🔷 শ্রীশ্রীঠাকুর — ধর্ম বলতে আমি কী বুঝি....
🔷 সন্ন্যাসী কাকে বলে..
🔷 সৎসঙ্গের প্রেসিডেন্ট..
🔷 সৎসঙ্গের evolve উদ্ভূত কার থেকে হয়েছ...
🔷 শ্রীশ্রীঠাকুরের সাক্ষ্য...
১৯ শে ভাদ্র , বুধবার , ১৩৪৭ ( ইং ৪/৯/১৯৪০ )
আজ শ্রীশ্রীঠাকুর সাক্ষ্য দিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর যেন ভাবিত হয়ে পড়েছেন কেমন করে সাক্ষ্য দেবেন । কোর্ট এসে জবানবন্দী নেবে । হাকিম ও দুই পক্ষের উকিল , মোক্তার আসবার আগেই শ্রীশ্রীঠাকুর কলা - কেন্দ্রের দক্ষিণ পাশের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ( কলাকেন্দ্রের মাঝের ঘরে কোট বসবে ) । কিছু পরেই পাবনার বিখ্যাত উকিল শ্রীরণজিৎ লাহিড়ী ও আশু রায় এলেন । রণজিৎবাবুকে দেখে শ্রীশ্রীঠাকুর সসমে উঠে বসে ‘ আসুন দাদা , আসুন ’ , ব'লে অভ্যর্থনা করলেন । রণজিৎবাবু শ্রীশ্রীঠাকুরকে চিন্তাকুল দেখে ভরসা দেবার জন্য বলতে লাগলেন - সাক্ষ্য দেওয়া কিছুই না , কত অশিক্ষিত মেয়েছেলেরা পর্যন্ত কোটে গিয়ে জবানবন্দী দিয়ে আসে ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি তার চাইতেও অখস্তা ।
অশুবাবুকে লক্ষ্য করে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন — তােকে যদি ‘ তুই ’ ‘ টুই ' ব'লে ফেলি তাতে কোন দোষ হবে না তাে ?
আশুবাবু — না , তােমার যা ইচ্ছে ব'লো , আর আমার সঙ্গে কথা বলার দরকার হবে না বিশেষ । হাকিম , উকিল , মােক্তার এলেন । ঘরের ভিতরে ও বাইরে লোকে লোকারণ্য । শ্রীশ্রীঠাকুর মাঝের ঘরের চৌকিতে অতি বিনীতভাবে বসলেন । দেখে মনে হয় যেন বিনয় ও নিয়মানুবর্তিতার মূর্ত প্রতীক — সহজভাবে ব'সে , হাতদুটি সংলগ্ন করে হাকিমের দিকে চেয়ে যেন নির্দেশের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন । পেশকার শপথ নিতে বললেন । পেশকার প্রথমটা বলে যেতে লাগলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রদ্ধাগম্ভীরচিত্তে মন্ত্রোচ্চারণের মতাে কথাগুলির পুনরাবৃত্তি করলেন ।
ভােলা রায়ের পক্ষের উকিল পরেশবাবু ( চৌধুরী ) জেরা সুরু করলেন । প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলতে লাগল । শ্রীশ্রীঠাকুর এক - এক করে জবাব দিয়ে যেতে লাগলেন । উত্তরগুলি যথাযথ , সংযত ও পরিমিত ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের বলার রকম দেখে মনে হচ্ছিল তিনি পরেশবাবুকে আপনজন বিবেচনায় তাকে সত্য উদঘাটনে সাহায্য করতে উন্মুখ । প্রশ্নোত্তরের নমুনা দেওয়া হলো ।
উকিল - অনন্তনাথ রায়ের কি আশ্রমে কোন দোকান ছিল ? শ্রীশ্রীঠাকুর — সৎসঙ্গের একটা দোকান ছিল , অনন্ত দেখত , আমি প্রণামীর টাকাটুকি দিয়ে ও কিছু যােগাড় করে দোকান করে দিয়েছিলাম ।
উকিল — আপনার পেশা কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর ( যেন একটু বিব্রত হ'য়ে ) আমি তো বরাবর এইসব নিয়েই আছি ।
উকিল — এইসব কী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— Religious work ( ধর্মকাৰ্য ) ।
হাকিম — আপনি কি হিন্দু বা মুসলমান এইরকম কোন ধর্ম প্রচার করেন , না spirituality- র ( আধ্যাত্মিকতার ) culture ( অনুশীলন ) করেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ধর্ম বলতে আমি কী বুঝি , বলতে পারি ?
