🔷️ Distorted- দের ( বিকৃতদের ) চাল - চলন...
🔷️ ছেলেপেলেদের কোন ঝোক ...
🔷️ শঙ্খ - চক্র - গদা - পদ্মধারী কথার তাৎপৰ্য্য
সম্বন্ধে কথা উঠলো...
১লা চৈত্র, শনিবার, ১৩৪৭(ইং১৫/৩/১৯৪১)
শ্রীশ্রীঠাকুর সকালে তাসুতে বসে আছেন , এক - এক করে অনেকে এসে প্রণাম করে যাচ্ছেন । তখনও সূৰ্য্য ওঠেনি , স্নিগ্ধ বায়হিল্লোলে আশ্রমের সামনেকার বকুল গাছগুলি ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছে , বাঁশবন ও ঝাউ - ঝোপ থেকে মাঝে - মাঝে পাখীর ডাক শোনা যাচ্ছে । শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খেতে - খেতে প্রসন্নবদনে কথাবার্তা বলছেন ।
নিবারণদা ( বাগচী ) এসে প্রণাম করে যাজনকাজ - সম্বন্ধে বললেন — আমি যশোহরের সর্বত্র ঘুরে - ঘুরে কাজ করছি এবং দীক্ষাও সর্বত্র কিছু - কিছু হচ্ছে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — নানা জায়গায় ঢু মারা মন্দ নয় , কিন্তু জায়গায় - জায়গায় concentrate ( কেন্দ্রায়িত ) করে পাঁচশো কিংবা হাজার সৎসঙ্গী করে consolidate ( সঘবদ্ধ ) করা দরকার । স্থানীয় কর্মী সৃষ্টি করতে হয় । তাদের সাহায্যে প্রত্যেকটি মানুষকে nurture ( পােষণ ) দিয়ে যজন , যাজন , ইষ্টভৃতিপরায়ণ ক'রে তোলা লাগে । আর , আশ্রমে লােক খুব পাঠাতে
হয় । সামগ্রিকভাবে পরিবারগুলি যাতে দীক্ষিত হয়ে ওঠে এবং আবাল - বৃদ্ধ - বনিত ইষ্টীচলনে ও সদাচারে অভ্যস্ত হয় , সেদিকে লক্ষ্য রাখা লাগে । তাদিগকে সব - ভাবে উচ্ছল করে তুলতে হয় । কতকগুলি সচ্ছল , সক্ষম , শান্তিময় , ইষ্টপ্রাণ পরিবার যদি গড়ে তুলতে পার , তার ফলে তাদের পরিবেশ ও আত্মীয় - স্বজনের মধ্যে সেটা চারিয়ে যাবে । আর , পারস্পরিক সেবা - বিনিময়ের ব্যবস্থা এমন করে করবে যাতে একটা লোকও না খেয়ে না থাকে , একটা লােকও পড়তে না পারে । একটা যজমানও যদি জীবনের পথে হ'টে যায় , জানবে , সে তুমিই হ'টে গেলে । দিনরাত মাথা খাটান চাই — কেমন ক'রে পারস্পরিক সাহায্য ও সেবার ভিতর দিয়ে প্রত্যেকটি লোককে দাঁড় করিয়ে দিতে পার । নিজের ছাওয়াল - পাওয়ালের জন্য যেমন বোধ কর , তাদের জন্যও সেইরকম active feeling ( সক্রিয় বােধ ) চাই , তাতে তোমাদেরও মাথা খুলে যাবে , যােগ্যতা বেড়ে যাবে । এইভাবে যদি চল , সবটা মিলে একটা শক্তি হয়ে দাড়াবে । আর , শ্রেষ্ঠযাজী হওয়া চাই । এর খানিকটা পর অমূল্যদা ( ঘোষ ) প্রেস থেকে একটি জিনিস ছাপিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখাতে নিয়ে আসলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে বললেন — বেশ হইছে । আরো ভাল টাইপ অনা ! তোমাদের প্রেসকে এদেশের সেরা প্রেস করে তোলা চাই । ভাল মেসিনের খোঁজ রাখিস্ ।
৪ ঠা চৈত্র , মঙ্গলবার , ১৩৪৭ ( ইং ২৮/৩/১৯৪১ )
শ্রীশ্রীঠাকুর রাত্রে খাওয়া - দাওয়ার পর বাঁধের ধারে তাসুতে ব'সে খুশিমনে
গল্পসল্প করছিলেন । বীরেনদা ( মিত্র ) , প্যারীদা ( নন্দী ) , অমরভাই ( ঘোষ ) , প্রফুল্ল এবং মায়েদের মধ্যে কালিদাসীমা , কালীষষ্ঠীমা , সরােজিনীমা , গৌহাটির মা , মানদামা ( প্রফুল্লর মতি ) প্রভৃতি অনেকেই ছিলেন । Distorted libido ( বিকৃত সুরত ) সম্বন্ধে কথা উঠলো ।
