🔷প্রফুল্ল — মা - বাবাকে অনুসরণ করলে কি অমন অনুভূতি হয় না ?
🔷ভগবৎ - প্রাপ্তি...
🔷 ইষ্ট না থাকলে মানুষের কী অবস্থা হয়..
🔷নগেনদা — ছেলেপেলের instinct ( সহজাত সংস্কার বােঝা যাবে কী করে?
🔷কিকরে বুঝব লােকের দক্ষতা কেমন...
🔷কী ধরনের কাজ করার অভ্যাস থাকলে আর বেকার হতে হবে না...
🔷স্বস্ত্যয়নীর পাঁচটি নীতির কথা...
৯ ই অগ্রহায়ণ , সােমবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৪/১১/১৯৪১ )
অন্যান্য দিনের মতো আজও ভােরে অনেকে গিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে তাসুতে সমবেত হলেন । ভগবৎ - প্রাপ্তি - সম্বন্ধে কথা উঠলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — ভগবানের মধ্যে আছে ঐশ্বৰ্য্য , আধিপত্য ( mastery ) , যাকে সার্থক করতে গিয়ে কারও দুনিয়ার প্রত্যেকটা জানা প্রত্যেকটা জানকে সার্থক করে মহাসার্থকতা লাভ করে meaningful ( সার্থক হয়ে ওঠে) , প্রবৃত্তিগুলি বিন্যস্ত ও সংহত হয়ে ওঠে , জীবনের যাবতীয় যা - কিছু সঙ্গতিশীল সমাধানী একীকরণে উদ্ভিন্ন হ'য়ে ওঠে — সংশ্লেষণী , বিশ্লেষণী তৎপৰ্যে , —তিনিই তার ভগবান । মানুষ বাস্তব মানুষের মধ্যে এইভাবে ভগবানকে পায় — যেমন অর্জুন পেয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে , হনুমান রামচন্দ্রের মধ্যে , বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের মধ্যে বাঞ্ছিতের আগ্রহে তাকেই উপলক্ষ্য করে সব সার্থকতায় সংগ্রথিত হয় , প্রত্যেকটা প্রত্যেকটাকে fulfil ( পরিপূরণ ) করে integrated ( সংহত ) হয় , lidated ( সংবদ্ধ ) হয় , প্রত্যেকটা প্রত্যেকটার সঙ্গে wedded ( পরিণয় - নিবদ্ধ ) , welded ( মিলিত ) হ'য়ে যায় । যেমন , কাম তখন ক্রোধ , লোভ , মদ , মোহ , মাৎসৰ্য্যকে fulfil ( পরিপূরণ ) করে , ক্রোধকাম , লােভ , মদ , মােহ , মাৎসৰ্য্যকে fulfil ( পরিপূরণ ) করে ইত্যাদি । এটা হয় যখন সবকিছুকে একমাত্র ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনে নিয়ােজিত করা যায় — এই করাই সব বৃত্তিকে converge (একমুখী ) ক'রে explain ( অর্থপূর্ণ ) করে , adjust ( নিয়ন্ত্রিত ) করে chaos (বিশৃঙ্খলা ) -এর মধ্যে cosmos ( সুশৃঙ্খল - বিধান ) গড়ে তােলে । নিশ্চয়াত্মিকা প্রত্যয় ও জ্ঞানের ভূমিতে দাড়িয়ে মানুষ স্বতঃই তখন ঐশ্বর্য্যে অধিষ্ঠিত হয় , সব্বার্থসিদ্ধির কৌশল তখন তার আয়ত্ত হয় । তখন ‘ বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি ’ হয়ে ওঠেন তার কাছে । তখন সে বলে— “ ব্রহ্ম আমার বাঞ্ছিতের অঙ্গজ্যোতিঃ , প্রেষ্ঠকে বাদ দিয়ে তখন তার চাওয়া ও পাওয়ার আর কিছুই থাকে না । এতে যে কী সুখ , কেমন করে বলব , কিভাবে বোঝাব ? মিছেই মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠার বুদ্ধিতে নিজেকে বঞ্চিত করে , মানুষের এই বেকুবী দেখে আমার বড় ব্যথা লাগে ।
