অনন্তনাথ রায় :-
🔷 অনন্তনাথ ভগবানকে বাস্তবভাবে পাওয়ার জন্য প্রাণত্যাগে উদ্যত হন...
🔷 অনন্তনাথ এর ভগবান দর্শন...
🔷 অনন্তনাথ এর কঠোর সাধনা পাঁচ দিন, সাত দিন, এক মাস, দু’মাস, এমন কি তিন মাস পর্যন্ত ...
🔷 দীর্ঘ সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেন- শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পূর্ণ অবতার;
🔷 অনন্তনাথের অসামান্য গুরুভক্তির উদাহরণ...
🔷 নাম কীর্তনের গুনে মৃতপ্রায় ব্যক্তি বেঁচে ওঠে...
মানবদেহে অবতীর্ণ ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব অনুভব করার সামর্থ্য বিশেষ প্রারব্ধজাত অধিকার না থাকলে লাভ করা সম্ভব হয় না। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র যখন অনকূলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী নামক গ্রাম্য বিপ্রসন্তানমাত্র ছিলেন, তখন তাঁর ঐশী বিভা উপলব্ধি করার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল প্রাথমিকভাবে মাত্র দুজনের-তাঁদেরই একজন মহাসাধক অনন্তনাথ রায়। ঠাকুরের বাল্যসখা অনন্তনাথ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সাধন-তপস্যার মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেন শ্রীশ্রীঠাকুরের পূর্ণাবতারত্ব এবং তাঁর এই উপলব্ধিজাত জ্ঞান জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নানা উপচারে উপস্থিত করেন পিপাসু আর্ত মানুষের কাছে, প্রেরণার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত করে তোলেন অগণিত প্রাণ।
অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত পাবনা জেলার কাশীপুর গ্রামে ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ৬ই আশ্বিন, শনিবার দ্বারকানাথ রায় ও ব্রহ্মময়ী দেবীর পুত্র অনন্তনাথের জন্ম হয়। মাত্র সাত বৎসর বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা-হেতু প্রথাগত শিক্ষালাভ বিশেষ সম্ভব হয়নি অনন্তনাথের। ষোল বৎসর বয়সে হিমাইতপুরের ডাক্তার বসন্তকুমার চৌধুরীর কাছে কম্পাউন্ডারির কাজ শেখেন এবং সেই সঙ্গে ডাক্তারি বিদ্যাও অধ্যয়ন করেন। এই সময় থেকেই কিশোর অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গে অনন্তনাথের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিছুদিনের মধ্যে অনন্তনাথের মাতৃবিয়োগ হয়। মাতৃবিয়োগের বছর দুই পরে তিনি বিবাহ করেন। বিবাহের তিন বৎসরের মাথায় একটি পুত্রের জন্ম দিয়ে স্ত্রী ইহলোক ত্যাগ করেন এবং শিশুপুত্রটিরও বাইশ দিনের মাথায় মৃত্যু হয়। উপর্যুপরি শোকে, যন্ত্রণায় অনন্তনাথ বিহ্বল, উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েন। শান্তি ও মানসিক স্থৈর্যের আশায় তিনি গুরুগ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং কিছুদিনের মধ্যে বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
দীক্ষাগ্রহণের পর সাধন-ভজন চলতে থাকে। ভগবৎ লাভের তীব্র আকাঙক্ষা- মনের অনিঃশেষ বুভুক্ষা যেন কিছুতেই তৃপ্ত হয় না। এদিকে বন্ধু অনুকূলচন্দ্রের সঙ্গেও নিত্য যোগাযোগ; যত দিন যায় ততই যেন এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন অনন্তনাথ অনুকূলচন্দ্রের প্রতি। ভগবান লাভের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যায় কালক্রমে অদ্বৈতানুভূতি, শব্দশ্রবণ, জ্যোতি দর্শন প্রভৃতি সাধন জগতের অনেক পর্যায়ই অতিক্রম করেন তিনি। কিন্তু মনে তৃপ্তি আসে না-ভগবানকে সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁর সঙ্গ লাভের আকাঙ্ক্ষায় অধীর হয়ে ওঠেন অনন্তনাথ। মন ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠতে থাকে, অবশেষে মনে হয়-এ জীবনে যখন তাঁকে বাস্তবভাবে পেলাম না, তখন এ দেহ রেখে লাভ কী? দেখি, পরজন্মে নূতন দেহ ধারণ করে নবীন উৎসাহে সাধনা করে তাঁকে পাওয়া যায় কি না। নির্জনে সাধনা করার জন্য কাশীপুরের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যখানে একটি সাধন-কুটির নির্মাণ করেছিলেন অনন্তনাথ-সেই সাধনগৃহেরই আড়িকাঠে উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগে উদ্যত হন।
