বিরাজকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য :-
🔷 এই তো দেখছি ঠাকুর এখানেই আছেন। এর মধ্যে কখন সুদূর মজিলপুরে গেলেন, কখনই বা ফিরলেন?
🔷 যজন, যাজন, ইষ্টভৃতির বিধান প্রবর্তন..
🔷 বিরাজদা (ভট্টাচার্য্য) - ঠাকুর! বিশ্বাসটা পাকা হয় কি করে?
‘জীবনে জীবন যোগ করা / নাহলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় প্রাণের পশরা।’ জীবনগীতির সমারোহ কৃত্রিম পণ্যের সমাহারে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যদি জীবনে জীবন যুক্ত না হয়। আর জীবন সফল হয়, সার্থকতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, যদি তা যুক্ত হয় মহাজীবনে। সেই সার্থকতার অন্বেষণে এসে মহাজীবন-সংযোগের পরম সৌভাগ্য সকলের হয় না; পূর্বার্জিত সংস্কার ও অদম্য আকুলতার শক্তিতে কেউ কেউ এসে পৌঁছে যান সেই মহামানবের সাগরতীরে-বহির্জগতের দুঃখ- কষ্টের সকল কাঁটা ধন্য করে যেখানে ফুটে ওঠে অন্তরের পূর্ণতার অম্লান কুসুম। বিরাজকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্যের জীবনে ঘটেছিল সেই বিরল যোগাযোগ-শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের পদতলে যুক্ত হয়ে বস্তুগত সাফল্যের কৃত্রিম পণ্যকে উপেক্ষা করে তিনি লাভ করেছিলেন প্রকৃত সার্থকতার অমল রত্ন।
চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত জয়নগর-মজিলপুরের এক স্বচ্ছল সম্ভ্রান্ত বিপ্র পরিবারে ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে যাদবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য ও নিস্তারিণী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিরাজকৃষ্ণের জন্ম হয়। বয়স যখন তাঁর মাত্রই চৌদ্দ বৎসর, পিতা যাদবকৃষ্ণ পরলোকগমন করেন। জ্যেষ্ঠতাত ও পিতৃব্যের অভিভাবকত্বে পিতৃহীন কিশোর জীবনপথে অগ্রসর হন। শিক্ষাজীবন সমাপন করার পর চাকুরির বদলে ব্যবসাকে স্বাধীন জীবিকা হিসাবে বেছে নেন তিনি। নিষ্ঠা, সততা ও উদ্যমের বলে ব্যবসায়ে প্রভূত উন্নতি করেন। তাঁর ব্যবসাকেন্দ্র ছিল শিলং, সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যা ছিল অতি সুদূর। ব্যবসার প্রয়োজনে প্রায়শই তাঁকে কলকাতায়ও যাতায়াত করতে হত।
শৈশব থেকেই বিরাজকৃষ্ণের অন্তরে আধ্যাত্মিক পিপাসা ছিল প্রবল; বয়ো- বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই পিপাসার প্রাবল্যও বৃদ্ধি পায়। একুশ বছর বয়সে তিনি আগ্রা দয়ালবাগ সৎসঙ্গের স্বামীজি মহারাজের সহধর্মিণীর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দয়ালবাগ থেকে প্রচুর হিন্দী পুস্তক সংগ্রহ করেছিলেন তিনি-সুকণ্ঠেরও অধিকারী ছিলেন। ব্যবসায়িক ব্যবস্ততার ফাঁকে ফাঁকে যথাসাধ্য নামধ্যান, ভজনগান, পুস্তকাদি পাঠ ছিল তাঁর নিত্যকর্ম। কিন্তু মন তবু ভরত না, কী যেন এক ফাঁক রয়ে যেত কোথায়! সংসারধর্মের মধ্যেও আত্মিক আকৃতি তাঁকে ব্যাকুল করে তুলত, খুঁজে বেড়াতেন সেই পরশমণি, যার স্পর্শে সোনা হয়ে উঠবে জীবনের সবখানি।
ব্যবসার সূত্রেই কুষ্টিয়ার অধিবাসী বসন্ত সাহাচৌধুরীর সঙ্গে কলকাতায় পরিচয় হয় বিরাজকৃষ্ণের; পরিচয় ক্রমে পরিণতি পায় ঘনিষ্ঠতায়। ব্যক্তিগত সুখদুঃখের অনেক কথাই হয় দুজনের মধ্যে, দুজনেই জানেন পারস্পরিক নানা বিষয়। বিরাজকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক অন্বেষা বসন্তের গোচরে আসে; তিনি তখন বিরাজকৃষ্ণকে বলেন এক ঠাকুরের কথা-সবার মতনই সাধারণ মানুষ তিনি, অথচ সকলের চেয়ে স্বতন্ত্র, অনন্য এক অস্তিত্ব। পূর্ব বাংলার পাবনা জেলার হিমাইতপুর গ্রামে নিবাস তাঁর, অপরূপ তাঁর চলা-বলা, সর্বসমস্যাহর তাঁর বাণী-সুধা; সর্বোপরি, মানুষকে ভালবেসে তিনি মানুষের ভগবান, মানুষ-ভগবান। তাঁরই চরণে নিজেকে সঁপে দিয়ে কৃতার্থ হয়েছেন বসন্ত। বসন্তের কথা শুনে বিরাজকৃষ্ণের পিপাসু চিত্তে জেগে ওঠে আশার কলরোল-তবে কি পাওয়া যাবে সেই অফুরন্ত অমৃত-নির্ঝর, সমস্ত তৃষ্ণা যার ধারায় নিঃশেষে নিবারিত হয়? একই সঙ্গে আশঙ্কাও দেখা দেয় মনে-আশাহত হতে হবে না তো শেষে? নানা চিন্তার টানাপোড়েনে অবশেষে স্থির