প্রফুল্ল — মা - বাবাকে অনুসরণ করলে কি অমন অনুভূতি হয় না ? শ্রীশ্রীঠাকুর — মাতৃভক্ত ছেলে ইষ্টানুরক্ত হয়ই । তবে যাঁকে অনুসরণ করব , তিনি যদি বৈশিষ্ট্যপালী অপুরয়মাণ আচরণ - প্রতিষ্ঠ আচাৰ্য্য না হন , তাঁর জীবনে জীবন্ত demonstration বা দৃষ্টান্ত যদি না দেখি , তার কাছ থেকে impulse (প্রেরণা) , যদি না পাই , তাহ'লে হয় না । দুটো দিকের সামঞ্জস্য চাই , অর্থাৎ বৈশিষ্ট্যপালী পুরয়মাণ আচাৰ্য ইষ্ট বা গুরুপুরুষােত্তম চাই এবং সেই সঙ্গে তার প্রতি চাই প্রবৃত্তিপরভেদী অচ্যুত সক্রিয় অনুরাগ । এই মণিকাঞ্চন সংযােগ যখন হয় , তখনই মানুষ সার্থক হয় । অমনতর সদগুরুকে শুধু জিনিস । দেখলেই হয় না বা নিষ্ক্রিয় ভাবে তার উপদেশ শুনলেও হয় না । করা চাই , করা ছাড়া কিছুই আমাদের করতলে আসে না , অর্থাৎ তা আমাদের আয়ত্ত হয় না । শুধু গুইসাপ দেখা আর শােনা যে গুইসাপের চামড়ায় খঞ্জরী হয় , আর গুই সাপের চামড়া দিয়ে খঞ্জরী করে মোচে তাও দিয়ে মনের আনন্দে আপন হাতে তা ’ বাজান , এই দুইয়ে ঢের তফাৎ । সন্ধান পাওয়া ও আধিপত্য থাকা পৃথক জিনিস। এই আধিপত্যলাভ — এও কিন্তু , ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার জন্য , নিজের হীনত্ববুদ্ধি বা কামকামনার পরিপােষণের জন্য নয় । আর কিছু না , ছেলেবেলা থেকে বৃত্তিস্বার্থ ও বৃত্তিপ্রতিষ্ঠা বড় না হয়ে যদি মা - বাপের স্বার্থপ্রতিষ্ঠা বড় হয় , তবে ঘরে - ঘরে দুর্গোৎসব লেগে যায় । অবশ্য , মা - বাপেরও ইষ্টপ্রাণ হওয়া দরকার । ইষ্টপ্রাণতাই বস্তু , আর কিছুরই দাম নেই । ইষ্টকে যে অনুসরণ করব তাও দেখব তিনি কতখানি ইষ্টপ্রাণ ।
পঞ্চাননদা -- ইষ্ট বা গুরুহীন বহু লােক আজ সমাজে গুরুর আসন অধিকার করে বসে আছেন । তাদেরই বেশী লােক মনে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ললিত - মধুর কণ্ঠে অপূৰ্ব ভঙ্গীতে বললেন -----‘
যার যাকে লাগে ভাল , তারে ভজুক তারা গাে
আমার কিন্তু লাগে ভাল শচীর দুলাল গোরা গাে । ”
ইষ্ট না থাকলে মানুষের কী অবস্থা হয় সেই - সম্বন্ধে শ্রীশ্রীঠাকুর আবেগভরে বলতে লাগলেন— Ideal ( ইষ্ট ) না থাকলে , ego ( অহং ) passion- এ ( প্রবৃত্তিতে ) rest করে ( অনুশায়ী হয়ে থাকে ) , ego ( অহং ) প্রবৃত্তিঝোকা হ'লে মানুষ whimsical ( খামখেয়ালী ) হয় , সে যে কখন কোন দিকে যাবে , কাকে কী করবে আর নিজেকেও বা কোন্ অবস্থার মধ্যে নিয়ে ফেলবে তার ঠিক নেই , কিন্তু মানুষ Ideal- এ ( ইষ্টে ) যুক্ত হলে wise ( প্রজ্ঞাবান ) , sweet ( মধুর ) , grave ( গম্ভীর ) ও strong ( শক্তিমান ) হয় , তার passion ( প্রবৃত্তি ) -গুলিও ঐ ইষ্টেরই সেবা করে । ইষ্ট হলেন