সন্ধ্যা আগতপ্রায়, প্রবল বৃষ্টি। অনুকূলচন্দ্র হিমাইতপুরে ডাক্তারখানার বারান্দায় বসে রোগীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে লাগলেন। প্রায় আধ ক্রোশ পথ অতিক্রম করে অনন্তনাথের সাধনগৃহের দ্বারে উপস্থিত হয়ে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলতে থাকেন, “অনন্ত রে, দরজা খোল্, দরজা খোল্, ভিজে গেলাম, শিগগির দরজা খোল্”! ঠিক সেই মুহূর্তে অনন্তনাথ বন্ধনরজ্জু গলায় পরতে উদ্যত হয়েছেন। বাইরে থেকে আকস্মিক বাধা পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় তিনি প্রস্তরমূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন আর ভাবতে লাগলেন-ভগবৎপ্রাপ্তিতে কি এতই বিঘ্ন? এ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহে নব উদ্যমে সাধনারও উপায় নেই! অনুকূলচন্দ্রের সবল আঘাতে কপাট ভেঙে পড়ল-ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে অনন্তনাথকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে তিনি বলেন, “আমি কী অপরাধ করেছি যে, তুই আমাকে ফেলে যাচ্ছিলি? ‘ভগবান’ ‘ভগবান’ বলে পাগল-ভগবান যে তোর পাছে পাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে!” বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে অনন্তনাথ প্রাণের আবেগে অনুকূলচন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। অনুকূলচন্দ্রের স্পর্শে ঝলকে ঝলকে জ্যোতি-তরঙ্গ আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অনন্তনাথের সত্তাকে। শান্ত সমাহিত হয়ে আসছে মন-অগণিত নাদ একটার পর একটা ধ্বনিত হয়ে চলেছে অভ্যন্তরে। জ্যোতি-তরঙ্গের কেন্দ্রবিন্দুতে সমাসীন এক তেজোময় পুরুষ, যাঁর অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে চলেছে অপরূপ বিভা। দেখলেন সেই তেজোময় পুরুষ স্বয়ং অনুকূলচন্দ্র, তাঁর বাল্যের সখা, জীবনের পরম সাথী।
বাল্যের ক্রীড়াসঙ্গীটির মধ্যে অনন্তনাথ সেদিন যে কী দেখতে পেলেন, তা অপরের বোধগম্য নয়। যেন এক অনন্ত বিশ্রাম, এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়; যেন জীবনের সমস্ত প্রাপ্তির শেষ সীমা! চির-ঐশ্বর্যময় পিতা তাঁর পুত্রকে টেনে নিলেন নিজের কাছে। অনন্তনাথের অন্তরতম আকুতি, তাঁর প্রগাঢ় নিষ্ঠা, ভক্তির ব্যাকুলতা সেদিন ধন্য হল-এক অভাবনীয়রূপে পেলেন তিনি সেদিন শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গ, এক নতুন দৃষ্টিতে দেখলেন এতদিনকার পরিচিত বান্ধবটিকে। ঠাকুর তখনই সেই অবস্থায় অনন্তনাথকে জননীদেবী (শ্রীশ্রীঠাকুরের মা)-র কাছে নিয়ে গেলেন।
উক্ত ঘটনার পর দু’বছর অতিক্রান্ত প্রায়-সাধন-ভজনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে অনন্তনাথের প্রায় রোজই আলাপ আলোচনা হয়। মাতা মনোমোহিনী দেবীর গুরুকৃপার নানা কাহিনী শুনে, তাঁর ইষ্টনিষ্ঠায় অভিভূত হয়ে অবশেষে অনন্তনাথ মাতৃদেবীর কাছ থেকে সৎনাম গ্রহণ করেন এবং সন্তমতের পশ্চিমদেশীয় গুরুদেব শ্রীশ্রীসরকার সাহেবের মূর্তি স্থাপন করে নিষ্ঠাসহ নামধ্যান করতে থাকেন। এই সময়ে প্রায়ই শ্রীশ্রীঠাকুরের মহাভাবসমাধি হতে থাকে। অপার বিস্ময়ে অনন্তনাথ লক্ষ্য করলেন ভাবসমাধি অবস্থায় অনুকূলচন্দ্রের অঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চুরাশি রকমের আসনের প্রকাশ, শুনলেন বিভিন্ন ভাষায়, বিনা আয়াসে, অবলীলাক্রমে জাগতিক নানাপ্রকার সমস্যার অপূর্ব সমাধান, ঈশ্বর-তত্ত্ব, অবতারতত্ত্ব ইত্যাদি জটিল ধর্মতত্ত্বের সহজ সুস্পষ্ট মীমাংসা। দিনের পর দিন এইরূপ অসংখ্য ভাববাণী শুনতে শুনতে অনন্তনাথের মনে অনুকূলচন্দ্রের ভিতরে ভগবত্তার পূর্ণ প্রকাশ সম্বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মায়। একদিন ভাববাণীতে অনুকূলচন্দ্র অনন্তনাথের নাম ধরে ডেকে বলেন, “অনন্ত রে, কোথাও রওনা হ’তে হ’লে মেল ট্রেনে যাওয়া যায়, mixed train - এ যাওয়া যায়, আবার গরু-মহিষের গাড়ীতেও যাওয়া যায়। ইহা বুঝে যা করার হয় করবি।” মহাভাবাবস্থায় এইরূপ-আরও অনেক নির্দেশই শুনতে পেলেন। অনুকূলচন্দ্রের ভাগবত সত্তা সম্বন্ধে পূর্ণ বিশ্বাসী হয়ে তাঁকেই গুরুপদে বরণ করে মাতৃপ্রদত্ত সাধন-পদ্ধতি নিষ্ঠাভরে অনুসরণ করতে থাকেন অনন্তনাথ; আর কোন দ্বিধা, কোন সংশয় রইল না, সম্পূর্ণভাবে তাঁতেই সমর্পিত হলেন। বিরতিহীন এ যাত্রা অনন্তনাথের চলল অনন্তের পথে- যার ইতি নেই, বিচ্ছেদ নেই, যাতে আছে শুধু ধ্বনিময় গতি, অব্যাহত নামময়তা।
