🔷 দেব শিশুর আবির্ভাব কি করে হয়..?
🔷 মেয়েরা যদি পিতৃভক্ত হয় , তাহলে সে - সব মেয়েরা সাধারণতঃ ভাল হয়ই
🔷 মানুষের রােগ - শােক , অভাব - অভিযােগ যেন দিন - দিন বেড়ে যাচ্ছে , এর প্রতিকার কী ?
🔷 রেণুমা সন্তান - প্রসবকালে মারা গেছেন..
১২ ই অ গ্রহায়ণ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৭/১১/১৯৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর ভােরে ঘুম থেকে উঠে বাঁধের ধারে তাসুতে বিছানায় বসে আছেন । অন্যদিনের মতো আজও তপােবনের শিক্ষকবৃন্দ এবং আরও অনেকে সেই শীতের মধ্যে এসে হাজির হলেন তার সঙ্গলাভের নেশায় । মানুষ ছুটে আসে তার কাছে , না এলে ভাল লাগে না তাই আসে । এসে নুতন করে প্রাণ পায় , প্রেরণা পায় , সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে । নিজেকে নূতন করে ফিরে পায় , নুতন করে অনুভব করে , তাই আসে ! যত আসে , তত আসতে ইচ্ছে করে , তাই আসে । আসে , বসে থাকে , তাকে দর্শন করে , তার কথা শােনে , আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে । চেতনার ক্ষেত্রে চলতে থাকে নব রূপায়ণ , এমনি করেই মানুষ সপরিবেশ নিজেকে নূতন করে ঢেলে সাজবার রসদ সংগ্রহ করে । সেই অমৃত উৎস হ'তে নিত্যই এমনি ক'রে উৎসারিত হচ্ছে প্রেমের প্রবাহ , প্রাণের প্রবাহ ।
শ্রীশ্রীঠাকুর নিজের থেকেই বলতে লাগলেন— —আমি কাল রাত্রে ভাবছিলাম , এখানে যারা আছে যদি পরস্পর পরস্পরের interest ( স্বার্থ ) দেখে , তাহলে কারও , —বিশেষ করে এখানকার ছেলেপিলেদের চাকরী করার দরকারই হয় না । প্রত্যেকে যদি মনে করে , অন্য সবার জন্যই তার দায়িত্ব আছে , তার দায়িত্ব শুধু তার পরিবারের কয়েক জনের জন্যেই নয় , তবে সেই love pressure- এর ( ভালবাসার চাপের ) ঠেলায় কত production ( উৎপাদন ) , কত industry (শিল্প ) গজিয়ে উঠবে । তাতে কেউ আর বেকার থাকবে না । সমভাবে এই দায়িত্ববােধের উদ্বোধন হয় না , পরগাছা হ'য়ে নিজের জীবনকে উপভােগ করার মতলবও অনেকের থাকে । তাই , বাস্তবে এটাকে রূপ দিতে গেলে মানুষের পিছনে যথেষ্ট খাটুনির প্রয়ােজন হয় । কয়েকটা মানুষ এমন চাই , যাদের মধ্যে অতােখানি দায়িত্ববোধ সক্রিয় হয়ে আছে । তারা নিজেরা তো কাজকর্ম করবেই , আবার অন্য সকলকেও স্ফূর্তি দিয়ে নিজেদের সঙ্গে রেখে উপচয়ীভাবে খাটিয়ে নেবে এমনতরভাবে , যাতে তারা নিজেদের অর্জনের উপর দাড়াতে তো পারেই , বরং অন্যকেও সাহায্য করতে পারে । প্রত্যেকের অর্জন পটুতা ও সেবাবুদ্ধি যাতে বাড়ে , প্রত্যেকটা মানুষ যাতে more and more efficient ( আরাে - আরো যােগ্যতর ) হয়ে ওঠে , প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ্য ক'রে তেমনভাবে nurture ( পােষণ ) দিতে হয় । করিৎকর্মা হওয়ার , মানুষকে সেবা - সাহায্য করার একটা আত্মপ্রসাদ আছে । আর , ওতে ব্যক্তিত্বও স্ফুরিত হ'য়ে ওঠে , তখন মানুষ মানুষের ভার হয়ে থাকতে চায় না । মানুষগুলির পিছনে লেগে থেকে সেই গুরে তাদের পৌঁছে দিতে হয় । এটা শুধু এখানে নয় , বাইরে গিয়ে ঋত্বিদেরও এটা করা লাগে । তবে সবাইকেই যে এমনভাবে ঠিক করতে পারবে তা নয় । কারণ , কিছু লােক আছে যাদের জন্মগত সম্পদের দৈন্য বড় বেশী । কিন্তু যাদের হ'তে পারে , তাদের যদি করে তােলা যায় , তবে সামান্য সংখ্যক লোক অকর্মণ্য হলেও তাতে কিছু আটকায় না ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) —মানুষের রােগ - শােক , অভাব - অভিযােগ যেন দিন - দিন বেড়ে যাচ্ছে , এর প্রতিকার কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তিনটে জিনিস দরকার । প্রথম চাই আদর্শে দীক্ষা , আর চাই সদাচারপরায়ণতা — শারীরিক , মানসিক , আধ্যাত্মিক । যাতে শরীর - মন শুচি , শুদ্ধ , সুস্থ , সুস্থ থাকে তাই করাই শারীরিক ও মানসিক সদাচার । আর , একমুখীন আদর্শানুগ গতিশীলতাই আধ্যাত্মিক সদাচার । এ - ছাড়া প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি interested ( অন্তরাসী ) হওয়া দরকার with active service (সক্রিয় সেবা নিয়ে ) , এইগুলি based ( প্রতিষ্ঠিত ) হবে auto - initiative responsibility ( স্বতঃ - স্বেচ্ছ দায়িত্ববোধ ) -এর উপর । নিজের পরিবারের জন্য মানুষ যেমন feel ( বোধ ) করে , বাস্তবে করে , পরস্পরের মধ্যে তেমন হওয়া
চাই । সবাইকে নিয়ে যেন একটা পরিবার । এই পরিবারের উন্নতির জন্য প্রত্যেকেই দায়ী । যার যেমন ক্ষমতা , যার যেমন গুণ , যার যেমন প্রকৃতি , সে সেইটুকুরই ষোল আনা সদ্ব্যবহার করবে , ফাকি দেবে না । আবার , তাই নিয়ে চেষ্টা করবে প্রত্যেকেরই ক্ষমতা , গুণ ও প্রকৃতি যাতে পুষ্ট হয় । তোমাদের চরিত্র ও চলন দিয়ে এই জিনিসটুকু যদি সঞ্চারিত করতে পার , মানুষের অভ্যাসে এনে দিতে পার , রােগ - শােক , অভাব - অভিযােগ যে কোথায় ছুটে পালাবে , তা ঠিকই পাবে না । প্রথমে তােমরা এখানে লেগে যাও , এই করায় এখানকার atmosphere ( অবহাওয়া ) saturated ( ভরপুর ) করে ফেল , cruelly but sweetly ( নিষ্ঠুর অথচ মিষ্টভাবে ) এটা করাই লাগবে । ' Cruelly ' (নিষ্ঠুরভাবে) বলছি এইজন্য যে আমরা যদি নিজের ও অপরের সত্তাঘাতী প্রবৃত্তিগুলির প্রতি নিষ্ঠুর না হই , তাহলে সত্তার প্রতিই নিষ্ঠুর হতে হবে ।
চক্রপাণিদার স্ত্রী রেণুমা সন্তান - প্রসবকালে মারা গেছেন । সে - সম্পর্কে শ্রীশ্রীঠাকুর দুঃখ করে বলছিলেন — মেয়েরা Eugenic principle ( সুপ্রজনন নীতি ) -গুলি ভাল করে জানে কিনা কি জানি ! নারীর নীতি ’ , ‘ নারীর পথে বইগুলি বোধ হয় সবাই ভাল করে পড়েনি কিংবা জেনেও পালন করে না । মােক্থা কথায় আমি যা বলেছি , ততটুকু যদি করে , মাতা - পিতা ও সন্তান সকলেরই ভাল হবেই এবং তা সব দিক দিয়ে । জাতির স্বাস্থ্য , আয় , ধী ও কর্মশক্তি দেখতে - দেখতে বেড়ে যাবে । বিয়েটা ঠিকমতো দেওয়া লাগে , বর হওয়া চাই সর্বাংশে শ্রেয় — বিশেষতঃ বংশে। অনেকে এদিকে খেয়ালই দেয় না , তার ফল ভাল হয় না । বরের কুলকৃষ্টি ও প্রকৃতি কন্যার কুলকৃষ্টি ও প্রকৃতির পরিপূরণী হবে , আবার কন্যার কুলকৃষ্টি ও প্রকৃতি হবে বরের কুলকৃষ্টি ও প্রকৃতির পরিপােষণী । কন্যার কুল ও কন্যা নিজে ঐ ছেলেকে পেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করবে । এমনতর শ্রদ্ধাপ্লুত ভাব নিয়ে যে - মেয়ে আসে , সে স্বামীর সংসারকে তার তীর্থক্ষেত্র মনে করে যথােপযুক্ত সেবায় সকলকে নন্দিত ক'রে সার্থক হয়ে ওঠে , সংসারকে সে উপচে তোলে তার বুকভরা প্রীতি ও প্রাণন পোষণী দক্ষতা দিয়ে । সে জানে মনােজ্ঞ ব্যবহার কাকে বলে — না চাইতেই , না বলতেই যার যখন যেমনটি প্রয়োজন সে তাই করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । আর মেয়েদের এ - সব training (শিক্ষা ) ছেলেবেলা থেকেই দেওয়া লাগে । বাপের বাড়ী থেকে অভ্যস্ত হয়ে এলে তখন আর বিয়ের পরে কষ্টও হয় না । তবে এ - সমস্ত করার মূলে চাই সুকেন্দ্রিক শ্রেয়প্রীতি , তখন সব জিনিসটাই সহজ হয়ে আসে । মেয়েরা যদি পিতৃভক্ত হয় , তাহলে সে - সব মেয়েরা সাধারণতঃ ভাল হয়ই ।
