🔷 শুধু নিলে হয় না , কিছু দিতে হয়..
🔷 আপনার নাম করে মানুষের কাছে ভিক্ষা করি , সেটা কেমন ?
৪ ঠা অগ্রহায়ণ , বুধবার , ১৩৪৮ ( ইং ১৯/১১/১৯৪১ )
আজ খুব বৃষ্টি হচ্ছে । মাঠ - ঘাট জলে ভেসে যাচ্ছে — আশ্রমের সামনে বিরাট চরের দিকে চেয়ে মনে হচ্ছিল , সব যেন ধোয়া হয়ে গেছে । শ্রীশ্রীঠাকুর তখন তাসুতে বসে । বিশেষ লোকজন নেই । মায়েদের মধ্যে ২|৩ জন ছিলেন । সুধাদি — আপনি চাইলে কেমন যোগাড় হয়ে যায় , অন্য কারও বেলায় তা হয় না।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি যেমন করি তেমন করলেই হয় ।
সুধাদি সে কি আমাদের পক্ষে সম্ভব ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— “ আমারে ঈশ্বর ভাবে আপনারে হীন
তার প্রেমে কভু আমি না হই অধীন । ”
এক - একটা মানুষের জন্য তােমার এতখানি করা থাকা চাই যে , আজীবন তুমি যদি তার উপর বসেও খাও , তবু সে যেন বেশী করেছে বলে বােধ করতে না পারে । প্যারী যে আমার জন্য এত যােগাড় করে , ওকে কিন্তু মানুষ খুশি হয়ে দেয় , ওর কথা যে মিষ্টি তা তাে নয় , তবে করাটা আছে মিষ্টি ।
৫ ই অগ্রহায়ণ , বৃহস্পতিবার , ১৩৪৮ ( ইং ২০/১১/১৯৪১ )
আজ সকালে তাসুর মধ্যে পরিবেশটি বড়ই আনন্দদায়ক মনে হচ্ছিল । তাকে কেন্দ্র করে ভক্তগণের সমাবেশে পদ্মাপারে যেন এক জীবন্ত অমৃতপরিমণ্ডল রচিত হয়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন — তুকের ' পর দিয়ে language- এর ( ভাষার ) সঙ্গে grammar ( ব্যাকরণ ) শেখাবার জন্য নূতন ধরণের বই লিখতে হয় — যা'তে ছেলেরা সহজেই সব শিখতে পারে ।
একটু বাদেই পঞ্চাননদা ( সরকার ) এসে তার ডায়েরী পড়ে শােনাতে লাগলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর সেই প্রসঙ্গে নানা কথা বলতে লাগলেন — একটা মেয়ে হয়তাে একটা পুরুষকে পান দিতে গেল , পানটা নেবার সময় সে তার আঙ্গুলটা টিপে ধরলো , মেয়েটা equal temper- এর ( সমান ধাতের ) হ'লে পট করে বুঝে ফেলে , তাকে অনুসরণ করে । Initiation ( দীক্ষা ) দিতে গেলে তেমনি যে যে- temper- এর ( ভাবের ) ই হােক , তাকে ইষ্টপ্রাণতা - ব্যাপারে তােমার সঙ্গে equitemper ( সমভাবাপন্ন ) করে তুলে initiation ( দীক্ষা ) দিতে হয় । সব জায়গায় খুব rational way- তে ( বিচারসম্মত পন্থায় ) proceed করলে ( অগ্রসর হলে ) কাজ হয় না , mystic pose ( ভাবুকের ভঙ্গী ) নেওয়া দরকার হয় , ওর ভিতর - দিয়ে মূল জিনিসটা ধরিয়ে দিতে হয় । নূতন জায়গায় গেলে key ( প্রধান ) -দের individually ( ব্যক্তিগতভাবে ) approach ( নিকটে গমন ) করতে হয় । তর্কে corner ( কোণঠাসা ) করা , আর sympathetically personal knots and problems discover করে solution দেওয়া ( সহানুভূতির সহিত ব্যক্তিগত সমস্যা বা গ্রন্থিগুলি আবিষ্কার করে সমাধান দেওয়া ) আলাদা জিনিস । তর্কে convinced ( ছিন্নসংশয় ) হয় না , এতে হয় ।