সমর্পিত-প্রাণ অনন্ত এরপর হিমাইতপুরে ঠাকুরের কাছে এসে বসবাস শুরু করেন। ঠাকুরের নির্দেশে তিনি নিজেকে কঠোর তপস্যায় নিয়োজিত করেন। কাশীপুরের মাঠে একটি মন্দির নির্মিত হয়—সেখানে অনন্তনাথ বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় আহারনিদ্রা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক ক্রিয়া-রহিত হয়ে একাদিক্রমে পাঁচ দিন, সাত দিন, এক মাস, দু’মাস, এমন কি তিন মাস পর্যন্ত একাসনে ধ্যানমগ্ন থেকে সাধনা করতেন। তাঁর তীব্র সাধনা সম্পর্কে ঠাকুর বলেছেন, অনন্তর সাধনা কী কঠোর! এমনও হয়েছে কতকাল ঘর থেকে বেরোয়নি। আমি একদিন গিয়ে দেখি সারা শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা, বুকে একটুও স্পন্দন নেই। মনে করলাম-মরে গেল নাকি! তার সমস্ত গায়ের পিঁপড়ে ছাড়িয়ে দিই, মাছিগুলো কোনরকমে গা থেকে ছাড়িয়ে দিই- তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। শেষে ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান হলো। শরীরের অবস্থা দেখে মনে হত আর বেশী দিন বাঁচবে না।
সাধনার সময়ে একবার অনন্তনাথ শুধু দুধ পান করে এবং মৌন ব্রতাবলম্বী হয়ে ছয় মাস কাটিয়েছিলেন। তখন সমস্ত ইন্দ্রিয় সংযমের মাধ্যমে অধিকাংশ সময়ই ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এই অবস্থায় কেবলমাত্র একান্ত প্রয়োজনে ঠাকুরের সঙ্গে সাধনাদি বিষয়ে কথাবার্তা বলে বিভিন্ন অবস্থা ও স্তর বিষয়ে নির্দেশ ও উপদেশ গ্রহণ করতেন। এই ভাবে দীর্ঘ সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করেন- শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পূর্ণ অবতার; এ পর্যন্ত জগতে যত অবতার পুরুষের আবির্ভাব হয়েছে তিনি সকলেরই পরিপূরক এবং তিনিই বর্তমান পুরুষোত্তম।
অনন্তনাথের এই মহাসাধনার যুগে তখনও কোন কর্ম-প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। সেই সময়টিকে কীর্তনের যুগ বলা চলে। ক্রমে ক্রমে আশ্রমে জনসমাবেশ আরম্ভ হয়েছে; চারিদিকে ভাবগম্ভীর সাধনতত্ত্বের আলোচনা চলছে—কোথাও ঠাকুর স্বয়ং, কোথাও অনন্ত মহারাজ, আবার কোথাও বা আগন্তুকগণ নিজেরাই আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহণ করে এক মগ্ন, ঐশ্বরীয় ভাবভূমি গড়ে তুলছেন। আনন্দময়, অমৃতময় সে এক নতুন জগৎ, যেখানে বিবাদ-বিসম্বাদ, অতৃপ্তি-হতাশার কোন ছায়া নেই।
নামধ্যানের মধ্যেই অনন্তনাথ পেতেন উদ্ভূত সমস্যার মীমাংসা। সেবার কুষ্টিয়াতে ঠাকুরের জন্মোৎসব পালনের আয়োজন চলছে। ইংরেজির ১৪ই ও ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৮। ভক্তরা বিশ্বগুরুর আবির্ভাব জানিয়ে ছাপিয়ে ফেলেছেন অসংখ্য প্রচারপত্র, প্রস্তুত করেছেন প্রাচীর-লিখন এবং সেই অনুযায়ী সবরকমের অন্যান্য প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তখনও পর্যন্ত বিষয়টি ঠাকুরকে জানানো হয়নি। ঠাকুরকে জানাতে এলে তিনি কোনমতেই সম্মতি দিলেন না-উৎসবে উপস্থিত হওয়া তো দূরের কথা। বললেন, সে কী কথা, আমাকে বিশ্বগুরু, অবতার ইত্যাদি বলে প্রচার করা কেন? আমি কি কখনও আপনাদের বলেছি যে আমি বিশ্বগুরু বা অবতার?
উদ্যোক্তারা মহা বিপন্ন হয়ে অনন্তনাথের শরণ নিলেন। সমস্ত শুনে অনন্তনাথ তাঁর কাশীপুরের সাধন-মন্দিরে গিয়ে ধ্যান মগ্ন হন। একাদিক্রমে পাঁচ দিন ধ্যানে অবস্থানের পর মন্দিরের দরজা খুলে কুষ্টিয়ার ভক্তবৃন্দকে ডেকে বলেন—যান, উৎসব করুন, ঠাকুরকে বিশ্বগুরু, পুরুষোত্তম যা খুশি বলুন। এ প্রণয়ের ডাক নয়, বিধিসম্মত নাম। ঠাকুর আপনাদের উৎসবে যাবেন।
এই কথা বলে মহারাজ মাতা মনোমোহিনী দেবীর কাছে গেলেন। তাঁর ও মায়ের মধ্যে কথা হল। ইতিমধ্যে ভক্তবৃন্দও জননী দেবীর সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত নিবেদন করেন। জননী দেবী অতঃপর ঠাকুরের কাছে গিয়ে বলেন, ওরা অত করে বলছে, কুষ্টিয়ার উৎসবে যা একবার। মায়ের কথায় ঠাকুর অবশেষে সম্মত হলেন।
তাপস-প্রবর অনন্তনাথ তপস্যার বলে যে উচ্চস্তরে আরোহণ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে ঠাকুর বলতেন- “সন্তমতের পূর্ব পূর্ব গুরুদের নামের সহিত ‘মহারাজ’ শব্দ যুক্ত দেখা যায়, যথা স্বামীজি মহারাজ, হুজুর মহারাজ, মহারাজ সাহেব প্রভৃতি অনন্তনাথও ঐ জাতীয় একজন উন্নত সাধক, সুতরাং তাহাকেও ‘মহারাজ’ বলিয়া ডাকা উচিত।” অনন্তনাথের অতিলৌকিক আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সন্তুষ্ট হয়েই ঠাকুর তাঁকে মহারাজ আখ্যা দেন। সেই থেকে শ্রীশ্রীঠাকুরের অগণিত শিষ্যবর্গের কাছে তিনি ‘মহারাজ’ বলে পরিচিত হন।