চিরমঙ্গলময় , তাই প্রবৃত্তিগুলিও তখন নিজের ও পরের মঙ্গল আবাহন করে , ওগুলি তখন হয় ধর্মের বাহন , রিপু অর্থাৎ শত্রু , হয়ে থাকে না , আর তাকে দমন করার জন্য কসরতও করতে হয় না । ফল কথা , প্রবৃত্তিগুলি খারাপ কিছু নয় , ওগুলি libido- রই ( সুরতের ) manifestation ( (অভিব্যক্তি ) । ওগুলি খারাপ হয় তখন , যখন ইষ্টের সেবায় লাগে না তখন ওরা আর আমার থাকে না , ওদের আমি হয়ে যাই , অর্থাৎ শয়তানই হয় তখন আমার ও আমার প্রবৃত্তির চালক । শুধু নামকো ওয়াস্তে ইষ্টস্বার্থ , ইষ্টপ্রতিষ্ঠা করলে চলবে না । মানুষ ইষ্টস্বার্থ ,ইষ্টপ্রতিষ্ঠা নিয়ে ঘোরে , তার পিছনেও অনেক সময় হয়তো উদ্দেশ্য থাকে কোন মেয়েমানুষের বাহবা পাওয়া , তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা , বা নাম - কেনা , তাতে যে বেশী - কিছু ফল হয় তা হয় না । এই বুদ্ধি থাকা চাই যে , আমার সবকিছু দিয়ে তাকেই উপচয়ী করে তুলব , তার জন্যই তাকে চাইব । একটু , যার মন আছে , ইচ্ছা আছে , সেই পারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে প্রশ্ন করা হ'লাে — ‘ শ্রীনাথে জানকীনাথে অভেদঃ পরমাত্মনি , তথাপি মম সব্বস্বঃ কমললােচনঃ - কথার তাৎপর্য কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ধরুন , আমি হয়তাে নেই , আমার অবর্তমানে আমার ছেলেদের মধ্যে আমার সাদৃশ্য লক্ষ্য করবেন , তাদের ভালবাসবেন আমার থেকে এসেছে ব'লে , কিন্তু তাদের ইষ্ট বলে ভাবতে পারবেন না , তেমনি । ঈষদা - দা একটি পেন্সিল ফেলে উঠে যাচ্ছিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তাড়াতাড়ি ডেকে পেন্সিল তুলে নিতে বললেন । আরাে বললেন , সব দিকে খেয়াল রেখে চলবেন । বে - খেয়াল মানেই জানবেন imbalance ( সাম্যহারা ভাব)।
১০ ই অগ্রহায়ণ , মঙ্গলবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৫/১১/১৯৪১ )
রাত্রির শেষযাম , পদ্মাচরের আশ্ৰমভূমি এখনও নিদ্রিত , বকুলগাছ ও বাবলা গাছগুলি নিৰ্বাক প্রহরীর মতো দাড়িয়ে আছে । সারা রাত্রির শিশিরস্নাত ধরিত্রী মৌন যােগাসনে ব'সে কার ধ্যান করছে কে জানে ? তারই কাছে তো সবাই ছােটে , সবাই তাঁর পায়ের তলায় এসে জোটে , এর কোন দিন - ক্ষণ নেই , অবিরত অবিশ্রান্ত চলেছে মানবাত্মার এই চিরন্তন অভিসার , দরদীর কাছে , মরমীর কাছে , প্রজ্ঞানঘন প্রেমময়ের কাছে তাই মানুষের ভিড় লেগেই থাকে , তিনি চির - অতন্দ্র , আর নিরন্তর চলে তার অজস্র সুধাবর্ষণ ।
আজ তপােবনের শিক্ষকবৃন্দ এসেছেন জিজ্ঞাসু মন নিয়ে । শিক্ষা - সম্বন্ধে সুর হলো তার অমৃত বাণী — আদর্শকে ধরে instinct ( সহজাত সংস্কার) গুলিকে বাস্তবে মূৰ্ত্ত করে তােলাই শিক্ষা ।
