🔷 সার্থক ধ্যান..
🔷 গালাগালি ও মিষ্টি হয়.🙂
🔷 বেশি টাকা থাকলে ইষ্টপ্রতিষ্ঠার কী সুবিধা হয়..?
🔷 নেতা কেমন হবে
🔷 উন্নতি মানেই উৎ - নতি..
🔷 বৃত্তি - নিয়ন্ত্রণ - সম্বন্ধে...
![]() |
৩ রা অগ্রহায়ণ , সোমবার , ১৩৪৭ ( ইং ১৮/১১/১৯৪০ )
শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে মাতৃমন্দিরের পিছনে বেঞ্চে বসেছিলেন । একটি দাদা বললেন — অনেক টাকা থাকে , তাহলে ইষ্টপ্রতিষ্ঠার খুব সুবিধা হয় ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তা ’ নয় । মানুষ যজন , যাজন করতে লাগলে টাকা আপনি আসে । এই যে আমাকে দেখছিস , আমার কী আছে ? আমার থাকার মধ্যে আছে এই — তোদের ভালবাসি , তোরা কেউ না পড়িস তাই ভাবি , এইজন্য অস্থির হ'য়ে বেড়াই , তােদের পিছনে লেগেই আছি , যার যাতে ভাল হবে বুঝি , তাকে তা ’ কই , তা যাতে করতে পারে , তার ফন্দীফিকির বাতলে দিই , একে দিয়ে এ করাই , ওকে দিয়ে তার জন্য আর - একটা করাই , প্রত্যেককে প্রত্যেকের পরিপােষণী করে তুলতে চেষ্টা করি । এই আমি করি , তােরই আমার সম্পদ । যে আমাকে টাকা দিস , ইচ্ছে করেই তো দিস । তোদেরও এমনি হবে । চিরকাল ছেলেই থাকে না , তার যখন ছেলে হয় , সে হয়ে দাঁড়ায় বাবা । তোরাও তাই ইষ্টকেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে এইরকম করবি , এইরকম হবি , ভাবনা কী ? আর , তােরা বড় না হলে আমার সুখ কোথায় ?
ধ্যান - সম্বন্ধে কথা উঠল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — মানুষ ধ্যান - ধ্যান করে , অথচ ধ্যান বলতে কিছু বােঝে , concentration ( একাগ্রতা ) না হ'য়ে হয় fixation ( ত্রাটকগোছের ) । ওতে মাথার কৰ্ম্ম নিকেশ । ধ্যান মানে হ’লো অনুরাগমুখর ইষ্টচিন্তন । ইষ্টস্বার্থ ও ইষ্টপ্রতিষ্ঠার পরিপােষক ক'রে ভিতর - বাইরের যা - কিছুর নিয়ন্ত্রণ , সামঞ্জস্য ও সমাধানের বুদ্ধি স্থিরীকরণ । ওইভাবে চিন্তা ক'রে বুদ্ধি স্থির করে কাজেও তা করা চাই । তাতেই হয় ধ্যান সার্থক , চরিত্রের ইষ্টানুগ বিন্যাসও হয় ওতে ক'রেই ।
১ লা পৌষ , সােমবার , ১৩৪৭ ( ইং ১৬/১২/১৯৪০ )
শীতের সকাল । আশ্রম কর্মমুখর । প্রেস , তপোবন , কেমিক্যাল ওয়ার্কস , ওয়ার্কশপ , আনন্দবাজার , ডিসপেনসারী , ফিলান্থপি অফিস , হােসিয়ারী , আট - স্টুডিও — সর্বত্রই কর্মিগণ কর্মরত । মাতৃমন্দিরের দক্ষিণ , দিকে আশ্রম - প্রাঙ্গণে স্থানীয় কয়েকজন তরকারীওয়ালা তরকারী নিয়ে বসেছে , মায়েরা সেখান থেকে তরকারী কিনছেন । অাশ্রমের সম্মুখে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে দিগন্তবিস্তৃত পদ্মার চর , তারই মাঝে অদূরে একটা বিরাট ঝিল । আকাশ নির্মল , উদার , থেকে - থেকে পাখীর ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে । উত্তর দিকে বাশ ঝাপের ভিতর মাঝে - মাঝে নানারকম পাখী কলরব করছে , বেশ রোদ উঠেছে , শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃমন্দিরের পাশে রােদপিঠ করে একখানি বেঞ্চিতে বসে সহাস্য স্নেহকোমল বয়ানে কেষ্টদাকে ( ভট্টাচাৰ্য ) বলছেন — প্রফুল্ল ( দাস ) , বীরেন ( মিত্র ) এরা যদি তপােবনে successful ( কৃতকাৰ্য ) হয় , ওদের আর কিছুতে আটকাবে না । মাল কয়টাই জুটেছে বেশ । successful ( কৃতকাৰ্য ) হওয়া মানে শুধু কয়েকখানা ঘর করে ছেলে নিয়ে স্কুল করে তোলা নয় । একটা University ( বিশ্ববিদ্যালয় ) গড়ে তুলতে হবে । এমন করা চাই যাতে তপোবনের নামে সারা ভারত নতি জানায় — শুধু ভারত কেন , পৃথিবীর সব দেশ ।