সৎনাম গ্রহণের পূর্বে অনন্তনাথের মাঝে মাঝে মাংস খাওয়ার ইচ্ছে হত। কিন্তু যতবার তিনি উদ্যোগ নিতেন ততবারই বন্ধু অনুকূলচন্দ্র কৌশলে তাঁকে নিবৃত্ত করতেন। একবার অনুকূলচন্দ্র নাজিরপুরে দুর্গানাথ সান্ন্যালের বাড়িতে নদীপথে রোগী দেখতে গিয়েছেন। অনন্তনাথ হিসেব করে দেখলেন নাজিরপুর থেকে ফিরতে অনুকূলচন্দ্রের অনেক রাত হবে। নিশ্চিন্তমনে তিনি ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে বাজিতপুর হাট থেকে মাংস, পেঁয়াজ প্রভৃকি কিনে ফেরার পথ ধরেন। গভীর জঙ্গলে ঘেরা ময়মনসিংহের কালীবাড়ির পথে হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর থেকে একটি সন্ধ্যামালতী ফুলের ডাল হাতে নিয়ে অনুকূলচন্দ্র অনন্তনাথের সামনে এসে বলেন, দেখ অনন্ত, কী আশ্চর্য-একই বৃন্তে দুই রঙের ফুল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর জিজ্ঞাসা করেন, কী রে কী বাজার করে আনলি দেখি!—বলেই ভৃত্যটির কাছ থেকে বাজারের ঝুড়ি নিচে নামিয়ে বলেন, কী রে অনন্ত, তুই এসব খাবি? অনন্ত আর কোন কথা না বলে ঝুড়ি ফেলে বাড়িতে ফিরে এলেন।
বাড়ি ফিরে খেয়াল হল-এত অল্প সময়ের মধ্যে অনুকূলচন্দ্রের এখানে আসা তো কোনভাবেই সম্ভব নয়! তখনই তিনি অনুকূল-জননীর কাছে গিয়ে জানলেন যে অনুকূলচন্দ্র নাজিরপুর থেকে ফেরেননি। এই দিনের ঘটনায় অনন্তনাথের মনে বাল্যবন্ধুটির সম্বন্ধে নানা প্রশ্নের উদয় হয়। পরদিনই দুর্গানাথ সান্ন্যালের বাড়িতে গিয়ে জানলেন যে আগের দিন ঐ সময়ে অনুকূলচন্দ্র ঐ বাড়িতে রোগী দেখতে এসে বহুক্ষণ ছিলেন। কথাবার্তার মাঝে একবার প্রাকৃতিক ক্রিয়ার জন্য বাইরে জঙ্গলে যান। অনন্তনাথ বুঝলেন—কোনভাবেই ঐ সময়ে কালীবাড়ির পথে অনুকূলচন্দ্রের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবে সম্ভব ছিল না। ভক্তের সঙ্গে ভগবানের লীলা লৌকিক চোখে চিরদিনই এভাবে রহস্যাবৃত থাকে। একনিষ্ঠ সাধককে তিনি ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক, মঙ্গলের পথেই পরিচালিত করেন।
সাধনভজন চলাকালীন একবার অনন্তনাথের ধারণা হল কামাদি রিপু জয় করা কঠিন নয়; ঠাকুরের কাছে তিনি তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেন। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন- ওতে স্বাধীন কর্তৃত্ব কিছুই নেই। ঐ সব ব্যাপার ইষ্টনিষ্ঠা ও পরমপিতার ইচ্ছার উপরই নির্ভর করে। এ বিষয়ে ঠাকুরের সঙ্গে অনন্তনাথের আরও অনেক আলাপ আলোচনা হলেও অনন্তনাথের মতের পরিবর্তন হল না। সম্ভবত তাঁর ঐ সময়কার স্বস্থ মানসিকতা এবং অন্তরের দৃঢ়তার জন্য ঐ ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল। এর কিছুদিন পর ফাল্গুনী পূর্ণিমায় অনন্তনাথ নবদ্বীপে যান; সেখানে তিন/চার দিন দিবারাত্রি বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের কীর্তনাদি শ্রবণ ও দর্শন করেন। এর পরে তাঁর মানসপটে অনবরত বৈষ্ণবীদের নৃত্যদৃশ্য আভাসিত হতে থাকে এবং এক তীব্র কামনার সৃষ্টি হয়। ঠাকুরের কৃপায় কোনমতে রিপুর হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে হিমাইতপুর ফিরে এসে ঠাকুরকে বিস্তারিতভাবে সব বলেন। ঠাকুর সব শুনে খুব হাসলেন। সাধনার উচ্চস্তরে উঠেও যে-কোন সময় বিচলন আসতে পারে এবং উত্থানের পর পতনমুখী স্রোতের টান স্বভাবতই প্রবলতর হয়। একমাত্র ইষ্টনিষ্ঠাই সেই পতন প্রতিহত করতে সক্ষম। সাধন- পথের আর এক শক্ত বাধা হল অহং; সেই কারণেই অনন্তনাথের রিপু জয়ের অহং এইভাবে বিদূরিত হয় তাঁর করুণায়।
হিমাইতপুরে ঠাকুরের শয়নগৃহের পাশে একটি ঘরে ঠাকুর অনন্তনাথের মাতৃদেবীর স্মৃতিতে ‘ব্রহ্মময়ী ঔষধালয়’ নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন এবং ঐ চিকিৎসালয়ের যাবতীয় দায়িত্ব অনন্তনাথের উপর অর্পণ করেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশে অনন্তনাথ সেখানে প্রত্যহ রোগী দেখতেন এবং বহু দূরদূরান্তে যেতেন রোগী দেখার জন্য। তাঁর সেবা এবং রোগ-অনুসন্ধিৎসু চিকিৎসা পদ্ধতির খ্যাতি অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাপক প্রসার লাভ করে। সুদূর পল্লীগ্রাম থেকে মহানগরী কলকাতাতে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি বহু কঠিন ব্যাধির চিকিৎসায় বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন।