নগেনদা — ছেলেপেলের instinct ( সহজাত সংস্কার বােঝা যাবে কী করে?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ছেলেপেলের instinct ( সহজাত সংস্কার বােঝা কঠিন কিছু নয় , heredity ( বংশগতি ) consider ( বিবেচনা ) করতে হয় , খেলাধুলাের মধ্যদিয়ে লক্ষ্য করতে হয় , কার কোনদিকে ঝোঁক দেখতে হয় , খেলার সাথীর সঙ্গে unguarded moment- এ ( অসতর্ক মুহূর্তে ) ব্যবহার কেমন করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয় , এই সবের মধ্য দিয়ে ধরা যায় , আর সেই অনুযায়ী nurture ( পােষণ ) দিতে হয় , stimulate ( উদ্দীপ্ত ) করতে হয় , active ( সক্রিয়) করতে হয় । জেলের ছেলের কাছে জালের উপমা দিতে হয় , কুমােরের ছেলের কাছে হাড়ি - পাতিলের কথা বলতে হয় । ক্লাসে অনেক ছেলে থাকে , তাদের বংশানুক্রমিকতা ও পরিবেশ বুঝে , এমন একটা common ( সাধারণ ) ধরণ বের করতে হয় , যেটা সকলেরই মনে ও মাথায় ধরে । তাছাড়া আবার রকমারি ধরণে বলা লাগে , যাতে বিভিন্ন group ( দল ) -এর ছাত্ররা specific nurture ( বিশিষ্ট পোষণ ) পায় । আর , যদি demonstrative delivery ( প্রদশনযােগ্য পরিবেশন ) -এর রকম ক'রে , অর্থাৎ একটা theatrical performance (নাট্যাভিনয় ) -এর মতাে করে তাদের কাছে appear ( প্রত্যক্ষ ) করিয়ে দিতে পার , আরাে ভাল । Instinct ( সহজাত সংস্কার ) গুলিকে nurture ( পােষণ ) দিয়ে acquisition ( অধিগমন ) -এ interested ( অনুরাগী ) ক'রে , প্রত্যেকটি জানা প্রত্যেকটি জানাকে meaningful ( সার্থক) করে তোলে , ছাত্রের ভিতর এমনতর active adjustment ( সক্রিয় সঙ্গতি ) এনে দেওয়াই শিক্ষকের প্রকৃত কাজ । সমস্ত life - affair ( জীবন চলনা ) -কে কতকগুলি activity ( কৰ্ম্ম ) -র group- এ ( শ্রেণীতে ভাগ করে নিতে হয় , syllabus ( পাঠ্যপুস্তক ) ও সেই অনুযায়ী activity- র ( কর্মের ) ভিতর দিয়ে পড়িয়ে দিতে হয় , ঐ purpose (উদ্দেশ্য ) fulfilled ( পূরণ ) হয় এমনতর ক'রে নুতন ধরণের বই লিখতে হয় ।
ছেলেপেলেরা কোন সময় পড়াশুনায় willing ( ইচ্ছুক ) থাক আর না থাক practical activity ( বাস্তব কৰ্ম ) থাকলে মুহূর্তে তাদের mood ( মনােভাব ) ready ( প্রস্তুত ) করে নেওয়া যায় । ছেলে যে পারে না এমনভাবে কিছুতে ঢোকাতে নেই— teacher ( শিক্ষক ) -এর একটা careless remark ( অসতর্ক উক্তি ) ছেলের মাথা খেয়ে দিতে পারে । কাজে , কর্মে , ব্যবহারে , পড়াশুনায় ছাত্রের একটু উন্নতি দেখলেই তা ’ publicly ( সাধারণ্যে ) appreciate (তারিফ) করা লাগে , ওতে encouraged ( উৎসাহিত) হয়ে বাহবার লোভে অরো লেগে যায় ।
