🔷 বোর্ডিংয়ে ছেলেদের কেমন ঘরে থাকা ভাল ?
🔷 নগেনদা ( বসু ) —শাসন কেমন করে করতে হয় ?
🔷 কঠিন বিষয়গুলি কেমন করে সহজ করে তােলা , যায় ?
১১ ই অগ্রহায়ণ , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৬/১১/১৯৪১ )
ভােরে তপোবনের শিক্ষকবৃন্দ এসে বসেছেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে তাসুতে । শ্রীশ্রীঠাকুর সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন — তিনিও যেন প্রতীক্ষায় বসে আছেন । এক - একজন আসছেন — আর শ্রীশ্রীঠাকুর হাসিখুশিভাবে বলছেন — কে ? অমুক দাদা নাকি ? বসে পড়েন , এটে - সেঁটে বসেন , যেমন শীত পড়েছে । বৃদ্ধ কোন দাদাকে হয়তো বলছেন , - “ দাদা আমার চ্যাংড়াদেরও হার মানিয়েছেন , এই শীতের মধ্যে হনহন করে চলে এসেছেন , আপনি যেন দিন - দিন young ( যুবক ) হয়ে উঠছেন । ইষ্টে নেশা থাকলে অমনি হয় । দেখতে - দেখতে যেন একটি প্রাণবন্ত , স্ফূৰ্ত্তিময় অন্তরঙ্গ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়ে উঠলো । ধীরে - ধীরে আলাপ আলােচনা ও প্রশ্নোত্তর সুর হলাে ।
ইন্দুদা ( বসু ) -বোর্ডিংয়ে ছেলেদের কি single - seated room ( একজন থাকার মতাে ঘর ) করা ভাল ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - একলা থাকলে social ( সামাজিক) হয় না । Conflict ( সংঘাত ) কম হয় । তাই conflict adjust (সংঘাত নিয়ন্ত্রিত ) করার ক্ষমতাও বাড়ে না , ওতে বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তিও ক্ষুন্ন হয় । অন্ততঃ তিনজন থাকা দরকার , দুইজন থাকাও সুবিধাজনক নয় , দুইজনের মধ্যে পারস্পরিক গােপন গলদ ঢুকতে পারে ।
বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) ঘরের মধ্যে ক্লাসে বসে পড়ান ভাল , না উন্মুক্ত স্থানে , মাঠে বা গাছতলায় পড়ান ভাল ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — বাইরে পড়নই আমার ভাল লাগে । ওতে যেন একটা liberty ( স্বাধীনতা ) গোজা থাকে , দেহ - মনের স্বাস্থ্য ভাল থাকে । তাছাড়া , ক্লাশের একটা কৃত্রিম আড়ষ্টভাব চলে যায় , প্রকৃতির সঙ্গে একটা নিজস্ব সম্পর্কও ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে । বিমলদা - ছেলেদের নিয়মানুবর্তী করে গড়ে তোলার জন্য করণীয় কী ?
ফলকথা , শ্রীশ্রীঠাকুর — হৈ - চৈ করুক , কিন্তু common - interest (পারস্পরিক সমস্বার্থ ) যাতে intact ( অক্ষুন্ন ) রাখে , সেই বুদ্ধি মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে । কেউ যেন কারও পক্ষে harmful ( ক্ষতিকর ) না হয় । বুদ্ধি থাকবে- প্রত্যেককে বাড়িয়ে তােলা , অন্যের ভালটা enjoy ( উপভােগ ) করবে , তাতে সাহায্য করবে । Inferiority ( হীনম্মন্যতা ) থাকলে jealousy ( ঈর্ষা ) প্রবল হয় , আর তাতে মানুষ নিজেও সুখী হয় না , কাউকে সুখী করতেও পারে না । অপরকে আপন বলে ভাবতে শেখা বাস্তবে , আর নিজ স্বার্থবোধে প্রত্যেকের সত্তাস্বার্থী হওয়া — এইটে হবে নিয়মানুবর্তিতার উৎসারক । উচ্ছল প্রাণচাঞ্চল্য নিয়েও তখন তারা অসুবিধা বা বিশৃঙ্খলার কারণ হবে না । আর common interest ( পারস্পরিক সমস্বার্থ ) -সম্বন্ধে এই sentiment ( বােধনুকল্পিত ) গজায় common Ideal- এ ( এক আদর্শে ) adherence ( অনুরাগ ) -এর ভিতর দিয়ে । শিক্ষক যতই ইষ্টপ্রাণ হবেন কর্মিষ্ঠ তপস্যায় , ততই এটা ছাত্রদের ভিতর সঞ্চারিত হবে । Discipline ( নিয়মনাুবৰ্তিত্য) -এর মূলে হ'লো disciple - ship (শিষ্যত্ব ) ।