অনন্তনাথের স্বতঃপ্রজ্ঞা ছিল অসাধারণ। ১৯২২ খৃষ্টাব্দে ঠাকুর অসুস্থ অবস্থায় কার্শিয়াং-এ আসেন বায়ু পরিবর্তনের জন্য। ঠাকুরের সঙ্গে অন্যান্যদের মধ্যে অনন্তনাথও এসেছেন। খ্যাতনামা চিকিৎসক ডাঃ আর. এল. দত্ত ঠাকুরের চিকিৎসায় নিযুক্ত; তিনি প্রতিদিনই এসে দেখে যেতেন ঠাকুরকে। ঠাকুরের শয্যার পাশে টেবিল চেয়ার রাখা ছিল, সেখানে বসে ডাঃ দত্ত প্রেসক্রিশন করতেন। একদিন অনন্তনাথ অন্যমনস্কভাবে টেবিলের পাশে বসে টেবিলের উপর রাখা কাগজে কিছু লিখে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর নিত্যদিনের মত ডাঃ দত্ত এসেছেন ঠাকুরকে দেখতে, হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল টেবিলের উপরের কাগজটিতে। তিনি কাগজটি হাতে নিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে বললেন-আমি আজ এই প্রেস্ক্রিশন করব মনে করে এসেছি-অথচ আমার লিখিত প্রেসক্রিপশন্ টেবিলের উপরই আছে। এ কী করে সম্ভব হল? অনন্তনাথ তখন বলেন, ঐ লেখাটা আমার। সকালে এখানে বসে থাকতে থাকতে কী যেন মনে হল, তাই লিখে ফেললাম। আর আপনার হাতের লেখা তো কিছুদিন ধরেই দেখছি, তাই হাতের লেখাটা আপনার মতই হয়েছে। ডাঃ দত্ত আবিষ্ট চিত্তে বলেন-তুমি যে এত বড় ডাক্তার ও এত keen observer, এটা সত্যিই বিস্ময়ের। তোমার মধ্যে যে প্রতিভা আছে তাতে তুমি খ্যাতনামা চিকিৎসক হতে পারবে।
আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি অনন্তনাথকে চিকিৎসা এবং সেবা-শুশ্রূষা ব্যতিরেকেও আরও অনেক জাগতিক দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তদানীন্তন সৎসঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতির বিপুল কর্মভার তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। সাধন- ভজনপ্রিয় মানুষটি এসব কাজে বিশেষ আনন্দ পেতেন না। কখনও কখনও বলতেন -আর এই সকল বিষয়ে যেতে ইচ্ছা হয় না। মনটাকে এত নীচে নামিয়ে আনতে আমার অত্যন্ত কষ্ট হয়, তবু করতেই হবে, কারণ এই মালিকের ইচ্ছা। ধর্ম ও কর্মযোগ সম্বন্ধে ঠাকুর তাঁকে বলেন, দ্যাখ অনন্ত, লোকহিতকর কাজ না করে শুধু বসে বসে নামধ্যান করলে ধর্ম হয় না। সাধনা যেমন করতে হবে, বাস্তব কর্মে ইষ্টের নির্দেশও তেমনই মূর্ত করে তুলতে হবে। গুরুগতপ্রাণ অনন্তনাথ ঠাকুরের এই আদেশ শিরোধার্য করে নিজের জীবনে এই আদেশকে বাস্তবায়িত করে তুলেছিলেন।
দীক্ষাদানের অধিকারী ঋত্বিকরূপে অনন্ত মহারাজের একটি নিজস্ব ধরন ছিল। তিনি সহসা দীক্ষাপ্রার্থীকে দীক্ষা দিতে চাইতেন না। বেশ কিছুদিন ঘোরাতেন, হয়তো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতেন, দীক্ষাপ্রার্থীর আধ্যাত্মিক পিপাসা প্রকৃত বা স্থায়ী কি না। ধৈর্য ছিল অসীম, জিজ্ঞাসু প্রার্থীর কথা নিজে শুনতেন বেশি, উত্তর দিতেন সীমিত- ভাবে। তাতেই প্রশ্নকর্তা পেয়ে যেতেন সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা। ভক্ত অধ্যাপক পঞ্চানন সরকারের ভাষায়-দেখলাম এক অতি আশ্চর্য্য মানুষ এই মহারাজ। কতই না আবোল তাবোল বকে চলেছি, ঘন্টার পর ঘন্টা একনাগাড়ে, শুনেই চলেছেন তিনি তীক্ষ্ণ মনোযোগে, সতৃষ্ণ অথচ সস্মিত দৃষ্টি বিছিয়ে। কথার মাঝে বাধা দেওয়ার প্রবৃত্তির লেশমাত্র নেই। এই অপরূপ প্রকৃতি ও শিক্ষা আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। মহারাজের আলোচনা পদ্ধতির আর একটি বিশেষত্ব আমাকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করেছিল। তা হচ্ছে আমার কথাগুলি মোটামুটি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে থেমে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি কথা কিছু বলতেন না, পরে যা বলতেন তা আমারই উক্তির সূত্র ধরে।... তিনি যেন এক মনোযোগী ছাত্র, আমার বক্তব্যটা অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে বুঝে নেওয়ার জন্য আগ্রহশীল।
সাধক অনন্তনাথের শরীরে বীজনাম জপের প্রভাবে যে তাপের সৃষ্টি হত, একবার তার পরিচয় পেয়েছিলেন ‘অমিয়বাণী’-র সংকলয়িতা অশ্বিনীকুমার বিশ্বাস। ঠাকুর ও অনন্তনাথ তখন কুষ্টিয়ায় অশ্বিনী বিশ্বাসের বাড়িতে কিছুদিন যাবত রয়েছেন। একদিন পাশাপাশি দুটি চৌকির একটিতে ঠাকুর, অপরটিতে অনন্তনাথ ঘুমিয়েছেন। অনেক রাত্রে অশ্বিনীকুমার বাড়ি ফিরে অনন্তনাথের পাশে এসে শুয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে ‘বাবারে বাবা, গেলাম, গেলাম’ বলে চিৎকার করে তিনি উঠে পড়লেন। তাঁর চিৎকারে ঠাকুর ও অনন্তনাথ ঘুম ভেঙে উঠে দেখেন, অশ্বিনীকুমার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন ও ঘামছেন। ঠাকুর কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন যে ঘুমের মধ্যে অনন্তনাথের হাত তাঁর বুকের উপর পড়লে প্রচণ্ডতাপের অসহ্য যন্ত্রণায় তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে একটা দাহ ভাব বোধ করেন, ক্রমে ঐ দাহ ভাব বেড়ে যেতে থাকায় অসহ্য যন্ত্রণা হতে থাকে এবং শরীর ঘামতে থাকে। ঠাকুর তখন রহস্যভরে বলেন, ওরে বাবা, আপনি আমার কাছে না শুয়ে ঐ ডাকাতের কাছে শুতে গেলেন কেন?