কেষ্টদা — শিক্ষার এই প্রথা সর্বত্র চারাতে হবে , compromise ( অপোস ) করলে হবে না ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Compromise ( আপােসরফা ) এতটুকুও না । কেষ্টদা — প্রফুল্ল , বীরেন যদি তেমন হয় , তাহ'লে হবে , তবে charge ( দায়িত্ব ও ক্ষমতা ) ওদের হাতে থাকা দরকার । শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি তো বলেছি , কাউকে সরান চলবে না , সবাইকে maintain ( প্রতিপালন) করতে হবে , আর charge ( দায়িত্ব ও ক্ষমতা ) আগে কী ? করে - করে আস্তে - আস্তে তা হাতে আসে । দায়িত্ব যে নিতে জানে , ভার যে বইতে পারে , ক্ষমতা তার হাতে এমনিই এসে পড়ে ।
ডাক্তার কালীদা এসে বললেন — মেডিক্যাল ডাইজেষ্টে বাতের একটা ভাল ওষুধের কথা বেরিয়েছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — প্যারীকেও দেখা । নতুন যা কিছু পাবি , নিজেও নােট করে রাখবি । ভাল করে তৈরী হ ' । মেডিক্যাল কলেজ - টলেজ যদি হয় , সব বিদ্যে কাজে লাগে যাবি ।
৩ রা পৌষ , বুধবার , ১৩৪৭ ( ইং ১৮/১২/১৯৪০ )
শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে আশ্রম - প্রাঙ্গণে পশ্চিমাস্য হয়ে চৌকিতে উপবিষ্ট । কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) , হরিপদদা ( সাহা ) , ধীরেনদা ( চৌধুরী ) , প্রফুল্ল প্রভৃতি অনেকেই উপস্থিত । শ্রীশ্রীঠাকুর আজ আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কথাবার্তা বলছেন , ভক্তবৃন্দ বিভাের হয়ে তার শ্রীমুখনিঃসৃত , কথামৃত পান করছেন । নেতা কেমন হবে সেই সম্বন্ধে কথা উঠলাে । প্রেমপূরিত , ললিত ভঙ্গীতে , প্রাণ - কাড়া , দরদভরা সুরে তিনি বলছেন- Leader- এর ( নেতার ) মুখ দিয়ে কথা বেরুবে এমন যে কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল , আকুল করিল গো পরাণ ব'লে মানুষ বোধ করবে । মুসােলিনীর কথা শুনেছি — যেমন sweet ( মধুর ) , soft ( কোমল ) , modest ( নম্র ) , তেমনি uncompromising ( অপােসরফাহীন ) Leader- এর ( নেতার ) হ'তে হবে loyal ( আনুগত্যসম্পন্ন ) , sweet ( মধুর ) , soft ( কোমল ) , sincere ( অকপট ) , active ( কর্মমুখর ) । তার চেহারা , চাউনিই হবে এমন যে মানুষ enchanted ( মুগ্ধ) হয়ে যাবে ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর ধীরেনদা সম্বন্ধে বললেন — আমি ভাবছি , ওকে জ্যাঠার ওখান থেকে এনে অন্য জায়গায় খাবার ব্যবস্থা করে দিই , কিন্তু আবার মনে হয় ওখানে থাকাই ভাল । যেখানে প্রতিমুহূর্তে opposition ( বাধা ) , কোন ক্ষমা নেই , সহানুভূতি নেই , সেখান থেকে যদি tone ও temper ( মন - মেজাজ ) ঠিক রেখে , principle ( আদর্শ ) নিয়ে চলতে পারে , তবে তার ভিতর - দিয়ে অনেক খানি বেড়ে উঠবে । সব সাধনার এই - ই প্রকৃত স্থান । আর , difficulty- র ( কষ্টের ) ভিতর - দিয়ে ছাড়া কোন greatman ( বড়লােক ) হয়নি । উন্নতি মানেই উৎ - নতি , শ্রেয়নতি আর তাই নিয়ে কুশল - কৌশলী নিয়ন্ত্রণে সুব্যবস্থিতির সহিত অন্তরায় অতিক্রম করে আমরা যত কৃতকার্য হ'তে পারি — শ্রেয় - উপচয়িতায় , ততই আমরা উন্নতি লাভ করি । যাদের move for principle ( আদর্শানুগ চলন ) আছে , তারা suffering- এর ( দুঃখের ) ভিতর প'ড়ে সেগুলি mani pulate ( নিয়ন্ত্রণ ) করে experience- এর ( অভিজ্ঞতার ) অধিকারী হয় , বড় হয় , আর যাদের তা নেই , তারা ওর চাপে ডুবে যায় ।
প্রফুল্ল মানুষের সহ্যের তাে একটা সীমা আছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষের fatigue layer ( শ্রান্তির স্তর ) break ( অতিক্রম) করে গেলে তখন সে যা পারে , তাই দেখে মানুষ অবাক হয়ে যায় , ভাবে অসাধারণ । কিন্তু তার কাছে সেটা স্বাভাবিক !