করলেন, একবার দেখে আসতে তো ক্ষতি নেই, অন্তত কৌতূহলের নিবৃত্তিও তো হবে। অতঃপর বসন্তের সঙ্গে পাবনায় যান বিরাজকৃষ্ণ ঠাকুর-দর্শনে। দেখেন, জঙ্গলে ঘেরা এক ক্ষুদ্র গ্রামে ক’টি খড়ে ছাওয়া কুটির নিয়ে পদ্মাপারে সেই আশ্রম। আশ্রমের কেন্দ্রবিন্দু এক অনিন্দ্যকান্তি মধুর-স্বভাব যুবাপুরুষ-নাম তাঁর অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্তী, ভক্তদের প্রীতিতে, ভক্তিতে, প্রেমে যিনি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বা সংক্ষেপে ‘ঠাকুর’ অভিধায় সমধিক পরিচিত। তাঁর আদর্শদীপ্ত চলনে, তাঁর দৃষ্টিতে, তাঁর বাক্যে যেন ক্ষরিত হচ্ছে অমরার আশ্বাস-নিঃস্রব, যেন যুগযুগান্ত ধরে তিনি অপেক্ষা করে আছেন অশান্ত, তৃষ্ণার্ত্ত, তাপিত প্রাণের জন্য শান্তিসরিৎ-এর অমৃতকুম্ভ নিয়ে। সেই সব-ভুলানো, সব-জুড়ানো প্রেমের ধারায় নিজেকে সমর্পণ করে তৃপ্ত হলেন, ধন্য হলেন বিরাজকৃষ্ণ, এতদিনে মিলল তাঁর অন্বিষ্ট সাধন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণে নিজেকে নিবেদন করে পাবনা থেকে ফিরলেন তিনি। কিন্তু দেহ ফিরলেও মন তো ফেরে না! ক্রমশই সমগ্র সত্তা যেন আরও বেশি উন্মুখ হয়ে উঠল ঠাকুরের অহর্নিশি সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্ক্ষায়। সফল ব্যবসায়ী সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভূত বিরাজকৃষ্ণ ভট্টাচর্য্যের অন্তর জুড়ে থাকে পাবনার এক অখ্যাত গ্রামের অলোকসামান্য সেই যুবার প্রেমময় মুখচ্ছবি—সব ফেলে ছুটে যেতে ইচ্ছা হয় তাঁর কাছে। ব্যবসা উপলক্ষে তাঁকে শিলং থাকতে হত, কলকাতা থাকতে হত, স্বভূমি মজিলপুরে যাওয়া হত মাঝে মধ্যে। মজিলপুরের প্রাসাদোপম বিরাট বাড়িতে জ্ঞাতিকুটুম্বসহ থাকতেন তাঁর মাতা নিস্তারিণী দেবী, কনিষ্ঠ ভ্রাতা, ভ্রাতৃবধূ, স্ত্রী সরোজিনী দেবী ও দুটি শিশুপুত্র। ক্রমে মনের আকুলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, জমজমাট ব্যবসা, মজিলপুরের প্রভূত সম্পত্তি, সবই যেন বর্ণহীন, তাৎপর্যহীন হয়ে উঠল তাঁর কাছে। কারণে- অকারণে ছুটে চলে যান হিমাইতপুর, একবার গেলে আর আসতে ইচ্ছে করে না সেই সর্বাঙ্গসুন্দর মানুষটিকে ছেড়ে।
বিরাজ-জায়া সরোজিনী দেবী স্বামীর এই ভাবান্তর লক্ষ করে চিন্তিত হয়ে পড়েন। মনে মনে ভাবেন-সংসার, ব্যবসা, সব ফেলে কোন আকর্ষণে মানুষটি ছুটে যান বারে বারে পাবনায়? একদিন জিজ্ঞাসাও করে ফেলেন সুযোগ বুঝে-তুমি কার কাছে পাবনায় যাও এতবার? বিরাজকৃষ্ণ সংক্ষেপে উত্তর দেন-যাই আমার ঠাকুরের কাছে। সরোজিনী দেবী ছিলেন সবার্থে তাঁর সহধর্মিণী। স্বামীর এমন ভাববিহ্বল অবস্থা, বিষয়কর্মে ক্রমবর্ধমান অনাসক্তি সাংসারিক বুদ্ধিসম্পন্ন যে-কোন গৃহিণীর পক্ষে বিশেষ প্রীতিকর মনে না-ও হতে পারত। কিন্তু পতিব্রতা শুদ্ধচিত্তা সরোজিনীর মনে স্বামীর আকর্ষণের কেন্দ্র সম্বন্ধে ধীরে ধীরে জেগে উঠল প্রেমভক্তি মিশ্রিত কৌতূহল, আকূতি। মাঝে মধ্যেই মনে হয়, কেমন ঠাকুর তিনি, যাঁকে পেয়ে আমার স্বামীদেবতা এমন তন্ময়! যদি দেখতে পেতাম একবারটি তাঁকে। বিরাজকৃষ্ণ তখন অধিকাংশ সময়ই পাবনায় থাকেন। সরোজিনী দেবী সংসার সামলান, সন্তানদের লালন-পালন করেন, শ্বশ্রূমাতার সেবা করেন, আর নানা কাজের ফাঁকে ফাঁকে চিন্তা করেন সেই না-দেখা ঠাকুরের কথা। অবশেষে একদিন রাত্রে স্বপ্নের মধ্যে হল তাঁর অনির্বচনীয় এক অভিজ্ঞতা। স্বপ্নে দেখলেন, দরজায় করাঘাত করে কেউ দরজা খুলতে বলছেন। সরোজিনী দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দেখলেন, সম্মুখে দণ্ডায়মান দীর্ঘ দেহ, উজ্জল গৌরবর্ণ, খালি গা, ধুতির কোঁচা লুটোনো এক দীপ্তিমান পুরুষ। তাঁর অঙ্গচ্ছটায় করুণার স্নিগ্ধতা, প্রাণস্পর্শী দৃষ্টিতে, মোহন হাসিতে অশেষ আশ্রয়ের আশ্বাস! মধুর হেসে বললেন তিনি-মা, তোকে দেখতে এলাম। সরোজিনীর সমগ্র সত্তা যেন বিহ্বল, অভিভূত হয়ে পড়ল-সম্মোহিতের মত সেই অপরূপ আগন্তুককে পরম সমাদরে ভিতরে নিয়ে এলেন, তাঁর পা ধুইয়ে দিয়ে নিজের সুদীর্ঘ কেশরাশি দিয়ে পা মুছিয়ে সযত্নে বসালেন তাঁকে। কী যেন অপূর্ব আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে অন্তর, মুগ্ধ, বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলেন অচেনা অথচ চির-চেনা সেই আদিত্যবর্ণ পুরুষের মুখের দিকে। তিনি সরোজিনীকে বলে দিলেন একটি বীজনাম। স্বপ্নের মধ্যেই ঘটল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি-স্বয়ং নামীর কাছ থেকে পেলেন তিনি সৎনাম।