সে যুগে নামস্পন্দনের সাহায্যে জীবনীশক্তির সঞ্চার বা এর গতিবেগ বৃদ্ধি করে মৃত বা মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং দুরারোগ্য রোগীর নিরাময়ের উদ্দেশ্যে একটি চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। নামচিকিৎসায় জীবন ফিরে পাওয়ার বহু ঘটনাই ঘটেছে সেই সময়। ঠাকুর বলতেন, খুব নাম করলে দেহের মধ্যে প্রবাহিত অদৃশ্য আলোকস্রোত মস্তিষ্কে সংহত হয়, চোখ দিয়ে তা বেশি করে ঠিকরে বেরোয়, আর তখন কারও দিকে কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকলে বা স্পর্শ করলে, ঐ সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি সঞ্চারণে সে শুধু নড়ে ওঠে তা নয়, মৃত হলে জীবন্ত হয়েও উঠতে পারে। সদ্যমৃত ব্যক্তির শরীর বিধানের কোন বিশিষ্ট যন্ত্র যদি একেবারে বিকল বা বিকৃত না হয় তবে ঐ রকম নাম করতে করতে তাকে স্পর্শ করে থাকলে, সে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে।
অনন্তনাথের অসামান্য গুরুভক্তির একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। একবার আশ্রমের ডাক্তারখানার পিছন দিক থেকে তীব্র দুর্গন্ধ সকলকে অতিষ্ঠ করে তোলে। ঐ পথে যাওয়ার সময় ঠাকুরও ঐ গন্ধ পান। তাঁর নির্দেশে অনুসন্ধান করে দেখা যায় একটি গরুর ঠ্যাং জঙ্গলে পড়ে আছে এবং সেটিই দুর্গন্ধের উৎস। অনন্তনাথ তখন ডিস্পেন্সারিতে বসে রোগী দেখছিলেন। ঠাকুর তাঁকে ডেকে বলেন, অনন্ত রে, ডাক্তারখানার পিছনে মরা গরুর ঠ্যাং নাকি পড়ে আছে, তা থেকে ভয়ানক দুর্গন্ধ আসছে, তুই এক্ষুনি গিয়ে মুখে করে কামড়ে ওটাকে ঐ নদীর চরায় দূর করে ফেলে দিয়ে আয় তো। যেমনই বলা তেমনই কাজ-অনন্তনাথ ঠাকুরের আদেশ পাওয়ামাত্র সানন্দে সেই পূতিগন্ধময় গরুর ঠ্যাং দাঁতে কামড়ে নদীর ধারে আস্তে আস্তে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় ঐটি থেকে তাঁর শরীরে ময়লা পড়ছিল, কিন্তু কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যথাস্থানে ঠ্যাংটি ফেলে দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ফিরে এলেন এবং পূর্ববৎ রোগী দেখতে লাগলেন। শ্রীশ্রীঠাকুর যেন জগতের সামনে তুলে ধরলেন সাধকের নির্বিকারতা এবং গুরুভক্তির পরাকাষ্ঠা।
ঠাকুর-সেবায় অনন্তনাথ ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী-নিজ হাতে সর্বদা গুরুর সেবা করায় তৎপর ছিলেন। ঠাকুর কখন কী কাজের আদেশ করেন, তার জন্য প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রস্তুত রাখতেন। অনেক সময় গভীর রাতে ঠাকুর বিশেষ কোন জিনিষ খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। তখনই মহারাজ বাজিতপুর ঘাট না হয় পাবনা থেকে সেই খাদ্য সংগ্রহ করতেন অথবা নিজ হাতে প্রস্তুত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঠাকুরের কাছে উপস্থিত হতেন। আর ঠাকুরও শিশুর মত চাওয়ামাত্র কিছু না পেলে অস্থির হয়ে উঠতেন—যেন এতটুকু বিলম্বও সহ্য হচ্ছে না, এমন করতেন।
দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র বৃহৎ বহু বিষয়েই অনন্তনাথের গুরুসেবার আকুলতা পরিব্যাপ্ত হয়ে ছিল। ঠাকুর কড়াইশুঁটি খেতে ভালবাসেন-মহারাজ প্রখর রৌদ্রে- দুপুর দুটো, তিনটে পর্যন্ত শুঁটি তুলছেন, কোন ক্লেশবোধ নেই। কোথাও গেলে যা ভাল লাগত তাই ঠাকুরের জন্য নিয়ে আসতেন। ঠাকুরের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়- স্বজন সবই তাঁর আপনার। ঠাকুর খাবার-পাতে লেবু ভালবাসতেন, তাই ঘরে কখনও লেবু না থাকলে যেখানে থেকে হোক লেবু সংগ্রহ করা চাই-ই তাঁর। শিষ্যবর্গও তাঁর বড় আপনার জন, কারণ তারা যে সব ঠাকুরের লোক। ঠাকুর ছাড়া তাঁর নিজস্ব বলে আর কিছু ছিল না। তাঁর সমস্ত কাজের লক্ষ্যই ছিল ঠাকুরের প্রীতি-সম্পাদন।
কীর্তনের যুগে অনন্ত মহারাজ কীর্তনের দল নিয়ে অনেক জায়গা পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি ছিলেন সুকন্ঠের অধিকারী। তাঁর আপনভোলা নৃত্যভঙ্গিমা এক স্বর্গীয় ভাব-বলয়ের সৃষ্টি করত।