নগেনদা ( বসু ) —শাসন কেমন করে করতে হয় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — শাসন মানে মারধর নয় - সংযমন , নিয়ন্ত্রণ করা । শিক্ষকের প্রতি যদি ছাত্রের টান থাকে , তখন তিনি অসন্তুষ্ট হবেন , এমন কোন কাজ সে করতে চায় না , ঐ টানই তাকে অনুশাসিত করে । আর , যে - ই যে - কোন অন্যায় করুক না কেন , তার মূল কারণটা কী , সেটা আবিষ্কার করতে হবে এবং যে deficiency- র ( খাকতির ) দরুন সে অন্যায় করে , সেইটে make up ( পরিপূরণ ) করতে চেষ্টা করতে হবে । Heredity ( বংশগতি ) -র থেকে যে defect ( দোষ ) অসে , সেটা সারা মুশকিল হয়ে পড়ে । Environmental nurture- এ ( পারিবেশিক পােষণে ) error ( ভুল ) -এর দরুন যে defect (দোষ) গজিয়ে ওঠে , sympathetically deal ( সহানুভূতিসহকারে) পরিচালনা করতে পারলে তা ঢের শােধরান যায় । পােষণ , তােষণ যেমন বৈশিষ্ট্যানুযায়ী করতে হয় , শাসনের বেলায়ও তেমনি বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতিকে লক্ষ্য করতে হয় । তাহলেই শাসনের মাত্রা ও ক্রম ঠিক থাকে । গড়সাপটা একরকমে কাজ হয় না । কঠোর শাসন করতে হলেও শাসন ও তােষণের উপযুক্ত সমাবেশ চাই ।
ভূদেবদা ( মুখােপাধ্যায় ) —কঠিন বিষয়গুলি কেমন করে সহজ করে তােলা , যায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - সাহিত্য , ইতিহাস , বিজ্ঞান , ভূগােল , স্বাস্থ্যতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ের উপর যদি রকমারি film ( চলচ্চিত্র ) , drama ( নাটক ) ইত্যাদি করা যায় , ভাল হয় । আর , যে - কোন বিষয়েই ছাত্রদের পড়াও না কেন , তার একটা dramatic representation ( নাটকীয় অভিব্যক্তি ) যদি এমন করে দিতে পার যে ছেলেদের তা ভাললাগা ছাড়া উপায় থাকবে না , তখন দেখবে দুরূহ বিষয়গুলিও তাদের কাছে সহজ হয়ে উঠবে । আর , বাস্তব জীবনের সঙ্গে সব কিছুর যােগ দেখিয়ে দিতে হয় ।
ঈষদা - দা ( বিশ্বাস ) —শিক্ষকের করণীয় বলে আপনি যা বলেন , তা কি আমাদের দিয়ে সম্ভব ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — কেন সম্ভব হবে না ? একটু ইচ্ছা ও commonsense ( সাধারণ বুদ্ধি ) থাকলেই পারা যায় । Unbiased observation ( অপক্ষপাত পৰ্যবেক্ষণ ) থেকে commonsense ( সাধারণ বুদ্ধি ) grow করে ( গজিয়ে ওঠে । যেমন , ডাক্তার তাে মেটিরিয়া মেডিকার সব ওষুধগুলি ব্যবহার করেনি , তবু পাচটা দেখা থাকে বলে নুতন রোগ দেখে ঠিক করে নেয় এই ওষুধটা দিতে হবে । Ideal - এ (আদর্শে) fanatically inclined ( গভীরভাবে আনত ) থাকলেই passion- এর ( প্রবৃত্তির ) সওয়া - হাত উপরে থাকা যায় , তখনই ঠিক - ঠিক observe (পৰ্যবেক্ষণ) করা হয় । নইলে প্রবৃত্তি অভিভূতির দরুন অনেক জিনিস আমাদের চোখেই পড়ে না । কোন - একটা জিনিস যা ‘- যা’ নিয়ে , তা অনুধাবন করার ভিতরদিয়ে আসে জানা , সে - সম্বন্ধে অনুভবকে বলে বোধি । না করে জানা হয় না , করার ভিতর - দিয়ে যে integrated sense ( সংহত বােধ ) হয় , তাকেই বলে জানা । পড়াশুনা ভাল পারলে তাকে আমরা ভাল ছেলে বলি , কিন্তু ভাল ছেলে মানে profitably active ( লাভজনকভাবে কর্মঠ ) ছেলে , profitable to himself and the environment ( নিজের এবং পারিপার্শ্বিকের পক্ষে লাভজনক ) ।
