🔷 ব্যক্তিত্ব কীভাবে বাড়ে
🔷 মানুষ কী করে দারিদ্রব্যাধিগ্রস্ত হয়
১৩ ই চৈত্র , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৭ ( ইং ২৭ /৩/১৯৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর আজ সকালে নিভৃত - নিবাসে বলছিলেন — অর্জন - পটুত্ব , সাশ্রয়ী স্বভাব ও সর্বব্যাপারে সৌন্দৰ্যবোধ যাদের আয়ত্তের মধ্যে নেই , তারা যে শুধু অকৃতকার্য হয় তা নয় , তাদের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বও স্ফুরিত হতে পারে না । অঞ্জন - পটুত্ব মানে , কাজ হাসিল করার বুদ্ধি , যারা এক উদ্দেশ্যে একটা কাজে হাত দিয়ে মাঝপথেই বিভ্রান্ত হয়ে বিরত হয় বা লভ্যবস্তু লাভ না করে অন্যদিকে মন দেয় , তাদের distortion- এর ( বিকৃতির ) সম্ভাবনা থাকে । সাশ্রয়ী যারা নয় , তাদের pauper ( দারিদ্রব্যাধিগ্রস্ত ) হবার সম্ভাবনা খুব থাকে , অযথা ব্যয়বহুল্য ও অপচয় তাদের স্বভাবগত হ'য়ে দাড়ায় ; উপচয়ী পরিচালনা তারা ভুলে যায় । এই লক্ষ্মীছাড়া স্বভাবের ফলে মানসিক ও সম্পদ - গত দৈন্য তাদের ঘিরে ধরে । সাশ্রয়ী হ'তে গেলে অতােখানি মাথা , বুদ্ধি , বিবেচনা ও নিয়ন্ত্রণ - কৌশল খাটাতে হয় , তাতে মানুষ বেড়ে ওঠে , কিন্তু যারা হেলাফেলায় অনেক - কিছু নষ্ট করে , তাদের বুদ্ধিবৃত্তি , শক্তি - সামর্থ্যও অতােখানি ঢিলে ও খাটো হ'য়ে পড়ে । আর , সুন্দরের sense ( বোধ ) যাদের নেই তাদের clumsy ও disintegrated ( এলােমেলাে ও অসংহত ) হবার সম্ভাবনা থাকে । সুন্দরের মধ্যে আছে একটা সমতা ও সঙ্গতিবোধ , তাই তা ’ সত্তার কাছে আদরণীয় । যাই করি , যা'ই ভাবি , যাই বলি — তা যদি সত্তার কাছে আদরণীয় না হয় , অর্থাৎ তার দ্বারা আমার এবং অপরের সত্তা তৃপ্ত ও নন্দিত না হয় — করায় , বলায় , চলায় যদি বিশৃঙ্খলা , অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্য অভ্যাসগত হ'য়ে ওঠে , তবে তার ফলে ব্যক্তিত্বও ক্রমশঃ বিশৃঙ্খল ও বিশ্লিষ্ট হ'য়ে পড়ে , সবটার মধ্যে সঙ্গতি নিয়ে শক্তিমান অখণ্ড ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে পারে না ।
কেষ্টদার একটা প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর একটা লেখা দিলেন । পরে বললেন — সত্যেনকে যা দিয়েছিলাম , সে ভাষা থেকে এটা একেবারে তফাৎ । তাই দেখে মনে হয় , এ - সব কি বস্তুসাপেক্ষ । ( অর্থাৎ , প্রশ্নকর্তার ব্যক্তিত্বের বিকিরণ যেমনতর , তার দ্বারা তার উত্তরের ভাষা ও ভঙ্গীটা হয়তাে প্রভাবিত হয়) ।
১৬ ই চৈত্র , শনিবার , ১৩৪৭ ( ইং ৩০/৩/১৯৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর বেলা আন্দাজ ন'টার সময় বাঁধের ধারে তাসুতে বিছানায় বসে সকলের সঙ্গে সহাস্যবদনে আলাপ - আলোচনা করছেন । তখন বেশ রােদ উঠেছে , কিন্তু ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে বলে গরম তেমন লাগছে না । প্রেস , তপােবন , মাতৃবিদ্যালয় , কেমিক্যাল ওয়ার্কস , কারখানা , ছুতোর মিস্ত্রীর আড্ডা , হােসিয়ারী , কার্ডবোর্ড কনসার্ণ , ডিসপেনসারী , ফিলানথপি অফিস , অতিথিশালা , ঋত্বিগাচাৰ্য - ভবন , কলাকেন্দ্র , কৃষিক্ষেত্র , কুটীর - শিল্প - কেন্দ্র ইত্যাদি সর্বত্রই তখন পুরােদমে কাজকর্ম চলেছে । বাইরে থেকে এক ভদ্রলোক তখন আশ্রমে বেড়াতে আসলেন । তাকে আশ্রমের বিভিন্ন কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলি দেখান হ'লো । তিনি সেগুলি দেখেশুনে পরে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে গেলেন । ভদ্রলোক শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে যেতেই তিনি স্নেহ - সম্ভাষণে তাকে বসতে বললেন । তিনি প্রণাম করে উপবেশন করলেন । প্রাথমিক আলাপ - পরিচয়ের পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন — ধরুন , শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে আমার খুব ভাল লাগে , আজ তিনি নেই , এখন তাকে কেমন করে পাব ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - পরবর্তীকে বাদ দিয়ে পূর্বতনকে ধরা যায় না । শ্রীরামচন্দ্রকে যদি কেউ ভক্তি করে , আর সে যদি শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক হয় , তবে তাকে শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই শ্রীরামচন্দ্রকে পেতে হবে , নচেৎ পাওয়া হবে না । পরবর্তী পূরয়মাণ মহাপুরুষের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ধ্বতনে অনুরাগী আচার্যের শরণাপন্ন হতে হয় ।
তিনি নিজের চাকরী - সম্বন্ধে বললেন — আমি খােশামােদ করতে পারি না , তাই আমার চাকরীর উন্নতি হয় না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর তখন তাকে দরদভরে বুঝিয়ে বললেন — খােশামোদ করতে যাবে কেন ? তবে স্তুুতি করতে হয় । প্রত্যেকের বাস্তব গুণগুলি দেখতে হয় , সেগুলির তারিফ করতে হয় , তাতে নিজেরও উন্নতি হয় । আর , প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য বুঝে মনােজ্ঞ ব্যবহারে সকলকে মুগ্ধ করে তাদের হৃদয় জয় করতে হয় । তখন প্রয়ােজনমত তাদের তুমি সংশােধনও করতে পার । আর , এইভাবে যদি চল , মানুষকে তুমি তােমার আদর্শে অনুপ্রাণিত করে তুলতে পারবে । এতে মানুষ সহজেই তােমাতে স্বার্থান্বিত হয়ে তোমার শ্রীবৃদ্ধির সহায়ক হবে । তুমি সম্মান ও খ্যাতিলাভ করবে , সুখী হবে , পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সম্প্রীতি বেড়ে যাবে তোমার ।
ভদ্রলােক শ্রীশ্রীঠাকুরের কথাগুলি শুনে খুবই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন , তার চোখ - মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলাে , তিনি যেন একটা পথ পেয়ে গেলেন । এই সব কথাবার্তার পর সত্যেনদা তার সদ্যলিখিত একটি কবিতা শ্রীশ্রীঠাকুরকে পড়ে শােনালেন । শ্রীশ্রীঠাকুর যে কতবড় প্রেমিক এবং মানুষ যে কেন তার চারপাশ ঘিরে থাকে — সেই কথাই কবিতাটির মধ্যে আছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর কবিতাটি শুনে বললেন — দ্যাখ ! মানুষের নিজের তরফ থেকে কারাে প্রতি করা থাকলে , তখনই তাকে সত্যি মিষ্টি লাগে । নচেৎ ভালবাসা নদী বা কোন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যকে ভালবাসার মতাে হয় , তার জন্য কিছু করতে হয় না , তাই ভালবাসার প্রকৃত sensation ( বােধ ) গজায় না , আর জীবনের দুঃখরাতে সে - ভালবাসার চেতনা তাকে কোন উৎসাহ বা প্রেরণা যােগায় না , তখন তা কপূরের মতাে উবে যায় । অথচ বৌকে ভালবাসার ব্যাপারে দেখা তুমি দিনরাত অকুপাকু করে এটা জোগাড় করছ , ওটা এনে দিচ্ছ , তার জন্য একটু , constable ( কনষ্ট্যাবল ) -ই না হয় হলে , কত ভাবছ , খাটছ , তাই সেটা feel ( বোধ ) করা যায় , real ( বাস্তব ) হয় ।
যশােহরের একটি দাদা স্থানীয় কয়েকজন মুসলমানের দুর্ব্যবহারের কথা বলেন । তাতে শ্রীশ্রীঠাকুর বিশেষ জোরের সঙ্গে বললেন — ইসলামের অপ্রতিষ্ঠা যাতে হয় , তেমন কিছু করার সুযােগ মানুষকে দেওয়া তােমাদের উচিত নয় ।
10