🔷 কারা বেশি সুখী হয়
🔷 বর্ণাশ্রমের লাভবর্ণাশ্রমের লাভ
🔷 যােগ্যতা কী করে বাড়ে
১১ ই চৈত্র , মঙ্গলবার , ১৩৪৭ ( ইং ২৫/৩/১৯৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে নিভৃত - নিবাসে ( পাবনা কেন্দ্র - সৎসঙ্গ ) কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) সত্যেনদা ( সাহিত্যশাস্ত্রী ) প্রভৃতির সঙ্গে নানা কথা আলোচনা করছিলেন । আহার - সম্পর্কে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — মা যে আপনাদের ভাত মেখে হাতে - হাতে দলা করে দিতেন , অত কম খেয়েও আপনারা বেশ ছিলেন , কত কাজ করতে পারতেন । আগেকার মতাে কাজ এখন তাে আর হয়ই না । তখন রাতেই যেন কাজের জোর বাধতাে । সন্ধ্যার আগেই সব আলো জ্বালান হতো । আলো জেলে সারারাত কাজ চলতো । তখন আপনাদের দিন - রাত জ্ঞান ছিল না , ভূতের মতো খাটতেন , খাওয়া তো ছিল ঐ । তাই মনে হয় , মনে যদি ইষ্টের জন্য নেশা থাকে , সম্বেগ থাকে , তবে অতি অল্প আহারেই মানুষের চলতে পারে , আর তা'তে সে সুস্থ ও কর্মঠ থাকে । আর , ঐ নেশার কমতি যদি হয় , ভােগের দিকে মন যদি যায় , তখন ঐ ভোগের উপকরণ যতই বাড়ুক কোনটাই আর গায়ে লাগে না , প্রকৃত পুষ্টি সরবরাহ করে না , বরং আলস্য , অবসাদ , রোগ বালাইই বাড়তে থাকে । যারা যত প্রত্যাশাহীন , সুনিষ্ঠ ও কৰ্ম্মমাতাল , তারাই তত সুখী হয় । যাদের প্রত্যাশা নেই , তারা সামান্য পেলেও তাতে মহাখুশি হ'য়ে ওঠে , না পেলেও তাদের আপসােস থাকে না । কিন্তু প্রত্যাশাপীড়িত যারা , তারা কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না , তাই তাদের সুখ আর হয় না ।
পাওয়ার প্রত্যাশা রাখার থেকে , দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখা বরং ভাল । তাতে মানুষের যােগ্যতা বাড়ে , পাওয়াটা বরং সহজ হয়ে আসে । আগে পরপর পরস্পরকে সেবা দেবার আগ্রহে ঘুরতো । একজনের কাপড়খানা ময়লা হ'লে কোন ফাঁকে যে আর - একজন তার অগােচরে সেটা কেচে দিয়ে অসিতো তা যার কাপড় সে ঠিকই পেতাে না । অশ্রমের যাত্রী স্টীমার - ঘাটে কেউ এসে নামলে , তার মাল বয়ে আনার জন্য সৎসঙ্গীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত । কারো অসুখ করলে এত লোকে খবর নিতে আসতো যে ভিড় ঠেকাবার জন্য নােটিশ দেওয়া লাগতো । আমি তখন কারাে সেবা নিতাম না , বরং নিজ হাতে সকলের জন্য যতটুকু পারি করতাম । কিন্তু অনেকে সেবা করবার আগ্রহ নিয়ে ঘুরতো , তারা কোন সুযােগ না পেলে ক্ষুন্ন হতো , কান্নাকাটি করতাে , তাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন - কোন ক্ষেত্রে সায় দিতে হয়েছে , পরে আবার অসুখ হলো , অন্যের সেবা নিতে বাধ্য হলাম , সেই থেকে কেমন হয়ে গেল । আমি তো আগে বুঝতেই পারতাম না , অন্যের সেবা নেবার আমার প্রয়ােজন কী !
