🔷 দুর্বলতার হাত - থেকে রেহাই পাবাে কেমন করে ?
🔷 আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হয় না
🔷 আত্মা তো অমর
১৪ ই অগ্রহায়ণ ,শনিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২৯/১১/১৯৪১)
ভােরে আশ্রম - প্রাঙ্গণের তাসুতে অনেকেই এসে সমবেত হলেন । সবাই এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করে যার - যার জায়গামতো বসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুরও কাথা গায়ে জড়িয়ে চৌকিতে বিছানায় আসন গেড়ে বসেছিলেন , মুখে মাখা এক প্রশান্ত পরিতৃপ্তি , চোখে তার করুণাঘন দীপ্ত দৃষ্টি , দেখলে প্রাণ স্বতঃই পুলকিত হয়ে ওঠে , অজানিতে তারই কাছে ছুটে যেতে চায় । সবাই আসার পর ঘরােয়া কথাবার্তা দু'চারটে হলো — দুই - একজনের অসুখ - বিসুখ , খাওয়া - দাওয়া , শীত কেমন পড়েছে ইত্যাদি কথা । অতি সাধারণ কথাও শ্রীশ্রীঠাকুর যখন বলেন , মনে হয় , কত সরস , কেমন সুন্দর , কতখানি প্রাণদ ! কথাবার্তায় একটা সহজ সভ্রান্ত অন্তরঙ্গ আবহাওয়া জমাট বেঁধে উঠলো ।
বীরেনদা ( ভট্টাচাৰ্য ) প্রশ্ন করলেন— “ কৌন্তেয় প্ৰতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি ” কথার মানে কী এবং তা হয় কী করে ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলছেন— “ তুমি নিশ্চয় করে জেনাে আমার ভক্ত কখনও বিনষ্ট হয় না । ” মানুষ বিনষ্ট হয় প্রবৃত্তিবশ্যতায় , কিন্তু with all our passions ( সব প্রবৃত্তি নিয়ে ) ইষ্টে interested ( অন্তরাসী ) হ'লে বিনষ্ট হওয়ার উপায় নেই । বেশ্যালয়ে যাবার সময় বাপ , মা , স্ত্রী কত বলে ,
কঁদে , কিন্তু সে - সব কথা কি মানুষ তখন শোনে ? —এমনি with all our passions ( সর্ববৃত্তি - সহ ) তাতে অচ্ছেদ্যভাবে চিরকালের জন্য interested (অন্তরাসী ) হওয়া চাই , তাতে বিনষ্টির মূল মরে যায় , বিনষ্ট হবে কেমন করে ? তার মানে এ নয় যে , তার দুঃখ , কষ্ট , রােগ , শােক , মৃত্যু হবে না । দুঃখ - কষ্ট রােগ - শোক এলেও তাকে শুভে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কেমন করে , তা সে জানে । সব অবস্থাকেই তখন সে ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠার পরিপােষক ক'রে বিন্যস্ত করে তোলে । কিছুই তখন তাকে দমাতে পারে না , হটাতে পারে না , সে নিরাশ হয় না , হতাশ হয় না , হাল ছেড়ে দেয় না কিছুতেই । ক্রিয়াশীল আশাবাদী হয় সে । আবার , ভক্তি যদি মানুষের জীবনে একবার জাগে , সে এমন কৰ্ম্ম কমই করে যাতে নূতন করে দুর্ভোগের আমদানী হয় । আমাদের সমস্ত দুর্ভোগের মূলে আছে প্রবৃত্তি জনিত কৰ্ম । তাছাড়া , ইষ্টকর্ম করতে গিয়ে মানুষের জীবনে অনেক দুঃখ - কষ্ট আসতে পারে , কিন্তু ইষ্টপ্রীতি যদি থাকে ঐগুলিই তখন সুখের মনে হয় , সেগুলি মনকে ক্লিষ্ট করতে পারে না , কারণ এতে করে সত্তা পুষ্ট বই ক্ষুন্ন হয় না । এই পথে চলতে স্বাভাবিকভাবে কারও মৃত্যুও যদি হয় , তাও সে উন্নততর জীবনের অধিকারী হয় , এমন কি স্মৃতিবাহী চেতনাও হয়তাে লাভ করতে পারে । তাই , জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া তার বেলায় পিছে হটা বা নষ্ট পাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না । পুরুষােত্তমের প্রতি ভক্তিই এই জিনিস সংগঠন করে তােলে ।
