোটিস পাঠিয়ে দিলেন। বক্তৃতা এতই মনোগ্রাহী হয়েছিল যে বক্তৃতার পর প্রধান-শিক্ষক মহাশয় ত্রৈলোকনাথকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং ঠাকুর বিষয়ক আলাপ আলোচনায় তৃপ্ত হয়ে সৎনাম গ্রহণ করেন।
একবার যাজন-উপলক্ষ্যে ফরিদপুরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন ত্রৈলোক্যনাথ, এমন সময় নিবারণ বাগচিকে দিয়ে ঠাকুর ডেকে পাঠালেন তাঁকে এবং ফরিদপুর যেতে নিষেধ করলেন। এদিকে আশ্রম থেকে ঈশ্বরদি স্টেশনে যাওয়ার বাসে টিকিট বুক করা ছিল, কিন্তু ঠাকুরের নির্দেশে যাওয়া স্থগিত হল। সন্ধ্যার আগে নিবারণ বাগচিকে দিয়ে আবার ত্রৈলোক্যনাথকে ডেকে পাঠিয়ে ঠাকুর অবিলম্বে ফরিদপুর যেতে বলেন। তদনুযায়ী ঈশ্বরদি স্টেশনে পৌঁছে জানতে পারেন, সকালের ট্রেনটি ভেড়ামারা স্টেশনে একটি মালগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগায় বহু লোক আহত হয়েছে। ত্রৈলোক্যনাথ বুঝলেন, কেন ঠাকুর সকালের যাত্রা বন্ধ করেছিলেন। দৃষ্টি যাঁর অনন্ত তিনিই তো ভজমান, মানুষের ভগবান। তাইতো যুগে যুগে ভক্ত তথাকথিত পার্থিব ত্যাগ স্বীকার করে তাঁর চরণতলে আশ্রয় পেতে চায়। তিনিও স্থান দেন ব্যাকুল হৃদয়কে। তাঁর আহ্বান ভক্তের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে বোধক্ষম ও বহনযোগ্য করে তোলে।
রাজশাহী জেলার দীঘাপাতিয়ার রাজবাড়ি দয়ারামপুরে যাজন কাজে গিয়ে একবার অপ্রিয় পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ত্রৈলোক্যনাথকে। সেখানে অবস্থানের সময় তিনি সেখানকার স্কুল বোর্ডিং-এ ছিলেন। দয়ারামপুর হাইস্কুলে বক্তৃতা দেওয়ার পর দুজন শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র দীক্ষা গ্রহণ করে। তখন ছাপানো দীক্ষাপত্রের প্রবর্তন হয়নি, সাদা কাগজে দীক্ষিতদের স্বাক্ষরসহ বিস্তারিত বিবরণ নেওয়া হত। এভাবে স্বাক্ষর নিতে দেখে বিরুদ্ধবাদী কয়েকটি ছাত্র ও শিক্ষক একত্রিত হয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করেন যে, ত্রৈলোক্যনাথ ইংরেজ সরকারের গুপ্তচর, সুতরাং অবিলম্বে তাঁকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হোক। প্রধান শিক্ষকও সত্যাসত্যের অনুসন্ধান না করে ঐ রাত্রেই তাঁকে স্কুল বোর্ডিং পরিত্যাগে বাধ্য করেন। সে যুগ ছিল স্বদেশী যুগ। অপরিচিত নবাগতদের পুলিশ ভাবত বিপ্লবী, আর সাধারণ মানুষ মনে করত সি. আই. ডি.-র লোক।
ময়মনসিংহ জামালপুর দয়াময়ী কালীবাড়িতে ত্রৈলোক্যনাথ বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, সৎনাম গ্রহণ করলে মাছ-মাংস বা মাদক গ্রহণ করা উচিত নয়। এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, মাদক দ্রব্য যে নিষিদ্ধ এ কথা আপনি বলছেন, কিন্তু মদ-গাঁজা-আফিং-এর দোকানে আপনাকে অহরহ দেখতে পাই, অতএব মাদকদ্রব্যের কোন্টি যে আপনার বাদ আছে তা তো বুঝি না। ঐ ব্যক্তিটির বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ঐ সব দোকানের মালিকরা একযোগে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমরা এঁর মাধ্যমে দীক্ষা গ্রহণ করেছি। আমাদের সময়ের নিতান্ত অভাব, সেজন্য আমাদের অনুরোধে ইনি গদিতে এসে সৎ আলোচনায় আমাদের তৃপ্ত করেন। নেশা-ভাঙ তো দূরের কথা, চা সিগারেট পর্যন্ত ইনি সেবন করেন না। সমবেত প্রতিবাদে অগত্যা সে- যাত্রায় ত্রৈলোক্যনাথ মিথ্যা অপবাদের হাত থেকে রেহাই পেলেন।