হাকিম — হ্যা ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — মানুষ যখন সবকিছু নিয়ে Ideal- এ ( আদর্শে ) ligared ( নিবদ্ধ ) হ'য়ে পারিপার্শ্বিক নিয়ে বাচা - বাড়ার পথে চলে , তখনই সে ধর্ম পালন করে ।
উকিল — আপনি কি সন্ন্যাসী ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — সন্ন্যাসী বলতে আমি বুঝি তাকে যিনি তার সমস্ত বৃত্তি ও শক্তি দিয়ে Ideal ( আদর্শ ) -কে fulfil ( পরিপূরণ করতে চেষ্টা করেন । উকিল - আপনি কি জমিদার বা জোদ্দার ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — আমি নিজেকে তা ভাবি না , আমি নিজেকে জমিদার বা জোদ্দার বলে মনে করি না ।
উকিল — আপনি কি ট্রাষ্টি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — ট্রাষ্টি কারে কয় আমি বুঝি না , আমি যা করি তা করি । তা যদি trusteeship cover করে ( অছিত্বের অন্তর্গত হয় ) তাহ'লে আমি trustee ( অছি ) । হয় তো নয় ।
উকিল একটা কাগজ দেখিয়ে —আপনি কি ট্রাষ্টি হিসাবে এই জিনিসটা sign ( সই ) করেননি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর— Sign ( সই ) করেছি কিনা মনে নেই , হয়তাে ক'রে থাকতে পারি , ওরা এসে বলেছে , করেছি , কী হিসাবে করেছি জানি না ।
উকিল — আপনি কি সৎসঙ্গের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — প্রেসিডেন্ট কিনা জানি না , প্রেসিডেন্ট বােধ হয় মা ছিলেন । তবে এই জানি , সৎসঙ্গ আমার থেকে evolve করেছে ( উদ্ভূত হয়েছে ) ।
হাকিম — অাপনি যে ১২,০০০ টাকা সেবার সৎসঙ্গকে দিলেন , কেন দিলেন ? কোন্ সৰ্তে দিলেন ? আপনি কি সেটা loan ( ধার ) দিয়েছিলেন ?
আপনি কি পাবার আশা রাখেননি , কোন দাবী - দাওয়া রাখেননি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর - না । ওরা এসে বলল যে ১২,০০০ টাকা দরকার , আমি সকলের কাছ থেকে চেয়ে - চিন্তে যােগাড় করে দিলাম , কোন প্রত্যাশা আমার ছিল না । আমার একমাত্র প্রলােভন ছিল সৎসঙ্গ বাঁচবে , তাছাড়া আমি আর কিছু চাইনি।
উকিল — আপনি কি বিয়ে করেছেন ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — হ্যাঁ ।
উকিল — আপনার স্ত্রী ক’টি ?
শ্রীশ্রীঠাকুর —৬|৭ টি । সবর্ণ বাদে অনুলােম অসবর্ণ মতেও আমি বিয়ে করেছি । আমার বিশ্বাস common Ideal ( এক আদর্শ ) ও অনুলৈাম বিয়ে এই দুটোই জাতকে integrated ক'রে রাখে । তাই example set করার ( দৃষ্টান্ত স্থাপনের) জন্য আমি এই বিয়েগুলি করেছি । আমি না করলে তো ‘ চারাবে না । আমি স্থলবিশেষে যেখানে প্রয়ােজন , বহুবিবাহকে সমর্থন করি , কিন্তু তা অনুলোমক্রমিক ।
হাকিম — অনুলােম কী ? — Inter - caste Marriage ( বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ ) ?