স্বপ্ন ভেঙে গেল, কিন্তু নামটি মনে রইল, রইল ভাবের গভীর আবেশ। এদিকে ঐ একই সময়ে পাবনায় শ্রীশ্রীঠাকুর বিরাজকৃষ্ণকে ডেকে বলেন—বিরাজদা, আপনার মজিলপুরের বাড়ি দেখে এলাম। মা (বিয়াজকৃষ্ণের স্ত্রী)-টির মাথায় মেলা চুল! মা আমার পা ধুইয়ে চুল দিয়ে পা মুছিয়ে দিল, আমি তাকে নাম দিলাম। বিরাজকৃষ্ণ অবাক হয়ে ভাবেন-ঠাকুর এ কী রহস্য করছেন? এই তো দেখছি ঠাকুর এখানেই আছেন। এর মধ্যে কখন সুদূর মজিলপুরে গেলেন, কখনই বা ফিরলেন? তিনি এরগূঢ়ার্থ বুঝতে না পেরে তখনকার মত চুপ করে রইলেন।
কিছুদিন পর মজিলপুরে ফিরলেন বিরাজকৃষ্ণ। তাঁকে দেখেই ব্যাকুলভাবে সরোজিনী দেবী জিজ্ঞাসা করেন-তোমাদের ঠাকুর কেমন দেখতে? তিনি কী নাম দেন? বিরাজকৃষ্ণ বিস্মিত হয়ে তাঁর এই জিজ্ঞাসার কারণ জানতে চাইলে সরোজিনী অশ্রুপ্লাবিত আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে তাঁর স্বপ্নের আনুপূর্বিক বিবরণ দ্যান। বিদ্যুচ্চমকের মত বিরাজকৃষ্ণের মনে পড়ে যায় ঠাকুরের সেদিনের কথা-শ্রীশ্রীঠাকুরের অপরিমেয় করুণায় এবং সহধর্মিণীর পরম সৌভাগ্যে উদ্বেল হয়ে ওঠে তাঁর অন্তর। ভক্তির অনাবিল স্রোতে পূর্ণ হয়, ধন্য হয় তাঁদের যুগল জীবন।
কিন্তু শুধু নিজের বা নিজ পরিবারের মধ্যে এই পরম ধন প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না বিরাজকৃষ্ণ; পরিপার্শ্বে, বিশেষত তাঁর পৈতৃক ভূমি মজিলপুর ও সন্নিহিত অঞ্চলে শ্রীশ্রীঠাকুরের অমৃত ভাবধারার প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে সকলকে উদ্বুদ্ধ ও সমুন্নত করে তোলার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে ব্যাকুল করে তোলে। সপার্ষদ ঠাকুর যদি একবার মজিলপুর আসেন, তবেই পূর্ণ হতে পারে তাঁর আকাঙ্ক্ষা। তাঁর আগ্রহের ঐকান্তিকতায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের পৌষমাসে সতীশচন্দ্র গোস্বামী, অনন্ত মহারাজ, কিশোরীমোহন দাস, কৃষ্ণচন্দ্র দাস, কৃষ্ণলাল রায়চৌধুরী, সতীশচন্দ্র জোয়ারদার, সত্যচরণ দত্ত, খোকন বুনে, তরণী বুনে প্রভৃতি কীর্তনদলের সহচর-সহ শ্রীশ্রীঠাকুর মজিলপুরে বিরাজকৃষ্ণের গৃহে পদার্পণ করেন। এই উপলক্ষ্যে জয়নগর-মজিলপুর অঞ্চলে যে বিপুল ভাবান্দোলন, যে প্রাণের জোয়ার উচ্ছলিত হয়ে উঠেছিল, তার ঈষৎ বিস্তারিত বিবরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
মজিলপুর ও সন্নিহিত অঞ্চল থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শিক্ষা-সম্পদ নির্বিশেষে অগণিত মানুষ প্রতিদিন বিরাজকৃষ্ণের গৃহে ঠাকুর-দর্শনে সমবেত হতেন। প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা, প্রত্যেকের জন্যই অভিনব সমাধান। সমবেত ব্যক্তিমণ্ডলী ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে নানা অধ্যাত্ম তত্ত্ব আলোচনা করতেন। অনন্ত মহারাজ, কিশোরীমোহন, সতীশচন্দ্র গোস্বামী, সতীশচন্দ্র জোয়ারদার, সুশীলচন্দ্র বসু প্রমুখ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ পার্ষদ্গণ সে-সমস্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করে আলোচ্য বিষয় সমূহ অত্যন্ত সহজভাবে সকলকে বুঝিয়ে দিতেন। এরই ফাঁকে ফাঁকে ড্রাম, জয়ঢাক, খোল, করতাল, কাঁসর, ঘন্টা সহযোগে তুমুল কীর্তনে মেতে উঠতেন সকলে। এভাবে কীর্তনে, গানে, সদালোচনায় বিরাজকৃষ্ণের গৃহ তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়ে উঠত।
