সতীশচন্দ্র গোস্বামী:-
🔷 গোঁসাই অদ্ভুত এক আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখলেন ঘুমের মধ্যে...
🔷 গোঁসাই এর দর্শন হিরণ্যগর্ভ পুরুষ...
🔷 আচার্য সতীশচন্দ্র গোস্বামীকে। শ্রীশ্রীঠাকুরের এই প্রথম নিজে দীক্ষাদান...
🔷 নাস্তিক রামকৃষ্ণ গোঁসাইকে মারতে এসে পাগলের মত নেচে নেচে কীর্তনে চলেছে...
🔷 গোঁসাইয়ের কাছে মাঝে মাঝে অশরীরী আত্মার আসা-যাওয়া ছিল...
প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মমত—যেমন, ইসলাম, বৌদ্ধ, শিখ, খৃষ্টান, এসবের সঙ্গে হিন্দু ধর্মমতের একটি প্রধান পার্থক্য এই যে অন্যান্য ধর্মের কেন্দ্রে যেমন একজন মাত্র করে মহামানব আছেন, হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে তা নয়। ভিন্ন ভিন্ন দেব দেখী অথবা অবতারকে কেন্দ্র করে হিন্দুমতের একেক শাখা সৃষ্টি হয়েছে, বেড়ে উঠেছে। শ্রীকৃষ্ণকে আরাধ্য করে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য-অনুগামী সম্প্রদায় বৈষ্ণব সম্প্রদায় নামে খ্যাতি লাভ করেছে। মহাপ্রভুর একান্ত পার্ষদ পরম সাধক অদ্বৈতাচার্যের অধস্তন পঞ্চদশ পুরুষ আচার্য সতীশচন্দ্র গোস্বামী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সান্নিধ্যে এসে তাঁর বংশগৌরবের পরম্পরা সার্থকভাবে বহন করেছেন।
অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত শালগাড়িয়ার বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠ সন্তান সতীশচন্দ্রের জন্ম ১২৮১ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে, এক শুক্রবারে। পারিবারিকভাবেই একটি আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে তাঁর বেড়ে ওঠা, এছাড়াও অতিরিক্ত বৈরাগ্য ও অধ্যাত্ম-প্রবণতা ছিল সতীশচন্দ্রের মধ্যে। যখন সাত / আট বছরের বালক মাত্র, তখন অন্যঅনেকের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ-দর্শনে কলকাতায় এসেছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের গলার মালা খুলে বালকের গলায় পরিয়ে দেন-যেন চিহ্নিত করেন ভবিষ্যতের পরম ভগবদনুরাগীটিকে।
ইংরেজি স্কুলে শিক্ষালাভ করেন সতীশচন্দ্র, আবার চতুষ্পাঠীতে পড়াশুনো করে 'বিদ্যারত্ন' উপাধি লাভ করে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত সমাজেও স্থান করে নেন। টোলে পড়াশুনো করতে যেতে হত পাবনাতে, সেখানে স্কুলে যাতায়াতকারী একটি বালককে দেখে বড় ভাল লাগত। ছেলেটি দেখতে ভারী সুন্দর তো ছিলই, তাছাড়াও আরও কী যেন ছিল তার মধ্যে, বারবার চোখ পড়ত সতীশচন্দ্রের তার প্রতি।
সতীশচন্দ্রের জন্মগত বিবাগী মন উপনয়নের পরে ব্রহ্মচর্য পালনের সময় থেকেই উচ্চতর ভাবভূমিতে যায়, সংসার-বৈরাগ্য ভালভাবে বাসা বাঁধে অন্তরে। এদিকে পারিবারিক শিষ্যসংখ্যা প্রচুর, প্রায়ই কোন-না-কোন শিষ্যবাড়ি যেতে হয়। যা যা করণীয় করেন সবই, কিন্তু মনপাখি আনমনা হয়ে থাকে। দাদা মুকুন্দচন্দ্র বহুবার বলেও ভাইকে বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি। দেখতে দেখতে বয়স হল ত্রিশ বছর। ১৩১১ বঙ্গাব্দ। শিষ্যবাড়ি থেকে ফিরছেন সতীশচন্দ্র, দূর থেকে দেখেন বাড়ির সদরে নহবৎ বসেছে, উঠোনে সামিয়ানা, কোন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। বাড়িতে ঢুকে জানতে পারেন, পরের দিন তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলা হয়েছে, তাঁকে কিছু জানানো হয়নি আগে। মনের মধ্যে ভারী অস্থিরতা অনুভব করেন; একদিকে পারিবারিক মর্যাদার প্রশ্ন-কথার খেলাপ হলে তাঁর অভিভাবকদের চরম অসম্মানিত হতে হবে। আবার অন্যদিকে বাউন্ডুলে বৈরাগী মন ছটফটিয়ে ওঠে বন্ধনের আশঙ্কায়। অদ্ভুত এক এল, এবং আশ্চর্য এক স্বপ্ন দেখলেন ঘুমের মধ্যে। এক পরম রূপবান কিশোর তাঁর মাথায় হাত রেখে গভীর স্নেহে বলছেন-'ভোগের দ্রব্য সম্মুখে রেখে ত্যাগই ত্যাগ। নতুবা ত্যাগ ভ্রান্তিমাত্র।' বড় চেনা চেহারা কিশোরের - পাবনার সেই স্কুল পড়ুয়া সুন্দর ছেলেটি! ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখেন এক অপূর্ব শিহরণে শরীর-মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে। মনের অস্থিরতা দূর হল-কেমন করে যেন মনের মধ্যে একটি সুস্থিতির ভাব ফুটে উঠল। কাশীপুরের মহানন্দ চৌধুরীর কনিষ্ঠা কন্যা ইন্দুবাসিনীর সঙ্গে সতীশচন্দ্রের বিবাহ হয়ে গেল।
সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করলেও মনের গভীরের সন্ন্যাসীটি তাড়না করে ফিরতেন সতীশচন্দ্রকে। আপন-পর বোধের সীমারেখা অন্য সংসারী মানুষের মত সীমায়িত করতে পারেনি তাঁকে। পরিপার্শ্বস্থ সকলের মঙ্গল-আকাঙ্ক্ষা এবং তদনুযায়ী কর্ম তাঁর সহজাত ছিল। একারণে পারিবারিক শিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে তাঁর মান্যতা ছিল খুব বেশি। সকলেই তাঁকে চাইতেন—তিনিও বেশির ভাগ সময়ই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। ১৩১৯ বঙ্গাব্দে সতীশচন্দ্র তীর্থভ্রমণের সঙ্কল্প করেন।
বাজিতপুর ঘাটে এসে উপস্থিত হন স্টীমার ধরার জন্য। সেখানে এসে শোনেন, স্টীমার আসতে অনেক দেরি আছে। কাছেই শিষ্য পুলিন ঘোষের বাড়ি। পুলিনের একান্ত ইচ্ছা, সতীশচন্দ্র এই সময়টুকু তাঁর বাড়িতে বিশ্রাম করুন। প্রিয় শিষ্যের অনুরোধে গেলেন তিনি পুলিনের বাড়িতে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল বেড়ার গায়ে টাঙানো একটি বাণী- 'ভোগের দ্রব্য সম্মুখে রাখিয়া ত্যাগই ত্যাগ, নতুবা ত্যাগ ভ্রান্তিমাত্র।' কথাটি খুব চেনা মনে হল সতীশচন্দ্রের—কবে, কোথায় যেন শুনেছেন। বিদ্যুচ্চমকের মত মনে পড়ে গেল বিবাহের আগের রাত্রে দেখা স্বপ্নের কথা, অপরূপ এক কিশোরের কথা! বিস্মিত হয়ে পুলিনকে জিজ্ঞাসা করেন সেই বাণীর উৎসের কথা। পুলিন কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে ইতস্তত করতে থাকেন-মনে সংশয় আসে যে গুরুদেব ব্যতীত অন্য কারও প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরক্তির কথা জানলে গুরুদেব হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। এমন সময় বাড়িতে প্রবেশ করলেন তেইশ/চব্বিশ বছরের এক তরুণ-উজ্জ্বল, কমনীয় মুখখানি-সেই স্বপ্নের সুন্দর কিশোর, পাবনার সেই ছোট ছেলেটি। সতীশচন্দ্রের বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই সেই তরুণ তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করেন-দাদা, কথাটা কি ভুল বলেছি? কী উত্তর দেবেন গোঁসাই, সমস্ত শরীরে অপূর্ব আনন্দের শিহরণ জাগে, সে রাত্রের স্বপ্নদর্শনের আনন্দের স্মৃতি জেগে ওঠে। তিনি আবিষ্টের মত সেই কত দিনের আকর্ষণের মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। জানতে পারলেন, মহিমাইতপুর গ্রামের বাসিন্দা এই যুবকের নাম অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী, ইতিমধ্যেই আশেপাশের অনেকে তাঁকে 'ঠাকুর' বলে ডাকে, তাঁকে অসীম ভক্তি করে। ঠাকুর গোঁসাইকে আদরভরা সুরে বলেন-দাদা, আমার তো মনে হয়, আপনি জন্ম- জন্মান্তরে আমার ভাই ছিলেন। যাবেন কি একবার আমাদের কীর্তনের ওখানে কিশোরীর বাড়িতে? এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে দুর্দান্ত কিশোরীমোহন দাসকে বিবর্তিত করে তাঁকে উত্তরণের দিকে নিয়ে যেতে ঠাকুর কীর্তনের পরশমণি ছুঁইয়ে স্বপথে এনেছিলেন। কিশোরীমোহনের অদম্য প্রাণশক্তির মত্ততা কীর্তনের মাতনের যাদুতে বিনায়িত হয়ে উঠেছিল। তাই সেসময় প্রতি সন্ধ্যায় কিশোরীমোহনের বাড়িতে কীর্তন হত। সেখানে যাওয়ার জন্যই সতীশচন্দ্র গোস্বামীকে অনুরোধ করলেন ঠাকুর। গোঁসাই ঐ মধুর আবদারের উত্তরে কথা দিলেন যে তীর্থযাত্রা শেষে কিশোরীমোহনের বাড়ি হয়ে অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে যাবেন। ঐদিনই তাঁর তীর্থে রওয়ানা হওয়ার কথা, তাই সেদিন যাওয়া হবে না।
উত্তর ভারতের সমস্ত তীর্থ ঘোরেন গোঁসাই, কিন্তু তাঁর মন পড়ে রয়েছে অনুকূলচন্দ্রের প্রতি। তাঁর হাসিভরা মুখখানি সর্বদাই জাগরিত হয় মানসপটে। তীর্থপতির ধ্যান করতে গেলে ভেসে ওঠে ধ্যানে অনুকূলচন্দ্রের সহাস্য বদন, কানে ভাসে তাঁরই কন্ঠস্বর, 'দাদা, আমার কথা ভুলে যাবেন না কিন্তু'। দেবতার পায়ে অঞ্জলি দিতে গিয়ে দেখেন অঞ্জলি দিচ্ছেন তাঁরই শ্রীপাদপদ্মে। তীর্থে আর মন বসে না। বাড়ির পথে রওয়ানা হয়ে বাজিতপুর স্টীমার ঘাটে এসে দেখেন ঘাটে দাঁড়িয়ে পুলিনের ভাই মুকুন্দ। ঠাকুর তাকে পাঠিয়েছেন গোঁসাইকে কিশোরীমোহনের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। গোঁসাই স্তম্ভিত; আজ এই স্টীমারে ফেরার কথা অনুকূলচন্দ্র জানলেন কি ভাবে?
গোঁসাই রওয়ানা হলেন কিশোরীর বাড়ির দিকে মুকুন্দকে সঙ্গে নিয়ে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে সংকীর্তনরব, "এসো গৌরাঙ্গ নদীয়ার চাঁদ হে"। গোঁসাই ঘরে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। ঠাকুর এগিয়ে এসে গোঁসাইকে জড়িয়ে ধরে বলেন, এসেছেন দাদা? এবার চলুন বাইরে গিয়ে কীর্তন করা যাক, কীর্তনের আগুন জ্বালিয়ে দিন। ঠাকুরের উপস্থিতিতে কীর্তন জমে উঠেছে, সবাই কীর্তনানন্দে মাতোয়ারা। ঠাকুরও নাচছেন হেলেদুলে। অবাক বিস্ময়ে গোঁসাই দেখছেন ঠাকুরের গায়ের রঙ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে-লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, সবুজ ইত্যাদি সাত রঙের খেলা তাঁর শরীরে। এক একবার এক এক রঙে রঙীন হয়ে উঠছেন, কখনও আবার সপ্তরশ্মির সমন্বয়ে শ্বেতশুভ্র, কখনও বা সমস্ত রঙহীন ঘোর কৃষ্ণ। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না গোঁসাইয়ের। এর পরই ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে পড়েন। অসংখ্য আসন-মুদ্রা তাঁর শরীরে স্বাভাবিক ভাবে হতে থাকে, যার এক একটিকে আয়ত্ত করতে সাধককে করতে হয় বহু বছরের তপস্যা। আসন-মুদ্রাদির পর দেহ ক্রমশ স্থির হতে থাকে এবং অতি দ্রুত কাঁপতে থাকে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটি। তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য একজন ডাক্তারি প্রোব ঢুকিয়ে দেয় আঙুলের মধ্যে-কিন্তু ঠাকুরের ভাবের কোন পরিবর্তন হয় না। এই কঠোর নির্যাতনে শিউরে ওঠেন গোঁসাই, কাঁদতে থাকেন অঝোরে।
অবিশ্রান্তভাবে ঠাকুরের শ্রীমুখ থেকে বাণী নির্গত হয়ে চলেছে, কিন্তু সেইসব অমূল্য বাণীনিচয় অনুলিখন করে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই। অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে কত পরম ধন ভেবে দুঃখিত হন গোঁসাই। সমাধি ভঙ্গের পর ঠাকুর জল খেতে চাইলেন গোঁসাইয়ের কাছে। উৎফুল্ল গোঁসাই ঘটি মাথায় নিয়ে পদ্মায় ডুব দিয়ে জল নিয়ে এলেন ঠাকুরের জন্য, জল পানে তৃপ্ত হলেন ঠাকুর।
সেদিনের মত যে যার বাড়ি ফিরে যান। গোঁসাই শ্রীশ্রীঠাকুরের অন্তরঙ্গ পার্ষদ অনন্তনাথকে এই মহাভাববাণী সংকলনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এবং পরে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৩২১ বঙ্গাব্দের ৩১শে জ্যৈষ্ঠ থেকে বাণী অনুলিখনের কাজ শুরু হয়।
গোঁসাই আসেন কাশীপুরে শ্বশুরালয়ে। রাত্রে তাঁর ঘুম হল না, ভাবেন শুধু ঠাকুরের কথা। সমাধিস্থ অবস্থায় অনুকূলচন্দ্র কথা বলেন, এতো শ্রীপুরুষোত্তমের লক্ষণ! আর বিলম্ব নয়-এবার সময় এসেছে তাঁকে গ্রহণ করার। ভোরে উঠে স্নান করে ঠাকুর ঘরে আসেন রাধাগোবিন্দর পূজা করতে। কৃষ্ণ নাম করতে গিয়ে করেন অনুকূল নাম -সবই তাঁর ভুল হয়ে যাচ্ছে, মনপ্রাণ সবকিছু জুড়ে আছেন শুধু ঐ একজন। পুজোর ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য দরজায় হাত রেখে এক পা তুলেছেন, কিন্তু পা নামাতে পারছেন না, দেখছেন সেখানে অনুকূলচন্দ্রকে, পা ফেললেই যে তাঁর গায়ে লাগবে; হাত নামাবেন, তারও উপায় নেই, বাহুর তলায় ঠাকুরের শ্রীমুখখানি; সর্বত্র তিনি পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন। নিশ্চল হয়ে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন গোঁসাই, অঝোরে ঝরে চলে প্রেমাশ্রু।