ধূর্জটিদা ( নিয়ােগী ) —নিউটনের মাথায় এলাে ,, ফল পড়ে কেন ? অন্যর মাথায় এলো না কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— Inquisitive ( সন্ধিৎসু ) থাকা active brain- এর ( সক্রিয় মস্তিষ্কের ) লক্ষণ , inquisitive ( সন্ধিৎসু ) হ'লে অমন হয় । যার যেমন interest (ভাল লাগা ) তার inquisitiveness ( অনুসন্ধিৎসা) । তেমনি , একজন হয়তো একদিকে interested ( অন্তরাসী ) inquisitive ( অনুসন্ধিৎসু ) হ'য়ে থাকে — অন্যদিককার ঘটনা তার নজরে পড়ে না ।
Lord ( প্রভুর) অনেকের inquisitiveness ( অনুসন্ধিৎসা ) আদপেই বিশেষ দেখা যায় না , callous ( বোধহীন ) হ'য়ে থাকে । তারও কারণ দেখা যায় , তাদের inquisitive tendency ( সন্ধিৎসু ঝোক ) কোথাও হয়তাে thrashing (আঘাত ) পেয়ে বুজে গেছে । Heredity- র ( বংশগতির ) ভিতর - দিয়েও আবার callousness ( বােধহীনতা ) transmitted ( সঞ্চারিত ) হয় — তারও মূলে অনেক সময় থাকে পিতৃপুরুষের জীবনে পারিপার্শ্বিকের সংঘাতে সন্ধিৎসার অপমৃত্যু ।
ব্ৰজেনদা ( চট্টোপাধ্যায় ) অসুস্থ , তাই শ্রীশ্রীঠাকুর দেবীকে ( চক্রবর্তী ) পাঠিয়ে তার খবর নিলেন ।
প্রফুল্ল — আমাদের এ আন্দোলনে ঋত্বিকদের দায়িত্বই তাে সবচেয়ে বেশী , কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এতই প্রবৃত্তি - ঝোকা যে আমরা তাে তাদের পথে আনতে পারছি না । এর প্রতিকার কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ঋত্বিকরা হলো messenger of the lord (প্রভুর বার্তাবহ ) , তারা যদি ইষ্টের সঙ্গে in tune ( একতান ) থাকে , তখন এমনতর একটা microphonic adjustment ( সুক্ষ্ম শব্দ - শ্রবণযন্ত্রের মত সমাবেশ ) হয় যে , ঐ ইষ্টানুগ প্রেরণাই যেন রাশ ঠেলে দিতে থাকে , যেখানে যেমন চলা , বলা , ব্যবহার প্রয়োজন , সেখানে নিখুতভাবে তেমনতরই হতে থাকে , তখন তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে । যত বেয়াড়া মানুষই হােক , বাচার ক্ষুধা সবারই আছে , কামুক কামের সেবা করেও বাঁচতে চায় , মরতে চায় না ; লােভী খেতে যেমন চায় , বাঁচতেও চায় ; বেঁচে যদি না থাকে খাবে কি করে ? বাঁচার আকুতিই হ'লে common basis ( সাধারণ ভিত্তি ) । ওর উপর ভর দিয়ে , তার প্রবৃত্তিমাফিক টোপ ফেলে সেই সূত্রের ভিতর - দিয়ে তাকে ইষ্টানুগ নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত করেই হােক , আর যে - ক'রেই হােক , ইষ্টবিষয়ে interested ( অনুরক্ত ) ও convinced ( প্রত্যয়শীল ) করে তোলাই ঋত্বিকের পারগতার মাপকাঠি । ছলেবলে , কলে - কৌশলে যেমন করেই হােক , মানুষকে মঙ্গলের পথে যুক্ত করে তুলতে হবে । শুধু ভাল মানুষ হলেই চলবে না , কুশল - কৌশলী হবারও প্রয়ােজন আছে । যার মধ্যে যে - রাস্তা দিয়ে ঢুকতে হয় তার মধ্যে সেই রাস্তা দিয়েই টোকা লাগবে । এর কোন ধরা - বাঁধা পথ নেই । তবে এক - এক complex- এর ( প্রবৃত্তির) উপর দাড়িয়ে এক - এক category ( শ্রেণী ) হয় , তার মধ্যে আবার কত রকমারি থাকে । কোন category- র ( শ্রেণীর) লােককে কেমন করে deal ( পরিচালনা করলে , সহজে তার ভিতর
প্রবেশ করা যায় , সেটা করতে - করতে বোধ করা যায় । যাজনের আগে - পরে বিশ্লেষণ করতে হয় । মহড়া দিতে হয় , কোন ধরণের লােকের সাথে কেমনভাবে কী বলা উচিত । মাথায় ঐ ধ্যান লেগে থাকা চাই । আর , সব বিষয়ে ভাল করে পড়াশুনা করে ঢাল - তরােয়ালও ঠিক রাখা লাগে ।
10