একদিন কথাপ্রসঙ্গে মজিলপুরের জমিদার সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঠাকুরকে বলেন যে, এককালে গঙ্গা ঐখান দিয়ে প্রবাহিত হত, নদী মজে গিয়ে এই গ্রামের সৃষ্টি হয়েছে বলে এর নাম মজিলপুর। কথিত আছে, শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এই স্থান দিয়েই নীলাচলে গিয়েছিলেন। মজিলপুর থেকে সাত মাইল দূরে যে জায়গায় তিনি অবস্থান করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা ‘চক্রতীর্থ’ নামে পরিচিত হয়। একথা শুনে শ্রীশ্রীঠাকুরের চক্রতীর্থ- দর্শনের আকাঙ্ক্ষা হয়। পরের দিন, ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯১৭, শ্রীশ্রীঠাকুর সদলে কীর্তন সহযোগে রওয়ানা হন চক্রতীর্থের পথে। দিনের শুরু না হতেই কীর্তনের কলরোলে মুখরিত হয়ে উঠল মজিলপুর গ্রাম। বিরাজকৃষ্ণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কীর্তনের দল ঢাক, ঢোল, খোল, করতাল, কাঁসর, ঘন্টা ইত্যাদি বাদ্য ও উদ্দাম নৃত্যসহ অগ্রসর হতে লাগল—সকলের পুরোভাগে আছেন দু’বাহু তুলে সুঠাম নৃত্যে ভাবে বিভোর শ্রীশ্রীঠাকুর। সেই কীর্তনের প্লাবন যে-পথে অগ্রসর হল, দু’কূল ছাপিয়ে আত্মসাৎ করে এগিয়ে চলল। কীর্তনের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে, ঠাকুরের বিশ্বমোহন ভঙ্গিমায় ও নামের তড়িৎ স্পন্দনে সম্পূর্ণ অঞ্চলটি যেন সম্মোহিতের মত কীর্তনের দলে যোগ দিল। সমবেত উলুধ্বনি ও হরিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল দশদিক-দলে দলে লোক শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবোন্মাদ মূর্তিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে লাগল। ঠাকুরও যাকেই সামনে পাচ্ছেন, প্রেমালিঙ্গনে ধন্য করে দ্রুতগতিতে ধাবিত হচ্ছেন। নামস্পন্দনের তড়িৎ প্রবাহে তাঁর কেশরাশি মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে উঠছে মাথার উপর। ঠাকুর তীব্র গতিতে অগ্রসর হতে লাগলেন—অনুগামীদের প্রাণপণ গতিও তাঁকে ধরতে পারল না। সকলের আগে একাকী চক্রতীর্থে উপস্থিত হলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরে ভক্তবৃন্দ সেখানে পৌঁছনোর পর সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল অবিরাম কীর্তন। অর্ধভাবাবস্থায় শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখ খেকে উচ্চারিত হল একটি মহাভাববাণী: ‘One is equal to various and various is equal to one.’ সন্ধ্যার পর সকলে মজিলপুরে ফিরে আসেন।
বিরাজকৃষ্ণের প্রাণ আনন্দে, তৃপ্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠল নিজ গৃহে ঠাকুরের লীলাময় অবস্থিতির সৌভাগ্যে। মোট সাত দিন সেখানে থেকে, বিদায়কালে সমগ্র গ্রামটিকে বিদায়-ব্যথায় ব্যথিত করে শ্রীশ্রীঠাকুর সপার্ষদ হিমাইতপুরে ফিরে গেলেন।
মজিলপুর থেকে চলে আসার সময় সেখানকার মানুষজন শ্রীশ্রীঠাকুরের আসন্ন বিদায়ের কথা ভেবে যে-ভাবে আবেগ উচ্ছ্বাসে তাঁর চারপাশে ভেঙে পড়েছিল তা দেখে ঠাকুরের মনে হয়েছিল-উপযুক্ত পোষণের অভাবে তিনি চলে যাওয়ার পর এই আবেগ-উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে ক্রমে একেবারেই মিলিয়ে গিয়ে গতানুগতিক জীবনধারায় পরিণত হবে আবার। মানুষের আবেগ ও উন্মাদনাকে শ্রেয়কেন্দ্রিক অনুরাগী করে যদি তার প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে যোগ করা না যায় তবে ঐ আবেগ- উন্মাদনায় সত্যিকারের স্থায়ী কোন লাভ হয় না মানুষের। শ্রীশ্রীঠাকুরের এই ভাবনারই ফলশ্রুতি যজন, যাজন, ইষ্টভৃতির বিধান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের আবেগকে নিয়মিত শ্রেয়মুখী প্রেরণায় দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া। এবং তা-ই ক্রমে সংহত সৎসঙ্গ আন্দোলনের রূপ নিতে থাকে। মজিলপুর পর্বকে তাই সৎসঙ্গ আন্দেলনের একটা পীঠস্থান বলা যায়।