বৃত্তি - নিয়ন্ত্রণ - সম্বন্ধে কথা উঠলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে রসগােল্লা খাওয়ার লােভ জয় , উপর্যপরি তিনরাত্রি স্বপ্নে পরমাসুন্দরীর আকুল প্রেমনিবেদন এবং সর্বশেষে মায়ের আবির্ভাব এবং তার উপদেশমতাে নাম করার ফলে প্রলোভন হ'তে রেহাই পাওয়ার বৃত্তান্ত সংক্ষেপে উল্লেখ করে বললেন -Clue ( সঙ্কেত ) -টা পেয়ে গেলাম । দেখলাম অত্যন্ত সোজা , ঝোঁকটা যখন চাপে , ততখানি speed (বেগ) নিয়ে otherwise benignly engaged ( অন্যথা হিতকরভাবে ব্যাপৃত ) হয়ে পড়লে ও - কথা আর মনেই থাকে না , আপনা থেকেই নেশা কেটে যায় ।
এরপর লোকের সঙ্গে ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত , সেই সম্বন্ধে কথা উঠলো । শ্রীশ্রীঠাকুর - আপন জনের মতো প্রাণস্পর্শী ব্যবহারটাই মানুষ চায় , তােমার ব্যবহার যদি বাহ্যতঃ রুঢ়ও হয় , অথচ তার মধ্যে ঐ জিনিসটি থাকে , তাহ'লেও মানুষ তা পছন্দ বৈ অপছন্দ করবে না । আমি যখন ডাক্তারী করতাম , একবার একজন মুসলমানকে চিকিৎসা করছিলাম । একটু , কমার পর তার বাড়ী থেকে ওষুধ নিতে আসে না , আমার তখন দিনরাত কি ভাবনা , মনটা কেবলই অস্থির অস্থির করতাে , কি জানি কী হ'লাে , কেমন আছে লােকটা ! তিনদিন পরে যখন ওষুধ নিতে আসলে আমি তাকে খুব বকলাম । বকা শুনে সে বলে — বাবু অপিনি যে এত গালাগালি দিলেন , অন্য কেউ হলে আমি তাকে আস্ত রাখতাম না । কিন্তু আপনার কথাগুলি আমার এত মিষ্টি লাগছে , ইচ্ছে করছে , আপনি আরও গালাগালি করেন , আমি শুনি । আমি তখন ভাবলাম , “ ভগবান আমাকে গালাগালি করতে শিখিয়েছেন তাহ'লে ! তা ছাড়া আমি কাউকে বেশী - কিছু কড়া কথা বলতে পারি না , এই ভয়টা যেন আমাকে ভূতের মতাে পেয়ে বসে আছে — যাকে আমি বকছি , পাছে সে মরে যায় , তাহলে তাে আমার আর দুঃখ রাখার জায়গা থাকবে না । অবশ্য অসৎ - নিরােধের জন্য যেখানে যা প্রয়োজন তা করাই লাগে । তবে uncompromising ( অপপাসরফাহীন ) হ'তে গেলে sweet ( মিষ্টি ) হবার অসুবিধা নেই , thrashing ( বকুনি ) এমনভাবে দেওয়া যায় , যাতে মানুষ elated ( উদ্দীপ্ত ) হ'য়ে ওঠে ।
এরপর শ্রীশ্রীঠাকুর কেষ্টদার কাছে শুনতে লাগলেন যাজন - কাৰ্যাদি কোথায় কেমন হচ্ছে ।
10