যাজন-পরিক্রমায় ত্রৈলোক্যনাথ তখন সিরাজগঞ্জে। যজন-যাজন ইষ্টভ্রাতাদের নিয়ে ভালই কাটছিল দিনগুলি। একদিন ইষ্টভ্রাতা জয়কুমারদার বাড়ি থেকে খবর এল, তার ভ্রাতুষ্পুত্রের অবস্থা খুব খারাপ। খবর পেয়ে ত্রৈলোক্যনাথ সেই বাড়ি গিয়ে দেখেন, বালকটির মুমূর্ষু অবস্থা, ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে, কণ্ঠনালী শ্লেষ্মায় অবরুদ্ধ, চোখ কপালে উঠেছে। ত্রৈলোক্যনাথ উপস্থিত হলে ছেলেটির পিতা ও জয়কুমারদার স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে আবেগাপ্লুত হয়ে বলতে থাকেন যে ত্রৈলোক্যদার কৃপায় ছেলেটি রক্ষা পেতে পারে। তিনি ছেলেটিকে স্পর্শ করে ‘নাম’ করলে সে ঠাকুরের দয়ায় বেঁচে উঠবে-গৃহকর্তাও এই বিশ্বাস ব্যক্ত করেন। অবশেষে সবার অনুরোধে ত্রৈলোক্যনাথ ছেলেটির মস্তক স্পর্শ করে ‘নাম’ শুরু করেন। এভাবে নাম করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটির নাক-মুখ দিয়ে অনর্গল শ্লেষ্মা নির্গত হতে থাকে; দু তিন মিনিট শ্লেষ্মা নির্গমনের পর তার শ্বাসকষ্ট কমে যায়, চোখও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। ছেলেটি ধীরে ধীরে বিপদমুক্ত হয়। নামের কম্পনেই যে আরোগ্য লাভ হয়, এ বিষয়ে উপস্থিত সবাই নিশ্চিত হন।
১৩৩১ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে আনন্দময়ী মায়ের সঙ্গে এই ভক্ত তাপসের প্রথম সাক্ষাত হয়। আনন্দময়ী মা পূর্বেই শ্রীশ্রীঠাকুর ও আশ্রমের সম্বন্ধে বিশেষ অবগত ছিলেন। একবার হিমাইতপুর আশ্রমে মা একাদিক্রমে তিন দিন ছিলেন, সেসময় ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়। কিশোরীমোহন দাসের নৃত্যসহ কীর্তন দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। ঠাকুর, মাতা মনোমোহিনী দেবী ও আশ্রম সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। আনন্দময়ী মা ত্রৈলোক্যনাথের পরিচয় পেয়ে তাঁকে নিয়ে নাটমন্দিরে আসেন। তখন নাটমন্দিরে মায়ের কীর্তন হচ্ছিল, মা তাঁকে কিশোরীদার মত নৃত্যসহ কীর্তন করতে অনুরোধ করেন। ত্রৈলোক্যনাথ কিছুক্ষণ নিবিষ্ট চিত্তে ধ্যানমগ্ন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে “পতিতপাবন নাম রাধা রাধা বল” -এই তান ধরে কীর্তন শুরু করেন। যাঁরা এতক্ষণ মায়ের কীর্তন করছিলেন তাঁরাও ‘রাধা বল’ বলে দোহার দিতে থাকেন। ক্রমশ কীর্তন তুঙ্গে উঠলে তিনি নাচতে আরম্ভ করেন; এক ঘন্টা এভাবে নৃত্যসহ কীর্তনের পর ক্লান্ত হয়ে তিনি আসরে শুয়ে পড়েন। আনন্দময়ী মা তখন দ্রুত সেখানে এসে ভক্তের মাথাটি নিজের কোলে তুলে নিয়ে নিজ হাতে পাখার বাতাস করতে থাকেন। ত্রৈলোক্যনাথ পিপাসার্ত বুঝতে পেরে মা ভিতরে গিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে এক গ্লাস ঘোলের সরবৎ ও সন্দেশ এনে স্বহস্তে তাঁকে খাইয়ে দেন।
যাজন পরিক্রমায় বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয় বিভিন্ন সময়ে-কখনও কখনও মিথ্যা সন্দেহ, অপযশের তিক্ত পরিস্থিতি, আবার কখনও বা আনন্দময়ী মায়ের মত স্নেহমধুর আপ্যায়নের স্মৃতিসুধায় অবগাহন। কিন্তু কোন বিরুদ্ধতা বা বিরূপতার ক্লেশ এই সন্ন্যাসীপ্রতিম সাধককে স্পর্শ করতে পারত না-কারণ ঠাকুরকে খুশি করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত, ক্লেশসুখপ্রিয়তা তাই ছিল তাঁর মজ্জাগত। নিজের কষ্ট অসম্মান ইত্যাদি তাঁর কাছে ছিল একান্ত তাৎপর্যহীন।
যাজন-কার্যের পথিকৃৎ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্ত্তী ব্রহ্মদেশ থেকে শুরু করে আসাম, ত্রিপুরা, বাংলার প্রত্যন্ত প্রদেশ পর্যন্ত যে ব্যাপক যাজন-যজ্ঞ সমাধা করেন, তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে তা অকল্পনীয়। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায়, প্রতিকূল পরিবেশে রীতিমত যুক্তির ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গুরুর বিজয়-পতাকা বহন করে এগিয়ে চলা একমাত্র গুরুর কৃপাতেই সম্ভব, প্রগাঢ় ইষ্টনিষ্ঠাতে যে কৃপার উৎসমুখ উৎসারিত হয়। চরম বিপরীত বা বিরুদ্ধ পরিবেশে কখনও দুষ্কৃতীর সুপরিকল্পিত আক্রমণ, কখনও তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের নীচ ঈর্ষাপ্রসূত বিরুদ্ধতা, আবার কখনও রক্ষণশীল গোঁড়া সমাজের রক্তচক্ষুর আস্ফালনকে উপেক্ষা করে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিজয় রথ এগিয়ে নিয়ে চলেন ত্রৈলোক্যনাথ সাফল্যলক্ষ্মীর