বিরাজকৃষ্ণের মন আর মজিলপুরে থাকতে চাইল না; স্থির করলেন, কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে বিষয়-সম্পত্তি সব অর্পণ করে পাকাপাকিভাবে হিমাইতপুর নিবাসী হবেন। ভাইয়ের বিবাহ দিয়েছেন, একটি পাঁচ মাসের শিশু সন্তান তখন তার। বিরাজকৃষ্ণ তখন হিমাইতপুরে রয়েছেন। ভগবৎ সান্নিধ্যের মাধুর্যে মাতোয়ারা মন তাঁর। হঠাৎ একদিন ঠাকুর তাঁকে ডেকে বললেন-বিরাজদা, বাড়ি থেকে যদি এখনই কোন দুঃসংবাদ পান, তাহলে কী করবেন? মেনে নিতে পারবেন তো? তিনি ভেবে পান না, কী এমন দুঃসংবাদ হতে পারে! এই তো বাড়িতে সকলকে সুস্থ দেখে এলেন, এরই মধ্যে কী ঘটতে পারে? তবু ঠাকুরের কথায় অজানা অমঙ্গলের আশঙ্কায় তাঁর বুক কেঁপে ওঠে। ঠাকুরের ঐ কথার কিছুক্ষণ পরই টেলিগ্রাম এসে পৌঁছল যে, আকস্মিকভাবে কলেরায় তাঁর ছোট ভাইটির মৃত্যু হয়েছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল তাঁর। একে কনিষ্ঠ সহোদরের মৃত্যুশোক, তার ওপর তাঁর সমস্ত পরিকল্পনাও সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল এই ঘটনায়। ঠাকুর নানাভাবে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—যান দাদা, এখন বাড়ি যান, বাড়িতে তো এখন আপনাকে খুবই দরকার।
মজিলপুরে ফিরে এলেন বিরাজকৃষ্ণ। শোকাতুরা বিধবা মা, নিতান্ত অল্পবয়সী বিধবা ভ্রাতৃবধূ, তার শিশু সন্তান, সকলেরই দায়িত্ব তাঁর ওপর। তাছাড়া, তাঁর নিজের দুই পুত্র, এক কন্যাও তখন নিতান্তই শিশু। কিছুটা সামলে নেওয়ার পর পরিবারের সকলকে নিয়ে হিমাইতপুর চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি। মজিলপুরে স্বজন-জ্ঞাতির কাছে বিষয়-সম্পত্তি সমর্পণ করে সপরিবারে হিমাইতপুরে এসে শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণে আশ্রয় নিলেন বিরাজকৃষ্ণ। বিষয়-বৈভব, জাগতিক সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য পড়ে রইল পিছনে-তিনি এগিয়ে চললেন পার্থিব দুঃখের কাঁটা দ’লে অন্তরের অবিনশ্বর প্রেমপুষ্প-চয়নে।
হিমাইতপুর এসে আশ্রম থেকে কিছুটা দূরে জায়গা কিনে একটি ছোট গৃহ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন বিরাজকৃষ্ণ। এক বহু প্রাচীন ভাঙা কালীমন্দিরের কাছে, ফাঁকা জায়গায়, প্রায় মাঠের মধ্যে ছিল তাঁর বাড়িটি। ঠাকুরের পরিবারের সঙ্গে এক পরিবারের মতই সহজ সরলভাবে দিন কাটে তাঁদের। একবার কোন অজ্ঞাত রোগে দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন বিরাজকৃষ্ণ; ডাক্তাররা সন্দেহ করেছিলেন পেটে ফোঁড়া বা টিউমার জাতীয় কিছু হয়েছিল এবং কোন চিকিৎসায়ই আরোগ্য লাভ হচ্ছিল না। সেসময় ঠাকুর তাঁকে বলেন-বিরাজদা, কিছুদিন আপনি আমার বাড়ি এসে থাকেন, আমি গিয়ে থাকি আপনার বাড়ি। সেই কথামত তিনি আশ্রমে এসে জননী মনোমোহিনী দেবীর কাঠের দোতলা বাড়ির কাছেই একটা ঘরে থাকতে লাগলেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর বাড়িতে গিয়ে থাকতে লাগলেন। এর ফলে বিরাজকৃষ্ণ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠলেন; কিন্তু তাঁর বাড়ির দাওয়া থেকে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ঠাকুরের পা মচকে গেল। তখন ঠাকুর বোলওয়ালা কাঠের খড়ম ব্যবহার করতেন, বাঁশের সিঁড়িতে সেই খড়ম পিছলে যায়। সেই মচকানোর ফলে ঠাকুর দীর্ঘদিন পায়ের পীড়া ভোগ করেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের নিবিড় সান্নিধ্যে জাগতিক সুখদুঃখকে অতিক্রম করে আনন্দে নিমগ্ন থাকেন বিরাজকৃষ্ণ। অনন্ত মহারাজের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল। দয়ালবাগ সৎসঙ্গের যে-সমস্ত হিন্দী গীত ও ভজন বিরাজকৃষ্ণ জানতেন, সেগুলি অনন্ত মহারাজকেও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। মহারাজ ঘোড়ায় চড়ে ডাক্তারি করতে যেতেন। সেই ঘোড়ার জন্য ঘাস কাটতে কাটতে দুই বন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে সে-সমস্ত গীত ও ভজন গাইতেন। কাশীপুর গ্রামে সাধন-ভজনের জন্য মহারাজ যে মঠ বানিয়েছিলেন, সেই নিরালা নির্জন মঠটিতে মহারাজের সঙ্গে বিরাজকৃষ্ণও যেতেন এবং দুজনে দিনের পর দিন সাধন-ভজন, জপ-তপে নিমগ্ন থাকতেন।