কোন জায়গায় গিয়ে লােকের কাছ থেকে কিছু নিলে তারা interested ( অন্তরাসী ) হয়ে থাকে , অনন্য নিন্দা করতে থাকলে , তারাই তখন oppose করে ( বাধা দেয় ) । শুধু নিলে হয় না , কিছু দিতে হয় । তুমি হয়তাে শুনে আসলে , একজনের কৃষ্ণ - অদা দরকার , সেখান থেকে কলকাতা গেলে , কলকাতা থেকে কৃষ্ণ - আদা পাঠিয়ে দিলে , লিখে দিলে — ভাই , তােমার অসুখের জন্য কৃষ্ণ - আদা দরকার , তাই পাঠালাম । এতটুকু loving aquisitive service ( affo সন্ধিৎসু - সেবা ) লাখ ডজন তত্ত্বকথার চাইতে ঢের কার্যকরী । আবার , পরের বার যাবার বেলায় ছেলেপেলেদের জন্য হয়তো কিছু হাতে করে নিয়ে গেলে । কারও হয়তো দেখছ ছেড়া কাপড় , কারও বাড়ী চাল নেই , খোঁজ - খবর নিয়ে একজনকে দিয়ে আর - একজনের অভাব পরিপূরণ করছ , এমনি ক'রে পরস্পরকে পরস্পরের প্রতি interested করে তুলছ । একেই বলে consolidation ( সংহতি ) , আর যতই তুমি এমন করতে থাকবে , প্রতিপ্রত্যেকে তােমাতে ততটা— integrated ( সংগ্রথিত ) হ'তে থাকবে । যাদের কাছ থেকে নিচ্ছ , with loving urge ( প্রীতি - উদ্দীপনার সাথে ) তাদের যদি কিছু না দাও , তোমার পাওয়ার পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে যাবে , তারা তোমায় দেখে সঙ্কুচিত হবে ।
ইলুদা —অনেক সময় আপনি আমাদের কাছে চাইলে , আপনার নাম করে মানুষের কাছে ভিক্ষা করি , সেটা কেমন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তাতে তুমি আমার activity- র ( কর্মের ) উপর দাড়ালে , তােমার activity- র উপর দাড়ালে না । ঠাকুর - ভাঙ্গানাে হলো , ঐ ফটো র’য়ে গেল — তােমার worth ( ক্ষমতা) বাড়ালো না । মানুষকে যত বেশী fulfik (পরিপূরণ )করতে পারবে , ততই তােমার personality established (ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা ) হবে , মানুষ তোমার asset ( সম্পদ , ) হয়ে থাকবে , প্রত্যেকটা মানুষ যেন তােমার এক - একটা ব্যাঙ্ক , তুমি গিয়ে দাঁড়াবামাত্র ভিক্ষার meter ( মাত্রা ) চড়ে যাবে । কারও প্রতি মানুষের করা ব্যর্থ যায় না , সে ungrateful ( অকৃতজ্ঞ ) হ'লে disinterested third person ( নিঃসম্পকীয় তৃতীয় পক্ষ ) , যে সব জানে সে হয়তাে বেশী sympathetic ( সহানুভূতিসম্পন্ন) হবে ।
আত্মকেন্দ্রিক হওয়া যে মানুষের নিজের পক্ষেই ক্ষতিকর সেই প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর বলছিলেন — মানুষ self - centric ( আত্মকেন্দ্রিক ) হ'লে সাড়াবাহী ও সাড়াগ্রাহী হয় না , rubber- এর ( রবারের ) opposite extreme ( বিপরীত প্রান্তগুলি ) কুচকে থাকলে যেমন হয় । Superior- এর ( প্রেষ্ঠের ) জন্য মাথায় নিরবচ্ছিন্ন টান ও উদগ্রতা থাকলেই মানুষের sensitiveness ( সাড়াপ্রবণতা ) , observation ( পৰ্যবেক্ষণ ) , intelligence ( বুদ্ধিমত্তা ) , common ( সাধারণ বোধ ) grow করে ( জন্মায় ) ।