কৃপামাল্য গলে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি অকাট্য টানের প্রভাবে নামময়তা ত্রৈলোক্যনাথকে সাধনস্তরের কত উচ্চ পর্যায়ে উপনীত করেছিল, একটি ঘটনার উল্লেখে তার কিছু আভাস পাওয়া যেতে পারে। একবার ত্রৈলোক্যনাথ ইষ্টভ্রাতা সতীশচন্দ্র জোয়ারদারের সঙ্গে কুমারখালিতে গেছেন আম কেনার জন্য। আম কেনার পর্ব শেষ করে উভয়ে সন্ধ্যার আগে কুমারখালি স্টেশনে পৌঁছলেন। সেখানে বিনতি-প্রার্থনা ও নামধ্যানের পর কিছুটা বিরতি দিয়ে স্বল্প কিছু আহার করেন। ট্রেন আসতে অনেক দেরি-শেষ রাত্রে, রাত তিনটেয়। অনেকখানি সময় হাতে-ঘুমিয়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। উভয়ে পাশাপাশি শুয়ে আছেন; কিন্তু ঘুম আসছে না-অবিরাম নাম চলছে ত্রৈলোক্যনাথের অন্তরে আর শুনতে পাচ্ছেন কাঁসর-ঘন্টা-শঙ্খের মিশ্রিত নানা ধ্বনি। ভাবলেন- বাইরে কোথাও কোন মন্দিরের শব্দ নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। কিন্তু সঙ্গী সতীশচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে বুঝলেন এ ধ্বনিস্রোত তিনি একাই শুনতে পাচ্ছেন এবং এই ঝংকার বাইরের ধ্বনি প্রবাহ নয়, তাঁর মস্তিষ্কের ভিতরই হয়ে চলেছে। ঘুম আর হল না- তবু কোন ক্লান্তির বোধ নেই, মনের মধ্যে বয়ে চলেছে এক অফুরন্ত আনন্দের ধারা, উৎসাহ উদ্দীপনায় ভরে উঠেছে মন-প্রাণ। মনে পড়ে, ঠাকুর প্রথম দর্শনের দিনেই বলেছিলেন সাধনার পথে কিছুদূর অগ্রসর হলেই এই শব্দ সাধকের অন্তরে স্বতঃই ধ্বনিত হয়। মহাভাববাণী-গ্রন্থ ‘পুণ্য-পুঁথি’-তে আছে, “শব্দ প্রথমে একটু একটু শোনা যায়। ডানপাশে নয়, সোজাসুজি একটু ডানে। ঐ শব্দের মধ্যে বিশেষত্ব আছে, লক্ষ্য করা লাগে। একটু পরেই ঘন্টাধ্বনি পাওয়া যায়! ওঁম্ ছাড়িয়ে যেতে হবে। ওঁম্ তো কাছেই-ঐ পার হলেই ক্রমে ক্রমে রাধাস্বামী! আস্তে আস্তে!” (ভাববাণী, তৃতীয় দিবস।)
গভীর ইষ্টানুরাগ এনে দেয় অভ্রান্ত চলন এবং সাধনপথে দ্রুত অগ্রগমন। শব্দশ্রবণ বা জ্যোতিদর্শন, এ সবই সাধন জগতের এক-একটি স্তরের অবস্থান মাত্র-ঠাকুর বলেছেন, এসবের আশায় নামধ্যান করতে নেই, নামধ্যান ঠিকমত হলে এগুলি আপনিই এসে যায়।
ত্রৈলোক্যনাথ-জননী বগলাসুন্দরী দেবী কুলগুরু প্রথায় শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন। কিন্তু পুত্রের কাছে নিয়ত ঠাকুর-বিষয়ক আলাপ-আলোচনা শুনে মুগ্ধ হয়ে সৎনাম গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি তখন চলৎশক্তি রহিত, চোখে ছানি পড়ে দৃষ্টি ক্ষীণ। এ অবস্থায় ঠাকুরদর্শনে যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে দীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। ঠাকুরকে সব কথা চিঠিতে লিখে জানালেন ত্রৈলোক্যনাথ। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকেই নির্দেশ দিলেন মাকে দীক্ষাপ্রদানের। সে আদেশ শিরোধার্য করে ত্রৈলোক্যনাথ মাকে সৎনাম প্রদান করেন। দীক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে বগলাসুন্দরী দেবী সর্বদাই ইষ্টনাম জপ করতেন। ক্রমে জরায় আরও জীর্ণ হয়ে যেতে থাকে দেহখানি- দীপনির্বাপণের সময় সমাসন্ন। একদিন বালিকার মত আব্দার করেন, খিচুড়ি আর পায়েস খেতে সাধ হয়েছে। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী খিচুড়ি আর পায়েস প্রস্তুত করে ঠাকুরকে নিবেদন করে যখন তাঁকে দিতে যাওয়া হল, তিনি বললেন, আমার পেটে আর জায়গা নেই-এই তো ঠাকুর এসেছিলেন, দিব্যকান্তি যুবাপুরুষ-ফল, মিষ্টি, পায়েস নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে এইমাত্র চলে গেলেন। বগলাসুন্দরীর চোখে-মুখে রোগযন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই, আনন্দে, তৃপ্তিতে উদ্ভাসিত মুখখানি! এর সাতদিন পরই তাঁর ঐহিক জীবনের অবসান হয়। ভালবাসার দায় বড় দায়-স্বয়ং ভগবানকেও ছুটে আসতে হয় ভক্তের ছোট্ট অপূর্ণ বাসনা পূরণ করতে!