সাধনভজন ও জপতপের ফলে বিরাজকৃষ্ণর মন নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁতেই সংলগ্ন হয়ে থাকত এবং যখন যেখানে থাকতেন, যাঁদের মধ্যেই থাকতেন—‘কানু বিনা গীত নেই’-এর মত তাঁরও ‘ঠাকুর ছাড়া কথা নেই’ অবস্থা হয়েছিল। একবার নৈহাটি গেছেন। শ্রীশ্রীঠাকুরও সেসময় কলকাতায় অবস্থান করছেন। বিরাজকৃষ্ণ নৈহাটিতে রেলকর্মী সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাসস্থানে গেছেন এক সকালে। সুরেন্দ্রনাথের বাড়ি নবদ্বীপে। শ্রীমদ্ভাগবতে তাঁর বিশেষ পাণ্ডিত্য ছিল, সুগায়কও ছিলেন তিনি। সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ করতে করতে বিরাজকৃষ্ণ স্বভাবতই ঠাকুরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের ঈশ্বরীয় নানা গুণের, বিশেষত অন্তর্যামিত্বের কথা বর্ণনা করেন। শুনতে শুনতে সুরেন্দ্রনাথ বলে ওঠেন-আচ্ছা বিরাজবাবু, আপনার ঠাকুর তো অন্তর্যামী, ডাকুন তো তাঁকে, দেখি তো আপনার ডাকে তিনি কলকাতা থেকে এখন নৈহাটি আসেন কিনা? বিরাজকৃষ্ণ জানতেন এভাবে পরীক্ষার জন্য ঠাকুরকে ডাকা অবিধেয়, তাই তিনি প্রথমে চুপ করে থাকেন। কিন্তু তাঁদের সকলের সংশয়াত্মক অনুরোধের অতিশয্যে অবশেষে তিনি চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন সেখানে আবির্ভূত হতে। কিছুক্ষণ পরেই আবার সুরেন্দ্রনাথ অবিশ্বাসী কৌতূহলে প্রশ্ন করেন,-আপনার ঠাকুর এখন কোথায় বলুন তো? বিরাজকৃষ্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে ফেলেন- মনে হয় ঠাকুর এখন শিয়ালদা স্টেশনে, ট্রেনে উঠছেন। এর কিছুক্ষণ পরেই শ্রীশ্রীঠাকুর নৈহাটি এসে উপস্থিত হন। সুরেন্দ্রনাথ এবং তাঁর পরিবারের সকলেই যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুরেন্দ্রনাথ দীক্ষাগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এক্ষেত্রে ইংরেজি প্রবাদ “You can drag the horse to the water, but you cannot make him drink it “-টিই মনে আসে।
শ্রীশ্রীঠাকুরের নিয়ত-কর্মী, তন্নিষ্ঠ বিরাজকৃষ্ণ সহপ্রতিঋত্বিকের পবিত্র পাঞ্জা প্রাপ্ত হন; যাজন-কার্য এবং দীক্ষাদান ছিল তাঁর অস্তিত্বেরই অঙ্গ। ঠাকুরের অমিয় ভাবধারা প্রচারের আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা বিস্মৃত হলে ইতিহাসের প্রতি তঞ্চকতার অপরাধে অপরাধী হতে হবে। ঠাকুরের আদেশে তিনি নদীয়া জেলার সৎসঙ্গ আন্দোলনের জেলা-তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ কাজে তাঁকে প্রায় সারা বছরই বাইরে বাইরে ঘুরতে হত। তিন মাস অন্তর ঋত্বিক অধিবেশনে আশ্রমে তথা বাড়িতে আসতেন। সে যুগ আশ্রমের এবং কর্মীদের চরম আর্থিক কৃচ্ছুতার যুগ; একদা বিপুল সম্পদের অধিকারী বিরাজকৃষ্ণকেও পরিবার-পরিজনসহ হাসিমুখে সেই কৃচ্ছতা বরণ করতে হয়েছে। উপরন্তু, মজিলপুর থেকে আনীত যা কিছু যৎসামান্য বিষয়বস্তু ছিল, উপর্যুপরি আটবার চুরি হওয়ায় সেসবই নিঃশেষিত হয়ে যায়।
তিনি যাজন-কাজে সবসময়ই নানা স্থানে ব্যাপৃত থাকতেন; তাঁর সহধর্মিণী সরোজিনী দেবী ছেলে মেয়ে নিয়ে আশ্রম সংলগ্ন বাড়িতে বাস করতেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের স্নেহছায়ায় অভাব-অনটনের মধ্যেও মনের প্রসন্নতা ছিল অটুট।
একবার চৈত্রের শুরু থেকেই দিন আর চলে না। পূজার সময় এসে বিরাজকৃষ্ণ যেটুকু যা ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিলেন, তা শেষ হয়েছে অনেক দিনই। ছেলেটি সংসারের হাল ফেরাবার আশায় পার্বতীপুরে গিয়ে চাকুরি বা ব্যবসার চেষ্টা করছে। সরোজিনী দেবী প্রায় জঙ্গলের মধ্যে সেই বাড়িতে দুটি মেয়েকে নিয়ে অসহায়ভাবে ঠাকুরের নাম নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে মুগকলাই সিদ্ধ, শাকপাতা সিদ্ধ খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে; পরপর সাত দিন মেয়েদের মুখে ভাত দিতে পারেননি সরোজিনী; পয়সার অভাবে কেরোসিন কেনা হয় না কতকাল-সন্ধ্যা হতেই অন্ধকারে ডুবে যায় ঘরদোর সব, নির্জন নিশীথে এটা সেটা গল্প করে, ঠাকুরের কথা বলে ভোলাতে চেষ্টা করেন মেয়েদের। বড় মেয়েটি তবু খানিকটা বোঝে, মুখ বুজে সহ্য করে সব, ছোট মেয়ে কিন্তু কেবল বায়না করে ভাতের জন্য। অবশেষে অসহায়া জননী বড় মেয়েকে বলেন ঠাকুরপদ-র দোকান থেকে ধারে সব কিনে আনতে। কিন্তু সে কিছুতেই ধার করবে না, বলে-ধার করলে শোধ করব কোথা থেকে, এই তো অবস্থা! তখন ছোট মেয়েকে তিনি এই বলে ভোলান-এই তো ১লা বৈশাখে উনি আসবেন, ঘরের লক্ষ্মী ঘরে এলে সব আবার ভরে উঠবে। কত কিছু আনবেন উনি-তখন ভাত খেতে কত মজা লাগবে!