জামাতাকে ঠাকুর ঘর থেকে বেরোতে না দেখে চিন্তায় পড়েন শ্বশ্রূমাতা রাধারাণী দেবী। তিনি ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঐ অবস্থায় সতীশচন্দ্রকে দেখে এবং ডেকেও সাড়া না পেয়ে অত্যন্ত ভয় পেয়ে যান, ভাবেন-সতীশচন্দ্র পাগল হয়ে গিয়েছেন। খবর পাঠানো হয় অনন্তর কাছে। অনন্ত সব শুনে বোঝেন এ কোন্ ব্যাধি, তিনি নিজেও তো ভুক্তভোগী, ঐ একই ব্যাধির শিকার। মহা আনন্দে অনন্ত ছুটে আসেন গোঁসাইয়ের কাছে, তাঁকে জড়িয়ে ধরে নাচতে থাকেন। গোঁসাইয়ের ঘোর ভাঙে, ভাবেন- আর কোন অন্তরাল নয়, প্রত্যক্ষভাবে চাই তাঁকে। মহারাজ অনন্তনাথ গোঁসাইকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে-নিজের রান্না হবিষ্যান্ন দুভাগ করে নিয়ে একে অপরকে খাইয়ে দেন পরম আদরে।
সন্ধ্যায় দুজনে এলেন ঠাকুরবাড়িতে। গোঁসাই জড়িয়ে ধরেন ঠাকুরের চরণ- যুগল, ঠাকুর তাঁকে বুকে তুলে নিলেন। ইতিমধ্যে কিশোরীমোহন এসে পড়লেন সদলে জয়ঢাক সহ তুমুল নিনাদে কীর্তন করতে করতে। ঠাকুর যোগ দিলেন কীর্তনে অনন্ত মহারাজ ও গোঁসাইকে সঙ্গে নিয়ে। কীর্তন জমে উঠল, পরপর দু'বার ঠাকুর সমাধিস্থ হলেন, তবে এদিন কোন বাণী প্রকাশ হয়নি। কীর্তনের পর রসগোল্লা প্রসাদ পেলেন ভক্তরা-মহারাজ, গোঁসাইও প্রসাদ নিলেন পাত্র থেকে।
রাত্রে ঠাকুর গোঁসাইকে নিয়ে এলেন হিমাইতপুর নিজের বাড়িতে। শ্রীশ্রীঠাকুর-
জননী মাতা মনোমোহিনী সাদরে গ্রহণ করেন তাঁর এই নতুন পুত্রটিকে। পাশাপাশি বসে আহার শেষ করেন ঠাকুর ও গোঁসাই। গভীর রাত্রে ঠাকুর গোঁসাইকে নিয়ে এলেন পদ্মাতীরে নিমতলায়। গোঁড়া বৈষ্ণব হলেও গোঁসাই কালী পূজাও করতেন, দেখতেন জগজ্জননীর মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিকাশ। ঠাকুর গোঁসাইকে জিজ্ঞাসা করেন, দাদা নাকি কালীপূজায় সিদ্ধ? গোঁসাই জানালেন তিনি কালীপূজোও করেন। এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর কালী, তারা, ত্রিপুরা প্রভৃতি দশমহাবিদ্যার রূপ বর্ণনা আরম্ভ করে বীরাচারী ও দিব্যাচারী সাধন পদ্ধতির গূঢ় তত্ত্ব বলতে থাকেন-উদ্ঘাটন করেন পঞ্চমকার ও ষচক্রের রহস্য। তন্ময় হয়ে শুনতে থাকেন গোঁসাই, মনে হয় জগজ্জননী স্বয়ং যেন চরম গূঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে চলেছেন। ঠাকুর হঠাৎ বলেন, দাদা তো এই মন্ত্র জপ করেন, তাই না? তাঁর অজানা কিছুই নয়, আবার জানলেন গোঁসাই। তিনি সর্বব্যাপী, সর্বত্রগামী, অন্তর্যামী, ধরাধামে অবতীর্ণ পুরুষোত্তমরূপে।
ঠাকুর গোঁসাইকে বললেন তাঁর সামনে বসে জপ করতে। গোঁসাই জপধ্যান আরম্ভ করলেন, ঠাকুর তাকিয়ে আছেন অপলকে মুখের দিকে। তরতর করে সুরত চড়ে যাচ্ছে, যচক্র, সপ্তস্বর্গ ভেদ করে মন আরোহণ করছে আরও ঊর্ধ্বে, সহস্রার,বঙ্কনাল পার হয়ে কত নাদ, ধ্বনি-তারপর অপরূপ জ্যোতিতরঙ্গের খেলা। সম্মুখে হিরণ্যগর্ভ পুরুষ-যাঁর অঙ্গজ্যোতি দিদিগন্তে বিচ্ছুরিত হয়ে কোটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করছে, যাঁর প্রতি রোমকূপে হিরণ্যবর্ণ জ্যোতিষ্ক-মণ্ডলী, যাঁর চতুষ্পার্শ্বে ধ্বনিত হচ্ছে অশ্রুতপূর্ব নাদব্রহ্ম-এই তো সেই পুরুষ-এ যে অনুকূলচন্দ্র! বাহ্য সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেন গোঁসাই। ঠাকুর ডাক দিলেন, নিন দাদা, উঠুন, ঢের হয়েছে। আর কেন? জ্ঞান ফিরে পেয়ে গোঁসাই দেখলেন তিনি তখনও জপ করে চলেছেন-কিন্তু এ জপ তো তিনি আরম্ভ করেননি! তিনি আরম্ভ করেছিলেন নিজের ইষ্টমন্ত্র জপ ও কৃষ্ণমূর্তির ধ্যান দিয়ে, কিন্তু এখন তিনি জপ করছেন এক নতুন নাম যা তিনি আগে কখনও শোনেননি, আর ধ্যান করছেন ঠাকুরের। তৃষিত হৃদয়ে পেলেন এক অবর্ণনীয় আনন্দানুভূতি, যার কোন উপমা নেই।
ভোর হয়ে এল-ঠাকুর গোঁসাইকে নিয়ে এলেন কাঠের ঘরের দোতালায়, নিজে হাতে দরজা বন্ধ করে বললেন, এবার হ'ল তো? লেগে পড়েন। 'কী হ'ল'- গোঁসাইয়ের এই জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেন—কী পেলেন কাল রাত্রে নিমতলায়-কী দেখলেন-কী বুঝলেন? গোঁসাই আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে, তাঁরশ্রী চরণে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে ফেলে বললেন, আমাকে দয়া করে আশ্রয় দিন! 'আশ্রয় তো দেওয়াই আছে শালা। আশ্রয় না দিলে তুমি পেলে কোথায়? দেখাল
কে?'-'আপনি' থেকে 'তুমি'-তে নেমে এলেন ঠাকুর। বললেন—আর বসে থাকলে চলবে না, এবার ঝাঁপিয়ে পড় পরমপিতার কাজে। ঢের সময় গেছে, আর নয়। আকুল হৃদয়ে গোঁসাই বলেন, আমাকে দয়া করে আপনার যোগ্য করে নিন। এবার 'তুমি'থেকে 'তুই'-তে নেমে এসে পরম রসিকটি বলেন, যোগ্য তো হয়েই আছিস শালা, না হলে কি আর ও পাওয়া যায়? পরমুহূর্তেই বয়সের মর্যাদা রক্ষা করতে ফিরে গেলেন 'আপনি' সম্বোধনে। বললেন-জানা তো হয়ে গেছে সব- আর একবার শুনে নিন। সেদিনের তারিখ ছিল ২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩২১ বঙ্গাব্দ। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র স্বয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা দিলেন শ্রীমৎ আচার্য সতীশচন্দ্র গোস্বামীকে। শ্রীশ্রীঠাকুরের এই প্রথম নিজে দীক্ষাদান।
দীক্ষাগ্রহণের পর গোঁসাই ফিরে এসেছেন তাঁর নিজের বাড়ি শালগাড়িয়ায়। ধ্যান, জপ চলতে থাকে নিয়ত, জ্যোতিদর্শন, নাদ শ্রবণও হয়, কিন্তু সেই অভূতপূর্ব অনুভূতি কোথায়, যা তিনি পেয়েছিলেন পদ্মাতীরে নিমতলায়? তবে কি তিনি সব দিয়েও ফিরিয়ে নিলেন? ব্যাকুল হয়ে ওঠেন গোঁসাই। ভাবেন, সেদিন তাঁর অহৈতুকী করুণায় যা পেয়েছিলেন, সাধনার দ্বারা তা অর্জন করতে হবে। কঠোর তপস্যা আরম্ভ করেন তিনি। এদিকে ঠাকুরও ব্যাকুল হয়ে ওঠেন গোঁসাইয়ের জন্য। লোকের পর লোক পাঠান, তারা ফিরে এসে বলে জপধ্যানে ডুবে আছেন গোঁসাই। কিন্তু ব্যক্তিগত অধ্যাত্ম-আনন্দ তো লক্ষ্য নয়, চাই কর্ম, তীব্র গতিতে কর্ম। ঠাকুরের যে এখনই প্রয়োজন এই শিষ্যটিকে মানবকল্যাণার্থে-গোঁসাই ঝাঁপ দিলে তবেই শুরু হবে কাজ, নতুবা তাঁর কাজের যে দেরি হয়ে যাবে!