শ্রীশ্রীঠাকুর আলোচনা-প্রসঙ্গে গ্রন্থে বলেছেন, “জীবনের প্রত্যেকটি নিঃশ্বাসে ভগবান যেন জাগ্রত থাকেন আমাদের ভিতর, তবেই তো চলে স্ফূর্ত্তি, কয়ে স্ফূর্ত্তি, করে স্ফূর্ত্তি।” তিনি জাগ্রত থাকা মানেই তাঁর সঙ্গে যোগযুক্ত থাকা। এবং এই অবস্থায় সাধকের কাছে কিছুই আর অসাধ্য থাকে না—সবকিছুই আয়ত্তের মধ্যে এসে পড়ে। সমস্ত প্রতিকূল পরিবেশকে নিজের অধীনে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। যাজন-পরিক্রমায় ত্রৈলোক্যনাথকে বিভিন্ন সময়ে নানা বিরুদ্ধ ও অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়- ভগবানকে নিজের মধ্যে সদাজাগ্রত রেখে সেসমস্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। ১৩২৮ সনে একবার মুক্তাগাছায় হরিসভায় বক্তৃতার আমন্ত্রণ পান ত্রৈলোক্যনাথ। আলোচ্য বিষয় ছিল, “বীজতত্ত্ব ও মন্ত্র-চৈতন্য।” বক্তৃতা চলাকালীন এক ব্রহ্মচারী ত্রৈলোক্যনাথকে নানাভাবে বাক্যবাণে আক্রমণ করতে থাকেন। কিন্তু তাতে বিশেষ ফল না হওয়ায় অর্থাৎ যুক্তি ও বিচারে ত্রৈলোক্যনাথের মত সর্বজনগ্রাহ্য হওয়ায় ব্রহ্মচারী নতুন পন্থায় তাঁকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেন। সভাশেষে ত্রৈলোক্যনাথ মঞ্চ থেকে নেমে আসতে উদ্যত হলে ব্রহ্মচারী বেশ নরম সুরে তাঁকে বলেন, আপনি প্রচারক, দীক্ষাও দিয়ে থাকেন শুনেছি, শ্রীমদ্ভগবদীতা সম্বন্ধে আপনি নিশ্চয়ই অভিজ্ঞ। তাই পঞ্চদশ অধ্যায়ের
ঊর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।
ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ।।
- এই শ্লোকের ব্যাখ্যা আমরা আপনার কাছে শুনতে চাই।
ব্রহ্মচারীর উদ্দেশ্য ছিল ত্রৈলোক্যনাথকে সভাসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করা; তাঁর মনে হয়েছিল এই শ্লোকের ব্যাখ্যা ত্রৈলোক্যনাথের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ত্রৈলোক্যনাথ নিবিড়ভাবে ইষ্টচিন্তায় নিমগ্ন হন এবং স্বতোৎসারিত অপূর্ব ব্যাখায় সকলের মন জয় করে নেন। তাঁর নিজের ভাষায়, “এইভাবে ধ্যানের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের ভিতর এক অপূর্ব সাড়া পাইলাম, শ্লোকের অর্থ যেন অভাবনীয়ভাবে ভাসিয়া আসিতে লাগিল।” অর্থাৎ যোগযুক্ত হয়ে তিনি ঐ শ্লোকার্থ প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেন এবং তা প্রকাশ করেন। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ ঐ ব্যাখ্যার অকুন্ঠ প্রশস্তি করেন।
এই ঘটনার তিন/চার মাস পরে আশ্রমে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেলে ঠাকুর বলেন, ব্যাখ্যা যথাযথই হয়েছে। একান্ত যুক্ত অবস্থায় যা করা যায়, আশ্চর্য্যভাবে তা সাফল্যমণ্ডিত হয়ে থাকে; তারপর স্মিত হেসে অস্ফুট স্বরে বলেন-
মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্।
যৎকৃপা ত্বামহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম্।।
- ত্রৈলোক্যনাথ একবার বার্মার (অধুনা মায়ানমার) কামায়ুটে গিয়েছেন যাজন পরিক্রমায়। সেখানে বার্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইষ্টভ্রাতা নিবারণচন্দ্র দত্তের সঙ্গে আলাপ হয় এবং তাঁর মাধ্যমে তাঁর প্রতিবেশী কিরণচন্দ্র ঘোষের সঙ্গেও পরিচয় হয়। যাজনকার্য চলাকালীন কিরণচন্দ্রের বাড়িতে কোন কোন দিন রাত্রিবাসও করতে হয় ত্রৈলোক্যনাথের। একদিন সেখানে নিবারণচন্দ্রও উপস্থিত আছেন, পূণ্য- পুঁথি থেকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ। কিছুটা শোনার পরই কিরণচন্দ্র হঠাৎ বলে ওঠেন, ওঁ-কার সবার ওপরে, তার ওপরে আর কিছু থাকতে পারে তিনি বিশ্বাস করেন না। নিবারণচন্দ্র উত্তরে বলেন, শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাববাণীর প্রতিটি কথাই সত্য, আর শব্দতত্ত্ব সম্বন্ধে যা বলা আছে তার সমর্থন পূর্ববর্তী সন্তগুরুদের বচনেও পাওয়া যায়; অতএব তাবৎ মহাপুরুষের কথা বিশ্বাস না করার কোন কারণ নেই। একথায় কিরণচন্দ্রের পরিবর্তন তো হলই না, বরং বইখানি তাঁর হাতে দিতে গেলে তিনি উত্তেজিত হয়ে সেটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে থেকে চলে যান।