টানের লক্ষণ সম্বন্ধে বলছিলেন — চাইলে দেওয়াটাই বড় কথা নয় , এরা যে আমার পরিকল্পনা অনুধাবন করে ১৩০ টাকার signatory ( স্বাক্ষর ) যোগাড় করতে লেগেছে , আমি কিছু না বলতেই স্বতঃদায়িত্বে নিজেরাই আরম্ভ করেছে , এইটেই normal ( স্বাভাবিক ) ।
যাজন - সম্বন্ধে বললেন — গোড়াতেই ঠাকুরের কথা বললে মানুষ ঘাবড়ে যায় , কিন্তু with every sympathy ( পূর্ণ সহানুভূতির সাথে ) , ভাবে ব্যাঘাত করে ধীরে - ধীরে তার knot ( গ্রন্থি ) সব resolve ( মীমাংসা ) করে দিয়ে যদি বলা যায় , this is what Thakur says ( এই কথাই তো ঠাকুর বলেন ) , তা’তে অমােঘভাবে ক্রিয়া করে ।
★ ★ ★
ঈষদা - দা- Resist no evil ( অন্যায়কে প্রতিরােধ করাে না ) মানে কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— Resist no evil'- এর মানে আমি বুঝি , বিচলিত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে সহ্য , ধৈৰ্য্য , অধ্যাবসায় , পরাক্রম ও কৌশল নিয়ে evil- এর ( পাপের ) মাথার উপর এমন করে দাঁড়ান যাতে সে surrender ( আত্মসমর্পণ) করে । চলার পথে difficulty ( অসুবিধা ) আছেই , তাকে ধীরভাবে manage ( নিয়ন্ত্রণ ) করে manipulate ( সামঞ্জস্য ) করে successful ( কৃতকাৰ্য্য ) হওয়াতেই যত কৃতিত্ব। যাজনের ক্ষেত্রেও একটা মানুষের ভুল , ত্রুটি - বিচ্যুতি , অন্যায় যাই থাক , গোড়াতেই তা সােজাসুজি প্রতিরােধ করতে চেষ্টা না করে কুশল - কৌশলে তাকে উৎক্ৰমণী করে তােলার চেষ্টা করাই ভাল ।
৬ ই অগ্রহায়ণ , শুক্রবার , ১৩৪৮ ( ইং ২১/১১/১৯৪১ )
অতি প্রত্যুষে ইলুদা ( বসু ) , বিমলদা ( মুখােপাধ্যায় ) প্রভৃতি শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে আসলেন । দিগন্তবিসারী মাঠের উপর দিয়ে একটা হিমেল হাওয়া ভেসে আসছে , আশেপাশের বাশঝাড়ে পাখীগুলি আনন্দে কলরব করছে , আশ্রম - প্রাঙ্গণ নিরালা — নিস্তব্ধ । সবাই প্রণাম করে বসার পর শ্রীশ্রীঠাকুর আশ্রমের পূর্ব কাহিনী বলতে লাগলেন । Commerce and Culture ( কমার্স এ্যাণ্ড কালচার ) , বিশ্ববিজ্ঞান , Mechanical Works ( মেকানিক্যাল ওয়ার্কস ) , Chemical works ( কেমিকেল ওয়ার্কস ) , Registered Body ( রেজিষ্টার্ড বডি ) করার বৃত্তান্ত , মহারাজের নামে জমি কেনা , কত লোক কতভাবে ঠকিয়েছে ইত্যাদি কত কথা । তারপর শিক্ষাপ্রসঙ্গে বলতে লাগলেন — আজকাল training (শিক্ষা ) এমন হয়েছে যে একখানা দা গড়াতে পঞ্চাশজনের মিলিত পরিশ্রমের দরকার হয় । কোন একটা মানুষ কাজের সব দিকটা জানে না । All round training ( সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা ) দেব বলে কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান করলাম , এগুলির সত্তা খুব শক্ত , তা না হলে যেরকম foolish experiment ( বেকুবী পরীক্ষা ) সবটার উপর করা হয়েছে , এতদিন এগুলি টিকতাে না ।