৬ ই শ্রাবণ, ১৩২১ বঙ্গাব্দের সন্ধ্যায় কিশোরীমোহনের বাড়িতে সমবেত হয়েছেন অনেকে। ঠাকুর এসেছেন মহারাজকে সঙ্গে নিয়ে। পরমভক্ত যতীশ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করেন গোঁসাইয়ের কথা, শুনলেন তিনি সাধনায় নিমগ্ন হয়ে আছেন। কীর্তন শুরু হল; কীর্তনের চরম পর্বে সমাধিস্থ হলেন ঠাকুর। কিশোরীর মনে প্রশ্ন, ঠাকুর গোঁসাইয়ের জন্য এত ব্যস্ত কেন? অদ্বৈত বংশের সন্তান, সেই কি অদ্বৈত প্রভু? ঠাকুরের কন্ঠে উচ্চারিত হল, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই। অদ্বৈত মহাপ্রভু। ও ঝাঁপ দিলে প্রকৃত প্রচার আরম্ভ।' পরবর্তীকালে এ বিষয়ে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, সমাধিস্থ অবস্থায় তিনি যা বলেন, তাতে তাঁর কোন স্বাধীনতা নেই, তাই সে কথার দায়িত্বও তিনি নিতে পারেন না।
পরদিন ঠাকুর নিজেই গেলেন গোঁসাইয়ের বাড়ি, সঙ্গে অনন্ত মহারাজ, কিশোরীমোহন ও কীর্তনের দল। শুরু হল তুমুল কীর্তন। সেযুগের কীর্তনের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এককথায় ঠাকুরের উপস্থিতিতে সৎসঙ্গের আদিযুগের সেই তাণ্ডব কীর্তন অবর্ণনীয়, অকল্পনীয়। নৃত্য করছেন কিশোরীমোহন কখনও এগিয়ে, কখনও পিছিয়ে, কখনও বা হুঙ্কার দিয়ে ঢাকের উপর লাফিয়ে উঠে নেচে চলেছেন। তালে তালে লাফিয়ে উঠছেন মহারাজ, অথচ হাঁটু ভাঙছে না, পা বাঁকছে না, রবারের মূর্তির মতন পা মাটিতে ঠেকা মাত্র লাফিয়ে উঠছেন শূন্যে-ধ্যানস্তিমিত নেত্র, হাস্যময় প্রশান্ত মুখ। গোঁসাইও যোগ দিয়েছেন কীর্তনে-তুমুল তাণ্ডব নৃত্য, কন্ঠে হুঙ্কার, কখনও ঢাকসুদ্ধ ঢাকীকে বনবন করে ঘোরাচ্ছেন, কখনও বা কাউকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিচ্ছেন-কাউকে কাঁধে তুলছেন, কারও কাঁধে উঠছেন-এ যেন শিব তাণ্ডবের দুরন্ত রূপ! হেলে দুলে নাচছেন ঠাকুর-দেহে জ্যোতিতরঙ্গের খেলা-অস্থিহীন, গ্রন্থিহীন, অপরূপ ছন্দোময় নৃত্য। ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে পড়লেন—মহাভাববাণীতে উচ্চারিত হল-'কৰ্ম্ম, কৰ্ম্ম চাই, কর্ম্ম। যত কৰ্ম্ম, তত অগ্রসর। তোরা কি জানিস? ভগবানের বাহু। প্রচার করতে তোদের তৈরী, কুড়িয়ে নিতে। ঐ শোন, ঐ দ্যাখ, পূর্ণত্ব প্রাপ্তি অতি নিকটে।
'শালগাড়িয়ায় বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হয়-অগণিত মানুষ ভূলুণ্ঠিত হয় দয়াল ঠাকুরের শ্রীচরণে। এবার ঠাকুর গোঁসাইকে নিয়ে ফিরে এলেন হিমাইতপুরে। গোঁসাই ঠাকুরের কাছে মিনতি করেন-দয়াল আমার যখন পরম সৌভাগ্য হয়েছে আপনাকে লাভ করার, তখন যারা আমার কাছে পূর্বে দীক্ষা নিয়েছে বা পরে নেবে, তাদের এই সৎনাম দেওয়ার অনুমতি দিন আমাকে। ঠাকুর বলেন, গোঁসাইদা, প্রথম প্রচারের দায়িত্ব কিন্তু অনেক, বহু সইতে হয় প্রথম পথিকৃৎকে। গোঁসাই বলেন-রোগ- শোক-দারিদ্র্য-যন্ত্রণা, আজীবন এ মোর উপাসনা। তথাপি প্রচার তব আমার কামনা। শ্রীশ্রীঠাকুর মহারাজ ও গোঁসাইয়ের দীক্ষা দেওয়ার অনুমতি আনিয়ে দিলেন আগ্রায় লিখে, কারণ সেখানেই এই সৎনাম প্রথম প্রচারিত হয়। প্রচার আরম্ভ করেন গোঁসাই এতদিন দীক্ষা দিতেন নিজে গুরু হয়ে, এখন দীক্ষা দেন গুরুর প্রতিনিধি হিসাবে তাঁরই আদেশে। বহুধা-বিস্তৃত সৎসঙ্গ আন্দোলনের সূত্রপাত হল এই সময় থেকে।
১৩২২ সাল, গোঁসাই এসেছেন বারাদীতে। এখানে এসে কঠিন অসুখে পড়লেন, বিয়াল্লিশ দিন শয্যাশায়ী। খোকা ডাক্তার দেখে গিয়েছেন, কুষ্টিয়া থেকে বড় ডাক্তাররাও এসে দেখে যান-কিন্তু কোন আশার আলো পান না কেউ। হাত পা নাড়াবার ক্ষমতা নেই গোঁসাইয়ের। ঠাকুরকে খবর দেওয়া হল-ঠাকুর মহারাজ ও কিশোরীকে সঙ্গে নিয়ে এলেন কুষ্টিয়ায়, সঙ্গে ঢাক ও বাদ্যযন্ত্র ও কীর্তনের দল। কিশোরী কীর্তনের দল নিয়ে কীর্তন করতে করতে চললেন বারাদীতে। ঠাকুর ও মহারাজ যাবেন কিছু পরে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ঢাকের শব্দ; ভয় পেলেন গোঁসাইয়ের পরিচর্যাকারীরা, ভাবলেন ঢাকের প্রচণ্ড শব্দে হয়তো রোগীর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে। কীর্তনের দল এসে পড়েছে, বাধা দিতে গেলেন কয়েকজন—কিন্তু বাধা মানবে কে? কিশোরী সদলে এসে পড়লেন গোঁসাইয়ের ঘরের সামনে উঠোনে। আরম্ভ হল তুমুল কীর্তন। হঠাৎ অসুস্থ গোঁসাই এক লাফে দরজা ও বারান্দা পার হয়ে পড়লেন গিয়ে কীর্তনের মাঝে। দুই হাতে দুটো ঢাক ধরে বাদক সহ ঘোরাতে থাকেন বন বন করে-কণ্ঠে তাঁর ভীম গর্জন। সবাই ভাবল অসুখের বিকার-এবার পড়বেন আর প্রাণ হারাবেন। ঠাকুরও নেমেছেন কীর্তনে মহারাজকে নিয়ে। অনেকক্ষণ চলল সেই তাণ্ডব কীর্তন। গোঁসাই পড়লেনও না, মরলেনও না, ফিরে পেলেন তাঁর সুস্থ শরীর, রোগের কোন লক্ষণই আর নেই তখন তাঁর শরীরে।