Greatest disqualification of a teacher ( শিক্ষকের প্রধান দোষ ) হলো , আর - একজন teacher ( শিক্ষক ) -কে down ( খাটো ) করা । Ideal- কে মাঝখানে রেখে প্রত্যেক teacher ( শিক্ষক ) প্রত্যেক teacher- এ এমনভাবে interested ( অন্তরাসী ) হবে , যে ১৫ জন teacher ( শিক্ষক ) যেন আলাদা - আলাদা নয় , সবাই মিলে যেন একজন teacher ( শিক্ষক ) ছাত্ররা যতজনের কাছেই পড়ুক , মনে হবে একজনের কাছেই পড়ছে । একটি ছাত্র কোন একজন teacher ( শিক্ষক ) -এ interested ( অন্তরাসী ) হ'তে গেলে সব teacher- এ (শিক্ষকে ) interested ( অন্তরাসী ) না হয়ে পারবে না । শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে যে , indomitable active urge to fulfil the Ideal Beloved- ই ( প্রিয়পরমকে পরিপূরণের অদম্য সক্রিয় আকুতিই) হচ্ছে fundamental nucleus of man - building , nation building ( মানুষগঠন ও জাতিগঠনের মূল প্রাণকেন্দ্র ) । আরাে স্মরণ রাখতে হবে যে , করা - মুখর পড়া হবে , কিন্তু পড়া - মুখর করা নয় ।
বিমলদা — কী - কী কর্ম্মের আয়ােজন করা যায় ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - আমার মনে হয় , agriculture ( কৃষি ) -কেই করতে হয় মূল ভিত , সেই সঙ্গে থাকবে carpentry ( ছুতােরের কাজ ) , smithy (কামারশালের কাজ ) , wicker - works ( বাঁশ ও বেতের কাজ ) , tailoring (দর্জির কাজ ) , weaving ( বয়ন - শিল্প ) , drawing ( অঙ্কন ) , masonry (রাজমিস্ত্রীর কাজ ) ইত্যাদি with a view to demonstrate physics and chemistry with mathematical accuracy and artistic skill ( গাণিতিক অভ্রান্ততা ও শিল্প ও সৌন্দৰ্যবোধজাত কুশলতা নিয়ে পদার্থ বিদ্যা ও রসায়নশস্ত্রকে বোধয়িত করবার জন্য ) । সমস্ত কাজের ভিতর - দিয়ে দেখতে হয় efficiency ( দক্ষতা ) grow করছে ( বৃদ্ধি পাচ্ছে ) কিনা , কত কম সময়ে কত beautifully and profitably output ( সুন্দর ও লাভজনকভাবে উৎপাদন ) করছে ।
অর্জনে পটু সাশ্রয়ী কাজে
সুন্দরে সমাপন ,
এই দেখে তুই বুঝবি লােকের
দক্ষতা কেমন ।
গতানুগতিকভাবে কতকগুলি কাজের প্রবর্তন করলেই যে হবে তা নয় , teacher- এর ( শিক্ষকের ) যদি inquisitive ( অনুসন্ধিৎসু ) , researchful ( গবেষণামুখর ) , active attitude ( সক্রিয় মনােবৃত্তি ) থাকে , তবেই monotony ( একঘেয়েমি ) break করে ( ভেঙ্গে যায় ) , ছাত্রের শেখার urge (অকূিতি ) -ও বাড়ে ।
আলোচনার স্রোত চলেছে । সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথাগুলি শুনছেন । মাঝে - মাঝে এক - আধটা প্রশ্ন করা হচ্ছে । পূৰ্ব্ব - আলােচনার সূত্র ধরে প্রশ্নকরা হলাে — আপনি শিক্ষার মধ্যে কৃষি , কাঠের কাজ , কামারশালার কাজ , বয়ন , রাজমিস্ত্রীর কাজ , বেত ও বাঁশের কাজ , নানাপ্রকার কুটিরশিল্প ইত্যাদি অবশ্য শিক্ষণীয় হিসাবে প্রবর্তন করতে চেয়েছেন , জীবিকা - হিসাবে এ - সব যদি গ্রহণ করি , এত শিখে লাভ কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — এই