এই ঘটনার সপ্তাহকাল পরে ত্রৈলোক্যনাথের সঙ্গে কিরণচন্দ্রের দেখা হয় স্টেশনে। কিরণচন্দ্র অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে জানান যে তাঁর সেদিনকার গর্হিত আচরণে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত। আরও অনেক কথা হল দুজনের মধ্যে। ত্রৈলোক্যনাথ বলেন -গীতা, ভাগবত, চণ্ডী যেমন শ্রদ্ধার জিনিস, আমাদের কাছে পুণ্যপুঁথিও ততখানি আদরের। কথাপ্রসঙ্গে কিরণচন্দ্র আরও জানান যে সেদিন তিনি যা বলেছিলেন তা বইপত্র পড়া এবং অপরের কথার ওপর কথার ভিত্তি করে, নিজের সাধনালব্ধ অনুভূতি থেকে নয়। নানা আলাপ-আলোচনার পরে সেদিনের উগ্র কিরণচন্দ্র এতটাই মুগ্ধ হলেন যে সেদিনই দীক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং ঐদিন সন্ধ্যাতেই তাঁর দীক্ষা হয়ে গেল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে কামায়ুটে কিরণচন্দ্রের বাড়িতে বার্মার প্রথম অধিবেশন কেন্দ্র স্থাপিত হয়।
কিরণচন্দ্রের দীক্ষাগ্রহণের প্রায় দেড় মাস পরে তাঁর স্ত্রী দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষার সময় ধ্যান আরম্ভ করামাত্র তাঁর শরীরে স্বেদ-পুলক-কম্পনাদি লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং দুই চোখে অনবরত অশ্রুধারা বইতে থাকে। ক্রমে শরীর নিশ্চল হয়ে যায়। কিরণচন্দ্র স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন; তখন দীক্ষাদাতা ত্রৈলোক্যনাথ তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, নামের শক্তিতে অনেক সময় এরকম অবস্থার উদ্ভব হয়। মিনিট পনের পরে কিরণচন্দ্রের স্ত্রী প্রকৃতিস্থ হয়ে বলেন, ধ্যানের সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীশ্রীঠাকুর জ্যোতির্ময় মূর্তিতে তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ এক তুলনাহীন সুগভীর আনন্দস্রোত-যার হয়, সে-ই বোঝে। জগতের সমস্ত প্রাপ্তির চেয়ে সেরা প্রাপ্তি এই অনাবিল আনন্দঘন অনুভব। দীক্ষাদাতা যিনি তাঁর ভাবের গভীরতা এবং দীক্ষাগ্রহীতার উন্নত পূর্ব-সংস্কার এবং উচ্চ ভাবমুখিনতা থাকলে তবেই নামের স্পন্দন ক্রিয়াশীল হয়ে এমন অপরূপ অনুভবের উন্মেষ ঘটায়।
শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি ত্রৈলোক্যনাথের কী অপরিসীম নির্ভরতা ছিল তা নিম্নোক্ত ছোট ঘটনার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত। ইষ্টভ্রাতা ব্রজেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ও কিরণচন্দ্র ঘোষের আমন্ত্রণে তিনি দ্বিতীয় বার যখন রেঙ্গুনে আসেন তখন পরপর সভাসমিতি করার পর তাঁর মনে হল, এই বিরাট শহরে একক প্রচারে সাড়া পেতে যথেষ্ট সময় নেবে; তার চেয়ে মফঃস্বল শহরগুলিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাবে এবং ঠাকুরের ভাবাদর্শ প্রচার কার্য যথেষ্ট প্রসার লাভ করবে। এই প্রস্তাব উত্থাপন করায় নিবারণ দত্ত ও কিরণ ঘোষ জানান যে বার্মায় সৎসঙ্গীর সংখ্যা মুষ্টিমেয়; মফঃস্বলে ঘোরাফেরা ব্যয়সাপেক্ষ এবং এই ব্যয়ের সম্পূর্ণ ভার তাঁদের পক্ষে বহন করা সাধ্যাতীত। উত্তরে সাধকপ্রবর বলেন, একাধিক ধর্মীয় সংস্থা সর্বসাধারণের আর্থিক সহয়তায় প্রচারকার্য চালায়। প্রত্যেকের মধ্যেই ধর্মের চাহিদা আছে, মানুষের অন্তর স্পর্শ করতে পারলে তারাই সাড়া দেবে-অতএব চিন্তার কোন কারণ নেই। কিরণচন্দ্র উত্তরে বলেন, এইভাবে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করলে লোকে বিরক্ত হতে পারে, তাতে উদ্দেশ্য সাধনের অন্তরায় দেখা দেবে। সুতরাং এই প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকই সমীচীন। ত্রৈলোক্যনাথ তখন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ঠাকুরের বার্তা বহনের জন্য এদেশে এসেছি, তিনিই আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাকে পরিচালনা করছেন, একথা আপনারা সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করুন এবং আমি যাতে অবাধে স্বাধীনভাবে যাজনকার্য চালিয়ে যেতে পারি তাতে সহায়তা করুন। ত্রৈলোক্যনাথের এই দৃঢ়তার অভিব্যক্তি তাঁর সমস্ত শরীরে এমনভাবে প্রতিফলিত হল যে তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের সব দ্বিধা নিমেষে দূরীভূত হল-অচ্যুত ইষ্টনিষ্ঠার গভীরতার প্রকাশে আর কোন ‘কিন্তু’-র অবকাশ রইল না, সফল হল ত্রৈলোক্যনাথের বার্মা পরিক্রমা, বিভিন্ন প্রান্তে সৎনাম গ্রহণে ধন্য হলেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
বার্মার প্রচারকার্যের সাফল্যে শ্রীশ্রীঠাকুর, মাতা মনোমোহিনী দেবী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট আশ্রমিকবৃন্দ পরম পরিতৃপ্তি লাভ করেন। অনন্ত মহারাজের পত্রে ত্রৈলোক্যনাথ এই সংবাদ পান। এই প্রসঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘FORWARD’ দৈনিক পত্রিকায় (27th May 1925) প্রকাশিত নিম্নোক্ত অংশটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:
Dr. T. N. Chakrabarty of Dacca, a member of the Universal Satsang of Himaitpur, Pabna, has been deputed by the authorities to Rangoon in Burma, where there is a Branch Satsang and has been doing excellent work at Kamayut, Tharrawaddy and other neighbouring places. Many Burmeses and Marwaries, Punjabis and Bengalees domiciled in Burma have accepted the ideals of Satsang. A silent worker like Dr. Chakrabarty has attracted the notice of the elites of Rangoon and many pleaders, engineers and like have gathered round to help Tapovan, Viswa-Vigyan Kendra and various other institutions of the Central Satsng at Pabna. We hope he will soon return to Pabna with laurels from Burma.
বার্মায় ত্রৈলোক্যনাথের যাজন-পরিক্রমার প্রভাব শুধুমাত্র ভারতীয় বা বর্মীদের মধ্যেই সীমায়িত ছিল না, এমনকি দূর পাশ্চাত্যের ইংরেজও দীক্ষাগ্রহণে ধন্য হন। বার্মার খোমিওতে তখন ত্রৈলোক্যনাথ। সেখানে একসময়ে বার্মা গভর্নরের গ্রীষ্মাবাস ছিল-খোমিওকে বলা হত বার্মার দার্জিলিং। এখানে এক ইংরেজ বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকতেন -পূর্বজীবনে ইংল্যাণ্ডের স্কারবরো ইউনিভার্সিটি কলেজে মনোবিজ্ঞানের এই অধ্যাপকের পূর্বনাম ছিল জন স্টিফেন। প্রথম মহাযুদ্ধে গোলার আঘাতে তাঁর একটি পা পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অবসর পেয়ে চলে আসেন সিংহল (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) এবং সেখানে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে দ্রৌজি প্রজ্ঞানন্দ নামে অভিহিত হন।
প্রথম পরিচয়েই তাঁর ভাল লাগে ত্রৈলোক্যনাথের যাজন। ত্রৈলোক্যনাথ তাঁকে “Discourses on Radhaswami Faith” নামে একটি বই পড়তে দেন। তিন/চার দিন পর আবার তাঁর কাছে গেলে সেই ইংরেজ বৌদ্ধ ত্রৈলোক্যনাথকে বলেন- “This is a book on highest realisation; I have never come accorss such practical lesson. I wonder how one can put these into practice.”
ত্রৈলোক্যনাথ তাঁর সমস্ত অনুসন্ধিৎসার যথাযথ উত্তর দেন; ঠাকুর বিষয়ক নানা আলাপ-আলোচনার পর তিনি “নাম” নিতে ইচ্ছুক হন এবং পরদিন সকালে বেঙ্গল ক্লাবে এসে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