১৩২৪ সালের মাঘ মাস। সন্ধ্যায় ভক্তবৃন্দ সমবেত হয়েছেন কুষ্টিয়ার কলাবাগান আশ্রমে। গোঁসাই খিচুড়ি ভোগ রান্না করছেন-ঠাকুরকে ভোগ নিবেদনের পর প্রসাদ পাবেন ভক্তরা। কয়েকজন ভক্ত ধরে বসলেন গোঁসাইকে, ঠাকুর ভোগ চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করতে চান তাঁরা। গোঁসাই বললেন, তোমরা যদি আমাকে কীর্তনে মাতাল করে দিতে পার তবে তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। কীর্তন আরম্ভ হল, গোঁসাই ভাবাবেশে কীর্তন করে চলেছেন-সঙ্গে ভক্তরা। এদিকে ঠাকুর হিমাইতপুরে ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন। মাঘ মাসের শীত, রাত্রি তখন প্রায় আটটা, হঠাৎ ঠাকুর বললেন-কুষ্টিয়া যাব। বলা মাত্রই শুরু হল যাত্রা-সঙ্গে কিশোরী, মহারাজ, যদু পাল ও আরও কয়েকজন ভক্ত। দীর্ঘ নয় মাইল চড়া হেঁটে, খেয়া নৌকোয় দুটি নদী পেরিয়ে রাত দশটায় কলাবাগান আশ্রমে এসে পৌঁছলেন ঠাকুর। পাথরের থালায় ভোগ সাজিয়ে বসে আছেন সতীশচন্দ্র ঠাকুরের প্রতীক্ষায়, রাত বাড়ছে দেখে ভক্তরা অনেকেই খেতে বসে গেছেন। এমন সময় ঠাকুর এসেই বললেন-শীগগির খেতে দে, বড্ড খিদে পেয়েছে। হাতমুখ ধুয়ে ভোগে বসলেন তিনি।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলতেন, কীর্তনের একটা শক্তি আছে-জোর করে মনকে উচ্চে নিয়ে যায়। কীর্তন দিয়েই ঠাকুর আরম্ভ করেন এবারের তাঁর নরলীলা। কীর্তনের দল নিয়ে আচার্য সতীশচন্দ্র গোস্বামী নলডাঙায় গিয়েছেন প্রচারে। কীর্তন চলছে প্রবল বেগে, নামের অনলে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আলোড়ন। দলে দলে ধর্মপিপাসু মানুষের দল এসে দীক্ষা নিয়ে জীবন সার্থক করছেন। কাছেই ছিল পতিতাপল্লী-সেখানকার এক পরমা সুন্দরী রমণী অনুতাপের তুষানলে দগ্ধ হয়ে উন্মাদিনীর মত কীর্তনের মধ্যে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল গোঁসাইয়ের পা। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল- আমাকে উদ্ধার করুন, আমাকে রক্ষা করুন বাবা, বলে দিন আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী! গোঁসাই তাকে আশা দিলেন, আশ্বাস দিলেন, ভরসা দিলেন। শোনালেন দয়াল ঠাকুরের অভয় বাণী-জীব, তোর চিন্তা কী? তোর ভয় কী? মহাপাপ করে থাকিস ক্ষতি নাই। আমাকে বিশ্বাস কর, আমাকে তোদের অন্তরে স্থান দে-আমি সব পাপতাপ মুছে দেব। পরম আশ্বস্ত হয়ে রমণীটি ঠাকুরের চরণে আত্মসমর্পণ করেন এবং যথাসর্বস্ব দান করে মস্তক মুণ্ডন করে ঈশ্বরের নামগানে আত্মস্থ হন।
সাময়িক ভ্রান্তিতে কোন নারীর বিচলন ঘটলে সমাজ তাকে পরিত্যাগ করত, আত্মীয়-স্বজন কারোর কাছেই তার আর আশ্রয় মিলত না। এদের আশ্রয় ছিল গোঁসাইয়ের কাছে। তিনি বলতেন, এদের ছেড়ে দিলে এরা আরও অধঃপতনের পথে চলে যাবে, এদের দ্বারা বহুলোক কলুষিত হবে, অজস্র বর্ণসংকরে ভরে যাবে দেশ। বরং এদের আশ্রয় দিয়ে আদর্শের পথে উদ্বুদ্ধকরতে পারলে মঙ্গল হবে সব দিক দিয়ে
কীর্তনের অমিত শক্তির বহু পরিচয় কীর্তনসাধক আচার্য সতীশচন্দ্রের জীবনে পরিব্যাপ্ত। কীর্তনরত অবস্থায় স্পর্শ করে কতজনের জীবনে যে তিনি কত অঘটন ঘটিয়েছেন তার শেষ নেই। একবার বরইচারা গ্রামের জানকী হালদার অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে নাম চিকিৎসার সাহায্য চেয়ে খবর পাঠান। শ্রীশ্রীঠাকুর আমলাপাড়ার রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে জানকীর চিকিৎসার জন্য যেতে বলেন। রামকৃষ্ণ কিন্তু সাহস পায় না - ভাবে সে কী করে পারবে! ঠাকুর তাকে স্পর্শ করে ভরসা দেন-নিশ্চয়ই পারবি, চিন্তা নেই। ঠাকুরের নির্দেশে সে অবশেষে বরইচারা গিয়ে জানকীকে স্পর্শ করে নাম করতে করতে রোগীকে আরোগ্য করে ফিরে আসে। এই রামকৃষ্ণ বিশ্বাস সতীশচন্দ্রের কীর্তন-যাদুর এক দৃষ্টান্ত। সে জাতিতে ছিল নাপিত, জাতব্যবসা ছেড়ে জমিদারি সেরেস্তায় চাকরি করত; দুর্দান্ত প্রকৃতির নাস্তিক ছিল সে। গোঁসাই নগর-কীর্তন নিয়ে পথ পরিক্রমা করতে করতে তার বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হতেই এক মোটা লাঠি হাতে ছুটে এল গোঁসাইকে মারবে বলে, কিন্তু তাঁকে স্পর্শ করা মাত্র তার হল অদ্ভুত দশা-সমগ্র পৃথিবী যেন টলে উঠল, চারপাশের সব কিছু আলোকিত হয়ে উঠল, কিছু বোঝার আগেই দেখা গেল পাষণ্ড রামকৃষ্ণ বিশ্বাস পাগলের মত নেচে নেচে কীর্তনে চলেছে সবার আগে আগে। অচিরেই দীক্ষা নিল সে আর হয়ে উঠল নামধ্যান-পরায়ণ পরম ভক্ত; গোঁসাইয়ের নিত্য সহচর হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তাঁরই সেবায় দিন কাটতে লাগল তার।
