🔷 দারিদ্রব্যাধিগ্রস্তদের কেমন করে শােধরান যায়...
🔷 বর্ণাশ্রমটা যদি ঠিকভাবে জাগিয়ে তোলা যায় ,
তবে অনেক কিছু গােল চুকে যায়...
২৮ শে ফাল্গুন , বুধবার , ১৩৪৭ ( ইং ১২/৩/১৯৪১ )
সকালে শ্রীশ্রীঠাকুর হাতমুখ ধুয়ে নিভৃত - নিবাসে এসে বসেছেন পূৰ্বাস্য হ'য়ে , সম্মুখে দিগন্তের বিস্তার , কোন্ দূর - দূরান্তে আকাশের শেষপ্রান্তে যেন তার দৃষ্টি নিবদ্ধ , মুখে তার নির্মল প্রশান্তি , হাব - ভাব - ভঙ্গীতে একটা সহজ বৈরাগ্য , স্বচ্ছন্দ নির্লিপ্ততা — মহাযোগেশ্বর যেন যােগে ব'সে আছেন । একলাটি নিরালা আছেন । সত্যেনদা ( সাহিত্যশাস্ত্রী ) ও প্রফুল্ল এসে এককোণে চুপচাপ বসলেন । কিছু সময় এমনি কাটলো নীরব নিস্তব্ধ । তারপর শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক চেয়ে খেলেন , তামাক খেতে - খেতে , আলাপ সুরু হলে । সত্যেনদা ইষ্টভৃতি - সম্বন্ধে কথা তুললেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর আবেগভরে বলছেন — ইষ্টভৃতি করতে গেলেই যাজন ইত্যাদি সব এসে পড়ে । খেটে - পিটে যাঁকে প্রীতির সঙ্গে ভরণ করি , ভাবা - বলায় তার কথা এসেই যায় , তিনি আপন হ'য়ে ওঠেন , অন্তরে বাসা বাঁধেন । ইষ্টভৃতি শুধু বামুন - পণ্ডিতের দেওয়া ব্যবস্থা নয় — মুসলমান , খ্রীষ্টান ইত্যাদি সকলেরই আছে । জেম্সও ঐ ধরণের কথা বলছেন , তবে আমাদেরটার মধ্যে তপস্যার ভাবটা বেশী আছে । ‘ ভবতী ভিক্ষাং দেহি ’ ব'লে উপনয়ন - সংস্কারের থেকে আরম্ভ করে আমরণ দিনের পর দিন চলতেই থাকে । এককে কেন্দ্র করে অন্য , যা ' - সব করা যায় , সবই integrated ( সংহত ) হয়ে ওঠে , গোড়ায় ১ থাকলে , তারপর যত শুন্যই বসাও ততই বেড়ে যায় ।
বেলা গােটা নয়েকের সময় শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃ - মন্দিরের বারান্দায় বসা । বাইরে দোখল প্রামাণিককে দেখে বললেন — কি পরামাণিক ?
দোখল ওখানে দাঁড়িয়েই কথা বলতে লাগল ।
শ্রীশ্রীঠাকুর ( সহাস্যে ) “ তুমি অম্বা কর ক্যান ? কাছে আসাে , ব'সে , না হলি কি কথা ক'য়ে সুখ হয় ।
দোখল হাসিতে - হাসতে কাছে এসে বসলাে । শ্রীশ্রীঠাকুর তার সঙ্গে পুরোনো দিনের গল্প - গুজব করতে লাগলেন ।
৩০ শে ফাল্গুন , শুক্রবার , ১৩৪৭ ( ইং ১৪/৩/১৯৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর মাতৃমন্দিরের পিছনে বসেছেন । কেষ্টদা ( ভট্টাচাৰ্য ) এসে দাড়ালেন , আরও অনেকে ছিলেন । কথা উঠলো দারিদ্রব্যাধিগ্রস্তদের কেমন করে শােধরান যায় । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — তাদের জন্য আলাদা রকমের স্কুল করা লাগে , তার নাম দিতে হয় Pauper Reformatory School ( দারিদ্রব্যাধি সংশােধনী শিক্ষাগার ) , সেখানে তাদের বাস্তব কাজের মধ্যদিয়ে শিক্ষিত করে তুলতে হয়। ধরুন , ২০০ বিঘে জমি থাকলে , সেখানে কৃষিশিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে , ছােট - খাট কারখানা থাকলাে , শিল্পসংস্থা থাকল্যে , ল্যাবরেটারী থাকলো , সেখানে তারা হাতে - কলমে কাজ করলো । এমনতর স্কুলে শিক্ষক চাই । খুব পাকা ধরণের — তারা হবে ইষ্টপ্রাণ , চরিত্রবান , কর্মমুখর , আশা - ভরসা- উদ্দীপনাময় । তারা নিজেরা কাজ করবে , সঙ্গে - সঙ্গে ছাত্রদেরও কাজে অনুরক্ত ক'রে তুলবে elating thrash ( উদ্দীপনী ধাক্কা ) দিয়ে । Sham theorising এর ( মেকী উপপত্তির ) বাড়াবাড়ি থাকবে না । কাজকর্ম করবে , তার সঙ্গে কিছু - কিছু literation ( আক্ষরিক জ্ঞান ) -এর ব্যবস্থা থাকবে , নানারকম information ( সংবাদ ) -ও তাদের supply ( সরবরাহ) করতে হবে , তদনুপাতিক library ( গ্রন্থপীঠ ) থাকবে । শিক্ষক ও ছাত্র একত্রই থাকবে বােডিং - এ একসঙ্গে । প্রথম অবস্থায় বাইরের অন্য pauper ( দারিদ্রব্যাধিগ্রস্ত ) -দের অবহাওয়া থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে । তাদের এমন পরিমণ্ডলে রাখতে হবে যাতে তাদের ভিতর self - confidence ( আত্মবিশ্বাস ) গজিয়ে ওঠে । পারার আনন্দটা তাদের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে । আর , যা - কিছুই তারা করবে , লক্ষ্য রাখতে হবে , যাতে সাশ্রয়ে সুন্দরভাবে নিখুত রকমে করে । প্রত্যেকে তার কাজের full account maintain করবে ( পুরাে হিসেব রাখবে ) তার diary- তে ( রোজনামচায় ) । পরস্পরের মধ্যে একটা healthy competition ( জীবনীয় প্রতিযােগিতা) থাকবে । প্রত্যেককে due appreciation ( যথাযােগ্য প্রশংসা ) দিতে হবে । Normal economic use of time ও speed ( সময় ও ক্ষিপ্রগতির সহজ সাশ্রয়ী ব্যবহার ) -এ তাদের অভ্যস্ত করে তুলতে হবে । বৈশিষ্ট্যমাফিক labour ও output ( শ্রম ও উৎপাদন ) -অনুযায়ী প্রত্যেকের earning ( অৰ্জন ) হবে । তাদের মধ্যে এমন একটা ঝোঁক গজিয়ে দিতে হবে যাতে তারা নিজেদের অর্জনের উপর দাঁড়িয়ে ইষ্টভরণ , আচাৰ্য - ভরণ , ও আত্মপোষণ করতে পারে এবং পরিবার - পারিপার্শ্বিককেও কিছু - কিছু দিতে পারে , এটা compulsory ( অবশ্য করণীয়) করে তুলতে হয় । করা , পারা ও দেওয়ার আনন্দে তাদের মাতাল করে তুলতে হয় । নিত্য ইষ্টকে খাওয়ান লাগবেই এই ছিল আৰ্যপ্রথা , এই - ই সমস্ত inferiority ( হীনম্মন্যতা ) ও pauperism এর ( দারিদ্রব্যাধির ) গোড়া মেরে মানুষকে attached ( অনুরক্ত ) , active ( কর্মঠ ) , energetic ( উৎসাহদীপ্ত ) ও able ( যােগ্য ) করে তুলতে । সেইজন্য কথা আছে , গুরুকে কেবল দেবেই , গুরুর কাছ থেকে অর্থাদি নেবে না, এমনকি নিজের অভাব - অভিযােগের কথা জানাবেও না এমনতরভাবে , যাতে তার সাহায্য করার আগ্রহ আসতে পারে । গত্যন্তরবিহীন হ'য়ে নিতান্তই যদি তাকে বলতে হয় তখনই বলবে যখন তুমি একান্তই অপারগ - বাস্তবভাবে । কিন্তু তার প্রত্যেকটি চাহিদা with every effort fulfil ( সর্বপ্রচেষ্টায় পরি পূরণ) করতে চেষ্টা করবে ; pauperism ( দারিদ্রব্যাধি ) , inferiority ( হীনম্মন্যতা ) , psychical and physical idleness ( মানসিক এবং শারীরিক আলস্য ) যাতে মানব - চরিত্রের কানাচেও ঢুকতে না পারে , তার জন্য এটা একটা cruel safe - guard ( কঠোর রক্ষাকবচ ) । গুরুর কাছ থেকে সুযােগ , সুবিধা , সাহায্য নেওয়ার বুদ্ধি যত বাড়ে , তাকে পরিপূরণের ধান্ধাটা ততটা ঢিলে হয়ে আসে । অথচ তৎপরিপূরণী সক্রিয় সম্বেগটাই মানুষের উন্নতি ও কৃতকাৰ্যতার নিয়ামক ।
রাত্রে শ্রীশ্রীঠাকুর বাঁধের ধারে তাসুতে বসে আছেন , পদ্মাচরের দিগন্ত জুড়ে রাতের স্তব্ধতা থমথম করছে , আশ্রমভূমি কোলাহলশূন্য , শান্ত , দিনের কর্মব্যস্ততার পর অনেকেই স্ব - স্ব ধ্যানমন্দিরে ধ্যানরত । অতিথিশালা ইত্যাদি কয়েকটি জায়গায় ২|৪ জন পাঠ , আলোচনা ও যাজনে ব্যাপৃত , মাঝে - মাঝে পল্লীর দূর ঝোপজঙ্গল থেকে শেয়ালের ডাক এসে সকলকে সচেতন করে তুলছিল । শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে অল্প কয়েকজন ছিলেন , এমন সময় পাবনার মােক্তার শ্ৰীযুত ক্ষিতীশ বিশ্বাস আসলেন । ধীরে - ধীরে আলাপ জমে উঠলাে । জনসেবা - সম্বন্ধে কথা উঠলো । শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — মানুষের কার কী সমস্যা সেটা যথাযথভাবে অনুধাবন না করে আমরা যদি নিজেদের ভাবটা অন্যের উপর আরোপ করে তার সমাধান করতে চাই নিজেদের রকমে , তা'তে কারো সত্যিকার উপকার করা হয় না । কুলিদের খাটুনি দেখে আমার অনেক সময় কষ্ট হতাে , ভাবতাম , ওদের কত অসুবিধা । তাই আমি নিজে কিছুদিন ওদের সঙ্গে মিশে কুলিগিরি করে দেখেছি । দেখলাম , ওরা আয় করে প্রচুর বাবুদের থেকে বেশী করে । তা ছাড়া ওরা বেশ সুখী ; মাতি উন্নত ধরণের জীবন - যাপনের hankering- এর ( চাহিদার ) বালাই ওদের নেই — খেয়ে - দেয়ে ফুৰ্ত্তি করে স্থূলভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই খুশি । আমরা ওদের যা ’ problem ( সমস্যা ) বলে মনে করি , সে সব ওদের pproblem(সমস্যা) নয় । অথচ আমাদের কল্পিত ধারণা নিয়ে আমরা ওদের জন্য কত হৈ - চৈ করি , আন্দোলন করি । এত আন্দোলন আমরা করি , কিন্তু মূল আন্দোলনটা করি না । আমার মনে হয় , বর্ণাশ্রমটা যদি ঠিকভাবে জাগিয়ে তোলা যায় , তবে অনেক কিছু গােল চুকে যায় । বর্ণাশ্রমের মধ্যে un employment ( বেকার - সমস্যা ) ব'লে জিনিস ছিল না , তাতে বৃত্তিহরণ ছিল মহাপাপ , প্রত্যেকে স্ব - স্ব বর্ণোচিত কর্ম করতাে , প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহযােগী ও পরিপূরণী হ'তো । উদরাম্নের জন্য যদি বিপ্র , ক্ষত্রিয় , বৈশ্য তাদের বর্ণ - অনুচিত কাজ করতো তাহলে পতিত হতো । পয়সা না নিয়ে করলে দোষ হতো না । অন্যকে help ( সাহায্য ) করার জন্য যদি করে পয়সা নেওয়া যায় , তাও দোষের নয় । কিন্তু পেটের দায়ের জন্য যখন মানুষ ভালমন্দ বিচার করে না , সমাজের শৃঙ্খলা মানে না , তখন তার আর কিছুই থাকে না ।
10