ব্রহ্মদেশ বা বার্মায় ত্রৈলোক্যনাথের যাজন-কাল ১৩৩০ থেকে ১৩৪২ বঙ্গাব্দ - এই দীর্ঘ বারো বছর বিস্তৃত ছিল। তবে তা একাদিক্রমে নয়, সর্বসাকুল্যে তিনি সেখানে পাঁচবার যান। প্রথমবার ১৩৩০-এর মাঘ মাস থেকে ১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত অবস্থান করেন। এই সময়ে রেঙ্গুন শহরের কাছে ইষ্টভ্রাতা ব্রজেন চ্যাটার্জির আবাসস্থলে ওঠেন। এই চার মাস তাঁর কর্মস্থল রেঙ্গুন, যোগন ও কামায়ুটে সীমাবদ্ধ ছিল। কামায়ুটে অবস্থানকালে তিনি ছিলেন বার্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইষ্টভ্রাতা নিবারণ দত্তের গৃহে। ‘রঞ্জন কুটির’ নামে এই বাড়ির একটি ঘর সাপ্তাহিক অধিবেশন কেন্দ্র হিসাবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল। পরবর্তী পর্যায় বৈশাখ, ১৩৩২ থেকে আশ্বিন, ১৩৩৪। এই সময়ে তাঁর যাজনক্ষেত্র ছিল লোয়ার বার্মার ব-দ্বীপ অঞ্চল এবং আপার বার্মা। তৃতীয় দফায় তাঁর স্থিতিকাল ছিল অগ্রহায়ণ, ১৩৩৯ থেকে অগ্রহায়ণ, ১৩৪০-এই এক বছর। ১৩৪০-এ মোগং ও কাথায় যে উৎসব হয়েছিল, তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর পরবর্তীকালে মাঘ, ১৩৪০ থেকে শ্রাবণ, ১৩৪১ পর্যন্ত ছিলেন। এই সময়ে ১৯৩৪ খৃষ্টাব্দের বিধ্বংসী বিহার ভূমিকম্পের পর অর্থ সংগ্রহের জন্য বার্মা থেকে চলে আসেন। ঐ পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে আছে যোগন-এ তপোবন-বিদ্যালয় স্থাপন। এরপর আসেন ভাদ্র, ১৩৪১-এ, স্থিতিকাল ছিল ভাদ্র, ১৩৪২ পর্যন্ত। এই সময়ের বিশেষ উল্লেখ্য-রেঙ্গুনে নবনির্মিত সৎসঙ্গ কেন্দ্রের উদ্বোধন এবং বৃহদাকারে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মোৎসব উদ্যাপন।
যাজন-কার্যের এই প্রথম যুগের অভিজ্ঞতার কথা ঠাকুরের নির্দেশে লিপিবদ্ধ করে রাখেন তিনি। ১৩৫০ সনে শ্রীশ্রীঠাকুর ত্রৈলোক্যনাথের উদ্দেশ্যে বলেন প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ইতিবৃত্ত থাকা খুবই দরকার, ভবিষ্যতের কর্মীদের পক্ষে তা পথের আলো। আবার একবার দেওঘরে বড়াল বাংলো (অধুনা ঠাকুর বাংলো)-র সিড়িতে দাঁড়িয়ে বলেন, এই যে বিরাট বাড়িখানা দেখছেন, যে ভিতের উপর এটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আর কেউ দেখতে পায় না; এখনই যদি সৎসঙ্গের ইতিবৃত্ত না লেখা যায়, তাহলে সৎসঙ্গের গোড়ায় যারা ছিল, তাদের খবর আর কেউ পাবে না। ত্রৈলোক্যনাথ লেখক ছিলেন না, তবু ঠাকুরের নির্দেশে তিনি লিখেছেন, বই ছাপাও হল ১৩৬০-এর নববর্ষ উৎসবের সময়। ঠাকুরের শ্রীহস্তে বইখানি দিয়ে তিনি প্রণাম করলে ঠাকুর ডান হাতখানি তুলে আশীর্বাদ করে বলেন, ‘ত্রৈলোক্যদা, পরমপিতার অভয় হস্ত অদৃশ্যভাবে আপনাদের মাথার উপর সর্বদা প্রসারিত রয়েছে,
একবার তাকালেই হয়।’ ঠাকুরের বাণীলেখক, ‘আলোচনা-প্রসঙ্গে’ গ্রন্থের সুপ্রসিদ্ধ সংকলক প্রফুল্লকুমার দাস তখন ঠাকুরের কাছেই ছিলেন, বইটি খানিক নাড়াচাড়া করে ঠাকুর তাঁর হাতে দিয়ে বলেন, ‘দ্যাখ প্রফুল্ল, আজ এই যে সৎসঙ্গের ইতিবৃত্ত তৈরী হল, ভবিষ্যৎ ইতিহাস একে ভিত্তি করেই হবে।’ বইটি তিন খণ্ডে ‘যাজন পথে’ নামে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে কিছু সম্পাদনা করে এক খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৩৯৫ বঙ্গাব্দে। আশ্রম জীবনের প্রথম পর্বে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে তিনি কয়েকটি গান রচনা করেন এবং তা ঠাকুরকে শোনান। ঠাকুর গানগুলি শুনে তৃপ্ত হয়ে সেগুলি ছাপানোর কথা বলেন। ‘সন্ত গীতা’ নামে ১৩২৮ বঙ্গাব্দে গানগুলি প্রকাশিত হয়।
জীবনের শেষ প্রান্তে ত্রৈলোক্যনাথ কলকাতায় কনিষ্ঠ পুত্র প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে বাগবাজারে থাকতেন; সেখান থেকেই ঠাকুর-দর্শনে দেওঘরে যেতেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের তিরোধানের পরেও ঋত্বিক সম্মেলন অথবা উৎসবাদি উপলক্ষ্যে তাঁর দেওঘরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ১৯৭৩-এর নববর্ষ উৎসবেও গিয়েছিলেন দেওঘরে, সেখান থেকে ফিরে সেবারে হঠাৎ বলেন, আর বোধহয় আমার দেওঘর যাওয়া হবে না। কনিষ্ঠা পুত্রবধূ গোলাপ (সৎসঙ্গ হাসপাতালের ডাক্তার, শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্যের জ্যেষ্ঠা কন্যা) একথা শুনে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন-অমন কথা বলেন কেন, বাবা? আপনার শরীর তো ভালই আছে, আবার যাবেন দেওঘরে।