বরইচারা গ্রামেই ছিল শ্রীশ্রীঠাকুরের পরম ভক্ত ডাক্তার সতীশ জোয়ারদার, তাঁর ভাই রাধারমণ জোয়ারদার-এঁদের বাড়ি। রাধারমণ-জায়া সরোজিনীর একান্ত আকুল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ঠাকুর একবার তাঁদের গৃহে এসেছেন অন্যান্য অনেক ভক্ত ও পার্ষদ সহ। গোস্বামী সতীশচন্দ্রও আছেন সঙ্গে। সেখানে নাটমন্দিরে শুরু হল কীর্তন-কীর্তনের কম্পনে সমস্ত পরিবেশ প্রকম্পিত হতে লাগল। এমন সময় সেখানে রতনলাল নামে এক হিন্দুস্থানী এসে উপস্থিত হল-সরকারী খাজনা আদায় করার কাজ তার। সাড়ে ছ' ফুট লম্বা বলিষ্ঠ দেহী রতনলালকে গৃহকর্তা রাধারমণ অনুরোধ জানান সেদিন সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজনের। কিন্তু রতনলাল অত্যন্ত গোঁড়া, বাঙালীর ছোঁয়া রান্না সে খায় না। রাধারমণ জানান যে সদ্ ব্রাহ্মণ সব কিছু রান্না করছে, স্বয়ং শ্রীশ্রীঠাকুরের ভোগ হবে সেখানে। কিন্তু রতনলালের ঐ এক গোঁ-বাঙালির ছোঁয়া সে খাবে না। বিরক্ত হলেন রাধারমণ-তাকে বলেন যে এমন নামকীর্তন যাঁরা করছেন, তাঁদের যে-কারো প্রসাদ পাওয়াই ভাগ্যের কথা, আর স্বয়ং ঠাকুরের প্রসাদ পেলে তো তার বংশ উদ্ধার হবে। এ কথা শুনে ক্রুদ্ধ রতনলাল নামকীর্তনরত গোঁসাইকে লক্ষ করে ছুটে যায়—চেপে ধরে তাঁকে, উদ্দেশ্য-এদের ভণ্ডামি ভেঙে দেবে সে! কিন্তু ঐ দৈত্যোপম রতনলাল তাঁকে চেপে ধরতেই কীর্তন করতে করতে গোঁসাই রতনলালকেই বগলে চেপে আনন্দে নাচতে লাগলেন, তারপর সজোরে নিক্ষেপ করলেন প্রাঙ্গণে। সেখানে পড়েই রতনলাল উচ্চকণ্ঠে কীর্তন করতে লাগল, সঙ্গে উম্মাদ-নৃত্য। কীর্তনের পরে স্নানাহার পর্ব; ঠাকুর ভোগ হয়ে যাবার পরে ভক্তরা আহারে বসবে। গোঁসাই সেসময় রাধারমণকে বললেন রতনলালের সন্ধান নিতে। দেখা গেল-বাইরে বসে অঝোরে কাঁদছে সে, আর নাম করে চলেছে অবিরাম। রাধারমণকে দেখতে পেয়েই পরম আগ্রহে জানতে চাইল-ঠাকুর-ভোগ হয়ে গেছে কিনা এবং সে প্রসাদ পাবে কি না। রাধারমণ তখন তাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ঠাকুর তাঁর প্রসাদের থালা ধ'রেই রতনলালকে দিতে বললেন। রতনলাল মহা আনন্দে সে প্রসাদ গ্রহণ করে ধন্য হল। তারপর দীক্ষা নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এল আশ্রমে।
কীর্তনের আশ্চর্য প্রাণদায়ী ক্ষমতার আর এক প্রকাশ বর্ণিত হচ্ছে। কুষ্টিয়ার অন্তর্গত এক গ্রামে বিষ্ণুপদ বিশ্বাস নামে একজন ইষ্টভ্রাতাকে একবার মহাবিষধর কালকেউটে দংশন করে। তৎক্ষণাৎ বাঁধা হয় কামড়ানো জায়গার কাছে-চিকিৎসক এসে অপারেশন করে বিষ বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন, ইঞ্জেকশনও দেন। কিন্তু তার জীবনের লক্ষণ ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে; অতঃপর ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করানো হয় শেষ চেষ্টা হিসাবে—কিন্তু সবই বিফল হয়-ক্রমেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকে তরতাজা যুবক বিষ্ণুপদ। বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। এমন সময় হঠাৎই সেখানে হাজির হলেন আচার্য্য সতীশচন্দ্র। তাঁকে দেখে সকলের কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। সতীশচন্দ্র অবিলম্বে কীর্তনের আয়োজন করতে আদেশ দেন। সেইমত শুরু হল কীর্তন। জমে উঠল কীর্তন, গোঁসাই নিমগ্ন হলেন তাতে। এরপরেই বিষ্ণুর মৃতপ্রায় দেহখানি এক হেঁচকা টানে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে কীর্তন ও নৃত্য করতে থাকেন বিপুল বেগে - সতীদেহ স্কন্ধে শিবের তান্ডব নৃত্যের মত। দীর্ঘকাল কীর্তন করতে করতে বিষ্ণুর দেহে ক্ষীণ স্পন্দন ফিরে এল-ক্ষীণভাবে অনুভব করে সে যেন পদ্মার ঢেউয়ের মাথায় একবার উঠছে আবার নামছে। তার চেতনা ফিরে আসছে বুঝতে পেরে গোঁসাই দেহটি মাটিতে নামালেন—কিন্তু তখনই আবার অচেতন হয়ে পড়ে সে। আবার কাঁধে তুলে নিয়ে শুরু হল নাচ ও কীর্তন-সে কীর্তনের উম্মাদনায় উন্মত্ত হয়ে উঠল উপস্থিত অন্যান্য সকলেও। ক্রমে বিষ্ণুর জ্ঞান সম্পূর্ণ ফিরে এল-স্মরণে এল সর্প দংশনের কথা; দেখল, গোঁসাই তাকে কাঁধে করে নেচে চলেছেন তখনও। অতঃপর নেমে পড়ল সে গোঁসাইয়ের কাঁধ থেকে- সাশ্রুনয়নে প্রণাম করল প্রাণদাতাকে।
একবার শিবচতুর্দশীতে সতীশ জোয়ারদার, রাধারমণ জোয়ারদার এবং অন্যান্য কয়েকজন উপবাস করেন। সন্ধ্যাবেলা মাটির শিব গড়িয়ে তার মাথায় জল দেওয়ার উদ্দেশ্যে পদ্মার বাঁধের দিকে যাচ্ছিলেন তাঁরা। গোঁসাই বসে কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। ঠাকুরও ছিলেন কাছেই। শিবপূজার উদ্দেশ্যে যাওয়া ভক্তদলকে ডেকে ঠাকুর গোঁসাইকে ইঙ্গিত করে বলেন-মূর্তিমান চলন্ত শিব থাকতে আপনারা কোথায় পূজো করতে যাচ্ছেন?