প্রফুল্ল — আত্মা তো অমর , শেষ পর্যন্ত কেউই তো নষ্ট পায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমরা চাই ক্রম - অধিগমনে বিবর্তনের পথে চলতে , বেড়ে চলার পথেই জীবনের আনন্দ , আর এই বাড়তি গতি আমরা অবিচ্ছিন্ন রাখতে চাই জীবন - মৃত্যুর পারাপার ভেদ করে । এটা ঠিকই — অপূরয়মাণ ইষ্টে কারও যদি প্রকৃত টান জন্মে , এবং তাই নিয়ে যদি সে বিগত হয় তবে সে মহান জীবন লাভ করবেই । আবার , এ জীবনে , যে যতই হােমরা - চোমরা হােক না কেন , সে যদি সুকেন্দ্রিক না হয় , প্রবৃত্তিই যদি তার জীবনের নিয়ামক হয় , তবে ঐ বিচ্ছিন্ন বিকেন্দ্রিকতা তার মৃত্যুকালীন ভাবভূমি ও পরজন্মকে যে অপগতিতে অপকৃষ্ট করে তুলবে , তাতে সন্দেহ কমই ।
সুবােধদা ( সহা ) —আচ্ছা , আমাদের দুর্বলতার হাত - থেকে রেহাই পাবাে কেমন করে ? সেগুলিকে চেনা সত্ত্বেও যে তারা যায় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ললিতভঙ্গীতে নিন্মলিখিত ছড়াটি আবৃত্তি করলেন
“ পাপে যখন আসে ঘৃণা
আসে আক্রোশ , অপমান ,
ইষ্টপ্রাণন ফেপে ওঠে
তখন পাপের পরিত্রাণ । ”
তারপর বললেন , দুর্বলতাগুলির প্রতি আমাদের অনুরাগ থাকে , তাদের আদর করি , যত্ন ক'রে পুষে রাখি , তাই তাে তারা ঠাই পায় । আমি সেগুলিকে আশ্রয় না দিলে , সেগুলিকে না চাইলে , তারা আমাতে টেকে কি করে ? ঐ চলনের প্রতি যখন একটা ঘৃণা ও আক্রোশ আসে , তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে অপমান বােধ হয় , তখন বোঝা যায় যে সত্যিই আমি তা চাই না । তবে শুধু negatively ( নেতিবাচকভাবে ) ওগুলির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা অনেক সময় ওতে আরও আবদ্ধ করে তােলে । এই সম্বেগ নিয়ে দুর্বলতার মুহূত্তে ইষ্ট ও সৎ - এ নিজেকে বাস্তবভাবে নিয়ােজিত করতে হয় হাতে - কলমে ; শরীর ও মনকে এতখানি ব্যাপৃত করে তোলা চাই , য'তে অন্যদিকে নজর দেবার অবকাশই না থাকে । এমনি করতে - করতে ওগুলি খসে পড়ে । মানুষ ইষ্টনিষ্ঠ হ'লে খাপ - খােলা তরােয়ালের মতাে হয়ে যায় , তখন সে কিছুতেই ইষ্টবিরােধী দুর্বলতার সঙ্গে compromise ( অপিপাষরফা ) করে না । মানুষের বিকৃত স্বার্থবুদ্ধি - সম্বন্ধে কথা উঠলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — পরস্পরকে ঠকাবার বুদ্ধি মানেই নিজের cell ( কোষ ) গুলি ভেঙ্গে ফেলা , নিজত্বকে হনন করা । শরীরের অন্যসব cell ( কোষ ) -গুলি যদি সুস্থ ও জীবন্ত না থাকে , তাহলে একটা cell যেমন একক সুস্থ ও জীবন্ত থাকতে পারে না , সামাজিক পরিবেশে আমাদের ব্যক্তি - জীবনও তেমনি অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে একক টিকে থাকতে পারে না । তাতে তার অস্তিত্বও অচল হয়ে উঠবে , পরিবেশের পােষণ - বঞ্চিত হয়ে সে শুকিয়ে উঠবে । তাই , পরস্পর স্বার্থান্বিত হ'য়ে , সবাই মিলে একগাট্টা হয়ে চলায় কিন্তু প্রত্যেকের নিজের লাভই সবচেয়ে বেশী । দেহস্থ প্রাণন - শক্তির পোষকতায় যেমন শরীরের কোষগুলির মধ্যে একটা অচ্ছেদ্য সংহতি ফুটে ওঠে , সমাজ - জীবনেও তেমনি সবারই সত্তা পূরণপােষণী জীবন্ত নরবিগ্রহের প্রতি আনুগত্যের ভিতর - দিয়েই এই সংহতি ও সহযােগিতার অভ্যুদয় হয় । তা ’ বাদ দিয়ে শুধু স্বার্থবুদ্ধিতে কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার উপযোগী অবস্থা সৃষ্টি করা যায় না ।
10