fundamental activities at ease with electric speed ( মৌলিক কাজগুলি সহজে বিদ্যুৎ - গতিতে ) করার অভ্যাস থাকলে , তােমার আর বেকার হতে হবে না , allied ( সংশ্লিষ্ট ) যে - কোন কাজ আরম্ভ করতে পারবে । তােমাকে এ - সব কাজে কেউ ঠকাতে পারবে না । আর , এতগুলি কাজ যদি তােমার জানা থাকে , তুমি ওকালতি কর , আর যাই কর , finely (সূক্ষ্মভাবে ) ও successfully ( কৃতকাৰ্য্যতা - সহকারে ) করতে পারবে । কারণ , ঐসব কাজের অভিজ্ঞতা তােমার বোধকেও অতখানি পুষ্ট করে তুলবে , তােমার ভিতর confidence ( আত্মপ্রত্যয় ) গজিয়ে দেবে । ওগুলি জানতে গিয়ে motor - sensory co - ordination ( বোধপ্রবাহী ও কর্মপ্রবােধী স্নায়ুর সঙ্গতি ) ও অর্জনপটুতার training ( শিক্ষা ) ছেলেবেলা থেকে হয়ে থাকবে , তাই তােমাকে উতরে দেবে । সব কাজ জানা ও পারার মধ্যে থাকলে , যে - কোন situation ( অবস্থা ) -কে face করতে ( সম্মুখীন হতে ) ঘাবড়াবে না । আজ আমাদের দেশে চৌকষ মানুষের বড় অভাব হয়ে গেছে , স্ব - স্ব বৈশিষ্ট্যের উপর দাড়িয়ে যথাসম্ভব সৰ্বতােমুখী শক্তি ও প্রতিভার স্ফুরণ যদি করে তুলতে পার , মানুষগুলি গােটা মানুষ হয়ে উঠবে , জাতিও শক্তিমান হবে । দীর্ঘদিন motor nerve use ( কর্মপ্রবোধী স্নায়ুর ব্যবহার) না করে - করে তথাকথিত শিক্ষিত অনেকে অনেক দিক থেকে পঙ্গু হয়ে রয়েছে । তাদের ঐ - সব fine nerve (সূক্ষ্ম স্নায়ু ) -গুলি অবশ হয়ে গেছে । ওগুলিকে বাস্তব কাজের ভিতর - দিয়ে যদি পােষণ না দেওয়া যায় , জীবনের উল্লাসই তারা সম্যক উপলব্ধি করতে পারবে না , আবার future generation ( পরবর্তী বংশধর ) -ও এর দ্বারা affected (আক্রান্ত ) হবে । তাই , শিক্ষায় practical work ( বাস্তব কাজ ) -এর কথা আমি অতাে ক'রে বলি । Motor - sensory co - ordination (বোধপ্রবাহী ও কর্মপ্রবোধী স্নায়ুর সঙ্গতি ) -কে যদি ignore ( উপেক্ষা ) কর , সে - শিক্ষা ফলবতী হবে না ।
প্রফুল্লতাহ'লে motor - sensory co - ordination ( বােধপ্রবাহী ও কর্ম- প্রবােধী স্নায়ুর সঙ্গতি ) জাগানাের তুক কী ? আর , পারিপার্শ্বিকের মধ্যেও বা তা ’ ব্যাপকভাবে চারান যায় কেমনভাবে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর দৃপ্তকণ্ঠে আবেগভরে বলতে লাগলেন । ভাবের আতিশয্যে তার চোখদুটি বিস্ফারিত হয়ে জ্বলজ্বল করতে লাগল , বদনমণ্ডল এক অপূৰ্ব্ব - জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো — স্বস্ত্যয়নীর ক’টি factor ( নীতি ) পালন কর , ঐ ক’টি ছাড়া পথ নেই । ওতে সব হবে , নিশ্চয় , নিশ্চয় , নিশ্চয় বলছি , —কোন সন্দেহ নেই । একজন স্বস্ত্যয়নী করতে থাকলে , সে তো বৃহৎ হ’তে বৃহত্তর পারিপার্শ্বিকের সংস্পর্শে যাবেই , তার চলনায় , তার impulse- এ * (প্রেরণায় ) তার