শ্রীশ্রীঠাকুর — তথাকথিত Inter - caste Marriage প্রতিলােমও হ'তে পারে , তা নয় , অনুলোম । অনুলােমে ছেলে হবে উচ্চবর্ণের , মেয়ে হবে নিম্নবর্ণের । উচ্চবর্ণের মেয়ের নিম্নবর্ণের ছেলের সঙ্গে কিন্তু বিয়ে হ'তে পারে না ।
পরেশবাবু বুঝেসুঝেও না বোঝার ভান করে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি ছড়ার ক্রর, কুটিল , বিকৃত ব্যাখ্যা করে , মুখে শাতনী হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে এক অবান্তর প্রশ্নবাণ ছুড়লেন — আপনার প্রচারিত ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গই তাে হলাে সুন্দরী স্ত্রী এবং শ্যালক লাভ করা । কারণ , আপনিই তাে বলেছেন -
" ‘ না ’ সুন্দরী বধু যা'র
‘ হয় না’ যার শালা ,
অলক্ষ্মী তার ঘরে গিয়ে
হয়েছে অচলা। ”
উকিলের এই প্রশ্ন শুনে সমবেত দর্শকবৃন্দ হো - হো করে হেসে উঠলাে । আমাদের ভিতরে একজন বলল — উনি বােধহয় ভুলে গেছেন যে ‘ না ’ ও ‘ হয় না ’ কথা দুটি উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে আছে । হাকিম মেজাজের সঙ্গে বললেন Unnecessary comments by onlookers amount to contempt of court ( দর্শকদের অপ্রয়ােজনীয় মন্তব্য কোর্টের মর্যাদাহানিকর ) । এদিকে শ্রীশ্রীঠাকুর নির্বিকার ও নিরুদ্বেগভাবে নীরবে বসে আছেন । একবার একটু পরেশবাবুর দিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি মেলে করুণার হাসি হাসলেন । রণজিৎবাবু তেজোদ্দৃপ্ত ভঙ্গিতে হাকিমকে বললেন — আমার মহাসভ্রান্ত সাক্ষীর এই বাণীর গভীর তাৎপৰ্য সুস্পষ্ট । তাকে এইসব অবান্তর প্রশ্ন করে বিব্রত করার অধিকার বিজ্ঞ কৌসুলির আছে কিনা সে বিষয়ে আমি মাননীয় , সদাশয় কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করি ।
হাকিম পরেশবাবুকে বললেন— You may ask other relevant questions ( আপনি অন্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে পারেন ) । এইভাবে আরাে কিছু সময় চললাে ।
তখন শ্রীশ্রীঠাকুরের শরীর অত্যন্ত অসুস্থ । খুব রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে , তবু কেমন ধৈর্যের সঙ্গে জেরার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন । কত অবান্তর প্রশ্ন হচ্ছে , অথচ চোখে - মুখে এতটুকু বিরক্তির ভাব নেই । শারীরিক কষ্ট সত্ত্বেও প্রসন্নবদনে করণীয় করে চলেছেন । শ্রীশ্রীঠাকুরের শরীরের অবস্থা দেখে হাকিম তাকে বিশ্রাম নিতে বলে কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেলেন । খানিক পরে আবার জেরা আরম্ভ হলাে ।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কষ্ট হচ্ছে দেখে হাকিম শ্রীশ্রীঠাকুরকে বললেন — শুয়ে পড়ুন। হাকিম বলা মাত্র শ্রীশ্রীঠাকুর পট করে শুয়ে পড়লেন । হাকিম বললেন পা বাড়িয়ে দেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তখন পা মেলে দিলেন । এই অবস্থাতেও প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন । শ্রীশ্রীঠাকুরের শরীর অসুস্থ দেখে পরেশবাবু মাঝে - মাঝে বলছিলেন তাহলে আজ থাক । শ্রীশ্রীঠাকুর অনুনয় - সহকারে বলতে লাগলেন - না । আমি যতক্ষণ পারি বলি , আপনি প্রশ্ন করে যান । এইভাবে বেলা ৩ টে থেকে রাত ৮।। টা পর্যন্ত ৫ ৷৷ ঘণ্টা রােগযন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থায় জবানবন্দী দিলেন । এর মধ্যে হাকিম মাঝে - মাঝে শ্রীশ্রীঠাকুরকে কোন - কোন অবান্তর প্রশ্নের জবাব দিতে নিষেধ করছিলেন । শ্রীশ্রীঠাকুর তখনকার মতাে চুপচাপ বসেছিলেন । সব শেষ হয়ে গেলে হাকিম বললেন — এখন কেমন বোধ করছেন ? ও কিছু না , Blood - pressure ( রক্তের চাপ ) মানে mental - pressure ( মানসিক চাপ ) , আমি নিজেও ভুক্তভােগী । That is no disease at all ( ও কোন রােগই নয় ) ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — তবু ভাল লাগে না । হাঁ , আপনি নাকি যুদ্ধে গিয়েছিলেন ?
হাকিম — হ্যা ।
একটু পরে হাকিম বললেন— I have had two strokes ( আমরা দুইবার স্ট্রোক হয়েছিল ) , ওতে ভয় পাবার কিছু নেই ।
শ্রীশ্রীঠাকুর — আপনার nerve ( স্নাযু় ; ) কত strong ( শক্ত ) , আপনি কামান ছোঁড়েন , আর আমরা কামানের একটা শব্দ শুনলেই ফিট হয়ে পড়ি । হাকিম ক্যাপ্টেন , আর , এল , মুখার্জ্জী অত্যন্ত প্রীত হলেন ।
10