১৩২৯ বঙ্গাব্দ, ফাল্গুন মাসে একদিন সৎসঙ্গ দালানের পিছনে কিশোরীমোহনের ঘরের সামনে বাবলাতলায় কীর্তন হচ্ছে। কিশোরীমোহন, সতীশচন্দ্র, কোকনচন্দ্র, তরণী ও নফরচন্দ্র প্রভৃতি আছেন কীর্তনে। কিশোরীমোহনের তাণ্ডব নর্তন-কীর্তনের আঘাতে একজন কীর্তনসঙ্গী ছিটকে গিয়ে দালানের রকের উপর পড়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। সবাই কীর্তনে মাতোয়ারা, কিছুক্ষণ পর লক্ষ পড়ল সবার সঙ্গীটির প্রতি। অনেক চেষ্টাতেও প্রাণের স্পন্দন পাওয়া গেল না। অবশেষে অনন্ত মহারাজকে সংবাদ দেওয়া হল। মহারাজ এসেই ঐ মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে কীর্তনের মধ্যে নিজেও নাচতে থাকেন, ব্যক্তিটিকেও নাচাতে থাকেন। এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর লোকটির প্রাণের স্পন্দন দেখা দেয় এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে।
অনন্তনাথের তথাকথিত পড়াশুনো ছিল অতি সামান্যই, কিন্তু তাঁর জ্ঞানের পরিধি অপরিসীম ছিল। বিভিন্ন সময় তত্ত্ববিচারের সময় এই জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যেত। ঠাকুরের পিতৃদেবের শ্রাদ্ধবাসরে বিশিষ্ট পণ্ডিতদের এক মহাসম্মেলন হয়; সেখানে অনন্ত মহারাজের তত্ত্ব আলোচনায় তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ও প্রখর বিচারশক্তির পরিচয় পেয়ে পণ্ডিতবর্গ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর এই জ্ঞান ছিল উপলব্ধি- সঞ্জাত, তাই তার গভীরতা ছিল অমেয়।
ভক্তবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে ঠাকুরকে যেসব পত্র লিখতেন, ঠাকুরের আদেশ ও নির্দেশমত অনন্তনাথ সেসব পত্রের উত্তর দিতেন। এইসব পত্রাবলির কিছু সংকলিত হয়ে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৩০শে ভাদ্র ‘সান্ত্বনা’ নামে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। চিঠিগুলির মধ্যে সাধন-রাজ্যের বহু জটিল তত্ত্বের মীমাংসা ও চলার পথের বহু নির্দেশ সহজভাবে পাওয়া যায়। সাধনার বিভিন্ন স্তরে সাধকের অনুভূতি সংক্রান্ত ভাবগম্ভীর বিশ্লেষণও রয়েছে এই পত্রাবলিতে। ‘সান্ত্বনা’-র সার্বজনীন আবেদন সেই সময়ে ভক্তদের বিশেষ প্রেরণার উৎস হয়ে পথপ্রদর্শকের গৌরব অর্জন করে। এই পত্রসংকলনের শাশ্বত ভাবভূমি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তদানীন্তন পত্রপত্রিকায় সংকলনপুস্তকটি বিশেষ সমাদৃত হয়েছিল। বিশিষ্ট মাসিক পত্রিকা ‘প্রবাসী’-র মন্তব্য: “... এই পত্রগুলিতে লেখকের জ্ঞান, ভক্তি ও কাব্যশক্তির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ধর্মার্থ-বিষয়ক পত্রগুলির মধ্যে সাহিত্যেরও অনেক উপাদান আছে।” সৎসঙ্গের তৎকালীন মুখপত্রে অনন্তনাথের যেসমস্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল তাতেও তাঁর গভীর তত্ত্বজ্ঞান ও সাহিত্য-প্রতিভার অনবদ্য স্বাক্ষর রয়েছে।
এহেন স্থিতধী, সাধনসিদ্ধ অনন্তনাথও কিন্তু নিয়তির অলঙ্ঘ্য বিধান রোধ করতে পারেননি। ১৩৪১ সালের অর্ধোদয় যোগের সময় প্রবাসী সৎসঙ্গী মহল থেকে বারংবার আমন্ত্রণ আসতে থাকে অনন্তনাথের কাছে, কিন্তু অনন্তনাথ শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে বাইরে যাওয়ার অনুমতি চাইতে গেলে তিনি নিষেধ করেন। অনন্তনাথ একান্ত জোরাজুরি করায় একরকম ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঠাকুর অনুমতি দেন। ঠাকুর বলতেন- আমার ইচ্ছানুসারে যে কাজ হয়ে যায় তা মঙ্গলজনক। আর কেউ যদি বাধ্য করে কোন কাজ করায়, কিংবা অনুরোধ করে, তখন বড় অসুবিধে ঠেকে। তা অনেকে বোঝে না, কিন্তু তাতে ভালো ফল হয় না।
এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হল না। বাইরে থেকে ঘোরাঘুরি করে অনন্তনাথ আশ্রমে ফিরলেন মারক বসন্তরোগ নিয়ে। ঠাকুর শুনে ছুটে এলেন, স্বচক্ষে তাঁর অবস্থা দেখে গভীর পরিতাপের সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করলেন। ঠাকুরের বিশিষ্ট ভক্ত বঙ্কিম রায় শুশ্রূষার ভার নিলেন। তিনি এবং আরও দু’একজন ছাড়া কেউই ঘরে প্রবেশ করতে পারত না। ঠাকুর অবিরাম বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেন ওষুধের সন্ধানে আর হাহুতাশ করে বলেন, আমার কথা কেউ শোনে না, তাই যতসব বিপদ ঘটে।