শ্রীশ্রীঠাকুর দীপ্ত আবেগে বলতে লাগলেন — ফলকথা , তোমরা কয়েকজন ঠিক হলেই হয়ে যায় । Conviction ( প্রত্যয় ) -ই বড় জিনিস , আর এটা শক্ত কিছু নয় । এই মুহূর্তেই morality- র ( নৈতিকতার মোড় ) ফিরিয়ে দেওয়া , বলা yes ( হ্যাঁ ) , আর চাল - চলন , কথা - কায়দা তদনুযায়ী করা , suffering- এর ( দুঃখকষ্টের ) জন্য প্রস্তুত হওয়া , -এতেই হয়ে যায় । এমন conviction ( প্রত্যয় ) থাকা চাই যে শরীরটাকে খণ্ড - খণ্ড করে কেটে ফেললেও টুকরােগুলি বলতে থাকবে , ‘আয়নল হক , ‘আয়নল হক’ ।
তার চোখ দুটি জ্বলছিল । মুখে আনন্দের দিব্য জ্যোতি , কণ্ঠস্বরে তীব্র প্রেরণার তড়িৎ - দীপনা । তিনি অপূৰ্ব ভঙ্গীতে বলে চলেছেন — অবতার কথা টথা আমার ভাল লাগে না । আমাকে অবতার বলা সেইদিনই সাজবে যেদিন তােমরা প্রত্যেকে অবতার হয়ে উঠবেএকেবারে চুলের ডগা থেকে পায়ের বুড়াে আঙ্গুল পর্যন্ত অমান । রামকৃষ্ণ - ঠাকুর , চৈতন্যদেব প্রভৃতিকে যে লোকে অবতার বলে , আমার মনে হয় যেন taunt ( ঠাট্টা ) করে । নিজেরা তাদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার কিছু না করে , তাদের ঈপ্সিত পথে না চলে বরং উল্টো পথে চলে মুখে মুখে শুধু অবতার বলা । অবতার কথাটা যেন হয়ে দাড়িয়েছে আজকালকের রস গোল্লার মত , মৰ্যাদা কমে গেছে । আগের রসগােল্লা তাে খাসনি । সেইজন্য আমি অবতার কথা use ( ব্যবহার) না করে বলেছি প্রিয়পরম । ওতে যেন আত্মীয়তার বােধ রয়েছে । কেউ যদি meeting- এ ( সভায় ) দাঁড়িয়ে ইষ্ট সম্বন্ধে তেমন করে বলে— “ তুমি আমার ! তুমি আমার ! তুমি আমার ! ” সে হাজার - হাজার লােকের প্রাণকে স্পর্শ করে আকুল করে তুলতে পারে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে বললেন — যে যে - কোন ধর্মাবলম্বীই হােক না কেন , তার বংশে যদি প্রতিলোম সংমিশ্রণ না হয়ে থাকে , তবে তার বংশানুক্রমিক জীবিকা , অভ্যাস , আচার , ব্যবহার অনুপাতিক তার বর্ণ - নিরূপণ ক'রে বর্ণাশ্রমের বিধি অনুযায়ী তাকে পরিচালিত করা যেতে পারে । বর্ণাশ্রম একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাপার ; এটা সার্বজনীন । সহজাত সংস্কার - অনুপাতিক সমাজের বৃত্তি নির্বাচন , শ্রেণীবিন্যাস এবং বৈধী বিবাহের ভিতর - দিয়ে বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য গুলিকে ধারাবাহিকতায় অক্ষুন্ন রেখে বংশপরম্পরায় প্রতিপন্ন করে তোলাই হচ্ছে এর মূল কথা । পৃথিবীর প্রত্যেকটি সমাজকে যদি এমন বিধিবদ্ধভাবে সাজিয়ে তােলা যায় — তাদের বৈশিষ্ট্যের অপূরণী করে , তবে বিহিত অনুলােম-ক্রমে কমে পারস্পরিক পরিণয় - নিবন্ধও সৃষ্টি করা যেতে পারে । পূরয়মাণ এক আদর্শ ও অনুলােম বিবাহ যেমন একটা জাতকে একগাট্টা করে তোলে , তেমনি করে তা সমগ্র বিশ্বকেও সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে পারে — পারস্পরিক বৈশিষ্ট্যানুগ সংহতি নিয়ে । পরমপিতার দয়ায় বিশ্বশান্তির এই যা এৎফাঁক বের হয়েছে , এ একেবারে চরম এৎফাঁক , এখন তোরা মাথায় নিয়ে করলেই হয় ।
10