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই কালবৈশাখীর তাণ্ডব সুরু হয়ে গেল। রান্নাবাড়ার পাট নেই। দরজা বন্ধ করে মেয়েদের নিয়ে চৌকির নীচে গিয়ে আশ্রয় নিলেন সরোজিনী। হাওয়ার দাপাদাপিতে ঘর যেমন হেলছে দুলছে, কখন ভেঙে মাথায় পড়ে ঠিক নেই। পাশের বাঁশঝাড় নুয়ে পড়ছে ঝড়ের দাপটে। রান্নাঘরের বেড়াটা গেল পড়ে। এই প্রচণ্ড দুঃসময়ে দিশেহারা বিরাজ-জায়া আকুল হয়ে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলেন। দীর্ঘ সময় কেটে গেল এইভাবে-দুঃখের প্রহর দীর্ঘ বোধহয় আরও বেশি। মেয়ে দুটোও আতঙ্কে নিশ্চুপ হয়ে গেছে কখন। একসময় শান্ত হল পবনদেবতার রোষ, থামল ঝড়। নিস্তব্ধ চারিধার। হঠাৎ সদরের বাঁশের দরজা খোলার শব্দ হল ক্যাঁ-চ করে। চোর-বদমাশ কারও আগমনের শঙ্কায় ভীত সরোজিনী বন্ধ ঘরের মধ্যে রুদ্ধশ্বাসে রইলেন। অল্প পরেই দরজায় আঘাত করে কেউ বলতে লাগল- মা-ঠাকুরন, দোরটা খোলেন। নানা প্রশ্ন করে নিশ্চিত হলেন সরোজিনী দেবী যে, আগন্তুক অসদুদ্দেশ্যে অসেনি। দরজা খুললেন তিনি। আগন্তুক বলল—মা-ঠাকুরন, একটা বাতি ধরায়ে জিনিষগুলো ঘরে তোলেন।
—আর বাবা বাতি! তা, তুমি কোথা থেকে এলে, কী জিনিষ, আর কে-ই বা পাঠাল?
—আর বলেন কেন! বার হইছি সে ঝড়ের আগেই। এমন হুড়মুড়ায়ে ঝড় আলো! এসব পাঠায়েছেন বনমালী চৌধুরীর বাড়ির মা-ঠাকুরন। তেনার কী ব্রত ছিল, তার ভুজ্যি। বলেন—এসব বিরাজদার বাড়ি দিয়ায় গা (দিয়ে আয় গিয়ে)। এই রাখেন চাল, ডাল....
একে একে নামিয়ে রাখতে লাগল মানুষটা অন্ধকারেই। শেষে বলল-এই রাখেন মা, ছ’টা পয়সা-দক্ষিণা। যাওয়ার সময় বলে গেল-আলো জ্বালেন মা, অন্ধকারে কি মানুষ থাকবের পারে?
সরোজিনীর মনের সমস্ত অন্ধকার তখন দয়ালের করুণার স্নিগ্ধ কিরণে দূরীভূত হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল অন্তর-দু’চোখে নেমে এল বাঁধভাঙা অশ্রুর প্লাবন। এমনি করেই দুর্যোগের অমা পরমত্রাতার কৃপারশ্মিতে কেটে যায় ভক্তের জীবনে, দেশে দেশে কালে কালে।
নিরলস ইষ্টব্রতে নিরত বিরাজকৃষ্ণ তিন মাস অন্তর ঋত্বিক সম্মেলন উপলক্ষে যখন হিমাইতপুরে ফিরতেন, তখন প্রায়ই দেখা যেত পরিবার-পরিজনের জন্য নানারকম জিনিষপত্রের পরিবর্তে তিনি নিয়ে আসতেন থলে ভর্তি হরিতকী, দক্ষিণা হিসাবে যজমানরা তখন যা দিত। ইষ্টকর্মের আনুষঙ্গিক কৃচ্ছতা-পালন তাঁর কাছে ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক, শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশ মূর্ত করাই ছিল তাঁর কাছে পরম প্রাপ্তি।
আশ্রমে যতক্ষণ থাকতেন, শ্রীশ্রীঠাকুরের সান্নিধ্য-সুধা উপভোগ করতেন প্রাণ ভরে, মনের নানা প্রশ্নের ডালি তাঁর পায়ে নিবেদন করে তঁৎপ্রদত্ত অমিয় সমাধানে পূর্ণ করে নিতেন অন্তরের ভাণ্ডার। ঠাকুর-সান্নিধ্যের এমনই এক মনোজ্ঞ চিত্র পাওয়া যায় ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ মহাগ্রন্থে, ২২শে জুলাই, ১৯৪২-এ:
বিরাজদা (ভট্টাচার্য্য) - ঠাকুর! বিশ্বাসটা পাকা হয় কি করে?
শ্রীশ্রীঠাকুর-বিশ্বাস জিনিসটা শ্বাসক্রিয়ার মতো সহজ। ওটা এতই পাকা যে ও- সম্বন্ধে সন্দেহ, অবিশ্বাস বা প্রশ্ন আসে না। কারণ, ওটা প্রত্যক্ষ। মানুষের ভালবাসা যাতে, বিশ্বাসও তাতে। ঐ তার জীবন। তাতে অবিশ্বাস আসলে সে তো আর নেই। সদ্গুরুর সান্নিধ্যে এসে মানুষ Positively (বাস্তবে) যতটুকু তাঁকে follow (অনুসরণ) করে-Unexpectantly (অপ্রত্যাশী হয়ে), out of love (ভালবেসে)-তার ভিতর দিয়ে তার যে experience (অভিজ্ঞতা) হয়, সেই experience (অভিজ্ঞতা)-ই তাকে বলে দেয় যে, বিশ্বাসের অমনতর স্থল আর নেই। কারণ, মানুষ জীবনে অত সুখ আর কিছুতেই পায় না, অতো স্বস্তি আর কিছুতে পায় না। ঐটুকুই তার জীবনের অমৃত। তাই বিশ্বাস না করে সে যাবে কোথায়? অনেকের Love at first sight (প্রথম দেখাতেই ভালবাসা) হয়। তাদের বিশ্বাসও হয় স্বতঃ। বিশ্বাস যাকে বলে, তা একবার হলে, কখনও নষ্ট হয় না। বিশ্বাস সম্বন্ধে সত্যানুসরণে অনেক কথা আছে।
বিরাজদা-তার অনেকগুলি আমার মুখস্থ আছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-কন্ তো দেখি।
বিরাজদা-বিশ্বাসই বিস্তার ও চৈতন্য এনে দিতে পারে, আর অবিশ্বাস জড়ত্ব, অবসাদ, সঙ্কীর্ণতা এনে দেয়। বিশ্বাস যুক্তি-তর্কের পার, যদি বিশ্বাস কর, যত যুক্তি-তর্ক তোমায় সমর্থন করবেই করবে। তুমি যেমনতর বিশ্বাস কর, যুক্তি-তর্ক তোমায় তেমনতর সমর্থন করবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-বেশ সুন্দর তো!