ঠাকুরের এ কথায় ভক্তবৃন্দ গোঁসাইয়ের সামনে গিয়ে তাঁর পায়েই অঞ্জলি দিয়ে শিবপুজো সমাপ্ত ক'রে, প্রণাম করে গৃহে ফিরে উপবাস ভঙ্গ করেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের 'চলন্ত শিব' সতীশচন্দ্র তাঁর গুরুর মতই লোকপালী ছিলেন। ১৩৫০-এর নিদারুণ দুর্ভিক্ষে বাংলায় লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি হয়েছিল। কিন্তু ঠাকুরের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির প্রসাদে সৎসঙ্গীবৃন্দের তেমন দুর্দশা হয়নি।
এই দুর্ভিক্ষে ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ ভক্তদের অন্যতম কিশোরীমোহন দাসের অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা চিরস্মরণীয়। তিনি নিজে সারাদিন ভিক্ষা করে সেই ভিক্ষালব্ধ দানে অগণিত বুভুক্ষুর খাদ্য জুগিয়েছেন। সতীশচন্দ্রও আশ্রমস্থ যেসব পরিবার সংকোচবশত চাইতে পারতেন না, তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দৈনন্দিন সাহায্য দিয়ে আসতেন। পৌরোহিত্য বা প্রণামীর অর্থে না কুলোলে ভিক্ষা করে অর্থসংগ্রহ করে উপবাসী পরিবারগুলিকে নিয়ত সহায়তা করতেন।
গুরুকে বা ইষ্টকে যেমন সবদিক থেকে সর্বদা বহন করে চলতেন সতীশচন্দ্র, গুরুও তেমনই তাঁর প্রাণপ্রিয় ভক্তটির আধিব্যাধিতে ব্যাকুল হয়ে উঠতেন।
একবার সতীশচন্দ্রের কোমরে অত্যন্ত ব্যথা হয়েছে। বসলে উঠতে কষ্ট হয়, উঠলে বসতে কষ্ট হয়। ব্যথা যায় না কিছুতেই-কষ্ট পাচ্ছেন সতীশচন্দ্র। ঐ অবস্থা লক্ষ করে শ্রীশ্রীঠাকুর একদিন জিজ্ঞাসা করেন, সতীশদা, আপনার কী হয়েছে? ঠাকুরের কথা শুনে সতীশচন্দ্র ঠাকুরের পা দুখানি দু'হাতে স্পর্শ করে বললেন-আপনি আর সেকথা জিজ্ঞাসা করবেন না। সতীশচন্দ্রের একথা এভাবে বলার কারণ যে তিনি বিশেষভাবে জানেন যে, ঠাকুর অনেক সময়ই অপরের রোগ নিজের শরীরে গ্রহণ করে থাকেন, তাই তিনি তাঁর ব্যথার কথা ঠাকুরকে জানাতে চান না। এরপর জলযোগ গ্রহণের কিছুক্ষণ পর সতীশচন্দ্র উঠতে গিয়ে দেখলেন তাঁর আর কোন কষ্ট হচ্ছে না, ব্যথা সম্পূর্ণ দূরীভূত। কিন্তু ঠাকুরের কোমরে অত্যন্ত ব্যথা দেখা দিল। গুরুগতপ্রাণ সতীশচন্দ্র গভীর দুঃখে ঠাকুরকে বললেন, আমি তো বললাম আমার কথার কথা আপনার শুনে দরকার নেই। এই দেখুন, আমার ব্যথা সেরে গিয়ে আপনার হল। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, অনেক সময় ঠাকুরকে রোগব্যাধির কথা না জানালেও তাঁর মনোযোগ কোনভাবে আকৃষ্ট হলেই অপরের রোগ যন্ত্রণা তাঁর দেহে প্রকাশ পেত।
গোঁসাইয়ের কাছে মাঝে মাঝে অশরীরী আত্মার আসা-যাওয়া ছিল। গোঁসাইয়ের সঙ্গে তাদের বার্তাবিনিময় হত। একবার রাজশাহীর নওগাঁয় বিভূতিভূষণের বাড়ির বারান্দায় গোঁসাই ঘুমোচ্ছিলেন। গভীর রাত্রে বিভূতিভূষণের স্ত্রীর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ঘরের মধ্য থেকে শুনতে পেলেন, গোঁসাই কারও সঙ্গে কথা বলছেন। কৌতূহলবশত জানালা খুলে দেখলেন, চৌকিতে গোঁসাই একা উপবিষ্ট, অন্য কেউ নেই। গোঁসাইয়ের উত্তর শোনা যাচ্ছে, কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর গোঁসাই দিচ্ছেন, সে প্রশ্নগুলি শোনা যাচ্ছে না। ভয়ে তাঁর বাক্রোধ হয়ে যায়, জানালা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়েন। পরদিন সকালে গোঁসাই তাঁকে বলেন, রাত্রে আমাকে কথা বলতে শুনলে আর কখনও জানালা খুলে দেখিস না।
কুষ্টিয়ার রেলের ওভারসিয়ার প্রমথনাথ গাঙ্গুলির স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। প্রমথর প্রবল আকাঙ্খা স্ত্রীকে একবার দেখার ও কথা বলার। চেপে ধরলেন গোঁসাইকে। গোঁসাই রাজি হননি—কিন্তু প্রমথর অত্যন্ত পীড়াপিড়িতে শেষে সম্মত হলেন। গোঁসাই প্রমথর ঘরে তার খাটের পাশে একটি ছোট খাটে রাত্রে ঘুমোন। সেদিন বললেন, তুই একা থাক, আমি অন্য ঘরে শোব। রাত্রে ঘুম আসছে না প্রমথর, মৃদু আলোকিত ঘর। হঠাৎ দেখলেন—খাটের পাশে দণ্ডায়মান মৃতা স্ত্রী। সে বলল, কেন তুমি আমাকে বারবার ডাক বল তো? আমার যে কষ্ট হয়। প্রমথ জিজ্ঞাসা করেন, কোথায় আছ তুমি, কেমন আছ? সে বলল, ঠাকুরের কাছে আছি, ভাল আছি। অনেকক্ষণ কথা হল দুজনের। দরজার বাইরে থেকে গোঁসাই তারপর বললেন, আর নয়, এবার দরজা খোল্, আমাকে তামাক দে। অদৃশ্য হয়ে গেল অশরীরী। দরজা খুলে গোঁসাইকে তামাক সেজে খাওয়ালেন প্রমথ।
নামের তরঙ্গে কত যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটত যার অধিকাংশই আজ বিস্মৃতির গর্ভে বিলীয়মান। নামের প্রভাবে যোগযুক্ত অবস্থায় সমর্পিত প্রাণ উচ্চ আধার এসব ভক্তপ্রবরের ব্যক্তিত্বে আসত এক অসাধারণ পরিবর্তন-এঁদের চিন্তাতরঙ্গ স্পর্শ করতে পারত যে কোন অন্তরকে। মুখে প্রকাশ না করেও কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই প্রভাবিত করতে পারতেন যে কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিসমষ্টিকে। একবার গোঁসাই পাবনা থেকে কুষ্টিয়া যাচ্ছেন স্টিমারে। কিছুক্ষণ যাবার পর তাঁর খেয়াল হল স্টিমারে তো ঠাকুরের কোন ভক্ত নেই। গান ধরলেন গোঁসাই গভীর ভাবসম্বেগে। সুরেলা গলায় ভাবে আপ্লুত হয়ে গাইতে থাকেন গোঁসাই। মুগ্ধ হল সবাই, একে একে দীক্ষা নিল তারা। সারেং থেকে খালাসি, কেবিনের যাত্রী থেকে ডেকের যাত্রী, সবারই দীক্ষা সম্পূর্ণ হল। গোঁসাইয়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল, স্টিমার আর ভক্তশূন্য রইল না। আর একবার চলতি ট্রেনের কামরায় যতজন সহযাত্রী ছিল সকলকে দীক্ষিত করেছিলেন গোঁসাই।
নামময় অবস্থার সংস্পর্শে সেযুগে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হয়। ডাকপিওন লক্ষণ ঘোষ পক্ষাঘাতে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। বহু চিকিৎসাতেও ফল হয়নি কোন। অশ্বিনী বিশ্বাসের বাড়িতে কীর্তন হচ্ছে, পরিচালনা করছেন গোঁসাই। প্রতিবেশীরা লক্ষণকে এনে রাখল গোঁসাইয়ের পায়ের কাছে, ব্যাধিমুক্তির মিনতি জানিয়ে। লক্ষ্মণকে বুকে জড়িয়ে কীর্তনে নামেন গোঁসাই; কিছুক্ষণ নৃত্যের পর তাকে ছেড়ে দিলেন- লক্ষ্মণ সুস্থ দেহে হেঁটে বাড়ি ফিরে গেল সকৃতজ্ঞ চিত্তে। নাম চিকিৎসায় এভাবে অনেক দুরারোগ্য রোগীর ব্যাধিমুক্তি ঘটে। রোগীকে স্পর্শ করে নাম করা হত কখনও নিরবিচ্ছিন্নভাবে, কখনও বা পর্যায়ক্রমে। নামের বিচিত্র শক্তি দেখে দূরদূরান্ত থেকে নানা রোগের রোগীরা আসত নামচিকিৎসায় সুস্থ হতে। অটুট ভক্তি বিশ্বাস নিয়ে খুব তীব্রভাবে নাম করলে দেহের মধ্যে প্রবাহিত অদৃশ্য আলোকস্রোত মস্তিষ্কে সংহত হয়; তখন অসুস্থ বা সদ্য মৃত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে ঐ সূক্ষ্ম জীবনীশক্তির সঞ্চারণে অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হতে পারে, মৃত ব্যক্তিও জীবন পেতে পারে-যদি ঐ মৃত ব্যক্তির শরীর বিধানের কোন বিশিষ্ট যন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিকল বা বিকৃত না হয়।