এর কিছুদিন পরে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি গোলাপ একদিন লক্ষ করেন, ত্রৈলোক্যনাথ শ্রীশ্রীঠাকুরের ছবির সামনে বসে দু’হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে অত্যন্ত নিবিষ্ট চিত্তে কী যেন বলছেন। পরে তিনি জিজ্ঞাসা করেন-বাবা, ঠাকুরের কাছে কী বলছিলেন? ত্রৈলোক্যনাথ এড়িয়ে গিয়ে বলেন-ও তেমন কিছু না। পুত্রবধূও নাছোড়বান্দা-না, আপনাকে বলতেই হবে, অমন ক’রে কী বলছিলেন ঠাকুরের কাছে। আপনার মনে কি কোন কারণে দুঃখ হয়েছে? অবশেষে ত্রৈলোক্যনাথ মৃদু হেসে বলেন, ঠাকুরকে বলছি, যা যা কাজ ছিল, সবই তো হয়ে গেছে, আর তো এই দেহে তাঁর কাজ কিছু করার ক্ষমতা নেই, এবারে তিনি নিয়ে নিলেই পারেন। একথায় প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে গোলাপ বলে ওঠেন-না, না, ওসব কী কথা! অমন কথা একদম বলবেন না! ত্রৈলোক্যনাথ তেমনই হাসিমুখে বলেন, আমার কাজ শেষ হয়েছে রে, আর তোরা মায়া বাড়াস না, এবারে মায়া কাটা।
এর পরে ক’দিন ধরেই মাঝে মাঝে বলতে থাকেন, এবারে মায়া কাটিয়ে ফেলার পালা। তাঁর শরীর কিন্তু তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ। ১৫ই জুন, ১৯৭৩ রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুত্র প্রসাদকে কাছে ডেকে বলেন-ঐ ট্রাঙ্কে একটা নতুন থানধুতি আছে, ওটা তোর সেজদাকে দিস। প্রসাদ বলেন, সেজদা এলে তুমি নিজেই দিও। তিনি বলেন-নারে, ওর লাগবে তো! এ ছাড়াও আরও কতগুলো জিনিস কোনটা কাকে দিতে হবে, তাও বলেন। প্রসাদ বলেন-এখন এসব কথা বলছ কেন? রাত হয়েছে, তুমি ঘুমোও।
পরের দিন ১৬ জুন সকালে ছেলেকে বলেন-তাড়াতাড়ি বাজারে যা, ফেরার পথে ডাক্তারকে বলে আসিস যেন একবার আসে, এই দ্যাখ, হাতে একটু কেমন চুলকানি মতন হয়েছে। প্রসাদ হাতখানা দেখে বলেন, কই, কিছু তো দেখছি না। তিনি তাড়া দিয়ে বলেন-তুই যা না, তাড়াতাড়ি যা। অগত্যা প্রসাদ বেরিয়ে যান। এর পরে পুত্রবধূ তাঁর জন্য এক কাপ হরলিকস নিয়ে এলে তাকে বলেন- তোর ছেলের পরীক্ষা, সে পড়ছে, তুই তার কাছে যা। পুত্রবধূ কিন্তু যান না, বলেন- আপনার খাওয়া হোক, তারপর যাব। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তুই যা না ছেলের কাছে। কিন্তু শ্বশুরের প্রতি পুত্রবধূরও ছিল সন্তানের মত মমতা, তিনি আবারও বলেন, আপনার খাওয়া হোক আগে। পরের মুহূর্তেই একটি তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে কাত হয়ে ত্রৈলোক্যনাথ বলেন- আজ খুব গরম পড়েছে, নারে? বধূমাতা উত্তর দ্যান-আষাঢ় মাস পড়ল তো, তাই গুমোট। ত্রৈলোক্যনাথ অস্ফুট স্বরে ‘তাই হবে হয়তো’ বলতে বলতে নীরব হয়ে গেলেন-মাথাটা একটু ঝুঁকে পড়ল। তাঁর ভঙ্গী দেখে পুত্রবধূ চিৎকার করে ওঠেন ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে-কিন্তু জাগতিক কোন ডাক আর তাঁর শ্রবণে পৌঁছল না, স্বজ্ঞানে স্বেচ্ছায় সব মায়া কাটিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ চলে গেলেন তাঁর কাছে, যাঁর বার্তা বহন করে ফিরেছেন সম্পূর্ণ জীবন। সম্ভবত মায়াডোর ছিন্ন করার জন্যই প্রয়াণমুহূর্তে কোন প্রিয়জনকে কাছে রাখতে চাননি তিনি।
তাঁর মৃত্যুর পর সৎসঙ্গ আশ্রমের মুখপত্র আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ - শ্রদ্ধাঞ্জলিতে যথাযথভাবে তাঁকে ‘গুপ্ত তাপস’ অভিধায় অভিহিত করে বলা হয়- “...
শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শ মূর্ত্ত ক’রে তোলাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা। বহু বাধা বিঘ্ন ও সংগ্রামের দরিয়া পার হয়ে তিনি ইষ্টনিষ্ঠাকে অচ্যুত করে রেখেছিলেন। বলতে গেলে, তিনি ছিলেন গুপ্ত তাপস।...
তাপস ত্রৈলোক্যনাথের ইষ্টার্থ-প্রচার-তপস্যার সুফল দেশান্তরে যুগান্তরে শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবাদর্শের ক্রমবর্ধমান প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে নিত্যগতিশীল হয়ে রয়েছে।
____________________________
#ত্রৈলোক্যনাথ_চক্রবর্ত্তী
10