দুর্বিষহ রোগযন্ত্রণায় অনন্তনাথ ছটফট করেন। শ্রীশ্রীঠাকুর আশংকায়, উদ্বেগে অস্থির হয়ে ওঠেন, সমগ্র আশ্রমিক পরিমণ্ডলেই থমথমে বিষাদের মেঘ জমে। সেই ভয়ঙ্কর রোগগ্রস্তের ঘরে আর একজনেরও ছিল অবারিত গতি-তিনি পুরুষোত্তম- জননী মাতা মনোমোহিনী দেবী।
২৯ শে মাঘ সকালে ঠাকুর অনন্তনাথের ঘরের জানালার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন-অনন্ত, তোর কী কষ্ট হচ্ছে? অনন্তনাথ অতি কষ্টে বঙ্কিমের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দুর্বল হাত দুটি জড়ো করে প্রণাম জানান, তারপর ইশারায় জানান-বাকশক্তি নেই। ঠাকুর বেদনাদীর্ণ মুখে চলে আসেন সেখান থেকে। অল্পক্ষণ পরেই অনন্তনাথের সমস্ত যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটে- পরমপ্রিয়কে শেষ প্রণাম জানিয়ে স্থূল সত্তার অবসানে সূক্ষ্ম সত্তা তাঁরই চরণে চিরলগ্ন হয়। শেষ প্রণামের অবকাশটুকু দিতেই বোধহয় শ্রীশ্রীঠাকুর শেষ মুহূর্তে তাঁর বাল্যসখার কাছে গিয়েছিলেন।
অনন্তনাথের প্রয়াণসংবাদ জানামাত্র ঠাকুর পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যান পদ্মার চরের দিকে-পিছন পিছন জননীদেবী ছোটেন শোকাতুর পুত্রকে সামলাতে, যদিও তাঁর নিজের শোকও পুত্রশোকেরই সমতুল্য। আশ্রমের আকাশ- বাতাস বিষাদ বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় সকলের প্রাণের মানুষ মহারাজের অকাল বিয়োগে। তাঁর বয়স তখন মাত্র আটচল্লিশ বছর। তাঁর মৃত্যুশোক শ্রীশ্রীঠাকুরকে এমন মূহ্যমান করে তুলেছিল যে ঠাকুর পূর্ণ এক বছর পদ্মার পাড়ে একটি তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করেন-আশ্রমের মধ্যে থাকতে তাঁর বেদনা বোধ হত।
সমস্ত জীবন ঠাকুরের সঙ্গ করে অনন্তনাথ বুঝেছিলেন, ইষ্টের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন ভালবাসাই চরম সাধনা, আর এই ভালবাসার ভিতর দিয়ে প্রিয়পরমকে তৃপ্তি দেওয়ার এক একটা সাফল্যের আনন্দই মানুষের জীবনে সত্যিকার প্রাপ্তি বা উপভোগ। মৃত্যুশয্যায় যতক্ষণ বাকশক্তি ছিল তার মধ্যে শুশ্রূষাকারীদের বলেন-ভালমন্দ এ জীবনে অনেক কিছুই করলাম। তোরা যত পারিস প্রাণপণে ঠাকুরের ইচ্ছা পূর্ণ করিস, মানুষের জীবনে ইষ্টপ্রতিষ্ঠা ছাড়া কর্তব্য আর কিছুই নেই।
মহারাজ অনন্তনাথ রায়ের প্রথম স্মৃতিবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শ্রীশ্রীঠাকুর শিষ্যবর্গের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি ঠাকুরের প্রাণের আবেগের ব্যাপ্তি ও আকুলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই আবেগ-মথিত কাব্যময় আহ্বানটি এখানে উদ্ধৃত করা হল:
“রা”
অস্তিবর্ধন পরেষু,
এই কাঙাল আমাকে---
প্রথমেই যারা গ্রহণ করেছিল, তারা মাত্রই ছিল দুই জন। সে এক জন আমার কৈশোরের ছিল খেলার সাথী-আমার অনন্ত মহারাজ-আর এক জন- কিশোরীমোহন দাস।
এক জনই মাত্র আছে—আর এক জন সে চ’লে গেছে- এই দুনিয়ার মানুষের স্থূল দৃষ্টির অন্তরালে-বিরহ ও বেদনার ঢেউয়ে পারিপার্শ্বিক সব অন্তর হলদল ক’রে---
সেদিন এই তো এল-ওই আসে—সেই ২৯শে মাঘ-যেদিন আমার পায়ের তলা থেকে লহমায় দুনিয়াটা যেন সরে গিয়েছিল- আকাশটা হ’য়ে গিয়েছিল নীলহারা ফাঁকা--
ঐ দিনে কি কেউ ভাই তোরা—তার স্মৃতির আগুন জ্বালিয়ে-সেই তার স্মৃতিতর্পণ করে শ্রদ্ধার দানে এই পরিপার্শ্বিককে তৃপ্ত করে তার এই আমার আগুন-ছোঁয়া প্রাণ প্রত্যেক প্রাণে জ্বালিয়ে দিবি না?
কে আছ দরদী! আমার এই ক্ষীণ ডাকে প্রাণের সুরের টানে—চ’লে এস শ্রদ্ধাতর্পণে-যা দিতে সাধ-তাই নিয়ে।
সৎসঙ্গ, পাবনা
১৮ ই মাঘ, ১৩৪২ সন
দীন
তোদেরই
‘আমি’
উল্লেখ্য, শ্রীশ্রীঠাকুর অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে অনন্তনাথের বাৎসরিক শ্রাদ্ধকর্মের আয়োজন করেন এবং আশ্রমের ভিতরে ও বাইরে সকলকে যথাসাধ্য তৃপ্ত করে অন্তরতম সখার তর্পণ করেন।
মহাসাধক অনন্তনাথ মৃত্যুশয্যায় শয়ান অবস্থাতেও ইষ্টানুরাগের যে প্রেরণার আলো জ্বালিয়ে তুলে ধরেছেন, তার দ্যুতি চিরদীপ্যমান হয়ে অনন্তকাল পথ দেখাবে ভক্তজনকে।
____________________________
#অনন্তনাথ_রায়
10