প্রফুল্ল — সে experiment ( পরীক্ষা ) আপনি allow ( অনুমোদন ) করলেন কেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — না করে করি কী ? সবাই এসে বলে , suggestion ( মত ) দেয় । এখন অনেকের শিক্ষা হয়েছে । এই সব পরমেশ্বর ধাচের মানুষ নিয়েই মুশকিল । সবাই ঈশ্বর সাজতে চায় । যারা ঠাকুরের দ্বারা কতটা fulfilled (পরিপূরিত ) —সে কথা না বলে ঠাকুরকে তারা কতটা fulfil ( পরিপূরণ ) করছে সেইটেই বেশী করে বলে , তাদের সন্দেহ করতে হয় ।
কতিপয় লোক - সম্বন্ধে কথা উঠতে বললেন — এদের দোষই বা কী , সব খেয়ালনিন্দের দল আর কি ?
অনেক কথার পর বললেন — যা হয়েছে তাতেও কিছু না , তোরা কয়েকজন যদি আবার ফিঙ্গে হ'য়ে লাগিস — সব হবে । এই ভাব চাই — ইষ্টই আমার সব , তার জন্যই বেঁচে আছি , আমার উন্নতি বলতে বুঝি তার উন্নতি , তার স্বার্থ , তাঁর প্রতিষ্ঠা , এই যতটা করতে পারলাম ততটাই আমার জীবনের সার্থকতা । জীবন , বৃদ্ধি কিংবা আত্মােন্নতি ইত্যাদি ধুয়াে ধরলে তেমন লােক বুদ্ধি ঘুলিয়ে দিতে পারে । বাইরের লােকের কাছে সে - সব কথা থাকতে পারে , কিন্তু তােমাদের ত ’ থাকলে চলবে না । সোজা কথা — সেই মানুষটি , তিনি ভগবান কিনা , বুদ্ধ কিনা , কেষ্টঠাকুর কিনা , চৈতন্যদেব কিনা , অতশত দিয়ে আমার কাজ কী ? ‘ এহো বাহ্য আগে কহ আর , তিনি যদি তা হন,, তা’ পরে evolve করবে ( আমার বােধে উদ্ভিন্ন হবে ) । আমারই মা মা-ই কালী হ'তে পারেন , কিন্তু মা কালী হ'য়েও তিনি প্রথমতঃ ও প্রধানতঃ আমার মা । মা মা - ই — এ রূপ বাদ দিয়ে তার চিন্ময়ীরূপ আমার কাছে বড় নয় । তাই চণ্ডীদাস বলেছে — ‘ মরম না জানে ধরম বাখানে , এমন আছয়ে যারা , কাজ নাই সখি তাদের লইয়া , বাহিরে থাকুক তারা । তেমন ভালবাসা যদি থাকে , তখন তিনি ছাড়া , তার ভাল - মন্দ ছাড়া , তার স্বার্থপ্রতিষ্ঠা ছাড়া আলাদা কোন বােধই থাকে না । আর সাধু মানে সে - ই , যে সব circumstances- কে ( অবস্থাকে ) manage ( ব্যবস্থা ) ক'রে , disburse ( পরিবেষণ ) করে , adjust ( নিয়ন্ত্রণ ) করে rule ( আয়ত্ত) করতে পারে — কাজ সুন্দরে সমাপন করতে পারে ।
গীতার কয়েকটা শ্লোক নিয়ে আলােচনা হলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন , গীতার বাসুদেব ’ কথাটা আমার খুব ভাল লাগে । আত্মা , পরমাত্মা , বলে কথা নয় , বসুদেবের ছেলে বাসুদেবই আমার সব — এই হলো মােক্ষম কথা ।
10