ভক্তির আবার একটা পরখ আছে , ভক্তি চিরকালই কর্মমুখর । যাকে যে ভক্তি করে , ভালবাসে , তার খুশির জন্য , তার স্বস্তির জন্য সে মাথা ও - গতর না ঘামিয়েই পারে না । আবার , নিজের চরিত্রটাকেও সুসজ্জিত করে তোলে তেমনতর করে । এই করতে গিয়ে তার প্রবৃত্তিগুলিও নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে । তাই , অমনতর পিতৃভক্ত মেয়ে যদি আদর্শপ্রাণ উপযুক্ত ছেলের হাতে পড়ে , তাকেই নিজের অস্তিত্ব বলে গ্রহণ করে , তাকে বাদ দিয়ে নিজের আলাদা কোন খেয়াল খুশি তার না থাকে , তার জন্য যে - কোন কষ্টকেই সে সুখের বলে মনে করে । সংসার সেখানেই স্বর্গ হয়ে ওঠে , আর তেমনতর দম্পতির ভিতর - দিয়েই দেব শিশুর আবির্ভাব হয় । বংশপরম্পরায় বিয়ে যদি ঠিকভাবে হ'তে থাকে , তবে দেখা যাবে একটা বংশ কেমন করে ধাপে - ধাপে উন্নতির পথে এগিয়ে চলছে । অবশ্য , আদর্শপ্রাণতা ও সুশিক্ষার সংযােগ এর সঙ্গে চাই , আর স্বভাবতঃই তাদের ঝোকও থাকে এদিকে।
আবার , একটা বিয়েও যদি কোথাও বেমিসিল হয়ে যায় , বংশপরম্পরায় তা যে কত অপােগণ্ড ও অব্যবস্থের আমদানী করে থাকে তার ইয়ত্তা করা যায় না । লাখ মহাপুরুষ ও শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষেও তাদের মানুষ করা দুরূহ হয়ে ওঠে । বীসমোল্লায় গলদ ! করবে কি করে ? তাই আমি বিয়ে - থাওয়া ও সুপ্রজননের কথা এত ক'রে বলি । তােমরা কেমন পােষাকীভাবে কথাগুলি নেও , ভাল ক'রে মাথায় নেও না , তাই কেমন যেন ফস্কান ভাব । চারিদিকে কী সবনাশ হচ্ছে তা যদি তোমরা বুঝতে তাহলে কি এমন ঢিমে - তেতালা চলনায় চলতে পারতে ? আগুন হয়ে উঠতে ।
পরমপিতার দয়ায় এতখানি সম্পদ তোমরা পেয়েছ , এ নিয়ে tremendous ( প্রচণ্ড ) বাচা যদি না বাঁচা হ'লো , consolidation (সংহতি ) যদি না এলো— গতানুগতিক এই চলতি চলায় কী সুখ ! কী সার্থকতা । অবশ্য , তােমরা যতটুকু করেছ তা কম নয় , কিন্তু যা করণীয় তার তুলনায় তা কিছু নয় ।
অধীর আবেগে কথাগুলি বলতে - বলতে শ্রীশ্রীঠাকুর যেন একেবারে তন্ময় হয়ে গেলেন । তার চোখ - মুখ দিব্য ভবদীপনায় স্ফীত , বিস্ফারিত ও অরক্তিম হয়ে উঠলো । কাছে যাঁরা বসেছিলেন কারও কোন বাক্য - স্ফুৰ্ত্তি হচ্ছিল না , সকলেই ভাবতে লাগলেন — তার দয়ার দানের তো তুলনা নেই , কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণে আমরা করছি কতটুকু ?
কথা শেষ হ'তে হরিপদদা তামাক সেজে দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর উদাস দৃষ্টিতে আনমনভাবে তামাক টানতে লাগলেন , তার মন যেন তখন কোন অজানা রাজ্যে বিচরণ করছে । এতক্ষণে বেলা হয়ে গেছে । কৃষকেরা তখন চরের কলাই - ক্ষেতে কাজে নেমেছে , আর সমবেত প্রার্থনার জন্যও দাদা ও মায়েরা অনেকে এসে জড় হয়েছেন । হরিপদদা গাড়টা হাতে করে দাঁড়ালেন , দাদারও উঠে পড়লেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তখন ধীরে - ধীরে প্রাতঃক্রিয়ায় গেলেন । কিশোরীদার পরিচালনায় মাতৃ - মন্দিরের বারান্দায় সমবেত বিনতি ও প্রার্থনা সুরু হল ।
10