সতীশচন্দ্র দানে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অজস্র প্রণামী পেতেন-অকাতরে বিলিয়ে দিতেন শেষ কর্পদক পর্যন্ত। একবার সুরেন বিশ্বাস গোঁসাইয়ের গায়ে তখনকার সময়ের আড়াইশো টাকা দামের একটি নতুন শাল জড়িয়ে দিলেন। গোঁসাই ফিরছেন কুষ্টিয়ার আশ্রমে। রাস্তায় দেখেন এক নগ্ন ভিখারি শীতে কষ্ট পাচ্ছে। গোঁসাই প্রথমে শালটি তাকে দিলেন-তারপর একে একে নিজের জামা, কাপড়, জুতো ইত্যাদি যাবতীয় পরিধেয় তাকে দিয়ে সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে তাঁর জীবনে। যোগ্য সহধর্মিণী গোঁসাই-মা সবদিক থেকে পরিপূরণ করতেন গোঁসাইকে।
প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজেও তাঁর অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থ। প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে অর্থও সংগ্রহ করে নিয়মিত পাঠাতেন। ভিক্ষার চেয়ে গোঁসাই লোককে সেবা দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতেন বেশি। নাম চিকিৎসায় রোগীকে চিকিৎসা করে অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁকে ভুগতেও হয়েছে অনেকবার। রোগীর কর্মদোষ কাটাতে অনেক সময় রোগ টেনে নিয়েছেন নিজের দেহে। এর ফলে একবার তাঁকে দীর্ঘ ছ'মাস শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিল। এই জাতীয় অসুখে গোঁসাইয়ের চিকিৎসা করতেন কিশোরীমোহন।
মহা তাপস সতীশচন্দ্র গোস্বামী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইষ্টের অভীষ্ট পূরণে সচেষ্ট ছিলেন। জীবনের পরম মুহূর্তে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছ থেকে যে ঐশ্বর্য তিনি পেয়েছিলেন, জীবন-সায়াহ্নেও ছিল সেই পরম প্রাপ্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি। সাধন জগতের বিভিন্ন স্তরানুভূতি এবং তাতে সহজ বিচরণ তাঁর কাছে ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। কখনও কোন অবস্থায়ই বিচলিত হতেন না-শান্ত, স্থির লালিত্যে ভরা মুখমণ্ডল ছিল সদা হাস্যময়।
দেশ বিভাগের পর সতীশচন্দ্র কিছুদিন বোলপুরে ছিলেন সপরিবারে, তারপর দেওঘর চলে আসেন এবং দেওঘরেই তাঁর জীবন দীপ নির্বাপিত হয়। ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ থেকেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় গোঁসাইয়ের শরীর ভেঙে পড়েছিল। ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের শ্রীশ্রীঠাকুরের তিথি উৎসবের পর থেকে তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। ঠাকুরের সঙ্গ লাভের দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছরের জীবনে এবারই গোঁসাই ঠাকুরের জন্মতিথিতে তাঁকে পৈতে পরাতে পারলেন না অসুস্থতার জন্য। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ঠাকুরের ফটোর দিকে। নাম করে চলেছেন, মুখমণ্ডলে গভীর প্রশান্তির চিহ্ন। কথা খুব কম বলেন, তবে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেন। ১৬ই বৈশাখ, ১৩৬৯ অবস্থা আরও খারাপ হল, অক্সিজেন চলছে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ, মুখের হাসিটি তবু অম্লান। ছেলে হরি গোঁসাইকে অভয় দিয়ে বলেন—আমি ভালই আছি, তোর কোন চিন্তা নেই। ১৭ই বৈশাখ ঠাকুরের মধ্যম পুত্র পূজনীয় ছোড়দা (বিবেকরঞ্জন চক্রবর্তী) এসেছেন দেখতে, আনন্দের হাসি হাসলেন গোঁসাই। ১৮ই বৈশাখ সকালে পূজনীয় বড়দা (শ্রীশ্রীঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র) এসে বসলেন গোঁসাইয়ের কাছে-হাত বাড়িয়ে দিলেন গোঁসাই তাঁর দিকে। ঠাকুরের একটা বড় ফটো চাইলেন, ফটোটি বুকে নিয়ে পৈতে পরিয়ে দেওয়ার ভঙ্গীতে হাত বোলালেন ফটোর উপর, তারপর মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করে ফেরৎ দিলেন ফটো। বড়দাকে বললেন, এবার আমি চললাম এখান থেকে। আর সহ্য করতে পারলেন না বড়দা, বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।
সন্ধ্যার পর ডাঃ বনবিহারী ঘোষ গোঁসাইকে দেখে এসে পুত্র হরি গোঁসাইকে বলেন-মন শক্ত করুন, বিচলিত হবেন না, আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যাবেন। কীর্তনের ঋষির যাত্রালগ্নে কীর্তন করতে বলেন বনবিহারী ঘোষ। ঠাকুরের অন্যতম পার্ষদ বঙ্কিম রায় আপত্তি জানান—বলেন, পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে, এখন কীর্তন করা মানেই তাঁকে জানিয়ে দেওয়া। পুত্রকে ডেকে গোঁসাই জানতে চান, অমাবস্যা কখন লাগবে। হরি গোঁসাই জানান-পরের দিন বেলা বারোটায়। গোঁসাই বলেন-তাহলে সে-পর্যন্ত কোন চিন্তা নেই। পরদিন ১৯শে বৈশাখ দলে দলে ভক্তরা অবিরাম আসছেন শেষবারের মত তাপস শ্রেষ্ঠকে প্রণতি জানাতে। সকাল পেরিয়ে গেল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। যাঁর অভ্যন্তরে সর্বদাই রণিত হচ্ছে শঙ্খ-ঘন্টার সুমিষ্ট ধ্বনি, সেই গোঁসাইও শুনলেন পার্থিব ঘন্টার শব্দ। বাড়িতে প্রত্যেককে নাম ধরে ডেকে বললেন খেয়ে নিতে। চোখের জল ফেলতে দিচ্ছেন না কাউকে, চোখের জল পড়লেই মুছে নিতে বলছেন। একটা বাজার পর বললেন-এবার প্রস্তুত হও কে কে আমার সঙ্গে যাবে। আমি যাব ঐ পথে-হাতদিয়ে দেখিয়ে দিলেন শ্মশান যাত্রার পথ। দেড়টার সময় ঠাকুরের ফটো চেয়ে নিয়ে বুকে রেখে প্রণাম করলেন। চৌকিতে বসে দু'জন কায়স্থ কন্যা তাঁর পরিচর্যা করছিল, একটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন-“এবার যে তোমাদের একটু নামতে হয, লক্ষ্মী"। নেমে দাঁড়াল তারা। ঠাকুরের ফটোর দিকে তাকিয়ে রইলেন মহাসাধক, একটা পঞ্চাশ-এ
শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণতি জানিয়ে সাঙ্গ করেন সাতাশি বছরের পার্থিব জীবন-মিলিত হলেন প্রিয়পরমের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য মিলনে।
____________________________
#সতীশচন্দ্র_গোস্বামী
10