বিরাজদা-আরও আছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর-কন্।
বিরাজদা-ভাবেই বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা। যুক্তি-তর্ক বিশ্বাসকে এনে দিতে পারে না। ভাব যত পাতলা, বিশ্বাস তত পাতলা, নিষ্ঠা তত কম।
শ্রীশ্রীঠাকুর-ভাব মানে জানেন তো? ভাব মানে হওয়া। হওয়ার পিছনে থাকে করা। যার করা যত বেশী থাকে, তার ভাব বা হওয়াও হয় ততখানি। আবার ভাবের মানে অনুরাগও হয়। অর্থাৎ, ইষ্টের জন্য করা ও ভালবাসা যার যত বেশী, তার বিশ্বাসও তত গভীর।
বিরাজদা-সব জানাশোনা সত্ত্বেও যে অনেক সময় মন টলে যায়।
শ্রীশ্রীঠাকুর-মনের রাজ্যে মানুষের ওঠাপড়া আছেই। ওদিকে খেয়াল দিতে নেই। বিশ্বাসের প্রতিকূল চিন্তা যখন মনে জাগে, তাকে কিছুতেই আমল দিতে নেই। তার অনুকূল চিন্তা যেগুলি, সেগুলিকে তখন দৃঢ়ভাবে মনের উপর আরোপ করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে সেইভাবে বলতে হয়, করতে হয়, লিখতে হয়, গান গাইতে হয়। তখন আর সেটা দাঁড়াতে পারে না। গভীর বিশ্বাসী যারা, তাদের সঙ্গ করলেও ভাল ফল হয়। বিশ্বাস হারালেই কিন্তু মানুষ নিঃসম্বল, দেউলিয়া। তার বল, শক্তি, জ্ঞান কিছু থাকে না, সে দিনে দিনে নিস্তেজ ও জড় হয়ে পড়ে।
শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে খেতে মৃদু-মৃদু হেসে বলছেন-একটা লোক চোর, ধাউড়, গুণ্ডা, বদমায়েস বা লুচ্চা হয়েও যদি একনিষ্ঠহয়, তার বরং গতি আছে। কিন্তু সে বহুনৈষ্ঠিক, যে wabbler (অস্থিরমতি), সে যদি moralist (নীতিপরায়ণ) ও হয় তবু তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। রত্নাকর বা বিল্বমঙ্গল type (ধরন)-এর যারা, তাদের জন্য কোন ভাবনা নেই। ভাবনা হলো তাদের নিয়ে, যাদের মধ্যে খোলামেলা রকম নেই, ভালবাসা নেই।
১৯৪৬ খৃষ্টাব্দের ২রা সেপ্টেম্বর শ্রীশ্রীঠাকুর দেওঘর চলে আসার পরও বেশ কিছুকাল পর্যন্ত বিরাজকৃষ্ণ হিমাইতপুরেই ছিলেন। দেশভাগের পর নৈহাটীতে এসে তাঁর যজমান সতীশচন্দ্র ঘোষ প্রদত্ত একটি বাড়িতে ওঠেন। অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে বিরাজকৃষ্ণ জ্যোতিষচর্চাও করেছিলেন। তিনি জানতেন, চৌষট্টি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুযোগ আছে, এবং এও জানতেন যে সদগুরু সান্নিধ্যে থাকতে পারলে তা কেটে যাবে। তাঁর যখন চৌষট্টি বছর বয়স, তখন স্ত্রীপুত্র সহ মজিলপুরে ছিলেন তিনি। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কোষ্ঠীফলের কথা চিন্তা করে দেওঘরে ঠাকুরের কাছে আসেন। তখনও দেওঘরে শ্রীশ্রীঠাকুরের অবস্থিতি নিতান্ত অসংগঠিত অবস্থায় ছিল; নানা লোকজন, অনেকেরই অবস্থা এলোমেলো। বিরাজকৃষ্ণ ঠাকুরকে বিব্রত না করে আপন চেষ্টায় সেখানে থাকার প্রয়াস করেন; কিন্তু নানা ঘটনাচক্রে তা সম্ভব না হওয়ায় মজিলপুরে ফিরে যান।
১৩৫৫ বঙ্গাব্দের ১৭ই আশ্বিন ইষ্টস্বার্থী, ভক্তপ্রবর বিরাজকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য পরমপদে বিলীন হন-পূর্ণ হয় একটি জীবনবৃত্ত, স্তব্ধ হয় এক কর্মচাঞ্চল্যময় ইষ্টপ্রাণ সত্তার ঐহিক প্রকাশ। কিন্তু ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’—তাঁর পার্থিব তনুর লয় হলেও তাঁর তন্ময় ইষ্টাসঞ্চারী সত্তা ইষ্টসঞ্চারণার মধ্যেই চিরবিরাজমান হয়ে থাকবে।
![]() |
_________________________
#বিরাজকৃষ্ণ_ভট্টাচার্য্য
10