শ্রীশ্রীঠাকুর— Distorted- দের ( বিকৃতদের ) চাল - চলন সব - সময় হয় উল্টো । যাকে সে পছন্দ করে , বাইরে হয়তো দেখাবে , জোর গলায় বলে - বলে বেড়াবে , তাকে সে আদৌ পছন্দ করে না , আবার যাকে হয়তো সে পছন্দ করে না সেখানে হয়তো আদরের ছড়াছড়ি করবে । সে হয়তাে কাউকে চুমু খেতে চায় , কিন্তু নিজে চুমু খাবে না , অন্যকে দিয়ে খাওয়াবে , নিজে খেলে পাছে লোকে তার মনােগত ইচ্ছার বিষয় জেনে ফেলে । তারা একের অভাব অন্যকে দিয়ে পূরণ করতে চায় , পর - পর বিভিন্ন মানুষের পিছনে এইভাবে ছােটে , তাই শান্তি পায় না । Distorted ( বিকৃত ) -দের tackle ( পরিচালনা) করতে গেলে , sexual plane- এ ( যৌনস্তরে ) বন্ধু হওয়া লাগে , নিজে উষ্কে থেকে । খুব সাবধান হ'য়ে চলা লাগে , নচেৎ তার impulse carry ( সাড়া বহন ) করে - করে মানুষ নিজেও বিগড়ে যেতে পারে । অটুট ও কঠোর ইষ্টপ্রাণ যারা sex ( যৌনজীবন ) এর উপর complete mastery ( পূর্ণ আধিপত্য ) যাদের আছে , তারাই এটা পারে । তা ছাড়া , এ ব্যাপারে লাগে বহু subtle psychological operation ( সূক্ষ্ম মনােবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ) , তাই , যার - তার এ - ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করাই ভাল । আর , এক - একটা মানুষের পিছনে খাটনিও লাগে অসম্ভব । অতখানি ধৈৰ্য্য , সহ্য , অধ্যবসায় কম মানুষেরই থাকে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর অন্তরঙ্গ ভঙ্গীতে স্নেহব্যাকুল কণ্ঠে বললেন — দ্যাখাে , তােমাদের একটা কথা বলি , ছেলেপেলেদের কোন ঝোক জোর করে ভেঙ্গে দিতে যেও না । তাতে হয়তাে নিবৃত্ত হ'তে পারে , কিন্তু distortion- এর ( বিকৃতির) সূত্রপাত হয় । তাই , মন্দ ঝোক হ'লেও কায়দা করে মোড় ফিরিয়ে দিতে হয় । মানুষের ঝোকের মধ্যে জড়িত থাকে তার সম্বেগ । তাকে ডাঙ্গশ মেরে ভেঙ্গে দিলে সে হতভম্ব হয়ে ওঠে , দিশেহারা হয়ে পড়ে কিন্তু , ‘ হ্যা ’ , ‘ না ’ ভালমন্দ পছন্দ অপছন্দের একটা সহজ সুস্থ জীবনীয় বিন্যাস হয় না তার ভিতরে । ‘ হ্যা , ‘ না ’ idea ( ধারণা ) দু'বছরের মধ্যেই এস্তামাল করিয়ে দিতে হবে । কোন বিষয়ে ‘ না ’ না - ব'লে , ‘ না ’ কেন তার বুঝটা তার মাথায় তার মতাে করে ধরিয়ে দেওয়ার কায়দায় বলতে হবে with right pose and expression ( যথাযথ ভঙ্গী ) ও ব্যঞ্জনা - সহ ) ।
প্রফুল্ল — প্রত্যেকটি বিষয়ে আপনি যা, - যা, করতে বলেন , করা বড় কঠিন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — কঠিন কিছু না । ভিতরে অনিচ্ছা থাকলে বা অন্যরকম ইচ্ছা থাকলে কঠিন লাগে । ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠা যার নেশার মতো পেয়ে বসে , তার কাছে কঠিন বোধ থাকে না । কথা তো ঐ এক কথা — তার সুখই আমার সুখ , তার স্বার্থই আমার স্বার্থ । মানুষ নিজের সুখ - স্বাচ্ছন্দ্য , স্বার্থের জন্য যেমন করে , ইষ্টের জন্য সেইটুকু করা — এ তাে হাতী - ঘােড় কিছু না ; আর , এর মধ্যে তত্ত্বের ব্যাপারও কিছু নেই । ঐ ঝোকটা এসে গেলে তখন মানুষ সব পারে , আর , তাতে কষ্টের বােধ থাকে না । আমি যে কতখানি সুখী , trouble ( কষ্ট ) -গুলি trouble- ই ( কষ্টই ) মনে হয় না । করতে হবে — এই নেশা ।
শঙ্খ - চক্র - গদা - পদ্মধারী কথার তাৎপৰ্য্য সম্বন্ধে কথা উঠলো । শ্রীশ্রীঠাকুর বীরেনদা প্রভৃতির কাছে শঙ্খ , চক্র , গদা , পদ্ম প্রভৃতি শব্দগুলির মানে জিজ্ঞাসা করলেন । তারা এক - এক করে শব্দগুলির মানে বললেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — তাহ'লেই দাড়ালাে , দমন , পীড়ন ও কথন - বিন্যাসে মানুষকে সঞ্চালিত করতঃ স্থৈৰ্য্যের সহিত প্রাপ্তিকে যিনি সংঘটিত করান , তিনিই শঙ্খ - চক্র - গদা - পদ্মধারী ।
এইসব কথাবাত্তা চলছে , এমন সময় কিশােরীদার ঘরের বারান্দায় একটি দাদা খঞ্জরী বাজিয়ে আকুলভাবে গাইছেন—
তুমি হে দীনবন্ধু , পার কর ভবসিন্ধু ,
অকূলে ফেললা না আমারে ।
গান শুনতে - শুনতে শ্রীশ্রীঠাকুর কেমন আনমনা হয়ে গেলেন । দৃষ্টিতে তাঁর রহস্যঘন অতলস্পর্শ তন্ময়তা , মুখে এক অপূর্ব দিব্য ভাবাবেশ ।
10