পারিপার্শ্বিকের মধ্যেও factor ( নীতি ) -গুলি ঢুকতে থাকবে । স্বস্ত্যয়নী হলো একটা সপারিপার্শ্বিক run ( গতি ) -evolution ( বিবর্তন ) এর দিকে , becoming ( বিবর্ধন ) -এর দিকে । এতে physical ( শারীর ) , complex (বৃত্তি) -র psychical ( মানস ) , environmental ( পারিবেশিক ) , material (জাগতিক ) —সব দিক সমান্তরালভাবে adjusted ( নিয়ন্ত্রিত ) হ'তে থাকবে । সবগুলিই কিন্তু পালন করতে হবে , কোন - একটি নীতি পালনে ত্রুটি হলে বুঝতে হবে আমার এই পুণ্যব্রত ক্ষুন্ন হলাে , নিষ্ঠার সঙ্গে সর্বদা সজাগ হ'য়ে এদিকে লক্ষ্য রেখে চলতে হবে , নিত্য নিরখ - পরখ করে দেখতে হবে , আমার ঐ ব্রত উদযাপনে কোথায় ব্যত্যয় হলাে , সেটা আবার জাগ্রত প্রচেষ্টায় বাস্তব আচরণের বেলায় শােধরান লাগবে । এইভাবে দেখতে - দেখতে একটা মানুষ নিচ্ছিদ্র আমান দেবতা হয়ে ওঠে । তার পারিপার্শ্বিকও রাঙ্গিয়ে ওঠে নূতন রং - এ । স্বস্ত্যয়নীর পাঁচটি নীতির কথা আবার বলছি— ( ১ ) ইষ্ট -পূজার যন্ত্র বিবেচনা করে শরীরটাকে সুস্থ ও সহনপটু ক'রে তুলবে । ( ২ ) যে কাজে যা ’ ভাল বলে মনে হবে তাকে তৎক্ষণাৎ কর্মে ফুটিয়ে তুলবে । ( ৩ ) প্রবৃত্তি যখন যেদিকেই উকি মারুক না কেন , সে - ঝোঁকটাকে ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার দিকে ঘুরিয়ে দেবে । ( ৪ ) পারিপার্শ্বিকের বাঁচা - বাড়াকে নিজেরই বাঁচা - বাড়ার স্বার্থজ্ঞানে ইষ্টানুগ সেবা ও যাজনে তাদের উচ্ছল ও উদ্বর্ধিত করে শ্রেয়প্রাণ করে তুলবে । ( ৫ ) আর নিত্য নব - নব উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার ভিতর দিয়ে নিজের আহরণ বাড়িয়ে ইষ্টার্থে যত বেশী পার নিবেদন করবে , এবং ত্রিশ দিনের দিন তিনটি টাকা ইষ্ট - সকাশে নিবেদন করে বাদ বাকী স্বস্ত্যয়নীর উদ্বৃত্ত তহবিলে তা ’ দিয়ে স্থাবর ইষ্টোত্তর সম্পত্তি করবে , তার আয়ের এক পঞ্চমাংশ তুমি সেবাইত হিসাবে গ্রহণ করতে পার , বাকী চার অংশ ইষ্টোত্তর সম্পত্তি বৃদ্ধির কাজে লাগাবে । সবগুলি নীতিই পালনীয় , কিন্তু অর্ঘ্য রাখাটা যদি অটুটভাবে চালান যায় — এমন কি বিশেষ অবস্থায় ভিক্ষা করেও যদি সেটা অব্যাহত রাখা যায় , তার ফলে অস্তে - আস্তে অন্যগুলিও আসতে থাকে , অবশ্য যদি আগ্রহ থাকে । আরগুলি পালন করার চেষ্টা করি , কিন্তু অর্ঘ রাখি না , তাতে কিন্তু হবে না , উৎসের জন্যই যা - কিছু , ওইটে হ'লো বোটা — ঐ বোটা ভেঙ্গে গেলে আর সবও ভাঙ্গতে থাকবে , মূল urge ( আকুতি ) ঠিক রাখতে হবে সর্ব্বদাই , নইলে নিরর্থক হবে , শুকিয়ে যাবে প্রচেষ্টা । Knowledge of time ( সময়ের জ্ঞান ) -এর জন্য accuracy of time and date ( সময় ও তারিখের নির্ভুলতা ) observe ( প্রতিপালন) করা দরকার । বহু লােকে properly ( যথাযথভাবে ) স্বস্ত্যয়নী observe (প্রতিপালন) করার ফলে , কতখানি যে হতে পারে ভেবে শেষ করা যায় না । স্বস্ত্যয়নীর উদ্বৃত্ত থেকে কত স্বস্ত্যয়নী - ষ্টেট গড়ে উঠবে । কোন এক actuary ( হিসাব - বিশারদ ) নাকি এটাকে বলেছে revolutionary economics ( বিপ্লবী অর্থনীতি ) । কোন emergency- তে ( বিশেষ সঙ্কটকালে ) স্বস্ত্যয়নীর ষ্টেটগুলির বার্ষিক আয়ের চারের পঞ্চমাংশ টেনে নিলে আর tax ( কর) ধার্য করা লাগবে না , ইষ্ট ও পূৰ্ত্তের জন্য অফুরন্ত সম্পদ রয়ে যাবে , দেশে আর হা - ভাত আসতে পারবে না , জগৎ অমৃতময় হয়ে যাবে ।
সকলের মর্মস্থল আলোড়িত করে আগ্রহ - আবেগে শ্রীশ্রীঠাকুর কথাগুলি ব'লে গেলেন । বলার পর সহজভাবে আদরভর কণ্ঠে বললেন , “ প্যারীচরণ । তামাক খাওয়াও । ”
প্যারীদা তামাক সেজে গড়গড়ার নলটি শ্রীশ্রীঠাকুরের হাতে তুলে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে হাসিমুখে প্রীতি - প্রসন্ন ভঙ্গীতে সস্নেহে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন ; তার মধুময় দৃষ্টি সকলের অন্তরে যেন অমৃতস্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে , সকলের বুক কানায় - কানায় ভ'রে উঠছে , কারও কোন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না , একটা সুখ - বোঘােরে আচ্ছন্ন স্তব্ধ সবাই ।
ধীরে - ধীরে অরুণােদয় হ'লো । শিশিরস্নাত বালুচর ঝিকমিক করে উঠলো । বাবলা , নিম ও বকুলের শীর্ষে ঝলকে উঠলো সােনালী আলাে । শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে লােকের ভিড়ও জমে উঠতে লাগলাে । আবালবৃদ্ধ - বনিতা আসছেন সু প্রভাতে তাকে প্রণাম করে , সমবেত প্রার্থনায় যােগ দিয়ে দিন - যাত্রাকে শুভোৎসব ময় করে তুলতে ।
এরপর মহাপুরুষ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের আবির্ভাবের বিষয়ে কথা উঠলো । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — প্রয়ােজনমতাে এক - একটা constellation ( জ্যোতিঙ্ক মণ্ডলী ) আগে পরে সবটা নিয়ে ফুটে ওঠে , মহাপুরুষ যখন আসেন — তাতে অনুরক্ত সাঙ্গোপাঙ্গও আসেন , এই সাঙ্গপাঙ্গদের কাজ হয় ঐ মহাপুরুষের mission ( জীবনেদ্দেশ্য ) -কে বাস্তবে ফুটিয়ে তােলা , মহাপুরুষেরা যে পদাঙ্ক রেখে যান , তাই হয় ভবিষ্যৎ মানুষের চলার পথ । সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে যারা যত অচ্যুতনিষ্ঠাসম্পন্ন , আচরণ - সিদ্ধ , লোক - হৃদয়কে আদর্শে আকৃষ্ট করে তারা তত দেব - দীপ্তিতে দীপ্তিমান হয়ে ওঠেন । মানুষ এদের কথা স্মরণ করে ভরসা পায় , প্রেরণা পায় , জীবন পায় ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর উঠে পায়খানায় গেলেন এবং শ্ৰীযুত কিশােরীদার পরিচালনায় মাতৃ - মন্দিরের বারান্দায় সমবেত বিনতি - প্রার্থনা শুরু হলাে ।
10